সার্কাস-১, ২ যখন লিখেছিলাম
তখন যাবার সময় ট্রেনে স্লীপিং ব্যাগে ঘুমোনো হলনা বলে অনেক কাঁদুনি গেয়েছিলাম।
আপনারা ভেবেছিলেন হয়ত, “কি আশ্চর্য! স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে এত আদেখলাপনা কেন রে বাবা?” তখনই আপনাদের বলেছিলাম যে এই আদেখলাপনার
যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা দুজনেই এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়তে ভালবাসি ঠিকই কিন্তু দুজনের
কেউই বড়সড় অ্যাডভেঞ্চার করতে যাইনি কখনও যেখানে স্লীপিং ব্যাগ বিষয়টি অত্যন্ত
প্রয়োজনীয় বস্তু বলে মনে হতে পারে। তবুও আমরা যে কেন হুড়মুড়িয়ে গুচ্ছের টাকা খরচ
করে স্লীপিং ব্যাগ কিনেছিলাম তার একটা দুর্দান্ত ইতিহাস আছে। আজকে আপনাদের সেই
মারাত্মক অভিজ্ঞতার কথাই বলব বলে ঠিক করেছি।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা তিনজন যোধপুর যাব বলে ঠিক করলাম। তিনজন মানে আমরা দুজন আর আমাদের এক বন্ধু কাম বোন। ঘটনাচক্রে সে আর আমি সমনামধারিণী। এক্ষেত্রেও যাওয়া-আসার টিকিট এবং হোটেল বুকিং কনফার্ম ছিল। সুতরাং আমাদের পূর্ববর্তী ভ্রমণের ইতিহাস অনুসারে কিছু একটা গন্ডগোল হবারই ছিল। কিন্তু ইতিহাসের কালজয়ী ঘটনাবলী কি সেই ঘটনার কুশীলবদের আগে থেকে জানান দিয়ে আসে? স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ক্ষেত্রেও আসেনি। আমরা তিনমূর্তি পিঠে একটা করে ছোট ব্যাগ নিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে রাতে পুরনো দিল্লী ষ্টেশন থেকে যোধপুরগামী ট্রেন এ চেপে বসলাম। যদিও সেটা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ছিল আর দিল্লিতে পর্যাপ্ত ঠান্ডা পড়েছিল এইবছর। তাও আমরা ভেবেছিলাম কয়েকঘন্টার তো জার্নি, সকালে চোখ খুললেই যোধপুর। আর আমরা তিনজনেই কেউই খুব একটা আতুপুতু যাত্রী নই, সুতরাং পকেটের স্বাস্থ্যরক্ষার্থে এই কয়েকঘন্টার জার্নির জন্য স্লীপার ক্লাসই ঠিক আছে।
প্রত্যেক জায়গারই নিজস্ব বিশেষত্ব আছে। সেই বিশেষত্বের সাথে যদি মানিয়ে নেওয়া না যায় তবে ওই জায়গায় বেঁচে থাকাটা যে কি ধরনের মুশকিল ঘটনা হতে পারে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য আমাদের সেদিনের সেই জার্নিটাই যথেষ্ট ছিল। ট্রেনে উঠে তিনজনে তিনটে পুঁচকে ব্যাগ নিয়ে বসে আছি। আর বাকি যাত্রীরা দেখছি বড় বড় ব্যাগ নিয়ে উঠছেন। কোথায় কোন ব্যাগ রাখবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যত বড় পরিবার তত বেশি সংখ্যক ব্যাগ। হুলুস্থুল ব্যাপার। ট্রেন চালু হতে স্বাভাবিক নিয়মেই মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে এলো। আর আমরা তিনজনে এই পুরো অরাজকতার সময়টা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে গেলাম। ভাবখানা এই যে, লোকে এত যে কি নিয়ে