Friday, 27 February 2015

পলাশ


পলাশের মতন করে বসন্তকে বোধহয় আর কেউ সংজ্ঞায়িত করতে পারে না শীতের শেষের ন্যাড়া গাছে কোথা থেকে যে আসে এত লাল রঙ, সে এক রহস্য। বসন্তের উপস্থিতি যেমন ক্ষণিকের, তার উপস্থিতিকে অবহেলা করলে সে অনাবধানে বিদায় নেয় আরও এক বছরের জন্য; তেমনিই পলাশের উপস্থিতিও মনে হয় ঠিক ওই কটি দিনের জন্যেই। সবুজের ফাঁকে ওই আগুনরঙা গর্বিত ভঙ্গিকে উপেক্ষা করার যদিও কোন উপায় নেই, তাও যদি কোনোভাবে তার উপস্থিতি অবহেলিত হয় তবে কোন ফাঁকে যে সে একরাশ অভিমান নিয়ে বিদায় নেয়, তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। এমনিতে সারা বছর বড়ই বৈচিত্র্যহীন চেহারা পলাশগাছগুলির। বছরের মাত্র কটাদিনে তাই যেন সে পরিপূর্ণ সম্ভার নিয়ে ঘোষণা করে যে, পৃথিবীতে সকলের অগোচরে বসন্ত আসে। এখনও। 

পলাশ আমার বড় আদরের। বালিকা বয়সে বাড়ির পিছনের আধাজঙ্গলে একক অভিযানের সময় আবিষ্কার করেছিলাম একটি পলাশ গাছ। যদিও সেই দর্পিত লাল কলাপ গুচ্ছের নাম আমার জানা ছিল না তখন, হয়ত জানার প্রয়োজনও অনুভূত হয়নি কখনো। তবু সে সময়ও ঝরে পড়া সেই লাল পাপড়িগুলি আমি সংগ্রহ করতাম পরম যত্নে। আর পলাশের ক্ষণিকবাদিতার কথাও আমার সেই নিজস্ব গাছটির সূত্রে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল পলাশের নাম জানার আগেই। পলাশের উপস্থিতির সময়টুকুতে বাড়িতে কোন অতিথি এলেই আমি টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে যেতাম আমার সেই ‘লাল ফুলের গাছ’-টিকে দেখাতে। ‘আমার গাছ’ বলছি কারণ এই নয় যে, গাছটির বা গাছের মাটিটুকুর মালিকানা খাতায় কলমে কোন ভাবে আমাদের বাড়ির কুক্ষিগত ছিল। বস্তুত সে মালিকানা যে কার, সে আমি আজও জানিনা। কিন্তু কোন এক বসন্ত দুপুরে সেই আধাজঙ্গলে একক ভ্রমণে পলাশ গাছটির আবিষ্কর্তা আমার কাছে ছিলাম আমিই। সে গাছ বহুদিন ধরেই সেখানে আছে। হয়ত কেন নিশ্চিতরূপেই বলা যায় যে, সে গাছের অবস্থান কারও কাছে অবিদিত ছিল না। তাও একা একা সেই আধা জঙ্গলে যাবার অনুমতি পাবার পরে এক আকাশ ভর্তি সবুজের ফাঁকে লালে লাল গাছটিকে খুঁজে পাবার কৃতিত্ব যে আর কারও সাথে আমায় ভাগ করে নিতে হয়নি সেজন্যই বোধকরি আস্ত গাছটির মালিকানা সেই ছোট বয়সে কখন যেন একান্তই আমার নিজের হয়ে গিয়েছিল।

সে বয়সে বাড়ি থেকে বেঁধে দেওয়া আমার একক গতিবিধির সীমারেখার মধ্যে আর কোন পলাশ গাছ ছিল না। আর আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে বসন্ত আসতো বেশ জানান দিয়েই। ফলে বিদায়ী শীত আর আগত গ্রীষ্মের মধ্যের ওই ‘কেমন যেন একটা’ অবর্ণনীয় হাওয়ার নামই যে বসন্ত, সেটা বুঝতে আমার ওই নিজস্ব পলাশ গাছটির মতন আর কোন মাপকাঠিই ছিল না আমার কাছে। অর্থাৎ, যেসময় আমার ‘লাল ফুলের গাছে’ ফুল ফোটে সেইটিই হল বসন্ত ঋতু। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক কাহিনীর বসন্তোৎসবে বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবে পলাশের ভূমিকা জানার বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারার বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকেই তাই আজও পলাশ আর বসন্ত আমার কাছে সমার্থক। বড় হবার সাথে সাথে নানান অহৈতুকি ব্যস্ততায় স্বভাবতই সেই বসন্ত দুপুরের নীরব সঙ্গীটির কুশল সংবাদ নেওয়া হয়ে ওঠেনি আর। কিন্তু পরে যেখানে যেমন ভাবে পলাশ গাছ দেখেছি আমার সেই ছেলেবেলার আগাছার জঙ্গলের একলা পলাশ গাছটির কথা আমার মনে পড়েছে। মনে আছে হাজারীবাগ অঞ্চলের জঙ্গলে দেখা একজঙ্গল পলাশ সমুদ্রের কথা। সেটা ছিল শেষ মার্চ বা প্রথম এপ্রিল। জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেসে জম্মুর দিকে যাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল পলাশ বনে আগুন লাগা বুঝি একেই বলে। আরও কাছ থেকে এই পলাশবন দেখতে মার্চ-এপ্রিল মাসে নিশ্চয়ই একবার অতিথি হব এই অঞ্চলে, এটি স্থির করতে আমার এক মুহূর্তও লাগেনি সেদিন। যদিও সে ইচ্ছেপূরণ হয়নি এখনও। তবে এখনও ওই সময় ওই ট্রেনলাইনের যাত্রীরা ডাইনে-বামে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের লাল মাটির সাথে রঙ মিলিয়ে দেখতে পাবেন কেমন করে নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগে। সমতলের চেয়ে ওই রুক্ষ লাল মাটির অঞ্চলে সত্যিই ওদের মানায় ভাল।

দুদিন আগে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে চোখে পড়লো রাস্তার ডাইনে ঝাঁকড়া চুলো সবুজ ধুলো পড়া বড় বড় সব গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো নিতে কোনমতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সরু লিকলিকে একটি কিশোর পলাশ। আশেপাশের সমস্ত গাছে এসে পড়া ধূসর মালিন্যকে বিদ্রুপ করে প্রতিটি প্রশাখায় আগুন জ্বালিয়ে ঘোষণা করছে নিজের উপস্থিতি। হয়ত তা মাত্র কয়েকদিনের জন্যই। মনে হয়েছিল এ অর্থলিপ্সু ব্যস্ততার শহরেও বসন্ত আসে। এখনও। নীরবে। অগোচরে। কারও আবাহনের তোয়াক্কা না করেই।


Monday, 23 February 2015

সার্কাস-৪....শেষ পর্ব

সার্কাস-১, সার্কাস-২ এবং সার্কাস-৩ এরপর........




চারপাশে বরফ, দূরে পরিস্কার কিন্নর কৈলাস পর্বতমালা, আর শান্ত নীল আকাশ। এই হলো ফাগু। আমরা কুফরী থেকে মিনিট দশেকের মধ্যেই ফাগু এসে যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা নামছে। আর বরফে মোড়া হিমাচলপ্রদেশের সরকারী পর্যটকনিবাসের যেরকম অবস্থান ও সৌন্দর্য, শুধুমাত্র এই পর্যটকাবাসে দুটো দিন শান্তিতে কাটাবো বলেই ফাগুতে আসা যায়। আমাদেরও প্রাথমিক মনোভাব ছিল এটাই। ভেবেছিলাম মাঝের দিনটায় একটু শিমলাতে ঘোরাঘুরি করা যাবে। মাঝে কুফরীটা অতিরিক্ত পাওনা। ফাগুর অবস্থানটা এরকম যে শিমলা থেকে নারকান্ডার রাস্তায় এই ফাগুর পর থেকেই রাস্তাটি নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। ফলে ফাগুর পরে আর বরফ নেই। আমরা ওই সন্ধ্যায় আমাদের সামনের দুই দিনের অস্থায়ী অবস্থান দেখে আগের দিনের ক্লান্তি, সদ্য ক্যামেরার ব্যাটারি হারানোর দুঃখ সব ভুলে গেলাম। হোটেলে ঢোকার রাস্তা-হোটেলের ঢালু ছাদ, সামনে-পিছনের চত্বর পুরু বরফে ঢাকা। আর ভেতরে হিমাচল পর্যটন এর উষ্ণ অভর্থনা। হোটেলের রিসেপশনে বড় করে লেখা আছে "No one can serves you Himachal better than us" কথাটি যে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনী দেখনদারি নয় সেটা হোটেলে ঢোকার সাথে সাথেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম। বড় বড় কার্পেট মোড়া ঘর, যেমন সরকারী গেস্টহাউসে হয়। কিন্তু এখানকার সবচেয়ে বড় পাওনা হলো ঘরের একদিকের দেয়াল জোড়া মস্ত কাঁচের জানলাটা। সেখান দিয়ে নিচে তাকালে পুরু বরফে মোড়া উঠোন। সেখানে সুন্দর চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা। চাইলে রোদে পিঠ দিয়ে, মোটা বরফের ওপর পা দিয়ে বসে প্রাতরাশ সেরে নেওয়া যায়।সোজা তাকালে ঝকঝকে কিন্নর-কৈলাস। আর ওপরে তাকালে মন ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া চকচকে নীল আকাশ। শুধু এককাপ কফি হাতে এই জানালাটির সামনে বসে থাকাটাই আমার কাছে যথেষ্ট কারণ আবার শীতকালে ফাগু আসার জন্য।



পরদিন সকালে চকচকে রোদে আমরা বেরোলাম চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। তুষারশুভ্র কথাটার আক্ষরিক অর্থ বোধকরি হিমালয়ের এরকম ছোটখাটো গ্রামে আসলেই একমাত্র বোঝা যায়। চোখ ঝলসানো শুভ্রতা। আমাদের কোনো আইস বুট ছিল না। নিজেদের জুতোর মায়া ছেড়ে ঝুরো বরফে পা ডুবিয়ে হোটেলের পাশের রাস্তা দিয়ে উঠলাম অনেকটা। চারিদিক সাদা। আর ফাগু বাসস্ট্যান্ডের পর থেকেই দূরে যে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে সেখানে গিয়েই বরফ শেষ। ওপরে উঠে চারিদিকটা দেখে আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম দূরের শুভ্রবসন হিমালয়ের দিকে চেয়ে। সিমলার পরে যে দেওদারের জঙ্গল শুরু হয়েছিল, ফাগুতেই তার শেষ। আমাদের বামদিকে ঘন জঙ্গল আর ডাইনে পরিষ্কার আকাশে হিমালয়। মাঝে সাদা মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের জঙ্গমতা ঘোষণা করছে একলা একটি দেওদারের চূড়া। অদ্ভূত এক শিথিলতা আর শান্তি চারি দিকে। জানিনা সঠিক ভাবে ধ্যানমগ্নতা কাকে বলে। কিন্তু সেদিন সেই চকচকে রোদে সব মলিনতা গেছিল কেটে। চারিদিকের শুভ্রতার ছোঁয়া লেগেছিল মনে। আর উতল হাওয়ায় আকাশী রঙের আকাশে ঘন সবুজের সেই একলা দেওদারটি আমার মনে রেখে গিয়েছে চিরকালীন এক মুক্তির সাক্ষর। সবটুকু পরিপূর্ণতা পেল যখন সেই আকাশে উড়তে শুরু করলো একটি পাখি। হতে পারে পাহাড়ি চিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, সেদিনের সেই দেওদার আর দূরের হিমালয় এর দৃশ্যটি আমার কাছে অমলিন রয়ে যাবে আমার জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত।








 আমাদের সেদিন শিমলা যাবার কথা। অনিচ্ছা সত্বেও নেমে এলাম নিচে। আলগা বরফে গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে ওঠানামা করেছি। অবিলম্বে বরফ না ঝেড়ে ফেললে এ যাত্রায় নিয়ে আসা একমাত্র জুতোটি যাবে ভিজে। দুজনে নিঃশব্দে জুতোর বরফ ঝাড়তে থাকি। ঘোর লেগেছিল মনের মধ্যে দুজনেরই। 

