কিছুদিন আগে
পুরোনো রেকর্ডেড একটি ইন্টারভিউ দেখছিলাম। প্রশ্নকর্তার
প্রশ্ন ছিল প্রাদেশিকতাকে ছাপিয়ে কোনো একজন ভারতে জন্মগ্রহণকারী মানুষ হিসেবে আমরা
নিজেদের কতটা পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় হিসেবে মনে করি? একজন সমাজসচেতন
লেখিকা হিসেবে তাঁর মতামত কি? এই প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষাৎকারদাত্রী শোভা দে একটি
কথা বলছিলেন যেটা আমার বর্তমান সময়ে বড়ই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। বিষয়টি হলো, তাঁর
মতে, ব্রিটিশ যুগের আগে ভারতবর্ষে অর্থাৎ মানচিত্র অনুসারে যে
ভূখন্ডকে আমরা ভারতবর্ষ বলে চিহ্নিত করি সেটির কোনো সামগ্রিক অস্তিত্বই ছিল না।
ব্রিটিশ বানিজ্য তরী এসে ঠেকেছিল এমন ভারতের উপকূলে যার উত্তর দিকে বেশ কিছুটা অংশ
বাদ দিলে বাকি পুরোটাই ছোটো ছোটো খন্ডিত মেজো সেজো
রাজপরিবারের দখলে। তাদের মধ্যেও আবার পারস্পরিক বিবাদ, পারিবারিক ক্ষমতাদখলের
যুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর উত্তরপশ্চিম দিক থেকে মাঝে মাঝেই অস্তগামী মোঘলদের
লুটপাট, অরাজকতা আর সেনাবিদ্রোহের ঘটনা। সুতরাং সে সময় সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বলতে
ব্যাপারটা ঠিক কি সেটি একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ধারণাতেই ছিল না।
সবচেয়ে বড় কথা আস্ত ত্রিভূজাকৃতি ভারতবর্ষটাই ছিল না সেসময়। সুতরাং প্রাদেশিকটাই
তখন জাতীয়তা। তারপর আত্মকলহরত এতবড় সোনার খনি ভূখন্ডটিকে নেতৃত্ব এবং
সুরক্ষা দেবার মতন কোনো সুযোগ্য লোকের অভাবে কি করে ব্রিটিশ বণিককুল নিজের খাস
উপনিবেশ বানিয়ে ফেলল সে তো সবাই জানে। ইংরেজরা এদেশের জন্য ভালো
মন্দ মিশিয়ে অনেক কাজ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো ভারতবাসীর মধ্যে পরিপূর্ণ ভারতের
একটি ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে যাওয়া। তার আগে অযোধ্যা রাজ্য ছিল, বারানসীর রাজা ছিলেন,
হায়দ্রাবাদের নিজাম ছিলেন, মহিশূর রাজ্য ছিল। কিন্তু জয়পুরের রাজপরিবারকে খাজনা
প্রদানকারী কোনো কৃষক নিজেকে বাংলার কোনো কৃষকের সাথে তুলনায় আনতে পারতেন কি? তাঁর কাছে
জয়পুরের রাজ্য সীমানাই তাঁর দেশ। কিন্তু ব্রিটিশ এই দেশ ছেড়ে যাবার
পর দেখা গেল প্রায় প্রতিটি ভারতবাসীর মনে নিজের দেশ সম্পর্কে
ধারনাটা আমূল বদলে গেছে। এত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে দেশী-বিদেশী সংবাদপত্র,
রেডিওস্টেশন এবং সর্বোপরি দীর্ঘ স্বাধীনতা
আন্দোলন ভারতবাসীকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে- এই যে দেখছ সবুজ কাশ্মীর উপত্যকা এ তোমার, ওই
যে দূরে গুজরাটের নোনাভূমি ওটাও তোমারই, ওই যে দেখছ দক্ষিণের অবোধ্য ভাষাভাষী লোকটি, ও আর তুমি কিন্তু একই দেশের অন্নগ্রহণকারী। সুতরাং ভারতবাসী নিজেকে পূর্ণাঙ্গ ভারতবাসী বলে চিনতে শিখলো মাত্র এই সেদিন। অথচ একজন কাশ্মীরি-গুজরাটি-তামিল বা বঙ্গভাষী মানুষের মধ্যে 'আমরা
