Friday 14 February 2020

এই_সপ্তাহের_শেষে-8

#এই_সপ্তাহের_শেষে
৮. মাইটোকন্ড্রিয়া আর মেদ
----------------------------
আজ একটু অন্য গল্প করি। ক্যান্সারের গল্পে ফিরে আসব পরের সপ্তাহেই। কথা দিচ্ছি। আর ফিরে তো আসতেই হবে। অনেক গল্প বাকি আছে ওই নিয়ে। কিন্তু আজ একটু অন্য গল্প করতে ইচ্ছে করছে। এমনই স্বাদ বদল ধরে নিন। তা আমাদের আজকের গল্পের নায়ক আমাদের দেহের কোনো একটি কোষ। কোনো ক্যান্সার কোষ নয় কোনো বড় মতলবি বাজে কোষ নয়। ছাপোষা সুন্দর টুকটুকে একটি বাচ্চা কোষ। কেমন? এখন এই 'কোষ-কোষ' তো অনেক দিন ধরেই বলছি। এই 'কোষ' ব্যাপারটা কি, কীই বা থাকে তার ভেতরে সেটি বলিনি। সংক্ষেপে বলে নিই কেমন, নইলে আবার গল্পের দেরি হয়ে যাবে। 

মনে করুন একটা থকথকে জেলিজাতীয় জিনিস। রাসায়নিক দিয়েই বানানো। তবে মানুষের তৈরী কারখানায় নয়। প্রকৃতি নিজেই তৈরী করেছে। এবার মনে করুন সেই জেলি জাতীয় পদার্থটিকে দুটি পাতলা পর্দা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। যাতে ওই জেলি বেরিয়ে আসতে না পারে। এটিই আপাতত ধরে নিন আমাদের কোষ। এবার মনে করুন, ওই পর্দা মোড়া জেলির মধ্যে আরো একটি ছোট সাইজের পর্দা মোড়া জেলি রয়েছে। ওই একই ধরণের ডাবল পর্দা। তা এই ঘরের মধ্যে ঘর কেন? কারণ আছে! ওই ঘরের মধ্যেকার ঘরের ভেতরে আছে অনেক ছোট ছোট বেঁটে মোটা সুতো। এমনি সুতো নয় রীতিমত মাঞ্জা মারা সুতো। একে অন্যের ঘাড়ে উঠে আছে বটে ওই ছোট্ট জায়গায় সবাই মিলে থাকতে হবে তো। কিন্তু ভীষণ পরিপাটি এরা। কেউ কারো সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে নেই। এই সুতোগুলোর নাম ধরে নিন ক্রোমোসোম (Chromosome) আর এই মাঞ্জা মারা সুতোর ভেতরের আসল সুতোটা হলো গিয়ে আমাদের ডিএনএ (DNA) আর মাঞ্জাটা হলো গিয়ে এই ডিএনএ কে রক্ষা করার (এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার) জন্য কিছু প্রোটিন। তাদের মধ্যে প্রধান ধরণের প্রোটিনগুলোর নাম ধরে নিন হিস্টোন (Histone) আর এই পর্দা ঘেরা ঘরের ভেতর ঘরটি, যেখানে এই ক্রোমোসোমগুলি গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেটি হলো গিয়ে নিউক্লিয়াস (Nucleus)। আর নিউক্লিয়াসের বাইরের পর্দা ঘেরা জেলিটি হলো গিয়ে আমাদের কোষের সাইটোপ্লাজম বা সাইটোসল (Cytoplasm/ Cytosol)। 'সাইটো' মানে কোষ। কোষের সল্যুশন তাই সাইটোসল আর কি। তা এখন এই সাইটোসলে অনেক ধরণের জিনিসপত্র ওই থকথকে জেলির মধ্যে আটকে থাকে। আলাদা আলাদা তাদের কাজ, আলাদা আলাদা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন তাদের নাম। তাদের সবার গল্প একদিনে বলা যাবে না। এখন একজনের কথা বলি, সে আবার নিজেও ওরকম ডাবল পর্দা ঘেরা একটা ছোট লম্বাটে গোল জিনিস। সংখ্যায় অনেক। সবাই মিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সাইটোসলে। বহু বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবীর যখন ছোটকাল, তখন নাকি এরা ছিল পুঁচকে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া। তারা কোনো কারণে প্রাণী কোষে ঢুকে পড়েছিল। আর প্রাণী কোষও কোনো কারণে দেখেছিলো এদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে বের করে দেওয়ার থেকে সাথে রেখে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক উপকার করে ব্যাটারা। "সেই থেকে রয়ে গেছে।" কোষের কাজকর্ম চালাতে গেলে শক্তি লাগে তো? আপনার খাবার দাবার থেকে সেই শক্তি তৈরী করে এরা প্রধানত। এছাড়াও হাজার একটা কাজ করে এরা। যত দিন যাচ্ছে এই একদা পরজীবী এখন কোষের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ছোট্ট জিনিসগুলির অপরিমেয় গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। এদের নাম মাইটোকন্ড্রিয়া (Mitochondria)। এরা খানিক স্বনির্ভরও বটে। নিজের সংখ্যা কোষের মধ্যে নিজেরাই বাড়াতে পারে। মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এরা কোষের।  

