আমরা যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। দুই রকমের ভ্রমণ হয়। এক, যেখানে আপনি কেবল বেরিয়ে পড়বেন। বাকিটা গিয়ে ঠিক করা যাবেখন বলে। আর দুই, যেখানে আপনাকে আগে থেকে কে, কি, কেন, কবে, কোথায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জেনে তবে বেরোতে হবে। দ্বিতীয়টিতে খাটনি বেশি তাই আমার অপছন্দের। কিন্তু সময় বিশেষে দ্বিতীয় পদ্ধতিটিই কার্যকরী। প্রথম প্রটোকলটি সেখানে খাটাতে যাওয়া মানে যেচে বিপদ ডেকে আনা। বিশেষত এই ম্যাপে খুঁজে না পাওয়া জনপদে। একসময় দেখলাম দুজনে দুখানি পিঠের ঝোলা আর একটি ছোট সুটকেস নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর আর ক্যারাবিয়ান সাগরের সঙ্গমের ছোট্টদ্বীপ ভেইকোয়েস এর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি। তখনও আমাদের সঠিক ধারণা নেই যে আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি। অর্থাৎ, থিওরিটিক্যাল ধারণা হয়তো আছে কিন্তু সেতো ইন্টারনেটের থেকে ধার করা কিছু ধারণা। আসল জায়গাটা ধরা পড়েছিল আস্তে আস্তে। ওমাহা থেকে ভোরবেলার একটা ফ্লাইট নিয়ে পৌঁছেছিলাম হিউস্টোন। বেলা দশটা এগারোটা নাগাদ। তারিখ পত্র আজ আর মনে নেই। পুরোনো ফোল্ডার গুলো খুঁজলে হয়ত মনে পড়বে কিন্তু সে অবান্তর তথ্যের সাথে এ গল্পের বিশেষ যোগ নেই। হিউস্টোনের এয়ারপোর্ট ওমাহার ছোট্ট ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টের চেয়ে অনেকখানি বড়। আমরা খাওয়া দাওয়া করে, বাথরুম সেরে পরবর্তী ফ্লাইটের গেটের দিকে যাওয়াই মনস্থ করলাম। এখন থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য San Juan, পুয়ের্তো রিকোর রাজধানী শহর। উচ্চারণটা যদিও অনেকটা 'সান- ওয়ান'। সেটাও অবশ্য পরে জেনেছিলাম। আরো একটি তথ্য এই লিখতে গিয়ে এখনই জানলাম যে, হিউস্টোন থেকে ভেইকোয়েস যেতে এখন পুয়ের্তো রিকোতে না থামলেও চলে। সরাসরি আকাশ পথে খানিক হলেও যোগাযোগ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভূখণ্ডের সাথে। তিন বছর আগে সম্ভবত সেটি ছিল না। সময়ের সাথে সাথে সমস্ত জায়গাতেই যোগাযোগ, আধুনিকতা আসে। সে যত দরিদ্র, অবহেলিত অঞ্চলই হোক না কেন। এমনকি ঔপনিবেশিক অঞ্চল হলেও। উপনিবেশ পত্তনকারী দেশের সরকারের দায় থেকেই সে উন্নতি আসে। যাক, গল্পে ফিরই বরং। আপাতত হিউস্টোন থেকে সান ওয়ান এর ফ্লাইট ধরে আমরা এলাম পুয়ের্তো রিকো। চার- পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইট। সুতরাং পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল। সান ওয়ান এয়ারপোর্টে সৌন্দর্য আর কার্যকারিতার মেলবন্ধন।