একসাথে গাঁথা শব্দেরা যখন সুর খুঁজে পায় তখন কবিতা হয়ে ওঠে। পরপর রং জুড়ে জুড়ে ছবি হয়ে ওঠে। আর পরের পর অনুভূতি যোগ করে করে গড়ে ওঠে একটা গোটা জীবন। বিচিত্র সব অনুভূতি, অযুত তার প্রভাব। এক একটি ঘটনা, এক একটি মন্তব্য মুহূর্তে বদলে দেয় একটি মানুষকে। আগাপাশতলা। কখনো রাতারাতি, কখনো অতি ধীরে, একটু একটু করে সারা জীবন ধরে। আজন্মের ভীতু মানুষটি একরাতে ভয় সম্পর্কে বেমালুম উদাসীন হয়ে পড়ে। আবার কুড়ি বছরের ক্ষণিকবাদী মানুষটিই ষাট বছরে জীবনের আবহমানের চলমানতা অনুভব করে শান্ত দর্শকমাত্র হয়ে ওঠে।
আসলে বোধহয় বদলটা আসবে বলে আসে না। বদলটা চাও বা না চাও, হয়েই যায়। একজন মানুষ সারা জীবনে এতটুকুও বদলায়নি এমনটা হয়না। এবং আমার বিশ্বাস বদলটা ভালোর দিকেই হয়। এখন তুমি বলবে বদলটা ভাল না খারাপের দিকে সে আমি জানছি কেমন করে? ভাল বা খারাপটা তো আপেক্ষিক। তা ঠিকই। অবশ্যই আমি বলব, আমার যেটুকু ভালো বলে মনে হয় সেটুকুই। এতে বিশেষ সমস্যা নেই। সমস্যাটা তখনই শুরু হয় যখন আমার ভালোটা আমি তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইবো। তাই না? আমার ভাবনাটা যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন, ততক্ষণ তোমার সেটা চাপিয়ে দেওয়া বলেই মনে হবে যতক্ষণ না তুমি নিজে সেটাকে ভালো বা যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করছ, তাই না? তার আগে পর্যন্ত তোমার যুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখতে বা হয়ত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রানপণে তুমি সেটার বিরুদ্ধে কথা বলে যাবে। স্থিতধী মানুষ বেশি নেই। যাঁর ক্ষমতা আছে আদ্যন্ত সঠিক যুক্তির কাছে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পন করার। আমরা বেশির ভাগ মানুষই প্রথমে নিজের যুক্তিটা সঠিক মনে করেই যেকোনো বিষয়ে তর্ক করতে শুরু করি। তারপর তর্কের মাঝেই যুক্তি-প্রতিযুক্তির মাঝে পড়ে হয়ত কখনো নিজের যুক্তির ফাঁকটুকু নজরে আসে। মজাটা শুরু হয় তারপরেই। এতক্ষন পর্যন্ত যুক্তি তর্কের পর্যায় থেকে ব্যাপারটা "আমার যুক্তিকে হেরে যেতে দেব না" জাতীয় একটা আত্মরক্ষাসুলভ লড়াইয়ের চেহারা নিয়ে আসি আমাদের নিজেদের বাঁচাতে। আর কে না জানে যে আত্মরক্ষার সেরা উপকরণ হলো আক্রমণ। অর্থাৎ তখন আমরা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে শুরু করি। আর যেহেতু ততক্ষনে আমাদের যুক্তির ভাঁড়ার শূন্য, অতএব আমরা যুদ্ধের নিয়ম ভুলে দাঁত নখ বের করে আঁচড়াতে থাকি। অসভ্যের মত "অমুকে তো করেছে, তাই আমিও করেছি।" "বেশ করেছি, আবার করব" ইত্যাদি বলে কৃতকর্মের সামনে যাহোক একটা ঢাল খাড়া করার চেষ্টা করি। আমরা সবাই এরকম। বিশ্বাস করো, তেমন তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে তুমি, আমি প্রত্যেকে এরকম। কেউ ব্যতিক্রম নই। This is simple human nature, self-defense. এক্ষেত্রে, Defense to protect self opinion. আত্মধারণা সমর্থন। অনেকক্ষেত্রেই সেটি ভুল ধারণা। আর সেটি যে ভুল, আমরা সেটা খুব ভালো করে জানি মনে মনে। তবুও গলা ফাটিয়ে লড়ে যাই ওই basic human nature রক্ষার তাগিদে।
