পলাশের মতন করে
বসন্তকে বোধহয় আর কেউ সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। শীতের শেষের ন্যাড়া গাছে
কোথা থেকে যে আসে এত
লাল রঙ, সে এক রহস্য। বসন্তের উপস্থিতি যেমন ক্ষণিকের, তার উপস্থিতিকে অবহেলা করলে
সে অনাবধানে বিদায় নেয় আরও এক বছরের জন্য; তেমনিই পলাশের উপস্থিতিও মনে হয় ঠিক ওই
কটি দিনের জন্যেই। সবুজের ফাঁকে ওই আগুনরঙা গর্বিত ভঙ্গিকে উপেক্ষা করার যদিও কোন
উপায় নেই, তাও যদি কোনোভাবে তার উপস্থিতি অবহেলিত হয় তবে কোন ফাঁকে যে সে একরাশ
অভিমান নিয়ে বিদায় নেয়, তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। এমনিতে সারা বছর বড়ই
বৈচিত্র্যহীন চেহারা পলাশগাছগুলির। বছরের মাত্র কটাদিনে তাই যেন সে পরিপূর্ণ
সম্ভার নিয়ে ঘোষণা করে যে, পৃথিবীতে সকলের অগোচরে বসন্ত আসে। এখনও।
পলাশ আমার বড় আদরের। বালিকা বয়সে বাড়ির পিছনের আধাজঙ্গলে
একক অভিযানের সময় আবিষ্কার করেছিলাম একটি পলাশ গাছ। যদিও সেই দর্পিত লাল কলাপ
গুচ্ছের নাম আমার জানা ছিল না তখন, হয়ত জানার প্রয়োজনও অনুভূত হয়নি কখনো। তবু সে
সময়ও ঝরে পড়া সেই লাল পাপড়িগুলি আমি সংগ্রহ করতাম পরম যত্নে। আর পলাশের ক্ষণিকবাদিতার
কথাও আমার সেই নিজস্ব গাছটির সূত্রে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল পলাশের নাম জানার আগেই।
পলাশের উপস্থিতির সময়টুকুতে বাড়িতে কোন অতিথি এলেই আমি টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে
যেতাম আমার সেই ‘লাল ফুলের গাছ’-টিকে দেখাতে। ‘আমার গাছ’ বলছি কারণ এই নয় যে,
গাছটির বা গাছের মাটিটুকুর মালিকানা খাতায় কলমে কোন ভাবে আমাদের বাড়ির কুক্ষিগত ছিল।
বস্তুত সে মালিকানা যে কার, সে আমি আজও জানিনা। কিন্তু কোন এক বসন্ত দুপুরে সেই
আধাজঙ্গলে একক ভ্রমণে পলাশ গাছটির আবিষ্কর্তা আমার কাছে ছিলাম আমিই। সে গাছ বহুদিন
ধরেই সেখানে আছে। হয়ত কেন নিশ্চিতরূপেই বলা যায় যে, সে গাছের অবস্থান কারও কাছে
অবিদিত ছিল না। তাও একা একা সেই আধা জঙ্গলে যাবার অনুমতি পাবার পরে এক আকাশ ভর্তি
সবুজের ফাঁকে লালে লাল গাছটিকে খুঁজে পাবার কৃতিত্ব যে আর কারও সাথে আমায় ভাগ করে
নিতে হয়নি সেজন্যই বোধকরি আস্ত গাছটির মালিকানা সেই ছোট বয়সে কখন যেন একান্তই আমার
নিজের হয়ে গিয়েছিল।
সে বয়সে বাড়ি থেকে বেঁধে দেওয়া আমার একক গতিবিধির সীমারেখার
মধ্যে আর কোন পলাশ গাছ ছিল না। আর আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গের
গ্রামে গ্রামে বসন্ত আসতো বেশ জানান দিয়েই। ফলে বিদায়ী শীত আর আগত গ্রীষ্মের
মধ্যের ওই ‘কেমন যেন একটা’ অবর্ণনীয় হাওয়ার নামই যে বসন্ত, সেটা বুঝতে আমার ওই
নিজস্ব পলাশ গাছটির মতন আর কোন মাপকাঠিই ছিল না আমার কাছে। অর্থাৎ, যেসময় আমার
‘লাল ফুলের গাছে’ ফুল ফোটে সেইটিই হল বসন্ত ঋতু। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ঐতিহাসিক কাহিনীর বসন্তোৎসবে বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবে পলাশের ভূমিকা জানার
বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারার বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকেই তাই আজও পলাশ আর বসন্ত আমার
কাছে সমার্থক। বড় হবার সাথে সাথে নানান অহৈতুকি ব্যস্ততায় স্বভাবতই সেই বসন্ত
দুপুরের নীরব সঙ্গীটির কুশল সংবাদ নেওয়া হয়ে ওঠেনি আর। কিন্তু পরে যেখানে যেমন
ভাবে পলাশ গাছ দেখেছি আমার সেই ছেলেবেলার আগাছার জঙ্গলের একলা পলাশ গাছটির কথা আমার
মনে পড়েছে। মনে আছে হাজারীবাগ অঞ্চলের জঙ্গলে দেখা একজঙ্গল পলাশ সমুদ্রের কথা।
সেটা ছিল শেষ মার্চ বা প্রথম এপ্রিল। জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেসে জম্মুর দিকে যাচ্ছিলাম।
মনে হয়েছিল পলাশ বনে আগুন লাগা বুঝি একেই বলে। আরও কাছ থেকে এই পলাশবন দেখতে মার্চ-এপ্রিল
মাসে নিশ্চয়ই একবার অতিথি হব এই অঞ্চলে, এটি স্থির করতে আমার এক মুহূর্তও লাগেনি
সেদিন। যদিও সে ইচ্ছেপূরণ হয়নি এখনও। তবে এখনও ওই সময় ওই ট্রেনলাইনের
যাত্রীরা ডাইনে-বামে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের লাল মাটির সাথে রঙ মিলিয়ে দেখতে
পাবেন কেমন করে নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগে। সমতলের চেয়ে ওই রুক্ষ লাল মাটির
অঞ্চলে সত্যিই ওদের মানায় ভাল।
দুদিন আগে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে চোখে পড়লো রাস্তার
ডাইনে ঝাঁকড়া চুলো সবুজ ধুলো পড়া বড় বড় সব গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো নিতে কোনমতে
মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সরু লিকলিকে একটি কিশোর পলাশ। আশেপাশের সমস্ত গাছে এসে পড়া
ধূসর মালিন্যকে বিদ্রুপ করে প্রতিটি প্রশাখায় আগুন জ্বালিয়ে ঘোষণা করছে নিজের
উপস্থিতি। হয়ত তা মাত্র কয়েকদিনের জন্যই। মনে হয়েছিল এ অর্থলিপ্সু ব্যস্ততার শহরেও
বসন্ত আসে। এখনও। নীরবে। অগোচরে। কারও আবাহনের তোয়াক্কা না করেই।
আজ শান্তিনিকেতন নেই,পলাশ ও নেই,বসন্ত ও আসে না...সব যেন ধূসর ,তবে তোর লেখা কোথাও যেন একটু হলেও বসন্তের ছোঁয়া দিয়ে গেলো
ReplyDeleteকিছুটা হলেও যে কলমে না থুড়ি কিবোর্ডে বসন্ত আনতে পেরেছি তাতেই ভাল লাগছে। আর তোমার ভাল লেগেছে বলে আরও ভাল লাগছে।
Delete