#এই_সপ্তাহের_শেষে
৯. মাইটোকন্ড্রিয়া আর কোষীয় বিবর্তন
----------------------------------------
সেই যে নভেম্বর মাসের শেষাশেষি "মাইটোকন্ড্রিয়া আর মেদ" নিয়ে একদিন কথা বলছিলুম, তারপর তো অনেকদিন গপ্পগাছা হয়নি। সে অবশ্য আমারই দোষ। মন দিয়ে বেশ কিছু কাজকর্ম শেষ করে তারপর তাক তা ধিনা বলে একমাসের জন্য বাড়ি চলে গেলুম। আর বাড়ি গেলে বাপু আমি আর কাউক্কে চিনিনে। তারপর বাড়ি থেকে এসে এই দুসপ্তাহ হলো থিতু হয়ে বসেছি। এবার একটু গপ্প করা যেতেই পারে আপনাদের সাথে। হ্যাঁ কি যেন হচ্ছিলো? মাইটোকন্ড্রিয়া। তা মাইটোকন্ড্রিয়া ব্যাপারটা কি সেটা তো আগের গল্পেই বলেছি। ওই যে, #এই_সপ্তাহের_শেষে - র ৮ নম্বর গল্প, যার নাম নাকি "মাইটোকন্ড্রিয়া আর মেদ।"
কিন্তু আজকের গল্প শুরু করার আগে, আগের দিন কোষ নিয়ে দুটো কথা বলেছিলাম, সেকথা গুলি আবার একবার না বললেই নয়। নইলে আজকের গল্প করা যাবে না। আপনারা ভুলে যান যদি, আপনাকে আমিই নয় মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে কষ্ট করে আমার ওয়াল ধরে নেমে যেতে হবে না।
আগের দিন যা লিখেছিলাম:
"মনে করুন একটা থকথকে জেলিজাতীয় জিনিস। রাসায়নিক দিয়েই বানানো। তবে মানুষের তৈরী কারখানায় নয়। প্রকৃতি নিজেই তৈরী করেছে। এবার মনে করুন সেই জেলি জাতীয় পদার্থটিকে দুটি পাতলা পর্দা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। যাতে ওই জেলি বেরিয়ে আসতে না পারে। এটিই আপাতত ধরে নিন আমাদের কোষ। এবার মনে করুন, ওই পর্দা মোড়া জেলির মধ্যে আরো একটি ছোট সাইজের পর্দা মোড়া জেলি রয়েছে। ওই একই ধরণের ডাবল পর্দা। তা এই ঘরের মধ্যে ঘর কেন? কারণ আছে! ওই ঘরের মধ্যেকার ঘরের ভেতরে আছে অনেক ছোট ছোট বেঁটে মোটা সুতো। এমনি সুতো নয় রীতিমত মাঞ্জা মারা সুতো। একে অন্যের ঘাড়ে উঠে আছে বটে ওই ছোট্ট জায়গায় সবাই মিলে থাকতে হবে তো। কিন্তু ভীষণ পরিপাটি এরা। কেউ কারো সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে নেই। এই সুতোগুলোর নাম ধরে নিন ক্রোমোসোম (Chromosome) আর এই মাঞ্জা মারা সুতোর ভেতরের আসল সুতোটা হলো গিয়ে আমাদের ডিএনএ (DNA)। আর মাঞ্জাটা হলো গিয়ে এই ডিএনএ কে রক্ষা করার (এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার) জন্য কিছু প্রোটিন। তাদের মধ্যে প্রধান ধরণের প্রোটিনগুলোর নাম ধরে নিন হিস্টোন (Histone)। আর এই পর্দা ঘেরা ঘরের ভেতর ঘরটি, যেখানে এই ক্রোমোসোমগুলি গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেটি হলো গিয়ে নিউক্লিয়াস (Nucleus)। আর নিউক্লিয়াসের বাইরের পর্দা ঘেরা জেলিটি হলো গিয়ে আমাদের কোষের সাইটোপ্লাজম বা সাইটোসল (Cytoplasm/ Cytosol)। 'সাইটো' মানে কোষ। কোষের সল্যুশন তাই সাইটোসল আর কি। তা এখন এই সাইটোসলে অনেক ধরণের জিনিসপত্র ওই থকথকে জেলির মধ্যে আটকে থাকে। আলাদা আলাদা তাদের কাজ, আলাদা আলাদা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন তাদের নাম। তাদের সবার গল্প একদিনে বলা যাবে না। এখন একজনের কথা বলি, সে আবার নিজেও ওরকম ডাবল পর্দা ঘেরা একটা ছোট লম্বাটে গোল জিনিস। সংখ্যায় অনেক। সবাই মিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সাইটোসলে। বহু বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবীর যখন ছোটকাল, তখন নাকি এরা ছিল পুঁচকে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া। তারা কোনো কারণে প্রাণী কোষে ঢুকে পড়েছিল। আর প্রাণী কোষও কোনো কারণে দেখেছিলো এদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে বের করে দেওয়ার থেকে সাথে রেখে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক উপকার করে ব্যাটারা। "সেই থেকে রয়ে গেছে।" কোষের কাজকর্ম চালাতে গেলে শক্তি লাগে তো? আপনার খাবার দাবার থেকে সেই শক্তি তৈরী করে এরা প্রধানত। এছাড়াও হাজার একটা কাজ করে এরা। যত দিন যাচ্ছে এই একদা পরজীবী এখন কোষের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ছোট্ট জিনিসগুলির অপরিমেয় গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। এদের নাম মাইটোকন্ড্রিয়া (Mitochondria)। এরা খানিক স্বনির্ভরও বটে। নিজের সংখ্যা কোষের মধ্যে নিজেরাই বাড়াতে পারে। মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এরা কোষের।"
এই পর্যন্ত আগের গল্পে বলাই ছিল। তারপর তো সে মাইটোকন্ড্রিয়া কি করে শক্তি তৈরী করে আর আমাদের শরীরের মেদ তৈরী হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সেসব গল্প করেছিলাম। আজকে বরং একটু অন্য গল্প করা যাক। খুব মজাদার গল্প। গল্পটা হলো, ওই যে আগের দিন বলেছিলাম বা আজকেও পুনরাবৃত্তি করলাম না, যে, "মাইটোকন্ড্রিয়া ছিল পুঁচকে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া। বহু বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবীর যখন ছোটকাল, তখন নাকি তারা কোনো কারণে প্রাণী কোষে ঢুকে পড়েছিল। আর প্রাণী কোষও কোনো কারণে দেখেছিলো এদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে বের করে দেওয়ার থেকে সাথে রেখে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।" আজকে বরং সেই নিয়ে খানিক গপ্প করি। কি বলেন?
