Friday, 6 March 2020

দ্য ক্যাফে - ৩

উৎসব পরবর্তী আধো আলোকিত একটা ক্যাফে। জায়গাটা এ শহরের দুটি বড় বাজার সংলগ্ন দুটি ব্যস্ত রাস্তার চৌমাথায়। সপ্তাহান্তে এই ছোট্ট দোকানটিকে বসতে জায়গা পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। তবুও শীতের রবিবারের সন্ধ্যায় সেখানে লোকজন সেদিন কম। রবিবার বলেই হয়ত। শুক্র বা শনিবার হলে মানুষের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা থাকে না এখানে। রবিবারে তা নয়। সোমবার ভোর ভোর কাজের জায়গায় পৌঁছানোর তাড়ায় রবিবারের সন্ধ্যেটুকুও তাড়াহুড়োর কবলে পড়ে ছটফটায়। এমনই এক রবিবারের পড়ন্ত বিকেলে কোণের দিকে একটা ছোট্ট টেবিলে গিয়ে বসেছিলাম দুজনে। রোজকারের মতন নানান আবোলতাবোল বিষয়ে কথাবার্তা আলোচনা চলছিল। বাইরে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মরা মরা একটা হলদে আলো এসে পড়েছে কাঁচের বাইরে। কাঁচের ওপারে রাস্তা। তার ওপারে একটা ছোট্ট বাড়ি। এখন থেকে বাড়িটার পিছনের দিকটাই দেখা যায়। এতদিন এই ক্যাফেতে আসছি, কখনো বাড়িটার এইদিকে কাউকে আসতে দেখিনি। পিছনদিক বলেই হয়ত। এই ক্যাফেটার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। বাঁদিকে একটু গেলেই এশিয়ান মার্কেট। আমাদের মত দেশীয় খাবার-দাবারের রোজকার কারবারিদের জন্য ওরিয়েন্টাল শাকসব্জী-মশলাপাতির প্রধান যোগানকেন্দ্র। ডাইনে কিছুটা এগোলেই বাকি রোজকার অন্য প্রয়োজনীয় গার্হস্থ্য জিনিসপত্রের বাজার। আর পুরো এলাকাটা জুড়েই বিভিন্ন দেশের খাবারের সম্ভার নিয়ে অজস্র সস্তার রেস্টুরেন্ট। আমাদের মত ইউনিভার্সিটির মানুষদের জন্য কম পয়সায় উদরপূর্তির নিখুঁত আয়োজন। এসব কারণেই ইউনিভার্সিটি অফ ওমাহা আর মেডিকেল সেন্টারের আমাদের মত ভিনদেশি ছাত্র ছাত্রী বা কর্মী দলের জন্য এই ক্যাফেটা বড়োই প্রিয়।
         
ওই পাশে দুটো টেবিল জোড়া লাগিয়ে একদল ছেলে কলকল করে বিদেশী ভাষায় কথা বলে চলেছে। ওরা এখানকার প্রতি রবিবারের নিয়মিত আড্ডাধারী। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একদেশ থেকে এখানে এসেছে। ওদের একজনকে চিনি। আমাদের ইনস্টিটুটেরই রিসার্চার। বাকিরা সম্ভবতঃ ইউনিভার্সিটি অফ ওমাহায় ছোট বড় কোনো কোর্স করতে এসেছে। ওরা কি ভাষায় কথা বলছিলো সে আমাদের বোঝার কথাও ছিল না। ভাষা না বোঝার একটা বেশ উপকার আছে। বক্তব্যের ওপর থেকে মনোযোগ সরে গিয়ে মানুষের ওপর মন পড়ে। মানুষ দেখার সেরা জায়গা এই ক্যাফেগুলো। এককাপ পানীয় নিয়ে এককোণায় বসে নিশ্চুপে বহু কিছুর সাক্ষী থাকা যায়। সামনের মানুষগুলো সম্পর্কে মনে মনে কিছু ধারণা করা যায়। এই যেমন এই ছেলেগুলির পরিচ্ছদ দেখে অনুমান হয় প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। অবশ্য নইলে দেশ ছেড়ে রিসার্চ করতে আসলেও, ব্যাচেলার বা মাস্টার্স ডিগ্রি করতে কোন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ছেলেমেয়েরা এদেশে আসে না। আমাদের দুজনের আলসেমি মাখা বিকেল শেষ হচ্ছিল নিরুত্তাপে। ওদের হাসাহাসি কথোপকথন আর উচ্ছলতা দেখতে দেখতে। সাথে ছিল দুইকাপ উষ্ণ তিতকুটে তরল।

