হাসপাতালের রিসার্চ সেন্টারে কাজ করার একটা অযাচিত অভিজ্ঞতা রয়েছে। মানুষের উদ্বেলিত আবেগের সাক্ষী হওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নেগেটিভ ইমোশন। কান্নাকাটি। সবদিন সমান যায় না। ক্যান্সার সেন্টারের রিসার্চ আর ক্লিনিক্যাল দিকটির মাঝে কেবল একটিমাত্র দরজা। মাঝে মাঝেই সেই দরজা খুলে ওপারে যাবার প্রয়োজন পড়ে। দরজা খুলেই বারান্দা। সেখানে রোগীর বাড়ির লোকেদের অপেক্ষা করার ছোট একটু আয়োজন। কাল হুড়মুড়িয়ে বেরোচ্ছিলাম বিকেলবেলায়। দেরি হয়েছিলো। ক্লিনিক্যাল দিকের বারান্দা দিয়েই প্রতিদিনের পথ। বেরিয়েই দেখি একটি চেয়ারে প্রৌঢ়া মহিলা এক বসে। গালে হাত। চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখ দিয়ে জল নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে একটা গাল। চট করে মুছে নিচ্ছেন বাঁ হাত দিয়ে। পাশের চেয়ারে বছর বারো চোদ্দর কিশোর। ঘুমিয়ে পড়েছে। হাসপাতালে অপেক্ষারত মানুষের ছবি বোধহয় সব জায়গাতেই একই হয়। ভারত হোক বা আমেরিকা। কোথাও তাঁদের চেয়ে বেশি আতপ্ত বুঝি আর কেউ নেই। কী হবে না হবের দোলাচলে দিনের পর দিন কাটে। বুকের ভিতর ধুকধুক করে বেঁচে থাকে আশা। অনেকসময়ই চুড়ান্ত দুরাশা। পেটের মধ্যে গুড়গুড়িয়ে ওঠা ভয়। প্রতিটা ডাক, প্রতিটা ফোন রিং -এ প্রাণান্তকর ভয়। অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে চোখের জল। এক, সব এক অনুভূতি। সব জায়গায়। পৃথিবীর সব হাসপাতালে।
দিন দুই আগের কথা। আবার সেই বিকালে বাড়ি যাচ্ছি। আমাদের আগে আগে হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন বৃদ্ধ দম্পতি। শ্লথ গতি। বয়সোচিত। দুজনে একই রকম শার্ট পরেছেন। ম্যাচিং। হাত ধরে হাঁটছেন। ভালো লাগছিলো পিছন থেকে দেখতে। চলার পথে তিনটি সিঁড়ি পড়লো। একজন একপা করে নামলেন। দাঁড়ালেন। হাত ধরে অন্যকে নামালেন। ফের একপা নামলেন। দাঁড়ালেন। হাত ধরে অন্যকে নামালেন। এভাবে তিনটে সিঁড়ি উতরে গেল। ভাবছিলাম, তিনটেই কি সিঁড়ি! সারা জীবনে এভাবে কত কত সিঁড়িই না উতরেছেন। একে অপরের হাত ধরে। এখন কাল এর নিয়মে একজন আর একজনের চাইতে বেশি অসুস্থ হবেন। চলে যাবেন। সেটি দুজনের মধ্যে কে তা কেউ জানে না। জীবনের ধন্দ। কোনও সমাধান নেই এই ধাঁধার। ধীরে ধীরে পেরিয়ে গেলাম তাঁদের আমরা দুজনে। আমাদের সেদিনেও তাড়াহুড়ো ছিলো। বয়সোচিত। ওঁদেরও নিশ্চয়ই আমাদের মতো তাড়াহুড়ো ছিলো একটা সময়ে। এখন আমি নিশ্চিত যে ওঁরা চান সময় যেন থমকে যায়। ক্যান্সার সেন্টারের লবিতে, বারান্দায় বয়স্ক মুখগুলো বদলে বদলে যায়। কিন্তু সময়কে শ্লথ করে দেবার শান্ত প্রচেষ্টার পরিচিত ইচ্ছেটা থেকেই যায়। আমরা ওঁদের পার হয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। সময় বয়েই চলে।
0 comments:
Post a Comment