মানে কথাটা হলো গিয়ে, হঠাৎ করে প্রাণীকোষ কেনই বা বাইরের একটা ব্যাকটেরিয়াকে নিজের ঘরে ঢুকতে জায়গা দিলো? তাও আবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থেকে যাবার কড়ারে। আর মাইটোকন্ড্রিয়াই বা কেন স্বাধীনতা খুইয়ে শরণার্থী হিসেবে থেকে যেতে রাজি হলো? যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন নয় এটা? বলুন?
আসল ব্যাপারটা বলি তবে। ওই যে কোষ বলছি, বিবর্তনের কাহিনী অনুসারে প্রথম যুগের কোষগুলির আবার ওই ভেতরের নিউক্লিয়াস টিউক্লিয়াস কিচ্ছুটি ছিল না। শুধু ওই ডবল পর্দা ঘেরা সাইটোসল। আর তার মধ্যে ডিএনএ গুলো ছত্রখান হয়ে রয়েছে। ঠিকঠাক নিউক্লিয়াস বলে কিছু নেই। এদের মতন কোষ এখনো দেখা যায় যদিও। যেমন নানান ব্যাক্টেরিয়া। এদের নাম বড়রা দিয়েছেন "প্রোক্যারিওটিক কোষ" 'প্রো' মানে আদিম অর্থে আর কি। আর এদের চাইতে যারা কিঞ্চিৎ লায়েক হয়েছে অর্থাৎ আমাদের বা গাছেদের দেহের কোষগুলি, তাদের ঠিকঠাক নিউক্লিয়াস আছে, তার সাথে সাথে মাইটোকন্ড্রিয়ার মতন আরো নানান সহায়ক জিনিসপত্র আছে তারা হলো গিয়ে "ইউক্যারিওটিক কোষ।" অর্থাৎ বিভিন্ন কাজ করার জন্য বিভিন্ন পর্দা ঘেরা জায়গা। সকলের সব কাজ ঠিকঠাক চললে, তবেই কিনা গোটা কোষটি ঠিকঠাক কাজ করবে। একদম সমবায় পদ্ধতি। এসব তো আমরা সবাই ইস্কুলে থাকতেই পড়েছি, তাই না? তাও বললাম এই কারণে যে মাইটোকন্ড্রিয়ার স্বাধীনতা খোয়ানোর গল্পে ঢুকতে গেলে এই এই শিবের গীতটা গাইবার দরকার আছে।
এই যে বলছি বহু বহু বছর আগে মাইটোকন্ড্রিয়া প্রাণিকোষে ঢুকে পড়েছিল, এটা একটু ভুল কথা। আসল কথাটা হচ্ছে, প্রাণীকোষই নিজের স্বার্থে মাইটোকন্ড্রিয়াকে গিলে ফেলেছিলো। কারণটা বলি তবে। পৃথিবীর কৈশোর কালে আবহাওয়ায় অক্সিজেন বলে কোনো কিছু ছিল না। এক্কেবারে ছিলোনা বললে অবশ্য ভুল হবে। বিভিন্ন যৌগের সাথে যুক্ত অবস্থায়, পাথুরে ভূমির নানান খনিজের সাথে মিলে অক্সাইড তৈরী করে অবশ্যই ছিল। কিন্তু বাতাসে মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস হিসেবে ছিল না। আমরা যা প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে চোঁ-চোঁ করে নিয়ে চলেছি প্রতি সেকেন্ডে সেই মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস।আমাদের বর্তমানে বাতাসে অক্সিজেনের ভাগ মোটামুটি কুড়ি শতাংশ ধরতে পারেন। এই কুড়ি শতাংশ অক্সিজেনের কণামাত্র কমে গেলেই, মানে ওই পাহাড়ি জায়গায় গেলে-টেলে যেমন হয় আর কি, আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। তাহলে তখন ওই অক্সিজেনবিহীন আবহাওয়ায় কোষ বাঁচত কি করে? গোদা বাংলায় বললে, শ্বাস নিত কি করে? পদ্ধতি ছিল। কি সেই পদ্ধতি? পদ্ধতি বলার আগে দুটো লাইনে বলে নিই বর্তমানে আমাদের শ্বাস নেওয়া মানে আসলে ব্যাপারটা কি। ব্যাপারটা আসলে কিছুই নয়, আমাদের খাবার দাবার থেকে শক্তি উৎপাদনের জন্য মানে ATP তৈরির (গতদিনেই বলেছি) জন্য একদম শেষ ধাপে একটি জারণ প্রক্রিয়া থাকে। মানে ওই যে ক্লাস এইটের বইতে জারণ-বিজারণ পড়েছিলাম না, সেই। আপনি দরকার নেই বলে একটি ইলেক্ট্রন ছাড়লেন, আর আমি, ভীষণ দরকার বলে সেই ইলেক্ট্রনটা টপ করে নিজের ঝুলিতে ভরে নিলুম। এবার আমি হলাম 'জারিত' বা oxidized আর আপনি হলেন গিয়ে 'বিজারিত' বা reduced। আবার আমি যেহেতু oxidized হলাম আপনার দ্বারা, তাই আপনার oxidizing ক্ষমতা আছে। মানে আপনি ইলেক্ট্রন ছাড়তে পারেন। আপনার মতন এরকম একখানি oxidizing ক্ষমতাওয়ালা একটা মৌলের দরকার হবেই হবে শক্তি তৈরির শেষ ধাপে। এটিই হলো রেস্পিরেশন বা শ্বসনের কারণ। এটির দরকার না হলে এই চোঁ-চোঁ করে অক্সিজেন টানার বিশেষ কিছু দরকার নেই। কারণ অক্সিজেনের ওই জারণ করার বা oxidizing ক্ষমতা মারাত্মক। অর্থাৎ সে ইলেক্ট্রন ডোনার হিসেবে কাজ করে আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদনের সময়।
