সর্বহারার মত কিছুক্ষণ মেট্রো স্টেশন এর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার পর কিরকম যেন ঘোর লেগে গেল। দুজনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতেই দেখলাম পাশের লম্বা লাইনটি এঁকে বেঁকে বাড়তে বাড়তে স্টেশন এর বাইরে চলে গেছে। কিসের লাইন কে জানে? পার্থিব বিষয়ে জ্ঞান আস্তে আস্তে ফিরে আসছিল আমাদের। "কিসের লাইন এত বড় বলত?"-র উত্তরে ডেইলি টিকিট কাটার লাইনের কথাই মনে এসেছিল। তাই বললাম, "টিকিট কাটার লাইন হবে, আমরা সোজা ঢুকে যাই চল।" ব্যাগ নিয়ে পায়ে পায়ে এগোতে এগোতেই ভুল ভাঙ্গলো। "ওরে না রে! এ তো স্টেশনে ঢুকবার লাইন। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!" এই এতো লোক ছুটি বলে লটবহর নিয়ে বেরিয়েছে? কেন? এত লোকের বাইরে বেরোবার দরকারটা যে কি বুঝিনা। আমি নিশ্চিত আমাদেরকে দেখেও বাকি লোকেরাও ঠিক একই কথা ভাবছিল। এতক্ষণে বুঝলাম আমরা যখন লাইনের পাশ দিয়ে গুটি গুটি অর্ধেক রাস্তা চলে আসছিলাম তখন কেন আমাদের সাথে বাস থেকে নেমে আমাদের চেনাশোনা বাকি লোকেরা পিছনে রয়ে গেল। 'হরিবোল' বলে আবার লাইনের মুড়ো থেকে ল্যাজার দিকে চলতে শুরু করলাম। অন্ততঃ খুব কম করে পাঁচশো লোকের লাইন। একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। সকলেই স্টেশনে ঢুকতে চায়। লাইনের লিঙ্গভেদে আমার দুর্ভোগ বেশ খানিকটা কম। জন কুড়ি পঁচিশ মহিলার জটলা আর পোঁটলা করে কি কি বিষ্ফোরক নিয়ে যাচ্ছি না যাচ্ছি সেসবের হিসেব নিকেশ পেরিয়ে স্টেশন এর ভেতরে গিয়ে পৌঁছালাম। পিনাকী ফোন করে বললে সে আপাতত লাইনের ল্যাজা খুঁজতে খুঁজতে স্টেশন চত্বর, সিঁড়ি-টিঁড়ি পেরিয়ে রাস্তার ফুটপাথে গিয়ে পৌঁছেছে। ততক্ষণে একটা বিষয়ে নতুন করে বোধদয় হয়েছে আমার। আমাদের দেশে কন্যা ভ্রূণহত্যা আর ধর্ষণের প্রধান কারণ যে মহিলা ও পুরুষের অত্যন্ত অসমানুপাতিক সংখ্যা, সেটির অত্যন্ত প্রকৃষ্ট উদাহরণ সেদিনের সেই লাইন। আমাদের দেশে মহিলা-পুরুষের অনুপাতটা যে ঠিক কি সেটা বোঝা গেল। প্রতি একজন মহিলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন পুরুষ। ফলে পুরুষদের লাইন এঁকে বেঁকে গিয়ে পৌঁছেছে মেট্রো স্টেশনের বাইরে।তারপর আজও দাঁড়িয়ে আছি কালও দাঁড়িয়ে আছি, সারা পৃথিবীর লোক বেরিয়ে যাচ্ছে পিনাকীর দেখা নেই। সিকিউরিটি চেক করা পুলিশের মুখ পরিবর্তন হয়ে গেল। কতরকমের ব্যাগ ব্যাগেজ পৃথিবীতে আছে x-ray মেসিনের দৌলতে আমার দেখা হয়ে গেল। ঠিকঠাক সময় লাইন দিয়ে আমার বাসের চেনা ছেলে মেয়েরা আমার দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল। আমিই শুধু ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষতে থাকলাম।
তারপর লক্ষ কোটি বছর পরে পিনাকী এসে পৌঁছালে মেট্রোতে গিয়ে উঠলাম। স্টেশন এর সমস্ত লোকজনও আমাদের সাথে সাথে ট্রেনে উঠলো। বোধহয় অপেক্ষা করছিল আমরা কোন কামরায় উঠি দেখার জন্য। দেখে টেখে সক্কলে মিলে যুক্তি করে আমাদের কামরাতেই পড়ি কি মরি করে উঠবে ঠিক করলো। বোধহয় ওটিই দিনের শেষ ট্রেন আর ওটিই শেষ কামরা। সকলের মুখেই বিশ্বজয়ীর তৃপ্তি এবং কারোরই দাঁড়ানোর জায়গা নেই। একটা ঘটনা বলি এখানে। ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আমি বাড়ি থেকে স্কুল যাতায়াত করতাম বাসে। সকাল দশটা দশের বাসে যাওয়া আর বিকেল চারটে দশের বাসে ফেরা। সেখানে বাস কন্ডাকটরদের মধ্যে একটি চালু কথা ছিল "একটু ঝাঁকিয়ে দাও গুরু।" মানেটা হলো এই, বাড়িতে মুড়ির টিনে মুড়ি ভরার কথা মনে করুন। পুরোটা ভরা হয়ে যাবার পরেও বেশ করে ঝাঁকালে আরো বেশ খানিকটা মুড়ি সেই টিনে ভরে ফেলা যায়। সেই সময় আমাদের গ্রাম থেকে স্টেশনে আসার একমাত্র উপায় ছিল প্রতি একঘন্টা অন্তর অন্তর একটি করে লড়ঝরে বাস। কাছে পিঠে ভালো স্কুল না থাকার দরুণ ওই দশটা দশের বাসে অন্তত চারটি পাঁচটি স্কুলের ছেলেমেয়েরা, উপরন্তু দুটি কলেজের দাদা দিদিরা এবং তার সাথে অন্যান্য নিত্যযাত্রীরা অত্যন্ত কষ্ট করেই প্রায় গরু ছাগলের মতন বোঝাই হয়ে যাতায়াত করত। ফলতঃ বাসটির প্রায় পেট ফাটবো ফাটবো উপক্রম হত। এমতাবস্থায় যদি রাস্তায় অপেক্ষমান আরো যাত্রী সেই বাসে উঠতে চাইতো তখনই বাস কন্ডাকটরদের ড্রাইভারের উদেশ্যে উপরোক্ত উক্তিটি করতে হত। সেই শুনে বাস ড্রাইভার প্রবল বিক্রমে বাসের ব্রেক কষতেন। আর আমরা যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে এর ওর ঘাড়ে পড়ে, নড়ে চড়ে বেশ করে ঝেঁকে যেতাম আর সশব্দে অথবা নিঃশব্দে ড্রাইভারকে গালাগালি শেষ করে দেখতাম রাস্তার যাত্রীর বাসে ওঠার মতন সুন্দর খানিকটা জায়গা তৈরী হয়ে গেছে দরজার সামনে। সেদিনে ট্রেনে উঠে একজন কন্ডাকটরের অভাব বড় বোধ করছিলাম। যে ড্রাইভারকে বলে ট্রেনটাকে খুব খানিকটা ঝাঁকিয়ে দিলে একটু পা ফেলার জায়গা নিয়ে দাঁড়াতে পারি। আস্তে আস্তে ঠেলেগুঁজে সাধের স্লিপিং ব্যাগওয়ালা দুটো ব্যাকপ্যাক নিয়ে একটু জায়গা কোনমতে হলো। স্লিপিং ব্যাগে ঘুমানোর সাধ তো এযাত্রা মাঠে মারা গেল বলেই মনে হলো।
এখন প্রশ্ন আমরা যাব কি ভাবে? কালকা মেল এর জন্যে অপেক্ষা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সে আসবে পরদিন সকাল দশটা নাগাদ। তার আশায় থাকলে পরের পুরো দিনটাই রাস্তায় কাটবে। অতএব কালকা মেল বাদ। এছাড়া কালকা যাবার কোনো ট্রেন এ টিকিট নেই। তাহলে বাস। এখানে প্রশ্ন হলো বাসে কদ্দুর যাব? শিমলা পর্যন্ত অনেক বাস আছে দিল্লি থেকে। কিন্তু একটি ছোট্ট অথচ গুরুতর সমস্যা আছে সে ব্যবস্থায়। সমতলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সে বাস যখনই সমতল ছেড়ে পাহাড়ি পাকদন্ডী পথে ঘুরতে শুরু করবে তখনই আমার সঙ্গীটির সমস্ত বীরত্বের অবসান হবে। বাসের সাথে সাথে তার পেটের ভেতরের সমস্ত কলকব্জা গোল হয়ে ঘুরতে থাকবে। সে বারে বারে জোয়ান খেতে থাকবে, কোল্ড ড্রিংক খেতে থাকবে, আরো নানা টোটকার পরে সে অবধারিত ভাবে গাড়ি থামাতে বলবে এবং শরীরের সমস্ত গন্ডগোল সুন্দর পরিস্কার পাহাড়ি পথের পাশে উদগীরণ করবে। একবার তো মিলিটারী ব্যারাকের সদর দরজার ঠিক সামনে কাজ সেরে মুখে মাথায় ঘাড়ে জল থাবড়ে স্মার্টলি গাড়িতে উঠে বসেছিল। আর আমি তার ঘাড়ে জল থাবড়াতে থাবড়াতে ভয়ে ভয়ে সেই সদর দরজার মিলিটারী বন্দুকধারী তাগড়াই প্রহরীর দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলছিলাম আর মুখে একটা অসহায় হাসি আনার চেষ্টা করছিলাম। যাত্রার অর্ধদন্ড পূর্বে এভোমিন সেবন, লেবু, জোয়ান, কোল্ড ড্রিংক কোনো কিছুতেই এই রুটিনের ব্যত্যয় হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে রক্ষে এই যে, অ্যাকশন ওই একবারই। ঘটনা একবার ঘটে যাবার পরে বাকি যাত্রায় পাহাড়ি পথে আর তেঁনাকে এই কারণে গাড়ি থামাতে হয়না।