Wednesday, 24 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............ শেষ পর্ব

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............দ্বিতীয় পর্বের পর

রাজা রামমোহন রায় এর বসত বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে বেরিয়ে আসতে আসতে  মনে হচ্ছিল যে বাড়িটির যেটুকু অংশ এই দেড়শ-দুশো বছর ধরে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে সেটিকে যদি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ না করা হয়, উপরে একটা ছাউনির বন্দোবস্ত অন্তত না করা যায় তবে আর কতদিন এটি টিকে থাকবে? আর পাঁচটা ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মতন এটিও ধ্বংস হবে কালের নিয়মেই। বর্তমানে সামান্য দু-পাঁচ টাকা এন্ট্রি ফী নিয়ে এটিকে পার্ক হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন-প্রেমিক প্রেমিকার দল বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বাড়িটি, তার মালিক বা তাঁর লড়াই, তাঁর মতবাদ, তাঁর কুসংস্কারবিহীন-স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এসব নিয়ে বিশেষ উত্সাহী নন কেউই। ভাবতে ভাবতে আবার এটাও মনে হলো যে সত্যিই কি  সংরক্ষণ করার আদৌ দরকার আছে? এই বাড়ি তো কতকগুলি ইঁট মাত্র। যাঁর কারণে এই জায়গার মাহাত্ম, সেই লোকটির কথা কতজন মনে রেখেছে? নিজের জীবন দিয়ে জগদ্দল গোঁড়া সমাজটাকে নাড়িয়ে দিলেন যিনি, সারা ভারতবর্ষের মেয়েদের নবজীবন দিলেন যিনি, তাঁর মতাদর্শ কি সত্যিই বাংলাদেশের লোকেরা আত্মস্থ করতে পেরেছে? ব্রিটিশ শাসককুল আইন করে সতীদাহ বন্ধ না করলে আরো কতদিন চলত কে জানে? এই দুশো বছর পরেও এখনো জন্মানোর পর থেকেই মেয়েদের বৃহত্তর অংশকে তাদেরই মা ঠাকুমার দল বোঝাতে থাকে যে তাদের জন্মানোর উদ্দেশ্য বিয়ে, আর তার অব্যবহিত পরেই সন্তান। পরবর্তী জীবনে সন্তান পালন। এই মনোভাবের গ্রাম-শহর-শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো ভেদাভেদ নেই। পরিস্থিতি ভেদে বলার ভঙ্গিটা শুধু বদলে যায়। কোনো এক চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ের কথা মনে পড়ছে। তার ঠাকুমা তার সম্পর্কে তার সামনেই আমাদের বলেছিলেন "ওর মনে খুব দুঃখ জানত? গায়ের রং কালো তো, দিদিরা সবাই ফর্সা।" সেই শুনে একজন আধুনিকমনস্ক ব্যক্তির উত্তর ছিল, "ও নিজেই যত্ন নিতে শিখলে বয়সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে।" অর্থাত ফর্সা হওয়াটা জরুরি। আমি বাচ্চাটিকে ততক্ষনাত জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কেন রে? ফর্সা না হলেই বা কি হয়?" বিনা দ্বিধায় বাচ্চাটির উত্তর ছিল, "বিয়ে হবেনা তো কালো হলে।" একটি পাঁচ বছরের বাচ্চা জন্ম থেকে বিয়ে-বাচ্চা-সংসার-স্বামী এসব শুনে শুনে বড় হলে সে এর বেশি আর কি উত্তর দেবে? এই যখন এখনো আমাদের বাংলার নব্বই ভাগ বাচ্চা মেয়েদের ভবিষ্যত তখন রামমোহন রায় এর বাড়ির ইঁট কটা রইলো না খসে পড়ল তা নিয়ে মন খারাপ করে আর কি হবে?

