আপনাদের স্কুলজীবন কিভাবে শুরু হয়েছিল? আকাশী রঙের জামা-নীল রঙের প্যান্ট/স্কার্ট-গলায় খয়েরি টাই-পায়ে সাদা বা কালো জুতো, নাকি যেকোনো একটা রঙের জামা আর পায়ে যাহোক একটা জুতো? আমার দ্বিতীয়টা। অর্থাত কিনা আমার পাঁচ বছর বয়স হতেই আমার বাবা আর রুমার বাবা যথাক্রমে আমাকে আর রুমাকে সাইকেলে চাপিয়ে আমাদের গ্রামের ভারত সরকার এর স্নেহধন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়ে এলেন। তখন আমাদের গ্রামে কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল না, তার দু-এক বছর পরেই অবশ্য একটি স্কুল চালু হলো যার ড্রেস কোডটাই বললাম প্রথমে আপনাদের। তো সেই কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি অচিরেই সবার কাছে কেজি স্কুল হয়ে গেল। এবং উদ্যোগী সব মায়েরা ফুটফুটে-পরিস্কার বাচ্চাদের সকাল সকাল মাথায় পর্যাপ্ত পরিমান তেলসহ স্নান করিয়ে, চোখে এবং কপালের বামদিকে ধ্যবড়া করে কাজল পরিয়ে, পিঠে ব্যাগ ও গলায় লাল নীল জলের বোতল ঝুলিয়ে দিয়ে হাত ধরে সেই কেজি স্কুলে যেতে লাগলেন। যাঁরা যেতে পারলেন না তাঁরা স্কুলের নামলেখা টিনের বাক্স গাড়িতে তাঁদের বাচ্চাদের তুলে দিতে লাগলেন রাস্তার মোড় থেকে। বাক্স গাড়ি মানে...., ধরুন একটা বড়সড় টিনের বাক্স, তার চার দেওয়ালের উপরের দিকে তারের জানালা, এতে গাড়িটাকে অনেকটা খাঁচার মত দেখতে লাগত তাই আমরা অনেকে এটাকে খাঁচা গাড়িও বলতাম, এবার ওই বাক্স বা খাঁচাটাকে যদি একটু নিচু একটা ভ্যান রিক্সার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে যেটা দাঁড়ায় তাকেই আমি এখন বাক্সগাড়ি বলছি। এই পর্যন্ত লিখে জানেন আপনাদের ওই বাক্স গাড়ির খানিক আইডিয়া দেব বলে Google ইমেজে 'box van for kids', 'school vans for kids', 'rural kindergarten school vans' ইত্যাদি নানারকম সার্চ দিলাম, নাহ, অনেক খুঁজেও পেলাম না জানেন, ওটা কি ওখানকারই specialty ছিল নাকি কে জানে। তো সেই বাক্স গাড়ির চালক মানে ভ্যানকাকুটির যখন রাস্তার উঁচু নিচুর জন্য টানতে অসুবিধা হত তখন উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা মানে ওই স্কুল এর তুলনায় উঁচু ক্লাস আরকি, এই ধরুন ক্লাস থ্রী -ফোর, তাদের নেমে গাড়ির পেছনে ঠ্যালা মারতে হত। এটা বেশ মজার ও বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল আমার কাছে।
এত সব কান্ডের পর স্পষ্টতই আমাদের মত সরকারী প্রাইমারি স্কুলে পরা বাচ্চাদের মায়েদের সাথে ওই টাইপরা পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা খাঁচা গাড়ি করে যাওয়া LKG-UKG র বাচ্চাদের মায়েদের একটা তফাত তৈরী হলো। দ্বিতীয় দলের মায়েরা প্রতিনিয়তই পাড়ার বৈকালিক জটলায় তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলের মহিমা, বাদামী রঙের তেলতেলে কাগজের মলাট দেওয়া তাদের পিঠের ব্যাগের আর তাদের মায়েদের কথার ভার বাড়ানো নানা রকম বই, একশ আট রকম খাতা ইত্যাদি নিয়ে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করতে লাগলেন। তাঁদের দাপটে ওরই মধ্যে একটু ভালো জামা পরে টিনের সুটকেস হাতে হেঁটে যাওয়া সরকারী প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের মায়েদের দৃশ্যতই বেশ মুহ্যমান লাগতে লাগলো। অনেকেই এক-দুই বছর প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর পর তাঁদের বাচ্চাদের ওই কেজি স্কুলে ট্রান্সফার করিয়ে নিতে লাগলেন।