ভারতবাসী' এই বোধটি ছাড়া কতটা পার্থক্য বেড়ে ওঠার মধ্যে। ভাষা-আবহাওয়া-খাদ্যাভ্যাস
কোনকিছুই কারো সাথে মেলে না। ভারতবর্ষের বাইরে থাকা একটি ভারতবাসীর বরং নিজেকে
পরিপূর্ণ ভারতীয় বলে ভাবাটা খুব সহজ। বিদেশের কোনো একটি দেশে ভাষা-আবহাওয়া-খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির সাথে
তার এতটাই তফাৎ হয়ে পড়ে যে সে ভাবতে বাধ্য হয় সে প্রথমে ভারতীয়, তার পরে
সে তার প্রদেশের। ফলে ভারতে বসবাসকারী ভারতীয়দের চেয়ে ভারতের বাইরে থাকা ভারতীয়দের
জাতীয়তাবোধ হয়ত তাদের প্রাদেশিকতার চেয়ে বেশিই হয়।
ব্যাপারটা আমার
মতে খানিকটা এরকম, ধরা যাক আপনার বাড়িতে পারিবারিক কলহ চলছে। ঝগড়াঝাঁটির সময় মাথা
ঠিক নেই, দুপক্ষের পারস্পরিক দোষারোপে গলাবাজি তুঙ্গে। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে
দাঁড়িয়েছে যে, কি নিয়ে ঝগড়া সেইটিই গেছেন ভুলে। কেবল গালাগালির উত্তরে
গালাগালি উদগীরণ চলছে। এমতাবস্থায় যদি আপনারই বাড়ির অন্য একজন সদস্য বাড়ির
বাইরে থেকে হঠাৎ এসে পড়েন, তিনি হয়ত এই অস্থির, অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে প্রথমে ঘাবড়ে
গেলেও যেহেতু তিনি নিজে সরাসরি সেই গলাবাজিতে যুক্ত নন তাই প্রথম প্রশ্নটা তিনি এটাই করবেন
যে, "ঝগড়াটা হচ্ছে কি নিয়ে?" যেটি সেই মুহূর্তে হয়ত সবচেয়ে সঠিক প্রশ্ন। পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে দুজনেই আসল সমস্যাটা থেকে এত দূরে চলে গেছেন যে সমস্যাটির সমাধানের রাস্তা তো দূরস্থান, নিজেদের পারস্পরিক ঐক্য যা বাড়ির সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়, সেইটিই ডুবে যেতে বসেছে। এখন, যিনি বাইরে থেকে এলেন তিনি যদি বিচক্ষণ হন তবে তাঁর পক্ষে তৃতীয় পক্ষ হিসাবে সমস্যাটিকে বাইরে থেকে দেখে, সমস্যাটির সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মানুষের বা বিষয়ের ভালো মন্দ বিচার করে রায় দেওয়াটা অনেক বেশি নিরপেক্ষ বা সময়োপযোগী হবে বলে মনে হয়। আর এই মানুষটি যদি বাড়িরই সদস্য হন তবে তো বাড়ির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি সম্পর্কে আরো বেশি ওয়াকিবহাল হবেন। ফলে আরো সঠিকভাবে সমস্যার সমাধান করাটা সহজ হবে। তবে পুরো বিষয়টিতে একটি সমস্যা রয়েই যায়। সেটি হলো, বাইরে থেকে আসা ঘরের লোকটিকে নিজের বলে মনে করার মানসিক বাধা। ঘটনা অনেকসময়ই এরকম হয় যে, কলহরত পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে শুনতে হয় যে, "তুমি বাইরে থেকে এসে আমাদের সমস্যার সমাধান কি করে করবে? তুমি তো এখানে ছিলেই না, আমাদের সমস্যাটা তো তুমি জানোই না। অতএব চুপ থাকো।" কিন্তু সত্যিটা হলো এই যে বহিরাগত ঘরের লোকটি যেহেতু ঘরটিও চেনে ভালো করে, আবার বাইরের পরিবেশটিও দেখেছে। এবং বর্তমানের সমস্যাটিকে ঠিক একটু দূর থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছে সেই হয়ত সহজে সমাধানের রাস্তাটি দেখতে পারবে। তাকে বহিরাগতর তকমা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিলে ঘরের পরিবেশ তো স্বচ্ছ হবেই না উপরন্তু আরো ঘোলাটে হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