এখন বাতাসে যখন অক্সিজেন ছিল না, কোষগুলি তাহলে তখন এই ইলেক্ট্রন কথা থেকে পেতো? পেতো প্রধানত সালফার বা নাইট্রোজেন থেকে। তখন পৃথিবীর বাতাস অনেকটা আগ্নেয়গিরির বাতাসের মতন ছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে। আগ্নেয়গিরির আশেপাশে বা এখন যেমন অনেক উষ্ণ প্রস্রবণের আশেপাশে বেশ রঙিন পাথর বা জলে শ্যাওলার মত রঙিন সর দেখা যায় না? ওই রঙিন ব্যাপারটা হলো আগ্নেয়গিরির সালফারকে ব্যবহার করে শ্বাস নেওয়া সালফার ব্যাকটেরিয়ার দল। তো যা বলছিলাম। বাতাসে তখন সালফার ভর্তি। আমাদের আজকের কোষের পূর্বপুরুষরা তখন সালফার বা নাইট্রোজেন কে ব্যবহার করে দিব্য রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো অসুবিধা নেই। আস্তে আস্তে সূর্যের তেজ কমছে। জগৎ ঠান্ডা হচ্ছে। এবারেই আমাদের গল্পের শুরু। এমতাবস্থায়, কিছু অকালপক্ক ব্যাকটেরিয়া করলো কি, সূর্যের আলো, মাটিতে জমে থাকা কার্বনেট যৌগ গুলোকে ভেঙে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর দরকার মত সালফারকে ব্যবহার করে নিজেদের খাবার নিজেদের দেহেই বানিয়ে নিতে শুরু করলো। মানে গাছেদের আজকের সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis) পদ্ধতির এক্কেবারে আদিম অবস্থা। এ বার তো তারা মজা পেয়ে গেল, কারণ খাবারের কোনো অভাব হচ্ছে না। সুতরাং ঝাড়ে-বংশে বাড়তে শুরু করলো এই রাঁধুনে ব্যাকটেরিয়ার দল। এরা হলো সায়ানোব্যাকটেরিয়া (Cyanobactria)।
এইবার একখান মুশকিল শুরু হলো বুঝলেন। প্রাণঘাতী ঝামেলা। কিরকম?
এই সায়ানোব্যাক্টেরিয়ার আশেপাশে যেসব অন্য কোষগুলি ছিল যাদের কিনা এই রান্না করার ক্ষমতা নেই, তারা পড়লো ঝামেলায়। এক তো সায়ানোব্যাক্টেরিয়ারা সংখ্যায় এতটাই বাড়ছে যে অন্যদের জায়গা ছেড়ে দিতে দিতে কোনঠাসা অবস্থা। যেমন হয় আর কি এখনো সব জায়গায়। উপরন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া এই যে, এই নতুন রাঁধুনে সায়ানোব্যাক্টেরিয়ারা শুধু রান্নাই করে তা নয়। রান্না করার সাথে সাথে ভুসভুস করে অক্সিজেন ছাড়ে বাতাসে। রান্নায় উৎপন্ন সাইড প্রোডাক্ট। মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস। গাছেরা সালোকসংশ্লেষ করতে গিয়ে যা করে আর কি। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই বাতাসে মুক্ত অক্সিজেনের মাত্রা হু হু করে বাড়তে শুরু করলো। কারণ তখনও পর্যন্ত বাতাসের মুক্ত অক্সিজেনকে ব্যবহার করে শ্বাস নেওয়ার কেউ নেই। আগেই বলেছি অক্সিজেনের জারণ করার ক্ষমতা বা oxidizing power মারাত্মক। এখন এই জারণ ক্ষমতা তো "কবে আমাকে কেউ ATP তৈরীর জন্য ব্যবহার করবে, তবে আমি তাকে জারিত করবো"- এই আশায় বসে থাকবে না, তাই না? সে যাকে সুবিধে বুঝবে তাকেই জারিত করবে। সুতরাং এই বর্ধিত অক্সিজেনওয়ালা বাতাসে থেকে কোষেদের বাইরের দিকের পর্দার প্রোটিন, তারপর সেই অক্সিজেন ভেতরে ঢুকে ভেতরের নানান প্রোটিন, লিপিড, কার্বোহাইড্রেট যাকে পারল তাকেই দুমদাড়াক্কা oxidized করতে শুরু করলো। কেউ আর তার নির্দিষ্ট কাজ করতে পারছে না। কেউ বেশি করছে, কেউ কম করছে, কেউ একদম অকর্মন্যই হয়ে পড়ছে। কেউবা এমন ভুলভাল কিছু করছে তাতে কোষটির বেঁচে থাকাটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফল হলো মারাত্মক। কোষেদের সব কাজ কর্ম গোল্লায় গেছে। প্রবল অরাজকতা বলতে পারেন। এই অরাজকতার নাম 'oxidative stress'।
এই গন্ডগোল এখনো আছে আমাদের শরীরে। তার মোকাবিলা করার হাতিয়ারও জোগাড় করেছি আমরা। সেসব গল্প নয় অন্য আর একদিন হবে। এখন যা বলছিলাম বলি।
তা এই 'oxidative stress' এর মোকাবিলা তো করতে হবে। নইলে এই অক্সিজেনের জ্বালায় তো কোষেদের ভবলীলা সাঙ্গ হবার জোগাড়। কি করা যায়? নানান রকম কোষ তখন নানান পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করছে।