Wednesday, 13 May 2020

সমালোচনা

প্রতিদিনের জীবন মানে এমন অনেক কিছুরই সম্মুখীন হতে হবে যা আমার পছন্দ নয়। কিছু ঘটনায় দুঃখ পাবো, কিছু ঘটনায় ভীষণ রাগ হবে, কিছু ঘটনায় কিছু না করতে পারার হতাশা থাকবে। এতো স্বাভাবিক। কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু ঘটনাও তো থাকবে যা আনন্দের, যা সাহস জোগাবে, যা উদাহরণস্বরূপ সকলকে জানাতে ইচ্ছে করবে, যা ভীষণ নেগেটিভিটির মধ্যেও বুকভরে শ্বাস নেবার কারণ হবে। থাকবে তো? নাকি একটা সময়কালে যা যা ঘটছে সব- সমস্তটাই নেগেটিভ? সমস্তটাই হতাশার, রাগের, দুরছাই করার? ভাল খারাপ মিলিয়েই তো বিবর্তন হয় নাকি রে বাবা!

চিরকাল যা লেখা হয়ে এসেছে, বলা হয়ে এসেছে সেইটাই ভবিষ্যৎকালে আজকের সময়টার ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমি আজকে যা লিখছি, বলছি, আঁকছি, গাইছি অর্থাৎ যা এভিডেন্স হিসেবে রয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য, সেটি আমি সচেতনভাবে রেখে যাচ্ছি তো? নাকি বিচার বিবেচনাহীন জাস্ট একটা ইনস্ট্যান্ট ইমোশন রেখে দিয়ে, সমালোচনা করেই সমাজ এবং কাল সচেতনতার দায় সারছি?

আমার দিক থেকে আমার চারপাশের ভাল খারাপে যতটুকুর কিছুটা হলেও আমার দায় রয়েছে বা চাইলে আমি খারাপ থেকে ভালর দিকে আনতে পারি সে চেষ্টা আমি করছি তো? মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে, মেরুভাল্লুক মারা যাচ্ছে, সেজন্য ডাইরেক্ট আমার কিছু করার নেই। আমি মেরুতে গিয়ে তাপমাত্রা কমাতে পারবো না। ভাল্লুকদের রিহ্যাবিলিটেশন এর ব্যবস্থা করতে পারবো না। কিন্তু রাত্রে এসি-র ব্যবহার কমাতে পারবো। সেটুকু আমার হাতে আছে। সেটা করছি কিনা সেটি ভেবে তারপর নয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে নিজের উষ্মার কথা লিখি। বা নিজের ঘরের বাচ্চাটা রাস্তার কুকুর বেড়ালকে খাবার দিতে চাইলে তাকে "কামড়ে দিলে কি হবে" বা "রোগের ডিপো" বলে ভয় পাইয়ে ঘেঁটি ধরে ঘরে না ঢুকিয়ে মানুষ পশুর সহাবস্থানের গল্প শোনাই। তাতে সে বড় হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল জনতা না হয়ে স্থিতধী বিবেচনাশীল নাগরিক হবার একটা পাঠ বাড়ি থেকেই পাবে। ঠেকায় পড়ে কষ্ট পেয়ে শিখতে না হয়।  

যা যা খারাপ ঘটছে তাকে রেখে যাবার প্রয়োজন বোধ করছি, কিন্তু ভালো যা ঘটছে সেটিকে সামনে আনার দায় কি নেই? মানুষের মৃত্যুর খবর, অমানবিকতার খবর, হিংসার খবর যত দেখা যায়, মানুষের মৃত্যু পেরিয়ে বেঁচে থাকার খবর, মানবিকতার খবর, পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে সমস্যা উত্তরণের খবর তেমনটা সামনে আসে না কেন? কেন একজন মানুষ সরকারি অসহযোগিতার খবর যতটা উষ্মার সাথে প্রকাশ করেন, সহায়তার খবরের পেছনে একটা শব্দও প্রকাশ করেন না? নাকি তিনি যে বেঁচে বর্তে আছেন, মতপ্রকাশ করছেন তা নিঃশ্বাস নেবার মতোই স্বাভাবিক? তিনি উত্তর কোরিয়ায় বা সিরিয়ায় জন্মাননি সেজন্য তার কোনো ধন্যবাদ দেবার কি নেই ঈশ্বরের কাছে?

আমি জানি যে যেভাবেই থাকুন না কেন তার থেকে অনেক ভাল করে থাকা যায়, সুতরাং যা ভালো নয় তার জন্য দাবি করা বা উষ্মা প্রকাশ করাটা তাঁর অধিকার। কিন্তু হতাশা বা দাবিদাওয়ার শেষে যে সামান্যটুকু তাঁর আছে সেটুকুর উল্লেখ কেন তিনি করবেন না? ভালকে সামনে না আনলে ভাল এপ্রিসিয়েটেড না হলে কেউ আর ভালো কিছু করবেন না। এটা পরীক্ষিত মানবধর্ম। human nature .বাচ্চা অনেক দুস্টুমির মধ্যেও ভাল কিছু কাজ করলে সেটাকে acknowledge করলে, ভাল বললে, appreciate করলে, সে পরের বার আবার ভাল কাজ করতে চেষ্টা করে যাতে সে এপ্রিসিয়েশন পায়। আপনি মিথ্যে কথা বললে বাচ্চাকে চড়-থাপ্পড় মেরে ফাটিয়ে দিচ্ছেন অথচ সত্যি কথা বললে তার জন্য একটি বাক্যও খরচ করছেন না যেন এত হবারই ছিল। হ্যাঁ হবারই ছিল কিন্তু যতক্ষণ না সেজন্য তাকে একটি মিষ্টবাক্য খরচ করছেন ততক্ষন কিন্তু সে দোলাচলেই  থাকবে যে কাজটা ঠিক না ভুল হলো। চড় মারলে যেমন খারাপ কাজটা করবে না পিঠে হাত না রাখলে ভালটাও কিন্তু করবে না।

মানুষ হিসেবে আমার সমালোচনার অধিকার যদি থাকে তাহলে একশটা খারাপের মধ্যেও যদি একদল আলোর সন্ধানী মানুষ আশার কথা, আলোর কথা শোনায়, খারাপটাকে গিলে নিয়ে, সহ্য করে, বা তার জন্য যা করার ঢাক না পিটিয়ে করে তারপর ভালটাকে হাইলাইট করে, আমার খারাপ ইতিহাসটার পাশাপাশি ভালো যা হয়েছে সেটিকেও ভবিষ্যতের জন্য লিপিবদ্ধ করে যেতে চায় তাকে বিচার করার আগে, অসংবেদনশীল, ঠুনকো মানসিকতার জনতা ভেবে নিজেকে উচ্চাসনে বসাবার আগে ভেবে নেওয়া ভালো যে কোনটি ভাল কোনটি খারাপ তার বিচার কে করবে? খুব খারাপ সময়ে হা হুতাশ করে মন ভেঙে বসে থাকা নাকি খারাপটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য যেটুকু নিজের করার সেটুকু করার পরে ভালটিকে সামনে এনে মনোবল বাড়িয়ে আবার লড়াইয়ের মাঠে নামা? কে কোনদিকদিয়ে নিঃস্বার্থ কাজ করে চলেছেন, সারা জীবন ধরেই করে চলেছেন, তার থেকে আলোটা আরো চারটে লোকের মধ্যে নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছেন কেউ জানে না। সমালোচনার আগে মনে মনে অন্ততঃ সেটির জন্য ধন্যবাদ স্বীকার করে তারপর বরং ফাটিয়ে সমালোচনা করুন।

আমার যেমন বিষয় অনেক আছে সমালোচনার। দেখে শুনে পছন্দ মত বেছে নিলেই হলো। তেমনি আপনারও এমন কিছু বিষয় আছে যা আপনি নিঃশব্দে নিঃস্বার্থ ভাবে করে যাচ্ছেন যা আমি জানি না বলে কেবল আমার পছন্দের বিষয়ে কেন কথা বলছেন না সে নিয়ে গলা ফাটিয়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছি। অথচ দুজনেই নিজের নিজের বিষয়ে সিন্সিয়ারলি কাজ করছি কিন্তু। নইলে পৃথিবী এখনো আমাদের সহ্য করছে কি করে? অথচ দুজনেই ভাবছি আমি কেমন কাজের আর ও কেমন নিস্কর্মা, সুখী সুখী সখি টাইপ। আমি কেমন এই কদিনের মধ্যেই সমাজ বদলে ফেলবো পণ করেছি। আর ও কেবলই তাতে বাগড়া দিচ্ছে। আর 'সময়' এই ভেবেই আমোদ পাচ্ছে যে, "'বদল', সেতো  আমার হাতে। কোনটা রাখবো কোনটা নয় সে এই দুই পালোয়ানের কেউই জানে না।  অথচ দেখো কেমন গলা ফাটিয়ে বেকুবের মতন লড়াই করছে।"