অনেকটা যেন আমাদের কোচি এয়ারপোর্টের মত। অতীতের স্পেনীয় উপনিবেশ, ইতিহাস আর ক্যারাবিয়ান সাগরের দ্বীপভূমির সমস্ত বৈশিষ্ট নিয়ে সুন্দর এয়ারপোর্ট। এখন এখানে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আজই যাব ভাইকোয়েস। প্রথমে যেভাবে ভেবেছিলাম, সেই ফেরি লঞ্চে করে আটলান্টিক বেয়ে ভেইকোয়েস পৌঁছাব সেই উত্তেজক ব্যাপারটিতে কিঞ্চিৎ বাধা পড়েছে। মানে, সান ওয়ানের ফেরিঘাট থেকে ভেইকোইসের দিকে দিনের শেষ লঞ্চটি ছাড়ার সময় আর আমাদের সান ওয়ান পৌঁছানোর সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সময়ের ব্যবধান বড়োই কম। এখন ওমাহা থেকে আসা আমাদের সুটকেসটি সংগ্রহ করে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরিঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে লঞ্চ যে ছেড়ে যাবেই সে ব্যাপারে আমাদের কোনো সন্দেহই ছিল না। সুতরাং আমাদের সে রাত্তির টুকু সান ওয়ানেই থেকে যেতে হত। তাতে ভেইকোয়েসের ভাগে আধবেলা কম পড়ে যায় আর আমাদেরও এক রাতের জন্য আর একখানা আস্তানার খোঁজ করতে হয়। এই দুটি বিষয় এড়িয়ে সেরাত্তিরেই ভেইকোয়েস পৌঁছানোর আরো একটা উপায় আছে। সেটি হলো, সান ওয়ান এয়ারপোর্ট থেকেই ছোট্ট আট সিটের প্লেনে আধঘন্টার মধ্যে ভেইকোয়েস পৌঁছানো। ভাইকোয়েসে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও US আর্মির ঘাঁটি ছিল সেজন্য একটি ছোট্ট এয়ারপোর্টও আছে। সেখানে তখন কেবল ওই ছোট আট সিটের প্লেনই নামতে পারত। এখন জানিনা।আমরা আটলান্টিকের উপর দিয়ে ছোট লঞ্চে যাবার লোভ ছেড়েছিলাম কিছুটা হতাশ হয়েই। ভাবিনি জীবনে প্রথমবার আটলান্টিকের ওপর দিয়ে আট সিটের প্লেনে আধঘন্টার উড়ানও নতুন কিছু হবে আমাদের জন্য। হয়ত কিছুটা থ্রীলিংও। অন্তত টেক অফ এর সময়টা। সেই ছোট প্লেনের জন্য আমাদের সান ওয়ান এয়ারপোর্টের এক্কেবারে শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা অংশে বেশ খানিক খান অপেক্ষা করতে হলো। আমাদের সাথে যাঁরা অপেক্ষা করছেন ভাইকোয়েস যাবেন বলে তাঁরা সকলেই প্রায় বয়স্ক মানুষ। অবসর জীবনে ক্যারাবিয়ান দ্বীপে যাচ্ছেন ছুটি কাটাতে। যেখানে কিছু করার নেই বিশেষ। সেখানে আমরা দুজন অপরিপক্কতার চুড়ান্ত দুটি নিদর্শন হয়ে বসে আছি। দু একজন দেখছেনও আমাদের। বয়সোচিত স্বাভাবিক জায়গায় না গিয়ে আমরা এমন একটা মরা জায়গায় যাচ্ছি কেন? মানুষের কক্ষে এপ্রশ্ন আমাদের জন্য অস্বাভাবিক নয়। এতে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের এক চৈনিক বন্ধু তো বলেই ফেলেছিল, "তোমাদের পছন্দ গুলো ঠিক অবসর প্রাপ্ত বয়স্কদের মত।" যাক যে সেকথা, ভেইকোয়েসের ছোট প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এই ফাঁকে বরং পুয়ের্তো রিকো সম্পর্কে কটা গল্প করে নিই। আগেই বলেছি, পুয়ের্তো