আজকের গল্পে এই মাইটোকন্ড্রিয়ারই প্রধান ভূমিকা। তাই এই শিবের গীত গাইলাম। তাহলে এবার গল্পে ঢুকে পড়া যাক সরাসরি। আগেই তো বললাম, মাইটোকন্ড্রিয়া আমাদের শরীরে শক্তির জোগান দেয়। অর্থাৎ খাবার থেকে শক্তি (ল্যাবের ভাষায় ATP) তৈরী করে। এখন এই ATP তৈরী করতে গিয়ে তার দরকার পড়ে অক্সিজেনের। অর্থাৎ আমাদের শ্বাসবায়ুর সাথে আমরা খেয়াল না করেই যা টেনে নিই। মাইটোকন্ড্রিয়ার এই অক্সিজেন টেনে নেওয়ার ক্ষমতাকে (Oxygen Consumption Rate, OCR) বেশ কিছু ক্ষেত্রেই মাইটোকন্ড্রিয়ার কর্মক্ষমতা বলে বিবেচনা করা হয়। অন্তত শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তো বটেই। একটি নির্দিষ্ট সময়ে মাইটোকন্ড্রিয়ার এই OCR অত্যন্ত সুচারুরূপে মাপা সম্ভব। এখন মনে করুন, আপনি যখন শুয়ে-বসে আছেন অর্থাৎ Resting phase এ আছেন তখন আপনার অভ্যন্তরীণ শারীরিক কার্যকলাপ চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বা নড়াচড়ার জন্য যতটুকু শক্তি লাগে তাকে তৈরী করতে মাইটোকন্ড্রিয়ার কিছু পরিমাণ অক্সিজেন লাগে। এটিকে মেপে দেখলেন। এটি হলো গিয়ে আপনার Basal OCR, এবার ধরুন, আপনি বেজায় ছোটা-দৌড়া করলেন, জিমে গিয়ে খুব খানিক নড়াচড়া করলেন। তখন আপনার অনেক বেশি শক্তি দরকার। সে শক্তি যোগান দিতে তখন মাইটোকন্ড্রিয়ার অনেক বেশি অক্সিজেনের দরকার পড়ল। সে হু হু করে অক্সিজেন টানতে লাগলো। এবার এই অবস্থায় OCR সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালো। একে নাহয় বলুন Maximal OCR। 

এবার ছোট্ট একটা বিয়োগ অঙ্ক কষতে হবে। এই Maximal OCR থেকে Basal OCR বাদ দিয়ে দিলে কি পড়ে থাকে? যা পড়ে থাকে সেটা হলো, দরকার পড়লে সাধারণ স্থিতাবস্থা থেকে কতটা বেশি অক্সিজেন আপনার কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াগুলি টানতে পারে। তাইতো? একে আমরা বলবো রিসার্ভ ক্যাপাসিটি (Reserve Capacity)। 

