মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে আছে জানেন। কেন বলুন তো? কারণ পরের সপ্তাহে এতক্ষণ বাড়িতে। হে হে। আট মাস পর বাড়ি গেলে বাড়ির লোকজনও বেশ জমিয়ে আপ্যায়ন করে। অলরেডি খবর পেয়ে গেছি যে বাবা ডজন তিনেক ডিমের অর্ডার দিয়ে ফেলেছে। না না যে সে ডিম নয়। এই ডিম হলো সাধারণ মুরগির ডিমের ঠাকুর্দা। দু-দুটো কুসুম ভেতরে। আমরা বলি ডবল ডিম। খাব, ছাঁদা বেঁধে নিয়ে আসব। ঝুমরোদাকে মনে আছে? সেই যার কথা বাবার ঝামেলা মেটানোর কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম। সেই ঝুমরোদা, আমি যাচ্ছি শুনে কাঁকড়া-ছোটমাছ ইত্যাদির বন্দোবস্ত করছে। দারুন দারুন ব্যাপার স্যাপার। ভেবেই ঢোঁক গিলছি। এই সপ্তাহের আর চার পাঁচ দিন মাত্র কাটিয়ে ফেললেই হলো। তারপরে একদিন রাজধানীর ঠান্ডা স্যান্ডউইচ চিবোতে পারলেই পরদিন বাড়িতে ভোজ। আহ! উপরি পাওনা ট্রেনে যাবার সময় হরেককিসিমের লোক দেখা। আমার আর একটা প্রিয় কাজ। লম্বা ট্রেনজার্নিতে সাধারণত আমি তিনটে কাজ করে থাকি। এক, জানলার বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দারুন দারুন সব চিন্তা করা। দুই, আপার বার্থে উঠে মোষের মত ঘুমানো বা গল্পের বই পড়া। আর তিন, আশেপাশে ইন্টারেষ্টিং কোনো সহযাত্রী থাকলে তাকে নেক্সট ষোলো-সতের ঘন্টার জন্য নজরবন্দী করা, যাতে পরে তাকে নিয়ে খানিক হ্যা হ্যা করা যায় আর এরকম একটা ব্লগ পোস্ট লেখা যায়।
গতবার নভেম্বরে বাড়ি যাবার সময়কার ঘটনা। যাচ্ছিলাম ঠিক দেওয়ালির আগের দিন। স্বভাবতই নিউ দিল্লি স্টেশনে ঢোকার মুখে পা দেবার জায়গা নেই। পৃথিবীর সাড়ে সাতানব্বই পার্সেন্ট লোক সেদিন একই সাথে নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে চায়। ফলে বেশ একটা মুখরোচক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে ঢোকার মুখে। আমরা তো কোনক্রমে নিজেদের সিটে গিয়ে অবস্থিত হলাম। মাঝের সেসব ডিটেলে যাচ্ছিনা। কারণ তার চেয়েও সাতকাহন করে বলার মত বিষয় আসছে। সেইবার কি মনে হয়েছিল যে দুজনেই জানলার ধারে বসে যাব, তাই দুটো লোয়ার বার্থ নিয়েছিলাম আর পরে বুঝেছিলাম যে কত বড় ভুল করেছি। দুজনের দুটো লোয়ার বার্থ জমিয়ে বসেছি। আর ভাবছি যে লোয়ার বার্থ নিয়ে খুব একটা লাভ হলো না বোধহয়। কোনো বয়স্ক মানুষ থাকলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। উপরন্তু হাঁটুতে ব্যথা-কোমরে ব্যথা-আঙ্গুলে ব্যথা- বুক ধড়ফর ইত্যাদি ইত্যাদি জনগণ তো আছেই। এত জনসংখ্যার মধ্যে আমাদের ভাগ্যে একজন না একজন কেউ কি জুটে যাবে না? সুতরাং দম বন্ধ করে বসে থাকি কখন আমাদের কেউ এসে বলবে, "লোয়ার বার্থটা মানে হেঁ হেঁ বুঝতেই তো পারছেন বয়স্ক মানুষ/ পায়ের এই অবস্থায়/ কোমরে দেখুন না বেল্ট.......মানে রাতে শোবার সময়.....হেঁ হেঁ মানে......", আর আমরাও বলব, "না ঠিক আছে রাতে তো কোনো প্রবলেম নেই আমরা একজন ওপরে উঠে যাবখন।" রাতে তো আর জানলা দিয়ে প্রকৃতি দেখা যায় না, অতএব ট্রেনে আমার করণীয় প্রথম কাজটা হচ্ছে না। দ্বিতীয় আর তৃতীয় কাজটার জন্য আপার বার্থটাই উপযুক্ত জায়গা। সুতরাং রাতের জন্য কাউকে নিচের জায়গাটা ছেড়ে দেওয়াই যায়, সানন্দে। সকালে উঠে নিশ্চয়ই আমার জায়গা আমায় ছেড়ে দেবে। কিন্তু না। একবার স্বেচ্ছায় জায়গা ছেড়ে দেওয়া মানে হয়ে গেল। বাকি পুরো সময়টুকুর জন্যই আপনাকে সে সিটের মায়া ত্যাগ করতে হবে। সেটাই নাকি রেল যাত্রার অলিখিত নিয়ম। কতরকম নিয়মই যে জানা যায় রাস্তা ঘাটে বেরোলে তার ইয়ত্তা নেই।