রিকো ছিল স্পেনীয় উপনিবেশ। সে বড় আজকের কথা নয়, সেই কলম্বাসের সময় থেকেই। নাহোক প্রায় পাঁচশ বছর আগেকার সময় থেকেই। তার পর ফরাসি, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ কত জাতিই না চেষ্টা করেছে ভেইকোয়েস সহ পুয়ের্তো রিকো দ্বীপপুঞ্জকে দখল করার কিন্তু স্পেনীয়দের হাত থেকে তাকে সরাতে পারেনি। সেই নিয়ে কত যুদ্ধ, কতই না রক্তপাত। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই পুঁচকে একফালি দ্বীপের জন্য এত ঝগড়া ঝাঁটি, রক্তপাত কেন? কারণটা হল, এর অবস্থান। তখনকার পালতোলা জাহাজের যাত্রাপথ ঠিক হত সমুদ্রের বাতাসের এবং স্রোতের অনুকূলে। বাষ্প বা পর্বতীকালের ইলেকট্রিকের জলবাহনের যুগ তখনও অধরা। ইউরোপ থেকে পশ্চিমে উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকান ভূখণ্ডে আসতে গেলে আসার পথ ছিল উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের একটু দক্ষিণ দিয়ে। আর ফিরে যাবার পথটি ছিল একটু উত্তর দিক দিয়ে। বারমুডার কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে। কারণ সমুদ্র স্রোত সেকথাই বলে। এখন আসার রাস্তাটি ভাল করে দেখুন দিকি। স্পেন বা পর্তুগাল থেকে উত্তর আটলান্টিকের দক্ষিণ দিক দিয়ে আমেরিকা ভূখণ্ডের দিকে যাত্রা করলে প্রথম বড় দ্বীপটি কি? পুয়ের্তো রিকো। একমাস ধরে আটলান্টিকে কতে চলতে প্রথম যেখানে পায়ের তলায় জমি পেলেন, যেখান থেকে খাবার, জল, রসদ সংগ্রহ করে, পুরো ক্যারিবিয়ান সাগর পেরিয়ে আরো ধনশালী, সোনার দেশ, পেরু বা মেক্সিকোর দিকে অভিযান করতে গেলে বা পূর্ব দখলীকৃত অঞ্চলে পৌঁছাতে গেলে প্রথম পড়বে পুয়ের্তো রিকো। সুতরাং এই দ্বীপটি দখলে থাকলে এদিক থেকে যেমন সুবিধা তেমনি, ইউরোপ থেকে আগত শত্রূ জাহাজকে ক্যারাবিয়ান সাগরে ঢুকে পেরু বা অন্যান্য জায়গায় পৌঁছে লুট করতে দেবার আগেই আটলান্টিকেই রুখে দেওয়া যাবে। সুতরাং এই পাহারাদার সদৃশ ছোট্ট ভূখণ্ডটির দিকে হাত বাড়িয়েছে সকলেই। কিন্তু অনেক গৃহবিপ্লব এবং যুদ্ধ সত্ত্বেও ১৮৯৮ এর আগে পর্যন্ত এই অঞ্চল থেকে স্পেনীয়দের সরাতে পারেনি কেউই। এমনকি এখানকার আদিবাসী তাইনো সম্প্রদায়ের বিপ্লব সত্ত্বেও। ১৮৯৮ এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং স্পেনের যুদ্ধ শেষে প্যারিস চুক্তি অনুসারে এটি আমেরিকান উপনিবেশে পরিণত হয়. এবং ১৯১৭ থেকে পুয়ের্তোরিকানরা আমেরিকান নাগরিকত্ব পান।