এমন সময়, একধরণের কোষ, যে কিনা প্রোক্যারিওটিক কোষের চাইতে একটু উন্নত প্রজাতির কোষেদের মধ্যে একজন, সে নজর করল যে এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়াল কোষ, মানে নিচু জাতের প্রোক্যারিওট, সে ব্যাটা এই মারাত্মক oxidative stress কে তুশ্চু করে দিব্য বেঁচে থাকছে, বাচ্চাও পাড়ছে। এদের নাম "আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়া" (alphaproteobactria)। অন্যদের যেখানে সেই আবহাওয়ায় বেঁচে থাকাটাই দুস্কর। কারণ এই পুঁচকে ব্যাক্টেরিয়াগুলোর দেহে oxidative stress এর মোকাবিলা করার মত দরকারি উৎসেচক আছে। তারা সেটা তৈরী করতে পারে। সুতরাং তারা সহজেই oxidative stress জনিত মরণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারে। ধীরে ধীরে সে ক্ষমতা তারা তৈরী করেছে। তো আমাদের এই উচ্চ বংশীয় কোষ, যার গোত্র নাকি ছিল গিয়ে 'আর্কিব্যাকটেরিয়া' (archaebacteria) বা সংক্ষেপে আর্কিয়া (archaea), এরা দেখলো, এই আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়াকে যদি ভুজুং ভাজুং দিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসানো যায় তাহলে তাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে বেশ বাঁচিয়ে নেওয়া যায়। সুতরাং এই আর্কিয়া বুদ্ধি করে আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়াকে বেমালুম গপ্ করে গিলে ফেললো। তার আগে অবশ্য "এস এস গর্তে এস, বাস করে যাও চারটি দিন, আদর করে শিকেয় তুলে রাখবো তোমায় রাত্রিদিন" বলে বেশ তোয়াজ করেছিল হয়তো। আর সেসব মুধু মাখা বাক্যে গলে গিয়ে আমাদের আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়া দিব্য হাসি মুখে আর্কিয়ার ঘরে গিয়ে উঠলো। আর যেমন হয়, আর্কিয়া সুচতুর ভাবে অতিথির পয়সায় ওষুধ খেয়ে যেতে লাগলো। মানে আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়ার তৈরী করা উত্সেচকের সাহায্যে নিজের oxidative damage মেরামত করে নিতে লাগলো। আর বর্ধিত অক্সিজেনওয়ালা আবহাওয়ায় দিব্যি অন্যদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেঁচে রইলো। এই যে বিশেষ পরিবর্তন তার হলো তাকে সেজন্য নাম দেওয়া হয়েছে 'লোকীআর্কিয়া' (Lokiarchaea)। মানে ওই নর্স উপকথার দুস্টু ছদ্মবেশী দেবতা 'লোকী'-র নামে আর কি। আর এই বিশেষ ধরণের আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়া'-ই হলো আমাদের আজকের 'মাইটোকন্ড্রিয়া'।
এখন একটাই প্রশ্ন বাকি রইলো, মাইটোকন্ড্রিয়া কেন এই ব্যবস্থা মেনে নিলো? সে স্বাধীনতা খুইয়ে প্রথমে অন্যের অতিথি আর পরে পরাধীন শরণার্থী হয়ে রয়ে গেলো কেন? এর কারণ হলো, মাইটোকন্ড্রিয়ার স্বাধীনতা লোকীআর্কিয়া পুরোপুরি নষ্ট করেনি। বিজনেস স্ট্র্যাটেজি। বুঝলেন কিনা? পুরোপুরি মাইক্রোম্যানেজ করলে তো দুধেল গরু দড়ি ছিড়ে পালাতে চাইবেই। সুতরাং খানিক স্বাধীনতা দাও। মানে এই যে- তুমি নিজের মত সংখ্যায় বাড়তে পারবে, নিজের প্রয়োজনের বেশ কিছু প্রোটিন নিজেই তৈরী করতে পারবে, এইসব আর কি। আমায় বাপু ওই মহৌষধী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এর অ্যান্টি) উৎসেচকের সরবরাহ দিলেই চলবে। মাইটোকন্ড্রিয়া ভাবলো, মন্দ কি? বাইরে এত হয় ঝাপ্টার মধ্যে বেঁচে থাকার কষ্ট না করে বেশ একটা ঘর পাওয়া গেল। আর নিজের জন্য বানানো ওষুধ থেকে বাড়িওয়ালাকে খানিক নয় দেওয়াই গেল। সুতরাং সে লম্বা সময়ের জন্য অতিথি হত সম্মত হলো। কিন্তু আর্কিয়া বিজনেসটা বেশ ভালোই বুঝতো বুঝলেন। সে চুপিচুপি এমন ব্যবস্থা করলো যে, মাইটোকন্ড্রিয়ার বেশ কিছু ভীষণ দরকারি প্রোটিন "এই নাও এটা তোমার জন্য আমিই বানিয়ে দিচ্ছি" বলে তার দায়িত্ব নিলো। প্রথমে হয়ত মাইটোকন্ড্রিয়া ভেবেছিলো, ভালোই তো, খাটতে হচ্ছে না। কিন্তু পরে দেখা গেলো, ওই প্রোটিন গুলো তৈরী করার সমস্ত যন্ত্রপাতি আছে বা চলে গেছে আমাদের লোকীআর্কিয়ার কবলে। মাইটোকন্ড্রিয়া নিজে থেকে ওই প্রোটিনগুলো আর তৈরী করতে পারে না। আস্তে আস্তে সেই ক্ষমতা মাইটোন্ড্রিয়া থেকে আর্কিয়া নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছে মাইটোকন্ড্রিয়াকে পুরোপুরিভাবে ঘরবন্দি করার ব্যবস্থা পাকা করতে। মাইটোকন্ড্রিয়া যতদিনে একথা বুঝতে পারলো ততদিনে সে অতিথি থেকে পঙ্গু শরণার্থী হয়ে গেছে। যে বাইরে গিয়ে একা বেঁচে থাকার ক্ষমতা হারিয়েছে।
এই হলো গল্প। কেমন চেনা চেনা লাগছে না গল্পটা?
