অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই সেদিন একটা বাক্স পেলুম। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা। কি যে রেখেছিলুম তাতে ভুলেই গেছি। তাড়াতাড়ি খুলে দেখি একটা রঙিন পুঁটুলি আর পুঁটুলির মধ্যে কত্ত রং। কালো মেয়ের কপালের টিপের মতন লাল, গোধূলির আকাশের মতন কমলা। আহির ভৈরব যখন বাজে, তখন যেমন রং হয় রোদ্দুরের, তেমনি এক হলুদ রং ও পেয়ে গেলুম সেখানে। আর ছিল প্রথম প্রেমের স্পর্শের মতন এক গোলাপি রং, আর মধ্যদিনের ঝকঝকে আকাশের মতন স্বচ্ছ এক আসমানী রং।
রঙের সাথে রং মিলিয়ে ছবি আঁকতে গিয়ে দেখি আঁকব কি তাই তো ঠিক করিনি। সাদা পাতায় রং দিয়ে আঁকিবুকি কেটেছি কেবল সারা সকাল জুড়ে। ছবি তো ফোটেইনি তাতে বরং সাদা পাতায় এতোলবেতোল আনাড়ি রঙের ছোপ। কোনো অবয়ব নেই তার। আমার খানিকটা রং আর সারাটা সকাল অপচয় হওয়া ছাড়া আর কোনো গল্প নেই তাতে।
রং দিয়ে দোল খেলতে গিয়ে দেখি দোল খেলার সাথীই নেই তো রং মাখাবো কাকে? নিজেই নিজের গালে রং মাখানো যায় বোলো? দোল খেলার সাথীরা সক্কলে বড় হয়ে গেছে। আমার মতন অঢেল সময়ই বা কৈ তাদের? রং মাখতে তাদের ভারী বয়েই গেছে।
কি করি ? কি করি? ভাবতে ভাবতে ভারী অভিমান হল, কার ওপরে তা বলতে পারবোনা বাপু। কেন এই রং দিয়েও একটা সুন্দর ছবি আঁকা হলো না? কেন কেউ নেই প্রাণভরে রং মাখাবার, রং মাখবার? এইসব আনাড়ি ছেলেমানুষী।
ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল সেই একলা পলাশ গাছটার কথা। বেচারা সারা মরশুমে একলা একলাই রং মাখে। আশে পাশে আর কোনো গাছে রঙিন ফুল আসেনা যে। ঠিক করলুম, রং কে নিয়ে নির্বাসনে যাব সেই আধা জঙ্গুলে জায়গাটায়, সেই যেখানে আছে পলাশ গাছটা। যার ফুল কেউ তোলেনা, সুঁচ-সুতো দিয়ে জবাই করে গায়ে মাথায় গলায় নরমুণ্ড মালিকার মতন দোলাবে বলে। মুঠো মুঠো লালরং ছড়িয়ে দিলুম সেই একলা পলাশ গাছটার আশেপাশে। বাকি ন্যাড়াবোঁচা মামুলি আগাছাগুলোও নাহয় একদিনের জন্য রঙিন হলো। পলাশের সে কি খুশি। একা একা রঙিন হতে ভাল লাগে নাকি? পলাশ আমার রঙের বাক্স থেকে একমুঠো লাল আবির নিয়ে মাখিয়ে দিল আমারই দুগালে।
এখনো তো অনেক রং বাকি বাক্স ভরে। কি করি? কি করি? ভাবতে ভাবতে সামনে দেখি সেই আউল-বাউল মানুষটা একলাটি দাঁড়িয়ে পথের ধারে। পথিকের একতারা আজ সুর ভুলেছে। আড়বাঁশিটি এসেছে ফেলে সেই কবেই তার নিজের ভিটেয়। ফেলে আসা ঘরের উঠোনের কোণে আজও অপেক্ষায় বুঝি সেই বাঁশি। বাঁশিটিকে আর একবার হাতে নিয়ে সুর তুলতে মন গিয়েছে চুরি। তাই সে পথ ভুলেছে। তারও তো একদিন একটা আপন ভিটে ছিল। ভিটে তো সেই কবে গেছে দূরে যেদিন থেকে সে পথ চিনতে নেমেছে পথে। ঘর গিয়েছে, সাথে সাথে রংও গেছে জানো? রংকে বললুম, এসো রং, সেই পথিকের খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়ি বরং তোমায় নিয়ে। গিরিমাটি লেপা তার উঠোনের রঙে রং মিলিয়ে কমলা রঙের আল্পনা দিই পথের ওপর। সেই পুরোনো নকশা মেলাই তোমায় আমার আঙ্গুল দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে। সারা পথ জুড়ে কমলা রঙের আল্পনা আঁকলুম দুজন মিলে। আঁকার শেষে দেখি একতারাটি তার কখন যেন আবার বাজতে লেগেছে। নতুন রকম সুর উঠেছে তাতে। ক্রমশঃ সেই সুর নেশার মতন দুলতে দুলতে আমার কপালে বুলিয়ে দিল রঙিন পালক। ওমা! দেখি সারা কপাল জুড়ে আমার কমলা রং।