সেবারেও নতুন নিয়ম শিখলাম। প্রথমে ব্যাপারটা আমাদের দুই হাবার মাথায় ঢোকেনি। ট্রেনে উঠে জাঁকিয়ে বসে তো ভাবছি এই বুঝি লোয়ার বার্থের কোনো দাবিদার এলো। শেষ পর্যন্ত উঠলো ছয় জনের একটি পরিবার। অমি তো সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জানলার সিটে চেপে বসে পরিবারের প্রত্যেকের বয়স, এবং কোমর ও হাঁটু সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট হযে পড়ি এবং নিশ্চিন্ত হই। যাক বাবা, প্রত্যেকেই চল্লিশের নিচে, আর দিব্বি তো হই হই করেই চলাফেরা করছে তার মানে প্রত্যেকের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গই ঠিকঠাক আছে বলেই মনে হয়। দলে আছে দুই ভদ্রলোক, যাঁদের আমি যথাক্রমে 'রাম' আর 'শ্যাম' বলব এবার থেকে আপনাদের বোঝাবার সুবিধার জন্য। আর রাম আর শ্যামের দুই বউ, পরে জানতে পারি তাঁরা দুই বোন আর তাঁদের একটি করে ছানা, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। এই ধরুন বছর আটেক আর দশেক বয়স। এই হলো গিয়ে আমাদের সেবারের সহযাত্রী পরিবার। আমি তো উল্লাসে আটখানা হয়ে উঠলাম যে যাক বাবা আমায় জানলার ধার ছাড়তে হলো না।
কিন্তু মারে হরি রাখে কে? ট্রেনে উঠেই অভূতপূর্ব তত্পরতার সঙ্গে যেভাবে ছয় জনের ছ-ছয়ে ছত্রিশ খানা ব্যাগ-সুটকেস-পোঁটলা-হ্যান্ডব্যাগ-লম্বা কাপড় জড়ানো কি একটা যেন-মিল্টনের জলের জার-চটের বস্তা ইতাদি প্রভৃতি সারা পৃথিবীর জিনিস দিয়ে 'রামবাবু' আমাদের দুটো সিটের তলা-সাইড লোয়ার-এর তলা-নিজেদের দুটো আপার বার্থ ভর্তি করে ফেললেন তাতে করে তিনিই যে এই টিমের লিডার তার আর কোনো সন্দেহই রইলো না। সাত-আট মিনিটের মধ্যে দেখা গেল যে দুই সিটের মাঝের হাঁটা-চলার জায়গাটা পর্যন্ত নেই। ভুলবশতঃ আমি জুতো খুলে বাবু হয়ে বসেছিলাম সিটে। পা নামাতে গিয়ে দেখি জুতো কোথায় হরির লুট হয়ে চলে গেছে তার কোনো পাত্তা নেই। তার ওপরে অন্ততঃ গোটা তিনেক নেড়ি-নেড়ি বোঁচকা। আমার পাশে শ্যামবাবুর স্ত্রী (তখন জানতাম না পরে জেনেছি) পুঁচকে আয়নার দিকে অখন্ড মনোযোগে তাকিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক ঘসছেন, দুটি বাচ্চা নিজেদের মধ্যে মোবাইল গেম নিয়ে মারামারি করছে, শ্যামবাবু স্বয়ং বসে বসে দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। আর উল্টোদিকে পিনাকীর পাশে রামবাবুর স্ত্রী (এটাও পরে জেনেছি) সর্বহারার মত মুখ করে বসে আছেন, ভাবলাম বুঝি কোনো প্রবলেম কিন্তু না পরবর্তী ষোলো ঘন্টা ওঁনার মুখের চেহারার কোনো পরিবর্তন আমি দেখিনি-সে যেকোনো ধরনের কথাই হোক না কেন। কারনটা আমি পরে নিজে নিজে বিশ্লেষণ করেছিলাম, পরে বলছি আপনাদের। তাঁর পাশে গোটা পাঁচেক ছোটবড় ব্যাগ এখনো ঠিকঠাক প্লেসমেন্ট না পেয়ে বেকার ছেলেমেয়েদের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর রামবাবু মহা হম্বি তম্বি করে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে নড়াচড়া করছেন।
