Monday, 11 May 2020

সই


-বলি অ দিদি ? কলমি শাক লিবে নাকি?  
-কে? বোষ্টুমী দিদি নাকি গো? 
-হ্যাঁ আর কে? বলি কলমি লিবে? টাটকা, এই তুলে লিয়ে আসছি। 
-কি কলমি? জলকলমি না ডাঙ্গার? 
-না না জল কলমি। ড্যাঙ্গা কি জেগে আছে নাকি? সব তো জল ছপছপ করতিছে আখুনো। 
-সে কি গো? এখনো জল?
-আর কেন বলো! আখুনো জল লাবেনি। বাখুলেও জল থৈ থৈ করতিছে দিদি। পা-হাত-পা হেজে গেল এই দেখোনা। দুবেলা দশবার করে অরই মধ্যি যাতায়াত। লাতিটার জ্বর, কাশি। আর কত করে বননু কাল হাজরাদের লালাটা কেটে দিতে, থালিই বাখুল থিকে জল লেবে যায়। তা সে বুড়ার কত কতা। বলে, লতুন মাছ ছেড়ছি, আর কদিন যেতে দাও। জল ওমনিই লেবে যাবে। সব মাছ লাকি তার মাঠকে বেইরে যাবে। ওলাউঠায় মরুক শুয়ার। সব্বদা প্যাঁচ। সব্বদা প্যাঁচ। 

-কৈ কি কলমি আনলে দেখি। বিপদ বুঝে কথা ঘোরান জগদ্ধাত্রী। হাজরা বাড়ির কথা উঠলে বোষ্টমীকে থামানো মুশকিল। হাজরাদের বাঁশঝাড়টা আর পাশে মাঝারি গোছের পুকুরপাড়েই বোষ্টমীদের ছিটেবেড়ার ঘরদুয়ার। বর্ষায় পুকুর উপচে তাদের উঠোন থৈ থৈ করে। মাঠের দিকে নালা কেটে দিলেই জল খানিক নেমে যায়। কিন্তু বোষ্টমীর ঘর ডুবলে হাজরা বুড়োর কি? নালার মুখে মাছ আটকানোর জাল বসানোর ব্যবস্থা না করে নালা কাটবে কেন? ফি এই বর্ষায় এই নিয়ে বোষ্টমীর গজগজ শুনে আসছেন জগদ্ধাত্রী।

রোয়াকের ওপর মাথার ঝুড়িটা নামায় বোষ্টমী। ঝুড়ির সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে ভাঁজ করে রাখা গামছাটাও টুক করে খসে পড়ে। জগদ্ধাত্রী দেখলেন, ঝুড়িতে তিন-চার আঁটি লকলকে কলমি। আর তার সাথে একপাশে পড়ে আছে গোটা তিনেক মাঝারি গোছের কচি সবুজ পেঁপে। সত্যি সদ্যই তুলে নিয়ে আসছে বোঝা যায়। কেটে নেওয়া গোড়াগুলো থেকে সাদা রস গড়াচ্ছে। গামছাটা তুলে নিয়ে মুখ আর বাঁ হাতটা ঘষে নিতে নিতে বোষ্টমী বলে, 
- লও না কটা লিবে। এই কেটেই লিয়ে আসছি। 
-কাঁচা কাঁচা পেঁপে গুলোকে পেড়ে ফেললে কেন গো? পাকলে তো বেশি দাম পেতে। দু - আঁটি কলমিশাক হাতে করে তুলে নিতে নিতে বলেন বলে ওঠেন জগদ্ধাত্রী। 
-আর পাকা! গোড়ায় জল লেগি গেছে দিদি। উ গাছ কি আর তদ্দিন টিকবে? সব্বসো পচে ধসে যেতিছে। লও না দুটো।  ভাল পিঁফে গো। 
-না পেঁপে আজ থাক। ঘরভর্তি আনাজ। আর এই বর্ষায় সবই পচতে লেগেছে। এই দু - আঁটি কলমীই দিয়ে যাও। কত দোব বল দিকিনি। 
-আরে লও না দিদি, খোলা চুবড়িতে রেখে দিবে পচবেনি। এই তো আজগেই লাবিয়েছি গাছ থিকে। 

