#এই_সপ্তাহের_শেষে
২. ওষুধ আবিষ্কার (পর্ব-১)
-------------------------------
'শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার বাঙালি বিজ্ঞানীর।'
ধরা যাক, রোব্বারের সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি খবরের কাগজটি খুললেন বা ফেসবুকের পাতাটি স্ক্রল করতে শুরু করলেন আর এরকম একটি শিরোনাম দেখতে পেলেন। অনেকসময় এরকম ধরণের খবর পড়া যায় তো পত্র-পত্রিকায়, ফেসবুকেও। তাই না? আপনি বেজায় উত্তেজিত হয়ে খবরটি পড়তে শুরু করলেন। সাধারণত এধরণের খবরের জন্য খবরের কাগজে বিশেষ বেশি জায়গা খরচ হয়না। সুতরাং খবরের সংক্ষিপ্ততার জন্য চটপট খবরটি পড়ে ফেলতে আমাদের কারোরই কোনো অসুবিধা হলো না। তারপর আপনার চেনা জানা কারো প্রয়োজনের সময় দেখা গেল, ওই পরিবেশিত খবরটি কোনো কাজেই লাগছে না। যে নতুন ওষুধটির কথা বলা হয়েছিল, সেটি দিয়ে চিকিৎসা তো হচ্ছে না। তখন আপনার মনে দুই ধরণের ভাবনা আসতে পারে। এক, পরবর্তী সময়ে এরকম কোনো খবর আসলে আপনি বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে পাতা উল্টে চলে যাবেন। এবং "রিসার্চ-ফিসার্চ করে আদতে কিস্যু হচ্ছে না"- এই ধারণা আপনার দৃঢ় হবে। আর দুই, 'বায়ো-মেডিকেল সায়েন্টিস্ট' বলে একদল লোক আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি এবং নতুন ওষুধ এনে যুগের পর যুগ ধরে চিকিৎসা শাস্ত্রকে আধুনিকতা প্রদান করে চলেছেন এবং অসংখ্য ডাক্তারদের হাত ধরে আপনার প্রেসক্রিপশনে সে আধুনিক চিকিৎসার ছোঁয়া লাগছে সে সম্পর্কে আপনি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেবার প্রয়োজন অনুভব করবেন না।
তাহলে পরিবেশিত খবরটি কি ভুয়ো? খবরের মূল বিষয়টি ভুয়ো নাও হতে পারে, কিন্তু পরিবেশনাটি ভুল নিঃসন্দেহে। কারণ হয়ত খবরটি এরকম ছিল, 'অমুক গবেষণা কেন্দ্রের অমুক বিজ্ঞানী দেখেছেন, অমুক জিনিসটি প্রয়োগ করলে অমুক ক্যান্সারের কোষ মারা যাচ্ছে। তিনি এবং তাঁর দল বিষয়টি অমুক জার্নালে প্রকাশ করেছেন।' এই পর্যন্ত খবরটি সঠিক। এরকম অজস্র আবিষ্কার অহরহ হয়ে চলেছে। কিন্তু সমস্যা পরের অংশ টুকু নিয়ে। কোনো একটি জিনিসে ক্যান্সারের কোষ মারা যাওয়া মানেই সেই জিনিসটি কোনো ডাক্তার কোনো রোগীর প্রেসক্রিপশনে লিখতে পারেন না। আর আগে পরে অজস্র ধাপ থাকে। ভ্যালিডেশনের। সুতরাং খবরের ওই "ওষুধ আবিষ্কার" শব্দবন্ধটি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল এবং সংবাদ পরিবেশকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক ছাড়া কিচ্ছু নয়।
তাহলে "ওষুধ আবিষ্কার" কথাটি বলার সময় কখন আসবে?