বেরোয়? অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে নিলেই তো হলো। তাহলে আর এই জগঝম্প জার্নি করতে হয়না। এত ব্যাগ! আমাদের মতন মিনিম্যালিস্ট হতে আর পারল না এরা। এই সব উত্কৃষ্ট ভাবনাচিন্তা করে মনে মনে বেশ পুলকিতও হয়ে উঠলাম। আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর হয়ে তারপর যথাবিহিত নিয়মে খাওয়াদাওয়াও সারা হলো। এবার শোবার পালা। আমার আর দুই নম্বর অর্পিতার (বার বার দুই নম্বর অর্পিতা বলার চেয়ে ওর একটা অন্য নাম দেওয়া যাক। ধরা যাক ওর নাম টুকাই। এরপর থেকে ওকে টুকাই বলে ডাকবো।) শোবার জায়গা দুটো পাশাপাশি আপার বার্থে। আর পিনাকীর সাইড আপার। আমরা যথেষ্ট গরম জামা পরে আছি তাই শোবার জন্য একটা করে গায়ে দেবার চাদর পিঠের ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আমার আর পিনাকীর দুটি শাল। আর টুকাই-এর জন্য মোটামুটি পুরু একটি চাদর। আমরা ওপরে উঠে শুয়ে পড়লাম। চাদর গায়ে দিয়ে। বাকি জনগণ দেখি প্রত্যেকেই একটি করে মোটাসোটা কম্বল বের করে ফেলেছেন তাঁদের বয়ে আনা ব্যাগের পাহাড় থেকে। এদিক ওদিক নজরদারি করে দেখলাম এর কোনো ব্যতিক্রম নেই আমরা ছাড়া। না একটু ভুল বললাম পুরো কামরায় আরো একটি ব্যতিক্রম ছিল আমরা ছাড়া। তাঁর কাছে একটি স্লিপিং ব্যাগ ছিল। তিনি তাতে ঢুকে আরাম করে শুয়ে পড়লেন। আমরা একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কি রে বাবা! প্রত্যেকেই তো দেখি কম্বল বের করে। যত বড় পরিবারই হোক না কেন সকলের জন্য একটি করে কম্বল। এতক্ষণে বুঝলাম কেন ট্রেনে উঠে সকলেই দুচারটে করে ব্যাগ সিটের তলায় না ঢুকিয়ে সিটের ওপরে রাখছিলেন। আর তাই দেখে আমরা তাঁদের নাস্তানাবুদ অবস্থা হচ্ছে ভেবে নিজেরা চাপা স্বরে ঠাট্টা ইয়ার্কি করছিলাম। এখন দেখি সেই সিটের ওপরের প্রত্যেকটি ঢাউস ব্যাগ থেকে একটি করে ঢাউস কম্বল বেরিয়েছে। আর সকলেরই ব্যাগের সংখ্যা এক কি দুই এ দাঁড়িয়েছে। আমাদেরই মত। তখন মনে আশা ছিল আমাদের যে, কম্বল কেন লাগবে রে বাবা শুতে?এইতো এখনো ট্রেন ছুটছে, এখন কি আমাদের ঠান্ডা লাগছে নাকি? আমাদের গায়ে মোটা-পাতলা মিলিয়ে দুটি উলিকটনের গেঞ্জি, তার ওপরে জামা, তার ওপরে সোয়েটার-মোটা উলের মায়ের হাতে বোনা, তার ওপরে মোটা হাওয়া নিরোধক জ্যাকেট। এরপরে আর কোথা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকবে? শুধু শুধু কম্বল বয়ে বেড়াবার কোনো মানেই হয় না। আমরাই ঠিক কাজ করেছি। এই ভেবে আবার একপ্রস্থ আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমোলামও।
তারপরে?
তারপরে একটু একটু করে ঘুম কেটে যেতে লাগলো। কারণ আমার গায়ে মোটা-পাতলা মিলিয়ে দুটি উলিকটনের গেঞ্জি, তার ওপরে জামা, তার ওপরে সোয়েটার-মোটা উলের মায়ের হাতে বোনা, তার ওপরে মোটা হাওয়া নিরোধক জ্যাকেট।
কিন্তু পায়ে?