যাকগে, ছোট প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একগাদা কথা বলে ফেললাম। যেটা আজকাল চাইলে দু মিনিটেই জানা যায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখি প্লেন এলো কিনা। সময় হলে আমাদের পাশ দেখে লাইন করে ওয়েটিং লাউঞ্জ থেকে সোজা নিচে নামিয়ে দেওয়া হলো। এর আগে কোনো এয়ারপোর্টে এরকম পায়ে হেঁটে প্লেনে গিয়ে চাপিনি। নিদেন পক্ষে বাসে করে প্লেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের পথনির্দেশকের ঠিক পিছনে লাইন করে সবাই গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনও প্লেন আসেনি সেখানে। হাওড়া স্টেশনে বাসের জন্য লাইন দেওয়া মনে পড়ে যাচ্ছে। পথপ্রদর্শক আমাদের এবং আমাদের ব্যাগেদের সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিলেন। ব্যাগ তার আগেই আরো একবার করে ওজন করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ, প্লেনটিতে নির্দিষ্ট ওজনের বেশি নেওয়া যাবে না। সুতরাং পারমুটেশন কম্বিনেশন করে দেখা গেল, আমরা এবং আমাদের ব্যাগ আলাদা প্লেনে যাবে। সবই এরকম ছোট্ট আট সিটের বাহন। তো সে বাহন এলো। ঠিক যেন অটোয় উঠছি বলে মনে হল। পাইলটের ঠিক পিছনেই দরজা। এদিক ওদিক করে আরো সাতটা সিট্। উঠে বসলাম। নির্দেশিকা শোনানো হলো। বিশেষ কিছু শুনেছিলাম বলে মনে হয় না। প্লেন ছোট হবে জানতাম এরকম ছোট হবে আশা করিনি। আমার হতভম্ভ ভাব কাটছেই না। মনে হচ্ছে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে লঞ্চে যাবার হতাশা কাটতে চলেছে। পিঠের ব্যাগটা বাসের মত পায়ের তলায় নিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম। প্লেনের দরজা বাইরে থেকে পথপ্রদর্শক ভদ্রলোক বন্ধ করে দিলেন। একদম ম্যানুয়াল ব্যাপার স্যাপার। সম্ভবত উস আর্মির পুরোনো প্লেন এগুলো। জানিনা। একান্তই আমার মনে হওয়া। প্লেন গড়াতে শুরু করল। গড়াতে গড়াতে সান ওয়ানের এয়ারপোর্ট এলাকা প্রায় পেরিয়ে এলো। কিন্তু স্পিড আর নেয় না। কি রে বাবা? ওই তো দেখা যাচ্ছে গাছের সারি, তার ওপাশেই সমুদ্র। উড়বে কখন? এতো রানওয়ে শেষ হয়ে এলো। পাইলটের ঠিক পিছনেই একজন তার পিছনেই আমি। হটাৎ দেখলাম, ডানহাতে পাইলট তার বাহনের কন্ট্রোলারের ওপর। আর বাঁহাত দিয়ে প্রাণপণে পাশের জানলার হ্যান্ডেল ধরে হ্যাঁচকা টান মারছেন। জানলা বন্ধ হচ্ছেনা। আর প্লেন গড়িয়েই যাচ্ছে থামছেনা। এদিকে সামনে গাছের সারি এগিয়ে আসছে। আমি ততক্ষনে নিশ্চিত যে এই প্লেন আর উড়বে না। আর এই মাঝসাগরের পুঁচকে দ্বীপেই আমার সমাধি হলো বুঝি। হঠাৎ মনে হলো আমিও প্রানপণে দুই পা দিয়ে পায়ের নিচে রাখা ব্যাগটাকে চেপে ধরে আছি। মরার আগে কুটোর মতন। শেষমেশ গাছের সারির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার ঠিক আগেই কেমন করে যেন জানলাও বন্ধ হয়ে গেল আর প্লেনও একটা ঘাসফড়িং এর মতন পুট করে হাওয়ায় ভেসে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পরে যখন বুঝতে পারলাম মরিনি, এখনো বেঁচেই আছি ততক্ষনে গাছের সারি পেরিয়ে পায়ের তলায় আটলান্টিক।
