-দাদু, তুমি এখনও বাড়ি যাওনি? এত বেলা পর্যন্ত
মাঠে কি করছিলে? এত রোদ? ছাতা-ফাতাও নাওনি একটা! মা চিন্তা করবে যে।
-কে রে? লবা নাকি? এই যে এবার যাচ্ছি। আমার
আবার ছাতা? পুন্ন সামন্ত আর কবে রোদ-বিস্টির ধার ধেরেছে রে? আমায় ছাতা লিতে দেখছু
কখনও?
-সে নাহয় নাওনি আগে, এখন তো বয়স হয়েছে। এরকম
করে কেউ রোদে ঘোরে? মাঠে কি করছিলে এতক্ষণ?
-এই গরমের ধান উঠতেছে, ঘরের বাখুলে তো গাদা
দিবার জাগাই রাখেনি তর বাপ। ফ্যাসানের ঘর-দালান হচ্ছে তার। এখন ধান উঠলে কোথায়
রাখা হবে সেসব তো কেউ দেখবেনি লয়? সেতো এই বুড়োটাকেই দেখতে হবে। গেছিলুম রতনের
খামারটা যদি দেয় তাই জিগাতে।
- তা ধান উঠবে তো রাজিবুল চাচা তো আছে, সব
দেখেশুনে গুছিয়ে দেবে, তুমি ছোটাছুটি করছ কেন?
-নিজের জমির ধান, সে তো নক্ষ্মী রে বাপ। তা
ঘরের নক্ষ্মীর বসার জাগা সেকি বাইরের নোক ঠিক করে দিলে হয়?
-তাই বলে এই বয়সে.........।
-কি করব? তর বাপ দাদারা তো... দাদারা আর কেন
বলি, মেজবাবু তো মোদের বাপ ঠাকুরদাদা বলে পরিচয় দিতে নজ্জা পায়। পরাশুনা শিখছে।
শিক্ষিত। নাথি মারি অমন শিক্ষের মুখে। বিয়ে করে সেই যে বাবু বিবি গ্যালেন,
বচ্ছরান্তে একবারও তো ঘরের কথা মনে করেনি। তুই যেন অমন করিসনি লবা।
- ছাড়ো না দাদু। আবার ওসব কথা কেন? যে
যার মতো আছে।
-না বাপ, আমার আর কি? তমরা সব ভাল থাকলেই
ভাল। কিন্তু নিজের বাপ পিতেমোর ভিটেকে হেলাছেদ্দা করা ভাল নয় বাপ। ভাল নয়। তাতে
অভিশাপ লাগে। তমরা এখনকরার ছেলেপুলে, তমরা মানবেনি। নিজের জন্মভিটে-যে তমায় থাকতে
দিল, নিজের জমিজিরেত-যে তমায় খেতে দিল তাদের আশিব্বাদ না পেলে কোথাও শান্তিতে
থাকতে পারবেনি জেনে রেখ।
এই যে তর বাপ দাদা, জমি জায়গা পুখুর বাগান
ফেলে কি করছে? পঞ্চায়েত- পাটি- মিটিন- ভোট। যতসব উঞ্ছ কাজ। ক্ষমতা চাই। ট্যাকা
চাই। নিজের ছেলে, লাতি কি বলব বল। আর আমার কথা কেই বা শোনে? লিজেরটুকুনি লিয়ে
শান্তিতে থাক, তা সইবেনি। কুন পথে যে তর বাপ লতুন ঘর দালান তুলছে সে কি আমি বুজিনি
রে বাপ? সবই বুঝি। তর মা কে আমি বলেছি। সব উচ্ছুন্নে যাবে দেখ বউমা সব উচ্ছুন্নে
যাবে।
-মা কি বলে?