মনে করা যাক, এরকমই একটা উদাহরণ, 'কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়না।' এটা সত্যি সত্যি কোনো খবর নয়, কোনো কাগজেও বেরোয়নি। এমনি উদাহরণ হিসেবে 'কলমিশাক' কথাটা ব্যবহার করছি (এইমাত্র ভাত দিয়ে খেলাম তো, তাই ঐটাই মনে পড়ছে এখন)। এই 'কলমিশাক' কথাটির জায়গায় আপনারা X, Y, Z যেকোনো কেমিক্যাল বা বায়োলজিক্যাল কম্পাউন্ড বসিয়ে নিতে পারেন। এখন এই কথাটি থেকে কলমিশাককে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনে লেখার মাঝে রয়েছে অজস্র প্রশ্ন আর সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অজস্র ধাপ। সে ধাপগুলি প্রশ্নাতীতভাবে উত্তীর্ণ হলে, তবেই বলা যেতে পারে যে কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়না। তা কি সেই প্রশ্ন এবং কিই বা তার সমাধান পদ্ধতি? বেশ, কোনো একজন বৈজ্ঞানিক এই বিষয়ে কাজ করলে তাঁকে কোন কোন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তার একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক।
এক লাইনে পদ্ধতিটার একটা ধারণা দিতে গেলে বলতে হয়, প্রথমে কলমিশাক আর ব্রেস্ট ক্যান্সারের আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে এমন তথ্য সম্পৰ্কে পড়াশুনা করে প্রমাণ জোগাড় করা। তারপর সে সম্পর্কে গবেষণার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করা। নব্বইভাগ ক্ষেত্রেই অর্থের সংস্থান হয়না কারণ এর জন্য কোনো প্রোডাকশন হাউস নেই। যদি ধরা যায় টাকার জোগান হলো, তখন লোকজন জোগাড় করা। তারপর ল্যাবে বছরের পর বছর ধরে কোষস্তরে কলমিশাকের আন্টিক্যান্সার গুণকে প্রমাণ করা। তারপর প্রাণীদেহে মানে ইঁদুর বা বানর জাতীয় প্রাণীতে প্রমাণ করা। তারপর সেই ফলাফল গবেষণা পত্ররূপে জার্নালে প্রকাশ করা। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা প্রয়োজন মত আপনার সেই ফলাফলের সত্যতা নিজেদের ল্যাবে প্রমাণ করে দেখার বা তাতে কিছু যোগ বিয়োগ করার কাজ চলবে বেশ কিছু বছর ধরে। তারপর যখন বারে বারে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একই ফলাফল পাওয়া যাবে, তখন মানুষের দেহে সেই এন্টিক্যান্সার কম্পাউন্ড প্রয়োগ করার আবেদন করা। সেই আবেদন পত্র গৃহীত হলে খুব অল্পসংখ্যক মানুষে মানে রোগীদের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র নেওয়া। তারপর তাঁদের দেহে অন্য ওষুধের সাথে সেটি প্রয়োগ করা। কোনো অযাচিত বিষক্রিয়া না থাকলে আরো বেশি মানুষে প্রয়োগ করা। সেখানে ভাল ফল পাওয়া গেলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষে তা প্রয়োগ করা। তারপর তাঁদের বেশ কিছু বছর ধরে নজরে রাখা। যদি কোনো বাজে ঘটনা না ঘটলে তবে সেই কম্পাউন্ডের তখন প্রয়োগ শুরু হবে। এই অবস্থায় তাকে আপনি ওষুধ বলতে পারেন। প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সারা পৃথিবীর অন্তত পাঁচশ জন মানুষ কাজ করেছেন এই প্রকল্পে। একসাথে ছোট ছোট দলে বা আলাদা আলাদা ভাবে। কিন্তু এই এত চেষ্টা সত্ত্বেও বছর পাঁচ দশের মধ্যে সেই ওষুধ আবার কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। কেন? বলব। বিশদেই বলব। এর প্রত্যেকটি ধাপ সম্পর্কে আলোকপাত করব বলেই এই লেখা লিখতে শুরু করেছি। এই যুদ্ধের সলতে পাকানো থেকে যুদ্ধজেতার পর বিজয়োৎসব পর্যন্ত আমি আপনাকে আমার সাথে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো। গলিঘুঁজিগুলো না হলেও রাজপথের আশপাশের মাইলস্টোনগুলো তো নিশ্চয়ই দেখাবো। ধৈর্য্য রাখুন একটু।
প্রথম থেকেই শুরু করি তবে? তাহলে পুরো গল্পটা বুঝতে সুবিধা হবে। কেমন!
তাহলে, কলমিশাকের এন্টিক্যান্সার গুণ আছে এটি গবেষণা করে দেখতে গেলে একজন বিজ্ঞানীকে কি করতে হবে?
১. প্রথমেই সেই বৈজ্ঞানিককে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটি হলো, কলমিশাক এর সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সার উপশম হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে এমন উদ্ভট কথা মনে করার কারণ কি?
সুতরাং কলমিশাক এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে সেই বৈজ্ঞানিকের কিছু পড়াশুনা, কাজের অভিজ্ঞতা, প্রাথমিক ছোটখাটো কিছু গবেষণার তথ্য বা অন্য পূর্বজ বৈজ্ঞানিকদের প্রকাশিত কিছু গবেষণালব্ধ প্রমাণ বা গবেষণাপত্র থাকতে হবে। সেই প্রমাণ ব্রেস্ট ক্যান্সার সংক্রান্ত না হলেও অন্তত যার থেকে অনুমান করা যায় যে কলমিশাকের কিছুমাত্র এন্টিক্যান্সার গুণ থাকলেও থাকতে পারে। যদি সে বৈজ্ঞানিক কলমিশাক সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য (কেবল মাত্র প্রমাণিত গবেষণা পত্র, কোনো ওয়েবসাইটের প্রকাশিত খবর নয়) জোগাড় করে, পড়াশুনা করে মনে করেন, এই বিষয়ে কিছু গবেষণার প্রয়োজন তবেই তিনি পরবর্তী ধাপে এগোবেন। সে গবেষণার হাইপোথেসিসটি আগেই বলেছি, "কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয় না।" অর্থাৎ এই ধাপটি হলো 'Review of literature and preliminary data collection.'