তার আগে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে এসেছি একবারই। প্রথমবার যে ঢাউস এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি আমাদের দিল্লি থেকে প্রথম বারের জন্য শিকাগো পৌঁছে দিয়েছিল, সেই উড়ানের শেষ অংশটির কিছুটা। কিন্তু সেই যাত্রার পুরোটাই ছিল রাতের অন্ধকারে। শিকাগো এয়ারপোর্টে নামার আগে আকাশে লালচে আভা জেগেছিল মাত্র। সুতরাং আটলান্টিকের সাথে পরিকায় সে অর্থে এই প্রথম।ভয় কেটে যাবার পর জানলা থেকে নিচে আর সামনে দেখতে শুরু করলাম। পিছনে সান ওয়ান ডাকগা যাচ্ছে। দেখে মনে হলো এখানে না থেকে ভাইকোয়েসে থাকার সিদ্ধান্ত তা ঠিকই হয়েছে। সান ওয়ানের রাজধানীচিত কিছুটা হলেও আধুনিকতা আছে। যা হয়ত ভেইকোয়েসের নেই। মেঘ পেরিয়ে, সূর্যাস্ত পেরিয়ে, আর এক সাগর নীল পেরিয়ে আমাদের সেই ঘাসফড়িং ভেইকোয়েস পৌঁছে দিল যখন তখন সন্ধ্যা নেমেছে। পাইলট নিজেই নেমে দরজা খুলে দিলেন। লাফ মেরেই নেমে পড়লাম এবং তখন জানলাম যে এই জানলা বন্ধের গল্পটা রোজকারেরই। তাই উনি এত নির্বিকল্প চিত্তে বাঁহাতে জানলা ধরে টানতে পারছিলেন। বুঝলাম, আমাদের অভিজ্ঞতার এই শুরু। ভেইকোয়েস আমাদের আরো অনেক কিছুই দেবে। যা আদ্যন্ত নিজের প্রতি অনাস্থা রাখা একজন মানুষের পক্ষে এই চার্ পাঁচদিনে হজম করা একটু গুরুপাক। যাক পরের কথা পরে বলা যাবে। আপাতত ব্যাগ সংগ্রহ করে হোটেলে পৌঁছাতে হবে। ভেইকোয়েস এয়ারপোর্টটা হলো আদতে একটা দোতলা বাড়ি। ব্যাস আর কিচ্ছুটি নয়। ঢুকেই শেষ। ঢুকেই দেখতে পেলাম ব্যাগ। নিয়ে বাইরে এসে দেখি বাইরে একটি মাত্র একটু হাইপাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। সেটিই এয়ারপোর্টের বাইরের একমেঅদ্বিতীয়ম আলো। তাতে বাইরের মিশকালো অন্ধকারের শোভা আরো বেড়েছে বই না। আর সেই আধো অন্ধকারে সাদা শার্ট পরে একটি গাড়িরই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। আমাদেরই অপেক্ষায়। জানতাম এখানে বাইরে কিছুটা পাওয়া যাবে না হোটেলে পৌঁছাবার জন্য। তাই আগে থেকেই এই ব্যবস্থা। নাম ধাম মিলিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। উঠেও বসলাম। এয়ারপোর্ট বাড়িটার ঠিক সামনে দিয়েই ডাইনে বামে আড়াআড়ি শুয়ে আছে একটা সরু রাস্তা। যার ডানদিকে গেলে ভেইকোয়েসের মেন্ টুরিস্ট এলাকা। যার নাম 'এস্পেরাঞ্জা', বাংলায় তর্জমা করলে হয়, 'আশা'। সেদিকেই সব দেখবার বা ঘুরে বেড়াবার মত বিচ। আর বাঁয়ে গেলে এখানকার স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়ি। আর সেদিকেই আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল। আমাদের বাঁয়ে অন্ধকারের মধ্যে সাগরের থেকে একটা সাঁইসাঁই হওয়া আর শব্দ ভেসে আসছে। আর ডাইনে ঘন