সেই থেকে সেই লোকীআর্কিয়ার দেহে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে রয়ে গেছে মাইটোকন্ড্রিয়া। আর লোকীআর্কিয়া বিবর্তনের পথে চলতে চলতে নানান দরকারি জিনিস জড়ো করে পরিণত হয়েছে আজকের উন্নত ইউক্যারিওটিক কোষে। আর নতুন গল্প এই যে, নতুন আবিষ্কার বলছে- এই ঘটনা সেইদিন শুধু লোকীআর্কিয়ার দেহেই হয়নি। আরো অন্তত চারধরণের আর্কিয়া পাওয়া গেছে যাদের দেহে এই একইরকম পদ্ধতিতে মাইটোকন্ড্রিয়া ঢুকেছিলো। তাদের কি নামকরণ করা হয়েছে বলুন দিকি? খুব সোজা তো। 'লোকী' তো ছিলই। বাকিরা হলো -'থর', 'ওডিন', 'হেইমডেল' আর 'হেল'।
আচ্ছা আজ তবে আসি। অনেক গল্প হলো।
ভালো থাকুন সক্কলে।
অর্পিতা
সেই যে নভেম্বর মাসের শেষাশেষি "মাইটোকন্ড্রিয়া আর মেদ" নিয়ে একদিন কথা বলছিলুম, তারপর তো অনেকদিন গপ্পগাছা হয়নি। সে অবশ্য আমারই দোষ। মন দিয়ে বেশ কিছু কাজকর্ম শেষ করে তারপর তাক তা ধিনা বলে একমাসের জন্য বাড়ি চলে গেলুম। আর বাড়ি গেলে বাপু আমি আর কাউক্কে চিনিনে। তারপর বাড়ি থেকে এসে এই দুসপ্তাহ হলো থিতু হয়ে বসেছি। এবার একটু গপ্প করা যেতেই পারে আপনাদের সাথে। হ্যাঁ কি যেন হচ্ছিলো? মাইটোকন্ড্রিয়া। তা মাইটোকন্ড্রিয়া ব্যাপারটা কি সেটা তো আগের গল্পেই বলেছি। ওই যে, #এই_সপ্তাহের_শেষে - র ৮ নম্বর গল্প, যার নাম নাকি "মাইটোকন্ড্রিয়া আর মেদ।"
কিন্তু আজকের গল্প শুরু করার আগে, আগের দিন কোষ নিয়ে দুটো কথা বলেছিলাম, সেকথা গুলি আবার একবার না বললেই নয়। নইলে আজকের গল্প করা যাবে না। আপনারা ভুলে যান যদি, আপনাকে আমিই নয় মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে কষ্ট করে আমার ওয়াল ধরে নেমে যেতে হবে না।
আগের দিন যা লিখেছিলাম:
"মনে করুন একটা থকথকে জেলিজাতীয় জিনিস। রাসায়নিক দিয়েই বানানো। তবে মানুষের তৈরী কারখানায় নয়। প্রকৃতি নিজেই তৈরী করেছে। এবার মনে করুন সেই জেলি জাতীয় পদার্থটিকে দুটি পাতলা পর্দা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। যাতে ওই জেলি বেরিয়ে আসতে না পারে। এটিই আপাতত ধরে নিন আমাদের কোষ। এবার মনে করুন, ওই পর্দা মোড়া জেলির মধ্যে আরো একটি ছোট সাইজের পর্দা মোড়া জেলি রয়েছে। ওই একই ধরণের ডাবল পর্দা। তা এই ঘরের মধ্যে ঘর কেন? কারণ আছে! ওই ঘরের মধ্যেকার ঘরের ভেতরে আছে অনেক ছোট ছোট বেঁটে মোটা সুতো। এমনি সুতো নয় রীতিমত মাঞ্জা মারা সুতো। একে অন্যের ঘাড়ে উঠে আছে বটে ওই ছোট্ট জায়গায় সবাই মিলে থাকতে হবে তো। কিন্তু ভীষণ পরিপাটি এরা। কেউ কারো সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে নেই। এই সুতোগুলোর নাম ধরে নিন ক্রোমোসোম (Chromosome) আর এই মাঞ্জা মারা সুতোর ভেতরের আসল সুতোটা হলো গিয়ে আমাদের ডিএনএ (DNA)। আর মাঞ্জাটা হলো গিয়ে এই ডিএনএ কে রক্ষা করার (এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার) জন্য কিছু প্রোটিন। তাদের মধ্যে প্রধান ধরণের প্রোটিনগুলোর নাম ধরে নিন হিস্টোন (Histone)। আর এই পর্দা ঘেরা ঘরের ভেতর ঘরটি, যেখানে এই ক্রোমোসোমগুলি গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেটি হলো গিয়ে নিউক্লিয়াস (Nucleus)। আর নিউক্লিয়াসের বাইরের পর্দা ঘেরা জেলিটি হলো গিয়ে আমাদের কোষের সাইটোপ্লাজম বা সাইটোসল (Cytoplasm/ Cytosol)। 'সাইটো' মানে কোষ। কোষের সল্যুশন তাই সাইটোসল আর কি। তা এখন এই সাইটোসলে অনেক ধরণের জিনিসপত্র ওই থকথকে জেলির মধ্যে আটকে থাকে। আলাদা আলাদা তাদের কাজ, আলাদা আলাদা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন তাদের নাম। তাদের সবার গল্প একদিনে বলা যাবে না। এখন একজনের কথা বলি, সে আবার নিজেও ওরকম ডাবল পর্দা ঘেরা একটা ছোট লম্বাটে গোল জিনিস। সংখ্যায় অনেক। সবাই মিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সাইটোসলে। বহু বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবীর যখন ছোটকাল, তখন নাকি এরা ছিল পুঁচকে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া। তারা কোনো কারণে প্রাণী কোষে ঢুকে পড়েছিল। আর প্রাণী কোষও কোনো কারণে দেখেছিলো এদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে বের করে দেওয়ার থেকে সাথে রেখে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক উপকার করে ব্যাটারা। "সেই থেকে রয়ে গেছে।" কোষের কাজকর্ম চালাতে গেলে শক্তি লাগে তো? আপনার খাবার দাবার থেকে সেই শক্তি তৈরী করে এরা প্রধানত। এছাড়াও হাজার একটা কাজ করে এরা। যত দিন যাচ্ছে এই একদা পরজীবী এখন কোষের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ছোট্ট জিনিসগুলির অপরিমেয় গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। এদের নাম মাইটোকন্ড্রিয়া (Mitochondria)। এরা খানিক স্বনির্ভরও বটে। নিজের সংখ্যা কোষের মধ্যে নিজেরাই বাড়াতে পারে। মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এরা কোষের।"
এই পর্যন্ত আগের গল্পে বলাই ছিল। তারপর তো সে মাইটোকন্ড্রিয়া কি করে শক্তি তৈরী করে আর আমাদের শরীরের মেদ তৈরী হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সেসব গল্প করেছিলাম। আজকে বরং একটু অন্য গল্প করা যাক। খুব মজাদার গল্প। গল্পটা হলো, ওই যে আগের দিন বলেছিলাম বা আজকেও পুনরাবৃত্তি করলাম না, যে, "মাইটোকন্ড্রিয়া ছিল পুঁচকে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া। বহু বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবীর যখন ছোটকাল, তখন নাকি তারা কোনো কারণে প্রাণী কোষে ঢুকে পড়েছিল। আর প্রাণী কোষও কোনো কারণে দেখেছিলো এদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে বের করে দেওয়ার থেকে সাথে রেখে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।" আজকে বরং সেই নিয়ে খানিক গপ্প করি। কি বলেন?