-সে আমার ঘরের নক্ষ্মী রে লবা। সে সবই বোঝে। কি আর বলবে? বলে,
বাবা আপনি চুপ করুন। এখনি শুনতে পেলে চিল্লাবে। সেই বা কি করবে? দুদিক রক্ষে করে
চলেছে। কত মানা করল তর বাপকে পুরানো ঘর দুয়ার ত ভালই আছে কি হবে লতুন ঘর? তর বাপ
শুনলে তো। পুরানোতে মন উঠেনি তার? বলে আমি হলুম পঞ্চায়েত পরধান। কত নোক আসে ঘরে।
মাটির ঘর কি ভাল দেখায়? আরে বাপ আজ তুই পরধান তো কি? তুই মানুষটার কি তাতে চারটে
ঠ্যাং বারাইছে? পরের মেরে লিজের ঘর তুলবি? ছ্যা ছ্যা। বলেছি বলে বলে কি জানিস? বলে,
তুমি কি ট্যাকা দিবে ঘর বানাতে? দাওনা মনসাতলার পুখুরটা বেচে।
-তা বেচে তো তোমায় একদিন দিতেই হবে দাদু।
কদ্দিন তুমি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে বল?
-কেন? রাখতে পারব না কেন? আমি কি খেতে পাইনা
নাকি যে পুখুর জমি বেচে খেতে হবে? নিজের হাতে করা পুখুর জমি রে বাপ। তর বাপ দাদা
তার দাম বুজলনি। এখনও যদি ওসব ছেড়ে জমিজিরেতগুলোকে দেখে তো এখনকার চেয়ে দুইগুণ
পয়সা ফিরে দিবে এই জমি আমি তকে বলে রাখছি লবা। আমার শরীল আর দেয় না বাপ তাই পরের
হাতে দায় ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওই রাজিবুল যা করে করে। মেনে লিয়েছি। তর দাদাকে আমি
কতবার বলছি জানিস? তর মা ও বলছে, দৌড়াদৌড়ী ছেড়ে জমিজমাগুলো দেখ। চাকরি বাকরিও তো
করিসনি কো। তা ত্যানার নিজের ঘরের জমি চাষ করতে মানে লাগে। কিন্তু দেখ গে যা ভোটের
সময় ন্যাতাবাবুর গু-মুত পরিস্কার করতে মানে লাগে না। কুলাঙ্গার হতভাগা। বৌটাও
তেমনি জুটেছে। লেচে বেড়াচ্ছে।
-যাক গে দাদু ছাড়ো। চলো বাড়ি চলো। অনেক বেলা
হল। চান-খাওয়া হয়নি।
--তা হোক। চ ত বাপ, পিপুলতলায় দুদণ্ড জিরিয়ে
যাই।
-
সে কি দাদু? তুমি সাইকেলের পেছনে ওঠো না। এখুনি বাড়ি পৌঁছে যাব। তারপর জিরিয়ো না
হয়। খাওয়া দাওয়া করবে না? মা বকবে তোমায় দেখো। এমনিতেই এত বেলা হল।
-তর মা তো আমাকে সর্বদাই বকছে। হবেখন নাওয়া
খাওয়া। একদিন দেরি হলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধু হবে?
-বোসো তবে।
সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে নব। দাদু নাতি
পিপুলতলার বাঁশের মাচানে উঠে বসে। এই দুপুর রোদেও জায়গাটা বেশ আরামদায়ক। অল্প
হাওয়া দিচ্ছে। সেই হাওয়াতে পিপুলতলার মানসিকের লাল সুতোয় বাঁধা ঢেলার টুকরোগুলোকে দুলতে
দেখল নব। মনে পড়ল সে ও একবার এই পিপুল গাছে সকলের চোখ এড়িয়ে একটা ছোট ইঁটের টুকরো
রাস্তা থেকে কুড়িয়ে যেমন তেমন একটা সুতো দিয়ে এখানে বেঁধে দিয়ে গিয়েছিল। উপকরণগুলো
যেমন তেমন করে জোগাড় করলেও প্রার্থনায় কোনও ভেজাল ছিলনা ক্লাস সিক্সের নবর। অঙ্ক
পরীক্ষা দিয়ে মনে হয়েছিল পাশ করবে না সে। জন্ম ভীতু সে। সবেতেই তার ভয়। ঢিলের
জোরেই হোক বা অন্য কোনও কারণে সেবছর সে অনেক নম্বর না পেলেও মোটামুটি ভদ্রস্থ
নম্বর নিয়ে অঙ্কে পাশ করে গিয়েছিল নব। মনে পড়তে অজান্তেই একটু হাসি এল নবর। চমক
ভাঙল দাদুর ডাকে।
-লবা......