বারোটায় আমরা বেরোলাম সিমলার উদেশ্যে। ফাগু যেহেতু শিমলা-নারকান্ডা জাতীয় সড়কের ওপরেই অবস্থিত সুতরাং নারকান্ডা, রামপুর, সাহারান থেকে আসা সমস্ত বাসই ফাগুর ওপর দিয়ে শিমলা যায়। তাই আমাদের হোটেলের বয়স্ক রিসেপশনিস্ট আমাদের গাড়ি না নিয়ে বাসে যেতেই পরামর্শ দিলেন। গাড়িতে এখান থেকে শিমলা যেতে অন্তত বারোশ টাকা নেবে। আমরা দাঁড়ালাম বাসের জন্য, পেয়েও গেলাম তাড়াতাড়ি। সিটে গুছিয়ে বসে একটু এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই কুফরী এসে গেল। দেখলাম সামনে একটু একটু করে গাড়ির ভিড় বাড়ছে। তখনও কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এটিই ছিল আমাদের এবারের শিমলা ফাগু ভ্রমনের শেষ দুর্ভোগ। আধঘন্টা ধরে বোধহয় দশ-কুড়ি মিটার এগিয়েছি কি না কে জানে? আমরা দুই পর্যটক একবাস ভর্তি স্থানীয় লোকের মধ্যে হংস মধ্যে বক যথা হয়ে উশখুশ করতে লাগলাম। এখানকার স্থানীয় লোকজন যাঁরা বাসে ছিলেন তাঁরা দেখলাম সবাই খুবই ধৈর্যশীল। হয়তো পাহাড়ে থাকতে থাকতে ধ্বস ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করার অভ্যাস তৈরী হয়ে যায় প্রথম থেকেই। মনে মনে অধৈর্য হলেও বাইরে তার বিশেষ প্রকাশ দেখলাম না। ক্রমশঃ সেই আধঘন্টাটা একঘন্টা-দেড়ঘন্টা ছাপালো। আমাদের বাস অগুন্তি ছোটো গাড়ির সমুদ্রে সাঁতরে সাঁতরে কোনো মতে একচুল একচুল করে এগোতে লাগলো। আমি অধৈর্য্য হতে হতে শেষে হল ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোলাম, উঠে আবার ঘুমোলাম। আমাদের গাড়ি পাঁচ কিলোমিটারও এগোয়নি। ফাগু থেকে শিমলা মাত্র বাইশ-তেইশ কিলোমিটার রাস্তা। পরদিন ছাব্বিশে জানুয়ারির ছুটির জন্য দিল্লি-পাঞ্জাবের বিভিন্ন শহর-চন্ডিগড় (সঙ্গে বাঙালি তো আছেই) সমস্ত জায়গা থেকে সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে নিজেদের গাড়ি নিয়ে বা গাড়ি ভাড়া করে জনগণ কুফরীতে বরফ দেখতে, মজা করতে গেছে। এই পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তারা শিমলা থেকে কুফরী ঢোকার মুখেই রাস্তার পাশে এত বরফ দেখে উল্লসিত হয়ে রাস্তার দুপাশে যেমন তেমন ভাবে গাড়ি থামিয়ে বরফে হুরোহুড়ি করতে লেগেছে। তাতে করে মাঝে রাস্তার যেটুকু অংশ বাকি আছে তাতে একটি গাড়ি কোনোমতে যেতে পারে কি না পারে। মাঝে মাঝেই সেই ফাঁকটুকুর মধ্যে "বাবান এদিকে আয়, এখানে দাঁড়া সোজা হয়ে" (ছবি তোলা হবে), "গৌতমদা টুপিটা খোল না বস", "রবীন্দর আরতি কে পাস ঠ্যাহারো না", "আরে ভাই সানগ্লাস তো প্যাহান কে পিকচার লো"........ইত্যাদি ইত্যাদিতে ভরে যাচ্ছে। গাড়ির স্রোত আর শেষ হয়না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল বারোটায় ফাগু থেকে বেরোলে একটা নাগাদ সিমলার আপার ম্যালে পৌঁছে যাব। সেখানে কিছু খেয়ে দেয়ে নিয়ে পায়ে হেঁটেই ম্যাল রোড, কালিবাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় দ্রষ্টব্য দেখে আবার পাঁচটা নাগাদ একটা গাড়ি নিয়ে ফাগু ফিরে যাব। কিন্তু আমাদের বাস কুড়ি মিনিটের রাস্তা আসতে সময় নিল সাড়ে তিন ঘন্টা। পৃথিবীর সমস্ত গাড়ি বোধহয় কুফরীতে আজ। পরে শুনেছিলাম কুফরীতে সেদিন পুরো পঁয়ত্রিশ হাজার গাড়ি ঢুকেছিল। এটি একটি রেকর্ড। বর্ষশেষের ছুটিতেও এত ভিড় হয়নি কুফরীতে।আমরা সাড়ে তিনটে নাগাদ শিমলা শহরে ঢুকতে পারলাম। আমার এক দিদি গল্প করেছিল, তার বিয়ের পরের দিন সন্ধ্যেবেলা নতুন শ্বশুরবাড়িতে তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু মাত্র একদিনের বউ, বেচারা কথাটা কাউকে বলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ব্যাপারটা বর্ণনা করেছিল এরকম ভাবে, "খিদে পেয়ে পেয়ে, খিদে পেয়ে পেয়ে শেষে ঘুমিয়েই পড়লাম।" আমারও সেই অবস্থা। সকাল আটটায় খেয়ে এই বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত আমার মস্তিস্ক আর কাজ না করতে পেরে শেষে ঘুমিয়েই পড়ল। শেষে সেই গাড়ির জঙ্গল আর রাস্তা জুড়ে ছবি তোলার আদেখলামির মিছিল শেষ করে আমাদের বাস শিমলা শহরে তো ঢুকলো। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল সিমলার আপার আর লোয়ার ম্যাল সংযোগকারী লিফ্টের কাছে নামতে। কিন্তু এই বাস তো সেদিকে যাবে না। কোথায় নামব তবে? কথাটা বাসে পাড়তে না পাড়তেই বাস সুদ্ধু লোক হই হই করে মতামত দিতে থাকলো। সকলেই তাদের রাজ্যে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সাহায্য করতে চায়। সে এক বিশ্রী কান্ড। আমরা একবার করে কারো কথা শুনে নামব বলে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। আবার পরক্ষণে অন্য কারো কথা শুনে ফিরে এসে সিটে বসে পড়ি। বাস শুদ্ধু লোক নিজেদের মধ্যে বাকবিতন্ডা করতে থাকে আমাদের কোথায় নামা উচিত সেই নিয়ে। আর আমরা কোলে হাতের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে একবার এর মুখের দিকে আর একবার ওর মুখের দিকে তাকাতে থাকি। তাঁরা সকলে মিলে যেকোনো একটা জায়গায় সহমত হলেই আমরা সেখানে নেমে যাই। শেষে আমারই পার্শ্ববর্তিনী হিমাচলী যুবতীটি আমায় আশ্বাস দেয় যে আমি যেন তাকে অনুসরণ করি, কারণ সে এমন একটি জায়গায় নামবে যেখান থেকে লিফট পর্যন্ত  বাস পাওয়া যায়। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ওমা দেখি শিমলা শহরের ঘর বাড়ি সব ছাড়িয়ে বাস চলেছে তো চলেছে। আরে কোথায় নামব? পুরো শিমলাই তো শেষ হয়ে গেল? লিফট কি শহরের বাইরে নাকি? সে আশ্বস্ত করলো আমাদের নামতে হবে 'ছোটো শিমলা' বলে একটি জায়গায়। আসলে আমরা একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁক নিয়ে শিমলা শহরের ঠিক পেছনে পৌঁছিয়ে গেছিলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় তার পিছু পিছু নামলাম। সে আমাদের নতুন একটি বাস স্ট্যান্ড দেখিয়ে বলে গেল এখানেই বাস আসবে লিফটের জন্য। বাস প্রায় সাথে সাথেই এলো আর আমরাও দৌড়লাম। পিনাকী সামনের দরজায় উঠেছে। আমিও হাঁকুপাঁকু করে ওর পেছনে ছুটতে গিয়ে দেখি আমি আটকে গেছি। মানে আমার হ্যান্ডব্যাগের চেনের রানারের সাথে আমাদের পূর্ববর্তী বাস থেকে নামা বয়স্ক মানুষটির হাতের একপেটি হিমাচলী আপেলের বাক্সের দড়ি বিশ্রী বেকায়দায় জড়িয়ে গেছে। আপেলওয়ালা উঠতে চান এই বাসের পেছনের দরজায়, আমি উঠতে চাই সামনে। আপেলওয়ালাই শেষে হার স্বীকার করে আমার সাথে সাথে সামনের দরজায় উঠলেন। এদিকে পিনাকীর কাছে বাসের কন্ডাকটর পাঁচ টাকা খুচরো চেয়েছে বাসের ভাড়া বাবদ। তার কাছে না থাকায় পিনাকী আমায় বলছে দিতে। এদিকে আমি তো বাসে ওঠা ইস্তক নিজের ব্যাগকে আপেলের বাক্স থেকে আলাদা করতে পারছিনা। আমি আর আপেলওয়ালা দুজনেই টানাটানি চালিয়ে যাচ্ছি। পিনাকী এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। সে বারবার বলছে টাকাটা দিতে। অগত্যা আমি শ্যাম ছেড়ে কুল সামলাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে সিধা আপেলওয়ালার ঘাড়ে। বাসটা মোক্ষম সময় ব্রেক কষেছে। অনেক দুঃখিত টুঃখিত বলে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ব্যাগ আর আপেলের বাক্স এই রাম ধাক্কার চোটে অবশেষে আলাদা হয়েছে। যাক, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এইসব সেরে দেখি লিফট এসে গেছে। আর আমাদের দুজনের জন্য এই বাসে ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা। মানে দুজনের আড়াই আড়াই টাকা করে। ভারতবর্ষে এত কম ভাড়া আর কোথাও এখনো আছে কিনা জানিনা। বার বার কন্ডাকটরকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হলাম যে আমরা কোনো ভাবে ভুল বুঝে কম ভাড়া দিচ্ছি কি না।

এরপর লিফটের টিকিট কেটে লম্বা লাইন দিয়ে দুই ধাপ লিফট বেয়ে উপরে উঠে প্রথমেই পেটপুজো করা হলো। তখন প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেছে। অন্ধকার হতে বেশি দেরী নেই। তাড়াতাড়ি পা চালালাম ম্যালের দিকে। ম্যালে একটি স্থানীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠান চলছিল। কি সুন্দর হিমাচলী লোকসঙ্গীতের সুর। কিন্তু আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না দাঁড়িয়ে শোনার। তাই ম্যালে একটা চক্কর মেরে সিধে চার্চের মধ্যে। সেদিন রবিবার। কয়েকজন সেই বিকেলেও প্রার্থনা করছেন। শান্ত পরিবেশ। কি মনে হলো, চার্চের একটা বেঞ্চে বসে মনে মনে "সরস্বতী মহাভাগে..." করে সরস্বতীর পুস্পাঞ্জলির মন্ত্রটা বলে মনে মনেই প্রজ্ঞার দেবীকে প্রসন্ন হবার প্রার্থনা জানালাম। সেদিন ছিল এই বছরের সরস্বতী পুজোর দিন। বসন্ত পঞ্চমী তিথি। যদিও দিনের শেষে খেয়ে দেয়ে অঞ্জলি, তাও আমার বিশ্বাস আমার অঞ্জলি নিশ্চয়ই পৌঁছেছে দেবীর কাছে।

চার্চ থেকে বেরিয়ে ওল্ড ম্যাল রোড ধরে পড়ন্ত লালচে রোদে হাঁটতে শুরু করলাম দুজনে। অদ্ভূত সব জীর্ণ ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের বাড়ি। কিছু কিছু বসবাসের অযোগ্য এখন। হয়ত সেই ব্রিটিশ আমলের বানানো। মনে হলো কত ইতিহাস এখানে থেমে আছে। সেসব গল্প কথা থেকেই হয়ত বাড়িগুলোর ভূতুড়ে দূর্নামও জুটেছে। কৌতূহলে আরো সামনে থেকে দেখব বলে এগিয়ে গেলাম সেরকমই একটা বাড়ির দিকে। আমাদের দুজনকে কৌতূহলী হতে দেখে আমাদের পিছনে দেখি দাঁড়িয়ে পড়েছে আরো একটি দল। পড়ন্ত আলোয় সত্যিই কিরকম যেন থম মারা ভূতুড়ে লাগছিল বাড়িগুলোকে।          
পরিপাটি ছোট্ট শিমলা কালিবাড়ি দেখে আমরা যখন নিচের লক্কড়বাজার বাস স্টান্ডে নেমে এলাম ততক্ষণে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ফাগু যাবার বাস কখন আসবে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল, আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সেই কিছুক্ষণটা যে ঠিক কতক্ষণ কেউই তার সঠিক উত্তর দিতে পারে না। আমাদের টেনশন বাড়তে লাগলো। আসতে চার ঘন্টা লেগেছে। যেতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? যে কটা গাড়ি কুফরীর দিকে গেছে সব কটা না হলেও বেশির ভাগই তো ফিরবে। সুতরাং এখুনি যাত্রা শুরু না করলে কুফরী পার হয়ে ফাগু পৌঁছাতে আমাদের মাঝরাত হয়ে গেলেও অবাক হব না। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে ভগবানকে ডাকতে শুরু করলাম। এবার একটা গাড়ি না হলেই নয়। এদিক ওদিক তাকিয়ে গাড়ির খোঁজ শুরু করলাম। দেখলাম ভগবান আমাদের কথা শুনেছেন। নিজে না এলেও একজন দেবদূত পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য। আর সেই দেবদূত লক্কড়বাজার বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র অল্টো গাড়ির ড্রাইভার সেজে গাড়ির মধ্যে বসে গুটখা খাচ্ছেন। আমাদের মতন উদভ্রান্ত চেহারা আরো দুএকটা দেখতে পাচ্ছিলাম আশেপাশে। তারা গিয়ে সবেধন নীলমণি গাড়িটিকে নিয়ে ভেগে যাবার আগেই আমরা দৌড়ে গিয়ে পাকড়াও করলাম দেবদূতকে। তিনি এককথায় ন্যায্য মূল্যে আমাদের ফাগু পৌছে দেবার আশ্বাস দিলেন। তার রথে উঠে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম। যাই হোক রাত দশটার মধ্যে অন্তত ফাগু পৌছে যাবই।

কিন্তু না আমাদের ভাগ্যে আর কোনো দুর্ভোগ ছিল না সে যাত্রা। অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে কুফরীর থেমে থাকা গাড়িগুলো সব চলতে শুরু করে দিয়েছিল। অন্ধকারে তো আর ছবি তোলা যায় না ভালো। তাই রাস্তা আটকে বরফের ওপর বিভিন্ন বিভঙ্গে ছবিতোলার মাতলামিটা ফেরার সময় আর ছিল না। আমরা বেশ মসৃণ গতিতেই উল্টো দিক থেকে আসা কুফরী ফেরত গাড়ির মিছিলের দিকে তাকিয়ে গালাগালি দিতে দিতে আর আমাদের গপ্পে ড্রাইভারের সাথে গল্প করতে করতেই ফিরেছিলাম সেদিন। এই ড্রাইভারও সেদিন যাত্রী নিয়ে কুফরীতে এসে কি ঝামেলায় পড়েছিলেন সেই গল্প শোনাচ্ছিলেন। আমরাও আমোদ করে শুনতে শুনতে আসছিলাম।