শেষ পর্যন্ত দু আঁটি কলমি আর একটা পেঁপে নিয়ে জগদ্ধাত্রী  "দাঁড়াও পয়সা নিয়ে আসি" বলে ভেতরে চলে গেলেন। বোষ্টমী একটা শ্বাস ফেলে পুরোনো চটাওঠা রোয়াকটায় বসে পড়লো। পায়ের প্লাস্টিকের চটিটা খুলে ডানপায়ের বুড়ো আঙ্গুল আর পরের আঙ্গুলটার মাঝখানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঘষতে লাগলো। হাজায় সাদা হয়ে গেছে আঙুলের ফাঁকগুলো। তারমধ্যে খোঁচা ওঠা প্লাস্টিকের চটিটায় ঘষা লেগে খানিকটা চামড়া উঠে জ্বলছে জায়গাটা। মুখটা বিকৃত করে গামছার কোণাটা চেপে চেপে জায়গাটা শুকনো করার চেষ্টা করে বোষ্টমী। 

-এই নাও। সাতাশ বললে তো? এই বলে জগদ্ধাত্রী বেরিয়ে এসে দুটো দশটাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা এগিয়ে দেন বোষ্টমীর দিকে। তারপরেই তার পায়ের দিকে নজর পড়তে বলে ওঠেন, 
-এহ কি অবস্থা গো! ওষুধ লাগাওনি?
-কি আর ওষুধ লাগাবো দিদি? রাতের আগে পা শুখনাই হতে চায়নি। সারাদিন জলে কাদায়.....আগে তবু আলতা পায়ে দিলে এই জলের সময় হাজাটা কম হত। এখন তো আর......। কথাটা ওখানেই থামিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাকটা নিয়ে আঁচলে বাঁধে বোষ্টমী। গেলবার পুজোর চারদিন আগেই বোষ্টমীর আলতা পরার পাট চুকিয়ে তার ঘরের লোক তাকে ছেলে-বৌ এর হাতে ছেড়ে মাটি নিয়েছে। 
-তোমায় যে সেই মলমটা কিনে দিলুম সেদিনে? লাগাবে তো! এহ ভ্যাটভ্যাট করছে একবারে। জগদ্ধাত্রী বিরক্ত সুরে বলে ওঠেন। 
- সে আছে। লাগাতে মনে থাকেনি। রাত্তিরে শুবার সময় লাগালেই হয়। লাতিটা এমন বদমাশি করে.....। পান-দোক্তায় কালচে হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে অপ্রস্তুতের মত হাসতে থাকে বোষ্টমী। তারপর বলে, আর যা জল হচ্ছে এবছর! কিছু বলছে নাকি গো দিদি টিবির খপরে? কবে ধরণ হবে? জগদ্ধাত্রী হলেন বোষ্টমীর বাইরের খবর জোগাড়ের মাধ্যম। জগদ্ধাত্রীর দেওয়া টিভি, রেডিও বা খবরের কাগজের খবরে বোষ্টমীর চিরকালই ভরসা।   

-বলছে তো আরো দিনদুই ঢালবে। আজকের কাগজেই তো দিয়েছে দেখলুম। বঙ্গোপসাগরে দুটো নিম্নচাপ পরপর।
-আঁ? 
-বলছি, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। ইয়ে মানে, ওই পুরীর সমুদ্রে নিম্নচাপ। সেজন্যই। আরো দিনদুই লাগবে কাটতে।
-নিওচাপের মুকে আগুন! ধরণ হলে বাঁচি। ঢেলেই চলেছে। নদীর যা ফোঁসানি, বড়বাঁধ দে যেতে ভয় করে। - মুখতুলে ফের ঘন হয়ে আসা মেঘের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বোষ্টমী।