আমার মা-বাবা যে এত সব কিছুর পরেও মাথা ঠান্ডা রেখে আমাকে আগামী দিনের কেউকেটা বানানোর জন্য একদিন ওই বাক্স গাড়িতে তুলে দেননি তার মূলত তিনটি কারণ ছিল বলে আমার মনে হয়। এক: পাড়ার বৈকালিক জটলায় আমার মায়ের অনুপস্থিতি, দুই: পুরনো জিনিসের প্রতি আমার মা বাবার অগাধ আস্থা এবং তিন: আমাদের প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস-শিবানী রায়, আমার দিদিমনি। ছোটো পিসির সাথে বন্ধুত্বের কারণে ইনি আমাদের বাড়ির খুব কাছের লোক ছিলেন, বলা যায় আমার মায়েরও বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। এই তিন নম্বর ব্যাপারটা আমার বড়ই অসুবিধার কারণ ছিল বলাই বাহুল্য, কারণ এর ফলে স্কুলে আমাকে ভীষণ শান্ত বাচ্চা হয়ে থাকতে হত। স্বভাবসুলভ সর্দারি, বাঁদরামিগুলো বিকেলে খেলার মাঠের জন্য তুলে রাখত হত। তো সে দুঃখের কথা নাহয় পরে একদিন গল্প করা যাবে। এখন যা বলছিলাম বলি।
আমাদের সরকারবাহাদুর ঠিক সেসময়ই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে ক্লাস সিক্স এর আগে ইংরিজি শেখা মানে বাচ্চাদের কচি মাথায় চাপ পড়া। তাই তারা ক্লাস সিক্স এ গিয়েই নাহয় A-B-C-D শিখবে। এর ফলে বাচ্চাদের মাথায় কতটা চাপ পড়ত তা জানি না, তবে আমার পিঠে যে বেশ বড়সড় ধরনের চাপ পড়েছিল সেটা আমি হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। কারণ, এতে আমাকে ইংরিজিটা যে বাড়িতেই শেখাতে হবে এবং তাতে কোনো মতেই কোনো ফাঁক রাখা যাবে না এ ব্যাপারে আমার মা বোধহয় সেইদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাতে পরবর্তী চার পাঁচ বছর আমার যে অবস্থা হয়েছিল সে বোধহয় ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রতিদিন বিকেলে সে নরক যন্ত্রণা শুরু হত জানেন, কত আর বলব দুঃখের কথা।
এমতাবস্থায়, কেন জানিনা হঠাত শোনা গেল ওই বাক্স গাড়ির স্কুলটির পড়াশুনা নাকি ইংরিজি মাধ্যমে হয়। আর পর আর স্থির থাকা যায় বলুন? এই অজগাঁয়ে কিনা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল! মায়েরা তো উঠেপড়ে লাগলেন বাচ্চাদের সব ইংরিজিতে পন্ডিত করে তুলতে। রুমার মা একদিন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমার মা কে বললেন "হ্যাঁ গো, ইংরেজি পড়ায় খুব ভালো ভাবে। চলুন এদের দুজনকেও ওখানে ভর্তি করে দি।" মাকে সেদিন তাঁকে বোঝাতে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল যে স্কুলে ইংরেজি পড়ানো আর পুরোটাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর মধ্যে কি তফাত। যাক গে যাক সে সব কথা।