মানে কথাটা হলো গিয়ে, হঠাৎ করে প্রাণীকোষ কেনই বা বাইরের একটা ব্যাকটেরিয়াকে নিজের ঘরে ঢুকতে জায়গা দিলো? তাও আবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থেকে যাবার কড়ারে। আর মাইটোকন্ড্রিয়াই বা কেন স্বাধীনতা খুইয়ে শরণার্থী হিসেবে থেকে যেতে রাজি হলো? যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন নয় এটা? বলুন?
আসল ব্যাপারটা বলি তবে। ওই যে কোষ বলছি, বিবর্তনের কাহিনী অনুসারে প্রথম যুগের কোষগুলির আবার ওই ভেতরের নিউক্লিয়াস টিউক্লিয়াস কিচ্ছুটি ছিল না। শুধু ওই ডবল পর্দা ঘেরা সাইটোসল। আর তার মধ্যে ডিএনএ গুলো ছত্রখান হয়ে রয়েছে। ঠিকঠাক নিউক্লিয়াস বলে কিছু নেই। এদের মতন কোষ এখনো দেখা যায় যদিও। যেমন নানান ব্যাক্টেরিয়া। এদের নাম বড়রা দিয়েছেন "প্রোক্যারিওটিক কোষ" 'প্রো' মানে আদিম অর্থে আর কি। আর এদের চাইতে যারা কিঞ্চিৎ লায়েক হয়েছে অর্থাৎ আমাদের বা গাছেদের দেহের কোষগুলি, তাদের ঠিকঠাক নিউক্লিয়াস আছে, তার সাথে সাথে মাইটোকন্ড্রিয়ার মতন আরো নানান সহায়ক জিনিসপত্র আছে তারা হলো গিয়ে "ইউক্যারিওটিক কোষ।" অর্থাৎ বিভিন্ন কাজ করার জন্য বিভিন্ন পর্দা ঘেরা জায়গা। সকলের সব কাজ ঠিকঠাক চললে, তবেই কিনা গোটা কোষটি ঠিকঠাক কাজ করবে। একদম সমবায় পদ্ধতি। এসব তো আমরা সবাই ইস্কুলে থাকতেই পড়েছি, তাই না? তাও বললাম এই কারণে যে মাইটোকন্ড্রিয়ার স্বাধীনতা খোয়ানোর গল্পে ঢুকতে গেলে এই এই শিবের গীতটা গাইবার দরকার আছে।
এই যে বলছি বহু বহু বছর আগে মাইটোকন্ড্রিয়া প্রাণিকোষে ঢুকে পড়েছিল, এটা একটু ভুল কথা। আসল কথাটা হচ্ছে, প্রাণীকোষই নিজের স্বার্থে মাইটোকন্ড্রিয়াকে গিলে ফেলেছিলো। কারণটা বলি তবে। পৃথিবীর কৈশোর কালে আবহাওয়ায় অক্সিজেন বলে কোনো কিছু ছিল না। এক্কেবারে ছিলোনা বললে অবশ্য ভুল হবে। বিভিন্ন যৌগের সাথে যুক্ত অবস্থায়, পাথুরে ভূমির নানান খনিজের সাথে মিলে অক্সাইড তৈরী করে অবশ্যই ছিল। কিন্তু বাতাসে মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস হিসেবে ছিল না। আমরা যা প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে চোঁ-চোঁ করে নিয়ে চলেছি প্রতি সেকেন্ডে সেই মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস।আমাদের বর্তমানে বাতাসে অক্সিজেনের ভাগ মোটামুটি কুড়ি শতাংশ ধরতে পারেন। এই কুড়ি শতাংশ অক্সিজেনের কণামাত্র কমে গেলেই, মানে ওই পাহাড়ি জায়গায় গেলে-টেলে যেমন হয় আর কি, আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। তাহলে তখন ওই অক্সিজেনবিহীন আবহাওয়ায় কোষ বাঁচত কি করে? গোদা বাংলায় বললে, শ্বাস নিত কি করে? পদ্ধতি ছিল। কি সেই পদ্ধতি? পদ্ধতি বলার আগে দুটো লাইনে বলে নিই বর্তমানে আমাদের শ্বাস নেওয়া মানে আসলে ব্যাপারটা কি। ব্যাপারটা আসলে কিছুই নয়, আমাদের খাবার দাবার থেকে শক্তি উৎপাদনের জন্য মানে ATP তৈরির (গতদিনেই বলেছি) জন্য একদম শেষ ধাপে একটি জারণ প্রক্রিয়া থাকে। মানে ওই যে ক্লাস এইটের বইতে জারণ-বিজারণ পড়েছিলাম না, সেই। আপনি দরকার নেই বলে একটি ইলেক্ট্রন ছাড়লেন, আর আমি, ভীষণ দরকার বলে সেই ইলেক্ট্রনটা টপ করে নিজের ঝুলিতে ভরে নিলুম। এবার আমি হলাম 'জারিত' বা oxidized আর আপনি হলেন গিয়ে 'বিজারিত' বা reduced। আবার আমি যেহেতু oxidized হলাম আপনার দ্বারা, তাই আপনার oxidizing ক্ষমতা আছে। মানে আপনি ইলেক্ট্রন ছাড়তে পারেন। আপনার মতন এরকম একখানি oxidizing ক্ষমতাওয়ালা একটা মৌলের দরকার হবেই হবে শক্তি তৈরির শেষ ধাপে। এটিই হলো রেস্পিরেশন বা শ্বসনের কারণ। এটির দরকার না হলে এই চোঁ-চোঁ করে অক্সিজেন টানার বিশেষ কিছু দরকার নেই। কারণ অক্সিজেনের ওই জারণ করার বা oxidizing ক্ষমতা মারাত্মক। অর্থাৎ সে ইলেক্ট্রন ডোনার হিসেবে কাজ করে আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদনের সময়।
