শনিবার বা রবিবারের সকালগুলো আমাদের কাটতো ওমাহার ছোট ছোট ক্যাফেগুলোতে। যেখানে পরিবারের স্বামী -স্ত্রী বা দু একজন বন্ধু একসাথে চালাচ্ছেন ক্যাফেটি। বড় কোম্পানির ক্যাফে-চেনের কোনো কোনোটায় যাই না তা নয়, তবে শনি বা রবিবারের সকালগুলো তোলা থাকতো ছোট খাটো কফিশপগুলোর জন্যই। কারণ প্রতিটা কফিশপের আলাদা আলাদা মেজাজ। তাদের কফিতে বা খাবারে একটু হলেও আলাদা আলাদা স্বাদ। শুধুমাত্র এককাপ চা বা কফি নিয়ে দেওয়াল ঘেঁষা একটা ছোট টেবিলে বসে পড়তে পারলেই হলো। ক্যাফের মেজাজ অনুসারে বাকি সকালটা মানুষ দেখেই কাটিয়ে দেওয়া যেত। আর সেখান থেকে মনে মনে তৈরী করে নেওয়া যেত একশ গল্প। কফির টানে যতটা না গল্পের টানেই ছিল আমার সেই সপ্তাহান্তের ক্যাফেটাইম। আমার সেই ক্যাফে-র গল্পে খানিক বাধা পড়েছে বর্তমানে স্বাভাবিকভাবেই। এখন আমাদের শনি রবিবার ওমাহার নানান কফিশপে বসে কফি সেবন বন্ধ। শেষবার গিয়েছিলাম মার্চ মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখ। তারপর ১৬ তারিখ থেকে এখানে কোনো দোকানে বসে খাওয়া বন্ধ। চাইলে নিয়ে এসে খাওয়া যেতে পারে কিন্তু ওই এককাপ কফি তো প্রায় একই স্বাদে কখনো বা দোকানের চেয়ে বেশি ভালো স্বাদে ঘরে বসেই বানানো যায়। ওই ঘন্টা দুয়েক কফিশপে বসে সাপ্তাহিক ধীরলয়ে চলা দিনটাকে উপভোগ করাটাই তো ছিল আসল কথা। হাসপাতালের একতলার আমাদের প্রতিদিনের কফিশপটা যদিও এখনো খোলা। কালই ল্যাবে ঢোকার সময় হাসপাতালের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে কোনাকুনি চোখ পড়ে গেলে দেখতে পেলাম। অবশ্য এটি খোলা না থাকলে যাঁরা এখন নিয়মিত কাজ করছেন তাঁদের খুবই অসুবিধা হবে। বাইরে থেকে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। শুধু দেখলাম কফিশপের মেয়েরা সকলেই মাস্ক পরে আছে।
তা যা বলছিলাম, কফির গল্প, ক্যাফের গল্প। একটি ছোট্ট দোকান আছে, দোকানটি চালান এক রিটায়ার্ড দাদু আর ঠাম্মা। স্বামী স্ত্রী। একদিনই তাঁদের দোকানে গিয়েছিলাম আমরা। দোকানটিতে তিনটি ছোট্ট কফিটেবিল। তাতে দুটি করে চেয়ার আর একটি ছোট পুরোনো গদিআঁটা সোফা। তাতেও জন দুই বসতে পারে। এছাড়া একচিলতে জানলার কাঁচ বরাবর একটি টানা বেঞ্চ গোছের কিছু। সাকুল্যে জন দশেক হয়ত বসতে পারে সে দোকানে। বাইরে থেকে দোকানটিকে দেখে ছোট্ট একটি বাক্সের বেশি কিছু মনে হবে না। কিন্তু সে দোকানের কাস্টমার রেটিং অনেক সাজানো দোকানের চেয়ে অনেক বেশি। কিছুটা কৌতূহল বশেই গিয়েছিলাম সে দোকানে। দেখলাম বিক্রেতা এবং খরিদ্দাররা সকলেই সকলের পরিচিত। সপ্তাহান্তে সকালের কফিটা তাঁরা হয়ত প্রায়শই এখানেই পান করেন। দাদু-ঠাম্মাও হাসিমুখে সকলের হাঁড়ির খবর নিচ্ছিলেন কফি বানাতে বানাতে। ঠিক জেন্ আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানগুলির মত। বিক্রীবাটার প্রয়োজনে যতখানি, তার থেকেও মানুষের সাথে জুড়ে থাকার প্রয়োজনে টিকে আছে দোকানখানি। দোকানের একদিকের কাঠের দেওয়াল জুড়ে নানান পেন্সিল স্কেচ বা অয়েল পেন্টিং। ঠাম্মার নিজের আঁকা। কেউ কিনতে চাইলে বিক্রিও করেন। দোকানে পৌঁছতেই দাদু-ঠাম্মার আপ্যায়নের