এখন মনে করুন, কোনো কারণে আপনার শরীরের কোষগুলির মাইটোকন্ড্রিয়ার কর্মক্ষমতা কমে গেল তখন কি হবে? সাধারণ বসে থাকা অবস্থায় যতটুকু শক্তি দরকার সেটি তৈরী করতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন টেনে নিতে তাদের বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু হঠাৎ করে খুব বেশি শক্তি দরকার হলে তারা কিন্তু সেই পরিমাণে অক্সিজেন টেনে নিতে পারবে না। এইবারে আগের ফর্মুলা অনুসারে Basal OCR একই রকম থাকলেও Maximal OCR এর পরিমাণ কমে যাবে। তাই তো? তার ফলে আমাদের Reserve Capacity ও কমতে থাকবে। এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি সে উৎপন্ন করতে পারবে না। অর্থাৎ এই রিসার্ভ ক্যাপাসিটির পরিমান মাপলে বোঝা যেতে পারে আপনার মাইটোকন্ড্রিয়া কতটা সুস্থ আছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে তো?

এবার মনে করুন, যদি মাইটোকন্ড্রিয়া অসুস্থ হয়, তবে আপনার শরীরে খাবার থেকে যে পরিমানে শক্তি উৎপন্ন হবার কথা ছিল সেটা হতে পারবে না। মাইটোকন্ড্রিয়া ঠিকঠাকভাবে অক্সিজেন টানতে না পারায়। ফলে আপনার খাবার যেমনকার তেমনই শরীরে জমতে থাকবে। আর শরীর ভাববে, বাহ্ বেশ তো, এর তো তবে শক্তি তৈরীর প্রয়োজন নেই। তাহলে এই খাবার গুলো নিয়ে কি করি? জমিয়েই রাখি বরং পরে কাজে লাগবে। সুতরাং ফ্যাট হিসেবে জমতে শুরু করল। আপনি ভাবলেন, এইরে মোটা হয়ে যাচ্ছি! খাওয়া কমিয়ে দেওয়া যাক। ঝপ করে কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে কোনো পরামর্শ না করে, ইন্টারনেট দেখে খাওয়া কমিয়ে দিয়ে বসলেন। শরীর ভাবলো, এই রে? এতো দেখছি দুর্ভিক্ষ গোছের কিছু শুরু হয়েছে বুঝি। শরীরকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। নইলে আকালের বাজারে সব কোষ কলাগুলো না খেতে পেয়ে মরবে তো। এবার সে কি করলো? আপনি যা খাচ্ছেন প্রাণপণে সেসব জমিয়ে যেতে লাগলো। আপনি যতটুকুই খান না কেন মেদ আর কমে না! কি জ্বালা রে বাবা! এবার আপনি প্রাণপণে জিমে গিয়ে ধাঁই-ধাঁই করে ওজন তুলে, পাঁই-পাঁই করে দৌড়ে তিন মাসেই তিরিশ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলবেন ঠিক করে বসলেন। এবারেও আপনি কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই ইন্টারনেটের গুরুগিরিতে শুরু করে দিলেন। প্রথম দুএকদিন যেতে না যেতেই আপনার হাঁফ ধরছে, বুকে ব্যাথা করছে। চার দিনের দিন পায়ে এমন ব্যাথা করছে যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কারণ আপনার পেশিতে তো কোনো শক্তিই তৈরী হচ্ছে না। ব্যায়াম করার উৎসাহ পাবেন কি করে? অক্সিজেন কাজে লাগছে না, বুকে হাঁফ ধরবে না কেন? উপরন্তু জোর করে ক্ষতিগ্রস্ত মাইটোকন্ড্রিয়ার দিয়ে বেশি কাজ করতে গেছেন দৌড়াদৌড়ি করে। ফলে তারা শক্তি তো তৈরী করেইনি কারণ সেখানেই তাদের গলদ রয়েছে, উপরন্তু অতিরিক্ত অব্যবহারযোগ্য অক্সিজেন থেকে তৈরী করে ফেলেছে ভুরি ভুরি Reactive Oxygen Species বা সংক্ষেপে ROS। এ এক বিচ্ছিরি ধরণের জিনিস। সাধারণ অবস্থায় এটি তৈরী হয় অল্প পরিমাণে। আর সেটা অত্যন্ত দরকার শরীরের বহু দরকারি কাজ করতে। কিন্ত প্রয়োজনের চেয়ে এতটুকু বেশি হলেই এই ROS এর মত বিষ আর হয়না শরীরে। আমি এর সম্পর্কে পরে একদিন বলব গুছিয়ে। এর কথা বলতে শুরু করলে থামা যাবে না। এখন এই ROS যত বেশি তৈরী হবে তত আরো বেশি করে মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে। আর সেই ক্ষতিগ্রস্ত মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে তৈরী হবে আরো বেশি বেশি ROS এ এক সাংঘাতিক আত্মঘাতী চক্র। এই অতিরিক্ত ROS শরীর থেকে কমিয়ে ফেলাই মাইটোকন্ড্রিয়াকে সুস্থ রাখার একটা প্রধান উপায়। এটুকু আপাতত বলি। পরে এই নিয়ে বিস্তারিত গপ্প করা যাবেখন। 