এগিয়ে চললাম রাধানগরের দিকে। পথের দুপাশে মাঝে মাঝেই বহু পুরনো সুন্দর কারুকার্য করা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। যার কোনো ইতিহাস কেউ জানে না। স্বপনকাকাও কিছু বলতে পারলেন না। এভাবেই আর কিছু বছর পরে এগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রাধানগরে আছে রামমোহন মেমোরিয়াল হল। আমরা গিয়ে দেখলামতার সদর দরজায় তালাবন্ধ। আর বাইরে থেকে এক ভদ্রমহিলা তালাটার সাথে যুদ্ধরত। চাবি দিয়ে তালাটা কিছুতেই খুলছে না। বললেন তিনি নাকি সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। ভাবলাম ভালই হলো। ইনিই সব ঘুরিয়ে দেখাতে পারবেন। অমা! সে গুড়ে বড় বড় দানার বালি। তালাটা স্বপনকাকা চেষ্টা করে খুলে দেবার পর, তিনি চট করে ভেতরে ঢুকে কোলে করে তুলে নিয়ে এলেন একটি ছাগলছানা। আমরা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছি দেখে একগাল হেসে বললেন "এর জন্যই তো তালাটা খোলার চেষ্টা করছিলাম, তা তোমরা ঘুরে দেখো না। আমি একে বাড়িতে রেখে আসি। তোমাদের হয়ে গেলে দরজাটা টেনে দিও। গরু-টরু ঢুকে পড়ে তো নইলে।" বলে পান খাওয়া বাদামী দাঁতের এবড়ো খেবড়ো সারি আরো একবার দেখিয়ে চলে গেলেন। আমরাও গুটি গুটি ঢুকে পড়লাম। এখানেই নাকি রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি ছিল এখন একটি স্মৃতিমন্দির। আর আছে একটি বেদী যেটি নাকি ১৮৫৯ সালে রেভারেন্ড জেমস লঙ বলেছিলেন এটিই রাজা রামমোহন রায়ের জন্মবেদী। এই রইলো ছবি।

   
এই বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকেই আছে ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি মন্দিরের হুবহু নকল একটি স্মৃতিসৌধ। তার লাগোয়া একটি গ্রন্থাগার।  সেই নকল স্মৃতিসৌধের ছবি দিলাম নিচে। সঙ্গের লেখাটাও ব্রিস্টল এ আসল সমাধি মন্দিরের গায়ে উত্কীর্ণ লেখাটির প্রতিরূপ।


রামমোহন রায় কে এখানেই ফেলে রেখে এখান থেকে আমরা গেলাম খানাকুলের ঘণ্টেশ্বর মন্দির দেখতে। নাম শুনে যদিও মনে হয় যে শিব মন্দির আসলে এটি শক্তি মন্দির।   ভেতরে পাথরে খোদাই করা দশবাহু দুর্গার মূর্তি।


