সফলতার সংজ্ঞায় অর্থ-যশ এবং প্রতিপত্তি এই তিনের কদর অনেককালের। অর্থের প্রাচুর্য্য না থাকলেও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি প্রতিটি পরিবারেই কিছু না কিছু হয়েছে। শিক্ষা ও সমাজের উন্নতি হলে অর্থনৈতিক উন্নতি হতে বাধ্য। এই প্রজন্মের মানুষ নিঃসন্দেহে তাঁর বাবা মায়ের যাপিত জীবনের তুলনায় কিছুটা হলেও বেশি ক্রয়ক্ষমতা রাখেন। সেটিই এক্ষেত্রে আমি অর্থনৈতিক উন্নতি বলছি। ছোটবেলায় যার জন্য কিছুটা হলেও লড়াই করতে হয়েছে, কিছু ত্যাগ করে তবে প্রার্থিত বস্তু পেতে হয়েছে, তার জন্য আজ আর অতটা লড়াই করতে হয়না। সুতরাং, পূর্ববর্তী প্রজন্মে কিঞ্চিৎ অর্থানুকূল জীবন এবং শখ-আহ্লাদ মেটাবার জন্য কিঞ্চিৎ উদ্বৃত অর্থ এই থাকলেই সফল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব ছিল। বর্তমানে এটুকুতে সফল হওয়া যায় না। কারণ অর্থ এবং পকেট অনুসারে তার প্রদর্শনী, এ তেমন ভাবে আর অসাধারণত্বের দাবি করার ক্ষমতা রাখেনা। অনেককেই এই মাপকাঠিতে সফল বলা চলে। ব্যাংকের খাতা খুলে সঞ্চিত অর্থের প্রদর্শনী করা গেলেও নয় কিছু মানুষের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় সামনের দিকে থাকা যেত। কিন্তু সেসব প্রথাগত ভাবেই স্থুল বলে সংজ্ঞায়িত। সুতরাং নিজেকে সাধারণের লঙ্গরখানা থেকে তুলে অসাধারণের মোম-আলোকিত রেস্তোরাঁয় বসাতে গেলে কেবল অর্থই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যশ এবং প্রতিপত্তি। এখন লড়াই কেবল এই দুই নিয়ে। যশলাভ করলেই শুধু হবে না, তার পরিপূর্ণ প্রদর্শনী না হলেই নয়। প্রতিযোগীদের মধ্যে আমিই শ্রেষ্ঠ, আমার ভাবনা শ্রেষ্ঠ, আমার প্রোডাক্ট শ্রেষ্ঠ। এই সারির যতজন প্রতিযোগী আছে তার মধ্যে আমি প্রেমে, প্রতিভায়, শিক্ষায়, মননশীলতায়, অর্থে, ভ্রমণপিপাসায়, কবিতায়, গদ্যে, রন্ধনশিল্পে, উদ্যানকর্মে, চিত্রগ্রাহকতায়, রাজনৈতিক-সামাজিক-শৈল্পিক বোধে, জীবনের উদ্দাম উদযাপনে আমিই- আমিই শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ হতে চাওয়া কাম্য নিশ্চয়ই। শ্রেষ্ঠত্ব এমনই এক আলো, যাকে না চাইলেও বাইরে আসতে দিতে হয়। নিজের পথে চলতে চলতে সে নিজেই পথটিকে আলোকিত করে। শ্রেষ্ঠত্ব স্বপ্রভ। শ্রেষ্ঠত্বের বেআব্রু প্রদর্শনীতে বোধহয় অসম্মান।
অসুন্দরের লজ্জাহীন চিৎকারে মনোগত ক্লান্তি, পল্লবগ্রাহীতার নির্লজ্জ প্রদর্শনীতে মস্তিষ্কের শ্রান্তি। এই-ই যখন প্রথা, সেখানে দুই- একজন আছে, অপ্রতিম আভিজাত্য, লাবণ্য নিয়ে প্রতিবার তারা সামনে দাঁড়ায় প্রথাহীনতার দূর্বার উদাহরণ হয়ে। নিজেকে প্রকাশ করার সীমা এবং মাধুর্য্যের এমন মিশ্রণ বড় বিরল। যাদের দেখে পরিণত মানুষের ব্যবহার শিখি। যখনই দেখি, কথা কই, মন দিয়ে শেখার চেষ্টা করি, যে কি অনায়াস তাদের পরিণতবোধ। বয়স সব কথা বলে না। বাইরে থেকে শান্ত ঢেউহীন থাকার জন্য তাদের চেষ্টা করতে হয়না। ওই যে বললাম অনায়াস! অনায়াস পরিনতবোধ এবং প্রতিদিনের জীবনে অনায়াসে তার প্রয়োগ করে চলা সহজ গরিমা নয়। প্রথাগত সৌন্দর্য্যে তার বিচার চলে না। এরাও আছে। এবং এরাও সামাজিকতার বাইরের কোনো উদ্ভট জীব নয়। অথচ তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বে স্বপ্রভ। বিজ্ঞাপন না হলেও দিব্য হাসতে পারে।
সাফল্য হোক বা ব্যর্থতা, মানুষের সাথে মানুষের যোগ এমনই, যে তাকে জানান দিতেই হয়। সামাজিকতা। বহু বছরের সহজাত অভ্যাস। এখন অবস্থা এমনই যে ব্যাথার কথা বলা বারণ। কান্নার কথা জানান দেওয়া কাপুরুষতা। সুতরাং যেন -তেন- প্রকারেণ ব্যাথা চেপে হাসতেই হবে। নইলেই তুমি ফক্কা। ব্যাথা লুকিয়ে নয়, ব্যাথার ওপরে হাঁটতে হাঁটতে কিকরে পেরিয়ে এলে ব্যাথা আর প্রাণভরে আবার হাসতে শিখলে, সেই আদ্যন্ত সফলতার গল্পটিকে কিন্তু চাপাচুপি দিয়ে ব্যর্থতা ভেবে লুকিয়ে রাখতে হবে। এই সবই সফলতার বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয় মশলা। আমি আপনি প্রায় সক্কলেই এই ফাঁদের শিকার। জীবনব্যাপী শেখার বিষয় এই যে, এই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসা যায় কি না। নইলে এই প্রদর্শনী, প্রদর্শনী-উত্তর পারস্পরিক উষ্মাপ্রকাশ, কেন যথেষ্ট প্রশংসা পেলাম না ইত্যাদির হাত থেকে মুক্তি নেই। তাতে তিক্ততা বাড়ে, শ্রেষ্ঠত্ব নয়।
0 comments:
Post a Comment