যাক গে যাক। এসবে তোমার বিশেষ কিছু দোষ দেখিনা। এতদিন মুখে রক্ত তুলে তর্ক করেছো, তারপর মনে মনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে "হেঁ হেঁ, যাহঃ যাহঃ, এসব অনেক দেখা আছে" বলে ছদ্ম তাচ্ছিল্য করেছো, আর সব শেষে "ও কেন করেনি? তাই আমিও করিনি" - এরকম ক্লাস টু এর বাচ্চাদের মতো যুক্তি খাড়া করে দুর্গ আগলানোর চেষ্টা করেছো। শেষকালে আর না পেরে ফাটিয়ে ঝগড়া করেছো। কিন্তু এবার তো পরিস্থিতি তোমায় সুযোগ দিয়েছে বদলানোর। নিজেকের খোলসটাকে বদলানোর। ওই যে আমি প্রথমেই বলছিলাম না, ঝপ করে একদিন সুযোগ চলে আসে নিজেকে বদলানোর। আগে পিছে কিছু ভাবার আগেই দেখবে সামনে বিশাল সুযোগের সমুদ্দুর। সেটা হাতছাড়া করার বোকামি কি তোমার না করলেই নয়? বাইরে তোমায় যতই লোকে গালাগাল করুক না কেন যে তুমি "মূর্খ", "গাড়োল", "কিছুই বোঝোনা", তার পর আরো কিসব পড়লাম- "আবোদা", "আবাল"-ইত্যাদি ইত্যাদি বাছাই করা নতুন-পুরোনো বিশেষণ, তুমি লোকটা আদপে কি সেরকম নাকি? মোটেওনা। বিশ্বাস করো, এসব বিশেষণ প্রয়োগ করে যাঁরা তোমায় গন্ডমূর্খের একনম্বর উদাহরণ বলে দাগিয়ে প্রবল ধিক্কার আর ছ্যা ছ্যা করে মুখে মাস্ক পরে ঘরে খিল তুলছেন, তাঁরাও তার আগে দোকানে গিয়ে প্রয়োজনের অনেক অনেক অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার জিনিস আর হাত ধোয়ার জিনিস কিনে ঘর বোঝাই করেছেন। যাঁরা বলছেন তাঁরা, যাঁরা বলছেন না তাঁরা, যারা এসবের সমস্ত কিছুর ঊর্র্ধে কেবল কোনোক্রমে বেঁচে আছেন তাঁরা, তুমি আমি সক্কলে একই রকম গাড়োল। কেবল কে কোন বিষয়ে গাড়োলত্ত্ব প্রকাশ করবো সেই বিষয়ে খানিক তফাৎ আছে।
এই যেমন মনে করো, এখন তুমি নাক খুঁটে সেই হাতে এলিভেটরের সুইচ টিপলে আমি মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে তোমার গলাটাই টিপে দেব। কিন্তু এই আমিই আবার সারা শহর ঘুরে গাড়ির ট্রাঙ্ক ভর্তি করে জিনিস কিনে ফ্রিজ বোঝাই করি। আমিই বা তবে এই পরিস্থিতিতে গাড়োল নই কেন? যদিও আমার যুক্তি আছেই এখানে যে "সবাই সব কিছু কিনে দোকান ফাঁকা করে দিলো, আমি তবে বোকার মতো কিনবো না কেন।" এরপর এই ধরো, আপিস-কাচারী-ইস্কুল-কলেজ বন্ধ বলে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে বেড়ু করতে চললুম। তারপর পুলিশের তাড়া খেয়ে, ফেসবুকের গুঁতো খেয়ে তারপর বুঝলুম যে "এহেঃ, কাঁচা কাজ হয়ে গেছে বড্ড। এখন ফেসবুকে ছবিও দেওয়া যাবে না। "ভয় পাইনা" বলে বাহাদুরিও নেওয়া যাবেনা। আসাটাই ফালতু হলে গেলো।" কেন যে আদপেই আপিস-কাচারী-ইস্কুল-কলেজ বন্ধ তার কারণটা ঠিক করে বুঝে নেব? ফুহঃ, অতো সময় নেই। তারপর ধরো একদিনের কারফিউ, সেই একটা দিন ঘরে বসে থাকতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। তাই মনে করো পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে আরো পাঁচজনের সাথে গুলতানি করতে করতে বর্তমান পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর সেই আলোচনা যে করব একটু, তারও উপায় নাই বাপু? কে না কে এসে বলবে "এইও, চায়ের দোকান খুলেছো কেন? এই তোমরা এখানে জড়ো হয়েছো কেন? জানোনা কারফিউ?" আমি বাপু ফেসবুকে বাঘ মারা লোক, আমায় সহজে হারলে চলে? তাই