কোনো খেদ ছিল না। তবু জানলা ঘেঁষা একটি চেয়ারে বসে সামনে মুখ তুলেই দেওয়ালের সজ্জা দেখতে দেখতে একটু কিরকম যেন মনে হতে লাগছিলো সেদিন। এই 'কিরকম যেন' শব্দটাকে ঠিক করে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। একটা অস্বস্তি, একটা উশখুশে মনোভাব। দোকানের অন্য দিকের একটা দেওয়াল জুড়ে কটা অদ্ভুত জিনিস। এই দোকানের কফি বিনস আসে যেসব কাঠের বাক্সে সেইসব বাক্সের ওপরের বিভিন্ন আকারের ছোট বড় ঢাকনাগুলিকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। খুব চেনা সজ্জা পদ্ধতি। কফিবিনস আসে সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। ঢাকনার গায়ে সেইসব দেশের ছাপ। কখনো কাঠের ওপর স্প্রে পেন্ট দিয়ে, কখনো কাঠের ঢাকনার সাথে লাগানো ধাতব পাতের গায়ে খোদাই করে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া, কঙ্গো, কলম্বিয়া, চিলি। সেইসব মধ্য বা নিম্নবিত্ত দেশের নিতান্ত কেজো সামগ্রী দিয়ে আসর সাজিয়েছেন উচ্চবিত্ত দেশের কোনো এক দোকানী। দেখতে যে খারাপ লাগছে তা নয়, বরং দেওয়াল জুড়ে সুন্দর একটা কোলাজ তৈরী হয়েছে। ব্যাপারটা শৈল্পিক দিক থেকে বেশ দৃষ্টিনন্দনই। কিন্তু তবুও খুব বিত্তশালী কারো বাড়িতে গিয়ে পুরুলিয়ার বা ছত্তিশগড়ের মুখোশ বা বাংলার লাল-সাদা গামছা দিয়ে বানানো গৃহসজ্জার সামগ্রী দেখলে একইরকম অনুভূতি হয় আমার। মনে হয়, প্রতিদিন জবজবে করে নারকেল তেল মাথায় মেখে এইরকমই লাল-সাদা গামছা গায়ে পুকুরের দিকে দৌড়াতাম আমিও তো। আমিও সেই তাদেরই, গামছাটা যাদের জন্য নিতান্তই কেজো। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সামগ্রী, গৃহসজ্জার সামগ্রী নয়। আর সেই মুহূর্তেই কেন জানিনা গামছা যেখানে প্রয়োজন নয়, সজ্জার, সেই পরিস্থিতে আর নিজেকে মানানসই মনে হয়না। একখানি অদৃশ্য দেওয়াল কি করে যেন তৈরী হতে থাকে। গামছার সাথে তোয়ালের কোনো বিরোধ নেই। কোনোকালে ছিলোও না। একটা ব্যবহার করলে অন্যটা ব্যবহার করা যাবে না, এমনটাও নয়। তবুও দুটোই প্রয়োজনের। তবুও গামছা দিয়ে গৃহ বা সাজ সজ্জা করতে দেখলে কেমন একটা অনুভূতি হয়। আমার যা প্রয়োজনের তোমার তা ফ্যাশন। আমার যা নিতান্তই না হলে নয়, তোমার তা প্রয়োজনাতিরিক্ত গৃহসজ্জামাত্র। অচেনা জায়গার অস্বস্তিটা খোঁচাতে থাকে বেকুবের মত। নিজেকে নিতান্তই বেমানান, বিড়ম্বনার মনে হতে থাকে।
প্রায় এরকমই একটা অনুভূতি হয়েছিল মনে আছে প্রথম সেই দেওয়াল সজ্জা দেখার পর। একটু অস্বস্তি লাগছিলো। কিন্তু সে অস্বস্তি এতটাও তীব্র নয় যে সেখানে বসে থাকা চলে না। তেমন হলে তো এই তোয়ালের জীবন, তোয়ালে মোড়া সময়ে টিকতেই পারতাম না। সুতরাং ঠিক যতটা অস্বস্তি থাকলে কিবোর্ডে টাইপ করে এই লেখা লিখতে পারা যায়, আর ঠিক যতটা অস্বস্তি না থাকলে সেই প্রায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ঘরোয়া আপ্যায়নে উষ্ণ হয়ে সুস্বাদু কফি খেয়ে উঠে আসার সময়ে আবার একদিন সে ছোট্ট দোকানে আসার ইচ্ছে মনে জাগিয়ে রাখা যায়, ঠিক ততটাই অস্বস্তি নিয়ে কফি খেয়েছিলাম মনে আছে সেদিন।
0 comments:
Post a Comment