-বোলো দাদু।
-তুইও আর গেরামে ফিরবি নি বল? শহরে চাকরি
করছিস, শহরেই থেকে যাবি তাই লয় রে বাপ?
- কেন দাদু? এই যে এসেছি?
-এরকম শৌখিন আসার কথা লয় রে, গেরামে থাকার
কথা কইছি। এখান থিকে কাজের জাগা অনেক দূর বল? রোজ রোজ যাওয়া-আসা করা যাবেনি লয়?
- না দাদু সেতো সম্ভব নয়। এখান থেকে তো অনেক
দূর।
-হ্যাঁ, বৌমাও তাই বলতেছিল। সেতো হবেনি।
-কেন দাদু?
-আচ্ছা লবু, আমি তকে কাঁধে করে মাঠে আনতুম।
এই পিপুলতলায় বসিয়ে রেখে মজুরদের সঙ্গে মাঠে নামতুম। তর মনে আছে?
- তখন পিপুলতলার এই সামনের জমিটা আমাদের ছিল
তাই না দাদু? এখানেই তো হাল দিতে, না?
-তর মনে আছে লবা! মনে আছে তর? এই চারবিঘা
জমিটা রতনগভভা ছিল রে, রতনগভভা। তর মেজদার চাকরির জন্যে ঘুষ দিতে তর বাপ এটা জোর
করে বেচে দিল নগেন পাত্তরের কাছে। কি লাভ হল? সে ছেলে তো ভুলেই গেছে বাপকে।
পরাশুনা শিখলে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেতে হবে কেন বাপ। পেটে বিদ্যে থাকলে সৎপথে পেটের
ভাত জোটানো কি যায়নি? তুইও তো নেখাপড়া শিখছু, বলনা।
এই প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা নবর নেই। সে
নতমুখে দাদুর ধুতি থেকে একটা একটা করে শেয়ালকাঁটা বেছে তুলতে থাকে।
-‘জমি হল মা রে বাপ। জমি হল গে মা। মাকে
বেচে ঘুষ!’ রোদে ভেসে যাচ্ছে সামনের জমিটা। গরমের ধান উঠে ফের হাল পড়েছে তাতে।
সেইদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল পূর্ণদাস সামন্ত, তারপর মাথাটা ধীরে ধীরে
দুদিকে নাড়তে নাড়তে নামিয়ে দুই হাঁটুর উপর রাখল। দাদুর দিকে তাকিয়ে ভাবল নব, এই
তার দাদু পূর্ণদাস সামন্ত, সম্পন্ন কৃষক। এককালে তাদের চারটে তাগড়াই হেলে গরু ছিল।
আর দুটো হাল। তার ছোটবেলায় মনে আছে দাদু তাকে এককাঁধে বসিয়ে অন্যকাঁধে হাল নিয়ে
মাঠে যেতো। সেখানে তাকে জমির আলের উপর বসিয়ে রেখে মাঠে নামত দাদু। সঙ্গে রাজিবুল
চাচার বাবা রফিকুল আলি। এখন সেই হেলে গোরুগুলো আর নেই। দাদুও বোধহয় জমি, গরু এসবের
সাথে সাথে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অসুরের শক্তি ছিল যে হাতে, শিরা ওঠা দুবলা
সেই হাতে এখনও নখের ভেতরে মাটি জমে আছে। তখনও যেমন থাকত। দুই হাঁটুতে মুখ নামিয়ে
কেমন যেন কুঁকড়ে আছে মানুষটা। দুমড়ে যাওয়া বৃদ্ধের পিঠে হাত রাখে নব। মুখ তোলে
বৃদ্ধ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
-চ ঘর চ, তর নাওয়া খাওয়ার দেরি হয়ে গেল লয়
রে বাপ?
- না দাদু কোন দেরি হয়নি। তুমি বাবাকে এই
জমিটা বেচতে দিলে কেন দাদু? বারণ করলে না?