অনেক চেষ্টা করেও বোষ্টমীর এই নিম্নচাপকে 'নিওচাপ' আর বোষ্টমীর ছোটমেয়েটার গ্রেফতারকে 'গ্রেপতাপ' বলা ছাড়াতে পারেননি জগদ্ধাত্রী। বোষ্টমীর ছোটমেয়ে আশা জরিপাড় লাল সিন্থেটিক শাড়ি আর ফিনফিনে হার-চুড়ি-চন্দনে সেজে পোঁটলা হয়ে শ্বশুরঘর করতে যাবার আগে যে কদিন ইস্কুল গিয়েছিলো জগদ্ধাত্রীই তাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন। সময়টাও কাটতো। তা সেও আজ কতদিন আগেকার কথা। সেই সিকনি ঝরা আশা সেদিন কোলে একটা আর হাতে একটাকে ধরে বাপের বাড়ি থেকে ফিরে যাবার সময় বাসস্ট্যান্ডে দেখা হতে -'জ্যাঠিমা ভাল আছো তো' বলে ঢক করে প্রণাম করতে প্রথমটা চিনতে পারেননি জগদ্ধাত্রী। নীলের পুজো দিয়ে শিবমন্দির থেকে দুপুর রোদে মাথায় কাপড় চাপা দিয়ে হন হন করে ফিরছিলেন তিনি।   
 -নদীর কথা কি বলছিলে দিদি? জগদ্ধাত্রী জিজ্ঞাসা করেন বোষ্টমীকে। জগদ্ধাত্রীরও আশেপাশের দরকারি, অদরকারি সব খবরের যোগানদার এই বোষ্টমী। 
-অই শুক্কুরবারে বড়বাঁধ দে আসতেছিলুম তাই বলছি। নদী কী ফুঁশতেছে দিদি কি বলব! ওই গোবদ্দনপুরের বাজারের কাছে একটা বাঁশের সাঁকো ছিল নি? সেটা তো এগবারে দুভাগ হয়ে ভেঙে ভাসতেছে। বাঁধের তলা আবার ভাঙছে নাকি বলছে। সেদিন তো দেকলুম বালির বস্তার টেরাক এসতেছে বাঁধের ধারে ফেলাবে বলে। 
-সেকি গো! আবার! গেল বারেই তো শুনলুম বাঁধছে ভাল করে বাঁধটা। ওই গোবর্ধনপুরেই তো? এবছর আবার ভাঙছে কি গো? গলার ভয়টা বেরিয়ে আসে জগদ্ধাত্রীর। 
-তাই তো দেকলুম। তুমিও যেমন, গেলবার বেঁধছিলো বলে এবছর আর ভাঙবেনি? ওই বালির বস্তার কটা বাঁধের তলায় যাবে আর কটা কোন কোন গুদোমে যাবে দেকো। আবার দাঁত বের করে হাসে বোষ্টমী।
তাও ঠিক। এ তো জগদ্ধাত্রীরও অজানা কিছু নয়। 
-আবার শুননু হাজরাদের মেজছেলটা, ওই যে গো পোসেন, ওই যেটা আজকাল ভটভটি লিয়ে ঘুরে বেড়ায়, উ নাকি বড়বাঁধের পাঁচ কিলোমিটার না কত যেন কন্টাক্টারি লিছে। ওই জন্যি বলক ওপিসে যাচ্ছে-এসছে কদিন দেখি। 
কথাবার্তার মোড় আবার অন্যদিকে ঘুরছে দেখে জগদ্ধাত্রী বলে ওঠেন, বাব্বা, তুমি তো অনেক খবর রাখো দেখি। কে ব্লক অফিসে যাচ্ছে, কোথায় কন্ট্রাক্টারী পাচ্ছে,  এত খবর পাও কোথায়? তুমিই বা বড়বাঁধে গিয়েছিলে কেন? 
-কানে আসে দিদি। নিমাই সেদিন ঘরে বৌকে বলতেছিলো শুননু। বড়বাঁধে গিইছিলুম বলতে-

বলতে বলতেই চড়বড় চড়বড় করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। 
-এই রে! ওই শুরু হলো আবার। এসো এসো ঘরে ঢুকে এসো। ভিজবে যে। এই একটু থেমেছে দেখে জামাকাপড় কটা উঠোনের দড়িতে দিলুম! আবার সব ভিজল বোধহয়। উঠে এসো দিদি ভেতরে। -বলতে বলতে দুর্দ্দাড়িয়ে ভেতরের উঠোনপানে ছুটতে থাকেন জগদ্ধাত্রী। শাক আর পেঁপের ঝুড়িটা রোয়াক থেকে তুলে নিয়ে জলের ছাঁট বাঁচিয়ে দরজার কোণে রেখে নিজেও দরজার ভেতরে ঢুকে দাঁড়ায় বোষ্টমী। এ বাড়িতে তার সংকোচ কিছু নেই। একসময় এই বাড়িতে তার দুবেলা যাতায়াত ছিল। বয়সকালে ঘোড়ার মত খাটতে পারত সে। নিজের চিলতে ডাঙা জমির সবজি চাষ, গরুর কাজ, বাড়ির রান্নাবান্না, পরিস্কার-ঝরিস্কার সামলে পরের জমির বীজতলা ফেলা, ধান রোয়া, ধান কাটা, আগাছা নিড়েন দেওয়া থেকে শুরু করে, পুকুরে গুগলি কাঁকড়া ধরে বাজারে বিক্রি আবার দরকারে বাড়ি বাড়ি ধানসেদ্ধ, চিঁড়ে-মুড়িভাজা, ধান-গম ভাঙিয়ে দেওয়া কি করেনি সে! তবে এটাও ঠিক যে একমাত্র এই বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িতে গিয়ে এঁটো বাসন মাজেনি। জগদ্ধাত্রীর সাথে কি তার আজকের সম্পর্ক! সেই কবে থেকেই দুজনেই দুজনকে দিদি ডাকে। দাদা মানে এবাড়ির কত্তার মাঝে মাঝে নাইট ডিউটি থাকলে সে এসে থেকেচে রাত্তিরে জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে। তারপর বয়স বেড়েছে দুজনেরই। শরীর ভেঙেছে। আর ওই খাটুনি খাটতে পারে না বোষ্টমী। নিমাই চায়ও না সে আর কারো বাড়িতে কাজ করুক। তাই এই আনাজপাতি চাষ আর ঘরের গরু-বাছুরের কাজ নিয়েই থাকে এখন বোষ্টমী। তবে এক দুদিন ছাড়াই কলাটা-মুলোটা নিয়ে কখনোবা এমনিই চলে আসে সে এবাড়িতে। বেচাকেনাটা তো অছিলা। হাতের গামছাটা ঝুড়ির ওপর বিছিয়ে দিয়ে দরজা থেকে সরে এসে দাওয়ায় উঠে বসে বোষ্টমী। এখানে জলের ছাঁটটা কম। বসে বসে এদিক ওদিক চোখ বোলাতে থাকে। 