নিজের বাড়ি পরিষ্কার করার জন্য নার্সারীর বাচ্চাদের মতন 'এই তুমি ক্লাস নোংরা করলে কেন? কান ধরে দাঁড়াও" বলে ফাইন বা শাস্তির ভয় দেখাতে হবে এর মতন লজ্জার আর কি আছে? তাহলে তো বলতে হয় আমরা বড়ই হইনি, এখনো নার্সারীরই বাচ্চা। তার চেয়ে বিদেশের উদাহরণ দেখে যদি বোঝা যায় কোনখানটিতে মাত্র একটু নজর দিলেই পরিস্থিতির বেশ খানিকটা পরিবর্তন সম্ভব, তবে ক্ষতি কি? দিন কয়েক আগে জন্মসূত্রে জার্মান একজন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকের সামনে বসে তাঁর কাজের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।কোনো বিশেষ আশা নিয়ে হয়ত আমি শুনতে যাইনি সেই লেকচার। কিন্তু গিয়ে একটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা হলো। নিজের কাজের কথা শুরু করার আগে তিনি যে জায়গায় কাজ করেন সেই জায়গা, সেই দেশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত মনোগ্রাহী একটি সর্বাঙ্গীন ধারণা আমাদের দিলেন। সেদেশের অর্থনীতি, শিল্প, সেই শিল্পের ব্যাপকতার ফলে সেদেশের জনগনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সে সমস্যার সমাধানে সে দেশের সরকারের পদক্ষেপ, সেই পদক্ষেপের ফলে প্রতিষ্ঠিত গবেষনাগার, সেই স্বাস্থ্যগত সমস্যা নির্মূল করতে সেই গবেষণাগারের গবেষনার মূল লক্ষ্য সবই এলো একে একে। আরো একটি ব্যাপার তিনি বললেন, তাঁদের দেশের নতুন প্রজন্মকে আবশ্যিক ভাবে অন্তত দুই বছর ফেলোশিপ দিয়ে বিদেশের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় পড়াশুনার জন্য। তা শুধুমাত্র ডিগ্রীর জন্য নয়। তার সাথে নিজের দেশকে আরো ভালো করে জানার জন্য। তিনি বললেন একথা, স্পষ্টাক্ষরে, নিজমুখে। অবাক হচ্ছেন? আমাদেরও ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একজন হর্তাকর্তা হিসেবে তাঁর ব্যাখ্যাটি আমার যথেষ্ট মনে ধরেছে। তাঁর ব্যাখ্যাটি হলো, মানুষ দেশের বাইরে গিয়েই ঠিক করে নিজের দেশকে চিনতে শেখে। কারণ ভারতবর্ষে আমায় কেউ জিজ্ঞাসা করবে না যে তোমার দেশটি কেমন? ফলে একজন অত্যন্ত সাধারণ ভারতবাসী হিসেবে আমি নিজের দেশের খুঁটিনাটি জানার তাগিদও অনুভব করব না। কিন্তু সেই আমিই যদি বিদেশে কোনো একজনের প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে, ভারতবর্ষ দেশটি কেমন? সেদেশের মানুষরা কি একই রকম করে ভাবে? নাকি এত বড় দেশের এত প্রদেশভেদে বদলে যায় তাদের ভাবনা? কোন জায়গার কি বৈশিষ্ট্য? কি ইতিহাস? কি অর্থনৈতিক মূলনীতি? তাহলে? সেই পরিস্থিতিতে আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতন সেই মুহুর্তে যখন আর কেউ নেই, সে মুহুর্তে তখন আমায় ভাবতে