- আমার কথা কে শোনে ক? বুড়ো হয়েছি। আমার কি
জোর? বাপ-পিতেমোর এত সব জমি আমি মলেই শেষ রে, কেউ চোখ দিয়ে দেখলনি একবার। সবাই
বাবু হতে চায়। মাঠে নেমে চাষ করলে নাকি বাবু হওয়া যায়নি। সব চলে যাবে রে, সব চলে যাবে। তর
বাপ বলে- ‘মলে কি জমি শুদ্ধু চিতেয় যাবে নাকি?’ আরে আমি কি নিজের জন্যে এসব বুক
দিয়ে আগলাচ্ছি? বলে, ‘সব বেচে দাও। এতসব হ্যাপা কে দেখবে?’ সক্কলেই যদি হ্যাপাটাই
দেখে রে বাপ ফসলটা ফলাবে কে? খাবি কি?
- আচ্ছা দাদু, রাজিবুল চাচা তো আছে। সে
দরকার মত মজুর লাগিয়ে কাজ করিয়ে নিলেও কি অনেক হ্যাপা?
-রাজিবুলই তো আমার ভরসা রে। সবই সে করে,
কাউকে তো আর মাঠে নেমে আমি লাঙ্গল দিতে বলছিনিরে বাপ। শুধু একটু নজর রাখা সবদিকে।
নিজের ছেলেপুলেকে কি আর পরের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায় রে? তার সাথে
সুখ-দুখের কথা কইতে হয়, তাকে আদর করতে হয়। তা নইলে সে কখন পরের হাতে থাকতে থাকতে
পরই হয়ে যায় টেরও পাওয়া যায়নি। সেটুকুনইও করার মতন কেউ নেই রে লবা আমার ঘরে।
যাক, যা হবার হবে, আমি আর কদ্দিন। তারপর
তো......। চ তকে আর আটকাবনি রে বাপ, চ ঘরকে যাই। চাট্টি মুখে দিয়ে ফের একবার যেতে
হবে।
-আবার কোথায় যাবে?
-কাজ কি আর একটা রে বাপ? মনসাতলার পুখুরের পাশে
যে জমিটা তাতে তলা ফেলতে হবে, এখনও যদি মাটি তৈরি না করা যায় কবে তলা বোনা হবে,
কবে ফের রুইতে পারব ক? তো সে জমি তো তুই জানিস চোঁ চোঁ করে জল টানে। এখন পুখুর
থেকে এই হপ্তায় জল ছেঁচতে না পারলে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে। তাই যাব। দেখি যদি পরাণ
মোড়লের বড় পাইপটা ভাড়ায় পাওয়া যায় তাইলে পুখুর থেকে জলটা কাল পরশু করে ছেঁচে দিতে
বলব রাজিবুলকে। তা এই ভরা মরশুমে সে পাইপ কি আর ফাঁকা বসে আছে? দেখব হয়ত আগেই কেউ
ভাড়ায় লিয়ে লিছে। দেখি গিয়ে।
-পাইপ তো হল, তা মেসিন? জলসেচের মেসিন?
- সে তো ঘরেই আছে। তর বড়দা সে ম্যাসিন ভাড়া
দিচ্ছে যে। তাও জানিস, হারামজাদা বলে, ‘সে তো ভাড়া হয়ে গেছে তুমি আর কারো থেকে
লিয়ে লাও।’ ঘরে ম্যাসিন থাকতে আমি ভাড়া লুবো? একটা দিন সে ম্যাসিন ফাঁকা রাখতে
পারেনি? সব বজ্জাতি, অখে চিনিনি আমি? ঘরের জমির কাজে লাগালে ভাড়ার ট্যাকাটা পাবেনি
যে। শেষে তর মা বলতে বলে, ‘ঠিক আছে একদিন লাও তবে। একদিনেই যা করার কর।’
-আচ্ছা দাদু, তোমাকে কতবার পরাণজ্যাঠার কাছ
থেকে পাইপ ভাড়া করতে হয়?