হঠাৎই পিনাকী ডানদিকের জানলার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল "দেখ দেখ।" দেখি নিচে শিমলা শহরের দীপাবলী আর দিগন্তে আকাশ জুড়ে গাঢ় কমলা রঙের একটা লাইন তৈরী হয়েছে সূর্যাস্ত পরবর্তী আলোয়। ওপরের আকাশ পরোপুরি বেগুনি। একটি দুটি তারা ফুটেছে সেখানে। আমাদের স্তব্ধতায় মুগ্ধতা আন্দাজ করে আমাদের ড্রাইভার বললেন "দাঁড়াব? ছবি নেবেন? ভালো ক্যামেরায় আসবে এই ছবি।" পিনাকীর হাতের ক্যামেরা দেখেই বোধহয় এই মন্তব্য। দুজনেরই গলা থেকে যান্ত্রিক ভাবে একবাক্যে "না" বেরোলো। কিছু কিছু ছবি বোধহয় তোলার চেষ্টা না করাই ভালো। ছবি তুলতে গিয়ে প্রকৃতিদেবীর প্রসাধনী মাখা সেই ক্ষনিকের মুহুর্তটা বুঝি হারিয়ে যাবে এই ভয় হয়। গত আটচল্লিশ ঘন্টায় আমি অমানুষিক ভিড় ঠেলে দিল্লির বাস স্ট্যান্ডে এসেছি। সেখান থেকে তিনটি গাড়ি বদলে সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে গুড়ের নাগরীর মতন টলতে টলতে শিমলা এসেছি। আমার ক্যামেরার ব্যাটারি খোয়া গেছে। সারাদিন জ্যামে রাস্তায় কাটিয়ে বিকেলে শিমলায় ঝটিকা সফর সেরেছি। এত প্রতিকূলতা সত্বেও প্রিয় সাথীর হাত ধরে দেখা ফাগু আমার কাছে কেবলমাত্র সকালের বরফের মাঝে নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা একলা দেওদার গাছটি আর এই কমলা পাড় দেওয়া ঘন বেগুনী রঙের শাড়ি পরা সন্ধ্যাটুকুর জন্যেই হয়ত চিরজীবন অমলিন হয়ে থেকে যাবে।ঝিঁ ঝিঁ র ঝিম ধরা শব্দ আর মাঝে মাঝে কুফরী থেকে ফেরা ক্লান্ত ঘোড়া আর তাদের বাচ্চা সহিসদের দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম ফাগু। বাকি রাস্তাটা আমরা কেউ আর কোনো কথা বলিনি সেদিন।

কাল আমাদের ফিরে যেতে হবে।   

 (শেষ)

Sunday, 22 February 2015

সার্কাস-৩


এত কান্ড করে কালকা পৌঁছে শেষে সেই গাড়িতে করেই শিমলা পৌঁছতে হবে না কি রে বাবা? সেটাকে এড়াতেই যে এত কান্ড সে তো আগের পর্বেই বললাম। টয় ট্রেনে যাবার যখন সুবন্দোবস্ত আছে তখন হাতের ছয় ঘন্টা খরচ করেই না হয় যাব, তিন ঘন্টা সময় বাঁচাবার লোভে শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই-এরকম একটা চিন্তা করেই টয়ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছিল। সে ট্রেন তো আমাদের দেরী দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পালিয়েছে। এখন পরের ট্রেন তো শুনেছি বারোটায়। এখন কি তবে পাঁচ ছয় ঘন্টা হাপু গাইব? নাকি 'জয় মা' বলে বুক ঠুকে গাড়িতে করেই শিমলা যাবার চেষ্টা করব? দুজনে মিলে যুক্তি করে ভাবলাম দেখি একবার টিকিট কাউন্টারে কথা বলে আর কোনো ট্রেন মাঝখানে আছে কিনা? সুখবর! আছে, ট্রেন আছে। সকাল সাড়ে আটটায়। কিন্তু সেটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন, কোনো অগ্রিম বুকিং এর ব্যবস্থা নেই, জোর যার মুলুক তার হচ্ছে এই ট্রেনের মূলমন্ত্র। সে যাই হোক, ট্রেন আছে সেই ঢের। আমরা টিকিট কাউন্টারের ভদ্রলোককে প্রণাম করে ফেলি এরকম মনগত ইচ্ছে। পত্রপাঠ দুটি টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি ট্রেন দন্ডায়মান। ওফ কি শান্তি, জোর খাটানোর কোনো দরকারই নেই, পুরো মুলুকটাই আমাদের। যেখানে খুশি উঠে বসে পড়লেই হলো।  স্টেশনে দাঁতমুখ মেজে ধুয়ে ফের তৈরী আমরা যাত্রার জন্য। পছন্দমতন সিট খুঁজে নিয়ে বসে দেখি ততক্ষণে আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্যের প্রথম রোদ এসে পড়েছে গায়ে। গত রাতের বিভীষিকার পরে এত ভালো লাগলো কি বলব উৎসাহের চোটে পিনাকী দেখি বলছে,"চায়ের কাপ দুটো বের করত দেখি গরম জল পাই কিনা, চা খাওয়া যাবে।" বের করে দিতে স্টেশনের চা এর ষ্টল থেকে গরম জল নিয়ে হাজির। টি ব্যাগ ডুবিয়ে দিব্যি চা খাওয়া হলো সঙ্গে টা হিসেবে সেদ্ধ ডিম, বিস্কুট, কলা ইত্যাদি ইত্যাদি। খেয়ে দেয়ে মনে হল, আমাদের বেড়াতে যাবার যে নিয়মিত ফাঁড়ারা থাকে তারা বোধহয় এযাত্রা কেটে গেছে। দিব্যি কমলালেবু, মিষ্টি, চকলেট সেবন করতে করতে দুটো নাগাদ শিমলা স্টেশন এ পৌঁছলাম। মাত্র আমাদের পূর্বনির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিনঘন্টা পরে। ছটার ট্রেন শিমলা পৌঁছোয় বেলা এগারোটায়, আমাদের এই সাড়ে আটটার ট্রেন পৌঁছেছে বেলা দুটোয়। গত পনেরো-ষোলো ঘন্টার ছোটাছুটির তুলনায় এমন কিছু পিছিয়ে নেই আমরা। সেটা ভেবেই মনটা বেশ চাঙ্গা হয়ে গেল।  

স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি আমাদের রথ প্রস্তুত। রথী বললেন তিনি আমাদের সসন্মানে ফাগু পৌছে দেবেন। কিন্তু তার আগে আমরা শিমলার বাকি দ্রষ্টব্য কিছু তখুনি দেখতে চাই কিনা? আমাদের শিমলা দেখার বিশেষ তাড়াহুড়ো ছিল না। বললাম সরাসরি ফাগু যাব। তারপর শিমলার বাড়ি ঘরের জঙ্গল শেষ হতে না হতেই রাস্তার পাশে সাদা সাদা ওকি!! বরফ রে! পিনাকীর জীবনে প্রথম এত কাছ থেকে বরফ। তার তো চোখে মুখে আলো। দূরে পরিষ্কার নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কিন্নর কৈলাস।  অপূর্ব সে দৃশ্য। যত যেতে লাগলাম তত বরফ বাড়তে লাগল।এইসব দেখে মনটা এতো তরতাজা হয়ে গেল যে শারীরিক ক্লান্তি ভুলে আমাদের ড্রাইভার ভাইয়ের প্রস্তাবে সায় দিয়ে ফেললাম। না শিমলা দেখব না। সেটা কালকের জন্য তোলা থাক। আজ ফাগু পৌছানোর আগেই পড়বে কুফরী, সেখানে সন্ধ্যে নামা অবধি বরফে খানিক হুটোপুটি করে তারপর ফাগু যাব। কুফরীতে বরফই বরফ। আর তার সাথে গাঢ় সবুজ জঙ্গলে সাদা সাদা বরফ অদ্ভূত এক মোজাইক নক্সা তৈরী করেছে। বরফ আমি আগেও দেখেছি। বেশ ভালোরকমই দেখেছি। কিন্তু এই সবুজ-সাদার কম্বিনেশনের নয়নলোভন ল্যান্ডস্কেপ আর দেখিনি। কুফরীতে বরফের পোষাক, জুতো-টুতো  নেওয়া হলো। তারপরে আমরা গেলাম স্কি করতে। ছবি আর টিভি ছাড়া চর্মচক্ষে জন্মে কখনো স্কি করতে দেখিনি।



সেইসব ভারী ভারী সাজ-সরঞ্জাম দেখে প্রথমে খানিকটা ঘাবড়েই গেলাম। ভাবলাম থাকগে বাবা দরকার নেই ভূতের কিল খাবার। তারপরে ভাবলাম দেখিই না পারি কিনা। জীবনে প্রথম একটা অভিজ্ঞতা তো হবে। প্রথমেই তো আছাড় খেলাম একটা। পিনাকী সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করলো,"এই খাতা খুললো"। প্রচন্ড রাগ হলো। তক্কে তক্কে রইলাম, "আচ্ছা, মাঘ মাস কি আমার একার?" তারপরে আর কি? কিছুক্ষণের চেষ্টায় আর আমাদের গাইডদের সঙ্গতে একটু একটু করে এগোতে লাগলাম। নিজের দেহের ভার যে এতটাই বেশি সেটা আগে কখনো এমন করে বুঝিনি। তার পর আমি আরো দুবার আছাড় খাবার পর পিনাকী একবার আছাড় খেল আর আমার মুখ থেকে সাথে সাথে বেরিয়ে এলো,"এই খাতা খুললো।" অত বরফের রাজ্যে পর্যটক বেশি ছিল না তখন তাই কতটা উপভোগ করেছি সেটা নিয়ে আর কিছু লেখার নেই। শীতকালে শিমলা-কুফরী বা এরকম উচ্চতার যেকোনো পর্যটন স্থানেই যাঁরা গেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, আজন্ম সমতলের গরমে বাস করার পরে বিস্তীর্ণ বরফের প্রান্তর, সেই প্রান্তর ঘিরে ঝুরো বরফের প্রসাধনী জড়িয়ে গাঢ় সবুজ বনানী আর দিগন্তে শ্বেতশুভ্র পর্বতমালা, নামে-উচ্চতায় যাঁরা এক একজন রথী মহারথী-এরকম পরিবেশে কোনো কিছু করতেই মন চায় না। কেবল চুপটি করে বসে ইচ্ছে করে আত্মমগ্ন হবার, নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে অতল থেকে মন্থন করে আনার হারিয়ে ফেলা মনিমুক্তোগুলোকে। কিন্তু আমরা স্কি করলাম, আরো যা যা মজা করা যায় সব করলাম। আর আমাদের সেই সব মজা করতে সাহায্য করলো রীতিমত দক্ষ অভিজ্ঞ বছর বারো-পনেরো বয়সের পেশাদার গাইডরা। স্কি করতে আমার যতটা উৎসাহ তার থেকে আমাকে স্কি করাতে তাঁদের বেশি উৎসাহ। হটাৎ দেখি পেছন থেকে ঠেলতে শুরু করেছে আমায়। তার জন্য যে তারা বেশি টাকা পাবে তাও নয়। বলে,"দিদি এত আস্তে চালালে কি করে হবে?" আমায় দৌড় করিয়ে কি খুশি তারা, খিলখিল করে হাসছে। আমরা না করলেও বলছে "চল চল আর একবার।" একটা কথা মনে হচ্ছিল, আমায় যদি বলা হয় তোমার কাজ কর্ম, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি-মনন যেটুকু তোমার ঝুলিতে আছে, সব কেড়ে নেওয়া হলো। আজ থেকে তোমার পেশা এই বরফে গাইডগিরি, আমি কি এত খুশি হয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে পারতাম? নাকি আমার অর্ধেক বয়সী এইসব ছেলেরা তাসের উল্টো দিকটা হয়ত কোনো দিন দেখেনি বলেই এত খুশি হয়ে নিজের কাজটুকু করে চলেছে? আর আমরা সব পেয়েছির দেশে বাস করেও কোনো কিছুতেই নির্মল খুশির ঠিকানায় পৌঁছতে পারি না? তাহলে যে জীবন আমাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত, তাকে অহেতুক বদল করতে গিয়ে নিরন্তর অতৃপ্তির আগুনে ঝলসানোর থেকে কি তাসের অপর পিঠটা দেখতে পাবার চেষ্টা না করাই কি ভালো? যেটুকু সময়ের সাথে সাথে যেচে জীবনে যুক্ত হতে চায় তাকে উপভোগ করার নির্মল খুশির খিলখিল হাসিটা বুঝি তাহলে এমনিই বেরিয়ে আসে। তাকে ঝোলা কাঁধে খুঁজতে বেরোতে হয় না।

এরপরে আমরা গেলাম আরো ওপরে সেখানে বরফ-স্কি-টিউব চড়ে বরফের ঢাল বেয়ে নেমে আসা-চা, কফি, ম্যাগির অস্থায়ী পসরা সব নিয়ে আছে এক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। সেখানে যেতে গেলে পার হতে হয় বেশ কিছুটা কাঁচা রাস্তা আর সে রাস্তা তখন বরফগলা জলে আর ঘোড়া চলাচলের দরুণ আক্ষরিক অর্থেই একহাঁটু কাদার দহের চেহারা নিয়েছে। সে রাস্তার হেঁটে যাবার ক্ষমতা আমাদের মতন আলতুশি প্রানের নেই। ফলে বাধ্য হয়েই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাকিদের মত একটি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসতে হলো। অপরিসীম লজ্জায় দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত গামবুট পরে হাসিমুখে অবলীলায় সেই অবলা জীবটিকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে আর একটি বছর পনেরোর ছেলে। সেখানে গিয়ে কি দেখালাম ততো আগেই বললাম।