Tuesday, 12 May 2020

ইচ্ছে করে


আমার খুব ইচ্ছে করে খুব ভোরের বাসে করে বাড়ী ফিরব। বাসের জানলা দিয়ে দেখতে পাব ইলোরা এপার্টমেন্টের লম্বা বাড়ীটারছাদে সকালের রোদ এসে জুটেছে। তার কিছুটা বাসের জানলা দিয়ে ঢুকে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার বাঁদিকের গাল। আর ভোরেরহাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চুল। মুখে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগলে কেমন একটা স্নান করার অনুভুতি আসে। সেইটি নিয়েফাঁকা বাসে চেপে বাড়ি ফিরবার ইচ্ছে করে একবার। 

আমার খুব ইচ্ছে করে কাঁসাই নদীর ধারে গিয়ে বসি আর একবার। একটু দূরে ডানদিকে থাকুক একটা  ঝুপসি গাছ। কি গাছ তারনাম নয় নাই জানলাম। পুরনো দিনের গন্ধ থাকুক তাতে। লাল মাটির কাঁকুড়ে জমিতে গুছিয়ে বসে গল্প করি অনেক। বাঁদিকদিয়ে ওই দূরে থাকুক নয় একখানা একাবোকা ট্রেন লাইন। গ্ল্যামারহীনগ্রাম্য গোছের। খানিকটা ঠিক আমারই মতন। কুটুর কুটুরকত গল্পই না জমে থাকে অমন দিনে। গল্প করতে করতে সন্ধ্যে নামলে আবার কাঁকুড়ে পথে নয় ফিরে চলব  লাল মাটির পথেলাল সাইকেলের চাকায় কুড়কুড় করে শব্দ হবে তৃপ্তির। আমার খুব ইচ্ছে করে বন্ধু এসে এমন দিনে ছুঁয়ে দেবে ডানহাত দিয়ে।ভরসা দেবে বন্ধু থাকার। 

আমার ভীষণ ইচ্ছে করে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে নিজের ঘরেমায়ের পাশে। শীতের কুয়াশায় ডুবে আছে বাঁড়ুজ্জে পুকুর। এমনকুয়াশা যে ঘোষাল গাছের মাথাটাও আবছা হয়ে আছে নিচে থেকে দেখলে  প্রাক দীপাবলির সাতসকালে এমন দিনে চুবড়ি হাতেচোদ্দশাকের সন্ধানে বেরোই আর একবার। পাড়াসুদ্ধু বন্ধু বান্ধব সব জুটিয়ে নিয়ে। 

মাঠের ধারে কচি ধানের শিষের ভেতর দুধ জমে। জানতামই নাহিরুদিদি না দেখালে। আমার খুব ইচ্ছে করে আর একবারবিকেল বেলায় ক্ষেতের কোণায় গিয়ে দাঁড়াই দুজন মিলে। কত নতুন কিছু শিখব তবে। তারপরেতে বিকেল বেলায় খুব খানিকপিট্টু খেলব। নইলে নাহয় বউবসন্ত। আমি কিন্তু তোমার দলে। খুব খেলব সন্ধ্যে নামার পর পর্যন্ত। তারপর নয় সন্ধ্যে হলেলোডশেডিং হোক। যেমন হত প্রাত্যহিকই। হ্যারিকেনের আলোয় মায়ের কাছে ভূগোল বই খুলে বসব তখন। আবহবিকার আরভূপ্রকৃতি পড়ব তখন বেশটি করে। ঠাকুরদোরে ফুরফুরিয়ে হাওয়া দেবে আর চ্যাপ্টা মতন ম্যাপবইটা খুলে বসে দেশ দেখব দুজনমিলে। আমার খুব ইচ্ছে করে। 

আমার খুব ইচ্ছে করে সাতসকালে পুঁচকে খাঁদুর দাঁত মাজিয়েমুখ ধুইয়েবাঁ হাত দিয়ে গালটা ধরে চুল আঁচড়েদুধ বিস্কুট খাইয়েদিয়েহাত ধরে  বা কোলে করে শিবতলার দুগগাঠাকুর দেখিয়ে আনি। আর একবার। ইচ্ছে করে। 

আমার খুব ইচ্ছে করে গরমের ছুটিতে সোমদত্তাসংহিতার চিঠি পেতে। নীল রঙ্গের ইনল্যান্ড লেটার। আর একবার। গোটাঅক্ষরে লেখা থাকবে, "ছুটি খুললে প্রথম দিন তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু। এক বেঞ্চে বসতে হবেআমার খুব ইচ্ছে করে আরএকবার শ্যামলীদির সেই ছাদের ঘরে সাতসকালে পড়তে বসি। কিংবা সেই ব্যাকরণের পরীক্ষা হোক সবাই মিলে আর একবার।ভীষণ রকম ইচ্ছে করে সরস্বতীপুজোর দিনে গিয়ে জুটি সবাই মিলে মনিদীপার বাড়ি। কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডে ইচ্ছে করে মনিদীপাকে"মোণীদ্বীপালিখে দেখি। তুই কি অমন রেগে যাবিএখনোওহ্যাঁরে

মনিদীপাদেবীমিতাসুহিতাসোমদত্তাসংহিতাসঙ্গীতাসোনালীপুনমঅনামিকামালারিয়ারিমিঅনুস্মিতাতাপসীতমসাসরমাগায়েত্রী। সবার নামই কি সুন্দর। হয় ছোট্ট মিষ্টিমত। নইলে বড়সড়। ওজন আছে। গাম্ভীর্যও। আমারটা কেন এমনমাঝামাঝিচলনসই মতশুধুআমার খুব ইচ্ছে করে এই একটাই আমার একমাত্র ক্ষোভ হয়ে যাক জীবন জুড়ে। আর যতসববড়বেলার শোক দুঃখ সেসব স্রেফ নেই হয়ে যাক। আমার খুব ইচ্ছে করে। 

আমার এসব ইচ্ছে করে। আমার ভীষণ ইচ্ছে করে

Monday, 11 May 2020

সই


-বলি অ দিদি ? কলমি শাক লিবে নাকি?  
-কে? বোষ্টুমী দিদি নাকি গো? 
-হ্যাঁ আর কে? বলি কলমি লিবে? টাটকা, এই তুলে লিয়ে আসছি। 
-কি কলমি? জলকলমি না ডাঙ্গার? 
-না না জল কলমি। ড্যাঙ্গা কি জেগে আছে নাকি? সব তো জল ছপছপ করতিছে আখুনো। 
-সে কি গো? এখনো জল?
-আর কেন বলো! আখুনো জল লাবেনি। বাখুলেও জল থৈ থৈ করতিছে দিদি। পা-হাত-পা হেজে গেল এই দেখোনা। দুবেলা দশবার করে অরই মধ্যি যাতায়াত। লাতিটার জ্বর, কাশি। আর কত করে বননু কাল হাজরাদের লালাটা কেটে দিতে, থালিই বাখুল থিকে জল লেবে যায়। তা সে বুড়ার কত কতা। বলে, লতুন মাছ ছেড়ছি, আর কদিন যেতে দাও। জল ওমনিই লেবে যাবে। সব মাছ লাকি তার মাঠকে বেইরে যাবে। ওলাউঠায় মরুক শুয়ার। সব্বদা প্যাঁচ। সব্বদা প্যাঁচ। 

-কৈ কি কলমি আনলে দেখি। বিপদ বুঝে কথা ঘোরান জগদ্ধাত্রী। হাজরা বাড়ির কথা উঠলে বোষ্টমীকে থামানো মুশকিল। হাজরাদের বাঁশঝাড়টা আর পাশে মাঝারি গোছের পুকুরপাড়েই বোষ্টমীদের ছিটেবেড়ার ঘরদুয়ার। বর্ষায় পুকুর উপচে তাদের উঠোন থৈ থৈ করে। মাঠের দিকে নালা কেটে দিলেই জল খানিক নেমে যায়। কিন্তু বোষ্টমীর ঘর ডুবলে হাজরা বুড়োর কি? নালার মুখে মাছ আটকানোর জাল বসানোর ব্যবস্থা না করে নালা কাটবে কেন? ফি এই বর্ষায় এই নিয়ে বোষ্টমীর গজগজ শুনে আসছেন জগদ্ধাত্রী।

রোয়াকের ওপর মাথার ঝুড়িটা নামায় বোষ্টমী। ঝুড়ির সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে ভাঁজ করে রাখা গামছাটাও টুক করে খসে পড়ে। জগদ্ধাত্রী দেখলেন, ঝুড়িতে তিন-চার আঁটি লকলকে কলমি। আর তার সাথে একপাশে পড়ে আছে গোটা তিনেক মাঝারি গোছের কচি সবুজ পেঁপে। সত্যি সদ্যই তুলে নিয়ে আসছে বোঝা যায়। কেটে নেওয়া গোড়াগুলো থেকে সাদা রস গড়াচ্ছে। গামছাটা তুলে নিয়ে মুখ আর বাঁ হাতটা ঘষে নিতে নিতে বোষ্টমী বলে, 
- লও না কটা লিবে। এই কেটেই লিয়ে আসছি। 
-কাঁচা কাঁচা পেঁপে গুলোকে পেড়ে ফেললে কেন গো? পাকলে তো বেশি দাম পেতে। দু - আঁটি কলমিশাক হাতে করে তুলে নিতে নিতে বলেন বলে ওঠেন জগদ্ধাত্রী। 
-আর পাকা! গোড়ায় জল লেগি গেছে দিদি। উ গাছ কি আর তদ্দিন টিকবে? সব্বসো পচে ধসে যেতিছে। লও না দুটো।  ভাল পিঁফে গো। 
-না পেঁপে আজ থাক। ঘরভর্তি আনাজ। আর এই বর্ষায় সবই পচতে লেগেছে। এই দু - আঁটি কলমীই দিয়ে যাও। কত দোব বল দিকিনি। 
-আরে লও না দিদি, খোলা চুবড়িতে রেখে দিবে পচবেনি। এই তো আজগেই লাবিয়েছি গাছ থিকে। 