রামবাবু তার পর গেলেন পাশে এক দুটো কিউবিকল ছেড়ে ওঁনাদের যে আর একটা সিট আছে তার তদারকি করতে। ততক্ষণে শ্যামবাবুর স্ত্রী ঠোঁটের তদারকি সেরে আমায় মিষ্টি হেসে জানিয়ে দিয়েছেন যে বাচ্চারা যদি কখনো জানলার ধারে বসতে চায় আমি যেন তাদের বসতে দি। তাঁদের নিজেদের কোনো ব্যাপার নয় বাচ্চাদের জন্যই বলছেন। আমিও তো সাদা মনে লম্বা করে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে দিয়েছি। অনতিবিলম্বেই রামবাবু ফিরে এসেই দেখে নিলেন কার কোনটা সিট মানে আমরা কোনো বজ্জাতি করে ওঁনাদের সিট নিয়ে নিয়েছি কিনা। আমি তো আগে থেকেই একটা সিটে বাচ্চা বড় মিলিয়ে পাঁচ-পাঁচজন বসায় এমনিতেই সিঁটিয়ে বসেছিলাম, তার ওপরে এই হম্বি তম্বি শুনে তো "আতঙ্কে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে গেলাম"। জানা গেলো যে আমি নাকি ওঁনাদের সিটে বসে আছি। আমি আমার সিট নম্বর মিলিয়ে নিলাম আরেকবার। না তো। আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। হঠাত শুনি আমায় উদ্দেশ্য করে বাজখাঁই গলায় রামবাবু বলছেন- "এই যে, হ্যালো, আপনি একটু এদিকে আসুন তো, এদিকে এসে বসুন। ওখানে আমাদের বাচ্চারা বসবে।" বিশ্বাস করুন একটুও বানিয়ে বলছি না। ঠিক এইভাবেই এই কথাগুলোই বলেছিলেন তাই আমার মনে আছে এখনো। ভাবলাম, যাহ বাবা, এরকম করে বলে কেন। বাচ্চারা বসবে তো ভালো করে বললেই হয়, আর বাচ্চারা তো সেই ট্রেনে ওঠা থেকে মোবাইল নিয়ে ঝটাপটি চালিয়ে যাচ্ছে। মোটেই বায়না করছে না জানলার ধারে বসার। লোহার উইণ্ডোর চেয়ে মোবাইলের উইন্ডো অনেক বেশি আকর্ষনীয় তাদের কাছে। এখনকার মোবাইলের অবদান। তা সে যাই হোক, আমার সিট নম্বর অনুযায়ী আমার লোয়ারের এই সিটটাই হবার কথা। পিনাকী বলল সে কথা। আমিও মিন মিন করে বললাম আমার এত নম্বর সিট, আর সেটা এটাই। ভবি ভোলার নয়। অনেক কিছু বলে টলে শেষ পর্যন্ত এটা দাঁড়ালো যে এসব তাঁর অনেক দেখা আছে। আমি যেন মানে মানে সরে বসি।
আমি দেখলাম যে এই লোকের সাথে তর্ক করা আর দেওয়ালের সাথে তর্ক করা একই ব্যাপার। আমি উঠে পিনাকীর পাশে বসলাম আর শ্যামবাবুর স্ত্রী জাঁকিয়ে বসলেন জানলায়। বাচ্চারা যেমন হুটোপুটি করছিল তেমনিই করতে লাগলো। মাথাটা বেদম গরম হয়ে গেল আমার। বললাম, দেখুন সিট আমি ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু সিটটা আমাদেরই। আপনি নিজের সিট নম্বর মিলিয়ে দেখে নিন। তখন রামবাবু আমায় সেই মারাত্মক জ্ঞানটা দিলেন যে, লোয়ার বার্থের দুটি জানলাই কোনো একটি ফ্যামিলির দখলে থাকতে পারে না। একটা জানলা সবসময় ছেড়ে দিতে হয়। এটা নাকি নিয়ম। মানবিকতা বা সহযাত্রার নিয়ম নয় কিন্তু। রেলের নিয়ম। শুনে হাসব না কাঁদব না রেগে যাব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভেবে চিন্তে হাসাটাই সাব্যস্ত করলাম। আমি ফ্যাঁচ করে হেসে উঠতে দেখি পিনাকীও আমার সাথে সাথে খুক খুক করে হাসতে লেগেছে। পরের পুরো সময়টা জুড়ে আমার এ ধারণা বধ্যমূল হয়েছিল যে রামবাবুর এইধরনের হাস্যকর হম্বিতম্বির কারণেই হয়ত রামবাবুর স্ত্রী সদা সর্বদা 'অনিত্য এ সংসার' - এরকম মুড এ থাকেন।
যাই হোক এতক্ষণ তো রামবাবুর কথাই বললাম। দাঁত খোঁচানোর পর শ্যামবাবুর কি হলো সেকথা তো বলাই হলো না। রামবাবুর বিশেষণ যদি 'পরিচালক' হয় শ্যামবাবু হলেন আদর্শ 'পরিচালিত' এবং অবশ্যই 'খাইয়ে'। তিনি কেবলমাত্র রামবাবুর কথা শুনে চলেন। এবং যা পান তাই বিনা দ্বিধায় অনবরত খেয়ে চলেন। একটা কথোপকথন না বলে থাকতে পারছি না। রামবাবুদের একটি সিট খানিকটা দূরে ছিল। আর সেখানে এঁনাদের ছত্রিশটা ব্যাগের কয়েকটা হয়ত ছিল তাই দলের লিডারকে ওখানে থাকতে হচ্ছিল। এদিকে রাত্রের খাবারের জন্য যখন শ্যামবাবুর কাছে অর্ডার নিতে এলো তখন বেচারা শ্যামবাবুর অবস্থা দেখে আমার হাসি তো পাচ্ছিলোই কিন্তু বেশ খারাপও লাগছিল। আমি কথোপকথনটা মোটামুটি আপনাদেরকে রিলে করার চেষ্টা করছি, কেমন-
--"রাতে কি খাবেন? ভেজ না ননভেজ?"