আমি আর রুমা দুজন তো 'রাজ্য সরকারের ঐতিহাসিক ভুল' এর স্বীকার হয়ে 'সারদামনি প্রাথমিক বিদ্যামন্দির' এই রয়ে গেলাম। গুটি গুটি পায়ে ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে স্কুলে যেতে লাগলাম আর যথাসাধ্য সামলে-সুমলে বাঁদরামি করতে লাগলাম। এই করতে করতে যখন বেশ বড় হয়ে গেছি মানে ক্লাস থ্রী, অর্থাত বাক্স-গাড়ির স্কুলে পড়লে যেসময় আমাদের দুজনকে ঢালু রাস্তায় গাড়ি ঠ্যালার জন্য assigned হয়ে যেতে হত সে সময়কার কথা বলছি। একদিন টিফিন ব্রেকে ক্লাস সুদ্ধু সক্কলে হয় স্কুল এর সামনে হুড়োহুড়ি করছে নয়তো পাশের গার্লস হাই স্কুল এর গেটের সামনে ঝালমুড়ি-চানা-কাঠি আইসক্রিম খাচ্ছে, আর আমরা দুই মক্কেল ক্লাস থ্রী-র ক্লাস রুমে রাস্তার দিকের জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে বসে রাস্তা দেখছি (আমরাও কেন ছুটোছুটি করছিলাম না কে জানে, দুজনে মিলে তেড়ে কারো সাথে ঝগড়া করেছিলাম বোধহয়, তাই কেউ খেলতে নেয়নি। এমনিতে দুজনের দিনের মধ্যে প্রায় ১২ ঘন্টাই ঝগড়া চললেও থার্ড পারসন কেউ ঝগড়া করতে এলেই আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝগড়া করে ফাটিয়ে দিতাম), এমন সময় একটা অদ্ভূত দৃশ্য।
আপনাদের কেমন লাগে জানি না, আমার ক্যান্ডি ফ্লস জিনিসটা খুব একটা ভালো লাগে না, বড্ড বেশি রকমের মিষ্টি। কিন্তু আমি মেলা টেলায় গেলে ক্যান্ডি ফ্লস খেয়ে থাকি। কেন জানেন? ওটা বানানো দেখতে আমার 'দারু উ উ উ উ উ উ উ......ণ' লাগে। আর ওই দিন আমি আর রুমা ওই জানলা দিয়ে ওই দৃশ্যটাই জীবনে প্রথমবারের জন্য দেখেছিলাম, জানলার ঠিক নিচেই বানানো আর বিক্রি চলছিল জিনিসটা। দুজনে প্রবল গবেষণা করেছিলাম জিনিসটা কি হতে পারে সেই নিয়ে। রুমা তার কলকাতায় মাসির বাড়ি যাবার আর আমি কলকাতায় আমার জ্যেঠু-পিসিদের বাড়ি যাবার সমস্ত অভিজ্ঞতা জড়ো করেও বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কি হতে পারে। কলকাতার কথা বললাম এই কারণেই যে তখনও পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল পৃথিবীর সমস্ত রকমের আশ্চর্য ব্যাপার কলকাতাতেই হওয়া সম্ভব। তারপর যখন আমাদেরই দু-এক জন বন্ধু সেই আশ্চর্য বস্তুটি কিনে খেতে লাগলো তখন আমরা আরো মুষড়ে পড়লাম। কারণ ক্লাসের আশিভাগ লোকজনের মতই আমাদেরও পকেট গড়ের মাঠ। শেষে 'আঙ্গুর ফল টক' এর মত করে রুমা তো বড়দের মত নিদানই দিয়ে ফেলল যে "জিনিসটা খাওয়া ভালো নয় বুঝলি, বাইরের জিনিস, দেখিস না মা আমাদের চানা খেতে বারণ করে।" রুমার কথা সাধারণত আমি খানিকটা তর্কাতর্কি না করে কখনো মেনে নিইনি, কিন্তু সেদিন ওই মহার্ঘ বস্তুটি কিনে খাবার কোনো উপায়ই ছিল না কিনা তাই আমিও তত্ক্ষনাত 'ঠিক বলেছিস' বলে লোলুপ দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। ঠিক করে দেখে রাখি ব্যাপারটা ঠিক কি রকম, যাতে পরে ঠিকঠাক বর্ণনা করলে বাড়ির লোক ব্যবস্থা করলেও করতে পারে এমনই যখন মনের ভাব, ঠিক তখনিই শুনি পেছনে একটা গম্ভীর গলায় ডাক, "এই তোরা দুজন এখানে আয়, আমার কাছে।" আমাদের দিদিমনি, শিবানী রায়। পপুলার রাগী হেড মিস্ট্রেস। চার পাঁচটা ঢোঁক গিলে, এ-ওকে ঠেলাঠেলি করতে করতে তো দাঁড়ালাম গিয়ে সামনে। লাস্ট পিরিয়ডের ঝগড়ার জন্য পাওনা বাকি আছে, সেটারই শোধনপর্বের জন্য এই আহ্বান-এতে কোনো সন্দেহই ছিল না। কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে কানে এলো,"ওটাকে বলে 'বুড়ির চুল', এই নে টাকা, দুজনে দুটো কিনে নিয়ে আয়...যা....আরে মা কিছু বলবে না....বলবি আমি কিনে দিয়েছি।" উনি পেছন থেকে পুরো বিষয়টিই নজর করেছিলেন।...... এরপর আর কি? সেই 'অমৃত' তৈরী পুনরায় অবলোকন ও অমৃত ভক্ষণ।