শেষ পর্যন্ত দু আঁটি কলমি আর একটা পেঁপে নিয়ে জগদ্ধাত্রী  "দাঁড়াও পয়সা নিয়ে আসি" বলে ভেতরে চলে গেলেন। বোষ্টমী একটা শ্বাস ফেলে পুরোনো চটাওঠা রোয়াকটায় বসে পড়লো। পায়ের প্লাস্টিকের চটিটা খুলে ডানপায়ের বুড়ো আঙ্গুল আর পরের আঙ্গুলটার মাঝখানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঘষতে লাগলো। হাজায় সাদা হয়ে গেছে আঙুলের ফাঁকগুলো। তারমধ্যে খোঁচা ওঠা প্লাস্টিকের চটিটায় ঘষা লেগে খানিকটা চামড়া উঠে জ্বলছে জায়গাটা। মুখটা বিকৃত করে গামছার কোণাটা চেপে চেপে জায়গাটা শুকনো করার চেষ্টা করে বোষ্টমী। 

-এই নাও। সাতাশ বললে তো? এই বলে জগদ্ধাত্রী বেরিয়ে এসে দুটো দশটাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা এগিয়ে দেন বোষ্টমীর দিকে। তারপরেই তার পায়ের দিকে নজর পড়তে বলে ওঠেন, 
-এহ কি অবস্থা গো! ওষুধ লাগাওনি?
-কি আর ওষুধ লাগাবো দিদি? রাতের আগে পা শুখনাই হতে চায়নি। সারাদিন জলে কাদায়.....আগে তবু আলতা পায়ে দিলে এই জলের সময় হাজাটা কম হত। এখন তো আর......। কথাটা ওখানেই থামিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাকটা নিয়ে আঁচলে বাঁধে বোষ্টমী। গেলবার পুজোর চারদিন আগেই বোষ্টমীর আলতা পরার পাট চুকিয়ে তার ঘরের লোক তাকে ছেলে-বৌ এর হাতে ছেড়ে মাটি নিয়েছে। 
-তোমায় যে সেই মলমটা কিনে দিলুম সেদিনে? লাগাবে তো! এহ ভ্যাটভ্যাট করছে একবারে। জগদ্ধাত্রী বিরক্ত সুরে বলে ওঠেন। 
- সে আছে। লাগাতে মনে থাকেনি। রাত্তিরে শুবার সময় লাগালেই হয়। লাতিটা এমন বদমাশি করে.....। পান-দোক্তায় কালচে হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে অপ্রস্তুতের মত হাসতে থাকে বোষ্টমী। তারপর বলে, আর যা জল হচ্ছে এবছর! কিছু বলছে নাকি গো দিদি টিবির খপরে? কবে ধরণ হবে? জগদ্ধাত্রী হলেন বোষ্টমীর বাইরের খবর জোগাড়ের মাধ্যম। জগদ্ধাত্রীর দেওয়া টিভি, রেডিও বা খবরের কাগজের খবরে বোষ্টমীর চিরকালই ভরসা।   

-বলছে তো আরো দিনদুই ঢালবে। আজকের কাগজেই তো দিয়েছে দেখলুম। বঙ্গোপসাগরে দুটো নিম্নচাপ পরপর।
-আঁ? 
-বলছি, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। ইয়ে মানে, ওই পুরীর সমুদ্রে নিম্নচাপ। সেজন্যই। আরো দিনদুই লাগবে কাটতে।
-নিওচাপের মুকে আগুন! ধরণ হলে বাঁচি। ঢেলেই চলেছে। নদীর যা ফোঁসানি, বড়বাঁধ দে যেতে ভয় করে। - মুখতুলে ফের ঘন হয়ে আসা মেঘের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বোষ্টমী।

অনেক চেষ্টা করেও বোষ্টমীর এই নিম্নচাপকে 'নিওচাপ' আর বোষ্টমীর ছোটমেয়েটার গ্রেফতারকে 'গ্রেপতাপ' বলা ছাড়াতে পারেননি জগদ্ধাত্রী। বোষ্টমীর ছোটমেয়ে আশা জরিপাড় লাল সিন্থেটিক শাড়ি আর ফিনফিনে হার-চুড়ি-চন্দনে সেজে পোঁটলা হয়ে শ্বশুরঘর করতে যাবার আগে যে কদিন ইস্কুল গিয়েছিলো জগদ্ধাত্রীই তাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন। সময়টাও কাটতো। তা সেও আজ কতদিন আগেকার কথা। সেই সিকনি ঝরা আশা সেদিন কোলে একটা আর হাতে একটাকে ধরে বাপের বাড়ি থেকে ফিরে যাবার সময় বাসস্ট্যান্ডে দেখা হতে -'জ্যাঠিমা ভাল আছো তো' বলে ঢক করে প্রণাম করতে প্রথমটা চিনতে পারেননি জগদ্ধাত্রী। নীলের পুজো দিয়ে শিবমন্দির থেকে দুপুর রোদে মাথায় কাপড় চাপা দিয়ে হন হন করে ফিরছিলেন তিনি।   
 -নদীর কথা কি বলছিলে দিদি? জগদ্ধাত্রী জিজ্ঞাসা করেন বোষ্টমীকে। জগদ্ধাত্রীরও আশেপাশের দরকারি, অদরকারি সব খবরের যোগানদার এই বোষ্টমী। 
-অই শুক্কুরবারে বড়বাঁধ দে আসতেছিলুম তাই বলছি। নদী কী ফুঁশতেছে দিদি কি বলব! ওই গোবদ্দনপুরের বাজারের কাছে একটা বাঁশের সাঁকো ছিল নি? সেটা তো এগবারে দুভাগ হয়ে ভেঙে ভাসতেছে। বাঁধের তলা আবার ভাঙছে নাকি বলছে। সেদিন তো দেকলুম বালির বস্তার টেরাক এসতেছে বাঁধের ধারে ফেলাবে বলে। 
-সেকি গো! আবার! গেল বারেই তো শুনলুম বাঁধছে ভাল করে বাঁধটা। ওই গোবর্ধনপুরেই তো? এবছর আবার ভাঙছে কি গো? গলার ভয়টা বেরিয়ে আসে জগদ্ধাত্রীর। 
-তাই তো দেকলুম। তুমিও যেমন, গেলবার বেঁধছিলো বলে এবছর আর ভাঙবেনি? ওই বালির বস্তার কটা বাঁধের তলায় যাবে আর কটা কোন কোন গুদোমে যাবে দেকো। আবার দাঁত বের করে হাসে বোষ্টমী।
তাও ঠিক। এ তো জগদ্ধাত্রীরও অজানা কিছু নয়। 
-আবার শুননু হাজরাদের মেজছেলটা, ওই যে গো পোসেন, ওই যেটা আজকাল ভটভটি লিয়ে ঘুরে বেড়ায়, উ নাকি বড়বাঁধের পাঁচ কিলোমিটার না কত যেন কন্টাক্টারি লিছে। ওই জন্যি বলক ওপিসে যাচ্ছে-এসছে কদিন দেখি। 
কথাবার্তার মোড় আবার অন্যদিকে ঘুরছে দেখে জগদ্ধাত্রী বলে ওঠেন, বাব্বা, তুমি তো অনেক খবর রাখো দেখি। কে ব্লক অফিসে যাচ্ছে, কোথায় কন্ট্রাক্টারী পাচ্ছে,  এত খবর পাও কোথায়? তুমিই বা বড়বাঁধে গিয়েছিলে কেন? 
-কানে আসে দিদি। নিমাই সেদিন ঘরে বৌকে বলতেছিলো শুননু। বড়বাঁধে গিইছিলুম বলতে-