২. পরবর্তী ধাপটি সবচেয়ে কঠিন এবং হতাশাজনক। সেই গবেষণার জন্য খরচ জোগাড় করা। এখন, এই ধরণের গবেষণার জন্য ফান্ডিং করেন কারা? প্রথম নামটা কিন্তু কখনোই কোনো ওষুধ কোম্পানির নয়। সুতরাং, ওই যে আগের দিন বলছিলাম, "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা" এজাতীয় কথাবার্তা একাডেমিক রিসার্চের ক্ষেত্রে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষকঃ হলেন, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট বা হেলথ ডিপার্টমেন্ট। যেমন ভারতের কোনো বায়োমেডিক্যাল সায়েন্টিস্টের নতুন কোনো রিসার্চ প্রপোজাল এর ফান্ডিং এর জন্য আবেদন পাঠানোর ঠিকানা হলো, ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি (DBT), ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (DST), কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (CSIR), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR), ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানিজশন (DRDO) ইত্যাদি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে bio-medical রিসার্চের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH), যার মধ্যে অজস্র বিষয়ভিত্তিক ভাগ আছে। যেমন ক্যান্সার সংক্রান্ত প্রপোজালের জন্য ন্যাশন্যাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (NCI), ডায়াবেটিস সংক্রান্ত রিসার্চের জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডায়াবেটিস এন্ড ডাইজেস্টিভ এন্ড কিডনি ডিজিসেস (NIDDK) ইত্যাদি। এছাড়াও আছে ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স (DOD) ইত্যাদি। এই গেল কেন্দ্রীয় সরকারি ফান্ডিং এজেন্সিগুলোর কথা। এছাড়াও রাজ্যসরকারী বা স্থানীয় কিছু সরকারি ফান্ডিং থাকে। তার পরিমাণ খুবই সামান্য এবং সর্বদা সেখানে আবেদন গ্রহণ করা হয় না।
এই গেল সরকারি ফান্ডিং এর কথা। এছাড়াও কিছু বড় কোম্পানি বা সংস্থা কিছু কিছু ফান্ডিং করে থাকেন কিন্তু সে ফান্ডিং এবং তা থেকে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল কোনো ভাবেই তারা কেবলমাত্র নিজস্ব লাভের জন্য ব্যবহার করতে পারবে না এই শর্তে। অর্থাৎ 'conflict of interest' নিয়মকানুন কঠোর ভাবে মানা হয় সেখানে। ভারতে এরকম একটি ননপ্রফিট ননগভর্ণমেন্ট ফান্ডিং এজেন্সি হলো টাটা। তাঁদের বদান্যতায় শুরু হওয়া TIFR এখন দেশের অন্যতম রিসার্চ ইনস্টিটিউট যেখানে তাবড় তাবড় ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা সরকারি ফান্ডিংয়ে বড় বড় কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এরকম আরো অনেক বিষয়ভিত্তিক সংস্থা আছে যারা নির্দিষ্ট বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেমন, আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন (AHA), আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন (ADA) ইত্যাদি।
এখন এই ফান্ডিং জোগাড়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ওই বৈজ্ঞানিককে তার কাজের ধরণ এবং তার অন্তিম প্রয়োগ অনুসারে এইসব ফান্ডিং এজেন্সির কোনো একটিকে পছন্দ করতে হবে, যেটি তাঁর ওই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে ইচ্ছুক হতে পারে। অর্থাৎ ক্যান্সার সংক্রান্ত কাজের আবেদন হার্ট এসোসিয়েশনে না করাই শ্রেয়।
