দরজা দিয়ে বেরিয়েই দেখি অজস্র তুলো তানের বিস্তাররত শত শত গান্ধর্বীর মত সুরলোক থেকে নেমে আসছে যেন। উড়ছে। চলতে ফিরতে হাতে পায়ে মুখে এসে লাগছে। দুপাশের ঘাসের আস্তরণ ভরিয়ে তুলেছে সাদা সাদা তুলোয়। প্রতিটি তুলোর গোছায় একটা করে বীজ। দল বেঁধে প্রাণপণে প্রাণের বিস্তার করে চলেছে। এখানে প্রায় ছয়মাস শীতকাল। শীতের শেষে গাছেদের দেখলে সন্দেহ হয় যে এদের দেহে প্রাণের সামান্য কিছুও অবশিষ্ট আছে কিনা। হাড়সর্বস্ব গাছেরা তারপর কি করে যে শীতশেষে প্রথম বসন্ত সমাগমে পাতাহীন দেহে ফুটিয়ে তোলে কত রংবেরঙের ফুল সে এক রহস্য। পাতা নেই, কঙ্কালসার গাছগুলো যৌবন পায় গা ভর্তি ফুলে। কি তাদের রূপ তখন। দেমাকে ডগমগ। তারপর ফুল ঝরতে থাকে। যৌবনের যেমন ধর্ম। ততদিনে পাতা এসেছে শরীর জুড়ে। আর ফুলের বোঁটায় বীজ। সে বীজ ছড়িয়ে দিতে আবার কত রকম আয়োজন। একদলের কথা তো বললামই। তুলোয় মুড়ে দিকে দিকে খবর পাঠাচ্ছে -' এই রইল আমার স্বাক্ষর। ভুলে যেও না যেন আমায়।' আবার প্রতিদিনের যাতায়াতের পথে কয়েকজন আছে, তারা উত্তরাধিকারীকে দূর দূরান্তে পাঠাবার জন্য রঙিন ডানার বন্দোবস্ত করেছে। হাওয়ায় ভর দিয়ে কিছুদূর যাতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে। কি অভিনব সব পদ্ধতি তাই না? আদতে একটাই কথা যে- রেখে যেতে হবে আমার উত্তরসূরী। আমার বৈশিষ্ট্য কিছুতেই ভুলে যেতে দেব না কাউকে। সে যেমনই বৈশিষ্ট্য হোক না কেন। আমার নিজের মতন আর একটা আমিকে বা অজস্র আমিকে যে কোনো উপায়ে রেখে যেতে হবে পৃথিবীর বুকে। আমি তাকে প্রাথমিক শিকড় বিস্তারের বন্দোবস্ত করে দেব। তুলো বা ডানার পাথেয় দেব যাতে সে আরো কিছুটা দূরে গিয়ে দখলদারি কায়েম করতে পারে। আশা করব, ছোটখাট ঝোপঝাড়, গুল্ম, বাকি আর সকলকে দমিয়ে মাথা তুলবে একা। ভাগের সূর্যালোক ব্যতীত আরো কিছুটা পাবে, এমন আশাও করব। এ পর্যন্ত বোধহয় বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম। গাছেরা এ পর্যন্তই মানে। আমরা বাদে বাকি অন্যরাও। আমাদের কথা আলাদা। বিবর্তনের দাবি মেনে হাত পা, নখ, দাঁত, শারীরিক শক্তি কোনো কিছুরই বলবার মতন বিশেষ উন্নতি না হলেও, ঘাড়ের ওপরের অঙ্গটির যে অদ্ভুত এবং আকস্মিক পরিবর্তন হয়েছিল তার সু এবং কু দুই ফলই দীপ্যমান। আমরা কিছুই মানিনা। না বিবর্তনের বেঁধে দেওয়া দখলদারির নিয়ম, না আমাদের নিজেদের বেঁধে দেওয়া সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার কানুন। আমরা দখলদারি করি