বলতে বলতেই চড়বড় চড়বড় করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। 
-এই রে! ওই শুরু হলো আবার। এসো এসো ঘরে ঢুকে এসো। ভিজবে যে। এই একটু থেমেছে দেখে জামাকাপড় কটা উঠোনের দড়িতে দিলুম! আবার সব ভিজল বোধহয়। উঠে এসো দিদি ভেতরে। -বলতে বলতে দুর্দ্দাড়িয়ে ভেতরের উঠোনপানে ছুটতে থাকেন জগদ্ধাত্রী। শাক আর পেঁপের ঝুড়িটা রোয়াক থেকে তুলে নিয়ে জলের ছাঁট বাঁচিয়ে দরজার কোণে রেখে নিজেও দরজার ভেতরে ঢুকে দাঁড়ায় বোষ্টমী। এ বাড়িতে তার সংকোচ কিছু নেই। একসময় এই বাড়িতে তার দুবেলা যাতায়াত ছিল। বয়সকালে ঘোড়ার মত খাটতে পারত সে। নিজের চিলতে ডাঙা জমির সবজি চাষ, গরুর কাজ, বাড়ির রান্নাবান্না, পরিস্কার-ঝরিস্কার সামলে পরের জমির বীজতলা ফেলা, ধান রোয়া, ধান কাটা, আগাছা নিড়েন দেওয়া থেকে শুরু করে, পুকুরে গুগলি কাঁকড়া ধরে বাজারে বিক্রি আবার দরকারে বাড়ি বাড়ি ধানসেদ্ধ, চিঁড়ে-মুড়িভাজা, ধান-গম ভাঙিয়ে দেওয়া কি করেনি সে! তবে এটাও ঠিক যে একমাত্র এই বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িতে গিয়ে এঁটো বাসন মাজেনি। জগদ্ধাত্রীর সাথে কি তার আজকের সম্পর্ক! সেই কবে থেকেই দুজনেই দুজনকে দিদি ডাকে। দাদা মানে এবাড়ির কত্তার মাঝে মাঝে নাইট ডিউটি থাকলে সে এসে থেকেচে রাত্তিরে জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে। তারপর বয়স বেড়েছে দুজনেরই। শরীর ভেঙেছে। আর ওই খাটুনি খাটতে পারে না বোষ্টমী। নিমাই চায়ও না সে আর কারো বাড়িতে কাজ করুক। তাই এই আনাজপাতি চাষ আর ঘরের গরু-বাছুরের কাজ নিয়েই থাকে এখন বোষ্টমী। তবে এক দুদিন ছাড়াই কলাটা-মুলোটা নিয়ে কখনোবা এমনিই চলে আসে সে এবাড়িতে। বেচাকেনাটা তো অছিলা। হাতের গামছাটা ঝুড়ির ওপর বিছিয়ে দিয়ে দরজা থেকে সরে এসে দাওয়ায় উঠে বসে বোষ্টমী। এখানে জলের ছাঁটটা কম। বসে বসে এদিক ওদিক চোখ বোলাতে থাকে। 

উঠোন থেকে কাপড়জামা কটা তুলে পুঁটুলি করে নিয়ে আসেন জগদ্ধাত্রী। -দেখো দিকি আর একটু থাকলেই শুকিয়ে যেত। এই এক হয়েছে আমার এই ভিজে কাপড় নিয়ে একবার করে তোলো আর পাড়ো। - নিজের মনেই গজগজ করতে করতে ঘেরা দুয়োরে টাঙানো দড়িতে মেলে দিতে থাকেন। 

-ডোঙাটা আর চলবেনি দিদি। এবার দাদাকে বল পাল্টে লিতে। টিনের চালের জল যাওয়ার টিনের ডোঙাটা সত্যিই পুরোনো হয়েছে। এদিক ওদিকের ফুটো দিয়ে জল ছিটকোচ্ছে দুয়োরে। সেদিকে চোখ পড়েছে বোষ্টমীর। 
-হ্যাঁ ওটা এবার বদলাতে হবে। তুমি উঠে এস তো ঘরে। এ যা নেমেছে, এখন থামবে বলে মনে হয়না। একটু চা করি। 
-না না আর চা খাবুনি এখন। অনেক বেলা হলো। 
-আরে দূর! দু চুমুক চায়ের আবার বেলা! বোসোতো! এই বৃষ্টিতে যাবেই বা কোথায়?
বোষ্টমী শাকের ঝুড়িটাকে দরজার থেকে তুলে দাওয়াতে রেখে নারকেল দড়ির পাপোষে পা দুটো ঘষে ঘষে মুছে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বসলো। জগদ্ধাত্রী এবার শোবার ঘরের জানলার পাল্লাগুলো ধুপধাপ করে বন্ধ করে এসে গ্যাসে চায়ের জল চাপালেন। 
-বড়বাঁধের দিকে কেন গিয়েছিলে বললে না তো? - যেখানে শেষ হয়েছিল কথাটা সেখান থেকেই শুরু করলেন ফের কথাটা। -বড়বাঁধকে গিইছিলুম বলতে, হাটকে গিইছিলুম শুক্কুরবারে। একটা মুগরী কিনলুম। দুটো লুবো ভেবছিলুম, যা দাম হাঁকছে বাব্বা! আর এই দুটো হাতপাখা এইসব। পাখাগুলোন সব ছিঁড়েকুটে দিছে লাতিটা। 
-আবার মুগরী? কোথায় বসাবে ? 
- এই শ্মশান মাঠের কালভাটকে একটা বোস করি দুবো। আর বছরের পুরানো একটা মুগরী আছে। একটু ভেঙে ভুঙে গেছে ও কঞ্চি দড়ি দিয়ে একটু সোর্ করে লিলেই আবার বোস করানো যাবে। ওই বাঁশবনের পাশের ডোবাতে লাগি দুবো। প্রচুর কৈ- তেলাপিয়া আছে ডোবাটাতে। যা দু-একটা পড়ে। লাতিটার খাওয়ার মতন। 
-তা তোমার উঠোনে এবার কৈ মাছ ওঠেনি হাজরাদের পুকুর থেকে? 
গলাটা এবার নামিয়ে নেয় একটু বোষ্টমী। - আরে বুড়ো সত্যি মাছ ছেড়ছিলো গো। কৈ তো জল হলেই উঠছে। সেদিন বৌমাও ধরছে চারটে গামছা চাপা দিয়ে বাখুল থিকেই। আর ওই পেটমোটা মাছগুলা গো, আম্রিকান রুই না কি বলে জানিনি বাবা! সেই পেইচি দুদিন। কালো কালো ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসে বোষ্টমী।  
-শ্মশান মাঠের কালভার্টে মুগরী বসালে কেউ কিছু বলবে না? জিজ্ঞাসা করেন জগদ্ধাত্রী।
-বললে তখুন আর বসাবুনি। হেব্বি চুনো মাছ যাচ্ছে মাঠকে। রোজ দেখতিছি তো। সেজন্যিই তো কুঁচো মাছের মুগরী লিয়ে এলুম হাট থিকে। ডাঁরাও না মুগরী উঠলেই লিয়ে আসব তোমার জন্য। বোষ্টমী জানে জগদ্ধাত্রী শুকনো শুকনো চুনো মাছের ঝাল দিয়ে গরম ভাত খেতে বড় ভালবাসেন। চোখে একটা হালকা আদরমাখা হাসি আর মুখের রেখাগুলো নরম হয়ে এসেছে বোষ্টমীর জগদ্ধাত্রী লক্ষ্য করলেন। দুজনের লেখাপড়া, পয়সাকড়ি, সামাজিক অবস্থানে অনেকটা বিভেদ থাকলেও দুজনে একসঙ্গে অনেককটা দিন কাটিয়েছেন। কতদিন দুজনে রোদে পিঠ দিয়ে বসে এতোল-বেতোল গল্প করতে করতে শুকনো চুনো মাছের ঝাল দিয়ে গরম ভাত খেয়েছেন আগে। জগদ্ধাত্রীও জানেন শুকনো শুকনো চুনো মাছের ঝাল দিয়ে গরম ভাত বোষ্টমীরও বড় প্রিয় খাবার ছিল। সেজন্যই আর কথা বাড়ালেন না। জগদ্ধাত্রী জানেন কোথায় থামতে হয়। 
-এই দেখো জল ফুটে মরে গেল বোধহয়।- বলে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। 