পায়ের কথা আর কেই বা মনে রাখে শীতে? তুশ্চু প্রত্যঙ্গ। পায়ে আমার পাতলা ইনার এর ওপরে জিন্স। দুটোর কোনটিই হাওয়া নিরোধক নয়। আর এই মধ্যরাতে হুহু শব্দে ছুটে যাওয়া ট্রেনে শেষ ডিসেম্বরে পশ্চিমভারতের ঠান্ডা হাওয়া মোটা কম্বলের তলায় সুরক্ষিত স্লীপার ক্লাসের বাকি জনগনকে কামড় বসাতে না পেরে আমার এই নিরীহ অরক্ষিত পা জোড়াকেই খুঁজে পেয়ে মরণ কামড় বসিয়েছে। তারপর আমার সাথে সেই ঠান্ডা হওয়ার আক্ষরিক অর্থেই সারারাত্রিব্যাপী হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হলো।
হাত পা গুলো
ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। আমি ব্যাগ থেকে উলের টুপি আর উলের গ্লাভস
বের করে পরলাম।
তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। আমি ব্যাগ থেকে মাফলার বের করে টুপির ওপর দিয়ে মাথায় জড়ালাম।
তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি ব্যাগ থেকে আরো একটা মোজা বের করে পায়ে থাকা মোজার ওপর দিয়ে পরলাম।
তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি ব্যাগ হাঁটকে আর কোনো কিছু পরার মতন পেলাম না। তখন আমি গায়ের শালটাকে গা থেকে খুলে দু ভাঁজ করে পায়ের ওপর দিলাম।
তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি কি করব ঠিক করতে না পেরে পিঠের ব্যাগ টাকেই দুই পায়ের ওপর চাপালাম। মোটেই কিছু সুবিধে হলো না। পা দুটো বাবু হয়ে বসার মতন করে মুড়ে শুলাম।
তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। পিঠ দিয়ে ঠান্ডা উঠছে। শেষমেষ উঠে বসলাম। বেশ করে শালটাকে জড়িয়ে, নিজেকে যতটা সম্ভব ছোট্ট করে মুড়ে নিয়ে ব্যাগটাকে কোলে করে টুপির ওপর দিয়ে মাথা মুখ ভালো করে মাফলারে মুড়ে পুঁটলির মতন বসে দেখি- সামনের দুটো বার্থে আরো দুটো ছায়ামূর্তি উঠে গোল্লা পাকিয়ে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। আমাদেরই বাকি দুই মূর্তি। পা দুটো মনে হচ্ছে নেই আমার। প্রচন্ড ঠান্ডায় স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দেয় পড়েছিলাম। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষাটা সেদিন দিলাম। গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে পায়ে জড়াবো কিনা ভাবলাম একবার। কিন্তু না। ঠান্ডার চোটে পা অবশ হয়ে গেলেও কাল আমায় লোকজন ট্রেন থেকে চ্যাংদোলা করে নামাতে পারবে। কিন্তু গা থেকে জ্যাকেট খুলে পায়ে দিলে, এ যা ঠান্ডা, তাতে গায়ের সোয়েটার ভেদ করে পাঁজরে গিয়ে ঘা মারলে যদি বুকের হৃৎপিন্ডটাই কোনো মতে জবাব দিয়ে দেয় ঠান্ডার চোটে, তাতে চলন্ত ট্রেনে এই মাঝরাতে আমায় নিয়ে বাকিদের বড়ই অসুবিধায় পড়তে হবে। যদিও জানিনা বাকি দুই জন তখনও বেঁচে আছে কিনা। নাকি ঠান্ডায় জমে গিয়ে জীবাশ্মে পরিনত হয়ে গেছে বাঙ্কে বসে বসেই।
কিছুক্ষণ পরে দেখি পিনাকী নেমেছে নিচে। পায়চারী করতে শুরু করেছে ট্রেনের শরু প্যাসেজের মধ্যেই। যদিও ওকে তখন পিনাকী বলে চেনা যাচ্ছিল না। আমি জানি তাই বললাম। চশমায় ঢাকা চোখদুটি ছাড়া বাকি সব পরতের পর পরতে ঢাকা। একই দশা। পায়ে কেবল পাতলা একটি পরতের ওপর জিন্স। টুকাইয়ের তাও নেই। শুধুই জিন্স। টুকাইকে ডাকতে দেখি সামনের বাঙ্কের পুঁটলিটা একটু নড়ে উঠলো আর ক্ষীণ একটা "উঁ" ভেসে এলো। বুঝলাম এখনো জীবাশ্ম হয়ে যায় নি। পিনাকী পায়চারী করেই চলেছে। একবার বললাম "লোকজন বিরক্ত হতে পারে এত বার