আমার সামনে গামছা গায়ের লুঙ্গি পরা তুমি যদি মিনমিন করে বলো "চা খাবো না আমরা?" আমি চ্যাঁচাবো, "আমলার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো, ও কেন বেরিয়েছে, তাইলে আমি বলব।" তোমার থেকে বেশি জোরে চিৎকারটা আমাকেই করতে হবে তাই না? তুমি গামছা গায়ে, লুঙ্গি পরে আর আমি চশমা পরে ইন করে শার্ট-প্যান্ট। তুমি আমি দুজনেই গাড়োল। পরে অবশ্য ঘরে গিয়ে ফেসবুকের পাতায় তোমায় গাড়োল বলতে আমার একটুও আটকাবে না। কারণ আমি ছাড়া বাকি সবাই আমজনতা। আমজনতার মুণ্ডপাত করা আমার হক। এবার যদি মনে করো একমাস ঘরে থাকতে হয় তাহলে ভাইরাস কেন, স্নায়বিক রোগেই স্রেফ মরে যাবো।
তবে আমি কিন্তু আশাবাদী। আমি মনে মনে স্থির বিশ্বাস করি, তুমি যতই গাড়োল হওনা কেন একখানা দারুন পরিস্থিতির সম্মুখে সময় তোমায় দাঁড় করিয়েছে। কেবল দর্শক হয়ে থাকবে না তুমি-এ আমি ঠিক জানি। নিজের সবজান্তা খোলসটিকে ফেলে দিয়ে ঠিক নিজেকে পরিবর্তন করবে জানি। আর ইয়ে ওই "ও কেন করেছে ? আমিও বেশ করেছি। ওকে আগে বকো, নইলে আমিও করবো।"- এই বস্তাপচা, মানে এই ক্লিশে, মানে এই ভীষণ পুরোনো ডায়লগটা না - ভাবে দেখলুম আর চলছে না বুঝলে। সব স্টাইলেরই তো একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে তাই না? ঐটা বরং বাদই দিয়ে দাও বুঝলে। "দেখ কেমন দিলুম" লুকটার জন্য আরো একটা ভীষণ কার্যকরী ডায়লগ বলি বরং চুপিচুপি। আগামী দিনে ভীষণ "ইন" হয়ে যাবে ব্যাপারটা। আগেভাগে বলি বরং। এই মনে করো, সত্যি সত্যি নিজেকে বদলে একদম ভেতর বাইরে এক করে দিলে। বুক বাজিয়ে সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেলে। তুমি নিজেই জানো ভালো বলতে আমি কি বলছি। সব আছে তোমার ভেতরে। কেবল করতে ভয় পাও। আজকে যারা গাড়োল বলছে কালকে তারাই পিষে মারবে বলে। কিন্তু প্রথম বাধাটা কাটিয়ে সাহস করে সঠিক পথে অন্যের অসুবিধা না করে লড়াইটা করে দেখাও দিকি একবার, সবাই বলবে "দেখেছো, লোকটার কলজের জোর! যা বলে তাই করে দেখায় কিন্তু। লড়াইটা দেখলে?"
জৈব মারণাস্ত্র ব্যাপারটা সত্যি কিনা, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত সৎপ্রচেষ্টার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল থালা বাজানো আর কেমন ভুল পদ্ধতিতে কাশি ঢাকতে হবে এই নিয়ে খিল্লি করা, এবং আশ্চর্য সব গুজবের ভিডিও শেয়ার করার ফাঁকে ফাঁকে, এই ক্রাইসিস মিটে গেলে 'কেবল নিজেরটি ছাড়া কিছু বুঝিনা' এই মুখোশটা সরিয়ে ফেলে সত্যিকারের একজন স্বাস্থ্যসচেতন, নাগরিক-দায়িত্ব সচেতন, সুনাগরিক হয়ে দেখাও দিকি। আমি জানি তুমি ঠিক পারবে। কারণ আদতে তুমি সেরকমই। এই ক্রাইসিস তোমার মুখোশটা খুলে নিক এই শুভেচ্ছা রইলো। যেটা তুমি নানান ভয়ে কেবল খুলে উঠতে পারছো না।
এ লেখা যতক্ষণে তোমার চোখে পড়বে ততক্ষনে ওপরের স্ট্যাটিসটিক্স অনেকটাই বদলে যাবে, দুৰ্ভাগ্যবশতঃ খারাপের দিকেই। খুব বেশি না বদলানোটা তোমার হাতেই। এবার বোলো কতোটা শক্তিধর তুমি। ভেবে দেখো বদলটা আনবে কি না?
আর আমি? ধুর বোকা। আমি তো আগে থেকেই ভীষণ ভালো। আগেই তো বললাম। আমি বাদে বাকি সকলে তো আমজনতা। আর আমজনতারই তো সব দোষ এযাবৎ কাল পর্যন্ত যখন যা যা হয়েছে।