-দাদা কোথায় গো? দেখছিনি যে? বোষ্টমী প্ৰশ্ন করে। 
-সে তো সেই সাতসকালে বেরিয়েছে স্কুলের কমিটির কিসব মিটিং আছে তারপর কাগজ পত্তর সব জমা দিতে যাবে জেলা অফিসে। তার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হবে মনে হয়। নতুন বিস্কুটের প্যাকেটটা কেটে চ্যাবনপ্রাশের খালি হয়ে যাওয়া কৌটোয় বিস্কুটগুলো ঢালতে ঢালতে রান্নাঘরের ভেতর থেকেই জবাব দেন জগদ্ধাত্রী।
- বাবা এই জলের মধ্যিই যেতে হলো? সকাল থিকেই তো ঝরতিছে। কাল পরশু গেলে হতনি? খুকখুক করে কাশতে কাশতে বলে চলে বোষ্টমী। 
-কি বলবো বোলো? বর্ষাতি পরে চলে গেল ঢনঢন করে। কথা শোনার মানুষ কি সে? জানোই তো। এ নাও।  - দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দেন জগদ্ধাত্রী বোষ্টমীর দিকে। 
-আবার বিস্কুট খাবো? 
-আরে ধরো তো। চা টা ছাঁকি গিয়ে। 
-আচ্ছা একটা দাও। হাত বাড়িয়ে বিস্কুটটা নেয় বোষ্টমী।
চায়ের জল ফুটে গিয়েছিলো। চট করে একটুকরো আদা কুরে সরাসরি ফুটন্ত জলের মধ্যে ফেলে দিলেন জগদ্ধাত্রী। কাশছে বোষ্টমীটা। এই জলকাদায় গলায় আরাম পাবে। চা পাতা দিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে চাপা দিয়ে দিলেন সসপ্যানটা।          
-রান্নাবান্না হয়ে গেছে,ও দিদি? কি রাঁধলে ? বিস্কুট চিবোতে চিবোতে রান্নাঘরের বাইরে থেকে প্রশ্ন করে বোষ্টমী। 
-এই চালে ডালে বসিয়ে দিয়েছি দিদি। একচিমটে ঘি ছিটিয়ে হয়ে যাবে। আজ তো একা খাবো। তার জন্য আর...  চা ছেঁকে দুটো কাপ দুহাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন জগদ্ধাত্রী। বোষ্টমীর কাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন তোমার বৌমা কি রাঁধলো গো? 
-কে জানে কি রাঁধছে? কলমি দু- আঁটি ঘরকে রেখে আসছি। তাখে করে বা কি। আমি তো সকাল থেকে গরুর ঘাস করতেছিলুম। গোরুগুলা তো কদিন বেরোতে পায়নি নয়। হাত বাড়িয়ে কাপটা নেয় বোষ্টমী।
-এবার আর গরু টরু বাদ দাও দিদি। এই জলকাদায় ডুবে ডুবে ঘাস করা! বয়সটা তো বাড়ছে নাকি? রান্নাঘরের বাইরের মোড়াতে বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলেন জগদ্ধাত্রী। 
-আহ আদা দিয়েছো নয়? চায়ে চুমুক দিয়ে আরামের শ্বাস ছাড়ে বোষ্টমী। তারপর বলে- আর কি করি বোলো? ওই লিয়েই তো আছি। ঘরের দুধটুকুন তো হয়ে যায় বলো। আর রান্নাবান্না বলতে নেই আমায় দেখতে হয়নি। বৌমাই করে যা করার। আর গরু কি আমার আজকের বোলো। নিমাইয়ের বাপ্ বলতো রাত্তিরে গা থিকে আমার গোবরের গন্দ ছাড়ে। 

দুই সমবয়সী প্রৌঢ়া কিশোরীর মত হাসতে থাকে চায়ে চুমুক দিয়ে। 

চায়ের কাপে বড়সড়ো একটা চুমুক দিয়ে বলেন জগদ্ধাত্রী, নিমাই কখন আসে খেতে? 
-তার এসতে করতে রোজ আড়াইটে। তিনটের আগে ভাত নামেনি গলা দিয়ে। তবে আজগে বোধয় শিগগির করে এসবে। আজগে মিটিন আছে এগারোটা থিকে। সেখেনকে গেছে। মিটিন আর কতক্ষণ হবে? 
বৃষ্টির তেজ খানিক বেড়েছে। এই ঝরঝর করে ঝরছে। কিছু পরেই কমে যাবে। আবার কিছু পরে গুমগুম করে মেঘ বাজিয়ে ধেয়ে আসবে। বোষ্টমীর ছেলে নিমাই আজকাল স্টেশন রুটের বাসে হেল্পারী করে। মাঝে মাঝেই ভাড়া বাড়া, রাস্তা সারাই, মাইনে এসব নিয়ে স্টেশনের পাশে বাসডিপোতে মিটিং মিছিল লেগেই থাকে। বাস বন্ধও হয়ে যায় প্রায়শই। কিসব প্রতিবাদ টতিবাদ! সেসবই কিছু হবে। নদীর স্রোতের মত জলের ধারা যাচ্ছে জগদ্ধাত্রীর উঠোন দিয়ে। সেইদিকে তাকিয়ে আলগা প্রশ্ন করেন জগদ্ধাত্রী, কিসের মিটিং গো?
-বাস নাকি উঠে যাবে বলতিছে গো দিদি। মালিকদের লোসকান হচ্ছে নাকি। গলাতে স্পষ্ট উদ্বেগ ধরা পড়ে বোষ্টমীর।
-সে কি গো? উঠে যাবে মানে? 
-হ্যাঁ গো তাই তো বলতেছিলো নিমাই। তাই নিয়েই মিটিন হচ্ছে। বাস মালিকরা অন্য রুটে তুলে লিয়ে যাবে বাস। এখানকে লস হচ্ছে। ট্যাকাপয়সা লিয়ে ঝামেলি, দেয়নি তো ঠিক করে। সেদিনকে মালিকদের সঙ্গে হেল্পার, কন্ডাক্টারদের সে কি ঝামেলি বাপরে! সে মারপিট লাগে লাগে। গেল হপ্তায় তো ওই করেই দুদিন বাস বন্দ ছিলোনি?
এত কথা জগদ্ধাত্রীর জানার কথা নয়। বাড়ি থেকে বেরোনো মানে তাঁর মন্দির বা টুকটাক দোকান বাজার। খুব দরকার ছাড়া বাসে ওঠবার প্রয়োজন পড়েনা তাঁর। এই গ্রামের সাথে স্টেশনের একমাত্র যোগাযোগের ব্যবস্থা এই কটা লড়ঝড়ে বাসই। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় যার একটা করে এই রাস্তায় এমুখো ওমুখো চলার কথা। কিন্তু প্রায়শই নানা ছুতোয় কোনো একটি যদি বন্ধ থাকে তবে পরের ঘন্টার বাসটিতে ওঠা দায় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত জগদ্ধাত্রীর মতন মানুষদের পক্ষে। কিন্তু সে বাস একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামটি আক্ষরিক অর্থেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সে উদ্বেগটাই ফুটে উঠলো জগদ্ধাত্রীর গলায়।
-একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে কি গো? মানুষ আসবে যাবে কি করে? এ আবার কি কথা?
-ছোট অটো আর ওই ট্যাকার নাকি বলে বলোনা? ওই যে গো আনাজপাতি লিয়ে যায় জিপগাড়ির মতন? সেই নাকি চলবে।
-ও ট্রেকার?  জগদ্ধাত্রী খানিক স্বস্তি পান। তাই বলো। একেবারে সবকিছু বন্ধ করে দিলে কি করে চলবে? 
-ডাঁরাও কি হয় আজগে মিটিনে। নিমাই আসলেই বুঝা যাবে। তবে ছোট গাড়ি তো হেব্বি ভিড় হবে। এই যা। 
-সেতো হবেই। ঘন ঘন চালাতে হবে। নিমাই কি করবে তাহলে? ঠিক পরের প্রশ্নটিই মাথায় আসে জগদ্ধাত্রীর। 
-সে বাসে হেল্পারি করত এখন ট্যাকারে হেল্পারি করবে। কতাবাত্তা বলেছে বললো তো। দেখি কি বলে আজগে এসে। অয় গো জল ধরে এসতেছে। এই তালে পাইলে যাই। এই বলে কাপের তলানি চায়ে চোঁ করে একটান দিয়ে উঠে পড়ে বোষ্টমী। 

বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে সত্যিই। দুজনেরই চায়ের কাপ খালি হয়ে গিয়েছিলো। কাপদুটো নিয়ে গিয়ে কলপাড়ে নামিয়ে রাখে বোষ্টমী। তারপর জগদ্ধাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে - আসিগো আজ দিদি। 
-আর একটু দাঁড়িয়ে যাও দিদি। আর একটু কমুক। ভিজে যাবে যে।  - জগদ্ধাত্রী বোষ্টমীর পিছনে পিছনে নেমে আসছিলেন দুয়োর থেকে।
-ধরেই এসতেছে। তুমি আর নেমোনি এই জলে। পিছন পিছন দুয়োর থেকে নেমে আসা জগদ্ধাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে বোষ্টমী। 
-আচ্ছা তাহলে দাঁড়াও ছাতা দিই একটা। জগদ্ধাত্রীর গলায় উৎকণ্ঠা।
-দূর! তুমি থামোতো। আবার ছাতা কি হবে? উ গামছা মাথায় দিয়ে হনহন করে চলে যাবখন। গিয়েই তো চানে যাব। একটুস ভিজলেই বা কি?  মুগরী ঝাড়লে কাল পরশু আসবোখন আবার। দরজাটা দিয়ে দাও।  
-এস তাহলে। কি আর বলবো বলো ! 

ঝুড়ি থেকে গামছাটা নিয়ে মাথায়-গায়ে চাদরের মতন জড়িয়ে নেয় বোষ্টমী। তারপর ঝুড়িটা কাঁকালে তুলতে তুলতে কি ভেবে জগদ্ধাত্রীর মুখের দিকে তাকায় একবার। জগদ্ধাত্রীও বোধহয় এই দৃষ্টিটারই অপেক্ষা করছিলেন। কোন ভেতর থেকে অস্ফুটে তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি বাক্য, নাকি প্রশ্ন -"বাস তাহলে সত্যিই বন্ধ হলো এতদিনে দিদি?"  