উঠোন থেকে কাপড়জামা কটা তুলে পুঁটুলি করে নিয়ে আসেন জগদ্ধাত্রী। -দেখো দিকি আর একটু থাকলেই শুকিয়ে যেত। এই এক হয়েছে আমার এই ভিজে কাপড় নিয়ে একবার করে তোলো আর পাড়ো। - নিজের মনেই গজগজ করতে করতে ঘেরা দুয়োরে টাঙানো দড়িতে মেলে দিতে থাকেন। 

-ডোঙাটা আর চলবেনি দিদি। এবার দাদাকে বল পাল্টে লিতে। টিনের চালের জল যাওয়ার টিনের ডোঙাটা সত্যিই পুরোনো হয়েছে। এদিক ওদিকের ফুটো দিয়ে জল ছিটকোচ্ছে দুয়োরে। সেদিকে চোখ পড়েছে বোষ্টমীর। 
-হ্যাঁ ওটা এবার বদলাতে হবে। তুমি উঠে এস তো ঘরে। এ যা নেমেছে, এখন থামবে বলে মনে হয়না। একটু চা করি। 
-না না আর চা খাবুনি এখন। অনেক বেলা হলো। 
-আরে দূর! দু চুমুক চায়ের আবার বেলা! বোসোতো! এই বৃষ্টিতে যাবেই বা কোথায়?
বোষ্টমী শাকের ঝুড়িটাকে দরজার থেকে তুলে দাওয়াতে রেখে নারকেল দড়ির পাপোষে পা দুটো ঘষে ঘষে মুছে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বসলো। জগদ্ধাত্রী এবার শোবার ঘরের জানলার পাল্লাগুলো ধুপধাপ করে বন্ধ করে এসে গ্যাসে চায়ের জল চাপালেন। 
-বড়বাঁধের দিকে কেন গিয়েছিলে বললে না তো? - যেখানে শেষ হয়েছিল কথাটা সেখান থেকেই শুরু করলেন ফের কথাটা। -বড়বাঁধকে গিইছিলুম বলতে, হাটকে গিইছিলুম শুক্কুরবারে। একটা মুগরী কিনলুম। দুটো লুবো ভেবছিলুম, যা দাম হাঁকছে বাব্বা! আর এই দুটো হাতপাখা এইসব। পাখাগুলোন সব ছিঁড়েকুটে দিছে লাতিটা। 
-আবার মুগরী? কোথায় বসাবে ? 
- এই শ্মশান মাঠের কালভাটকে একটা বোস করি দুবো। আর বছরের পুরানো একটা মুগরী আছে। একটু ভেঙে ভুঙে গেছে ও কঞ্চি দড়ি দিয়ে একটু সোর্ করে লিলেই আবার বোস করানো যাবে। ওই বাঁশবনের পাশের ডোবাতে লাগি দুবো। প্রচুর কৈ- তেলাপিয়া আছে ডোবাটাতে। যা দু-একটা পড়ে। লাতিটার খাওয়ার মতন। 
-তা তোমার উঠোনে এবার কৈ মাছ ওঠেনি হাজরাদের পুকুর থেকে? 
গলাটা এবার নামিয়ে নেয় একটু বোষ্টমী। - আরে বুড়ো সত্যি মাছ ছেড়ছিলো গো। কৈ তো জল হলেই উঠছে। সেদিন বৌমাও ধরছে চারটে গামছা চাপা দিয়ে বাখুল থিকেই। আর ওই পেটমোটা মাছগুলা গো, আম্রিকান রুই না কি বলে জানিনি বাবা! সেই পেইচি দুদিন। কালো কালো ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসে বোষ্টমী।  
-শ্মশান মাঠের কালভার্টে মুগরী বসালে কেউ কিছু বলবে না? জিজ্ঞাসা করেন জগদ্ধাত্রী।
-বললে তখুন আর বসাবুনি। হেব্বি চুনো মাছ যাচ্ছে মাঠকে। রোজ দেখতিছি তো। সেজন্যিই তো কুঁচো মাছের মুগরী লিয়ে এলুম হাট থিকে। ডাঁরাও না মুগরী উঠলেই লিয়ে আসব তোমার জন্য। বোষ্টমী জানে জগদ্ধাত্রী শুকনো শুকনো চুনো মাছের ঝাল দিয়ে গরম ভাত খেতে বড় ভালবাসেন। চোখে একটা হালকা আদরমাখা হাসি আর মুখের রেখাগুলো নরম হয়ে এসেছে বোষ্টমীর জগদ্ধাত্রী লক্ষ্য করলেন। দুজনের লেখাপড়া, পয়সাকড়ি, সামাজিক অবস্থানে অনেকটা বিভেদ থাকলেও দুজনে একসঙ্গে অনেককটা দিন কাটিয়েছেন। কতদিন দুজনে রোদে পিঠ দিয়ে বসে এতোল-বেতোল গল্প করতে করতে শুকনো চুনো মাছের ঝাল দিয়ে গরম ভাত খেয়েছেন আগে। জগদ্ধাত্রীও জানেন শুকনো শুকনো চুনো মাছের ঝাল দিয়ে গরম ভাত বোষ্টমীরও বড় প্রিয় খাবার ছিল। সেজন্যই আর কথা বাড়ালেন না। জগদ্ধাত্রী জানেন কোথায় থামতে হয়। 
-এই দেখো জল ফুটে মরে গেল বোধহয়।- বলে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। 