যাতায়াত করছিস, ঘুমোচ্ছে সবাই।" উত্তর এলো, "হুম"। তারপর দেখি সোজা হয়ে গ্লাভস পরা হাত পকেটে ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। একই রে বাবা? বাকি রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবে নাকি? এখনো তিন চার ঘন্টা জার্নি বাকি? বললাম, দাঁড়িয়ে আর কি করবি? ওপরে উঠে বস। উত্তর এলো, "হুম "। আমি আর ঘাঁটালাম না ভদ্রলোককে। কারণ এই স্লীপারে যাবার বদবুদ্ধিটা প্রধানত আমার। আর তার ফলেই এই দশা। এখন বেশি ঘাঁটালে যদি চড়-থাপ্পড় মেরে বসে? দরকার নেই বাবা। অবশ্য তাতেও বিশেষ অসুবিধা হত না। বরং সুবিধাই হত। দুচারটে কিলচড় খেলে খানিক গা গরম তো অন্তত হত।
আশে পাশে তাকিয়ে দেখি আমরা তিনজন গর্বিত মিনিম্যালিস্ট ছাড়া কম্বলধারী প্রত্যেক বোকারাই আরাম করে কম্বলের মধ্যে নাক ডাকাচ্ছেন। এঁনারা স্লীপারের নিয়মিত যাত্রী। তাই এই শীতে যে কম্বল ছাড়া চলবে না তা এঁনারা জানেন। শুধু আমাদেরই স্লীপার ক্লাসে নিয়মিত যাতায়াত করা হয়না বলে এই যাত্রার আবশ্যকীয় উপাদানগুলি সম্পর্কে আমরা মোটেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। উল্টে যাঁরা এই যাত্রার নিয়মগুলি মেনে চলছিলেন তাঁদের নিয়ে হ্যাহ্যা করছিলাম। ভগবান তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হ্যা হ্যা করছিলেন আমরা শুনতে পাইনি। তারপর যত রাত বাড়তে লাগলো নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ভগবানের হাসি তত আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। আমার তো সত্যি বলছি এরকমও মনে হলো একবার যে, এই যে প্রত্যেকে একটা করে গোটা কম্বল মুড়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছে। আর আমরা তিন তিনজন নিরীহ প্রাণী ঠান্ডায় প্রায় পঁচাত্তর ভাগ মরে গেছি। আর আমি নিশ্চিত বাকি পঁচিশ ভাগও কাল যোধপুর স্টেশনে পৌঁছবার আগেই মরে যাব। এ হেন দুর্ভাগাদের কি অন্তত একটা কম্বলও কেউ ধার দিতে পারে না? তাতেই তিনজনে পা ঢুকিয়ে বসে বাকি রাতে বাকি পঁচিশ ভাগটাকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা অন্তত করতে পারব। শীতে দুঃস্থদের উষ্ণতা দেওয়া তো কত পূণ্যের কাজ। কিন্তু সে রাতে কোনো পূন্যাত্মাই পূণ্য সঞ্চয়ের লোভে জেগে বসে ছিলেন না। সুতরাং আমরা বাকি রাত জেগে বসে করুণ চোখে চারপাশের রং-বেরঙের নরম কম্বলের শোভা দেখতে দেখতে কাঁপতে লাগলাম। আর পিনাকী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো।
সব মহাপ্রলয়েরই তো শেষ আছে। সেরকমই সেই রাত কেটেও ভোর হলো। ট্রেন যোধপুর স্টেশনে এসে পৌঁছালো। আসার আগে এই যোধপুর স্টেশন নিয়ে কত নস্টালজিয়া আমাদের। সোনার কেল্লায় ফেলুদারা এখানেই এসে নেমেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। স্টেশনটা, চারপাশটা, শহরটা এখন কেমন দেখতে সেই নিয়ে কত জল্পনা আমাদের। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমায় যদি এখন জিজ্ঞাসা করা হয় যোধপুরে নেমে তুমি কি দেখলে? কেমন স্টেশন? আমি কি বলব জানেন? বলব, "যে প্লাটফর্মে নেমেছিলাম সেখানে কোনো রোদ ছিল না। ওভারব্রিজে উঠে প্রথম পায়ে রোদ লেগেছিল। আর স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে পুরো গায়ে রোদ লেগেছিল। আর সেই রোদ মেখে আমরা স্টেশনের কাছেই হোটেল পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছেছিলাম। আমাদের আনতে হোটেল থেকে কেউ গিয়েছিলেন। আমাদের মস্তিস্ক বোধহয় তখনও পুরোপুরি কাজ করতে শুরু করে নি তাই আমরা তিনজনেই তাঁকে নামের প্যাকার্ড থাকা সত্বেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওভার ব্রিজে উঠে গেছিলাম। বোধহয় ট্রেন থেকে নেমে তিনজনেরই চোখ ছিল ওভারব্রীজের ওই রোদের ফালিটুকুর দিকে তাই আর ওই নশ্বর প্যাকার্ডধারীর দিকে আর কারো নজর পড়ে নি।