তাই এখন আমি ওই প্রথম বারের ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করি। হয়ে গেলে-যাক বাবা, আর টেনশন নেই বলে হাঁপ ছাড়ি। সুতরাং পুরো শিমলা পর্যন্ত বাসে করে গেলে পাহাড়ি রাস্তায় এঁনার একার জন্য গাড়িকে অন্তত একবার থামাতে হবে। উপরি পাওনা শারীরিক অস্বস্তি। তাহলে কি কালকা পর্যন্ত বাসের খোঁজ করব? সেখান থেকে সকাল ছটার টয়ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। ভেবেচিন্তে সেটিই ঠিক হলো আমরা কালকা পর্যন্ত বাসের খোঁজ করব। সেখান থেকে সকাল ছটার টয়ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করব। ক্রমে ক্রমে নিউ দিল্লি, চাঁদনী চক স্টেশনগুলো পেরিয়ে গেল। আমরা শেষ বারের মত দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কালকামেল আর স্লিপিং ব্যাগে ঘুমনোর মায়া ত্যাগ করলাম। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে আমাদের যে সে যাত্রা কত আবেগ ছিল তা তো
সার্কাস-১ পর্বে বলেছি। কারনটা নাহয় পরেই কোনো একদিন শুনবেনখন। কালকা মেলে নির্ঝনঝাট যাত্রার মায়ার থেকে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমনোর মায়া কোনো অংশে কম ছিল না সেদিন। যাই হোক কপালে ছিল না সে যাত্রা আর কি হবে। মসৃণ ভ্রমণ আজ অবধি কোনদিন আমাদের হয়নি সুতরাং সমস্ত টিকিট কনফার্মড আগে থেকে, হোটেল বুকিং হয়ে গেছে এত মসৃণতা যে বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাষ সেটা বোঝা উচিত ছিল আমাদের। যাই হোক। আপাতত সামনের দিকে চলাই ভালো।
কাশ্মিরি গেটে নেমে গুটি গুটি স্টেশনের বাইরে এলাম। বাস স্টেশনের দিকে হাঁটতে যাব দেখি বাস হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকে আসছে কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন করতে করতে। মানে বাসের দালাল। শিমলা-কালকা আমতা আমতা করতে না করতেই দেখি আমাদের দুজনকে বগলদাবা করে তিনি হাঁটা লাগিয়েছেন বাস স্টেশন এর সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। হাঁ হাঁ করে উঠতেই বললেন তাঁর প্রাইভেট বাস। ঐসব রোডওয়েজ বাসের মতন লড়ঝরে নয় রীতিমত ডিলাক্স। তাই সেটি স্টান্ডের বাইরে আছে, সেখানে তিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু ভালো মত বোঝার আগেই দেখলাম আমরা স্টেশন চত্বরের বাইরে পৌঁছে গেছি। ফ্লাইওভারের নিচে আবছা আলোয় আরো কয়েকজন লোকজনের সাথে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সাথে আমাদের পথপ্রদর্শক। আমাদের সামনে একটি পুঁচকে কাঠের টেবিল। টেবিলের ওদিকে চটপটে একটি ভুঁড়িদাস ছেলে। কোথায় যাবেন? বললাম কালকা।
--কালকা তো যাবে না বাস।
--অ্যাঁ !! বলে পথপ্রদর্শকের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাতেই তিনি বিনয়ের অবতার হয়ে বললেন "আপলোগ আম্বালা মে উতার যাইয়েগা। উঁহাসে কালকাকা বাস হরদম মিলতি হ্যায়।"
--তো পহেলে আপ কিঁউ নেহি বোলা?