এইবার ওই বৈজ্ঞানিককে পূর্ববর্তী প্রকাশিত তথ্য এবং তা থেকে ভবিষ্যতে কি করা যেতে পারে তার ভিত্তিতে একটি আবেদন পত্র লিখতে হবে ওই ফান্ডিং এজেন্সিকে। এই ধাপটি হলো 'Grant writing.' এই পদ্ধতিটি সঠিক ভাবে শেখা এবং তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করাই সফলভাবে গবেষণা চালানোর মূলমন্ত্র বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিকদের জন্য। কারণ, আপনার অনুমান, তার সপক্ষে ১০০% নিশ্ছিদ্র তথ্য না দিতে পারলে এবং সেই ভিত্তিতে আপনি ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন সেটি ফান্ডিং এজেন্সির রিভিউইং বোর্ডের সে বিষয়ে অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিকদের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বোঝাতে না পারলে আপনি ফান্ডিং পাবেন না। এই অর্থ জোগাড়ের পদ্ধতিটি সম্পর্কে পরে আরো বিশদে লেখার ইচ্ছে রইল। কারণ, কতখানি সতর্কতার সাথে, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বিজ্ঞান ও বাজেটের বিন্দু বিন্দুর হিসেব রেখে এই অর্থ বরাদ্দ এবং খরচ হয় সেটি না জানলে, "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা" - এজাতীয় ধারণার বদল হওয়া সম্ভব নয়।
এবং এত করেও অনেক সম্ভাবনাময় আবেদনপত্র খারিজ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সংস্থার যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণে, সঠিক রিভিউইং বোর্ডের হাতে না পড়ার কারণে, প্রজেক্টটি নিশ্ছিদ্র না হবার কারণে বা আরো অন্য কারণে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে একটি প্রজেক্ট বহু বছর ধরে বার বার বিভিন্ন ফান্ডিং এজেন্সিতে আবেদন করেও স্যাংশান না হয়ে শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর অন্যান্য প্রজেক্টের ঝড়তি পড়তি অর্থ ব্যবহার করে আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে কাজ করে বহু বছর পরে সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার করেছেন সেই প্রজেক্টটি থেকে, যা সম্পূর্ণ নতুন একটি দিক খুলে দিয়েছে সেই সংক্রান্ত গবেষণার।
যাই হোক, আপাতত ধরা যাক, আমাদের ওই বৈজ্ঞানিকের লেখা কলমিশাক সংক্রান্ত আবেদনপত্র বা গ্রান্ট বার বার রিভিউ, পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন হবার পর, যুক্তি-প্রতিযুক্তির বেড়া ডিঙিয়ে বছর খানেক বা তারও বেশি সময় পরে স্যাংশন হলো। অর্থাৎ ওই যে প্রথমে বলেছিলাম-"কলমিশাকের কি ব্রেস্ট ক্যান্সার আটকাবার ক্ষমতা আছে?" এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য ওই বৈজ্ঞানিক কিছু অর্থ পেলেন। এখানে বলে রাখি, এই অর্থ কিন্তু কোনো মতেই ওই বৈজ্ঞানিকের নিজস্ব, তা নয়। কারণ, ওই অর্থ থেকে ওই বৈজ্ঞানিকের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়বে না। যথেচ্ছ ভাবে ওই অর্থ খরচ করতে তিনি পারবেন না। ওই অর্থ যে কেবলমাত্র অনুমোদিত প্রজেক্টই খরচ করা হয়েছে সেই রিপোর্ট তাঁকে সায়েন্টিফিক রিপোর্টসহ যথোপযুক্ত অডিট হবার পর ভবিষ্যতে ফান্ডিং এজেন্সিকে জমা দিতে হবে। এবং অর্থটি আসবে সেই বিজ্ঞানী যে ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটে কাজটি করছেন সেই ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটের একাউন্টে। যাই হোক, এখন টাকা স্যাংশান হবার চিঠি বা ইমেলটি পাবার সময় থেকে অর্থটি সত্যি সত্যি একাউন্টে আসার মাঝে অনেকসময়ই বিস্তর সময়ের ব্যবধান থাকে। সে কথা বাদ দিলে অতি সংক্ষেপে এই হলো 'Grant writing and funding approval' এর গল্প।