বোষ্টমীও বুঝি বুঝেছিলো এরকমই কিছু বলবেন জগদ্ধাত্রী। বাঁ কাঁকালে ঝুড়িটাকে ধরে ডান হাত দিয়ে জগদ্ধাত্রীর বাম কাঁধটা স্পর্শ করে বোষ্টমী। তারপর কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ। ডানহাতের চাপে জগদ্ধাত্রীর কাঁধটা প্রায় খামচে ধরে সে। দুজনেরই চোখে অপার এক শূন্যতা। কী যেন চিরতরে হারিয়ে ফেলার অসহায়তা। জগদ্ধাত্রীর ডান হাতটা যেন অজান্তেই উঠে এসে জাপটে ধরতে চায় বোষ্টমীর ডানহাতটিকে। 

পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে জগদ্ধাত্রীর ডান হাতটা বোষ্টমী। একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ছেড়ে বলে বলে- আর কি করবে বলো? উপরওয়ালা যেমন চাইবেন! যাও দিদি ঘরে যাও। জলে ভিজোনি। দরজাটা লাগিয়ে দাও। আমি আজ এসি? আবার এসবো। 

এই কয় সেকেন্ড জগদ্ধাত্রীর একমাত্র নির্ভরতা যেন ছিল ওই একগাছি ব্রোঞ্জের চুড়ি পরা বোষ্টমীর শীর্ণ তামাটে হাতটাই। কোন অতীত থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনে এবার ছেড়ে দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন -এসো দিদি। 

কাঁকালে ঝুড়ি নিয়ে কমে আসা বৃষ্টির মধ্যে পায়ের পাতা ডোবা  লাল মোরাম ধোয়া জল ছপছপ করতে করতে ফিরছিলো বোষ্টমী। বৃষ্টির ফোঁটা তার মাথার গামছা বেয়ে নেমে তার চোখের পাতা ধুয়ে দিচ্ছিলো ভাগ্যিস! হলোই বা সে আজ এত বছর আগের কথা, হলোই বা সে তার নিজের মেয়ে ছিল না, তবুও জগদ্ধাত্রীর কোলের সেই টুকটুকে পুতুলটা যেদিন জগদ্ধাত্রীরই সঙ্গে বড় রাস্তায় বেরিয়ে হাত ফস্কে বাসের চাকার তলায় চলে গেছিলো সেদিন থেকে কি তারও একটা পাঁজর খসে পড়েনি? পাক্কা তিনমাস পর আর কোনো উপায় না দেখে বাক্যিহারা প্রায়োন্মাদ জগদ্ধাত্রীর কোলে নিজের ছোট মেয়ে আশাকে ঠুকে বসিয়ে দিয়ে বলে এসেছিলো সে, এ রইলো তোমার কাছে দিদি। দেখলে তুমি দেখবে, নইলে মরবে। তোমায় দিয়ে গেলুম। কিছু না বুঝে হাঁ করে কাঁদছিলো সেদিন ছোট্ট আশাটা। তবুও সে ফিরে তাকায়নি মেয়ের দিকে। আশার বয়সীই তো ছিল সে। অনেক সময় লেগেছিলো বোষ্টমীর আবার জগদ্ধাত্রীর বাইরেটা অন্তত গুছিয়ে দিতে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছেন জগদ্ধাত্রী। বোষ্টমীর কাছে জগদ্ধাত্রীর দায়িত্ব দিয়ে এবাড়ির কর্তা বাইরেটা সামলেছেন। আর বোষ্টমী বুক দিয়ে আগলে রেখেছে জগদ্ধাত্রীকে। তবুও আজকের মত এ-কথায় ও-কথায় মাঝে মাঝে ক্ষতটা বেরিয়ে এসেছে যখন, দুজনেই দুজনকে ধরে সামলেছে। আজকের মতোই। 

কিসের যে বন্ধন? কিসের যে টান জানে না কেউই। তবুও সেই যে সেই কবে সে একরত্তি এক মেয়ে নিজে চলে গিয়ে এই দুই আপাত অসম দুই নারীকে চিরদিনের জন্য বেঁধে দিয়ে গেল, তা এই দুই প্রৌঢ় নারীর পরম নির্ভরতা, পরম বন্ধন হয়ে বেঁচে রয়ে গেল আজও।  

মেঘটা জমেছে আবার উত্তরে। বৃষ্টি বাড়ছে। মাথা বেয়ে, চোখ বেয়ে জল নামছিলো বোষ্টমীর। বৃষ্টি আর চোখের জল মিশে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো বারবার সামনেটা। গামছা বেয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে বোষ্টমী। পায়ে পায়ে পথ পার হয়ে ফিরে চলছিল। বোষ্টমীর ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও তো ফিরতে হয়। চাইলেই কি আর সবটুকু আঁকড়ে থাকা যায়?   