এত্ত এত্ত আল্পনা দিয়েও এখনো এতো রং বাকি আমার বাক্সতে। কি করি? কি করি? ভাবতে ভাবতে দেখি একটা মস্ত বড় বাড়ি। ভারী গম্ভীর বাড়ি। বাড়িটার চারপাশে মস্ত পরিখা কাটা। সামনে এগিয়ে দেখি, সে হল ভয়ের পরিখা। অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা দিয়ে দৃষ্টিপথ বন্ধ করে রেখেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না সামনে। দেখিইনা কি হয় বলে দিলুম একমুঠো রং ছড়িয়ে সেই কুয়াশার দিকে। ওমা! যেইনা ছোঁড়া, রঙিন আবিরের ছোঁয়ায় টুক করে খানিকটা কুয়াশা গেল কেটে। ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা দিয়ে রং কে দূরে রেখেছিল। তাইতো সামনে যা কিছু সব এক্কেবারে রংহীন। বাড়িটা, বাড়িটার সামনের সারি সারি মানুষ। সবকিছু রংহীন, বিষণ্ণ। কেন বলতো? বাড়িটা একটা হাসপাতাল। প্রিয়জন অসুস্থ হলে হাসপাতালের বাইরে সব সারি সারি অনিশ্চিত মুখের ভিড়ে, ভয় জড়ো হয়। অনিশ্চয়তা আর হতাশার মেঘ ঘনিয়ে আসে। তাইতেই তো বাড়িটার চারিদিকে অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশায় মোড়া ভয়ের পরিখা তৈরিহয়েছে। রঙের প্রবেশ নিষেধ করতে। বিবর্ণ কুয়াশায় দিন দুবেলা রং হারানো মায়ের মুখ, প্রাণপণে রং খুঁজে ফেরে ইষ্ট-উপাসনায়। অপেক্ষা করে খেলতে খেলতে ঝিমিয়ে পড়া মেয়ের জন্য। কিংবা ধরো, রংহীন মেয়ে বাবার সুস্থতার অপেক্ষা দিয়ে সাদাকালো বিনুনি বানায়। কেন জানো? ভয় যেখানে বাসা বাঁধে, রং সেখানে থাকে না। কিংবা ধরো রং ফুরোলে অনিশ্চয়তা জন্ম নেয়। তাই তো সেখানে রঙের খুব প্রয়োজন। রং দিয়েই তো ওই কুয়াশায় নজর পথ আবার খোলা যায়। এই আমি যেমন করে রং দিয়ে পথ খুঁজলুম, তেমন করেই।
রংকে বললুম, তোমায় নিয়ে বরং নির্বাসনেই যাই হাসপাতালে বাইরে বসা এই সবার মাঝে, যেখানে ভয় আর হতাশায় বর্ণহীন করেছে আশা আর আনন্দকে। বাইরে থেকে রং না পেলে অসুস্থ মানুষগুলো যুঝবে কেমন করে বলো দেখি? যেই না তুমি বুকের মাঝের পদ্মটা ভেদ করে সোজা হৃদমাঝারের সুখ জাগালে, অমনি মনের অসুখ গায়েব। আর মনের অসুখ হার মানলে দেহের অসুখের আর জোর কি যে রং কে দূরে ঠেলে রাখে? যারা অসুখের বাইরে আছে, তাদের মনে রং পৌঁছতে না পারলে কেমন করেই বা ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা কাটিয়ে অসুখের ভেতরে থাকা প্রিয়জনদের মনে রং পৌঁছে দেবে?
তারপর সেই গোটা রঙের বাক্সটা দিলুম উপুড় করে বিবর্ণ মুখ গুলোকে রঙিন করতে। দেখি এইবার কেমন করে ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশার মেঘ দিয়ে অসুখকে রঙের থেকে দূরে রাখতে পারে। যেই না এক একটা রংহীন মুখ রাঙিয়ে উঠতে শুরু করলো, সেই রং আমার গায়েও এসে লাগতে লাগলো। ক্রমশঃই আমার সারা শরীর লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, গোলাপি, আসমানিতে রঙিন হয়ে উঠতে লাগলো। আশ মিটিয়ে দোল খেলব আজ। দেখি এইবার অসুখ পেরিয়ে আনন্দের দোলরং আসে কিনা।
0 comments:
Post a Comment