বোধহয় কেবলমাত্র দখলদারি করবো বলেই। ভীষণ রকম একটা হুলুস্থুল ফেলে দিয়ে নিজেদের এবং বাকিদের বিপর্যস্ত করে শেষপর্যন্ত দখলদারিত্ব হয়ত কায়েম হয়। কিন্তু দখল করার পর দখলীকৃত সম্পত্তিটিকে নিয়ে ঠিক কি যে করব, কি যে করা উচিৎ সেইটিই ভাবা থাকে না বলে দখলদারীর খেলাটা শেষ হয়ে যাবার পর আর কিচ্ছুটি করার থাকে না। মাথা চুলকে ভাবতে বসতে হয় তাহলে বরং আরো কিছুটা জায়গা দখল করা যাক। রীলে রেস এর মতন। জন্মেছ? বেশ করেছ। বড় হচ্ছো? ভীষণরকম সাংঘাতিক একটা লেখা পড়া করে তাক লাগিয়ে দাও দেখি তবে। দারুন একটা ডিগ্রী পেয়েছো? বেশ করেছো। এবার ছোট থেকে যা যা ভাল বলে জেনেছো, দিনরাত এক করে সারা পরিবারকে তটস্থ করে সমস্ত শুভাকাঙ্খী, সামাজিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এতদিন যা পড়াশুনা করেছো ডিগ্রি পাবার জন্য সবটা বেমালুম ভুলে যেতেও পারো। উঁহু উঁহু, ডিগ্রির কাগজটা ফেলো না। ওটা লাগবে। আচ্ছা বেশ, এবার যেন তেন প্রকারেণ গ্রাসাচ্ছাদনের একখানা ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে বুঝলে। করে ফেলেছো। আরে ব্র্যাভো। ডিগ্রিটা কি এমনি এমনি নাকি? যাক বাবা, দখলদারির পঞ্চাশ ভাগই মেরে এনেছো। বাকিটা অবিশ্যি একার দ্বারা হবেনা। এবার আস্ত একখানা মানুষকে দখল করে ফেল বরং বুঝলে। তারপর তাকে নিয়ে আরো একখানা মানুষ বানিয়ে ফেল, ব্যাস হয়ে গেল গোল্লা সম্পূর্ণ। এবার এই পুঁচকে মানুষটা সাদা পাতাকে নিজের মতন আঁকিবুঁকিতে ভরিয়ে তোলার আগেই তার মগজ ধোলাইটি করে ফেলা চাই। নইলে কিন্তু রীলে রেসের এখানেই ইতি।
এতগুলি দখল হলো কিন্তু কেন যে হলো সেটা বোঝা গেল না। জ্ঞানের দখল হল, হিসেবের শেষে জ্ঞান গেল বাড়ি, হাতে রইল পেন্সিল। থুড়ি, ডিগ্রির কাগজ। কাগজ দিয়ে জবরদস্ত একখানা কাজ দখল হলো। তারপর কাজের কি হলো খোদায় মালুম। থাকার বাড়ি, চড়ার গাড়ি, বেড়ানোর প্যাকেজ, আরো কি কি যেন সব হলো যখন, তখন আর অন্য কিছু ভাবতে নেই। ওসব বোকায় ভাবে। এরপর আস্ত একখানা মানুষ পর্যন্ত দখল করে ফেললে। তারপর সংসার, সমাজ ইত্যাদি প্রভৃতির ভুজুং দিয়ে তাকে টিপে মেরে ফেলতে পারলেই- 'যাক বাবা সুখের সংসার।' তারপর কিচ্ছুটি না ভেবেই, একখানা আস্ত মানুষ তৈরী করে ফেললে। কেবল তৈরী করা যায় বলেই আর প্রোটোকলে আছে বলেই। সম্পূর্ণ সাদা পাতা নিয়ে জন্মানো সেই মানুষটাকে তারপর আর কিছুতেই সাদা থাকতে দেওয়া যাবে না। দখলদারির চক্করে নিজের রেপ্লিকাকেও ছাড়বে না। তাকে আমার মতন হতেই