--"রাতে? দাঁড়ান একটু।" বলে রামবাবুর থেকে জেনে এলেন।
--"মাংস, মাংস, সবাই মাংস-ভাত।"
--"আর কাল ব্রেকফাস্টে?"
--"ও আচ্ছা, দাঁড়ান।" আবার রামবাবুর কাছে গমন।
--"ডিম খাব। তিনটে ডিম আর বাকি এমনি।"
--"এমনি মানে? ভেজ? তাইতো?"
-- "হ্যাঁ ওই।"
--"ডিম কি অমলেট না বয়েলড?"
--"ডিম?" বলে একটু থমকালেন। আর বোধহয় উঠে যেতে ইচ্ছে করলো না। এবার একটু মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে-"কিরে, ডিম ভাজা খাবি না সেদ্ধ?"
ওদিক থেকে উত্তর এলো, "সেদ্ধ, সেদ্ধ"। আর পাশ থেকে, মানে মহিলা দল বলছে "ভাজা ভাজা"। শ্যামবাবুর মহা মুস্কিল। কি বলবেন এখন?
আমিও ততক্ষণে কথোপকথনে প্রায় ঢুকে গেছি। আর একটু হলে প্রায় বলেই ফেলছিলাম, "তাহলে দুটো ভাজা আর দুটো সেদ্ধ হয়ে যাক, আর দুটো ভেজ।" শেষ মুহুর্তে বাপ বাপ বলে সামলে নিলাম। তারপর দেখি লিডার উঠে এসেছে। দেখি কি বলে কিনা, "দুটো ভাজা, দুটো সেদ্ধ"। আমি গর্বিত মুখে পিনাকীর দিকে তাকালাম। সেও দেখি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। এইভাবে তো শ্যামবাবু নিজেই প্রায় একা একা পুরো অর্ডার টর্ডার করে বসে বসে পা নাচাতে লাগলেন। আমরাও ভাবলাম কোনো গাইড এরকম অনুগত ছাত্র পেলে বর্তে যেত।
তারপর তো তাঁর খাবার ক্ষমতারও দারুন নমুনা পেলাম রাতে খাবার সময়। ট্রেনে উঠে সপরিবারে বাড়ি থেকে আনা পরটা থেয়েছিলেন দেখেছি। তারপর রাজধানীর স্ন্যাকস। স্বভাবতই রাতে বাচ্চারা আর মহিলারা বেশি খেতে পারছিলেন না। শ্যামবাবুর ছেলে সন্ধ্যেথেকেই মোবাইল ছেড়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। রাতের খাবার আসতে তার মা তাকে তোলার চেষ্টা করতে দেখি তার বাবা বলে কিনা, "ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, ঘুমোচ্ছে যখন আর তুলে লাভ নেই। পরটা তো খেয়েছে।" আর তখনি দেখলাম শ্যামবাবুর ক্ষমতা। নিজের পুরোটা, স্ত্রীর প্রায় অর্ধেক সঙ্গে ছেলের পুরোটা। সঙ্গে আইসক্রিম, দই ইত্যাদি ইত্যাদি যা যা থাকে স অ অ অ অ ব .......আমরা হাঁ আ আ আ আ করে তাকিয়ে দেখলাম আর মনে মনে নমস্কার করলাম। ভাবলাম আর যাই হোক দুই রতনের সাক্ষ্যাত পেলাম এযাত্রায়। একজন প্রসিদ্ধ নেতা আর একজন প্রসিদ্ধ খাইয়ে। এহেন আমি, যে কিনা যা পাই তাই হাঁউমাঁউ করে খেয়ে খেয়ে এইরকম বিশাল বপুখানি বানিয়েছি সেও কিনা শ্যামবাবুর ভোজনপটুত্ব চোখের সামনে দেখে টেখে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনক্রমে একটা রুটি খানিকটা ভাত দুটো চিকেন পিস দিয়ে চিবিয়ে, আইসক্রিম, দই-টই গুলোকে হাঁ হাঁ করে 'না' বলে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরে আর একটি জিনিস আবিস্কার করেছিলাম যে, আমাদের দুজন বাদ দিলে এখানে বাকি সিটের সংখ্যা চার। আর দূরে ওঁনাদের একটা সিট। সবমিলিয়ে পাঁচটা সিট। অথচ ওঁনাদের জনসংখ্যা ছয়। ব্যাপারটা কি? বছর আস্টেকের বাচ্চা মেয়েটি কি ফাউ? খাবার দাবারের দাম দিয়েছে। আর বাচ্চাটিকে নিয়ে একটা সিটে মা শুয়ে পড়েছে? যাক বাবা, এসব কূট প্রশ্ন আমার মনে না আনাই ভালো। তবে এটুকু বুঝেছিলাম যে করিতকর্মা পরিবার। আমাদের মত ন্যালা ক্যাবলা নয়। কি বলুন?