অর্পিতা চ্যাটার্জী 
   

Friday, 8 May 2020

অন্য শহর


লাস ভেগাসের রাস্তায় ব্রহ্মা মন্দির।

প্রায় দুশো লোকের সাথে সিগন্যাল পেলে একসাথে রাস্তা পার হবার জন্য একটা ব্যস্ত রাস্তার ধারে জেব্রা ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে ছিলাম। পায়ে হাঁটার সিগন্যাল হতেই একসাথে পা বাড়ালাম রাস্তায়। এত লোকের সাথে পা ফেলে রাস্তা পার হতে গিয়ে দুটি অনুভূতি মন ছুঁয়েই বেরিয়ে গেল। আমার মত মানুষের জন্য ওমাহার মত শান্ত শহরই ভাল। লোকজনের ভিড় নেই। অনর্থক চঞ্চলতা নেই। তাই এত লোকের সাথে একসাথে পথ পার হবার সুযোগও নেই। এতো গায়ে গা লাগানো ভিড়ে মন তিক্ত হয়ে যেতেই পারত। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিলো আমার মন। আমার ভাল লাগছিলো সবার সাথে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে। আমার ভাল লাগছিলো এত লোকের মাঝে 'কেউ না' হয়ে, ভিড়ের অংশ মাত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, পথ পার হতে। এই যে অন্তত দুশো লোক আমার ডাইনে-বাঁয়ে, আগু-পিছুতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কাউকে আমি চিনি না। তারাও আমায় চেনে না। অথচ সকলে একটি নির্দিষ্ট সিগন্যালের দিকে চোখ রেখে অপেক্ষা করছেন। একসাথে হেঁটে রাস্তা পার হবেন বলে। রাস্তাটুকু পার হয়েই হয়তো এই দুশো লোকের পুরো 'ভীড়'টা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যাবে।তবুও এই অচেনা মানুষের ভিড়ের সকলের আপাতত গন্তব্য একই। রাস্তার ওই ওপারে যেখানে আরো একদল লোক অপেক্ষা করছে সিগন্যাল পেলেই এপারে আসবে বলে, সেই সেখানটায় পৌঁছানো। আমাদের জীবনের মতন না অনেকটা? কিছুদিনের জন্য ছোট্ট একটা রাস্তা পার হবার জন্য অপেক্ষা। আশে পাশের লোকজনের সাথে আদান প্রদান, মান- অভিমান তারপর রাস্তা পার হবার পর গন্তব্য বদলে যাওয়া। এই যে এত লোক আমার আশেপাশে তারা সকলেই আমার অচেনা। মাঝে মাঝে অচেনা লোকের সাথে অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজের অপরিমেয় "কেউ না" হওয়ার সত্যিটা নতুন করে উপলব্ধি হয়। আমার যা কিছু চাওয়া-পাওয়া- মান-অভিমান, আমার যা কিছু গুরুত্ব, আলাদা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার যা কিছু অন্য কারো কাছে এতটুকুও গুরুত্বপূর্ণ সেরকম মানুষের সংখ্যা গুনতে হাতের এক-দুইটি আঙুলের করই যথেষ্ট। আমরা জানি বা না জানি, মানি বা না মানি, পৃথিবী সুদ্ধ বাকি প্রতিটা লোকের কাছে আমি ভিড় মাত্র। জনবহুল রাস্তার আরো একজন মানুষ। এইটি মনে হলে নিজের প্রতি নজর খানিক কমে। এই যে এত লোক আমার গা ঘেঁষে আমার কাছে তো তারা ভিড় মাত্র। কিন্তু প্রতিটা অবয়ব, মন, অনুভব, হাসি কান্নার কারণ সব আলাদা। তাদের কাছে আমিও তো তাইই। এই কদিনে এই অনুভুতিটা বেশ হচ্ছে।
গত কয়েকদিন লাস ভেগাসে এসেছি। লোকজনের কথায় অবশ্য বুঝেছি, এখন 'লাস ভেগাস' -র জায়গায় 'ভেগাস' বলাটাই স্মার্টনেস। তা সে যাই হোক, আলোর আর হুল্লোড়ের শহর। যে বয়সে লোকে লাস ভেগাস যেতে পেলে মনে মনে নাচতে শুরু করে আমি সে বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন আগেই। এখানে এসে অবশ্য প্রতিপদে লোককে বলতে শুনছি -"Ultimately it's Vegas." এবছর Society for Redox Biology and Medicine (SfRBM) বার্ষিক সম্মেলন হচ্ছে এখানে প্ল্যানেট হলিউড রিসোর্টে। প্রতিবছরেই এই সম্মেলনে আমরা আসি। কারণ রেডক্স বায়োলজির এটিই আপাতত সবচাইতে বড় সম্মেলন। এখানেই সমস্ত রেডক্স বায়োলজিস্টরা জড়ো হন। আইডিয়া আদান প্রদান করেন। আমরাও আমাদের কাজের ঠিক ভুল বুঝে নিই। তাই লাস ভেগাস যাবার আলাদা করে উৎসাহ কিছু ছিল না। যেটা ছিল সেটা হলো, এবছর এই দিন চার-পাঁচদিনের পুরো সময়টা আমার নিজের। এইটা আমার কাছে কম বড় পাওনা নয়। সাধারণত এই সম্মেলনে এতদিন আমি আমার গাইডের সাথে এসেছি, থেকেছি। শেষ দিনে হয়ত পিনাকী গেছে। সম্মেলনের পরের এক-দুই দিন সেই নতুন শহরে হেঁটে বেড়িয়েছি। কিন্তু এবছর আমার গাইড আসেননি। পিনাকীও আসবে না। সুতরাং কারো সময়ের সাথে আমার সময় মেলাবার দায় নেই আমার। উপরোন্তু যখন শুনলাম আমার সাথে থাকছে অন্য প্রদেশের, অন্য ইউনিভার্সিটির সম্পূর্ণ অচেনা একমেয়ে, আমার ভালো বৈ মন্দ লাগলো না। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের কাছে বসে তার কথা শুনতে বড় ভাল লাগে। কারণ সে মানুষ আমায় বিচার করবে না। করলেও সে বিচারে আমার কিছু যাবে আসবে না। তাকে ভালো লাগলে, তার কাছে আমার মন আলগা করে দিতে পারলে, সে আমার নিত্যদিনের দৈনন্দিকতায় নতুন মানুষ। আর ভাল না লাগলে তার সাথে সময় কাটাবার দায় আমার নেই। তাকে এড়িয়ে সম্পূর্ণ নিজের মধ্যে ঢুকে গিয়ে সময় কাটাতে আমার কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না।
সুতরাং লাস ভেগাসে এসে যখন নামলাম তখন খানিকটা ছুটির দিনে কোনো পূর্বনির্ধারিত কাজ ছাড়া অনেক ভোরে সতেজ হয়ে ঘুম ভাঙার মতন একটা অনুভূতি হলো। হাতে অনেকটা সময় আর অনেকদিন ধরে করতে চাইছেন মনের মত এমন অনেক পড়ে থাকা কাজ আছে। কিন্তু আজই শেষ করতে হবে এমন কোনো তাড়া নেই। আবার শেষ করে ফেলতে পারলে বেশ একটা শান্তি আসে মনে। একা নিজের সময় নিজে নিয়ন্ত্রন করার বেশ একটা সুযোগ পেয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে লাস ভেগাসে এয়ারপোর্ট থেকে ল্যাবের আর দুইজনের সাথে প্ল্যানেট হলিউডের ঠিকানায় পৌঁছালাম। বেশিক্ষণের রাস্তা নয়। উবেরের ড্রাইভার আমাদের দেখে লাস ভেগাসের বড় বড় শো গুলির কথা জানাতে লাগলেন। আমি কোনোদিন আসিনি। আমাদের মধ্যে একজনই আগে বার-তিনেক এসেছে। আসলে এদেশে ছেলেপুলেরা প্রথম চাকরি বা পিএইচডি করতে এসে এখানে একবার করে আসেই। হুল্লোড়, গাঁঞ্জা, খোলা যৌনতার আর জুয়ার পীঠস্থান। তবে পুরোটাই নিপুন ভাবে কন্ট্রোলড। কোথাও কোনো বাজে ঝামেলা বিশেষ হয়না। তবে এই এত লোকজন আর এত শব্দ চারিদিকে সে বিষয়ে আমার একটা ভাল না লাগা ছুঁৎমার্গ ছিল। ছিল বলবো না, বলা ভাল আছেই। এখনো কোনো খোলা আকাশের নিচে নির্জন কোনো জায়গাকে আমি একবাক্যে বেশি ভোট দেব যেকোনো হুল্লোড়ে শহরের থেকে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নিজেকে ভিড় বানিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ছাড়াও লাস ভেগাস আমায় আর কিছু দিয়েছে। সেটি হলো পারিপার্শ্বিকতাকে অস্বীকার করে মুহূর্তে নিজের খোলসে ভেতরে ঢুকে গিয়ে হুল্লোড়ের মধ্যেও শান্ত থাকার একটা প্রাথমিক পরীক্ষাস্থল।
মাঝে মাঝে নিজেকে ভাল না লাগা জায়গায় ফেলে দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কতটা পারিপার্শ্বিকতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, ভীষণ রকম একটা হুল্লোড়ে জায়গায় বসে নিজেকে একটা অদৃশ্য বুদ্বুদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতে পারি তার একটা পরীক্ষা করতে ইচ্ছে করে। মানে কমফোর্ট জোনের বাইরে বসে মনটা বরফশীতল রাখার একটা চেষ্টা মনে করতে পারেন। প্ল্যানেট হলিউডে চেক ইন করে সন্ধ্যেবেলা যখন বাইরের রাস্তাটায় হাঁটাহাঁটি করব বলে ক্যাসিনোর ভেতর দিয়ে হেঁটে বেরোচ্ছি, তখন মনে হলো এই মানসিক এক্সসারসাইজটা করার জন্য এর চাইতে ভাল জায়গা আর দুটো হয়না। প্ল্যানেট হলিউড সিজার গ্রূপেরই রিসোর্ট। একদম লাস ভেগাসের বিখ্যাত রাস্তা স্ট্রিপ বা লাস ভেগাস বুলেভার্ডের ওপরেই এর অবস্থান। এই রাস্তাতেই ডাইনে বাঁয়ে পর-পর বিখ্যাত এবং সিনেমাখ্যাত ক্যাসিনোসহ হোটেলগুলো। প্ল্যানেট হলিউডের ক্যাসিনো লেভেল সুতরাং অত্যন্ত জনবহুল, সাথে রয়েছে ক্যাসিনো লাগোয়া নামি দামি খাবারের দোকান। ফলে ভিড়, ক্যাসিনোর উচ্চকিত বাজনা আর হুল্লোড়। কি নেই এখানে! ঠিক করলাম এখানেই বসে লেখার চেষ্টা করব। দেখাই যাক না মনস্থির করতে পারি কিনা। একটু চোখ চারাতেই দিব্যি একখানা স্টারবাক্স নজরে এসে গেল। তার সামনে ক্যাসিনোর প্রাইম জায়গাটা, বাঁয়ে ক্যাফে হলিউড নাম দিয়ে এই রিসোর্টের রেস্তোরাঁ আর ডাইনে বিখ্যাত গর্ডন রামসে বার্গার। সুতরাং মনস্থির করার এর চাইতে ভাল জায়গা আর হয়না। মনে মনে স্টারবাক্সটিকে দাগিয়ে নিয়ে বাকি দুজনের সাথে বেরিয়ে এলাম লাস ভেগাস বুলেভার্ডে।