- সে তো ধর না কেন বছরে পাঁচ-সাতবার তো
বটেই। একদিনে দুশ করে। গেলবারেও দেড়শ ছিল। একধাক্কায় দুশ করে দিল। হবেনে কেন? অতবড়
পাইপ, সবাই খোঁজে। আর তো কারো কাছকে নেই লয়।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে নিজের হাতের তালুর
দিকে তাকিয়ে চটপট মনের মধ্যে কতকগুলো অঙ্ক কষে নেয় নব। আর নয়, অনেকদিন ধরে বিষয়টা
তাকে খোঁচাচ্ছে। সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলল। এই দোনোমন, এই নড়বড়ে শিরদাঁড়া, এই
সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক বিষয়ে তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক কিছুকে সে
হারিয়েছে চিরকালের মত। আর না। এবারে সে প্রত্যয়ী। আর ভাববে না। এবার কাজ করার সময়।
সোজা দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল,
- তা অমন একটা পাইপ ঘরে কেনা থাকলে সুবিধা
হয় না?
- তা তো হয়। সে আর আমায় কে ব্যবস্থা করে
দিচ্ছে? অত ট্যাকা একসাথে......।
চট করে উঠে পড়লো নব। কপালের জমে থাকা ঘামটা
জামার হাতায় মুছে নিয়ে সাইকেলের স্ট্যান্ডটা তুলে দিয়ে বলল, চলো দাদু, বসে পড়ো
সাইকেলের পেছনে।
-চ লবা, অনেক বেলা হল, তর মা হানটান করবে।
-না দাদু, বাড়ি একটু বাদে যাব। এখন একবার
চলো তো বিকাশের সাথে একটু কথা বলতে হবে। সে এই বাড়ি গেছে। ফের বেরিয়ে যাবার আগেই
ধরতে হবে। চলো, বসে পড়ো ক্যারিয়ারে।
-কার সঙ্গে কথা কইতে হবে?
-বিকাশ গো, আমার বন্ধু, সেই যে একসাথে
স্কুলে পড়তাম। আমাদের বাড়ি যেত গো, মনে নেই তোমার?
-অ, সাঁতেদের? হরেন সাঁত-এর ছোট লাতিটা লয়?
তার সাথে এখন আবার কি দরকার রে বাপ? বিকেলে যাসক্ষণ। এখন ঘর চ। বেলা হল।
-না গো দশ মিনিট লাগবে, কথাটা বলেই যাই।
-তাইলে তুই যা, আমি বরং ঘরকে যাই এবার।
- না দাদু তুমি ছাড়া হবে না। কত বড় পাইপ, কি
ব্যাপার আমি তো বলতে পারব না। তুমি চলো বিকাশকে বুঝিয়ে বলবে, ওর তো এইসব লোহা-লক্কর,
বালি-সিমেন্ট এর ব্যবসা, ও তোমার পাইপ কিনে এনে দিতে পারবে। আমি টাকা দিয়ে দেব, ও
কাল পরশু এনে দিলে, তুমি এই সপ্তাহেই জমিতে জল দিয়ে দিতে পারবে। আর ও যদি না পারে
তো আমি পরের সপ্তাহে নিয়ে আসব কিনে। তোমায় আর পরাণজ্যাঠার কাছে যেতে হবে না আজ।
দুচার দিন অপেক্ষা করো তোমার নিজের পাইপ এসে যাবে।
কিছুক্ষণ হাঁ করে নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে
থাকে পূর্ণ। বলে, ‘সে যে অনেক ট্যাকা দাম রে লবু...তুই এত টাকা......আমি রাজিবুলকে
দিয়ে খোঁজ লিয়েছিলুম, সে পাইপের তো হাবিবপুরের বাজারে হাজার তিনেক ট্যাকা দাম
রে......তর বাপ জানলে রাগ করবে যে বাপ।’
-তা হোক দাদু, আমি তো এখন কলেজে পড়াচ্ছি
দাদু, আমি এ টাকাটা খরচা করতে পারব। আর বাবা কেন রাগ করবে, আমি তো বাবার থেকে টাকা
চাইছি না। বাজে কাজে টাকা উড়িয়েও দিচ্ছিনা। ঘরের কাজে কাউকে তো খরচা করতেই হবে
বলো? বাবার সাথে আমি কথা বলে নোবো। তুমি ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। কি করতে হবে তুমি
আমাকে সময় সময় শুধু বোলো। এখন চলো দেরি হচ্ছে।
-সত্যি লবু, তুই কিনে দিবি আমায় পাইপটা? তর
অসুবিধে হবেনি? এতগুলা ট্যাকা?