গতবার নভেম্বরে বাড়ি যাবার সময়কার ঘটনা। যাচ্ছিলাম ঠিক দেওয়ালির আগের দিন। স্বভাবতই নিউ দিল্লি স্টেশনে ঢোকার মুখে পা দেবার জায়গা নেই। পৃথিবীর সাড়ে সাতানব্বই পার্সেন্ট লোক সেদিন একই সাথে নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে চায়। ফলে বেশ একটা মুখরোচক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে ঢোকার মুখে। আমরা তো কোনক্রমে নিজেদের সিটে গিয়ে অবস্থিত হলাম। মাঝের সেসব ডিটেলে যাচ্ছিনা। কারণ তার চেয়েও সাতকাহন করে বলার মত বিষয় আসছে। সেইবার কি মনে হয়েছিল যে দুজনেই জানলার ধারে বসে যাব, তাই দুটো লোয়ার বার্থ নিয়েছিলাম আর পরে বুঝেছিলাম যে কত বড় ভুল করেছি। দুজনের দুটো লোয়ার বার্থ জমিয়ে বসেছি। আর ভাবছি যে লোয়ার বার্থ নিয়ে খুব একটা লাভ হলো না বোধহয়। কোনো বয়স্ক মানুষ থাকলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। উপরন্তু হাঁটুতে ব্যথা-কোমরে ব্যথা-আঙ্গুলে ব্যথা- বুক ধড়ফর ইত্যাদি ইত্যাদি জনগণ তো আছেই। এত জনসংখ্যার মধ্যে আমাদের ভাগ্যে একজন না একজন কেউ কি জুটে যাবে না? সুতরাং দম বন্ধ করে বসে থাকি কখন আমাদের কেউ এসে বলবে, "লোয়ার বার্থটা মানে হেঁ হেঁ বুঝতেই তো পারছেন বয়স্ক মানুষ/ পায়ের এই অবস্থায়/ কোমরে দেখুন না বেল্ট.......মানে রাতে শোবার সময়.....হেঁ হেঁ মানে......", আর আমরাও বলব, "না ঠিক আছে রাতে তো কোনো প্রবলেম নেই আমরা একজন ওপরে উঠে যাবখন।" রাতে তো আর জানলা দিয়ে প্রকৃতি দেখা যায় না, অতএব ট্রেনে আমার করণীয় প্রথম কাজটা হচ্ছে না। দ্বিতীয় আর তৃতীয় কাজটার জন্য আপার বার্থটাই উপযুক্ত জায়গা। সুতরাং রাতের জন্য কাউকে নিচের জায়গাটা ছেড়ে দেওয়াই যায়, সানন্দে। সকালে উঠে নিশ্চয়ই আমার জায়গা আমায় ছেড়ে দেবে। কিন্তু না। একবার স্বেচ্ছায় জায়গা ছেড়ে দেওয়া মানে হয়ে গেল। বাকি পুরো সময়টুকুর জন্যই আপনাকে সে সিটের মায়া ত্যাগ করতে হবে। সেটাই নাকি রেল যাত্রার অলিখিত নিয়ম। কতরকম নিয়মই যে জানা যায় রাস্তা ঘাটে বেরোলে তার ইয়ত্তা নেই।
সেবারেও নতুন নিয়ম শিখলাম। প্রথমে ব্যাপারটা আমাদের দুই হাবার মাথায় ঢোকেনি। ট্রেনে উঠে জাঁকিয়ে বসে তো ভাবছি এই বুঝি লোয়ার বার্থের কোনো দাবিদার এলো। শেষ পর্যন্ত উঠলো ছয় জনের একটি পরিবার। অমি তো সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জানলার সিটে চেপে বসে পরিবারের প্রত্যেকের বয়স, এবং কোমর ও হাঁটু সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট হযে পড়ি এবং নিশ্চিন্ত হই। যাক বাবা, প্রত্যেকেই চল্লিশের নিচে, আর দিব্বি তো হই হই করেই চলাফেরা করছে তার মানে প্রত্যেকের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গই ঠিকঠাক আছে বলেই মনে হয়। দলে আছে দুই ভদ্রলোক, যাঁদের আমি যথাক্রমে 'রাম' আর 'শ্যাম' বলব এবার থেকে আপনাদের বোঝাবার সুবিধার জন্য। আর রাম আর শ্যামের দুই বউ, পরে জানতে পারি তাঁরা দুই বোন আর তাঁদের একটি করে ছানা, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। এই ধরুন বছর আটেক আর দশেক বয়স। এই হলো গিয়ে আমাদের সেবারের সহযাত্রী পরিবার। আমি তো উল্লাসে আটখানা হয়ে উঠলাম যে যাক বাবা আমায় জানলার ধার ছাড়তে হলো না।
