একটু দূর থেকে কিছু বা কাউকে নজর করার মধ্যে বেশ একটা নেশা আছে। যেমন দুজন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক। ধরা যাক, একটা কফির দোকান। এককাপ কফি নিয়ে বুঁদ হয়ে বসেছিলাম। আশেপাশে সামনে দূরে বেশ কিছু মানুষ। কেউ কফি খাচ্ছেন, কেউ অন্য কিছু করছেন। কেউ কারো সাথে কথা বলছেন, কেউ একা নিজের সাথে নিজেকে সঙ্গ দিচ্ছেন। এদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের নিশ্চয়ই একটা সম্পর্ক আছে। আছেই। এই যে আমি এককাপ কফির সাথে বসে আছি, আমার সাথে এই চেয়ার টেবিল বা কাগজের পাতলা কফি কাপটার কি কোনো সম্পর্ক নেই নাকি? হলোই বা ভেতরের তরলটা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক, কিন্তু শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো ও আমায় সঙ্গ দিচ্ছে। আমি ওকে নিয়ে দেখছি আর চারপাশটার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছি। পারছি না ঠিক করে। সব কিছু কি আর পারা যায়?
একটু দূরে হাসপাতালের সদর দরজার সামনের বৈঠকখানা। আমরা অবশ্য লবি বলি। লবির বাংলা কি বৈঠকখানা হতে পারে? না বোধহয়। বৈঠকখানার মধ্যে একটা সম্পন্ন গৃহস্থালীর আতিথেয়তার গন্ধ থাকে। লবিতে তার লেশমাত্র নেই। হাসপাতালের লবিতে থাকে উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা। দুটি শব্দ এক হতে পারে না। আমার সামনে লবি, বাঁয়ে রেস্তোরাঁ। এই জায়গাটিতে অনেকসময়ই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুরের আয়োজন করেন। কখনো পিয়ানো, কখনো ভায়োলিন, কখনো অন্য কিছু। সুর যে আমাদের উদ্বেগ কমায়, সুর যে আমাদের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে থাকা অযথা অসুখকে নরম করে, সুর যে আমাদের জমে থাকা কান্নাকে বাইরে বের করে এনে আমাদের সুস্থ করে, স্থিরচিত্তে চিন্তা করার শক্তি যোগায় সেকথা আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত। যতই মিউসিক থেরাপিকে অল্টারনেটিভ থেরাপির তকমা দিয়ে তাকে ব্রাত্য করে রাখা হোক না কেন, নাকউঁচু আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা যে আসতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে, একথা সত্যি। এই আয়োজন তারই অঙ্গ। মূলত রোগীর বাড়ীর লোকজনকে দুঃসহ দিনে সুস্থ রাখতে এই আয়োজন। পাগল করা ভায়োলিনের সুরে হাসপাতালের এই কফিশপে বসে রোগীর বাড়ির লোককে খাওয়া ফেলে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখেছি। আমি অসম্পূর্ন মানুষ। জানিনা এরকম জায়গায় কি বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে হয়। দেওয়া আদৌ যায় কিনা তাই-ই জানি না। তার কাঁধে হাত রাখতে পারিনি। তার বদলে অপ্রস্তুত হয়ে কফির কাপ হাতে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেছি।
রেস্তোরাঁর সামনের জায়গাটায় দেখেছিলাম একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা হার্প বাজাচ্ছিলেন। এর আগে আমি হার্প দেখিনি কখনও। নামটাও জানতাম না। ছবিতে দেখেছিলাম। আমার কেমন যেন একটা ধারণা ছিল এই তারযন্ত্রটির বর্তমানে আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব ইতিহাসের যুগে চলত বুঝি। কত কিছুই তো আর নেই। আর চলে না। আমরা খুঁজিও না তাই। কেমন একটা রূপকথা রূপকথা ব্যাপার আছে বিশালাকায় যন্ত্রটির মধ্যে। এমনই একদিন দিনের মাঝে কফি খেতে এসে আমার সে ধারণা ভেঙে গিয়েছিলো। কফি হাতে হাঁ করে শুনছিলাম। বলা ভালো গিলছিলাম। কি রাজকীয় ভঙ্গিমায় অনায়াসে বাজিয়ে চলেছেন ওই রূপকথার রূপসী তারযন্ত্রটিকে। মুখে মৃদু হাসি। সেদিন কেন জানিনা খুব একটা কেউ শুনছিলো না ওঁনার বাজনা। খুব একটা জনপ্রিয় বাজনা নয় বলেই কি? কে জানে! কেমন যেন মন খারাপ লাগলো।
এমন একটা বিশাল আল্পনার মতন যন্ত্র। দেখলেই মনে হয় সমুদ্দুরের তলা থেকে উঠে আসা মৎস্যরাজকন্যার হাতের বাজনা বুঝি। তার সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। নির্বাক শ্রোতা হওয়া যায়। তার ঢেউ এর মতন শারীরিক বিভঙ্গের রূপতাপস হওয়া যায়। কিন্তু তাকে অশ্রুত রেখে এমন অবমাননা করা যায় কি?
0 comments:
Post a Comment