৩. এবার সেই প্রজেক্টে কাজ শুরু হবে। এখন যদি প্রজেক্টটির বাজেট অনুসারে বৈজ্ঞানিককে সাহায্য করার জন্য অন্য আরো একটি বা দুটি সাহায্যকারী নিয়োগ করার সুযোগ থাকে তবে তাদের এই পর্যায়ে নিয়োগ করা হবে। সাহায্যকারী বলতে বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা অনুসারে গ্রান্ট লেখার সময়েই সেই বিজ্ঞানী টেকনিসিয়ান, ছাত্র (PhD স্টুডেন্ট) বা পোস্টডক্টরাল ফেলো ইত্যাদি দরকার বলে আবেদন করবেন। সেই সাহায্যকারীর বেতন বা ফেলোশিপও সেই গ্রান্ট থেকেই আসবে। সুতরাং গ্রান্টটি যদি তিন বা পাঁচ বছরের হয় তবে ওই সাহায্যকারীর ফেলোশিপ বা বেতনের মেয়াদও তিন বা পাঁচ বছর। অনেক সময় বিজ্ঞানীর নিজস্ব বেতনের একটা শতাংশও যদি এর মধ্যে থাকে তবে গ্রান্ট এর মেয়াদ শেষে বিজ্ঞানীর বেতনের ওই শতাংশ অর্থ তিনি আর পাবেন না। সুতরাং আমাদের ওপরতলা থেকে নিচেরতলা সমস্ত ক্ষেত্রেই টাকাপয়সার ব্যাপারটা নড়বড়ে। আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। এসব হলো যদি গ্রান্টটি বড় গ্রান্ট হয় তবেই। বেশিরভাগ ছোট গ্রান্ট এর ক্ষেত্রে লোকজন নেবার সুযোগ থাকে না। সেক্ষত্রে নতুন শুরু করা বিজ্ঞানী নিজেই কাজ করেন। আর সিনিয়র সায়েন্টিস্টরা তাঁদের আগের বা অন্য ongoing প্রজেক্টে কাজ করা লোকজনের মধ্যে কাজটি বাঁটোয়ারা করে দেন। অথবা অনেক সিনিয়র সায়েন্টিস্টকে দেখেছি সব কিছু সামলে সন্ধ্যার পরে নিজে ল্যাবে কাজ করেন।
এবার ল্যাবের কাজ শুরু হবে। কিন্তু সে অনেক লম্বা পদ্ধতি। সংক্ষেপে বললেও বড্ড বড় হয়ে যাবে লেখাটা। তখন আর আপনার পড়তে ইচ্ছে করবে না। তার চাইতে আজ বরং এই পর্যন্তই থাক কেমন? পরের সপ্তাহে বরং আমি আপনাকে নিয়ে ল্যাবে ঢুকবো।
আজ আসি। ভালো থাকুন সবাই।
অর্পিতা
'শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার বাঙালি বিজ্ঞানীর।'
ধরা যাক, রোব্বারের সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি খবরের কাগজটি খুললেন বা ফেসবুকের পাতাটি স্ক্রল করতে শুরু করলেন আর এরকম একটি শিরোনাম দেখতে পেলেন। অনেকসময় এরকম ধরণের খবর পড়া যায় তো পত্র-পত্রিকায়, ফেসবুকেও। তাই না? আপনি বেজায় উত্তেজিত হয়ে খবরটি পড়তে শুরু করলেন। সাধারণত এধরণের খবরের জন্য খবরের কাগজে বিশেষ বেশি জায়গা খরচ হয়না। সুতরাং খবরের সংক্ষিপ্ততার জন্য চটপট খবরটি পড়ে ফেলতে আমাদের কারোরই কোনো অসুবিধা হলো না। তারপর আপনার চেনা জানা কারো প্রয়োজনের সময় দেখা গেল, ওই পরিবেশিত খবরটি কোনো কাজেই লাগছে না। যে নতুন ওষুধটির কথা বলা হয়েছিল, সেটি দিয়ে চিকিৎসা তো হচ্ছে না। তখন আপনার মনে দুই ধরণের ভাবনা আসতে পারে। এক, পরবর্তী সময়ে এরকম কোনো খবর আসলে আপনি বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে পাতা উল্টে চলে যাবেন। এবং "রিসার্চ-ফিসার্চ করে আদতে কিস্যু হচ্ছে না"- এই ধারণা আপনার দৃঢ় হবে। আর দুই, 'বায়ো-মেডিকেল সায়েন্টিস্ট' বলে একদল লোক আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি এবং নতুন ওষুধ এনে যুগের পর যুগ ধরে চিকিৎসা শাস্ত্রকে আধুনিকতা প্রদান করে চলেছেন এবং অসংখ্য ডাক্তারদের হাত ধরে আপনার প্রেসক্রিপশনে সে আধুনিক চিকিৎসার ছোঁয়া লাগছে সে সম্পর্কে আপনি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেবার প্রয়োজন অনুভব করবেন না।
তাহলে পরিবেশিত খবরটি কি ভুয়ো? খবরের মূল বিষয়টি ভুয়ো নাও হতে পারে, কিন্তু পরিবেশনাটি ভুল নিঃসন্দেহে। কারণ হয়ত খবরটি এরকম ছিল, 'অমুক গবেষণা কেন্দ্রের অমুক বিজ্ঞানী দেখেছেন, অমুক জিনিসটি প্রয়োগ করলে অমুক ক্যান্সারের কোষ মারা যাচ্ছে। তিনি এবং তাঁর দল বিষয়টি অমুক জার্নালে প্রকাশ করেছেন।' এই পর্যন্ত খবরটি সঠিক। এরকম অজস্র আবিষ্কার অহরহ হয়ে চলেছে। কিন্তু সমস্যা পরের অংশ টুকু নিয়ে। কোনো একটি জিনিসে ক্যান্সারের কোষ মারা যাওয়া মানেই সেই জিনিসটি কোনো ডাক্তার কোনো রোগীর প্রেসক্রিপশনে লিখতে পারেন না। আর আগে পরে অজস্র ধাপ থাকে। ভ্যালিডেশনের। সুতরাং খবরের ওই "ওষুধ আবিষ্কার" শব্দবন্ধটি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল এবং সংবাদ পরিবেশকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক ছাড়া কিচ্ছু নয়।
তাহলে "ওষুধ আবিষ্কার" কথাটি বলার সময় কখন আসবে?