গাছপালা ঘেরা অন্ধকার জঙ্গলের মাঝে মাঝে একটা একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামেন একটা করে মিটমিটে বাল্ব জ্বলছে। তাতেই সামনের রাস্তাটুকু একটু করে আলোকিত হচ্ছে। ঠিক যেন শীতকালে আমাদের বাড়ির রাস্তার মত। সেই একইরকম অন্ধকার। ও নাকি US territory. অর্থনৈতিক অগ্রগতি নাকি আধুনিকতা নাকি আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশকে তার আপন জায়গায় থাকতে দেওয়া কোনটা যে দরকারি কে জানে। যাই হোক, চলছিলাম। অবিশ্বাস আমাদের মজ্জায় মজ্জায় গাঁথা হয়ে গেছে। আর অবিশ্বাস থেকেই ভয়। বার বার মনে হচ্ছে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব কি সত্যিই এত দূর? নাকি......? ইন্টারনেট কাজ করছে না ঠিক করে ফোনে ঠিক করে দেখতেও পাচ্ছি না। কিন্তু প্রতি বারের মত আমায় ভুল প্রমাণিত করে আমাদের উনি পৌঁছে দিলেন হোটেলের সামনে। হোটেলের নাম ভুলে গেছি। পরে মনে পড়লে বলবখন। নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে ভেইকোয়েস আমাদের দিনের দ্বিতীয় চমকটা দিল। এখানে সমস্ত কিছুই ক্যাশে পেমেন্ট করতে হয়। একদম আমাদের বাড়ির মত। এদিকে আমরা গত একবছরে মানিব্যাগ সাথে রাখা ভুলেছি। সবকিছুই কার্ড সোয়াইপ করে চলছে। আমরাও এখানে আসার আগে ভাবিনি আর কেউ বলেও নি যে, US এর সমস্ত জায়গা মানেই US এর শহর নয়। সেখানেও অজ গ্রাম আছে। দুজনের ব্যাগ, সুটকেশ সমস্ত কিছু হাঁটকে কিছু ক্যাশ বেরোলো। কখনো কোনো কারণে তুলেছিলাম। সেসব যোগ করেও প্রায় তিন চার ডলার কম হল ওঁনার গাড়ির ভাড়ার থেকে। কিন্তু আমাদের আর কিচ্ছু করার নেই তখন। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আপনার গাড়ির অফিসে গিয়ে কাল আমরা বাকি টাকাটা দিয়ে আসবো। আর আরো একবার আমায় লজ্জিত করে উনি বাকি টাকাটা না নেবার কথা বলেই চোলে গেলেন। আর দেবার দরকার নেই বলে। উনি বুঝতে পেরেছেন যে আমরা সত্যিই আতান্তরে পড়েছি। গাড়ি ঘুরিয়ে চোলে গেলেন আর পিঠে ব্যাগ আর হাতে সুটকেস নিয়ে আমি ভাবলাম এঁনাকেই নাকি কয়েক মিনিট আগে আমি ভয় পাচ্ছিলাম।
প্রথমেই বলেছি যে বিশ্রী একটা মানসিক অসুস্থ (অসুস্থই বলব) অবস্থায় আমি তখন। নিজের ওপর তো নয়ই, কারো ওপরেই বিশেষ ভরসা হয়না। এরকম অবস্থায়, অনভিজ্ঞ দুজনে রাতের অন্ধকারে, আটলান্টিক আর ক্যারাবিয়ান সাগরের মাঝের একটা নির্জন দ্বীপে সম্পূর্ণ ক্যাশলেস অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। বেরোবার চক্করে বেশি কিছু করে ফেলিনি তো? আবার একটা অনিশ্চয়তা ফিরে আসছে মনে। ব্যাগ টেনে হোটেলের দরজার দিকে চলতে শুরু করলাম দুজনে। কাল যা হোক করে কোনো ব্যাংকের ATM থেকে ক্যাশ তুলতে হবে। নইলে তো খাবার জলটুকুও কিনতে পারব না।
(চলবে)