ফেরার সময় দুটি ঘটনা। এক, আমাকে আর পিনাকীকে যথাক্রমে 'শেরু' আর 'ছুমরী' নাম দুটি ঘোড়ার পিঠে তোলা হলো, যারা নাকি জুড়িদার। আমরা দুজন ছাড়াও আরো ছজনকে নিয়ে একজন মাত্র বাচ্চা ছেলে নামতে লাগলো যথারীতি হাসি ঠাট্টা করতে করতে। ঘোড়াগুলি এ রাস্তায় আজন্ম ওঠানামা করছে প্রতিদিন। তাই তাদের লাগাম ধরে নিয়ে যাবার কোনো দরকার নেই। ওরা নিজেরাই নিচে নেমে যেতে পারবে এই যুক্তিতে। কিন্তু গাইড সামনে না থাকলে আমাদের যেমন ফেসবুকে চ্যাট করতে কোনো বাধা নেই, তেমনি গাইড না থাকলে ঘোড়াদেরও পাহাড়ি পিচ্ছিল রাস্তায় পিঠে প্রাণ হাতে করে বসে থাকা সখের সওয়ারী নিয়ে বেয়াক্কেলে লাফালাফি করতে কোনো বাধা নেই। শেরু আর ছুমরী আগে পিছে হাঁটছিল বেশ। হটাৎই তাদের প্রেম উথলে উঠলো। আর 'শেরু' ঘাড়  বেঁকিয়ে আড়াআড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে 'ছুমরী'র ঘাড় কামড়াতে শুরু করলো। আর এর ফলে 'ছুমরী' সেই হাঁটু পর্যন্ত কাদা মাখা সরু পাহাড়ি রাস্তায় তড়িঘড়ি খাদের দিকে চলে যেতে লাগলো। শেরুও তার সওয়ারীকে নিয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে আসতে লাগলো। ফলে আসা যাওয়ার পথে বাকি ঘোড়ারাও রাস্তা না পেয়ে সেখানে একটি সুন্দর জটলা তৈরী করলো। সরু পাহাড়ি রাস্তা-বরফগলা জলে হাঁটু পর্যন্ত কাদা-সহিসহীন ঘোড়াদের চাঞ্চল্য-তাদের পিঠে ঠুনকো সওয়ারীদের বিকট আর্তনাদ সব মিলিয়ে আমার সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের কাবুল যাত্রার কথা মনে হচ্ছিল। অনেক কষ্টে 'শেরু' কে বাগে আনা গেল সহিসের সাহসে। আর এর ফলে আরো একটি লাভ হলো সেটি এই যে আমার নিজের অশ্বারোহণ ক্ষমতার প্রতি এতটাই বিশ্বাস জন্মালো যে আমি একহাতে ঘোড়ার পিঠের আসনের হাতল ধরে আর এক হাতে ক্যামেরা বাগিয়ে কেরামতি করতে গেলাম। এবং এর ফলস্বরূপ এদিনের শেষ সার্কাসটা ঘটলো। আমি আশেপাশের বরফ-গাছপালা-রাস্তাঘাট-রাস্তার কাদা-ঘোড়া এসবের ছবি তুলতে লাগলাম। মাঝে একটি ঘোড়া হঠাৎ বেঁধে দেওয়া রাস্তা ছেড়ে পাশের জঙ্গলের দিকে ঢুকে গিয়ে মনে সুখে রাস্তার পাশের বরফ খেতে লাগলো। জলতেষ্টা পেয়েছিল বোধহয়। তার সওয়ারী তো প্রবল বিক্রমে চেঁচাতে লাগলেন ঘোড়া আর কিছুতেই সিধে রাস্তায় আসে না। আর আমি অপরের দুঃখে হ্যা হ্যা করতে গিয়ে হটাৎ দেখলাম আমার ক্যামেরা স্পিকটি নট হয়ে গেছে। না তার লেন্স বন্ধ হয়। না সে সচল হয়। ঘোড়ার পিঠে ওই কাদাওয়ালা রাস্তায় দোদুল্যমান হয়ে যেতে যেতে যত সম্ভব খোঁচাখুঁচি করেও যখন সে ক্যামেরার মুখ কোনো মতেই বন্ধ করতে পারলাম না তখন হল ছেড়ে দিয়ে বাকি রাস্তাটা শক্ত করে ছুমরির পিঠে চেপে বসে রইলাম। আর মাঝে মাঝে ছুমরির পিঠে হাত বুলিয়ে মনে মনে বলতে লাগলাম "সাবধানে নিয়ে চল মা, এই রাস্তায় যদি একবার পড়ে  যাই কাদাতেই তলিয়ে যাব। তারপর উঠে যতই পরিস্কার করি না কেন নিজেকে, আমার মাও বোধহয় আর আমাকে চিনতে পারবে না।" একহাঁটু কাদা জলের নিচে রাস্তার কোথায় কি উঁচু নিচু আছে না জেনে সম্পূর্ণ আন্দাজে কি করে যে সে আমায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই জানে।  তবে একসময় দেখলাম আমি সজ্ঞানে, পরিষ্কার অবস্থাতেই পাকা রাস্তায় অবতরণ করেছি। আর ওই অশ্বারোহণ পর্বে আমার ক্যামেরার ব্যাটারিটি খুস করে খুলে নিচে ওই কর্দম সমুদ্রে বিসর্জিত হয়েছে। তাই আমার ক্যামেরা অমন অবাধ্য ঘোড়ার মতন ব্যবহার করছিল আমার সাথে। কোনো মতেই সে ক্যামেরার মুখ আমি আর সে যাত্রা বন্ধ করতে পারলাম না। সে মুখ বন্ধ হয়েছিল আরো দিন দশেক পর। ফিরে এসে ব্যাটারি কেনার পর। সেই ব্যাটারি কেনার সময় নাম সংক্রান্ত ঝামেলার কথা তো আগেই আপনাদের বলেছি 'নামাবলী' শিরোনামে। সে পর্যন্ত আমার ওই হাঁ মুখ ক্যামেরা টিসু পেপার জড়ানো অবস্থাতেই বসে ছিল ব্যাগের ভেতরে। সুতরাং এই ভ্রমনে এই অশ্বারোহণ পর্বের পরবর্তী সমস্ত ছবিই আমার মোবাইলে তোলা। ক্যামেরায় তোলা শেষ ছবিটি আপনাদের দেখাই।  তাতে রাস্তার কাদার অন্তত সিকিভাগ আন্দাজ পাবেন আপনারা।



এখানেই আমাদের সার্কাস শেষ নয় কিন্তু। উৎসাহের চোটে আমরা যে সেই টয়ট্রেন থেকে নেমেই আগের রাতের যাত্রা, খিদে-ক্লান্তি এবং আর যা কিছু জৈবিক প্রয়োজন সব ভুলে গিয়ে ব্যাগ ট্যাগ নিয়েই সারাদিন ধরে কুফরীতে চষে বেড়ালাম, সেটা একর্থে আমাদের কাছে ছিল ভগবানের বলে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত। কারনটা সেদিন বুঝিনি, পরদিন বুঝেছিলাম। যথাসময়ে ব্যাখ্যা করব সে কথা। আপাতত আজকের মতন সার্কাস শেষ। পরের দিনের শেষ সার্কাসটার গল্প আবার পরের দিন বলবখন। সেদিনের মতন আমরা কুফরীকে বিদায় জানিয়ে ফাগুর হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।    
          
(চলবে)

Friday, 20 February 2015

সার্কাস-২

সার্কাস-১ এরপর.....

সর্বহারার মত কিছুক্ষণ মেট্রো স্টেশন এর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার পর কিরকম যেন ঘোর লেগে গেল। দুজনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতেই দেখলাম পাশের লম্বা লাইনটি এঁকে বেঁকে বাড়তে বাড়তে স্টেশন এর বাইরে চলে গেছে। কিসের লাইন কে জানে? পার্থিব বিষয়ে জ্ঞান আস্তে আস্তে ফিরে আসছিল আমাদের। "কিসের লাইন এত বড় বলত?"-র উত্তরে ডেইলি টিকিট কাটার লাইনের কথাই মনে এসেছিল। তাই বললাম, "টিকিট কাটার লাইন হবে, আমরা সোজা ঢুকে যাই চল।" ব্যাগ নিয়ে পায়ে পায়ে এগোতে এগোতেই ভুল ভাঙ্গলো। "ওরে না রে! এ তো স্টেশনে ঢুকবার লাইন। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!" এই এতো লোক ছুটি বলে লটবহর নিয়ে বেরিয়েছে? কেন? এত লোকের বাইরে বেরোবার দরকারটা যে কি বুঝিনা। আমি নিশ্চিত আমাদেরকে দেখেও বাকি লোকেরাও ঠিক একই কথা ভাবছিল। এতক্ষণে বুঝলাম আমরা যখন লাইনের পাশ দিয়ে গুটি গুটি অর্ধেক রাস্তা চলে আসছিলাম তখন কেন আমাদের সাথে বাস থেকে নেমে আমাদের চেনাশোনা বাকি লোকেরা পিছনে রয়ে গেল। 'হরিবোল' বলে আবার লাইনের মুড়ো থেকে ল্যাজার দিকে চলতে শুরু করলাম। অন্ততঃ খুব কম করে পাঁচশো লোকের লাইন। একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। সকলেই স্টেশনে ঢুকতে চায়। লাইনের লিঙ্গভেদে আমার দুর্ভোগ বেশ খানিকটা কম। জন কুড়ি পঁচিশ মহিলার জটলা আর পোঁটলা করে কি কি বিষ্ফোরক নিয়ে যাচ্ছি না যাচ্ছি সেসবের হিসেব নিকেশ পেরিয়ে স্টেশন এর ভেতরে গিয়ে পৌঁছালাম। পিনাকী ফোন করে বললে সে আপাতত লাইনের ল্যাজা খুঁজতে খুঁজতে স্টেশন চত্বর, সিঁড়ি-টিঁড়ি পেরিয়ে রাস্তার ফুটপাথে গিয়ে পৌঁছেছে। ততক্ষণে একটা বিষয়ে নতুন করে বোধদয় হয়েছে আমার। আমাদের দেশে কন্যা ভ্রূণহত্যা আর ধর্ষণের প্রধান কারণ যে মহিলা ও পুরুষের অত্যন্ত অসমানুপাতিক সংখ্যা, সেটির অত্যন্ত প্রকৃষ্ট উদাহরণ সেদিনের সেই লাইন। আমাদের দেশে মহিলা-পুরুষের অনুপাতটা যে ঠিক কি সেটা বোঝা গেল। প্রতি একজন মহিলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন পুরুষ। ফলে পুরুষদের লাইন এঁকে বেঁকে গিয়ে পৌঁছেছে মেট্রো স্টেশনের বাইরে।তারপর আজও দাঁড়িয়ে আছি কালও দাঁড়িয়ে আছি, সারা পৃথিবীর লোক বেরিয়ে যাচ্ছে পিনাকীর দেখা নেই। সিকিউরিটি চেক করা পুলিশের মুখ পরিবর্তন হয়ে গেল। কতরকমের ব্যাগ ব্যাগেজ পৃথিবীতে আছে x-ray মেসিনের দৌলতে আমার দেখা হয়ে গেল। ঠিকঠাক সময় লাইন দিয়ে আমার বাসের চেনা ছেলে মেয়েরা আমার দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল। আমিই শুধু ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষতে থাকলাম।

তারপর লক্ষ কোটি বছর পরে পিনাকী এসে পৌঁছালে মেট্রোতে গিয়ে উঠলাম। স্টেশন এর সমস্ত লোকজনও আমাদের সাথে সাথে ট্রেনে উঠলো। বোধহয় অপেক্ষা করছিল আমরা কোন কামরায় উঠি দেখার জন্য। দেখে টেখে সক্কলে মিলে যুক্তি করে আমাদের কামরাতেই পড়ি কি মরি করে উঠবে ঠিক করলো। বোধহয় ওটিই দিনের শেষ ট্রেন আর ওটিই শেষ কামরা। সকলের মুখেই বিশ্বজয়ীর তৃপ্তি এবং কারোরই দাঁড়ানোর জায়গা নেই।  একটা ঘটনা বলি এখানে। ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আমি বাড়ি থেকে স্কুল যাতায়াত করতাম বাসে। সকাল দশটা দশের বাসে যাওয়া আর বিকেল চারটে দশের বাসে ফেরা। সেখানে বাস কন্ডাকটরদের মধ্যে একটি চালু কথা ছিল "একটু ঝাঁকিয়ে দাও গুরু।" মানেটা হলো এই, বাড়িতে মুড়ির টিনে মুড়ি ভরার কথা মনে করুন। পুরোটা ভরা হয়ে যাবার পরেও বেশ করে ঝাঁকালে আরো বেশ খানিকটা মুড়ি সেই টিনে ভরে ফেলা যায়। সেই সময় আমাদের গ্রাম থেকে স্টেশনে আসার একমাত্র উপায় ছিল প্রতি একঘন্টা অন্তর অন্তর একটি করে লড়ঝরে বাস। কাছে পিঠে ভালো স্কুল না থাকার দরুণ ওই দশটা দশের বাসে অন্তত চারটি পাঁচটি স্কুলের ছেলেমেয়েরা, উপরন্তু দুটি কলেজের দাদা দিদিরা এবং তার সাথে অন্যান্য নিত্যযাত্রীরা অত্যন্ত কষ্ট করেই প্রায় গরু ছাগলের মতন বোঝাই হয়ে যাতায়াত করত। ফলতঃ বাসটির প্রায় পেট ফাটবো ফাটবো উপক্রম হত। এমতাবস্থায় যদি রাস্তায় অপেক্ষমান আরো যাত্রী সেই বাসে উঠতে চাইতো তখনই বাস কন্ডাকটরদের ড্রাইভারের উদেশ্যে উপরোক্ত উক্তিটি করতে হত। সেই শুনে বাস ড্রাইভার প্রবল বিক্রমে বাসের ব্রেক কষতেন। আর আমরা যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে এর ওর ঘাড়ে পড়ে, নড়ে চড়ে বেশ করে ঝেঁকে যেতাম আর সশব্দে অথবা নিঃশব্দে ড্রাইভারকে গালাগালি শেষ করে দেখতাম রাস্তার যাত্রীর বাসে ওঠার মতন সুন্দর খানিকটা জায়গা তৈরী হয়ে গেছে দরজার সামনে। সেদিনে ট্রেনে উঠে একজন কন্ডাকটরের অভাব বড় বোধ করছিলাম। যে ড্রাইভারকে বলে ট্রেনটাকে খুব খানিকটা ঝাঁকিয়ে দিলে একটু পা ফেলার জায়গা নিয়ে দাঁড়াতে পারি। আস্তে আস্তে ঠেলেগুঁজে সাধের স্লিপিং ব্যাগওয়ালা দুটো ব্যাকপ্যাক নিয়ে  একটু জায়গা কোনমতে হলো। স্লিপিং ব্যাগে ঘুমানোর সাধ তো এযাত্রা মাঠে মারা গেল বলেই মনে হলো।

