5th August দিনটা বিশেষ বিখ্যাত নয় হয়ত। আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতই ক্যালেন্ডারের একটা তারিখ। কিন্তু আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে এরকমই এক 5th August এই সূচনা হয়েছিল এমন এক পরিস্থিতির যার ফলে হয়ত আমাদের মত আমজনতার গায়ে বিশেষ কোনো আঁচ না লাগলেও ভারতীয় সৈন্য বিভাগে রীতিমত হুলুস্হুল পড়ে গিয়েছিল।
১৯৬৫ সালের ৫ই অগাস্ট সাতসকালে হঠাতই তানমার্গ পুলিশচৌকিতে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির গুলমার্গের দক্ষিন-পশ্চিমের একটি ছোট্ট গ্রাম 'দাড়াকাসসী'-র পুঁচকে গুর্জর ছোঁড়া 'মহম্মদ দীন'।....... "আরে আরে করে কি করে কি, বলা নেই কওয়া নেই সোজা পুলিশ চৌকিতে? ব্যাটার ভয়ডর বলে কিছু নেই নাকি? এই, কি চাই রে তোর? সাতসকালে এখানে এসে হল্লা করছিস কেন?"........... এইসব যখন প্রশ্নবান চলছে মহম্মদ দীন তো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে - "হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি দাঁড়ান....... দুটো লোক....ওই হোথায়.....পেল্লায় চেহারা.....হাতে বন্দুকও আছে.....আমায় অনেক টাকা দিল......মিলিটারি ক্যাম্পটা কোথায়, কত দূর, কত লোক আছে সেখানে.......এসব অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করছিল।"
--"আরে ধুর ছোঁড়া দাঁড়া দাঁড়া, তড়বড় করে বলেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে দে ভালো করে। কে লোক? তোকে তারা কোথায় পেল? কেমন দেখতে তাদের? কোথায় তারা?"
--"বলছি তো, আমি ওই হোথায় পাহাড়ের ঢালে ভেড়ার পাল নিয়ে গেছিলাম তো সকালে। সেখানেই তো দেখলাম। সবুজ রঙের সালওয়ার কুর্তা পরা দুটো লোক আগে কোনদিন দেখিনি, আমায় টাকা দিল তো অনেক, এই দেখো না, বলল আরো দেবে যদি আরো খবর দিতে পারি।"
--"কি খবর?"
--"সেনা ছাউনির সব রকমের খবর"।
--"বলিস কি রে? ঠিক বলছিস তো? ভুল হলে কিন্তু বেদম পিটিয়ে সোজা জেলে ভরে দেব, মনে থাকে যেন।"
--"আরে না না, চল না, এখুনি তো কথা বলে এলাম। আমার কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছিল না তাই তো বলতে এলাম।"
--"চল তো দেখি।"
উপরের কথোপকথনটা আমার বানানো, কিন্তু ঘটনাটা এবং স্থান কাল পাত্রের নাম আদ্যন্ত নির্য্যস সত্যি। মোটামুটি জুন মাসের শুরু থেকেই আস্তে আস্তে তখনকার সিজ ফায়ার লাইন (CFL) যেটা বাহাত্তর সালের শিমলা চুক্তিতে 'লাইন অফ কন্ট্রোল' বলে পরিচিত হবে সেই আগাপাশতলা অশরীরী বেড়াটাকে টপকে সাধারণ কাশ্মিরীদের পোশাকে কাশ্মির উপত্যকায় ঢুকতে থাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সঙ্গে 'আজাদ কাশ্মীর ব্যাটেলিয়ান' নামধারী কিছু সেনা। মহম্মদ দীন এর দৌলতে সেদিন ততক্ষনাত বর্ডার পুলিশ এবং ভারতীয় সেনাদল তত্পর হয়ে ওঠে। সাতজন অনুপ্রবেশকারী গ্রেপ্তার হয়েছিল সেদিন। পরের তিন চার দিন ধরে লাগাতার তল্লাশিতে ধরা পড়ে আরো অনেক অনুপ্রবেশকারী, সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র। আটই অগাস্ট গ্রেফতার করা হয় দুজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে। আর তাদের থেকেই উদ্ধার করা হয় পাকিস্তানের 'অপারেশন জিব্রাল্টার' সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। মতলব ছিল ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন সময়ে CFL টপকে ঢুকবে পাকিস্থানি সেনা। এবং পরে কোনো এক নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হয়ে ভ্যালিতে নেমে আসবে। আমাদের পুঁচকে সাহসী মহম্মদ দীন যে সে গুড়ের নাগড়িতে একসাথে একশ পঁচিশ মণ বালি ঢেলে দেবে তাতো তারা জানত না না। তার ওপরে কয়েক মাস আগে এপ্রিল মাসে কচ্ছের রান নিয়ে দুপক্ষের কামড়াকামড়িতে বেচারারা বেমালুম হেরে বসে আছে। পাকিস্থানের দাবি, কচ্ছের রানের ওই পান্ডববর্জিত রুক্ষ জায়গাটার একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটারই নাকি তাদের চাই। ওটা নাকি তাদেরই। ভারত উত্তরে বলল, 'ইল্লি আর কি? মামার বাড়ির আবদার? 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।' সুতরাং, 'লাগ-লাগ-লাগ নারদ! নারদ!' সেই রণঝটাপটি থামাতে শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে উকিল ধরে আনতে হলো। সে উকিল অর্থাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন যখন অনেক ভেবে চিন্তে পেন্সিল টেন্সিল চুষে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হাতে একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটার এর জায়গায় মাত্র নয়শ দশ বর্গকিলোমিটার এর চুষিকাঠি ধরিয়ে দিলেন তখন তো মানে বুঝতেই পারছেন আয়ুব খানের মুখের অবস্থা কি হয়েছিল। খানিকটা ওই চার বছরের ছানা যদি এক প্লেট মাটন বিরিয়ানির পুরোটাই খাবে বলে আর তাকে যদি ভুজুং ভাজুং দিয়ে একটা চাটনি খাবার বাটিতে করে বিরিয়ানি খেতে দেওয়া হয়, অনেকটা সেরকম আর কি। এইসব রাগ যাবে কোথায়? সুতরাং পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্থান শুরু করে দিল 'অপারেশন গ্র্যান্ড স্লাম'। সেসব তো বহুল চর্চিত ব্যাপার-স্যাপার। সেসবের মধ্যে আর যাচ্ছি না এখন। আমার যেটা বলার সেটা হলো এই ৫ই অগাস্ট তারিখটা কিন্তু ফেলনা নয়। আর 'দাড়াকাসসী'-গ্রামের 'মহম্মদ দীন' তো 'হিরো অফ ফিফথ অগাস্ট'।
আমার প্রচন্ড চেনা একজন লোক, যিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান আর্মিতে থাকার এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের দু-দুটি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ পান, তাঁর ১৯৬৫ সালের একটি ডায়েরি আমার হাতে এসে পড়ে। আর ডায়েরির মালিকের সম্মতিক্রমে সে ডায়েরি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়। ফলে আমি জানতে পারি যে, ১৯৬৫ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতীয় সেনাদলের সর্বস্তরে এই অনুপ্রবেশের খবর তখনও পৌঁছায়নি। কারণ সেদিনের ডায়েরির এন্ট্রি অনুসারে তিনি তখন তাঁর অসমাপ্ত পড়াশুনার জন্য আক্ষেপ, আর সেসময়ে তাঁর জীবনে এই মিলিটারি চাকরিটির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেই লিখে গেছেন। পরবর্তী দু এক মাসের ডায়েরির পাতায় পাতায় অবশ্য অন্য ইতিহাস। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে পড়াশুনা ছেড়ে পেটের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেখানে দেশপ্রেম কতটা, কতটাই বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদ, কতটা মিলিটারী নিয়মানুবর্তীতার প্রতি শ্রদ্ধা, কতটাইবা দারিদ্রের উর্দ্ধে উঠে কাজের প্রতি সততা, সত্যের প্রতি সততা, আগের দিন পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধরত বন্ধুর মৃতদেহ পরদিন কফিনবন্দি হতে দেখার যন্ত্রণা আর কতটাইবা যুদ্ধবিজয়ী পাকিস্থানি গ্রামে স্বজন পরিত্যাক্তা বৃদ্ধাকে দেখে গ্রামে রেখে আসা বৃদ্ধা মায়ের মুখ মনে পড়ে যাওয়ার কষ্ট সেসবেরই ইতিহাস সেই ডায়েরি। এককথায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সিগনালিং ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা যেকোনো সাধারণ একজন সেনানীর কাছে ১৯৬৫ সালের এই ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ সেই ডায়েরি।
যুদ্ধের হার জিত, রাজনৈতিক নীতি, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব, বড় বড় সেনা নায়কদের কীর্তি এসবের তো হাজার হাজার তথ্য ছড়ানো চার দিকে। কিন্তু সে যুদ্ধে যাঁরা 'টিনের তলোয়ার' নয় সত্যিকারের তলোয়ার হাতে 'জয়্মা' বলে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা তাঁদের জীবনটাকে ঠিক কিভাবে দেখেন তার সঠিক তথ্য মেলা ভার। তাই সেরকম একজনের যুদ্ধকালীন সময়ের রোজনামচা যখন এসেই পড়ল হাতে তখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকি কেন?দিনলিপিটির আসল মালিকের সর্বান্তসম্মতিক্রমে সে ডায়েরির অনেক গল্পই ভবিষ্যতে বিশদে আপনাদেরকে বলার আশা রাখি। কেমন যেন মনে হচ্ছে, বলাটা বোধহয় আমার দায়িত্ব। কারনটা শুধু মাত্র এই নয় যে ডায়েরির মালিক হলেন আমার বাবা, সঙ্গে এটাও যে এই গল্প বোধহয় শুধু আমার বাবার একার নয়। ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১ অথবা হালের কার্গিল যুদ্ধসহ সীমান্তে প্রতিদিনের লড়াইতে জীবন না মৃত্যু, দেশপ্রেম না গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান- এসবের মধ্যে দোলাচলে দিনযাপন করে চলা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রাম-গ্রামান্ত থেকে উঠে আসা হাজার হাজার সাধারণ সেনানীরও এই একই গল্প। হয়ত একটু এদিক ওদিক।
১৯৬৫ সালের ৫ই অগাস্ট সাতসকালে হঠাতই তানমার্গ পুলিশচৌকিতে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির গুলমার্গের দক্ষিন-পশ্চিমের একটি ছোট্ট গ্রাম 'দাড়াকাসসী'-র পুঁচকে গুর্জর ছোঁড়া 'মহম্মদ দীন'।....... "আরে আরে করে কি করে কি, বলা নেই কওয়া নেই সোজা পুলিশ চৌকিতে? ব্যাটার ভয়ডর বলে কিছু নেই নাকি? এই, কি চাই রে তোর? সাতসকালে এখানে এসে হল্লা করছিস কেন?"........... এইসব যখন প্রশ্নবান চলছে মহম্মদ দীন তো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে - "হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি দাঁড়ান....... দুটো লোক....ওই হোথায়.....পেল্লায় চেহারা.....হাতে বন্দুকও আছে.....আমায় অনেক টাকা দিল......মিলিটারি ক্যাম্পটা কোথায়, কত দূর, কত লোক আছে সেখানে.......এসব অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করছিল।"
--"আরে ধুর ছোঁড়া দাঁড়া দাঁড়া, তড়বড় করে বলেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে দে ভালো করে। কে লোক? তোকে তারা কোথায় পেল? কেমন দেখতে তাদের? কোথায় তারা?"
--"বলছি তো, আমি ওই হোথায় পাহাড়ের ঢালে ভেড়ার পাল নিয়ে গেছিলাম তো সকালে। সেখানেই তো দেখলাম। সবুজ রঙের সালওয়ার কুর্তা পরা দুটো লোক আগে কোনদিন দেখিনি, আমায় টাকা দিল তো অনেক, এই দেখো না, বলল আরো দেবে যদি আরো খবর দিতে পারি।"
--"কি খবর?"
