Sunday, 29 March 2015

পরিচয়

কিছুদিন আগে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন অন্য একটি বিশেষ কারণে আমাদের চার পাঁচ জন ছাত্রছাত্রীর দলের সাথে সেই সম্মেলনে আমাদের ল্যাবের অন্যতম অপরিহার্য বন্ধু রাজেশও আমাদের সাথে ছিল। রাজেশের এই বৈজ্ঞানিক আলোচনা শোনার কোনো উত্সাহ ছিল না। তার কারণ হয়ত ওর এই আলোচনার বিষয় সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত থাকার কথা নয়। সেই পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ জীবন তাকে দেয়নি। তার অনেক আগেই মিষ্টি স্বভাবের এই রাজস্থানী ছেলেটি আমাদের ল্যাবে আমাদের বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলায় সকলকে সাহায্য করার জন্য ঘর ছেড়েছে। সেদিনের সেই সম্মেলন মোটামুটি ভাবে ঘরোয়া সম্মেলনই বলা যায়। তাই সম্মেলনের বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুরু হবার আগে সম্মেলনের সভানেত্রী ছোট্ট সভাঘরে উপস্থিত সকলকে নিজের নিজের পরিচয় এবং তিনি কোথায় কি কাজ করেন সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আভাস দেবার প্রস্তাব রাখলেন। এবং সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব গৃহীতও হলো। যেহেতু সভাটি ছোট্ট তাই সেখানে উপস্থিত প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক যাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই চেনে এবং তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল, তাঁরাও প্রথামাফিক নিজের নিজের পরিচয় দিলেন। ছাত্রছাত্রীরাও একে একে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করলাম। অবশ্যই তা ইংরাজিতে। সমস্যাটা হলো তখন যখন পালাক্রমে পরিচয় দানের বিষয়টি আমাদের সারিতে এসে পড়ল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। রাজেশ প্রথাগতভাবে এই সম্মেলনে একেবারেই বেমানান। কোথাওই কোনো সম্মেলনে রাজেশের মতন লোকেদের কোনো জায়গা হয়না। হয়ত তাঁরাও সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো উত্সাহ পান না। পালাক্রমে রাজেশের পরিচয়দানের পালা যখন এলো তখন দেখলাম রাজেশকে টপকে আমাদেরই অন্য এক সহকর্মী নিজের পরিচয় দিচ্ছে। এবং অবশ্যই সেটা রাজেশের সম্মতিক্রমে। প্রথমত রাজেশ ইংরাজি ভাষায় নিজের পরিচয় দিতে অপারগ। আর দ্বিতীয়ত পদাধিকারগত ভাবে আমাদের মতন বিজ্ঞান গবেষক নয়, সহকারীমাত্র। সুতরাং সে নিজেই সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে উঠতে চায়নি। আর তাতে পাশের বাকি বন্ধুরাও সায় দিয়েছে তাকে বিড়াম্বনা থেকে বাঁচাতে। বাকিরা নিজেদের মতন পরিচয় দিলেন। সভার কাজও যথাবিহিত সুষ্ঠ ভাবেই শেষ হলো। রাজেশ পুরো সময়টা নিজের মতন সিটে বসে ঝিমিয়ে নিলো। পরে সভা শেষে বাইরে বেরিয়ে চা-কফি পানের ফাঁকে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে সে ঠিক কি ধরনের কাজ করে তা তার বাড়ি লোকজন জানে কিনা? বা তার কাজ সম্পর্কে তার আশেপাশের লোকজন জানতে বা বুঝতে উত্সাহী কিনা? বা এত বছর এই ল্যাবে কাজ করে প্রতিনিয়ত সকলকে সব কাজে সাহায্য করে চলা এই মানুষটি নিজে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উত্সাহী কিনা? প্রত্যাশা মতই উত্তর এলো। সে যে একটি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কাজ করে সেটি বাদ দিয়ে তার বাড়ির লোক বা আশেপাশের লোকজন বিশেষ কিছুই জানেন না। বা তার কাছেও কাজটি একটি জীবিকামাত্র। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। 

রাজেশ আমাদের কাজে অত্যন্ত অপরিহার্য অঙ্গ। আমরা যেকোনো একজন ল্যাবে অনুপস্থিত থাকলে ল্যাবের কাজেকর্মে বিশেষ কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। কিন্তু রাজেশ সপ্তাহখানেকের জন্য রাজস্থানে তার বাড়িতে চলে গেলে ল্যাবশুদ্ধু সকলের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়। কিছুটা যদিও এই কারণে যে আমরা সকলেই এখানে এসেছি এই জায়গাটিকে নিংড়ে নিয়ে সিঁড়ির পরবর্তী ধাপটিতে পা রাখতে। আর সে এসেছে এই জায়গাটিকেই নিজের ভেবে যত্ন করে জড়িয়ে ধরতে। এর সাথে তার রুটিরুজির ব্যাপারটিও ওতপ্রত ভাবে জড়িত বলেই হোক বা না জানা অন্য কোনো কারণেই হোক, হয়ত আমাদের সকলের চেয়ে একটু বেশিই আদর যত্নে রাখে সে তার কাজের জায়গাটাকে। অথচ আমরা কোনো দিনই তাকে তার কাজের আসল বিষয়টিকে বুঝে উঠতে সাহায্য তো করিইনি উপরন্তু কোনো আলোচনায় তার উপস্থিতিও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর ভেতরের কার্যকলাপের সাথে ঠিক তার বাইরের মানুষদের যে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ থাকে না, সে তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু কোনো সভায় রাজেশের মতন রিসার্চের জন্য অপরিহার্য কেউ উপস্থিত থাকলেও, তিনি ইংরাজি না বলতে পারলে হিন্দিতে নিজের পরিচয় দিতেও কুন্ঠা বোধ করেন। তিনি খাতায়কলমে গবেষক নন, কিন্তু তাকে ছাড়া যে আমাদের মতন তথাকথিত গবেষকরা ঠুঁটো তা তিনি নিজেও যেমন জানেন আমরাও জানি। তিনি নিজে যতটা কুন্ঠা বোধ করেন তার থেকেও হয়ত আমাদের লজ্জিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এইসব ক্ষেত্রে। আমিও তো সেদিন সেই সভায় তার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গর্বিত হয়ে রাজেশকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। সে যদি লজ্জায় হোক বা অন্য কোনো কারণে নিজের পরিচয় দিয়ে উঠতে না পেরে থাকে তবে আমিও তো উঠে দাঁড়িয়ে বলতে পারতাম- 'এই হলো রাজেশ, একে ছাড়া আমাদের ল্যাব অচল। আমাদের ল্যাবের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, সবচেয়ে একাগ্র, আমাদের সহকর্মী।' তাকে একটু একটু করে তার মতন করে বিষয়টির মধ্যে ঢুকিয়ে নেবার চেষ্টা তো কোনোদিন করিনি। যদি করতাম কে বলতে পারে কয়েক বছর পরে রাজেশকেও হয়ত আর কোনো সেমিনার হল-এ ঢুকে ঝিমোতে নাও দেখতে পারতো কেউ। 

     

0 comments:

Post a Comment