এই হলো আমাদের যোধপুর যাবার ইতিকথা। হোটেলে পৌঁছালাম আমরা শনিবার সকালে। রবিবার রাতে আমাদের ফেরার ট্রেন। এর মধ্যেই আমাদের যোধপুরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য শেষ করে একফাঁকে ওঁশিয়া ঢুঁ মেরে আসতে হবে। হোটেলের ছাদে চড়চড়ে রোদে বেশ করে হাত পা সেঁকে একটু সুস্থ হতেই মাথা কাজ করতে শুরু করলো। আর আমরা বেড়ানো-চড়ানো শিকেয় তুলে দৌড়ালাম পরদিনের তত্কালের টিকিট বুকিং করতে। আমাদের ফেরবার টিকিট কিন্তু কনফার্ম ছিল। কিন্তু সেও তো সেই স্লীপার ক্লাসে থুড়ি ফ্রীজার ক্লাসে। হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই রেলওয়ে বুকিং কাউন্টার। পিনাকী সেখানে, আর আমরা হোটেল মালিককে তাঁর চেয়ার থেকে উত্খাত করে তাঁর কম্পিউটারে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমরা তত্কালে এসির টিকিট পেলাম না। মানে পেলাম কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত কনফার্ম হলো না। ফলে ফেরার সময় আবার সেই ফ্রীজার ক্লাস।
এবারে মানসিক ভাবে অনেকটা প্রস্তুত ছিলাম বিপর্যয়ের জন্য। তারপর সদ্য বেড়ানোর তাজা মনোভাব আর উত্তেজনাও ছিল। ফলে যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার অর্থাৎ মনোবল, সেটি যাবার সময়ের তুলনায় খানিক বেশিই ছিল আমাদের। ফেরার সময় ট্রেন অনেক ফাঁকা। তবুও যাঁরা আছেন প্রত্যেকেই কম্বল নিয়ে উঠেছেন। দেখে শুনে এবারে আমাদের স্বভাবতই আর হাসি এলো না। ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু। খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের পাশেই একটি কমবয়সী ছেলে উঠলো সাথে একটি মাত্র মাঝারি মাপের ব্যাগ। নিজেদের একার দূর্দশায় যতটা কষ্ট হয়, সাথে আরো কেউ দূর্দশায় পড়লে কষ্টটা ভাগ করে নেবার আরো কেউ থাকে বলে মানুষ কষ্ট খানিক কম পায়। মনে আশা জাগলো। এ বেচারাও আমাদেরই মতন অভাগা। একটাই ব্যাগ নিয়ে উঠেছে। এই ব্যাগে যদি কম্বল নেয় তবে আর অন্য জিনিস কোথায় নেবে? তার মানে নিশ্চয়ই কম্বল নেই এর সাথে। কিন্তু সেযাত্রা আরো ঐশ্বরিক ঠাট্টা বরাদ্দ ছিল আমাদের কপালে। সবে মাত্র ফিসফিস করে টুকাইয়ের কানে কানে কথাটা বলেছি। সাথে সাথে, বিশ্বাস করুন সাথে সাথেই, আমার কথা শুনতে পেয়েছিল কিনা কে জানে, দেখি ছেলেটি তার ওই সবেধন নীলমনি ব্যাগখানি থেকে টেনে টুনে একটা মোটা কম্বল বের করে ব্যাগটাকে ভাঁজ করে মাথার বালিশ করে শুয়ে পড়ল। শোবার সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল কিনা সেটা খেয়াল করিনি। ব্যাগটায় কম্বল বাদ দিয়ে আর কিচ্ছু ছিল না। এই ঘটনায় আমি অন্তত একটা জিনিস শিখলাম, যে, শীতকালে স্লীপারে যেতে হলে যদি একটিই ব্যাগ নিতে হয় তবে কম্বলের ব্যাগটিই নাও অন্য সব মহার্ঘ্য বস্তু ছেড়ে।