-দাদা কোথায় গো? দেখছিনি যে? বোষ্টমী প্ৰশ্ন করে। 
-সে তো সেই সাতসকালে বেরিয়েছে স্কুলের কমিটির কিসব মিটিং আছে তারপর কাগজ পত্তর সব জমা দিতে যাবে জেলা অফিসে। তার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হবে মনে হয়। নতুন বিস্কুটের প্যাকেটটা কেটে চ্যাবনপ্রাশের খালি হয়ে যাওয়া কৌটোয় বিস্কুটগুলো ঢালতে ঢালতে রান্নাঘরের ভেতর থেকেই জবাব দেন জগদ্ধাত্রী।
- বাবা এই জলের মধ্যিই যেতে হলো? সকাল থিকেই তো ঝরতিছে। কাল পরশু গেলে হতনি? খুকখুক করে কাশতে কাশতে বলে চলে বোষ্টমী। 
-কি বলবো বোলো? বর্ষাতি পরে চলে গেল ঢনঢন করে। কথা শোনার মানুষ কি সে? জানোই তো। এ নাও।  - দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দেন জগদ্ধাত্রী বোষ্টমীর দিকে। 
-আবার বিস্কুট খাবো? 
-আরে ধরো তো। চা টা ছাঁকি গিয়ে। 
-আচ্ছা একটা দাও। হাত বাড়িয়ে বিস্কুটটা নেয় বোষ্টমী।
চায়ের জল ফুটে গিয়েছিলো। চট করে একটুকরো আদা কুরে সরাসরি ফুটন্ত জলের মধ্যে ফেলে দিলেন জগদ্ধাত্রী। কাশছে বোষ্টমীটা। এই জলকাদায় গলায় আরাম পাবে। চা পাতা দিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে চাপা দিয়ে দিলেন সসপ্যানটা।          
-রান্নাবান্না হয়ে গেছে,ও দিদি? কি রাঁধলে ? বিস্কুট চিবোতে চিবোতে রান্নাঘরের বাইরে থেকে প্রশ্ন করে বোষ্টমী। 
-এই চালে ডালে বসিয়ে দিয়েছি দিদি। একচিমটে ঘি ছিটিয়ে হয়ে যাবে। আজ তো একা খাবো। তার জন্য আর...  চা ছেঁকে দুটো কাপ দুহাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন জগদ্ধাত্রী। বোষ্টমীর কাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন তোমার বৌমা কি রাঁধলো গো? 
-কে জানে কি রাঁধছে? কলমি দু- আঁটি ঘরকে রেখে আসছি। তাখে করে বা কি। আমি তো সকাল থেকে গরুর ঘাস করতেছিলুম। গোরুগুলা তো কদিন বেরোতে পায়নি নয়। হাত বাড়িয়ে কাপটা নেয় বোষ্টমী।
-এবার আর গরু টরু বাদ দাও দিদি। এই জলকাদায় ডুবে ডুবে ঘাস করা! বয়সটা তো বাড়ছে নাকি? রান্নাঘরের বাইরের মোড়াতে বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলেন জগদ্ধাত্রী। 
-আহ আদা দিয়েছো নয়? চায়ে চুমুক দিয়ে আরামের শ্বাস ছাড়ে বোষ্টমী। তারপর বলে- আর কি করি বোলো? ওই লিয়েই তো আছি। ঘরের দুধটুকুন তো হয়ে যায় বলো। আর রান্নাবান্না বলতে নেই আমায় দেখতে হয়নি। বৌমাই করে যা করার। আর গরু কি আমার আজকের বোলো। নিমাইয়ের বাপ্ বলতো রাত্তিরে গা থিকে আমার গোবরের গন্দ ছাড়ে। 

