Sunday 9 February 2020

দ্য ক্যাফে - ২

কিছু কিছু দিন ভালো মন্দ মিশিয়ে কেটে যায়। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই মগজে কিছুটা ছাপ ফেলবার আগেই কি করে যেন সন্ধ্যে নেমে আসে। খারাপ লাগে, মনে হয় একটা দিন নষ্ট করলাম। কিন্তু তবুও মনস্থির করে কোনো কিছুতে একটানা মন দেওয়া হয়ে ওঠে না। আজ সেরকমই একটা দিন। কাজ হয়নি তা নয়। যা করবো বলে ভেবেছিলাম সমস্তই খাতায় কলমে শেষ করেছি ঠিকই। কিন্তু তবুও সে কাজের কোথাও যেন আমি ছিলাম না। আমার মত অন্য আর একজন যন্ত্রের মত করে যাচ্ছিল। সবচাইতে ব্যাথার কথা যন্ত্রের মত ভেবেও যাচ্ছিলো কি? ওহ যন্ত্র তো আবার নাকি ভাবতে পারে না। আসল কথাটা হলো ভাবার জন্য মাথা ছাড়াও আরও অন্য কিছু একটা লাগে। কি যে লাগে সেটা এই মুহূর্তে লিখে উঠতে পারছিনা। সেটা আপাতত নেই।  তাই বললাম যন্ত্রের মতো ভেবে যাওয়া।

সন্ধ্যে হতে চলেছে। সকলে বাড়ি যাচ্ছে। আমিও চলে যেতে পারি। কাজ নেই আপাতত। কিন্তু তাও যাচ্ছিনা। পনের মিনিট হাঁটলেই ঘরের বিছানায় গড়ানো কে আটকায়? এই সন্ধ্যে পৌনে ছটায় কেমন একটা আকাশ-খাই পাতাল-খাই গোছের খিদে পায় প্রতিদিন। আজও পাচ্ছে। কিন্তু একটুও ইচ্ছে করছে না ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্তও এগিয়ে যাই। কিছু কিছু সময় থাকে যখন অপরিসীম মানসিক কুঁড়েমির কাছে খিদে-তেষ্টা সব হার মানে। ল্যাবের চেয়ারটা অসহ্য লাগছিলো। ব্যাগ গুটিয়ে নিচের কফিশপের সামনে এসে বসেছি। অন্ধকার থাকতে এরা দোকান খোলে। তাই সাড়ে চারটে বাজলেই ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। তবে পরিষ্কার করা, সারাদিনের হিসেবে নিকেশ করার জন্য আরও কিছু সময় এদের থাকতে হয়। আমি যখন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এলাম এখানে তখনও দুজন ছিল। আলো জ্বালিয়ে কিসব খুটুর খাটুর করছিলো ভেতরে। তারপর চলে গেল। আপাতত অন্ধকার কাউন্টার। তবে এই সামনের জায়গাটা কখনো অন্ধকার হয়না। হাসপাতালের ভেতরের কফিশপে বসার এই মজা। আমার পাশের টেবিলেই একজন বসে ল্যাপটপে কিছু একটা শো দেখছেন। মাঝে মাঝে খুকখুক করে হাসছেন। বয়স্ক মানুষ। হয়তো কেউ ভর্তি আছে এখানে। বা অন্য কোনো কারণে অপেক্ষা করছেন এখানে বসে। টেবিলে একটা খালি হয়ে যাওয়া হাফ স্যান্ডউইচ এর প্যাকেট আর দুটো ঠান্ডা ফুল ফ্যাট দুধের প্লাস্টিকের বোতল। মনে হয় অনেকক্ষন বসে আছেন এখানে। একবার উঠে গিয়ে খালি দুধের বোতলে জল ভরে নিয়ে আসবেন বলে ড্রিঙ্কস ডিস্পেন্সারটার সামনে গেলেন। কিন্তু ততক্ষনে ওরা কফির কাউন্টার বন্ধ করে দিয়েছে বলে সে মেশিনটাও আজ রাতের মতো মৃত হয়ে পড়ে রয়েছে। আমার পিঠের দিকের হলওয়েটা দিয়ে গেলেই খাবার জলের কল। বলে দিলেই হতো। কেজানে কেন বললাম না? মাঝে মাঝে কি যে হয়! কারো সাথে কথা বলতে হবে মনে হলে গর্তে গিয়ে সেঁধুতে ইচ্ছে করে। 'সেঁধুতে' শব্দটায় মনে পড়লো, জ্যেঠুমনির কাছে কোনো এক রোগী এসেছিলেন। তাঁকে পরীক্ষা করার সময় জিভ দেখাতে বলেছে জ্যেঠুমনি। পরীক্ষা শেষ। জ্যেঠুমনি তাঁকে বলছে-"জিভটা ঢুকিয়ে নাও।" কিন্তু জিভ আর ভেতরে ঢোকাচ্ছেন না তিনি। শেষে তাঁর সাথে যিনি এসেছিলেন তিনি বললেন-"জিভটা সাঁধ করিয়ে নাও।" তখন জিভ ঢুকলো ভেতরে। গ্রামের মানুষের প্রিয় ডাক্তারবাবু সেদিন নতুন শব্দ ব্যবহার করতে শিখেছিলেন। আরো অনেক গল্পের সাথে সাথে এই গল্পটাও অনেকবার শুনেছি জ্যেঠুমনির কাছে। খুব মজা করে বলত। অনেকবার শোনা থাকা স্বত্বেও প্রতিবারই খুব মজা করে শুনতাম। গল্পগুলো নিজেকেই মনে রাখতে হবে এবার। আর মনে করিয়ে দেওয়ার লোক নেই।   

পাশের টেবিলের মানুষটির অপেক্ষা শেষ হলো। ল্যাপটপ গুটিয়ে, খালি প্যাকেট, বোতলগুলো ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চেয়ারের পিঠ থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে গায়ে গলিয়ে মাথায় একটা সাধারণ টুপী পরে নিলেন। বাইরে এখন দু ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাথে হাওয়া। এই ঠান্ডায় এই টুপিতে কিকরে হবে? অবশ্য আমার ভারতীয় মন এসব ভাবছে। উনি এখানকার মানুষ এই ঠান্ডায় ওঁনার বিশেষ কিছু মনে হবে না হয়ত। আমি ওঁনার বয়সটাও যোগ করছি এই হিসেবের মধ্যে। মৃদু পায়ে বেরিয়ে গেলেন মানুষটি। 

বাইরে এতক্ষনে অন্ধকার হয়ে গেছে। 






          

0 comments:

Post a Comment