এর পর যতবার আমি বুড়ির চুল খেয়েছি বা যতবার ওটি তৈরি হতে দেখেছি, ততবার আমার ওই দিনটার কথা মনে হয়েছে। আর আজও প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরও ছোটবেলার স্কুলের ওই একতলা টালির চাল এর বাড়িটা, সামনে ফুলে ছাওয়া দুটো লালে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ, ছোটবেলার বন্ধু-বান্ধব, ক্লাস ওয়ানের মেঝে থেকে ক্লাস টু-র বেঞ্চে উন্নতি ইত্যাদি সমস্ত রকম স্মৃতি ছাপিয়ে আমার এই ঘটনাটার কথা প্রথমেই মনে পড়ে আর মনে হয় ভাগ্যিস আমার মা-বাবা আমায় টাই পরিয়ে খাঁচা গাড়িতে তুলে দেননি তাহলে তো রাশভারী শিবানী রায় চিরদিন আমার কাছে হেড মিস্ট্রেস হয়েই থেকে যেতেন, আমার দিদিমনি হয়ে উঠতেন না কোনদিন। ভাগ্যিস! ভাগ্যিস!
এত সব কান্ডের পর স্পষ্টতই আমাদের মত সরকারী প্রাইমারি স্কুলে পরা বাচ্চাদের মায়েদের সাথে ওই টাইপরা পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা খাঁচা গাড়ি করে যাওয়া LKG-UKG র বাচ্চাদের মায়েদের একটা তফাত তৈরী হলো। দ্বিতীয় দলের মায়েরা প্রতিনিয়তই পাড়ার বৈকালিক জটলায় তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলের মহিমা, বাদামী রঙের তেলতেলে কাগজের মলাট দেওয়া তাদের পিঠের ব্যাগের আর তাদের মায়েদের কথার ভার বাড়ানো নানা রকম বই, একশ আট রকম খাতা ইত্যাদি নিয়ে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করতে লাগলেন। তাঁদের দাপটে ওরই মধ্যে একটু ভালো জামা পরে টিনের সুটকেস হাতে হেঁটে যাওয়া সরকারী প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের মায়েদের দৃশ্যতই বেশ মুহ্যমান লাগতে লাগলো। অনেকেই এক-দুই বছর প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর পর তাঁদের বাচ্চাদের ওই কেজি স্কুলে ট্রান্সফার করিয়ে নিতে লাগলেন।
আমার মা-বাবা যে এত সব কিছুর পরেও মাথা ঠান্ডা রেখে আমাকে আগামী দিনের কেউকেটা বানানোর জন্য একদিন ওই বাক্স গাড়িতে তুলে দেননি তার মূলত তিনটি কারণ ছিল বলে আমার মনে হয়। এক: পাড়ার বৈকালিক জটলায় আমার মায়ের অনুপস্থিতি, দুই: পুরনো জিনিসের প্রতি আমার মা বাবার অগাধ আস্থা এবং তিন: আমাদের প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস-শিবানী রায়, আমার দিদিমনি। ছোটো পিসির সাথে বন্ধুত্বের কারণে ইনি আমাদের বাড়ির খুব কাছের লোক ছিলেন, বলা যায় আমার মায়েরও বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। এই তিন নম্বর ব্যাপারটা আমার বড়ই অসুবিধার কারণ ছিল বলাই বাহুল্য, কারণ এর ফলে স্কুলে আমাকে ভীষণ শান্ত বাচ্চা হয়ে থাকতে হত। স্বভাবসুলভ সর্দারি, বাঁদরামিগুলো বিকেলে খেলার মাঠের জন্য তুলে রাখত হত। তো সে দুঃখের কথা নাহয় পরে একদিন গল্প করা যাবে। এখন যা বলছিলাম বলি।