দুই সমবয়সী প্রৌঢ়া কিশোরীর মত হাসতে থাকে চায়ে চুমুক দিয়ে। 

চায়ের কাপে বড়সড়ো একটা চুমুক দিয়ে বলেন জগদ্ধাত্রী, নিমাই কখন আসে খেতে? 
-তার এসতে করতে রোজ আড়াইটে। তিনটের আগে ভাত নামেনি গলা দিয়ে। তবে আজগে বোধয় শিগগির করে এসবে। আজগে মিটিন আছে এগারোটা থিকে। সেখেনকে গেছে। মিটিন আর কতক্ষণ হবে? 
বৃষ্টির তেজ খানিক বেড়েছে। এই ঝরঝর করে ঝরছে। কিছু পরেই কমে যাবে। আবার কিছু পরে গুমগুম করে মেঘ বাজিয়ে ধেয়ে আসবে। বোষ্টমীর ছেলে নিমাই আজকাল স্টেশন রুটের বাসে হেল্পারী করে। মাঝে মাঝেই ভাড়া বাড়া, রাস্তা সারাই, মাইনে এসব নিয়ে স্টেশনের পাশে বাসডিপোতে মিটিং মিছিল লেগেই থাকে। বাস বন্ধও হয়ে যায় প্রায়শই। কিসব প্রতিবাদ টতিবাদ! সেসবই কিছু হবে। নদীর স্রোতের মত জলের ধারা যাচ্ছে জগদ্ধাত্রীর উঠোন দিয়ে। সেইদিকে তাকিয়ে আলগা প্রশ্ন করেন জগদ্ধাত্রী, কিসের মিটিং গো?
-বাস নাকি উঠে যাবে বলতিছে গো দিদি। মালিকদের লোসকান হচ্ছে নাকি। গলাতে স্পষ্ট উদ্বেগ ধরা পড়ে বোষ্টমীর।
-সে কি গো? উঠে যাবে মানে? 
-হ্যাঁ গো তাই তো বলতেছিলো নিমাই। তাই নিয়েই মিটিন হচ্ছে। বাস মালিকরা অন্য রুটে তুলে লিয়ে যাবে বাস। এখানকে লস হচ্ছে। ট্যাকাপয়সা লিয়ে ঝামেলি, দেয়নি তো ঠিক করে। সেদিনকে মালিকদের সঙ্গে হেল্পার, কন্ডাক্টারদের সে কি ঝামেলি বাপরে! সে মারপিট লাগে লাগে। গেল হপ্তায় তো ওই করেই দুদিন বাস বন্দ ছিলোনি?
এত কথা জগদ্ধাত্রীর জানার কথা নয়। বাড়ি থেকে বেরোনো মানে তাঁর মন্দির বা টুকটাক দোকান বাজার। খুব দরকার ছাড়া বাসে ওঠবার প্রয়োজন পড়েনা তাঁর। এই গ্রামের সাথে স্টেশনের একমাত্র যোগাযোগের ব্যবস্থা এই কটা লড়ঝড়ে বাসই। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় যার একটা করে এই রাস্তায় এমুখো ওমুখো চলার কথা। কিন্তু প্রায়শই নানা ছুতোয় কোনো একটি যদি বন্ধ থাকে তবে পরের ঘন্টার বাসটিতে ওঠা দায় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত জগদ্ধাত্রীর মতন মানুষদের পক্ষে। কিন্তু সে বাস একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামটি আক্ষরিক অর্থেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সে উদ্বেগটাই ফুটে উঠলো জগদ্ধাত্রীর গলায়।
-একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে কি গো? মানুষ আসবে যাবে কি করে? এ আবার কি কথা?
-ছোট অটো আর ওই ট্যাকার নাকি বলে বলোনা? ওই যে গো আনাজপাতি লিয়ে যায় জিপগাড়ির মতন? সেই নাকি চলবে।
-ও ট্রেকার?  জগদ্ধাত্রী খানিক স্বস্তি পান। তাই বলো। একেবারে সবকিছু বন্ধ করে দিলে কি করে চলবে? 
-ডাঁরাও কি হয় আজগে মিটিনে। নিমাই আসলেই বুঝা যাবে। তবে ছোট গাড়ি তো হেব্বি ভিড় হবে। এই যা। 
-সেতো হবেই। ঘন ঘন চালাতে হবে। নিমাই কি করবে তাহলে? ঠিক পরের প্রশ্নটিই মাথায় আসে জগদ্ধাত্রীর। 
-সে বাসে হেল্পারি করত এখন ট্যাকারে হেল্পারি করবে। কতাবাত্তা বলেছে বললো তো। দেখি কি বলে আজগে এসে। অয় গো জল ধরে এসতেছে। এই তালে পাইলে যাই। এই বলে কাপের তলানি চায়ে চোঁ করে একটান দিয়ে উঠে পড়ে বোষ্টমী। 

বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে সত্যিই। দুজনেরই চায়ের কাপ খালি হয়ে গিয়েছিলো। কাপদুটো নিয়ে গিয়ে কলপাড়ে নামিয়ে রাখে বোষ্টমী। তারপর জগদ্ধাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে - আসিগো আজ দিদি। 
-আর একটু দাঁড়িয়ে যাও দিদি। আর একটু কমুক। ভিজে যাবে যে।  - জগদ্ধাত্রী বোষ্টমীর পিছনে পিছনে নেমে আসছিলেন দুয়োর থেকে।
-ধরেই এসতেছে। তুমি আর নেমোনি এই জলে। পিছন পিছন দুয়োর থেকে নেমে আসা জগদ্ধাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে বোষ্টমী। 
-আচ্ছা তাহলে দাঁড়াও ছাতা দিই একটা। জগদ্ধাত্রীর গলায় উৎকণ্ঠা।
-দূর! তুমি থামোতো। আবার ছাতা কি হবে? উ গামছা মাথায় দিয়ে হনহন করে চলে যাবখন। গিয়েই তো চানে যাব। একটুস ভিজলেই বা কি?  মুগরী ঝাড়লে কাল পরশু আসবোখন আবার। দরজাটা দিয়ে দাও।  
-এস তাহলে। কি আর বলবো বলো ! 

ঝুড়ি থেকে গামছাটা নিয়ে মাথায়-গায়ে চাদরের মতন জড়িয়ে নেয় বোষ্টমী। তারপর ঝুড়িটা কাঁকালে তুলতে তুলতে কি ভেবে জগদ্ধাত্রীর মুখের দিকে তাকায় একবার। জগদ্ধাত্রীও বোধহয় এই দৃষ্টিটারই অপেক্ষা করছিলেন। কোন ভেতর থেকে অস্ফুটে তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি বাক্য, নাকি প্রশ্ন -"বাস তাহলে সত্যিই বন্ধ হলো এতদিনে দিদি?"  