মনে করা যাক, এরকমই একটা উদাহরণ, 'কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়না।' এটা সত্যি সত্যি কোনো খবর নয়, কোনো কাগজেও বেরোয়নি। এমনি উদাহরণ হিসেবে 'কলমিশাক' কথাটা ব্যবহার করছি (এইমাত্র ভাত দিয়ে খেলাম তো, তাই ঐটাই মনে পড়ছে এখন)। এই 'কলমিশাক' কথাটির জায়গায় আপনারা X, Y, Z যেকোনো কেমিক্যাল বা বায়োলজিক্যাল কম্পাউন্ড বসিয়ে নিতে পারেন। এখন এই কথাটি থেকে কলমিশাককে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনে লেখার মাঝে রয়েছে অজস্র প্রশ্ন আর সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অজস্র ধাপ। সে ধাপগুলি প্রশ্নাতীতভাবে উত্তীর্ণ হলে, তবেই বলা যেতে পারে যে কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়না। তা কি সেই প্রশ্ন এবং কিই বা তার সমাধান পদ্ধতি? বেশ, কোনো একজন বৈজ্ঞানিক এই বিষয়ে কাজ করলে তাঁকে কোন কোন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তার একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক।
এক লাইনে পদ্ধতিটার একটা ধারণা দিতে গেলে বলতে হয়, প্রথমে কলমিশাক আর ব্রেস্ট ক্যান্সারের আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে এমন তথ্য সম্পৰ্কে পড়াশুনা করে প্রমাণ জোগাড় করা। তারপর সে সম্পর্কে গবেষণার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করা। নব্বইভাগ ক্ষেত্রেই অর্থের সংস্থান হয়না কারণ এর জন্য কোনো প্রোডাকশন হাউস নেই। যদি ধরা যায় টাকার জোগান হলো, তখন লোকজন জোগাড় করা। তারপর ল্যাবে বছরের পর বছর ধরে কোষস্তরে কলমিশাকের আন্টিক্যান্সার গুণকে প্রমাণ করা। তারপর প্রাণীদেহে মানে ইঁদুর বা বানর জাতীয় প্রাণীতে প্রমাণ করা। তারপর সেই ফলাফল গবেষণা পত্ররূপে জার্নালে প্রকাশ করা। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা প্রয়োজন মত আপনার সেই ফলাফলের সত্যতা নিজেদের ল্যাবে প্রমাণ করে দেখার বা তাতে কিছু যোগ বিয়োগ করার কাজ চলবে বেশ কিছু বছর ধরে। তারপর যখন বারে বারে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একই ফলাফল পাওয়া যাবে, তখন মানুষের দেহে সেই এন্টিক্যান্সার কম্পাউন্ড প্রয়োগ করার আবেদন করা। সেই আবেদন পত্র গৃহীত হলে খুব অল্পসংখ্যক মানুষে মানে রোগীদের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র নেওয়া। তারপর তাঁদের দেহে অন্য ওষুধের সাথে সেটি প্রয়োগ করা। কোনো অযাচিত বিষক্রিয়া না থাকলে আরো বেশি মানুষে প্রয়োগ করা। সেখানে ভাল ফল পাওয়া গেলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষে তা প্রয়োগ করা। তারপর তাঁদের বেশ কিছু বছর ধরে নজরে রাখা। যদি কোনো বাজে ঘটনা না ঘটলে তবে সেই কম্পাউন্ডের তখন প্রয়োগ শুরু হবে। এই অবস্থায় তাকে আপনি ওষুধ বলতে পারেন। প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সারা পৃথিবীর অন্তত পাঁচশ জন মানুষ কাজ করেছেন এই প্রকল্পে। একসাথে ছোট ছোট দলে বা আলাদা আলাদা ভাবে। কিন্তু এই এত চেষ্টা সত্ত্বেও বছর পাঁচ দশের মধ্যে সেই ওষুধ আবার কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। কেন? বলব। বিশদেই বলব। এর প্রত্যেকটি ধাপ সম্পর্কে আলোকপাত করব বলেই এই লেখা লিখতে শুরু করেছি। এই যুদ্ধের সলতে পাকানো থেকে যুদ্ধজেতার পর বিজয়োৎসব পর্যন্ত আমি আপনাকে আমার সাথে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো। গলিঘুঁজিগুলো না হলেও রাজপথের আশপাশের মাইলস্টোনগুলো তো নিশ্চয়ই দেখাবো। ধৈর্য্য রাখুন একটু।
প্রথম থেকেই শুরু করি তবে? তাহলে পুরো গল্পটা বুঝতে সুবিধা হবে। কেমন!
তাহলে, কলমিশাকের এন্টিক্যান্সার গুণ আছে এটি গবেষণা করে দেখতে গেলে একজন বিজ্ঞানীকে কি করতে হবে?
১. প্রথমেই সেই বৈজ্ঞানিককে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটি হলো, কলমিশাক এর সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সার উপশম হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে এমন উদ্ভট কথা মনে করার কারণ কি?
সুতরাং কলমিশাক এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে সেই বৈজ্ঞানিকের কিছু পড়াশুনা, কাজের অভিজ্ঞতা, প্রাথমিক ছোটখাটো কিছু গবেষণার তথ্য বা অন্য পূর্বজ বৈজ্ঞানিকদের প্রকাশিত কিছু গবেষণালব্ধ প্রমাণ বা গবেষণাপত্র থাকতে হবে। সেই প্রমাণ ব্রেস্ট ক্যান্সার সংক্রান্ত না হলেও অন্তত যার থেকে অনুমান করা যায় যে কলমিশাকের কিছুমাত্র এন্টিক্যান্সার গুণ থাকলেও থাকতে পারে। যদি সে বৈজ্ঞানিক কলমিশাক সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য (কেবল মাত্র প্রমাণিত গবেষণা পত্র, কোনো ওয়েবসাইটের প্রকাশিত খবর নয়) জোগাড় করে, পড়াশুনা করে মনে করেন, এই বিষয়ে কিছু গবেষণার প্রয়োজন তবেই তিনি পরবর্তী ধাপে এগোবেন। সে গবেষণার হাইপোথেসিসটি আগেই বলেছি, "কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয় না।" অর্থাৎ এই ধাপটি হলো 'Review of literature and preliminary data collection.'