খানাকুল হলো স্বপনকাকার পূর্বতন কাজের জায়গা। সুতরাং তিনি সবই চেনেন। চেনা একটি দোকানে চা খেয়ে গোপীনাথ মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে একটি ঘটনা ঘটল যেটি বলার লোভ আমি সামলাতে পারছিনা। পথে পড়ল একটি দর্জির দোকান। যেখানে নাকি স্বপনকাকা একদম প্রথম জীবনে দর্জির কাজ শিখেছিলেন। আমরা বাইরে  রইলাম। স্বপনকাকা ভেতরে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। হটাত দেখি মালিক বেরিয়ে এসেছেন। স্বপনকাকা ভেতরে গিয়ে কি বলেছিলেন জানিনা। তিনি দেখি প্রচন্ড গদগদ হয়ে পিনাকীকে বলছেন, "আমার কি সৌভাগ্য, আপনি আমার দোকানে এসেছেন। আমার দোকান ধন্য হয়ে গেল। আপনার সাথে আলাপ করে খুব খুশি হলাম। আমি স্বপনের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করব কিন্তু। কি সৌভাগ্য! একটু  অন্তত: বসে যান, একটু চা-কফি-ঠান্ডা কিছু খান........" সত্যি বলছি ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন আমাদের যথাসম্ভব "হেঁ হেঁ.....না মানে....ইয়ে ঠিক আছে......হেঁ হেঁ......" এসব উপযুক্ত ধরতাই এর ফাঁকে ফাঁকে। পিনাকীর মুখটা দেখছি ক্রমশঃই ভেবলু হয়ে উঠছে। উনি তাকে বোধহয় নোবেলজয়ী কোনো বৈজ্ঞানিক ভেবেছেন। আর আমার পেট থেকে ক্রমশঃই ভসভসিয়ে হাসি উঠে আসছে। কোনোক্রমে তাঁর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ফের মোটরবাইক এ উঠেই হ্যা হ্যা করে মিনিট পাঁচেক হেসে নিলাম। তারপর স্বপনকাকাকে বললাম তুমি ঠিক কি বলেছিলে আমাদের সম্পর্কে বলত? সেও দেখি খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। যাই হোক হাসি টাসি সামলে একটা কথা ভেবে অবশ্য খুব লজ্জা পেয়েছিলাম যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়টা পাঁচজন সাধারণ মানুষ যাঁরা এই পেশায় নেই তাঁদের কাছে কতটা দূরের বিষয় এখনো। নুন্যতম ধারণা নেই কারো। সুতরাং ভালো মেধার তুখোড় বুদ্ধির ছাত্ররা কেমন করে আকৃষ্ট হবে এ রাস্তায় হাঁটতে। এটা আমাদেরই লজ্জা। আমরা যারা এই বিষয়ে কিছুটা অন্তত জানি তারাই পারিনি আমাদের বাবা-কাকা-মামা-বন্ধুবান্ধবদের এ সম্পর্কে অবগত করতে। তাই এখনো একজন সাধারণ গবেষককে কেউ বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভেবে ভুল করে, আশা করে তার থেকে বিশাল কিছু স্বাস্থ্য বা সামাজিক পরিবর্তনের।

গেলাম গোপীনাথজীর রাসের মেলা দেখতে। মেলা বিশেষ কিছু দেখলাম না। সাধারণ দোকান পাতি। আর পাঁচটা মেলার সাথে বিশেষ ফারাক নেই। যদিও জিলিপির দোকানগুলো চোখ টানছিল খুবই। কিন্তু দুপুরের ভরপেট খাওয়া আর রাতের জোরদার মেনু স্মরণ করে কষ্ট করেই লোভ সামলালাম। মন্দির দেখলাম।

গোপীনাথ মন্দির 
পাশেই রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের সামনে তিনদিন ধরে হচ্ছে নর-নারায়ণ সেবা। এত লোক একসাথে বসে খাচ্ছেন। সামান্যই খাবার। খিচুড়ি। হয়ত সবার বাড়িতেই আজ এরচেয়ে ভালো মেনু। তাও চারচাকা দামী গাড়ি থেকে নেমে আর দুচাকার লড়ঝরে সাইকেল থেকে নেমে পাশাপাশি বসে একহাতা ঝোল ঝোল খিচুড়ি খাওয়ার আমেজ বোধহয় আলাদা। পাশেই সুন্দর করে আলোয় সাজানো রাধাগোবিন্দ মন্দির।

রাধাগোবিন্দ মন্দির 
ফেরবার পথে রাসপূর্নিমার ঝকঝকে জ্যোত্স্নায় মনে হচ্ছিল এই যে রাস উপলক্ষ্যে মেলা-আনন্দ-লোকসমাগম এতকিছু মানুষের এই ছোটছোট আনন্দটা সত্যি? নাকি ইন্টারনেট-বিদেশযাত্রা-মহাকাশ ভ্রমণ-ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-সবকিছুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে স্কুল এর পড়া শেষ হতে না হতেই স্বপনকাকার মেয়ের মত হাজার হাজার ভারতীয় মেয়েদের শুধুমাত্র বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো এই চরম সত্যিটাই সত্যি?

মোটরসাইকেল-এর হুহু গতি, চকচকে জ্যোত্স্না, দুপাশে মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত আর শিরশিরে ঠান্ডায় মনটা দোলাচলে দুলছিল। খুশি হতে গিয়েও কিরকম ভাবে যেন পুরোপুরি খুশি হতে পারছিলাম না। ভারী হয়ে আসছিল মনটা।


(শেষ)  
    

0 comments:

Post a Comment