এখন প্রশ্ন আমরা যাব কি ভাবে? কালকা মেল এর জন্যে অপেক্ষা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সে আসবে পরদিন সকাল দশটা নাগাদ। তার আশায় থাকলে পরের পুরো দিনটাই রাস্তায় কাটবে। অতএব কালকা মেল বাদ। এছাড়া কালকা যাবার কোনো ট্রেন এ টিকিট নেই। তাহলে বাস। এখানে প্রশ্ন হলো বাসে কদ্দুর যাব? শিমলা পর্যন্ত অনেক বাস আছে দিল্লি থেকে। কিন্তু একটি ছোট্ট অথচ গুরুতর সমস্যা আছে সে ব্যবস্থায়। সমতলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সে বাস যখনই সমতল ছেড়ে পাহাড়ি পাকদন্ডী পথে ঘুরতে শুরু করবে তখনই আমার সঙ্গীটির সমস্ত বীরত্বের অবসান হবে। বাসের সাথে সাথে তার পেটের ভেতরের সমস্ত কলকব্জা গোল হয়ে ঘুরতে থাকবে। সে বারে বারে জোয়ান খেতে থাকবে, কোল্ড ড্রিংক খেতে থাকবে, আরো নানা টোটকার পরে সে অবধারিত ভাবে গাড়ি থামাতে বলবে এবং শরীরের সমস্ত গন্ডগোল সুন্দর পরিস্কার পাহাড়ি পথের পাশে উদগীরণ করবে। একবার তো মিলিটারী ব্যারাকের সদর দরজার ঠিক সামনে কাজ সেরে মুখে মাথায় ঘাড়ে জল থাবড়ে স্মার্টলি গাড়িতে উঠে বসেছিল। আর আমি তার ঘাড়ে জল থাবড়াতে থাবড়াতে ভয়ে ভয়ে সেই সদর দরজার মিলিটারী বন্দুকধারী তাগড়াই প্রহরীর দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলছিলাম আর মুখে একটা অসহায় হাসি আনার চেষ্টা করছিলাম। যাত্রার অর্ধদন্ড পূর্বে এভোমিন সেবন, লেবু, জোয়ান, কোল্ড ড্রিংক কোনো কিছুতেই এই রুটিনের ব্যত্যয় হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে রক্ষে এই যে, অ্যাকশন ওই একবারই। ঘটনা একবার ঘটে যাবার পরে বাকি যাত্রায় পাহাড়ি পথে আর তেঁনাকে এই কারণে গাড়ি থামাতে হয়না।তাই এখন আমি ওই প্রথম বারের ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করি। হয়ে গেলে-যাক বাবা, আর টেনশন নেই বলে হাঁপ ছাড়ি। সুতরাং পুরো শিমলা পর্যন্ত বাসে করে গেলে পাহাড়ি রাস্তায় এঁনার একার জন্য গাড়িকে অন্তত একবার থামাতে হবে। উপরি পাওনা শারীরিক অস্বস্তি। তাহলে কি কালকা পর্যন্ত বাসের খোঁজ করব? সেখান থেকে সকাল ছটার টয়ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। ভেবেচিন্তে সেটিই ঠিক হলো আমরা কালকা পর্যন্ত বাসের খোঁজ করব। সেখান থেকে সকাল ছটার টয়ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করব। ক্রমে ক্রমে নিউ দিল্লি, চাঁদনী চক স্টেশনগুলো পেরিয়ে গেল। আমরা শেষ বারের মত দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কালকামেল  আর স্লিপিং ব্যাগে ঘুমনোর মায়া ত্যাগ করলাম। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে আমাদের যে সে যাত্রা কত আবেগ ছিল তা তো সার্কাস-১ পর্বে বলেছি। কারনটা নাহয় পরেই কোনো একদিন শুনবেনখন। কালকা মেলে নির্ঝনঝাট যাত্রার মায়ার থেকে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমনোর মায়া কোনো অংশে কম ছিল না সেদিন। যাই হোক কপালে ছিল না সে যাত্রা আর কি হবে। মসৃণ ভ্রমণ আজ অবধি কোনদিন আমাদের হয়নি সুতরাং সমস্ত টিকিট কনফার্মড আগে থেকে, হোটেল বুকিং হয়ে গেছে এত মসৃণতা যে বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাষ সেটা বোঝা উচিত ছিল আমাদের। যাই হোক। আপাতত সামনের দিকে চলাই ভালো।

কাশ্মিরি গেটে নেমে গুটি গুটি স্টেশনের বাইরে এলাম। বাস স্টেশনের দিকে হাঁটতে যাব দেখি বাস হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকে আসছে কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন করতে করতে। মানে বাসের দালাল। শিমলা-কালকা আমতা আমতা করতে না করতেই দেখি আমাদের দুজনকে বগলদাবা করে তিনি হাঁটা লাগিয়েছেন বাস স্টেশন এর সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। হাঁ হাঁ করে উঠতেই বললেন তাঁর প্রাইভেট বাস। ঐসব রোডওয়েজ বাসের মতন লড়ঝরে নয় রীতিমত ডিলাক্স। তাই সেটি স্টান্ডের বাইরে আছে, সেখানে তিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু ভালো মত বোঝার আগেই দেখলাম আমরা স্টেশন চত্বরের বাইরে পৌঁছে গেছি। ফ্লাইওভারের নিচে আবছা আলোয় আরো কয়েকজন লোকজনের সাথে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সাথে আমাদের পথপ্রদর্শক। আমাদের সামনে একটি পুঁচকে কাঠের টেবিল। টেবিলের ওদিকে চটপটে একটি ভুঁড়িদাস ছেলে। কোথায় যাবেন? বললাম কালকা।
--কালকা তো যাবে না বাস।
--অ্যাঁ !! বলে পথপ্রদর্শকের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাতেই তিনি বিনয়ের অবতার হয়ে বললেন "আপলোগ আম্বালা মে উতার যাইয়েগা। উঁহাসে কালকাকা বাস হরদম মিলতি হ্যায়।"
--তো পহেলে আপ কিঁউ নেহি বোলা?
এরকম বেশ কিছু চাপানউতোরের পর ভাবলাম যেরকম ভাগ্য চলছে তাতে যা পাচ্ছি সেটাই নিয়ে নেওয়া যাক। নইলে হয়তো কালও সারাদিন ব্যাগ ঘাড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে।
"বেশ যাবখন তোমাদের বাসে কিন্তু দেখো ভাই আম্বালা যেতে কতক্ষণ লাগবে? আর সেখান থেকে কালকাই বা কতদূর? মোদ্দাকথা সকাল ছটার ট্রেনটা পাবতো কালকা থেকে?"
প্রশ্ন শুনে দুজনে এমন ভাবে হই হই করে উঠলো যেন মনে হলো আমি জিজ্ঞাসা করেছি "বাপুহে নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে কুতুব মিনার যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে? আজ রাত্রি দশটায় শুরু করলে কাল সকাল ছটায় তোমাদের বাস আমায় সেখানে পৌঁছে দেবে তো?"
দিল্লি থেকে বাস রাত দশটায় ছেড়ে চার ঘন্টার মধ্যে নাকি আম্বালা পৌঁছাবে, সেখানথেকে একঘন্টা কালকা। সুতরাং ছটার অনেক আগেই আমরা কালকা পৌঁছাবো এরকম বিস্তর আশ্বাস টাশ্বাস দিয়ে আমাদের বাসে তুলে দিল। আমরাও খাবার দাবার কিনে সিটে গুছিয়ে বসতে না বসতেই দেখি আমাদের ইনস্টিটিউটের আরো তিনজন একগাল হাসতে হাসতে বাসে উঠছে।
-"আরে তোরা কোথায় যাবি?"
বলে জলন্ধরে নামবে, সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য ডালহৌসি-খাজিয়ার-চাম্বা।
তাদের বাসে দেখতে পেলাম না কেন জিজ্ঞাসা করতে বলল তারা জানত বাস রাত দশটার আগে ছাড়েনা তাই দেরী করে বেরিয়েছে। আর এই সময় কুয়াশার জন্য দিল্লির ট্রেনের ভরসা না করাই ভালো তাই তারা ট্রেনের কথা ভাবেই নি। সরাসরি বসে এসে উঠেছে। আমরাও 'ও আচ্ছা' টাচ্ছা বলে একবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম ভাবখানা এই যে, আমরা ভেবেছি এবং এই নাক মুলছি কান মুলছি আর কোনো দিন ভাববনা। বিশেষত শীতকালে।

যাই হোক রাত দশটায় ছেড়ে চার ঘন্টা মানে রাত দুটোয় আম্বালা পৌঁছাবার আশ্বাস শেষ পর্যন্ত মাত্র আড়াই ঘন্টা পরে ফলপ্রশূ হলো। ছাড়তে এক আর পৌঁছাতে আরো দেড়ঘন্টা দেরী করে ভোর সাড়ে চারটেয় আমাদের দুই ভ্রমনার্থীকে ধু ধু হাইওয়ের ধারে "এই তো সামনে এগোলেই ওই যে দেখা যাচ্ছে আলো ওটাই আম্বালা স্টেশন" বলে নামিয়ে দিয়ে বাস তো টাটা করে পগার পার। এদিকে আমরা হেঁইও বলে ব্যাকপ্যাকদুটো তুলে দূরের ফুটকি ফুটকি আলো লক্ষ্য করে সার্কাস শুরু করলাম। আমাদের হাতে দেড়ঘন্টা সময় এখান থেকে কালকা পৌঁছানোর জন্য। তার মধ্যে নাকি একঘন্টা অন্তত লাগবে রাস্তায়। তাহলে ঝটপট কিছু একটা পেতে হবে কালকা যাবার জন্য। ব্যাগ কাঁধে হাঁটছি তো হাঁটছি। রাস্তার বামদিকে চায়ের দোকান টোকান গুলো সবে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসছে। কুকুরগুলো রাতের ডিউটি সেরে কুন্ডলী পাকাবার চেষ্টা করতে করতে ভাবছে এখন ঘুমিয়ে পড়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? চা এর দোকানের বিস্কুট-টিস্কুট এর ব্যাপারগুলোর কথাও তো ভাবা উচিত। রাস্তার ডানদিকে সোজা একটি দানবীয় ফ্লাইওভার। যে দোকানেই জিজ্ঞাসা করি যে, "কালকা যাবার বাস কোথা থেকে পাব" সবাই সামনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে ওই তো সামনের মোড়ে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে আমার আরো একটি বোধদয় হলো। সেটা এই যে, এমনিতেই আমায় লোকে কিপ্টে বলে তা সে অন্য যেকোনো বিষয়ে বলুক না কেন, আমি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সময় আর কিপ্টেমি করবনা। দুটো ব্যাকপ্যাকের মধ্যে আমার নিজেরটা কেনার সময় ভেবেছিলাম পিনাকীর বড় ব্যাগটার মধ্যেই বেশিরভাগ জিনিস এঁটে যাবে আমারটা আর কতই বা ভারী হবে? সুতরাং ব্যাগের প্যাডিং-ট্যাডিং নিয়ে পিনাকী আমায় নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করলেও অনলাইনে ব্যাগের ছবির পাশে লেখা মূল্য বিজ্ঞাপক সংখ্যাটির দিকেই সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিলাম। সেটা যে কত বড় আহাম্মকি হয়েছে সেটা হাঁটতে হাঁটতে হাড়ে হাড়ে থুড়ি কাঁধে কাঁধে টের পাচ্ছিলাম।

শেষকালে কপালে জুটলো একটা ট্রেকার। যেটার পায়ে আমার বাড়ি যাবার ট্রেকারও দন্ডবৎ হবে। ওঠার সময় জিজ্ঞাসা করলাম "ভাই ছটার মধ্যে কালকা পৌছাবে কি?" নইলে যে চলতি বাস যাচ্ছে তাতেই উঠে যাব। ভিড় হোক না হয় দাঁড়িয়েই যাব। ড্রাইভার ভাই প্রবল কনফিডেন্সের সঙ্গে বলল, আরে দিদি উড়িয়ে নিয়ে যাব, এখন তো ভোরবেলা চল্লিশ মিনিটেই পৌছে দেব। কোনো চিন্তা করবেন না। বসলাম। এবং পরবর্তী ভুলটা করলাম। ফলে এই সার্কাসে আরো একটি রুদ্ধশ্বাস খেলা শুরু হলো। তার গাড়িতে লোক তোলা আর থামে না। চা খেয়ে, অন্য ড্রাইভারদের কুশল সংবাদ নিয়ে, গাড়ির পেট ঠেসে ভর্তি করে শেষ পর্যন্ত আমাদের ট্রেকার যখন ছাড়লো ঘড়িতে তখন পাঁচটা দশ।  

