একটি বিষন্ন সন্ধ্যা কেমন করে তার একটি একটি মোড়ক খুলে হয়ে উঠতে পারে নতুনের প্রেরণা তার সাক্ষী রইলো আজকের শেষ শীতের শিরশিরে বাতাস, তন্বী বাবলা গাছের ঘন সবুজ জঙ্গলের পেছনে ডুবতে থাকা অনেকদূরের কিন্তু বড় আপনার আগুনরঙা একটি অগ্নিগোলক, আর মন শান্ত করা কিছু সুর।
শীতের হিমেল হওয়ার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সমস্ত সবুজেরা। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি শুয়েছিল মৃত সবুজের দল। এখন অবশ্য তাদের আর সবুজ বলে চেনার উপায় নেই। সবাই ধূসরের এক একটি রকমফের। কম ধূসর-বেশি ধূসর, কম শুকনো-বেশি শুকনো, কম মৃত-বেশি মৃত। মৃতের কি কম-বেশি হয়? জানিনা। মৃত শরীর আর মৃত চেতনা দুটির মধ্যে পার্থক্য কি? দুটি তো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল নয়? শারীরিক মৃত্যু আর চেতনার মৃত্যু দুটি আলাদা-আলাদা ভাবে ঘটা সম্ভব? নাকি চেতনা বা বোধ বা অন্তরাত্মার মৃত্যু অসম্ভব একটি ঘটনা? আজন্মের প্রাচ্য দার্শনিকতার সঙ্গে সঙ্গে নবতম বিজ্ঞানও কি সেকথাই বলবার দিকে এগোচ্ছে না? কেজানে?
শুকনো ঝরে পড়া মৃত পাতাগুলি রাস্তার ওপর রচনা করেছিল একটি আস্তরণ। দুই জোড়া শ্রান্ত-বিধ্বস্ত পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল তাদের অতীত অস্তিত্ব। শীতল দমকা হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে তাদের জড়ো করছিল রাস্তার দুইপাশে। জীবনকে চলার পথ করে দিতে মৃত্যুকে তো ধীরে ধীরে সরে যেতেই হয় মাঝরাস্তা থেকে। ক্রমশঃ কমতে থাকা আলোয় সভ্যতার পরিধির ঠিক বাইরে সভ্যতার দিক থেকে ক্ষনিকের জন্য মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বেঁচে উঠতে চাইছিলাম আদিমতার দিকে তাকিয়ে। মোবাইল ফোনে বাজছিল বেঁচে ওঠার সুর। সে সুর শুনতে শুনতে দেখতে পাচ্ছিলাম কেমন করে ঝরে পড়ে একটি একটি মৃত পাতা। কেমন যেন স্প্রিং এর মতন পাক খেতে খেতে অদ্ভূত সুন্দর গতিতে নেমে আসছিল নিচের দিকে। সুরের সাথে তাল মিলিয়ে। মিশে যাচ্ছিল নিচে জমে থাকা অগুন্তি মৃত পাতার ভীড়ে। জীবনের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে ঘটতে থাকা এক একটি মৃত্যুর মত।
জীবনের সাথে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা, একটি মৃত্যু। অথচ কি অদ্ভূতভাবে হয়ে ওঠে সবচেয়ে অনভিপ্রেত, সবচেয়ে দুর্দমনীয় ঘটনা, কেমন করেই বা সেই দুর্দমনীয় সুনামির ঢেউ-এর তোড়ে নাড়িয়ে দিয়ে যায় জীবনের গভীরতম মূলকেও সেটিই বুঝি সবচেয়ে আশ্চর্যের। বকরূপী ধর্ম আর যুধিষ্ঠিরের গল্প দিয়ে সেই মহাভারতের সময় থেকেই এই আশ্চর্যের সাথে শুধুমাত্র আহার-নিদ্রা-মৈথুন বৃত্তে আজন্ম আবর্তিত অচেতন মনুষ্যকুলকে চৈতন্য প্রদানের চেষ্টা করে চলেছেন মহাভারতের আখ্যানকার। অথচ আমরা সেই বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে কলুর বলদের মতন ভাবছি বুঝি এইতো এগোলাম। আসলে কলু নামক সময়ের বেঁধে দেওয়া দড়ি গলায় পরে মহানন্দে জীবন বৃত্তে ঘুরেই চলেছি, ঘুরেই চলেছি-আজন্ম-আমৃত্যু। সবাই জানি। কিন্তু মানি না। তাই হয়ত মৃত্যু এত আকস্মিক, এত অনভিপ্রেত, এত বেদনার।
চারপাশের শুকনো পাতাওয়ালা গাছগুলো দেখে মনে হলো পুরনো পাতা খসিয়ে সময় হয়েছে এদের নতুন পাতায় সেজে নেবার। আর কয়েকদিন পরেই কচি সবুজ পাতায় ঝলমলিয়ে উঠবে এরা। পুরনো শরীর ত্যাগ করে নতুন ভাবে জন্ম নেওয়া চিরন্তন আত্মার মতন। ভাবলাম এখনই কেন নয়? দেই ঝরিয়ে সব মরে যাওয়া পাতা। বেঁচে উঠুক নতুন করে। সবুজ হয়ে উঠুক চারপাশটা এখনি। ছোটোমত একটা গাছের ডাল ধরে ঝাঁকালাম খুব। দুচারটে পাতা ঝরলেও বেশিরভাগই রয়ে গেল নিজের নিজের জায়গায়। ঠিকই তো, আমার ক্ষমতা কোথায় প্রকৃতির নিয়মকে একচুল নাড়াবার। মহাকালের ইচ্ছাই তো প্রকৃতির নিয়ম। আমার এই হাতে অত জোর নেই ধূসর হয়ে যাওয়া, নব্বই ভাগ মৃত একটি পাতাকেও খসিয়ে দেবার। হাসি পেল নিজের কাজে। আর তারপরেই আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আস্তে থাকলো চরাচর।
পাশে বাজতে থাকা বেঁচে থাকার সুর থেকে প্রাণরস শুষে নিতে নিতে আস্তে আস্তে বেঁচে উঠছিলাম যখন, অবিশ্বাস্য ভাবে তখনই আমার থেকে মস্তিস্কের বিবর্তনের প্রশ্নে লক্ষগুণ পেছনে পড়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট কালো-হলদে পাখিগুলো একসাথে গেয়ে উঠলো জীবনের সুর। আর ঠিক তখনই হলদে আলো ছড়াতে ছড়াতে শেষে আজকের মতন ছুটি নিলেন সূর্য্যদেব। কাল আবার নতুন করে আসবেন বলে। জঙ্গলের অজস্র ছোট্ট ছোট্ট পাখি, এমনকি মৃত পাতাগুলি পর্যন্ত হাসতে হাসতে বিদায় দিল তাঁকে। অবাক হয়ে দেখলাম কখন যেন সোজা হয়ে গেছে কপালের মৃদু ভাঁজ। সুস্থ হয়েছে শ্বাস, শান্ত হয়েছে মন। কালকের জীবনের জন্য আজকে বুকের কোণে এসেছে সম্পৃক্ততা। মনজুড়ে তখন কেবল কৃতজ্ঞতা আর প্রণতি এই অপার্থিব সন্ধ্যার কাছে।
0 comments:
Post a Comment