বোষ্টমীও বুঝি বুঝেছিলো এরকমই কিছু বলবেন জগদ্ধাত্রী। বাঁ কাঁকালে ঝুড়িটাকে ধরে ডান হাত দিয়ে জগদ্ধাত্রীর বাম কাঁধটা স্পর্শ করে বোষ্টমী। তারপর কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ। ডানহাতের চাপে জগদ্ধাত্রীর কাঁধটা প্রায় খামচে ধরে সে। দুজনেরই চোখে অপার এক শূন্যতা। কী যেন চিরতরে হারিয়ে ফেলার অসহায়তা। জগদ্ধাত্রীর ডান হাতটা যেন অজান্তেই উঠে এসে জাপটে ধরতে চায় বোষ্টমীর ডানহাতটিকে। 

পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে জগদ্ধাত্রীর ডান হাতটা বোষ্টমী। একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ছেড়ে বলে বলে- আর কি করবে বলো? উপরওয়ালা যেমন চাইবেন! যাও দিদি ঘরে যাও। জলে ভিজোনি। দরজাটা লাগিয়ে দাও। আমি আজ এসি? আবার এসবো। 

এই কয় সেকেন্ড জগদ্ধাত্রীর একমাত্র নির্ভরতা যেন ছিল ওই একগাছি ব্রোঞ্জের চুড়ি পরা বোষ্টমীর শীর্ণ তামাটে হাতটাই। কোন অতীত থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনে এবার ছেড়ে দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন -এসো দিদি। 

কাঁকালে ঝুড়ি নিয়ে কমে আসা বৃষ্টির মধ্যে পায়ের পাতা ডোবা  লাল মোরাম ধোয়া জল ছপছপ করতে করতে ফিরছিলো বোষ্টমী। বৃষ্টির ফোঁটা তার মাথার গামছা বেয়ে নেমে তার চোখের পাতা ধুয়ে দিচ্ছিলো ভাগ্যিস! হলোই বা সে আজ এত বছর আগের কথা, হলোই বা সে তার নিজের মেয়ে ছিল না, তবুও জগদ্ধাত্রীর কোলের সেই টুকটুকে পুতুলটা যেদিন জগদ্ধাত্রীরই সঙ্গে বড় রাস্তায় বেরিয়ে হাত ফস্কে বাসের চাকার তলায় চলে গেছিলো সেদিন থেকে কি তারও একটা পাঁজর খসে পড়েনি? পাক্কা তিনমাস পর আর কোনো উপায় না দেখে বাক্যিহারা প্রায়োন্মাদ জগদ্ধাত্রীর কোলে নিজের ছোট মেয়ে আশাকে ঠুকে বসিয়ে দিয়ে বলে এসেছিলো সে, এ রইলো তোমার কাছে দিদি। দেখলে তুমি দেখবে, নইলে মরবে। তোমায় দিয়ে গেলুম। কিছু না বুঝে হাঁ করে কাঁদছিলো সেদিন ছোট্ট আশাটা। তবুও সে ফিরে তাকায়নি মেয়ের দিকে। আশার বয়সীই তো ছিল সে। অনেক সময় লেগেছিলো বোষ্টমীর আবার জগদ্ধাত্রীর বাইরেটা অন্তত গুছিয়ে দিতে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছেন জগদ্ধাত্রী। বোষ্টমীর কাছে জগদ্ধাত্রীর দায়িত্ব দিয়ে এবাড়ির কর্তা বাইরেটা সামলেছেন। আর বোষ্টমী বুক দিয়ে আগলে রেখেছে জগদ্ধাত্রীকে। তবুও আজকের মত এ-কথায় ও-কথায় মাঝে মাঝে ক্ষতটা বেরিয়ে এসেছে যখন, দুজনেই দুজনকে ধরে সামলেছে। আজকের মতোই। 

কিসের যে বন্ধন? কিসের যে টান জানে না কেউই। তবুও সেই যে সেই কবে সে একরত্তি এক মেয়ে নিজে চলে গিয়ে এই দুই আপাত অসম দুই নারীকে চিরদিনের জন্য বেঁধে দিয়ে গেল, তা এই দুই প্রৌঢ় নারীর পরম নির্ভরতা, পরম বন্ধন হয়ে বেঁচে রয়ে গেল আজও।  

মেঘটা জমেছে আবার উত্তরে। বৃষ্টি বাড়ছে। মাথা বেয়ে, চোখ বেয়ে জল নামছিলো বোষ্টমীর। বৃষ্টি আর চোখের জল মিশে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো বারবার সামনেটা। গামছা বেয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে বোষ্টমী। পায়ে পায়ে পথ পার হয়ে ফিরে চলছিল। বোষ্টমীর ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও তো ফিরতে হয়। চাইলেই কি আর সবটুকু আঁকড়ে থাকা যায়?   

অর্পিতা চ্যাটার্জী 
   

0 comments:

Post a Comment