কিন্তু মারে হরি রাখে কে? ট্রেনে উঠেই অভূতপূর্ব তত্পরতার সঙ্গে যেভাবে ছয় জনের ছ-ছয়ে ছত্রিশ খানা ব্যাগ-সুটকেস-পোঁটলা-হ্যান্ডব্যাগ-লম্বা কাপড় জড়ানো কি একটা যেন-মিল্টনের জলের জার-চটের বস্তা ইতাদি প্রভৃতি সারা পৃথিবীর জিনিস দিয়ে 'রামবাবু' আমাদের দুটো সিটের তলা-সাইড লোয়ার-এর তলা-নিজেদের দুটো আপার বার্থ ভর্তি করে ফেললেন তাতে করে তিনিই যে এই টিমের লিডার তার আর কোনো সন্দেহই রইলো না। সাত-আট মিনিটের মধ্যে দেখা গেল যে দুই সিটের মাঝের হাঁটা-চলার জায়গাটা পর্যন্ত নেই। ভুলবশতঃ আমি জুতো খুলে বাবু হয়ে বসেছিলাম সিটে। পা নামাতে গিয়ে দেখি জুতো কোথায় হরির লুট হয়ে চলে গেছে তার কোনো পাত্তা নেই। তার ওপরে অন্ততঃ গোটা তিনেক নেড়ি-নেড়ি বোঁচকা। আমার পাশে শ্যামবাবুর স্ত্রী (তখন জানতাম না পরে জেনেছি) পুঁচকে আয়নার দিকে অখন্ড মনোযোগে তাকিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক ঘসছেন, দুটি বাচ্চা নিজেদের মধ্যে মোবাইল গেম নিয়ে মারামারি করছে, শ্যামবাবু স্বয়ং বসে বসে দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। আর উল্টোদিকে পিনাকীর পাশে রামবাবুর স্ত্রী (এটাও পরে জেনেছি) সর্বহারার মত মুখ করে বসে আছেন, ভাবলাম বুঝি কোনো প্রবলেম কিন্তু না পরবর্তী ষোলো ঘন্টা ওঁনার মুখের চেহারার কোনো পরিবর্তন আমি দেখিনি-সে যেকোনো ধরনের কথাই হোক না কেন। কারনটা আমি পরে নিজে নিজে বিশ্লেষণ করেছিলাম, পরে বলছি আপনাদের। তাঁর পাশে গোটা পাঁচেক ছোটবড় ব্যাগ এখনো ঠিকঠাক প্লেসমেন্ট না পেয়ে বেকার ছেলেমেয়েদের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর রামবাবু মহা হম্বি তম্বি করে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে নড়াচড়া করছেন।
রামবাবু তার পর গেলেন পাশে এক দুটো কিউবিকল ছেড়ে ওঁনাদের যে আর একটা সিট আছে তার তদারকি করতে। ততক্ষণে শ্যামবাবুর স্ত্রী ঠোঁটের তদারকি সেরে আমায় মিষ্টি হেসে জানিয়ে দিয়েছেন যে বাচ্চারা যদি কখনো জানলার ধারে বসতে চায় আমি যেন তাদের বসতে দি। তাঁদের নিজেদের কোনো ব্যাপার নয় বাচ্চাদের জন্যই বলছেন। আমিও তো সাদা মনে লম্বা করে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে দিয়েছি। অনতিবিলম্বেই রামবাবু ফিরে এসেই দেখে নিলেন কার কোনটা সিট মানে আমরা কোনো বজ্জাতি করে ওঁনাদের সিট নিয়ে নিয়েছি কিনা। আমি তো আগে থেকেই একটা সিটে বাচ্চা বড় মিলিয়ে পাঁচ-পাঁচজন বসায় এমনিতেই সিঁটিয়ে বসেছিলাম, তার ওপরে এই হম্বি তম্বি শুনে তো "আতঙ্কে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে গেলাম"। জানা গেলো যে আমি নাকি ওঁনাদের সিটে বসে আছি। আমি আমার সিট নম্বর মিলিয়ে নিলাম আরেকবার। না