মানুষ লাস ভেগাসে আসেন এই রাস্তায় হাঁটবেন বলে। এই জনজোয়ারে গা ভাসিয়ে সমস্ত ভুলে আলো আর অলীক সুখ স্পর্শ করবেন বলে। রাস্তার উল্টোদিকেই বেলাজিওর ফোয়ারা। গানের সাথে সাথে সে ফোয়ারার নাচ দেখা হলো। লাস ভেগাসের আলো দেখা হলো। বিখ্যাত হোটেলগুলোর আলো, বহিরঙ্গ আর বৈভব দেখা হলো। যা দেখাতে চায় এরা, আর যা দেখতে আসে মানুষ এখানে। বৈভবের প্রদর্শনীর মত লজ্জা বোধহয় আর হয়না। জানি না হয়তো আমিই ভুল। এই যে চারপাশে এত আলো, এত চাকচিক্য জানিনা আমার বুড়োটে মনের জন্যই কিনা, সেদিকে বিস্মিত-আকুল চোখে তো কই তাকাতে পারছিনা? বরং চোখ চলে যাচ্ছে এই জনসমুদ্রের দিকে। আমার কাছে যারা কেবল ভীড় মাত্র। তাদের কাছে আমি যেমন। অজস্র হাসিমুখ, চকচকে চোখ, অর্ধনগ্ন-অদ্ভুত মেকআপ করা মেয়েদের সাথে ছবি তুলছে। ছবি তুলতে দেওয়ার জন্য এই মেয়েরা টাকা পায়। সাথে তাদের বডিগার্ড যাদের কাজ মানুষকে মাঝে মাঝেই ধমকানো। "No free pictures! No free pictures!" নগ্নতার প্রতি মানুষের কৌতূহল আর খিদে এই মেয়েদের খিদে মেটায়।
এটাই "ভেগাস।" এটাও "লাস ভেগাস।"
হোটেল রিও-র বাফে নাকি খুব বিখ্যাত। জনগণ সেখানেই আজকের ডিনারটা করতে চায়। বাইরে বেরোলে আমার কাছে যাহা রিও তাহাই স্টারবাক্সের স্যান্ডউইচের প্যাকেট। ক্ষিদে মেটার মতন পেটে কিছু পড়লেই হলো। গেলাম। রিও থেকে ফেরার সময় ঠিক হলো হেঁটে ফিরবো। ম্যাপ বলছে পঁয়ত্রিশ মিনিট মত লাগবে। এইটা আমার মনের মত কাজ। মেঘ করেছে আকাশে। হালকা শিরশিরে হাওয়ায় হাঁটতে ভালোই লাগছিলো। হাইওয়ের পাশে ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। মাঝে হাইওয়ের কাটাকুটির জায়গায় পথচারীদের জন্য ফুট ওভারব্রিজ করে দেওয়া আছে। অন্ধকার সেখানে। শহরের আলো চুঁইয়ে এসে যতটুকুনি আলো হয় কি না হয়। সেখানে বাসা বেঁধেছে এক দম্পতি। মানবেতর নয় মানব দম্পতি। আমাদের দেশে ঠিক যেমন হয়। অজস্র পোঁটলা-পুঁটলি, সাথে একটা হুইল চেয়ার। পাশ দিয়ে নির্দ্বিধায় পেরিয়ে গেলাম। যেমন যাই। যেমন গিয়ে অভ্যস্ত! পেরিয়েই একগাদা ময়লা জড়ো করে রাখা। গন্ধ বেরোচ্ছে পচে যাওয়া জিনিসের। যেমন আমাদের নাক আর চোখ সওয়া! হাইওয়ের দূরে লাস ভেগাসের আলোকোজ্জ্বল স্কাইলাইন। কি আলো! কি আলো !
এই ভেগাস! এও লাস ভেগাস!
হেঁটে এসে লাস ভেগাস বুলেভার্ডের স্কাই ব্রিজ ধরে রাস্তা পার হয়ে হেঁটে আসছিলাম সকলে মিলে, কেউ আইসক্রিম খাবে, কেউ পরদিনের ব্রেকফাস্ট কিনবে। কেউ টুথব্রাশ ভুলেছে। সেসব কিনবে।বাইরে বেরোলে এদিক ওদিক লোক দেখা ছাড়া আমার কখনোই বিশেষ কিছু করার থাকে না। সুতরাং আমি লোক দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম। স্বল্পবসনা মেয়েরা পোশাকে, মেকআপে আলো আর চোখে বিরক্তি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তুলে আর চামড়ার বিজ্ঞাপন করে করে চোখে তাদের বিরক্তি জন্মে গেছে বোধহয়। তার মধ্যেই 'ভেগাস' বেড়াতে আসা কমবয়সী ছেলে মেয়েদের উজ্জ্বল পোশাক, চোখে মুখে যৌবনের উচ্ছ্বাস। এদের কাছে 'Sin City' এখনো তার ঔজ্বল্য হারায়নি। ভাল লাগে দেখতে। এই ভিড়েই ভালবেসে ঠাম্মার কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটছেন দাদু। আমার ঠিক সামনেই। খুনসুটিতে ঠাম্মা টোকা মারছেন বহু বছরের সঙ্গীর গালে। তারপর দুজনেই হাসছেন। 'Sin City' হয়ে উঠছে প্রেমের শহর, বহু বছরের নির্ভরতার শহর। হাঁটছিলাম CVS ফার্মাসির পাশ দিয়ে। কষ্ট করে বৃদ্ধ বেরোলেন সেখান থেকে হাতে ওষুধ ভর্তি প্যাকেট। আস্তে আস্তে ভিড় ঠেলে হেঁটে চলেছেন। সিজার প্যালেস, নামকরা হোটেল। এই দেখতে কত লোক আসে। তার পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এদিকে আলো নেই বিশেষ। আটপৌরে দিক এইটা হোটেলের। পাঁচিলের গায়ে সাজানো গাছের বেদিতে একগোছা জ্যাকেট, জুতো, কম্বল একসাথে পুঁটলি বানিয়ে রাখা। বোঝা যায় এখানেই রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। পুঁটলির মালিক অবশ্য তখন অনুপস্থিত।
এই ভেগাস! এও লাস ভেগাস!
পরদিন দুপুরে এইলিভ এসে পৌঁছালো। আমার এই কদিনের রুমমেট। সে টার্কির ইসমির থেকে একবছরের জন্য এসেছে এদেশে কিছু কোলাবোরেটিভ এনিম্যাল এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। পিএইচডি স্টুডেন্ট। তার উচ্চারণ শুনেই মনে হয়েছিল তার পর তার সাথে পরে কথা বলে বুঝলাম। সুন্দর চেহারা আর সেই মতোই চোখা সুন্দরী মেয়েটি। টার্কিশ মেয়েরা যেমন হয়। এইবারের কনফারেন্স এইলিভ আমার আর একটা পাওনা। বড় ভাল লেগেছে আমার মেয়েটিকে। সোজা সাপ্টা , স্পষ্ট ধারণা, স্পষ্ট দার্শনিকতার সোজা মেরুদণ্ডের মানুষ সে। সর্বদা হাসছে। আর অজস্র কৌতূহল আমাদের ধর্ম, স্পিরিচুয়ালিটি আমাদের দেবদেবী নিয়ে। আমি যতটা জানি বলার চেষ্টা করছিলাম। ওর সাথে পরদিন রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। মিরাজের ভলক্যানিক ঝর্ণা দেখেছে সে। আমায় দেখাতে চায়। বললে, চলো তোমায় দেখিয়ে নিয়ে আসি। ঝর্ণা দেখা হয়েছে। কিন্তু ভলক্যানিক শো এর সময় তখন নয় তাই সেটি আর দেখাতে পারেনি মেয়ে। তাই নিয়ে তার ভারী আফশোষ। মনে হলো, আমায় সে কতটুকু চেনে? তবুও ভাল কিছু দেখলে বন্ধু বা বোনের মতো সে আমায় দেখাতে চায়। মনটা ভাল হয়ে যায় এমন অপ্রত্যাশিত পেলে কিছু। এইলিভের সাথে বুলেভার্ডে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিলাম। বেশিরভাগই সে জানতে চায় আমাদের ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে। আমি জানতে চাই তার টার্কিশ জীবন যাপন, রীতি রেওয়াজ সম্পর্কে। আর দুজনেই জানতে চাই আমাদের খাবার দাবারের রেসিপি সম্পর্কে। টার্কির সাথে আমাদের মোঘলাই খানার বেশ মিল। সে অবশ্য থাকাই স্বাভাবিক। এই করতে গিয়ে লাস ভেগাস বুলেভার্ডের একটি অন্ধকার কোণায় আমরা আবিষ্কার করলাম ফুল, ধূপ দিয়ে সাজানো একটি চতুর্মুখ মূর্তি। আমি ভেবেছিলাম বজ্রযানী বৌদ্ধ দেব-দেবী কেউ হবেন। এইলিভ নজর করে বলল, এতো ব্রহ্মা। দেখো লেখা আছে। আমি লাস ভেগাস বুলেভার্ডে ধূপ-ধূনো-ফুল মালা সজ্জিত ব্রহ্মামূর্তি অন্তত আশা করিনি। এইলিভ জিজ্ঞাসা করলে, এটা কি তোমাদের ওখানে ব্রহ্মা-উপাসনার সময়? ব্রহ্ম-উপাসনার তো আমি ছাই জানি। বললুম 'না তো'। আদতে, পুষ্কর ছাড়া ব্রহ্মা মূর্তির পুজো হয় কিনা সেটাই আমার জানা নেই। দুজনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে এগিয়ে চললাম। আসা ইস্তক সে আমায় রাতে শোবার আগে, ক্যাসিনো লাগোয়া স্টারবাক্সে বসে ল্যাপটপে ক্রমান্বয়ে বাংলায় টাইপ করে যেতে দেখেছিল। জিজ্ঞাসা করেই ফেললো আমি কি এত টাইপ করছি। বললুম, কিছু নন সায়েন্টিফিক লেখা লিখতে আমার ভালো লাগে। তাই লিখছি। আর লাস ভেগাস সম্পর্কে লিখলে তাতে তুমি একটা বড় অংশ হয়ে থাকবে। ততক্ষনে এইলিভ আমার ভাললাগা মানুষের তালিকায় এসে গেছে। তাই আমার যে তাকে ভাল লেগেছে একথা জানাতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আনন্দ-ভালো লাগা কখনো চেপে রাখতে নেই। বিশেষত সেই কারণ যদি কোনো মানুষ হয়। তার কাছে সেইটুকু ভালবাসা পাবার জন্য কৃতজ্ঞতা তো নিশ্চয়ই জানাতে হয়। এইলিভ বললে, "Oh thank you! say 'Hi' to your readers from me."
দুই সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ পৃথিবীর সম্পূর্ণ আলাদা দুটি দেশ থেকে এসে একে অপরের দেশ সম্পর্কে জানতে জানতে 'Sin City' তে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ছিলো।
গতকাল রাতে কনফারেন্স শেষ হয়েছে। আজ ভোর চারটেয় এইলিভ চলে গেছে। ওর ফ্লাইট ছিল সকাল ছটায়। ভোরবেলা ওকে নিচে বিদায় জানিয়ে এসে আমি একা ঘরে বসে টাইপ করছি। এবার বেরোতে হবে আমায়ও। লাস ভেগাস থেকে আমার শান্ত শহর ওমাহার দিকে।