-তোমায় কিনে দিচ্ছি কোথায় দাদু? ও পাইপটা কি
আমার কাজে লাগবে না? তখন তুমি আমায় এই পিপুলতলায় বসিয়ে রেখে মাঠে নামতে, এখন তোমায়
আমি জমির আলে ছাতা মাথায় বসিয়ে রেখে মাঠে নামবো।
-ঠাট্টা করছিস বাপ? এসব কি তদের শহরের
ছাত্তর পড়ানো রে? মাঠের মাটি মাথায় মাখতে পারবি? অনেক পরিশ্রম।
-ঠাট্টা করব কেন দাদু? কলেজে ছাত্রও পড়াবো,
মাঠের মাটিও মাখব। না পারলে তুমি তো আছ, দেখিয়ে দেবে।
কৃশকায় শরীরটাকে টানটান করে নাতির মুখের
দিকে ভাল করে তাকায় পূর্ণচন্দ্র। এতদিনে তবে কি সে হাত রাখার মত একটা কাঁধ পেল?
নেওটা এই ছোট নাতিটাও যখন শহরে পড়তে চলে গেল তখন থেকেই সে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল।
বাকিদের প্রতি তার ভরসা কোনদিনই ছিল না।
-চলো দাদু, বিকাশ আবার কোথাও বেরিয়ে যেতে
পারে। তাড়াতাড়ি ফিরে চান-খাওয়াও তো করতে হবে নাকি?- নব তাড়া দেয় দাদুকে।
-কিন্তু লবা, তুই যে বললি, তুই পরের হপ্তায়
পাইপ এনে দিবি, তুই কি করে পরের হপ্তায় ফের আসবি? অনেকদূর যে তর কাজের জাগা। তবে?
-ভাবছি দাদু কাল-পরশু করে বরং চলেই যাই। ফের
শনিবার আসব। এবার থেকে ভাবছি প্রতি শনিবারেই আসব। আর সোমবারে যাবো। যেমন কলেজে
পড়ার সময় আসতাম গো। এখনও আসব। পাঁচদিন কলেজে পড়াব, শনি-রবিবার বাড়ি এসে তোমার সাথে
থাকব। তুমি আমায় আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দেবে।
রোদ পড়ে চোখের কোণটা চকচক করে ওঠে
পূর্ণচন্দ্রের। শিরাওঠা ডানহাতটা তার আদরের নাতির বুকের ওপর রেখে আস্তে আস্তে
কয়েকবার হাত বোলায় পূর্ণ। নব হাতটা ধরে ফেলে দাদুর।
-ঠিক বলছিস তো রে লবু? তুইও আমায় ঠকাবিনি তো
বাপ?
-দেখ না দাদু, পারি কিনা। চেষ্টাটা তো করি।
দুজনেই কয়েক মুহূর্ত নীরব। সামনের জমি, যেটা
একদিন তাদেরই ছিল সেটার দিকে তাকিয়ে পূর্ণচন্দ্র একসময় বলে ওঠে, ‘চ লবু, তর বন্ধুর
সঙ্গে কথা কইবি যে? চ, সে যদি আবার কোথাও চলে যায়।’
-চলো দাদু, বোসো ক্যারিয়ারে, সাবধানে।
সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিয়ে,
দাদুকে বসিয়ে, সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় নবকুমার। চালাতে চালাতে বুঝতে পারে সে,
দাদু তার জামাটাকে প্রানপণে দুহাতে চেপে ধরে বসে আছে তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে।
সামনের বাঁকটা ছেড়ে মিনিট পাঁচেক গেলেই পৌঁছে যাবে তারা বিকাশদের বাড়ি। তাড়াতাড়ি
পৌঁছতে হবে তাকে, এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছে সে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে গতি বাড়ায়
নব।