--"সেনা ছাউনির সব রকমের খবর"।
--"বলিস কি রে? ঠিক বলছিস তো? ভুল হলে কিন্তু বেদম পিটিয়ে সোজা জেলে ভরে দেব, মনে থাকে যেন।"
--"আরে না না, চল না, এখুনি তো কথা বলে এলাম। আমার কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছিল না তাই তো বলতে এলাম।"
--"চল তো দেখি।"
উপরের কথোপকথনটা আমার বানানো, কিন্তু ঘটনাটা এবং স্থান কাল পাত্রের নাম আদ্যন্ত নির্য্যস সত্যি। মোটামুটি জুন মাসের শুরু থেকেই আস্তে আস্তে তখনকার সিজ ফায়ার লাইন (CFL) যেটা বাহাত্তর সালের শিমলা চুক্তিতে 'লাইন অফ কন্ট্রোল' বলে পরিচিত হবে সেই আগাপাশতলা অশরীরী বেড়াটাকে টপকে সাধারণ কাশ্মিরীদের পোশাকে কাশ্মির উপত্যকায় ঢুকতে থাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সঙ্গে 'আজাদ কাশ্মীর ব্যাটেলিয়ান' নামধারী কিছু সেনা। মহম্মদ দীন এর দৌলতে সেদিন ততক্ষনাত বর্ডার পুলিশ এবং ভারতীয় সেনাদল তত্পর হয়ে ওঠে। সাতজন অনুপ্রবেশকারী গ্রেপ্তার হয়েছিল সেদিন। পরের তিন চার দিন ধরে লাগাতার তল্লাশিতে ধরা পড়ে আরো অনেক অনুপ্রবেশকারী, সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র। আটই অগাস্ট গ্রেফতার করা হয় দুজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে। আর তাদের থেকেই উদ্ধার করা হয় পাকিস্তানের 'অপারেশন জিব্রাল্টার' সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। মতলব ছিল ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন সময়ে CFL টপকে ঢুকবে পাকিস্থানি সেনা। এবং পরে কোনো এক নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হয়ে ভ্যালিতে নেমে আসবে। আমাদের পুঁচকে সাহসী মহম্মদ দীন যে সে গুড়ের নাগড়িতে একসাথে একশ পঁচিশ মণ বালি ঢেলে দেবে তাতো তারা জানত না না। তার ওপরে কয়েক মাস আগে এপ্রিল মাসে কচ্ছের রান নিয়ে দুপক্ষের কামড়াকামড়িতে বেচারারা বেমালুম হেরে বসে আছে। পাকিস্থানের দাবি, কচ্ছের রানের ওই পান্ডববর্জিত রুক্ষ জায়গাটার একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটারই নাকি তাদের চাই। ওটা নাকি তাদেরই। ভারত উত্তরে বলল, 'ইল্লি আর কি? মামার বাড়ির আবদার? 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।' সুতরাং, 'লাগ-লাগ-লাগ নারদ! নারদ!' সেই রণঝটাপটি থামাতে শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে উকিল ধরে আনতে হলো। সে উকিল অর্থাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন যখন অনেক ভেবে চিন্তে পেন্সিল টেন্সিল চুষে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হাতে একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটার এর জায়গায় মাত্র নয়শ দশ বর্গকিলোমিটার এর চুষিকাঠি ধরিয়ে দিলেন তখন তো মানে বুঝতেই পারছেন আয়ুব খানের মুখের অবস্থা কি হয়েছিল। খানিকটা ওই চার বছরের ছানা যদি এক প্লেট মাটন বিরিয়ানির পুরোটাই খাবে বলে আর তাকে যদি ভুজুং ভাজুং দিয়ে একটা চাটনি খাবার বাটিতে করে বিরিয়ানি খেতে দেওয়া হয়, অনেকটা সেরকম আর কি। এইসব রাগ যাবে কোথায়? সুতরাং পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্থান শুরু করে দিল 'অপারেশন গ্র্যান্ড স্লাম'। সেসব তো বহুল চর্চিত ব্যাপার-স্যাপার। সেসবের মধ্যে আর যাচ্ছি না এখন। আমার যেটা বলার সেটা হলো এই ৫ই অগাস্ট তারিখটা কিন্তু ফেলনা নয়। আর 'দাড়াকাসসী'-গ্রামের 'মহম্মদ দীন' তো 'হিরো অফ ফিফথ অগাস্ট'।