তো। আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। হঠাত শুনি আমায় উদ্দেশ্য করে বাজখাঁই গলায় রামবাবু বলছেন- "এই যে, হ্যালো, আপনি একটু এদিকে আসুন তো, এদিকে এসে বসুন। ওখানে আমাদের বাচ্চারা বসবে।" বিশ্বাস করুন একটুও বানিয়ে বলছি না। ঠিক এইভাবেই এই কথাগুলোই বলেছিলেন তাই আমার মনে আছে এখনো। ভাবলাম, যাহ বাবা, এরকম করে বলে কেন। বাচ্চারা বসবে তো ভালো করে বললেই হয়, আর বাচ্চারা তো সেই ট্রেনে ওঠা থেকে মোবাইল নিয়ে ঝটাপটি চালিয়ে যাচ্ছে। মোটেই বায়না করছে না জানলার ধারে বসার। লোহার উইণ্ডোর চেয়ে মোবাইলের উইন্ডো অনেক বেশি আকর্ষনীয় তাদের কাছে। এখনকার মোবাইলের অবদান। তা সে যাই হোক, আমার সিট নম্বর অনুযায়ী আমার লোয়ারের এই সিটটাই হবার কথা। পিনাকী বলল সে কথা। আমিও মিন মিন করে বললাম আমার এত নম্বর সিট, আর সেটা এটাই। ভবি ভোলার নয়। অনেক কিছু বলে টলে শেষ পর্যন্ত এটা দাঁড়ালো যে এসব তাঁর অনেক দেখা আছে। আমি যেন মানে মানে সরে বসি।
আমি দেখলাম যে এই লোকের সাথে তর্ক করা আর দেওয়ালের সাথে তর্ক করা একই ব্যাপার। আমি উঠে পিনাকীর পাশে বসলাম আর শ্যামবাবুর স্ত্রী জাঁকিয়ে বসলেন জানলায়। বাচ্চারা যেমন হুটোপুটি করছিল তেমনিই করতে লাগলো। মাথাটা বেদম গরম হয়ে গেল আমার। বললাম, দেখুন সিট আমি ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু সিটটা আমাদেরই। আপনি নিজের সিট নম্বর মিলিয়ে দেখে নিন। তখন রামবাবু আমায় সেই মারাত্মক জ্ঞানটা দিলেন যে, লোয়ার বার্থের দুটি জানলাই কোনো একটি ফ্যামিলির দখলে থাকতে পারে না। একটা জানলা সবসময় ছেড়ে দিতে হয়। এটা নাকি নিয়ম। মানবিকতা বা সহযাত্রার নিয়ম নয় কিন্তু। রেলের নিয়ম। শুনে হাসব না কাঁদব না রেগে যাব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভেবে চিন্তে হাসাটাই সাব্যস্ত করলাম। আমি ফ্যাঁচ করে হেসে উঠতে দেখি পিনাকীও আমার সাথে সাথে খুক খুক করে হাসতে লেগেছে। পরের পুরো সময়টা জুড়ে আমার এ ধারণা বধ্যমূল হয়েছিল যে রামবাবুর এইধরনের হাস্যকর হম্বিতম্বির কারণেই হয়ত রামবাবুর স্ত্রী সদা সর্বদা 'অনিত্য এ সংসার' - এরকম মুড এ থাকেন।
যাই হোক এতক্ষণ তো রামবাবুর কথাই বললাম। দাঁত খোঁচানোর পর শ্যামবাবুর কি হলো সেকথা তো বলাই হলো না। রামবাবুর বিশেষণ যদি 'পরিচালক' হয় শ্যামবাবু হলেন আদর্শ 'পরিচালিত' এবং অবশ্যই 'খাইয়ে'। তিনি কেবলমাত্র রামবাবুর কথা শুনে চলেন। এবং যা পান তাই বিনা দ্বিধায় অনবরত খেয়ে চলেন। একটা কথোপকথন না বলে থাকতে পারছি না। রামবাবুদের একটি সিট খানিকটা দূরে ছিল। আর সেখানে এঁনাদের ছত্রিশটা ব্যাগের কয়েকটা হয়ত ছিল তাই দলের লিডারকে ওখানে থাকতে হচ্ছিল। এদিকে রাত্রের খাবারের জন্য যখন শ্যামবাবুর কাছে অর্ডার নিতে এলো তখন বেচারা শ্যামবাবুর অবস্থা দেখে আমার হাসি তো পাচ্ছিলোই কিন্তু বেশ খারাপও লাগছিল। আমি কথোপকথনটা মোটামুটি আপনাদেরকে রিলে করার চেষ্টা করছি, কেমন-
--"রাতে কি খাবেন? ভেজ না ননভেজ?"