তারপর আমরা চেষ্টা করলাম যদি বাড়তি টাকা দিয়ে এসি থেকে তিনটে কম্বল যোগাড় করা যায়। কারণ আমার মাথায় ছিল যে দিল্লি-হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসে স্লীপার ক্লাসে টিকিট কাটার সময়ই বেডরোলের অপশন দেওয়া হয়। কিছু টাকা বেশি লাগে টিকিটের সাথে। এই সুবিধা আমরাও নিয়েছি একবার। সুতরাং এখানেও কি বাড়তি টাকা দিলে তিনটে কম্বল পাওয়া যাবে না? এই বিশ্বাসে অন্তত পাঁচ ছয় বার স্লীপার থেকে এসিতে যাতায়াত করে, দুই টিকিট পরীক্ষক এবং এসির কোচ এটেন্ডেন্টের সাথে কথা বলে বুঝলাম যে, এই ট্রেনে আইনগত ভাবে সেই সুবিধা পাবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এসির কোচ এটেন্ডেন্ট আর একজন টিকিট পরীক্ষকের বদান্যতায় বেআইনি পথে অন্য টিকিট পরীক্ষকের চোখ বাঁচিয়ে আমরা তিনটি কম্বল ব্যবহার করতে পারি আজকে রাতের জন্য।প্রতিটি কম্বল পাঁচশ টাকা। যা সম্ভবত ভাগাভাগি হবে এসির কোচ এটেন্ডেন্ট এবং ওই টিকিট পরীক্ষকের মধ্যে। ভারতীয় রেলের লাভ লবডঙ্কা। ওই মহাপুরুষ টিকিট পরীক্ষকের নাম তার বুকের নেমপ্লেটে লেখা ছিল। ভুলে গেছি এখন। মনে রাখা উচিত ছিল। কারণ তাঁর প্যাঁচালো কথাতেই আর একটু হলে এই বেআইনি কাজটি আমরা করে ফেলতে যাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা যে বেআইনি তা অন্য টিকিট পরীক্ষকের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত তো আমরা বুঝতেই পারিনি। তারপরে ব্যাপারটা বুঝে ফিরে যখন আসলাম ততক্ষণে এসির প্রায় সমস্ত যাত্রী জেনে গেছেন যে আমরা স্লিপারের যাত্রী। আর তিনটি কম্বলের জন্য ট্রেনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
তারপর আর কি? ব্যাগের সমস্ত জামাকাপড় পরে, এমনকি জিন্সের ওপর দিয়ে রাতে পরে শোবার জন্য যে পায়জামাটা নিয়ে গেছিলাম সেটা পর্যন্ত পরে বাঙ্কে উঠে শুলাম। আর একটু পর থেকেই আগের রাতের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি শুরু হলো। শুয়ে-দাঁড়িয়ে-বসে-কুন্ডলী পাকিয়ে কোনোক্রমে রাত কাটিয়ে যখন গুরগাঁও স্টেশনে এসে নামালাম তখন অন্ধকার। তারপর দুটো অটো বদলে এসে নামলাম আমাদের আস্তানা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে আমাদের ইনস্টিটিউটের গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যাবে। প্রচন্ড কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি ছুটছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি জাতীয় সড়কের ধারে আমাদের গাড়ির অপেক্ষায়। তখনিই আবার এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা নিয়ে আধখানা ব্লগপোস্ট আমি অলরেডি লিখে ফেলেছি। সেদিন ছিল এই মরশুমের শীতলতম দিন। দিল্লির তাপমাত্রা সেদিন ছিল ২.৬ ডিগ্রী। রাজস্থানের বুকে চলন্ত ট্রেনে সে তাপমাত্রা কত ছিল আমি জানি না। তবে সেযাত্রা দুটো পা নিয়ে আস্ত ফিরে এসে সেই দিনেই আমি দুটো স্লিপিং ব্যাগ অর্ডার করেছিলাম পরবর্তী এরকম কোনো স্লীপার ক্লাসে যাত্রার কথা মাথায় রেখে।
এখনো কি বলবেন যে জানুয়ারির শিমলা-ফাগু-কুফরী যাবার সময় (সার্কাস-১ এবং সার্কাস-২ তে লেখা) কালকা মেলের স্লীপার ক্লাসে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমোতে না পারার দুঃখটা সত্যিকারের দুঃখ নয়? আদেখলাপনা? যদিও সে দুঃখ আমার কালকা থেকে দিল্লি ফেরার সময় স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে মুছে গেছিল।
হ্যাঁ, কালকা থেকে ফেরার সময় আমার মনে আছে, শোবার জন্য তর সইছিল না। শুয়ে যে কি আরাম পেয়েছিলাম সে আর কি বলব। বড্ড তাড়াতাড়ি দিল্লী পৌঁছে গেছিলাম বলে মনে হয়েছিল।
ReplyDelete