আমার প্রচন্ড চেনা একজন লোক, যিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান আর্মিতে থাকার এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের দু-দুটি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ পান, তাঁর ১৯৬৫ সালের একটি ডায়েরি আমার হাতে এসে পড়ে। আর ডায়েরির মালিকের সম্মতিক্রমে সে ডায়েরি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়। ফলে আমি জানতে পারি যে, ১৯৬৫ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতীয় সেনাদলের সর্বস্তরে এই অনুপ্রবেশের খবর তখনও পৌঁছায়নি। কারণ সেদিনের ডায়েরির এন্ট্রি অনুসারে তিনি তখন তাঁর অসমাপ্ত পড়াশুনার জন্য আক্ষেপ, আর সেসময়ে তাঁর জীবনে এই মিলিটারি চাকরিটির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেই লিখে গেছেন। পরবর্তী দু এক মাসের ডায়েরির পাতায় পাতায় অবশ্য অন্য ইতিহাস। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে পড়াশুনা ছেড়ে পেটের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেখানে দেশপ্রেম কতটা, কতটাই বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদ, কতটা মিলিটারী নিয়মানুবর্তীতার প্রতি শ্রদ্ধা, কতটাইবা দারিদ্রের উর্দ্ধে উঠে কাজের প্রতি সততা, সত্যের প্রতি সততা, আগের দিন পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধরত বন্ধুর মৃতদেহ পরদিন কফিনবন্দি হতে দেখার যন্ত্রণা আর কতটাইবা যুদ্ধবিজয়ী পাকিস্থানি গ্রামে স্বজন পরিত্যাক্তা বৃদ্ধাকে দেখে গ্রামে রেখে আসা বৃদ্ধা মায়ের মুখ মনে পড়ে যাওয়ার কষ্ট সেসবেরই ইতিহাস সেই ডায়েরি। এককথায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সিগনালিং ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা যেকোনো সাধারণ একজন সেনানীর কাছে ১৯৬৫ সালের এই ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ সেই ডায়েরি।
যুদ্ধের হার জিত, রাজনৈতিক নীতি, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব, বড় বড় সেনা নায়কদের কীর্তি এসবের তো হাজার হাজার তথ্য ছড়ানো চার দিকে। কিন্তু সে যুদ্ধে যাঁরা 'টিনের তলোয়ার' নয় সত্যিকারের তলোয়ার হাতে 'জয়্মা' বলে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা তাঁদের জীবনটাকে ঠিক কিভাবে দেখেন তার সঠিক তথ্য মেলা ভার। তাই সেরকম একজনের যুদ্ধকালীন সময়ের রোজনামচা যখন এসেই পড়ল হাতে তখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকি কেন?দিনলিপিটির আসল মালিকের সর্বান্তসম্মতিক্রমে সে ডায়েরির অনেক গল্পই ভবিষ্যতে বিশদে আপনাদেরকে বলার আশা রাখি। কেমন যেন মনে হচ্ছে, বলাটা বোধহয় আমার দায়িত্ব। কারনটা শুধু মাত্র এই নয় যে ডায়েরির মালিক হলেন আমার বাবা, সঙ্গে এটাও যে এই গল্প বোধহয় শুধু আমার বাবার একার নয়। ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১ অথবা হালের কার্গিল যুদ্ধসহ সীমান্তে প্রতিদিনের লড়াইতে জীবন না মৃত্যু, দেশপ্রেম না গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান- এসবের মধ্যে দোলাচলে দিনযাপন করে চলা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রাম-গ্রামান্ত থেকে উঠে আসা হাজার হাজার সাধারণ সেনানীরও এই একই গল্প। হয়ত একটু এদিক ওদিক।
0 comments:
Post a Comment