আমি সবসময়ই আশাবাদী। মনে আশার উদয় হলো যদি আর কিছু ঘটনা না ঘটে তাহলে নিশ্চয়ই ছটার মধ্যে পৌঁছে যাব। স্কুলগামী অনিচ্ছুক বাচ্চার মতন ঢিমে তেতালায় গাড়ি চলতে লাগলো। স্পিড নিচ্ছেনা কেন জিজ্ঞাসা করতে উত্তর মিললো এত কুয়াশায় কি করে জোরে ছুটবে গাড়ি? মোক্ষম যুক্তি। কি আর করি? এর মধ্যে দেখি গাড়ি রাস্তা ছেড়ে বামদিকে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কি ব্যাপার? ভাড়া সংগ্রহ চলছে কারণ ট্রেকারে তেল নিতে হবে। আর ড্রাইভারের কাছে টাকা নেই। ততক্ষণে বুকভরা আশা ধুক ধুক করে নিভে আসছে। টাকা নিয়ে তেল ভরে আবার চলল গাড়ি। কিছুক্ষণ পর থেকেই যাত্রীরা নামতে শুরু করলো। শেষে যখন আমরা দুজন ছাড়া বাকি সকলেই নেমে গেল তখন দেখি গাড়ির ছাদ থেকে আমাদের ব্যাগ দুটো টেনে নামাচ্ছে হেল্পার।  কি ব্যাপার? বলে নিচে রাখুন। ভাবলাম এখন তো গাড়ি ফাঁকা আর এসেও পড়েছি বোধহয় কাছাকাছি। তাই ব্যাগ নামিয়ে দিল। কিন্তু ঘটনা তা ছিল না। সামনের মোড়টা ঘুরতেই দেখি ভ্যাগ সমেত আমাদের দুজনকেও নামিয়ে দিলো রাস্তার মাঝে। কালকা এসে গেল নাকি?নেমে দেখি, এটা কোনো মতেই কালকা নয়, আমি কালকা গেছি আগে। কি হলো? বলে এই দুজনের জন্যে আর আমরা যাব না। আমরা গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি আপনাদের। বলে পথ চলতি একটা অটোকে দাঁড় করিয়ে ব্যাগ সমেত ঠেসেগুঁজে আমাদের অটোর পেটে ঢুকিয়ে দিল। উঠে দেখি তাতে কাঁচা-সবজি ভর্তি। আশেপাশের গ্রাম থেকে কালকাতে যে সবজির সরবরাহ হয় সেরকমই একটি অটোতে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, পালং শাকের আঁটির সাথে দুলতে দুলতে আর অন্ধকার ভোরের ঠান্ডায় ফাঁকা অটোয় কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলাম এই গাড়িটা অন্তত আমাদের কালকা স্টেশনে পৌঁছে দেবে তো?  বলে হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আরো দুচার জন মাঝরাস্তায় উঠলো আবার নেমেও গেল। আমরা কাঁপতে কাঁপতে চলেছি। চোখের সামনে ঘড়ির কাঁটা আমাদের বুড়ো আঙ্গুল  দেখিয়ে ছটার ঘর পেরিয়ে গেল। অবশেষে অটোচালক আমাদের নামতে বললেন। বললাম স্টেশন এসে গেছে? বলে হ্যাঁ এই তো স্টেশন। নেমে দেখি কোথায় স্টেশন? অনেক দূরে কতগুলো টিমটিমে টিউব লাইট দেখ যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অটোড্রাইভারকে কিছু বলতে যাব দেখি তিনি ততক্ষণে ধাঁ। সকলেই তো আমাদের মতন হাঁদা নয়। দূরের ওই লাইটগুলি স্টেশনের  লাইট কিনা জিজ্ঞাসা করার মতন কেউ নেই ওই ভোরে। অগত্যা ব্যর্থ রাগে আবার ব্যাগ ঘাড়ে গজগজ করতে করতে টিউব লাইট লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগলাম। বিধ্বস্ত দুজনে স্টেশনে এসে যখন পৌঁছালাম তখন আমাদের সাধের কনফার্মড টিকিটওয়ালা টয়ট্রেন আমাদের বিরহে কেঁদে কেঁদে পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেই রওয়ানা দিয়েছেন। আর আমরা দুই মক্কেল ফাঁকা ধু ধু স্টেশনে ব্যাগ ঘাড়ে নখ খাচ্ছি।  ঘড়িতে তখন সকাল ছটা পঁয়তাল্লিশ।

বাড়িতে ফোন করে খবর দিলাম আমরা ঠিক মতন কালকা এসে পৌঁছেছি।       

(চলবে)
   

Tuesday, 17 February 2015

সুন্দর

সাত সকালে স্নান সেরে
পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে বললে
“কেমন লাগছে আমায়?”

যদি বলতাম,
প্রিয় কবিতার মত সুন্দর লাগছে তোমায়
বিশ্বাস করতে?

নাকি আরও অনন্য বিশেষণ আশা করতে আমার কাছে?
এর চেয়ে বেশি শব্দ তো বুকে ছিল না আমার
যা দিয়ে তোমায় বর্ণনা করতে পারি।

অপূর্ব সেই চোখের দিকে তাকিয়ে তাই শুধু বলেছিলাম
“সুন্দর”।
উত্তরে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়েছিল আমার কবিতা।

তারপর সমস্ত দিন ধরে
তুমি জড়িয়ে নিয়েছিলে আমায়
মৃদু অপার্থিব চন্দনের সুবাসের মতন।  

আর আমি ঘুমিয়েছিলাম
আমার প্রিয় কবিতার বুকে
নিশ্চিন্তে, পরম নির্ভরতায়।

Friday, 13 February 2015

সার্কাস-১

গত তেইশে জানুয়ারী আমার জীবনের প্রথম ভ্রমনের ছোট্ট একটি গল্প আপনাদেরকে শুনিয়েছিলাম। সেটি একান্ত সম্পর্কহীন নিছকই একটি স্মৃতিকথা ছিলনা বরং আমাদের পরবর্তী ভ্রমনের একটি মুখবন্ধ ছিল বলা যায়। পরবর্তী ভ্রমণটির গন্তব্য অবশ্যই দীঘা ছিল না বলাই বাহুল্য। এই সাগরহীন রুক্ষ এলাকায় থেকে সপ্তাহ শেষের ছুটিতে চাইলেই তো আর সাগর বিরহী মনকে নিয়ে 'চল মন খানিক সমুদ্রভ্রমন করে আসি' বলে লোটা-কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় না। তার জন্য প্রস্তুতি লাগে, সময় লাগে। অমন উঠলো বাই তো হিমালয় যাই বলে ব্যাগ ঘাড়ে বেরিয়ে পড়লে এতদূর থেকে সাগরের অপমান হয় না বুঝি? তাই আমরা এখনকার সাগরে নয়, যাচ্ছিলাম অনেক অনেক দিন আগেকার এক সাগরে যা নাকি এখন কালস্রোতে এদিক ওদিক থেকে চাপ খেতে খেতে পৃথিবীর প্রবল প্রতিবাদে একদিন টেথিস সাগর থেকে অভ্রভেদী হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল একটা কথা। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আচ্ছা, এই যে আমাদের দেশের তিনদিক জোড়া সাগর, এরাও যদি ভবিষ্যতে কোনো একসময় পৃথিবীর তলাকার বিভিন্নরকম প্লেটের খামখেয়ালী নড়াচড়ায় চাপ টাপ খেয়ে ওরকম ভাবে বঙ্গোপসাগর-আরবসাগর-ভারতমহাসাগর থেকে বঙ্গ পর্বতমালা-আরবপর্বতমালা আর ভারতমহাপর্বতমালায় পরিবর্তিত হয়ে যায় কেমন হবে তখন পৃথিবীর চেহারাটা? উত্তরের প্রাচীন প্রপিতামহ হিমালয়ের ছায়া থাকবে তো? নাকি সে নবজন্ম নেবে হিমালয়্মহাসাগর রূপে? আমার চেনা একটি দিল্লিবাসী বছর ছাব্বিশ-সাতাশের মেয়ে আমায় একবার বলেছিল সে এখনো চর্মচক্ষে সমুদ্র দেখেনি। মেয়েটি আদতে গাড়ওয়াল এর আদি বাসিন্দা। পাহাড়ের সঙ্গে সখ্যতা মেয়েটির জন্মসূত্রে। কিন্তু দিল্লি থেকে সমুদ্রের দূরত্ব আর বঙ্গভাষী মানুষদের মত জন্মসূত্রে পায়ের তলায় সর্ষে না থাকার দরুণ জীবনের সিকি শতাব্দী পার হয়ে এসেও ভারতবর্ষের নিচের তিন দিকের তিন প্রহরীর সাথে তার আলাপ করাটা আর হয়ে ওঠেনি। তো এই মেয়েটির পরবর্তী শততম উত্তরপুরুষ কি দিল্লির মতন জায়গায় বসে কোনো একজন বঙ্গভাষী (আমি নিশ্চিত তখনও বাংলা ভাষা লোপ পেয়ে বা পরিবর্তিত হতে হতে সম্পূর্ণ অন্য এক ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে না) মানুষকে অবাক হয়ে বলবে 'সেকি! তুমি এখনো সমুদ্র দেখনি? আমরা তো যেকোনো ছুটিতেই কোনো একটা সমুদ্রতটে চলে যাই।' আর তার উত্তরে সেই বঙ্গদেশের পাহাড়ি জায়গা থেকে গাড়ওয়াল প্রদেশের সমতলে কাজ করতে আসা বাঙালি উত্তরপুরুষ কি বলে উঠবে 'আসলে দুচারদিনের ছুটিতে কি করেই বা আর সমুদ্রে আসা যায় বলো? এতটা দূরত্ব। এবার দেখে নেব।' কিংবা কে জানে প্রকৃতিদেবীর সংসারের এইসব টালমাটালে তোমার দল-আমার দল, তোমার ধর্ম-আমার ধর্ম, নিয়ে নিরন্তর বিব্রত হয়ে থাকা ভারতবর্ষ বলে যে একটি ত্রিভুজাকৃতি ভূখন্ড আছে সেটিরই অস্তিত্ব বিলোপ ঘটবে কিনা।

যাক গে, কি যেন বলছিলাম? হ্যাঁ আমরা হিমালয়ে যাচ্ছিলাম। শনি-রবির সাথে ছাব্বিশে জানুয়ারির ছুটিটা যোগ করতেই সুন্দর তিনদিনের মুক্তাঙ্গন তৈরি হয়ে গেল মনের মধ্যে। এবারে ঠিক করেছিলাম ওরকম "যাবি?" "চল তাহলে" বলে একবেলার মধ্যে প্ল্যান করে শেষ মুহুর্তে ব্যাগ প্যাক করে বেরোব না। তার একটা বিশেষ কারণও অবশ্য ছিল। কারণটা হলো, অনেক দিন ধরেই প্ল্যান হচ্ছিল যে যেহেতু আমাদের বেশিরভাগ বেড়ানোই ওরকম শেষ মুহুর্তে ব্যাগ গুছিয়ে বেরোনো, তাই নানান টুকিটাকি জিনিস নিয়ে দুটি ব্যাগ প্যাক করেই রেখে দেব। সেই মর্মে দুটি ব্যাকপ্যাক, তাদের একটির মধ্যে একটি বেশ কয়েকটি খোপ-খাপ যুক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ছোটো ব্যাগ ইত্যাদি গুছিয়ে রাখা ছিল। আর তার সাথে যুক্ত ছিল দুটি স্লিপিং ব্যাগ। আমাদের বেড়াতে যাবার লটবহরের নবতম সংযোজন এই স্লিপিং ব্যাগ দুটি কেনার একটি ইতিহাস আছে। সেটিও বেশ গুছিয়ে "আমাদের স্লিপিং ব্যাগ কেনার কারণ " এই নামে একটি পৃথক ব্লগপোস্ট হবার দাবি রাখে। তাই এবারের হিমালয় ভ্রমণের গল্পের মাঝে দুলাইনে সে ইতিহাসকে বর্ণনা করলে পুরো ঘটনার প্রতি সুবিচার করা হয় না। তাই খুব তাড়াতাড়িই "আমাদের স্লিপিং ব্যাগ কেনার কারণ " আলাদা করে বর্ণনা করব। আপাতত এটা জেনে রাখুন যে সেই স্লিপিং ব্যাগ আসা ইস্তক তার ভেতরে ঢুকে শীতকাল শেষ হবার আগেই স্লীপার ক্লাসে করে কোনো একরাতের একটি ট্রেন জার্নির জন্যে আমরা মুখিয়ে ছিলাম। সুতরাং নতুন ব্যাকপ্যাক, তার ভেতরে স্লিপিং ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে মনে মনে ভ্রমণ শুরু হয়ে গেছিলো প্রায় সপ্তাহ দু-এক আগে থেকেই। তারপর যখন গন্তব্য স্থির হলো তখন যথারীতি দেখা গেল আমরা ছাড়া বাকি লোকজন অনেক আগে ভেবে সমস্ত ট্রেনের টিকিট শেষ করে রেখেছে। এতে অবশ্য আমরা একতিলও ঘাবড়ালাম না। কারণ এটাই আমাদের স্বাভাবিক ঘটনা বেড়াতে যাবার ক্ষেত্রে। কারণ আমরা বেড়াতে যাবার ক্ষেত্রে সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে তারপর গন্তব্য ঠিক করি। সমস্ত কিছু গুছিয়ে যেদিন বিকেলে বেরোব সেদিন সকালে ভ্রমণ পত্রিকা বা ইন্টারনেট দেখে কোথায় যাওয়া যায় সেটা ভেবে মাথার চুল ছিড়ছি এ ঘটনাও ঘটেছে। সুতরাং "কোনো চিন্তা নেই, তৎকাল কোটায় দেখব" বলে ব্যাগ গোছাতে থাকলাম 'ফাগু'-র উদ্দেশে। ফাগু হলো হিমাচলের রানী শিমলা থেকে নারকান্ডা যাবার রাস্তায় চব্বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে পর্যটক কোলাহলবিহীন একটি শান্ত পাহাড়ী হিমাচলী গ্রাম। আমাদের এবারের গন্তব্য।