২. পরবর্তী ধাপটি সবচেয়ে কঠিন এবং হতাশাজনক। সেই গবেষণার জন্য খরচ জোগাড় করা। এখন, এই ধরণের গবেষণার জন্য ফান্ডিং করেন কারা? প্রথম নামটা কিন্তু কখনোই কোনো ওষুধ কোম্পানির নয়। সুতরাং, ওই যে আগের দিন বলছিলাম, "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা" এজাতীয় কথাবার্তা একাডেমিক রিসার্চের ক্ষেত্রে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষকঃ হলেন, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট বা হেলথ ডিপার্টমেন্ট। যেমন ভারতের কোনো বায়োমেডিক্যাল সায়েন্টিস্টের নতুন কোনো রিসার্চ প্রপোজাল এর ফান্ডিং এর জন্য আবেদন পাঠানোর ঠিকানা হলো, ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি (DBT), ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (DST), কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (CSIR), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR), ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানিজশন (DRDO) ইত্যাদি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে bio-medical রিসার্চের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH), যার মধ্যে অজস্র বিষয়ভিত্তিক ভাগ আছে। যেমন ক্যান্সার সংক্রান্ত প্রপোজালের জন্য ন্যাশন্যাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (NCI), ডায়াবেটিস সংক্রান্ত রিসার্চের জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডায়াবেটিস এন্ড ডাইজেস্টিভ এন্ড কিডনি ডিজিসেস (NIDDK) ইত্যাদি। এছাড়াও আছে ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স (DOD) ইত্যাদি। এই গেল কেন্দ্রীয় সরকারি ফান্ডিং এজেন্সিগুলোর কথা। এছাড়াও রাজ্যসরকারী বা স্থানীয় কিছু সরকারি ফান্ডিং থাকে। তার পরিমাণ খুবই সামান্য এবং সর্বদা সেখানে আবেদন গ্রহণ করা হয় না।
এই গেল সরকারি ফান্ডিং এর কথা। এছাড়াও কিছু বড় কোম্পানি বা সংস্থা কিছু কিছু ফান্ডিং করে থাকেন কিন্তু সে ফান্ডিং এবং তা থেকে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল কোনো ভাবেই তারা কেবলমাত্র নিজস্ব লাভের জন্য ব্যবহার করতে পারবে না এই শর্তে। অর্থাৎ 'conflict of interest' নিয়মকানুন কঠোর ভাবে মানা হয় সেখানে। ভারতে এরকম একটি ননপ্রফিট ননগভর্ণমেন্ট ফান্ডিং এজেন্সি হলো টাটা। তাঁদের বদান্যতায় শুরু হওয়া TIFR এখন দেশের অন্যতম রিসার্চ ইনস্টিটিউট যেখানে তাবড় তাবড় ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা সরকারি ফান্ডিংয়ে বড় বড় কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এরকম আরো অনেক বিষয়ভিত্তিক সংস্থা আছে যারা নির্দিষ্ট বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেমন, আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন (AHA), আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন (ADA) ইত্যাদি।
এখন এই ফান্ডিং জোগাড়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ওই বৈজ্ঞানিককে তার কাজের ধরণ এবং তার অন্তিম প্রয়োগ অনুসারে এইসব ফান্ডিং এজেন্সির কোনো একটিকে পছন্দ করতে হবে, যেটি তাঁর ওই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে ইচ্ছুক হতে পারে। অর্থাৎ ক্যান্সার সংক্রান্ত কাজের আবেদন হার্ট এসোসিয়েশনে না করাই শ্রেয়।
এইবার ওই বৈজ্ঞানিককে পূর্ববর্তী প্রকাশিত তথ্য এবং তা থেকে ভবিষ্যতে কি করা যেতে পারে তার ভিত্তিতে একটি আবেদন পত্র লিখতে হবে ওই ফান্ডিং এজেন্সিকে। এই ধাপটি হলো 'Grant writing.' এই পদ্ধতিটি সঠিক ভাবে শেখা এবং তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করাই সফলভাবে গবেষণা চালানোর মূলমন্ত্র বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিকদের জন্য। কারণ, আপনার অনুমান, তার সপক্ষে ১০০% নিশ্ছিদ্র তথ্য না দিতে পারলে এবং সেই ভিত্তিতে আপনি ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন সেটি ফান্ডিং এজেন্সির রিভিউইং বোর্ডের সে বিষয়ে অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিকদের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বোঝাতে না পারলে আপনি ফান্ডিং পাবেন না। এই অর্থ জোগাড়ের পদ্ধতিটি সম্পর্কে পরে আরো বিশদে লেখার ইচ্ছে রইল। কারণ, কতখানি সতর্কতার সাথে, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বিজ্ঞান ও বাজেটের বিন্দু বিন্দুর হিসেব রেখে এই অর্থ বরাদ্দ এবং খরচ হয় সেটি না জানলে, "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা" - এজাতীয় ধারণার বদল হওয়া সম্ভব নয়।