এরকম বেশ কিছু চাপানউতোরের পর ভাবলাম যেরকম ভাগ্য চলছে তাতে যা পাচ্ছি সেটাই নিয়ে নেওয়া যাক। নইলে হয়তো কালও সারাদিন ব্যাগ ঘাড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে।
"বেশ যাবখন তোমাদের বাসে কিন্তু দেখো ভাই আম্বালা যেতে কতক্ষণ লাগবে? আর সেখান থেকে কালকাই বা কতদূর? মোদ্দাকথা সকাল ছটার ট্রেনটা পাবতো কালকা থেকে?"
প্রশ্ন শুনে দুজনে এমন ভাবে হই হই করে উঠলো যেন মনে হলো আমি জিজ্ঞাসা করেছি "বাপুহে নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে কুতুব মিনার যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে? আজ রাত্রি দশটায় শুরু করলে কাল সকাল ছটায় তোমাদের বাস আমায় সেখানে পৌঁছে দেবে তো?"
দিল্লি থেকে বাস রাত দশটায় ছেড়ে চার ঘন্টার মধ্যে নাকি আম্বালা পৌঁছাবে, সেখানথেকে একঘন্টা কালকা। সুতরাং ছটার অনেক আগেই আমরা কালকা পৌঁছাবো এরকম বিস্তর আশ্বাস টাশ্বাস দিয়ে আমাদের বাসে তুলে দিল। আমরাও খাবার দাবার কিনে সিটে গুছিয়ে বসতে না বসতেই দেখি আমাদের ইনস্টিটিউটের আরো তিনজন একগাল হাসতে হাসতে বাসে উঠছে।
-"আরে তোরা কোথায় যাবি?"
বলে জলন্ধরে নামবে, সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য ডালহৌসি-খাজিয়ার-চাম্বা।
তাদের বাসে দেখতে পেলাম না কেন জিজ্ঞাসা করতে বলল তারা জানত বাস রাত দশটার আগে ছাড়েনা তাই দেরী করে বেরিয়েছে। আর এই সময় কুয়াশার জন্য দিল্লির ট্রেনের ভরসা না করাই ভালো তাই তারা ট্রেনের কথা ভাবেই নি। সরাসরি বসে এসে উঠেছে। আমরাও 'ও আচ্ছা' টাচ্ছা বলে একবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম ভাবখানা এই যে, আমরা ভেবেছি এবং এই নাক মুলছি কান মুলছি আর কোনো দিন ভাববনা। বিশেষত শীতকালে।
যাই হোক রাত দশটায় ছেড়ে চার ঘন্টা মানে রাত দুটোয় আম্বালা পৌঁছাবার আশ্বাস শেষ পর্যন্ত মাত্র আড়াই ঘন্টা পরে ফলপ্রশূ হলো। ছাড়তে এক আর পৌঁছাতে আরো দেড়ঘন্টা দেরী করে ভোর সাড়ে চারটেয় আমাদের দুই ভ্রমনার্থীকে ধু ধু হাইওয়ের ধারে "এই তো সামনে এগোলেই ওই যে দেখা যাচ্ছে আলো ওটাই আম্বালা স্টেশন" বলে নামিয়ে দিয়ে বাস তো টাটা করে পগার পার। এদিকে আমরা হেঁইও বলে ব্যাকপ্যাকদুটো তুলে দূরের ফুটকি ফুটকি আলো লক্ষ্য করে সার্কাস শুরু করলাম। আমাদের হাতে দেড়ঘন্টা সময় এখান থেকে কালকা পৌঁছানোর জন্য। তার মধ্যে নাকি একঘন্টা অন্তত লাগবে রাস্তায়। তাহলে ঝটপট কিছু একটা পেতে হবে কালকা যাবার জন্য। ব্যাগ কাঁধে হাঁটছি তো হাঁটছি। রাস্তার বামদিকে চায়ের দোকান টোকান গুলো সবে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসছে। কুকুরগুলো