আমাদের সরকারবাহাদুর ঠিক সেসময়ই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে ক্লাস সিক্স এর আগে ইংরিজি শেখা মানে বাচ্চাদের কচি মাথায় চাপ পড়া। তাই তারা ক্লাস সিক্স এ গিয়েই নাহয় A-B-C-D শিখবে। এর ফলে বাচ্চাদের মাথায় কতটা চাপ পড়ত তা জানি না, তবে আমার পিঠে যে বেশ বড়সড় ধরনের চাপ পড়েছিল সেটা আমি হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। কারণ, এতে আমাকে ইংরিজিটা যে বাড়িতেই শেখাতে হবে এবং তাতে কোনো মতেই কোনো ফাঁক রাখা যাবে না এ ব্যাপারে আমার মা বোধহয় সেইদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাতে পরবর্তী চার পাঁচ বছর আমার যে অবস্থা হয়েছিল সে বোধহয় ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রতিদিন বিকেলে সে নরক যন্ত্রণা শুরু হত জানেন, কত আর বলব দুঃখের কথা।
এমতাবস্থায়, কেন জানিনা হঠাত শোনা গেল ওই বাক্স গাড়ির স্কুলটির পড়াশুনা নাকি ইংরিজি মাধ্যমে হয়। আর পর আর স্থির থাকা যায় বলুন? এই অজগাঁয়ে কিনা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল! মায়েরা তো উঠেপড়ে লাগলেন বাচ্চাদের সব ইংরিজিতে পন্ডিত করে তুলতে। রুমার মা একদিন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমার মা কে বললেন "হ্যাঁ গো, ইংরেজি পড়ায় খুব ভালো ভাবে। চলুন এদের দুজনকেও ওখানে ভর্তি করে দি।" মাকে সেদিন তাঁকে বোঝাতে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল যে স্কুলে ইংরেজি পড়ানো আর পুরোটাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর মধ্যে কি তফাত। যাক গে যাক সে সব কথা।
আমি আর রুমা দুজন তো 'রাজ্য সরকারের ঐতিহাসিক ভুল' এর স্বীকার হয়ে 'সারদামনি প্রাথমিক বিদ্যামন্দির' এই রয়ে গেলাম। গুটি গুটি পায়ে ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে স্কুলে যেতে লাগলাম আর যথাসাধ্য সামলে-সুমলে বাঁদরামি করতে লাগলাম। এই করতে করতে যখন বেশ বড় হয়ে গেছি মানে ক্লাস থ্রী, অর্থাত বাক্স-গাড়ির স্কুলে পড়লে যেসময় আমাদের দুজনকে ঢালু রাস্তায় গাড়ি ঠ্যালার জন্য assigned হয়ে যেতে হত সে সময়কার কথা বলছি। একদিন টিফিন ব্রেকে ক্লাস সুদ্ধু সক্কলে হয় স্কুল এর সামনে হুড়োহুড়ি করছে নয়তো পাশের গার্লস হাই স্কুল এর গেটের সামনে ঝালমুড়ি-চানা-কাঠি আইসক্রিম খাচ্ছে, আর আমরা দুই মক্কেল ক্লাস থ্রী-র ক্লাস রুমে রাস্তার দিকের জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে বসে রাস্তা দেখছি (আমরাও কেন ছুটোছুটি করছিলাম না কে জানে, দুজনে মিলে তেড়ে কারো সাথে ঝগড়া করেছিলাম বোধহয়, তাই কেউ খেলতে নেয়নি। এমনিতে দুজনের দিনের মধ্যে প্রায় ১২ ঘন্টাই ঝগড়া চললেও থার্ড পারসন কেউ ঝগড়া করতে এলেই আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝগড়া করে ফাটিয়ে দিতাম), এমন সময় একটা অদ্ভূত দৃশ্য।