--"রাতে? দাঁড়ান একটু।" বলে রামবাবুর থেকে জেনে এলেন।
--"মাংস, মাংস, সবাই মাংস-ভাত।"
--"আর কাল ব্রেকফাস্টে?"
--"ও আচ্ছা, দাঁড়ান।" আবার রামবাবুর কাছে গমন।
--"ডিম খাব। তিনটে ডিম আর বাকি এমনি।"
--"এমনি মানে? ভেজ? তাইতো?"
-- "হ্যাঁ ওই।"
--"ডিম কি অমলেট না বয়েলড?"
--"ডিম?" বলে একটু থমকালেন। আর বোধহয় উঠে যেতে ইচ্ছে করলো না। এবার একটু মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে-"কিরে, ডিম ভাজা খাবি না সেদ্ধ?"
ওদিক থেকে উত্তর এলো, "সেদ্ধ, সেদ্ধ"। আর পাশ থেকে, মানে মহিলা দল বলছে "ভাজা ভাজা"। শ্যামবাবুর মহা মুস্কিল। কি বলবেন এখন?
আমিও ততক্ষণে কথোপকথনে প্রায় ঢুকে গেছি। আর একটু হলে প্রায় বলেই ফেলছিলাম, "তাহলে দুটো ভাজা আর দুটো সেদ্ধ হয়ে যাক, আর দুটো ভেজ।" শেষ মুহুর্তে বাপ বাপ বলে সামলে নিলাম। তারপর দেখি লিডার উঠে এসেছে। দেখি কি বলে কিনা, "দুটো ভাজা, দুটো সেদ্ধ"। আমি গর্বিত মুখে পিনাকীর দিকে তাকালাম। সেও দেখি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। এইভাবে তো শ্যামবাবু নিজেই প্রায় একা একা পুরো অর্ডার টর্ডার করে বসে বসে পা নাচাতে লাগলেন। আমরাও ভাবলাম কোনো গাইড এরকম অনুগত ছাত্র পেলে বর্তে যেত।
তারপর তো তাঁর খাবার ক্ষমতারও দারুন নমুনা পেলাম রাতে খাবার সময়। ট্রেনে উঠে সপরিবারে বাড়ি থেকে আনা পরটা থেয়েছিলেন দেখেছি। তারপর রাজধানীর স্ন্যাকস। স্বভাবতই রাতে বাচ্চারা আর মহিলারা বেশি খেতে পারছিলেন না। শ্যামবাবুর ছেলে সন্ধ্যেথেকেই মোবাইল ছেড়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। রাতের খাবার আসতে তার মা তাকে তোলার চেষ্টা করতে দেখি তার বাবা বলে কিনা, "ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, ঘুমোচ্ছে যখন আর তুলে লাভ নেই। পরটা তো খেয়েছে।" আর তখনি দেখলাম শ্যামবাবুর ক্ষমতা। নিজের পুরোটা, স্ত্রীর প্রায় অর্ধেক সঙ্গে ছেলের পুরোটা। সঙ্গে আইসক্রিম, দই ইত্যাদি ইত্যাদি যা যা থাকে স অ অ অ অ ব .......আমরা হাঁ আ আ আ আ করে তাকিয়ে দেখলাম আর মনে মনে নমস্কার করলাম। ভাবলাম আর যাই হোক দুই রতনের সাক্ষ্যাত পেলাম এযাত্রায়। একজন প্রসিদ্ধ নেতা আর একজন প্রসিদ্ধ খাইয়ে। এহেন আমি, যে কিনা যা পাই তাই হাঁউমাঁউ করে খেয়ে খেয়ে এইরকম বিশাল বপুখানি বানিয়েছি সেও কিনা শ্যামবাবুর ভোজনপটুত্ব চোখের সামনে দেখে টেখে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনক্রমে একটা রুটি খানিকটা ভাত দুটো চিকেন পিস দিয়ে চিবিয়ে, আইসক্রিম, দই-টই গুলোকে হাঁ হাঁ করে 'না' বলে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরে আর একটি জিনিস আবিস্কার করেছিলাম যে, আমাদের দুজন বাদ দিলে এখানে বাকি সিটের সংখ্যা চার। আর দূরে ওঁনাদের একটা সিট। সবমিলিয়ে পাঁচটা সিট। অথচ ওঁনাদের জনসংখ্যা ছয়। ব্যাপারটা কি? বছর আস্টেকের বাচ্চা মেয়েটি কি ফাউ? খাবার দাবারের দাম দিয়েছে। আর বাচ্চাটিকে নিয়ে একটা সিটে মা শুয়ে পড়েছে? যাক বাবা, এসব কূট প্রশ্ন আমার মনে না আনাই ভালো। তবে এটুকু বুঝেছিলাম যে করিতকর্মা পরিবার। আমাদের মত ন্যালা ক্যাবলা নয়। কি বলুন?
0 comments:
Post a Comment