এখন বাতাসে যখন অক্সিজেন ছিল না, কোষগুলি তাহলে তখন এই ইলেক্ট্রন কথা থেকে পেতো? পেতো প্রধানত সালফার বা নাইট্রোজেন থেকে। তখন পৃথিবীর বাতাস অনেকটা আগ্নেয়গিরির বাতাসের মতন ছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে। আগ্নেয়গিরির আশেপাশে বা এখন যেমন অনেক উষ্ণ প্রস্রবণের আশেপাশে বেশ রঙিন পাথর বা জলে শ্যাওলার মত রঙিন সর দেখা যায় না? ওই রঙিন ব্যাপারটা হলো আগ্নেয়গিরির সালফারকে ব্যবহার করে শ্বাস নেওয়া সালফার ব্যাকটেরিয়ার দল। তো যা বলছিলাম। বাতাসে তখন সালফার ভর্তি। আমাদের আজকের কোষের পূর্বপুরুষরা তখন সালফার বা নাইট্রোজেন কে ব্যবহার করে দিব্য রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো অসুবিধা নেই। আস্তে আস্তে সূর্যের তেজ কমছে। জগৎ ঠান্ডা হচ্ছে। এবারেই আমাদের গল্পের শুরু। এমতাবস্থায়, কিছু অকালপক্ক ব্যাকটেরিয়া করলো কি, সূর্যের আলো, মাটিতে জমে থাকা কার্বনেট যৌগ গুলোকে ভেঙে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর দরকার মত সালফারকে ব্যবহার করে নিজেদের খাবার নিজেদের দেহেই বানিয়ে নিতে শুরু করলো। মানে গাছেদের আজকের সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis) পদ্ধতির এক্কেবারে আদিম অবস্থা। এ বার তো তারা মজা পেয়ে গেল, কারণ খাবারের কোনো অভাব হচ্ছে না। সুতরাং ঝাড়ে-বংশে বাড়তে শুরু করলো এই রাঁধুনে ব্যাকটেরিয়ার দল। এরা হলো সায়ানোব্যাকটেরিয়া (Cyanobactria)।
এইবার একখান মুশকিল শুরু হলো বুঝলেন। প্রাণঘাতী ঝামেলা। কিরকম?
এই সায়ানোব্যাক্টেরিয়ার আশেপাশে যেসব অন্য কোষগুলি ছিল যাদের কিনা এই রান্না করার ক্ষমতা নেই, তারা পড়লো ঝামেলায়। এক তো সায়ানোব্যাক্টেরিয়ারা সংখ্যায় এতটাই বাড়ছে যে অন্যদের জায়গা ছেড়ে দিতে দিতে কোনঠাসা অবস্থা। যেমন হয় আর কি এখনো সব জায়গায়। উপরন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া এই যে, এই নতুন রাঁধুনে সায়ানোব্যাক্টেরিয়ারা শুধু রান্নাই করে তা নয়। রান্না করার সাথে সাথে ভুসভুস করে অক্সিজেন ছাড়ে বাতাসে। রান্নায় উৎপন্ন সাইড প্রোডাক্ট। মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস। গাছেরা সালোকসংশ্লেষ করতে গিয়ে যা করে আর কি। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই বাতাসে মুক্ত অক্সিজেনের মাত্রা হু হু করে বাড়তে শুরু করলো। কারণ তখনও পর্যন্ত বাতাসের মুক্ত অক্সিজেনকে ব্যবহার করে শ্বাস নেওয়ার কেউ নেই। আগেই বলেছি অক্সিজেনের জারণ করার ক্ষমতা বা oxidizing power মারাত্মক। এখন এই জারণ ক্ষমতা তো "কবে আমাকে কেউ ATP তৈরীর জন্য ব্যবহার করবে, তবে আমি তাকে জারিত করবো"- এই আশায় বসে থাকবে না, তাই না? সে যাকে সুবিধে বুঝবে তাকেই জারিত করবে। সুতরাং এই বর্ধিত অক্সিজেনওয়ালা বাতাসে থেকে কোষেদের বাইরের দিকের পর্দার প্রোটিন, তারপর সেই অক্সিজেন ভেতরে ঢুকে ভেতরের নানান প্রোটিন, লিপিড, কার্বোহাইড্রেট যাকে পারল তাকেই দুমদাড়াক্কা oxidized করতে শুরু করলো। কেউ আর তার নির্দিষ্ট কাজ করতে পারছে না। কেউ বেশি করছে, কেউ কম করছে, কেউ একদম অকর্মন্যই হয়ে পড়ছে। কেউবা এমন ভুলভাল কিছু করছে তাতে কোষটির বেঁচে থাকাটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফল হলো মারাত্মক। কোষেদের সব কাজ কর্ম গোল্লায় গেছে। প্রবল অরাজকতা বলতে পারেন। এই অরাজকতার নাম 'oxidative stress'।
এই গন্ডগোল এখনো আছে আমাদের শরীরে। তার মোকাবিলা করার হাতিয়ারও জোগাড় করেছি আমরা। সেসব গল্প নয় অন্য আর একদিন হবে। এখন যা বলছিলাম বলি।
তা এই 'oxidative stress' এর মোকাবিলা তো করতে হবে। নইলে এই অক্সিজেনের জ্বালায় তো কোষেদের ভবলীলা সাঙ্গ হবার জোগাড়। কি করা যায়? নানান রকম কোষ তখন নানান পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করছে।এমন সময়, একধরণের কোষ, যে কিনা প্রোক্যারিওটিক কোষের চাইতে একটু উন্নত প্রজাতির কোষেদের মধ্যে একজন, সে নজর করল যে এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়াল কোষ, মানে নিচু জাতের প্রোক্যারিওট, সে ব্যাটা এই মারাত্মক oxidative stress কে তুশ্চু করে দিব্য বেঁচে থাকছে, বাচ্চাও পাড়ছে। এদের নাম "আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়া" (alphaproteobactria)। অন্যদের যেখানে সেই আবহাওয়ায় বেঁচে থাকাটাই দুস্কর। কারণ এই পুঁচকে ব্যাক্টেরিয়াগুলোর দেহে oxidative stress এর মোকাবিলা করার মত দরকারি উৎসেচক আছে। তারা সেটা তৈরী করতে পারে। সুতরাং তারা সহজেই oxidative stress জনিত মরণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারে। ধীরে ধীরে সে ক্ষমতা তারা তৈরী