হবে। হতেই হবে। নইলে আজই পৃথিবী গেল রসাতলে। খেলাটা চলতেই থাকলো। দখলীকৃত সম্পত্তিগুলোর ওপর ধুলো জমে জমে পাহাড় হয়ে গেল। আর তারপর কোনো কিছুর গোড়া অবধি শিকড় পৌঁছাবার আগেই দুম করে একদিন খবর এলো- 'নাও নাও অনেক হয়েছে, এবার তল্পি গোটাও।' ততদিনে টনক নড়ল তো ভালো নইলে গোটা একটা জীবন স্রেফ ফক্কা। গুটি সাজিয়েই সময় গেল আসল খেলাটা জানাই হলো না।
তবে, কোনোদিনই সবটা একরকম হয়না এই যা। বিবর্তনের পথে দু চারটে বেয়াড়া, উৎপটাং জীব থেকেই যায়। ঘাড় বেঁকিয়ে যারা নিজের নিয়মে চলতে থাকে। ফলাফল ভাল না খারাপ তক্ষুনি বোঝা যায় না যদিও। তবে তার ঘাড় সোজা করতে লোকেরও অভাব হয়না। হয়নি কোনোদিন। যদিও এসব অযথা শক্তিক্ষয়। বেঁকা ঘাড়ের নিয়ম যদি প্রকৃতির পছন্দ হয় তবেই সে সেটিকে অভিধানে জায়গা দেবে নচেৎ নয়। সুতরাং এই দায়িত্ব আর নিজের ঘাড়ে নেওয়া কেন বাবা? প্রকৃতিকেই ভাবতে দাওনা কোনটা রাখার কোনটা ফেলার। প্রতিদিনের যাতায়াতের পথে আরো একটা গাছ বাস করে। বেশ কিশোর বয়স্ক গাছ। শীতের শুরুতেই দেখি একদিন কয়েকজন মিলে অনেকটা মাটি খুঁড়ে তাকে আক্ষরিক অর্থেই সমূলে উৎপাটিত করে অন্য কোথাও নিয়ে গেল। বিশাল একটা বীভৎস গর্ত হয়ে পড়ে রইল তার অস্তিত্বের স্মৃতি। আশেপাশের ঘাসজমির পরিবর্তন হচ্ছিলো। শীতটা বাড়ছিল এমনি করেই। পাশ দিয়ে যেতে অস্বস্তি হত। মনে হতো গর্তটা বুজিয়ে দেয়না কেন রে বাবা? তারপর শীতের মাঝামাঝি সেই গাছটাকেই আবার এনে বসলো তার পুরোনো বসতে। চারিদিক থেকে ঠেকা দিয়ে গাছটার কঙ্কালটাকে বসিয়ে দেওয়া হলো পুরোনো মাটিতেই। আর গাছেরও কেমন বেঁকা ঘাড় দেখো, এত বড় গাছ, এতদিন ধরে উদ্বাস্তু। বেঁচে যাওয়াটাই যেন লজ্জার। প্রোটোকলের বাইরের গল্প। তবুও ছিল বুঝি পুরোনো মাটিতে বেঁচে ওঠার জেদ। রইলো পড়ে ফুল ফোটানো, রইলো পড়ে বীজ ছড়ানো। শীতের শেষে দেখি উৎপটাং সেই ব্যতিক্রম টুকুর টুকুর করে ফুটিয়ে ফেললে কচি পাতা। বাঁচতে হবে তো আগে। জীবন আছে যখন, সূর্য্যালোক সেঁচে জীবনটাকে পল্লবিত করার দায় তো বর্তায় আগে। তারপর নয় কুঁড়ি আসুক।
কাল দেখলাম গোল্লা গোল্লা হলদেটে কুঁড়ি এসেছে গাছটায়। সবার যখন খেলা সেরে ফেলে 'এবার কি করি তালে' জীবন, তখন তাদের ঠিক নাকের ডগায় বেমালুম নির্লজ্জের মতন বেঁচে উঠেছে আর প্রতিদিন আরো একটু বেশি করে বেঁচে উঠছে একটা উৎপটাং জীব। বিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ নাকি বিবর্তনের চ্যালেঞ্জ?
0 comments:
Post a Comment