হবে বৈকি? পড়াশুনা করতে হবে বৈকি? অথচ এদেশে থাকাকালীন সেই প্রয়োজনীয়তার কথাই মাথায় আসবে না আমার। আজ প্রায় আড়াই বছর হতে চলল আমি বাংলা ছেড়ে হরিয়ানায় আছি। এখন যদি কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করে বাংলা বা হরিয়ানার ঠিক যে জায়গায় তুমি ছিলে বা আছো ঠিক সে জায়গার আঞ্চলিক ইতিহাসটি একটু বল তো বাপু। বা হরিয়ানার এই অঞ্চলের চাষীদের সবজি ফলনে ঠিক কি ধরণের সমস্যা আছে বল দেখি। আমি তো অথৈ জলে পড়ব। আমি জানিই না। কারণ আমি জানবার কোনো চেষ্টাই করিনি কোনদিন। কারণ এই প্রশ্নের সম্মুখীনই হতে হয়নি আমায় কোনদিন। যা আমায় হতে হবে হয়ত বিদেশের কোনো মানুষের কাছে কোনো এক সন্ধ্যার ঘরোয়া আড্ডায়। তখন অন্তত আমি জানবার চেষ্টা করার কথা ভাবব। সুতরাং দেশের বাইরে গিয়ে সরাসরি সমস্যার মধ্যে না ঢুকলেও দেশের জন্য টান হেতুই হোক বা বিদেশে সঠিক ভাবে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার তাগিদেই হোক মানুষ নিজের দেশকে জানার চেষ্টা অন্তত করে। ফলে প্রথমে যা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই সূত্রই বলি, ভারতে বসবাসকারী ভারতীয়র চেয়ে বিদেশে বসবাসকারী একজন ভারতীয় এর পক্ষে প্রাদেশিকতার উর্দ্ধে উঠে নিজেকে ভারতীয় ভাবাটা অনেক সহজ। ফলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে একজন মারাঠি তার বিহারী বন্ধুর সাথে সান্ধ্য আড্ডায় বসে "তুমি বিহারি, কেন তুমি আমাদের মহারাষ্ট্রে থাকবে? এস তোমায় লাঠিপেটা করে নয়তো বোমা মেরে তাড়াই মহারাষ্ট্র থেকে"- এ ধরণের বালখিল্যপনার অসারতা নিয়ে অনায়াসেই সহমতে আসতে পারে। অথচ এ বিষয়ে রাজনৈতিক বালখিল্যদের বালখিল্যতার এক্কেবারে কেন্দ্রবিন্দুর মধ্যে পড়ে ভারতে বসবাসকারী কোনো মারাঠি তার বিহারী বন্ধুর সাথে সহমতে আসতেই হয়ত বেশ কিছুটা সময় নিয়ে নেবে।
উপরোক্ত এই বিশিষ্ট বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকটির বৈজ্ঞানিক কাজ বর্ণনার পূর্ববর্তী এই ভাষণটুকু থেকে আমার একটি কথা মনে হয়েছে যে, কোনো সমস্যার সত্যিকারের সমাধানের জন্য প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আগে সমস্যাটির কেন্দ্রবিন্দু থেকে একটু সরে এসে তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টি দিয়ে সমস্যাটির মূল বোঝার চেষ্টা কর। সময় দাও। তাড়াহুড়ো কোর না। তাতে ভুল পথে চালিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। তারপর নিরপেক্ষতা দিয়ে বিচার করে সর্বাঙ্গীন একটি সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করে তারপর সমস্যাটির মূলে ঝাঁপিয়ে পড়। নিজের সাধ্যমত সবশক্তি দিয়ে তার মূলটিকে ধরে নাড়িয়ে একেবারে উপড়ে ফেলার চেষ্টা কর। নইলে ওই ঘরোয়া বিবাদের মত কাদা ছোঁড়াছুঁড়িই সার। জল ক্রমশঃই ঘুলিয়ে উঠবে, মাছের নাগাল আর পাওয়া যাবে না। তা সে যে ধরণের সমস্যাই হোক না কেন।
0 comments:
Post a Comment