এই পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন সাপ্তাহান্তিক একটি সাধারণ ভ্রমণ কাহিনীর নাম 'সার্কাস' কেন? এ তো 'শিমলা-ফাগু' নাম দিয়েই লেখা যেত। বিশ্বাস করুন এই নামে লিখবার ইচ্ছে আমারও ছিল তাই তৎকাল-এ কালকা মেল এ টিকিট পেয়ে যেতেই ভাবলাম এত দারুন ব্যাপার! আমাদের দিল্লি থেকে কালকা যাবার ট্রেন, কালকা থেকে শিমলা যাবার টয়ট্রেন এর টিকিট কনফার্মড, ফাগু তে থাকার জায়গায় অ্যাডভান্স বুকিং কমপ্লিট, ফেরার ট্রেন এর টিকিট কনফার্মড। এত নিরাপদ এত গোছানো ভ্রমণ তো হয়না সচরাচর। কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই, নিশ্চিন্ত হয়ে "মন উড়েছে, উড়ুক না রে, মেলে দিয়ে গানের পাখনা"-বলে শুধু ঘুরে বেড়াও। ফিরে এসে জমিয়ে বেড়ানোর গল্প করব বলে তেইশ তারিখ সকালে বেড়ানোর গল্পের অনুসঙ্গ হিসেবে আমার প্রথম ভ্রমনের গল্প শুনিয়েছিলাম আপনাদের। বেড়ানো তো শুরু হয় ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে বাড়ি থেকে বাইরে প্রথম কদমটুকু নেওয়া হলেই।তখনও জানতাম না বাড়ি থেকে ফাগুতে পৌঁছানোর আগেই আমাদের কি দুর্দান্ত একটি অভিজ্ঞতা হতে চলেছে যাকে ভ্রমণ না বলে সার্কাস বলাই ভালো। আর সেই সার্কাসের দর্শক না হয়ে কুশীলব হতে চলেছি আমরা। সবটুকু শুনলে আপনারাও একে ভ্রমণ না বলে 'সার্কাস' ই বলবেন আমার বিশ্বাস। সুতরাং আমার এই কাহিনীর নাম 'সার্কাস' রাখাই সাব্যস্ত করলাম।

আমরা তেইশে জানুয়ারী বিকেল বেলায় দুটো ঢাউস ব্যাকপ্যাক নিয়ে ইনস্টিটিউট এর বাসে চেপে বসলাম। ব্যগদুটির পেটের মধ্যে শুয়ে আছে লাল রঙের স্লিপিং ব্যাগরূপি আমাদের দুটি মন। এই ভ্রমণে ফাগু দেখার লোভ আমাদের যতটা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে ঘুমোনোর উত্তেজনাও তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সুতরাং দুজনেরই মনের অবস্থা এই যে, ফাগু তো কাল দুপুরের আগে পৌঁছাতে পারছি না সুতরাং কখন কালকা মেলে উঠে স্লিপিং ব্যাগ এ ঢুকব এই চিন্তাতেই পা দুটো নেচে নেচে উঠছিল থেকে থেকেই। বাস কিন্তু টইটম্বুর। ছোটো-বড়-মাঝারি নানান রকম ছাঁদের ব্যাগে। দল কে দল লোক হোস্টেল ছেড়ে পাহাড়ে চলেছে। কোনো দল চলেছে বৈষ্ণোদেবী দর্শনে পূণ্য আর কাটরার পাহাড়ের সৌন্দর্য্যের লোভে, কোনো দল চলেছে উত্তরাখন্ডের কোনো পাহাড়ে, কেউবা আমাদের এই দুজনের দলের মত হিমাচলের পাহাড়ে। কেউ বা আবার স্রেফ ছুটি পেয়ে হোস্টেল এর লাউকি বা টিন্ডা-র ঘ্যাঁট এর মায়া ত্যাগ করে বাড়িতে ভালো মন্দ খেতে। মোদ্দাকথা বাসে তিল ধারণের জায়গা নেই। আমাদের ব্যাগ দুটো কোনক্রমে শেষ সিটে ডাঁই করে সিটে গুছিয়ে বসেই ঘড়িতে দেখি সাড়ে পাঁচ। কি ব্যাপার! সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেছে বাস ছাড়ছেনা কেন? সকলেই উসখুস করছে। শেষে প্রায় পাঁচটা চল্লিশ নাগাদ একটি মেয়ে ছোটো-ছোটো তিন চারটি ব্যাগ নিয়ে হেলতে দুলতে একপিঠ সদ্য শ্যাম্পু করা চুপচুপে ভিজে চুল নিয়ে বাসে এসে উঠলো। এই শ্যাম্পু করতে গিয়েই একবাস লোককে বোধহয় দশ মিনিট অপেক্ষা করাতে হলো বেচারাকে। মনে হলো একবার জিজ্ঞাসা করি "বাছার গন্তব্যস্থলের তাপমাত্রা বোধকরি বর্তমানে শুন্যাঙ্কের নিচে। তাই পরের তিনদিন স্নানটাই হয়ে উঠবে কিনা তার কোনো স্থিরতা নেই বলেই এই একবাস যাত্রীদের বসিয়ে রেখে শেষ মুহুর্তের চুল ধোওয়ার কাজটি না করলেই চলছিল না? " বাসের লোকজন হইহই করতে করতেই বাস স্টার্ট নিলো। মেন গেট থেকে বাইরে এসেছে কি আসেনি সদ্যস্নাতা গজগামিনী আরো একটি বোমা ফাটালেন। তাঁর বন্ধু আসছেন। আমাদের আরো একটু অপেক্ষা করতে হবে। ভাবলাম "স্বাভাবিক। একটাই তো বাথরুম। ঘরে দুজন মেয়ে। একজন স্নান সারলে তবে তো অন্যজন সারবে। বন্ধু ভালো করে শ্যাম্পু-ট্যাম্পু দিয়ে স্নান না সেরে কি করে আসে।" নিশ্চিন্তে হেলান দিয়ে বসলাম। কালকা মেলের তো অনেক দেরী। আহা বেচারা স্নান সারছে সারুক। বাস শুদ্ধু লোকজন ভুরু কোঁচকাচ্ছে, উশখুশ করছে। গজগামিনীর কোনো হেলদোল নেই। ফোন করে বন্ধুকে তাড়াটুকুও দিছে না। ফোনে নেটওয়ার্ক, চার্জ, ব্যালেন্স বা ফোন করার ইচ্ছে কোনো কিছু একটা ছিলনা বোধহয়। আহারে বেচারা। যাক গে। বন্ধুটিও দেখলাম 'তাড়াহুড়ো করা শয়তানের কাজ' এই মতে বিশ্বাসী। অত্যন্ত ধীরে সুস্থে কানে ফোন নিয়ে হেলেদুলে এলেন। এঁনার দেরী শ্যাম্পু করতে গিয়ে কিনা বুঝতে পারলাম না। চুল ভিজে তো নয়ই বরং বেশ ফুরফুরে। শ্যাম্পুর পরে ড্রায়ারও চালাতে হয়েছে বোধহয়। দেরী তো হবেই। বাসশুদ্ধু সবাই প্রায় দেরী দেখে হই হই করছে। আর এই দুজনের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই দেখলাম। ভালো কিন্তু একদিক থেকে। যতই গালাগাল দাও না কেন আমি শুনলে তবে তো।

বাস ছাড়ল তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় পাঁচটা পঞ্চাশ। এই যে কুড়ি মিনিটের দেরী সেটা আমাদের ফাগু আর স্লিপিং ব্যাগে বুঁদ হয়ে থাকা মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেনি তখন। এখন বুঝতে পারি এটিই ছিল পরবর্তী পনেরো ঘন্টায় ঘটা পুরো সার্কাসটার একটি অতি নগন্য পূর্বাভাস। বাস এগিয়ে চলল গুরগাঁও এর দিকে। দুই বাড়িতে সামনের দু-তিন দিনে লাগতে পারে এমন সম্ভব্য সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নিয়েছি এই সংবাদ বিশ্বাসযোগ্য ভাবে নিবেদন করার পর নিশ্চিন্তে পা ছড়িয়ে বাসের জানালা দিয়ে সন্ধ্যে নামা দেখতে দেখতে চললাম গুরগাঁও। মেট্রো স্টেশন এ নামার ঠিক এক মিনিট আগে সকলে যখন তৈরী হচ্ছে নামবে বলে তখন আমার মাথায় এটম বোমাটা ফাটলো। হঠাৎই মনে হলো আচ্ছা কালকা মেল কতটা দেরী করতে পারে? একবার রানিং স্টেটাস চেক করা যাক। সে বিষয়টি দেখার আগেই মনে পড়ল দিল্লির চারপাশে আর উত্তরপ্রদেশে প্রচন্ড কুয়াশার দরুন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা সমস্ত ট্রেনই তো অসভ্যের মত দেরী করে দিল্লি স্টেশন এ ঢুকছে আজকাল। ঢোঁক গিলে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত গলায় বললাম "একবার কালকা মেলের রানিং স্টেটাস চেক করতো" নিজে দেখার আর উৎসাহ ছিল না। পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিটি দেখলাম ব্যাপারটা দেখে শুনে থম মেরে বসে আছে। ইষৎ হাঁ করা মুখ। যা বোঝার বুঝে গেলাম। বললাম, "কতক্ষণ? বারো ঘন্টা?" অল্প মাথা নেড়ে বলল "দশ"। 'দশ' শব্দটা পিনাকীর মুখে কেমন যেন 'ধ্বস' কথাটার মতন শোনালো। সকলে ততক্ষণে ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে নামতে শুরু করেছে। মেট্রো স্টেশন এসে গেছে। আমরা দুজন স্থবিরের মত শূন্য দৃষ্টি মেলে দুটো সিটে বসে আছি। কেউ একজন নামার সময় বলল, "কি নামবে না?" মুখটা হাসি হাসি করার চেষ্টা করলাম, কেমন কেন মুখ ভেটকানোর মতন একটা প্রতিক্রিয়া বেরোলো। সেই দেখে প্রশ্নকর্তা আমাদের আর না ঘাঁটিয়ে নেমে গেলেন।  আর আমরা সকলের শেষে দুটো ব্যাগ ঘাড়ে আসতে আসতে নেমে মেট্রো স্টেশন এর সামনে দাঁড়ালাম। এইখান থেকেই আমাদের যাত্রা থুড়ি 'সার্কাস' শুরু হলো।


(চলবে)

পরবর্তী অংশ সার্কাস-২
             

Wednesday, 11 February 2015

নামাবলী

আবার নাম বিভ্রাট। হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছিনা।  এর আগে নাম নিয়ে কি ঝামেলায় পড়েছিলাম সেটা তো বিশদে বলেছিলাম আপনাদের। আগেরবারভেবেছিলাম পোস্টটার নাম দেব 'নামাবলী' বা 'নামসংকীর্তন', আবার এই নাম বিভ্রাটে সেই পুরনো নামখানা আর না দিয়ে পারলাম না। জ্যেষ্ঠতাত প্রদত্ত সুন্দর একটি নাম থাকতে দিনের পর দিন ক্রমাগত একদল লোক যদি আপনাকে 'পিঙ্কি-পিঙ্কি ' বলে থাকে এবং শুধু তাই নয় নাম বিভ্রাটে আপনার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিষ আপনি হাতে পাচ্ছেন না, এমতাবস্থায় মাথা গরম হয় কি না বলুন? 'পিনাকী' নামটির উত্পত্তি তো আমি যদ্দুর বুঝি 'পিণাক' থেকে অর্থাত কিনা 'পিণাক হস্তে যাহার'। কোন সমাস ভুলে গেছি। মোদ্দা কথা 'পিনাকী' শব্দটির অর্থ মহাদেব, শিবঠাকুর। যিনি নাকি সর্বাংশেই দৃপ্ত পৌরুষের প্রতীক। তাঁর সমনামধারী কোনো মানুষকে নিঃসন্দেহে  কি করে একজন মহিলা হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে আমার তো মাথায় ঢোকে না। নাকি 'ই-কার ' অন্ত শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ অনুসঙ্গের জন্যই শুধুমাত্র এই ভুল? হিন্দিভাষী বলয়ে পুরুষদের মধ্যে 'পিনাকী' নামটি প্রচলিত নয় একেবারেই। তুলনায় মহিলাদের মধ্যে 'পিঙ্কি' নামটি বহুল প্রচলিত। ফলে প্রথম থেকেই বেচারা পিনাকীকে তার পিতৃদত্ত নামটির মাঝখান থেকে একটি 'আ কার' মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। অনেকের কাছেই 'শ্রী পিনাকী মন্ডল' 'শ্রীমতী পিঙ্কি মোন্ডাল' হয়ে বিড়ম্বিত হচ্ছিলেন। আর পিনাকীর অবসম্ভাবী মহিলা অনুসঙ্গ যেহেতু আমি, সেহেতু ইনস্টিটিউট এর সিকিউরিটি গার্ড, অনলাইনে কেনা জিনিষপত্র ডেলিভারি দিতে আসা মানুষেরা সকলের কাছেই আমিই হয়ে উঠলাম শ্রীমতী পিঙ্কি মোন্ডাল। কারণ পিঙ্কি তো মহিলাদের নাম। প্রচন্ড কনফিডেন্সের সঙ্গে আমায় লোকে অর্পিতার জায়গায় পিঙ্কি বলে ভুল করতে থাকলো আর আমিও কখনো হেসে, কখনো রেগে সে ডাকে সাড়া দিতে থাকলাম। তার বেশ কিছু ঘটনার কথা তো আপনাদের জানা। ব্যাপারটা আমাদের কাছে বেশ একটা মজার ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন এই বিভ্রাটে সত্যি সত্যি কিছু ঝামেলার উত্পত্তি হয়। সেরকমই একটি ঘটনার কথা বলি। 