সুতরাং, না খাওয়া কমিয়ে, না দৌড় ঝাঁপ করে কিছুতেই মেদ কমছে না। মেদ জমার আরো একশো আটটা কারণ থাকা স্বত্ত্বেও এই মাইটোকন্ড্রিয়া সুস্থ আছে না নেই সেইটি আগে থেকে জানতে পারলে বেশ হয় তাই না? তাহলে আসল সমস্যার একটা নতুন কারণ বোঝা যায়। এই কথাটি বলবো বলেই ওপরের ওই সব Basal OCR, Maximal OCR, Reserve Capacity ইত্যাদি এতসব হাবিজাবি বকলাম। এবার মন করুন এই OCR মাপার মেশিন ক্লিনিকে ক্লিনিকে চলে এলো। আপনি প্রতিমাসে একবার করে মেপে নিলেন আপনার কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া কেমন আছে, ঠিক করে কাজকর্ম করছে কিনা। যেই না দেখলেন Reserve Capacity কমছে অমনি ভাবলেন মোটা হবার সম্ভাবনা বাড়ছে। আপনি অমনি সতর্ক হয়ে গিয়ে এ মাইটোকন্ড্রিয়াকে সুস্থ করার চেষ্টা শুরু করলেন। মানে শরীরের বাড়তি ROS কমিয়ে সঠিক লেভেলে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন (কি করে? সেটা পরে বলবখন)। বেশ ভাল না ব্যাপারটা? কিন্তু এসব হতে হতে আরো অনেক বছর। এই সবে কালকেই কনফারেন্স এসে এই গল্প শুনলাম। এসব FDA approved হয়ে ক্লিনিকে ক্লিনিকে আসতে বহু বছর লাগবে এখন। ততক্ষণ সন্ধ্যের খিদেটা ছোলাসেদ্ধ, শশা, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুড়ি মাখা চলুক বরং। পিৎজ্জা, পাস্তা, এগরোল, মুঠো মুঠো চিনি আর অপরিমেয় তেল গোল্লায় পাঠানো যাক। ভাল ফ্যাট শরীরে আসুক। মাইটোকন্ড্রিয়াকে সুস্থ রাখতেই হবে। কেমন।

আচ্ছা আজ তবে আসি। পরের সপ্তাহে আবার কথা হবে। 
ভাল থাকুন সব্বাই।
অর্পিতা         

0 comments:

Post a Comment