করেছে। তো আমাদের এই উচ্চ বংশীয় কোষ, যার গোত্র নাকি ছিল গিয়ে 'আর্কিব্যাকটেরিয়া' (archaebacteria) বা সংক্ষেপে আর্কিয়া (archaea), এরা দেখলো, এই আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়াকে যদি ভুজুং ভাজুং দিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসানো যায় তাহলে তাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে বেশ বাঁচিয়ে নেওয়া যায়। সুতরাং এই আর্কিয়া বুদ্ধি করে আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়াকে বেমালুম গপ্ করে গিলে ফেললো। তার আগে অবশ্য "এস এস গর্তে এস, বাস করে যাও চারটি দিন, আদর করে শিকেয় তুলে রাখবো তোমায় রাত্রিদিন" বলে বেশ তোয়াজ করেছিল হয়তো। আর সেসব মুধু মাখা বাক্যে গলে গিয়ে আমাদের আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়া দিব্য হাসি মুখে আর্কিয়ার ঘরে গিয়ে উঠলো। আর যেমন হয়, আর্কিয়া সুচতুর ভাবে অতিথির পয়সায় ওষুধ খেয়ে যেতে লাগলো। মানে আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়ার তৈরী করা উত্সেচকের সাহায্যে নিজের oxidative damage মেরামত করে নিতে লাগলো। আর বর্ধিত অক্সিজেনওয়ালা আবহাওয়ায় দিব্যি অন্যদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেঁচে রইলো। এই যে বিশেষ পরিবর্তন তার হলো তাকে সেজন্য নাম দেওয়া হয়েছে 'লোকীআর্কিয়া' (Lokiarchaea)। মানে ওই নর্স উপকথার দুস্টু ছদ্মবেশী দেবতা 'লোকী'-র নামে আর কি। আর এই বিশেষ ধরণের আলফা-প্রোটিও-ব্যাকটেরিয়া'-ই হলো আমাদের আজকের 'মাইটোকন্ড্রিয়া'।
এখন একটাই প্রশ্ন বাকি রইলো, মাইটোকন্ড্রিয়া কেন এই ব্যবস্থা মেনে নিলো? সে স্বাধীনতা খুইয়ে প্রথমে অন্যের অতিথি আর পরে পরাধীন শরণার্থী হয়ে রয়ে গেলো কেন? এর কারণ হলো, মাইটোকন্ড্রিয়ার স্বাধীনতা লোকীআর্কিয়া পুরোপুরি নষ্ট করেনি। বিজনেস স্ট্র্যাটেজি। বুঝলেন কিনা? পুরোপুরি মাইক্রোম্যানেজ করলে তো দুধেল গরু দড়ি ছিড়ে পালাতে চাইবেই। সুতরাং খানিক স্বাধীনতা দাও। মানে এই যে- তুমি নিজের মত সংখ্যায় বাড়তে পারবে, নিজের প্রয়োজনের বেশ কিছু প্রোটিন নিজেই তৈরী করতে পারবে, এইসব আর কি। আমায় বাপু ওই মহৌষধী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এর অ্যান্টি) উৎসেচকের সরবরাহ দিলেই চলবে। মাইটোকন্ড্রিয়া ভাবলো, মন্দ কি? বাইরে এত হয় ঝাপ্টার মধ্যে বেঁচে থাকার কষ্ট না করে বেশ একটা ঘর পাওয়া গেল। আর নিজের জন্য বানানো ওষুধ থেকে বাড়িওয়ালাকে খানিক নয় দেওয়াই গেল। সুতরাং সে লম্বা সময়ের জন্য অতিথি হত সম্মত হলো। কিন্তু আর্কিয়া বিজনেসটা বেশ ভালোই বুঝতো বুঝলেন। সে চুপিচুপি এমন ব্যবস্থা করলো যে, মাইটোকন্ড্রিয়ার বেশ কিছু ভীষণ দরকারি প্রোটিন "এই নাও এটা তোমার জন্য আমিই বানিয়ে দিচ্ছি" বলে তার দায়িত্ব নিলো। প্রথমে হয়ত মাইটোকন্ড্রিয়া ভেবেছিলো, ভালোই তো, খাটতে হচ্ছে না। কিন্তু পরে দেখা গেলো, ওই প্রোটিন গুলো তৈরী করার সমস্ত যন্ত্রপাতি আছে বা চলে গেছে আমাদের লোকীআর্কিয়ার কবলে। মাইটোকন্ড্রিয়া নিজে থেকে ওই প্রোটিনগুলো আর তৈরী করতে পারে না। আস্তে আস্তে সেই ক্ষমতা মাইটোন্ড্রিয়া থেকে আর্কিয়া নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছে মাইটোকন্ড্রিয়াকে পুরোপুরিভাবে ঘরবন্দি করার ব্যবস্থা পাকা করতে। মাইটোকন্ড্রিয়া যতদিনে একথা বুঝতে পারলো ততদিনে সে অতিথি থেকে পঙ্গু শরণার্থী হয়ে গেছে। যে বাইরে গিয়ে একা বেঁচে থাকার ক্ষমতা হারিয়েছে।
এই হলো গল্প। কেমন চেনা চেনা লাগছে না গল্পটা?
সেই থেকে সেই লোকীআর্কিয়ার দেহে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে রয়ে গেছে মাইটোকন্ড্রিয়া। আর লোকীআর্কিয়া বিবর্তনের পথে চলতে চলতে নানান দরকারি জিনিস জড়ো করে পরিণত হয়েছে আজকের উন্নত ইউক্যারিওটিক কোষে। আর নতুন গল্প এই যে, নতুন আবিষ্কার বলছে- এই ঘটনা সেইদিন শুধু লোকীআর্কিয়ার দেহেই হয়নি। আরো অন্তত চারধরণের আর্কিয়া পাওয়া গেছে যাদের দেহে এই একইরকম পদ্ধতিতে মাইটোকন্ড্রিয়া ঢুকেছিলো। তাদের কি নামকরণ করা হয়েছে বলুন দিকি? খুব সোজা তো। 'লোকী' তো ছিলই। বাকিরা হলো -'থর', 'ওডিন', 'হেইমডেল' আর 'হেল'।
আচ্ছা আজ তবে আসি। অনেক গল্প হলো।
ভালো থাকুন সক্কলে।
অর্পিতা