রাতের ডিউটি সেরে কুন্ডলী পাকাবার চেষ্টা করতে করতে ভাবছে এখন ঘুমিয়ে পড়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? চা এর দোকানের বিস্কুট-টিস্কুট এর ব্যাপারগুলোর কথাও তো ভাবা উচিত। রাস্তার ডানদিকে সোজা একটি দানবীয় ফ্লাইওভার। যে দোকানেই জিজ্ঞাসা করি যে, "কালকা যাবার বাস কোথা থেকে পাব" সবাই সামনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে ওই তো সামনের মোড়ে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে আমার আরো একটি বোধদয় হলো। সেটা এই যে, এমনিতেই আমায় লোকে কিপ্টে বলে তা সে অন্য যেকোনো বিষয়ে বলুক না কেন, আমি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সময় আর কিপ্টেমি করবনা। দুটো ব্যাকপ্যাকের মধ্যে আমার নিজেরটা কেনার সময় ভেবেছিলাম পিনাকীর বড় ব্যাগটার মধ্যেই বেশিরভাগ জিনিস এঁটে যাবে আমারটা আর কতই বা ভারী হবে? সুতরাং ব্যাগের প্যাডিং-ট্যাডিং নিয়ে পিনাকী আমায় নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করলেও অনলাইনে ব্যাগের ছবির পাশে লেখা মূল্য বিজ্ঞাপক সংখ্যাটির দিকেই সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিলাম। সেটা যে কত বড় আহাম্মকি হয়েছে সেটা হাঁটতে হাঁটতে হাড়ে হাড়ে থুড়ি কাঁধে কাঁধে টের পাচ্ছিলাম।
শেষকালে কপালে জুটলো একটা ট্রেকার। যেটার পায়ে আমার বাড়ি যাবার ট্রেকারও দন্ডবৎ হবে। ওঠার সময় জিজ্ঞাসা করলাম "ভাই ছটার মধ্যে কালকা পৌছাবে কি?" নইলে যে চলতি বাস যাচ্ছে তাতেই উঠে যাব। ভিড় হোক না হয় দাঁড়িয়েই যাব। ড্রাইভার ভাই প্রবল কনফিডেন্সের সঙ্গে বলল, আরে দিদি উড়িয়ে নিয়ে যাব, এখন তো ভোরবেলা চল্লিশ মিনিটেই পৌছে দেব। কোনো চিন্তা করবেন না। বসলাম। এবং পরবর্তী ভুলটা করলাম। ফলে এই সার্কাসে আরো একটি রুদ্ধশ্বাস খেলা শুরু হলো। তার গাড়িতে লোক তোলা আর থামে না। চা খেয়ে, অন্য ড্রাইভারদের কুশল সংবাদ নিয়ে, গাড়ির পেট ঠেসে ভর্তি করে শেষ পর্যন্ত আমাদের ট্রেকার যখন ছাড়লো ঘড়িতে তখন পাঁচটা দশ।
আমি সবসময়ই আশাবাদী। মনে আশার উদয় হলো যদি আর কিছু ঘটনা না ঘটে তাহলে নিশ্চয়ই ছটার মধ্যে পৌঁছে যাব। স্কুলগামী অনিচ্ছুক বাচ্চার মতন ঢিমে তেতালায় গাড়ি চলতে লাগলো। স্পিড নিচ্ছেনা কেন জিজ্ঞাসা করতে উত্তর মিললো এত কুয়াশায় কি করে জোরে ছুটবে গাড়ি? মোক্ষম যুক্তি। কি আর করি? এর মধ্যে দেখি গাড়ি রাস্তা ছেড়ে বামদিকে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কি ব্যাপার? ভাড়া সংগ্রহ চলছে কারণ ট্রেকারে তেল নিতে হবে। আর