প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে। একজন মানুষ এসে ক্যাফেতে ঢুকলেন। মানুষ দেখার একটা অলিখিত নিয়ম রয়েছে। দুইধরনের মানুষকে আর একজন মানুষ নজর করে দেখে। এক, যদি সেই মানুষটিকে দেখে যথেষ্ট সম্ভ্রমের উদ্রেক হয়। অর্থাৎ মানুষটিকে দেখে যদি নিজের চাইতে সামাজিকতায় বড় বলে  মনে হয় অথবা দুই, যদি মানুষটিকে দেখে সন্দেহের উদয় হয়। সন্দেহটা বেশিরভাগ সময়েই পোশাক দেখে অনুমিত হয়। এর বাইরে যাঁরা, তাঁরা তো নিতান্তই গড়পড়তা মানুষ। তাঁদের না আছে চোখ গোল গোল করে দেখার মতন আড়ম্বর। না আছে দুরছাই করার মতন মাটি সংলগ্ন নমনীয়তা। যদিও এসবের কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে বলে মনে হয় না। আমিও আর পাঁচজনার মতনই অজস্র ভুল ধারণার বশবর্তী সাধারণ একজন মানুষ দেখিয়ে। যে মানুষটি এসে ক্যাফেতে ঢুকলেন তাঁকে দেখে আমি বিনা দ্বিধায় দ্বিতীয় দলে ফেলে দিলাম। একগোছা ঝোলাঝুলি ব্যাগ। বেঢপ জ্যাকেট। এবং সন্ধ্যেবেলায় রোদচশমা ও টুপি। এমন ধারা মানুষকে নিঃসন্দেহেই সন্দেহ করা চলে, তাই না? আর সন্দেহ করার মতন হলেই তিনি পর্যবেক্ষণের বস্তু। সুতরাং আমার চোখও তাঁকে বিনা লজ্জায় অনুসরণ করে চললো। তিনি তিনটে টেবিল বদলালেন। কোথাও বসে তাঁর ভালো লাগলো না। অবশেষে চার নম্বর টেবিলে গিয়ে তাঁর অজস্র জিনিসপত্র নিয়ে থিতু হলেন। ঝোলা থেকে বেরোলো একটা বহুল ব্যবহৃত কফির কালচে দাগধরা কফিমগ। সেই মগ নিয়ে তিনি চললেন কাউন্টারে। ওতেই খানিকটা কফি ঢেলে দিতে বলবেন সম্ভবতঃ। তাঁর দিকে অনেকেই নজর পড়েছে এতক্ষনে। কাউন্টারের ছেলেমেয়েগুলোর তো বটেই। কিছু সমস্যা হলে ওদেরকেই সামলাতে হবে। এই ক্যাফেতেই একবার এক মহিলার পিছু ধাওয়া করে এসেছিলো একজন মানুষ। ক্যাফের বাইরে উল্টোদিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে করতে মহিলাকে চোখে চোখে রাখছিলো। তারপর ক্যাফের ভেতরে ঢুকে কিছু করার আগেই এই কাউন্টারের ছেলে মেয়েরা পুলিশে ফোন করে। আর আমাদের সামনেই মিনিট কয়েকের মধ্যে পুলিশ এসে মানুষটিকে ধমকে-ধামকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এই মানুষটির হাবেভাবেও সাধারণ কিছু ছিল না। ফলত: সকলেই সতর্ক। আমাদের কফি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমরাও উঠে পড়লাম। কারণ আমরা আরো বেশি সতর্ক।

বাইরে এসে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়েছি সবে। দেখলাম ক্যাফের দরজা ঠেলে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন তিনি। মন বুঝলো নিশ্চয়ই কিছু গোলমেলে ব্যাপার। শীতকাল বলে গাড়ির কাঁচ তো তোলাই ছিল। আরো সিঁটিয়ে বসলাম। পিনাকী ততক্ষণে গাড়ির মুখ ঘুরিয়েছে। বেরিয়ে যেতে হবে এখন থেকে।মানুষটি সোজা এসে আমার জানলার কাঁচে টোকা দিচ্ছেন। হাতে একটা নোটবই। সেটা দেখিয়ে কি যেন বলছেন। এখানে এমন ঘটনার কথাও শুনেছি যে, ভবঘুরে মানুষরা এক-দুই ডলার চেয়েছে কারো কাছে এবং সেটি না পাওয়ায় সোজা গুলি করে মেরেছে। সেসব গল্প মাথায় চট করেই চলে আসে এই সব পরিস্থিতিতে। দোনোমোনা করে পিনাকীর হাজার 'না'-এর মাঝেও কেন জানিনা সেদিন জানলার কাঁচটা খুলে ফেলেছিলাম খানিকটা। তিনি হাতের নোটবইটা দেখিয়ে বললেন, "এটা তোমরা ফেলে যাচ্ছিলে।" আমরা যে টেবিলে বসেছিলাম তার পাশেই কাউন্টারের কোণের দিকে একটা কলমসহ এই সুন্দর নোটবইটা রাখা ছিল। সম্ভবতঃ আমাদের আগে কেউ এতে কিছু লিখছিলো, তারপর ফেলে চলে যায়। ওটা আমাদের নয়। সেকথা তাঁকে জানাতে তিনি বললেন, "ওহ, তাহলে ঠিক আছে। আমি ভাবলাম তোমরা ভুলে রেখে যাচ্ছ বুঝি। আসলে এরকম ব্যক্তিগত জিনিস একবার হারিয়ে গেলে দোকানে তো কিনতে পাবে না, তাই না? কত কি স্মৃতি, হয়ত কোনো মানুষের দেওয়া উপহার এটা।  তাই ভাবলাম দিয়ে আসি।  ঠিক আছে। তোমাদের নয় যখন তাহলে এসো।  তোমাদের দেরি করালাম বলে দুঃখিত। শুভরাত্রি।" এই বলে পিছন ঘুরলেন।

একবুক লজ্জা নিয়ে কাঁচটা বন্ধ করতে করতে দেখলাম এতক্ষনে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে আমাদের চারপাশটা। গাড়ির হেডলাইটের আলো গিয়ে পড়েছে তাঁর ওপর। পিছন ফিরে হেঁটে ফের ঢুকে যাচ্ছেন আমাদের ফেলে আসা ক্যাফেটার দরজা ঠেলে। সেই বেঢপ জ্যাকেট গায়ে, অপরিষ্কার কফিমগ আর নোটবইটা হাতে করে নিয়ে।

   

0 comments:

Post a Comment