গত তেইশ থেকে ছাব্বিশে জানুয়ারির সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে লেন্স জুম্ করা অবস্থায় নিজের কম্প্যাক্ট ক্যামেরার ব্যাটারিটি আমি খুইয়েছিলাম। কি করে এই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনাটি আমি ঘটালাম তার ব্যাখ্যা আমি পরে দেবখন। আপাতত আমার সাধের ক্যামেরা ব্যাটারির অভাবে "ব্যাদড়া বালক" এর মতন মুখ ছুঁচালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো ভাবেই তার হাঁ করা মুখ আমি লেন্স কভার এর আবরণে ঢাকতে পারলাম না। শেষে ধুত্তেরি বলে সেই অচল সরু মুখী ক্যামেরার লেন্স টিসু পেপার দিয়ে মুড়ে কোনক্রমে আর্দ্রতা আর ধুলো ময়লা থেকে বাঁচাবার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে হাঁ করা ক্যামেরা বগলদাবা করে বেজার মুখে বাকি বেড়ানো সম্পূর্ণ করে ফিরে এলাম। আর ফিরে এসেই আমার প্রথম কাজ ছিল ক্যামেরার ব্যাটারি অর্ডার করা। অনলাইনে সে অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি "পয়সা কড়ি আগে থেকে না দিলে কিন্তু দিতে পারব না বাপু" নোটিশ সাঁটা। আমিও সাথে সাথে "হ্যাঁ বাবা, এই নাও বাবা, আমার ব্যাটারিটা কিন্তু যত শীঘ্র সম্ভব দিয়ে দিও বাবা। ব্যাটারির অভাবে আমার সাধের ক্যামেরা হাঁ করা মুখ বন্ধ পর্যন্ত করতে পারছে না বাবা- একটু তাড়াতাড়ি দিও বাবা " ইত্যাদি করে ঝটপট অর্ডার করে ফেললাম। তারপর হা ব্যাটারি, যো ব্যাটারি। কদিন পরে অনলাইন ট্র্যাকিং এ 'ডেলিভারড' কথাটা দেখেই লাফ দিয়ে উঠে সোজা নিচে রিসেপশনে সিকিউরিটি গার্ড এর কাছে। তার কাছেই দিয়ে যায় সব জিনিস। নেহাত 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' তকমা না থাকলে আমাদের নিচে তলব পড়ে না। যে যার সময় মতন নিজের নিজের প্যাকেট সংগ্রহ করে নেয়। অর্ডারটা দেওয়া হয়েছিল পিনাকীর নামে। পিনাকীকে দেখিয়ে বললাম এর নামে কোনো প্যাকেট আছে? সিকিউরিটি গার্ড মুখ বেঁকিয়ে, মাথা নেড়ে বলল না কোনো প্যাকেট নেই। যা বাবা! হলো টা কি?  তারপর পরপর তিন চার দিন একই খবর। প্যাকেট আসেনি। এদিকে ট্র্যাকিং বলছে আইটেম ডেলিভারড। এদিকে আমার হাঁ করা ক্যামেরার লেন্স এ তিনজায়গায় ছত্রাক ফুল ফুটিয়ে ফেলল আমার ব্যাটারির দেখা নেই। রেগেমেগে বিক্রেতাকে এক গ্যালন কটুকাটব্য করব বলে ফোন করতে যাব, হটাত মনে হলো এ সেই পুরনো নাম বিভ্রাটের কেস নয় তো? নিচে গিয়ে বাচ্চা গার্ডটিকে বললাম ভাই একটু ভালো করে দেখনা তোমার ভান্ডারে আমাদের নাম কোনো প্যাকেট আছে কিনা। বড়ই জরুরি প্যাকেট আমার। বলল কি নামে আছে? বললাম "পিনাকী", তার দেরাজ হাঁটকে যথারীতি বেরোলো 'পিঙ্কি মোন্ডাল' এর প্যাকেট। তিন দিন আগে দিয়ে গেছে সেই প্যাকেট। আমি পিনাকী কে দেখিয়ে বলেছিলাম এর নাম কোনো প্যাকেট আছে কিনা। ফলে গার্ড কোনো পুরুষালী নাম খুঁজতে গিয়ে 'পিঙ্কি মোন্ডাল' কে নস্যাৎ করে দিয়েছে। প্যাকেটের গায়ে জ্বলজ্বল করছে 'পি-না-কী" কথাটা। মাঝের একটি 'A' কে অনাবশ্যক ভেবে আর ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি হিন্দিভাষী গার্ড ছেলেটি। ফলে নামটি হয়ে পড়েছে 'পিঙ্কি', আর সেটি তো কোনো ছেলের নাম হতে পারে না। সুতরাং পিনাকীর কোনো প্যাকেট আসেনি এই তিনদিন ধরে। আর আমার ক্যামেরার হাঁ মুখ ও বন্ধ হয়নি। 

এই পর্যন্ত শুনেই পিনাকী রিসেপশন কাউন্টার এর পেছন দিকে চলে গেল। এরপর আমি যতক্ষণ ধরে হাত পা নেড়ে, প্যাকেটে লেখা বানান দেখিয়ে দেখিয়ে গার্ডটিকে 'পিনাকী ' আর 'পিঙ্কি' র তফাৎ বোঝাচ্ছিলাম, আর আমার নাম 'পিঙ্কি' নয় 'অর্পিতা', পিনাকীর নামও 'পিঙ্কি' নয় 'পিনাকী' যেটি বঙ্গ অভিধান মতে একটি পুরুষের নামই হওয়া সম্ভব, 'পিঙ্কি'-র সাথে আমাদের দুজনের নামের কোনো সম্পর্ক নেই-কোনদিন ছিলও না, এরপর কোনো প্যাকেট ডেলিভারি দিতে যেন এই ভুলটা না করে-এইসব বোঝাচ্ছিলাম আর রিসেপশনের মহিলা আমার মতন ম্যাদামারা ব্যক্তিত্বের হটাত এই উত্তেজিতার কারণ মগজস্থ করতে না পেরে আমার আর হাত পা নাড়া আর গার্ড এর মাথা নাড়ার দিকে ক্রমান্বয়ে গোলগোল চোখ করে দেখে গেলেন। আর এই পুরো সময়টা ধরে যার নাম নিয়ে এত সমস্যা তিনি রিসেপশন কাউন্টারের পেছনে অটোমেটিক বুট পালিশ মেশিনের সামনে পা বাড়িয়ে জুতোর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে খ্যাক-খ্যাক করে হেসে গেলেন। সাধে কি বলে 'যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর'।         

Monday, 2 February 2015

একটি অপার্থিব সন্ধ্যা



একটি বিষন্ন সন্ধ্যা কেমন করে তার একটি একটি মোড়ক খুলে হয়ে উঠতে পারে নতুনের প্রেরণা তার সাক্ষী রইলো আজকের শেষ শীতের শিরশিরে বাতাস, তন্বী বাবলা গাছের ঘন সবুজ জঙ্গলের পেছনে ডুবতে থাকা অনেকদূরের কিন্তু বড় আপনার আগুনরঙা একটি অগ্নিগোলক, আর মন শান্ত করা কিছু সুর। 

শীতের হিমেল হওয়ার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সমস্ত সবুজেরা। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি শুয়েছিল মৃত সবুজের দল। এখন অবশ্য তাদের আর সবুজ বলে চেনার উপায় নেই। সবাই ধূসরের এক একটি রকমফের। কম ধূসর-বেশি ধূসর, কম শুকনো-বেশি শুকনো, কম মৃত-বেশি মৃত। মৃতের কি কম-বেশি হয়? জানিনা। মৃত শরীর আর মৃত চেতনা দুটির মধ্যে পার্থক্য কি? দুটি তো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল নয়? শারীরিক মৃত্যু আর চেতনার মৃত্যু দুটি আলাদা-আলাদা ভাবে ঘটা সম্ভব? নাকি চেতনা বা বোধ বা অন্তরাত্মার মৃত্যু অসম্ভব একটি ঘটনা? আজন্মের প্রাচ্য দার্শনিকতার সঙ্গে সঙ্গে নবতম বিজ্ঞানও কি সেকথাই বলবার দিকে এগোচ্ছে না? কেজানে? 

শুকনো ঝরে পড়া মৃত পাতাগুলি রাস্তার ওপর রচনা করেছিল একটি আস্তরণ। দুই জোড়া শ্রান্ত-বিধ্বস্ত পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল তাদের অতীত অস্তিত্ব। শীতল দমকা হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে তাদের জড়ো করছিল রাস্তার দুইপাশে। জীবনকে চলার পথ করে দিতে মৃত্যুকে তো ধীরে ধীরে সরে যেতেই হয় মাঝরাস্তা থেকে। ক্রমশঃ কমতে থাকা আলোয় সভ্যতার পরিধির ঠিক বাইরে সভ্যতার দিক থেকে ক্ষনিকের জন্য মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বেঁচে উঠতে চাইছিলাম আদিমতার দিকে তাকিয়ে। মোবাইল ফোনে বাজছিল বেঁচে ওঠার সুর। সে সুর শুনতে শুনতে দেখতে পাচ্ছিলাম কেমন করে ঝরে পড়ে একটি একটি মৃত পাতা। কেমন যেন স্প্রিং এর মতন পাক খেতে খেতে অদ্ভূত সুন্দর গতিতে নেমে আসছিল নিচের দিকে। সুরের সাথে তাল মিলিয়ে। মিশে যাচ্ছিল নিচে জমে থাকা অগুন্তি মৃত পাতার ভীড়ে। জীবনের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে ঘটতে থাকা এক একটি মৃত্যুর মত। 

জীবনের সাথে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা, একটি মৃত্যু। অথচ কি অদ্ভূতভাবে হয়ে ওঠে সবচেয়ে অনভিপ্রেত, সবচেয়ে দুর্দমনীয় ঘটনা, কেমন করেই বা সেই দুর্দমনীয় সুনামির ঢেউ-এর তোড়ে নাড়িয়ে দিয়ে যায় জীবনের গভীরতম মূলকেও সেটিই বুঝি সবচেয়ে আশ্চর্যের। বকরূপী ধর্ম আর যুধিষ্ঠিরের গল্প দিয়ে সেই মহাভারতের সময় থেকেই এই আশ্চর্যের সাথে শুধুমাত্র আহার-নিদ্রা-মৈথুন বৃত্তে আজন্ম আবর্তিত অচেতন মনুষ্যকুলকে চৈতন্য প্রদানের চেষ্টা করে চলেছেন মহাভারতের আখ্যানকার। অথচ আমরা সেই বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে কলুর বলদের মতন ভাবছি বুঝি এইতো এগোলাম। আসলে কলু নামক সময়ের বেঁধে দেওয়া দড়ি গলায় পরে মহানন্দে জীবন বৃত্তে ঘুরেই চলেছি, ঘুরেই চলেছি-আজন্ম-আমৃত্যু। সবাই জানি। কিন্তু মানি না। তাই হয়ত মৃত্যু এত আকস্মিক, এত অনভিপ্রেত, এত বেদনার।

চারপাশের শুকনো পাতাওয়ালা গাছগুলো দেখে মনে হলো পুরনো পাতা খসিয়ে সময় হয়েছে এদের নতুন পাতায় সেজে নেবার। আর কয়েকদিন পরেই কচি সবুজ পাতায় ঝলমলিয়ে উঠবে এরা। পুরনো শরীর ত্যাগ করে নতুন ভাবে জন্ম নেওয়া চিরন্তন আত্মার মতন। ভাবলাম এখনই কেন নয়? দেই ঝরিয়ে সব মরে যাওয়া পাতা। বেঁচে উঠুক নতুন করে। সবুজ হয়ে উঠুক চারপাশটা এখনি। ছোটোমত একটা গাছের ডাল ধরে ঝাঁকালাম খুব। দুচারটে পাতা ঝরলেও বেশিরভাগই রয়ে গেল নিজের নিজের জায়গায়। ঠিকই তো, আমার ক্ষমতা কোথায় প্রকৃতির নিয়মকে একচুল নাড়াবার। মহাকালের ইচ্ছাই তো প্রকৃতির নিয়ম। আমার এই হাতে অত জোর নেই ধূসর হয়ে যাওয়া, নব্বই ভাগ মৃত একটি পাতাকেও খসিয়ে দেবার। হাসি পেল নিজের কাজে। আর তারপরেই আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আস্তে থাকলো চরাচর।

পাশে বাজতে থাকা বেঁচে থাকার সুর থেকে প্রাণরস শুষে নিতে নিতে আস্তে আস্তে বেঁচে উঠছিলাম যখন, অবিশ্বাস্য ভাবে তখনই আমার থেকে মস্তিস্কের বিবর্তনের প্রশ্নে লক্ষগুণ পেছনে পড়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট কালো-হলদে পাখিগুলো একসাথে গেয়ে উঠলো জীবনের সুর। আর ঠিক তখনই হলদে আলো ছড়াতে ছড়াতে শেষে আজকের মতন ছুটি নিলেন সূর্য্যদেব। কাল আবার নতুন করে আসবেন বলে। জঙ্গলের অজস্র ছোট্ট ছোট্ট পাখি, এমনকি মৃত পাতাগুলি পর্যন্ত হাসতে হাসতে বিদায় দিল তাঁকে। অবাক হয়ে দেখলাম কখন যেন সোজা হয়ে গেছে কপালের মৃদু ভাঁজ। সুস্থ হয়েছে শ্বাস, শান্ত হয়েছে মন। কালকের জীবনের জন্য আজকে বুকের কোণে এসেছে সম্পৃক্ততা। মনজুড়ে তখন কেবল কৃতজ্ঞতা আর প্রণতি এই অপার্থিব সন্ধ্যার কাছে।