আপনাদের কেমন লাগে জানি না, আমার ক্যান্ডি ফ্লস জিনিসটা খুব একটা ভালো লাগে না, বড্ড বেশি রকমের মিষ্টি। কিন্তু আমি মেলা টেলায় গেলে ক্যান্ডি ফ্লস খেয়ে থাকি। কেন জানেন? ওটা বানানো দেখতে আমার 'দারু উ উ উ উ উ উ উ......ণ' লাগে। আর ওই দিন আমি আর রুমা ওই জানলা দিয়ে ওই দৃশ্যটাই জীবনে প্রথমবারের জন্য দেখেছিলাম, জানলার ঠিক নিচেই বানানো আর বিক্রি চলছিল জিনিসটা। দুজনে প্রবল গবেষণা করেছিলাম জিনিসটা কি হতে পারে সেই নিয়ে। রুমা তার কলকাতায় মাসির বাড়ি যাবার আর আমি কলকাতায় আমার জ্যেঠু-পিসিদের বাড়ি যাবার সমস্ত অভিজ্ঞতা জড়ো করেও বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কি হতে পারে। কলকাতার কথা বললাম এই কারণেই যে তখনও পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল পৃথিবীর সমস্ত রকমের আশ্চর্য ব্যাপার কলকাতাতেই হওয়া সম্ভব। তারপর যখন আমাদেরই দু-এক জন বন্ধু সেই আশ্চর্য বস্তুটি কিনে খেতে লাগলো তখন আমরা আরো মুষড়ে পড়লাম। কারণ ক্লাসের আশিভাগ লোকজনের মতই আমাদেরও পকেট গড়ের মাঠ। শেষে 'আঙ্গুর ফল টক' এর মত করে রুমা তো বড়দের মত নিদানই দিয়ে ফেলল যে "জিনিসটা খাওয়া ভালো নয় বুঝলি, বাইরের জিনিস, দেখিস না মা আমাদের চানা খেতে বারণ করে।" রুমার কথা সাধারণত আমি খানিকটা তর্কাতর্কি না করে কখনো মেনে নিইনি, কিন্তু সেদিন ওই মহার্ঘ বস্তুটি কিনে খাবার কোনো উপায়ই ছিল না কিনা তাই আমিও তত্ক্ষনাত 'ঠিক বলেছিস' বলে লোলুপ দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। ঠিক করে দেখে রাখি ব্যাপারটা ঠিক কি রকম, যাতে পরে ঠিকঠাক বর্ণনা করলে বাড়ির লোক ব্যবস্থা করলেও করতে পারে এমনই যখন মনের ভাব, ঠিক তখনিই শুনি পেছনে একটা গম্ভীর গলায় ডাক, "এই তোরা দুজন এখানে আয়, আমার কাছে।" আমাদের দিদিমনি, শিবানী রায়। পপুলার রাগী হেড মিস্ট্রেস। চার পাঁচটা ঢোঁক গিলে, এ-ওকে ঠেলাঠেলি করতে করতে তো দাঁড়ালাম গিয়ে সামনে। লাস্ট পিরিয়ডের ঝগড়ার জন্য পাওনা বাকি আছে, সেটারই শোধনপর্বের জন্য এই আহ্বান-এতে কোনো সন্দেহই ছিল না। কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে কানে এলো,"ওটাকে বলে 'বুড়ির চুল', এই নে টাকা, দুজনে দুটো কিনে নিয়ে আয়...যা....আরে মা কিছু বলবে না....বলবি আমি কিনে দিয়েছি।" উনি পেছন থেকে পুরো বিষয়টিই নজর করেছিলেন।...... এরপর আর কি? সেই 'অমৃত' তৈরী পুনরায় অবলোকন ও অমৃত ভক্ষণ।
এর পর যতবার আমি বুড়ির চুল খেয়েছি বা যতবার ওটি তৈরি হতে দেখেছি, ততবার আমার ওই দিনটার কথা মনে হয়েছে। আর আজও প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরও ছোটবেলার স্কুলের ওই একতলা টালির চাল এর বাড়িটা, সামনে ফুলে ছাওয়া দুটো লালে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ, ছোটবেলার বন্ধু-বান্ধব, ক্লাস ওয়ানের মেঝে থেকে ক্লাস টু-র বেঞ্চে উন্নতি ইত্যাদি সমস্ত রকম স্মৃতি ছাপিয়ে আমার এই ঘটনাটার কথা প্রথমেই মনে পড়ে আর মনে হয় ভাগ্যিস আমার মা-বাবা আমায় টাই পরিয়ে খাঁচা গাড়িতে তুলে দেননি তাহলে তো রাশভারী শিবানী রায় চিরদিন আমার কাছে হেড মিস্ট্রেস হয়েই থেকে যেতেন, আমার দিদিমনি হয়ে উঠতেন না কোনদিন। ভাগ্যিস! ভাগ্যিস!
0 comments:
Post a Comment