ড্রাইভারের কাছে টাকা নেই। ততক্ষণে বুকভরা আশা ধুক ধুক করে নিভে আসছে। টাকা নিয়ে তেল ভরে আবার চলল গাড়ি। কিছুক্ষণ পর থেকেই যাত্রীরা নামতে শুরু করলো। শেষে যখন আমরা দুজন ছাড়া বাকি সকলেই নেমে গেল তখন দেখি গাড়ির ছাদ থেকে আমাদের ব্যাগ দুটো টেনে নামাচ্ছে হেল্পার। কি ব্যাপার? বলে নিচে রাখুন। ভাবলাম এখন তো গাড়ি ফাঁকা আর এসেও পড়েছি বোধহয় কাছাকাছি। তাই ব্যাগ নামিয়ে দিল। কিন্তু ঘটনা তা ছিল না। সামনের মোড়টা ঘুরতেই দেখি ভ্যাগ সমেত আমাদের দুজনকেও নামিয়ে দিলো রাস্তার মাঝে। কালকা এসে গেল নাকি?নেমে দেখি, এটা কোনো মতেই কালকা নয়, আমি কালকা গেছি আগে। কি হলো? বলে এই দুজনের জন্যে আর আমরা যাব না। আমরা গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি আপনাদের। বলে পথ চলতি একটা অটোকে দাঁড় করিয়ে ব্যাগ সমেত ঠেসেগুঁজে আমাদের অটোর পেটে ঢুকিয়ে দিল। উঠে দেখি তাতে কাঁচা-সবজি ভর্তি। আশেপাশের গ্রাম থেকে কালকাতে যে সবজির সরবরাহ হয় সেরকমই একটি অটোতে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, পালং শাকের আঁটির সাথে দুলতে দুলতে আর অন্ধকার ভোরের ঠান্ডায় ফাঁকা অটোয় কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলাম এই গাড়িটা অন্তত আমাদের কালকা স্টেশনে পৌঁছে দেবে তো? বলে হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আরো দুচার জন মাঝরাস্তায় উঠলো আবার নেমেও গেল। আমরা কাঁপতে কাঁপতে চলেছি। চোখের সামনে ঘড়ির কাঁটা আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছটার ঘর পেরিয়ে গেল। অবশেষে অটোচালক আমাদের নামতে বললেন। বললাম স্টেশন এসে গেছে? বলে হ্যাঁ এই তো স্টেশন। নেমে দেখি কোথায় স্টেশন? অনেক দূরে কতগুলো টিমটিমে টিউব লাইট দেখ যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অটোড্রাইভারকে কিছু বলতে যাব দেখি তিনি ততক্ষণে ধাঁ। সকলেই তো আমাদের মতন হাঁদা নয়। দূরের ওই লাইটগুলি স্টেশনের লাইট কিনা জিজ্ঞাসা করার মতন কেউ নেই ওই ভোরে। অগত্যা ব্যর্থ রাগে আবার ব্যাগ ঘাড়ে গজগজ করতে করতে টিউব লাইট লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগলাম। বিধ্বস্ত দুজনে স্টেশনে এসে যখন পৌঁছালাম তখন আমাদের সাধের কনফার্মড টিকিটওয়ালা টয়ট্রেন আমাদের বিরহে কেঁদে কেঁদে পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেই রওয়ানা দিয়েছেন। আর আমরা দুই মক্কেল ফাঁকা ধু ধু স্টেশনে ব্যাগ ঘাড়ে নখ খাচ্ছি। ঘড়িতে তখন সকাল ছটা পঁয়তাল্লিশ।
বাড়িতে ফোন করে খবর দিলাম আমরা ঠিক মতন কালকা এসে পৌঁছেছি।
(চলবে)