এবং এত করেও অনেক সম্ভাবনাময় আবেদনপত্র খারিজ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সংস্থার যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণে, সঠিক রিভিউইং বোর্ডের হাতে না পড়ার কারণে, প্রজেক্টটি নিশ্ছিদ্র না হবার কারণে বা আরো অন্য কারণে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে একটি প্রজেক্ট বহু বছর ধরে বার বার বিভিন্ন ফান্ডিং এজেন্সিতে আবেদন করেও স্যাংশান না হয়ে শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর অন্যান্য প্রজেক্টের ঝড়তি পড়তি অর্থ ব্যবহার করে আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে কাজ করে বহু বছর পরে সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার করেছেন সেই প্রজেক্টটি থেকে, যা সম্পূর্ণ নতুন একটি দিক খুলে দিয়েছে সেই সংক্রান্ত গবেষণার।
যাই হোক, আপাতত ধরা যাক, আমাদের ওই বৈজ্ঞানিকের লেখা কলমিশাক সংক্রান্ত আবেদনপত্র বা গ্রান্ট বার বার রিভিউ, পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন হবার পর, যুক্তি-প্রতিযুক্তির বেড়া ডিঙিয়ে বছর খানেক বা তারও বেশি সময় পরে স্যাংশন হলো। অর্থাৎ ওই যে প্রথমে বলেছিলাম-"কলমিশাকের কি ব্রেস্ট ক্যান্সার আটকাবার ক্ষমতা আছে?" এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য ওই বৈজ্ঞানিক কিছু অর্থ পেলেন। এখানে বলে রাখি, এই অর্থ কিন্তু কোনো মতেই ওই বৈজ্ঞানিকের নিজস্ব, তা নয়। কারণ, ওই অর্থ থেকে ওই বৈজ্ঞানিকের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়বে না। যথেচ্ছ ভাবে ওই অর্থ খরচ করতে তিনি পারবেন না। ওই অর্থ যে কেবলমাত্র অনুমোদিত প্রজেক্টই খরচ করা হয়েছে সেই রিপোর্ট তাঁকে সায়েন্টিফিক রিপোর্টসহ যথোপযুক্ত অডিট হবার পর ভবিষ্যতে ফান্ডিং এজেন্সিকে জমা দিতে হবে। এবং অর্থটি আসবে সেই বিজ্ঞানী যে ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটে কাজটি করছেন সেই ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটের একাউন্টে। যাই হোক, এখন টাকা স্যাংশান হবার চিঠি বা ইমেলটি পাবার সময় থেকে অর্থটি সত্যি সত্যি একাউন্টে আসার মাঝে অনেকসময়ই বিস্তর সময়ের ব্যবধান থাকে। সে কথা বাদ দিলে অতি সংক্ষেপে এই হলো 'Grant writing and funding approval' এর গল্প।
৩. এবার সেই প্রজেক্টে কাজ শুরু হবে। এখন যদি প্রজেক্টটির বাজেট অনুসারে বৈজ্ঞানিককে সাহায্য করার জন্য অন্য আরো একটি বা দুটি সাহায্যকারী নিয়োগ করার সুযোগ থাকে তবে তাদের এই পর্যায়ে নিয়োগ করা হবে। সাহায্যকারী বলতে বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা অনুসারে গ্রান্ট লেখার সময়েই সেই বিজ্ঞানী টেকনিসিয়ান, ছাত্র (PhD স্টুডেন্ট) বা পোস্টডক্টরাল ফেলো ইত্যাদি দরকার বলে আবেদন করবেন। সেই সাহায্যকারীর বেতন বা ফেলোশিপও সেই গ্রান্ট থেকেই আসবে। সুতরাং গ্রান্টটি যদি তিন বা পাঁচ বছরের হয় তবে ওই সাহায্যকারীর ফেলোশিপ বা বেতনের মেয়াদও তিন বা পাঁচ বছর। অনেক সময় বিজ্ঞানীর নিজস্ব বেতনের একটা শতাংশও যদি এর মধ্যে থাকে তবে গ্রান্ট এর মেয়াদ শেষে বিজ্ঞানীর বেতনের ওই শতাংশ অর্থ তিনি আর পাবেন না। সুতরাং আমাদের ওপরতলা থেকে নিচেরতলা সমস্ত ক্ষেত্রেই টাকাপয়সার ব্যাপারটা নড়বড়ে। আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। এসব হলো যদি গ্রান্টটি বড় গ্রান্ট হয় তবেই। বেশিরভাগ ছোট গ্রান্ট এর ক্ষেত্রে লোকজন নেবার সুযোগ থাকে না। সেক্ষত্রে নতুন শুরু করা বিজ্ঞানী নিজেই কাজ করেন। আর সিনিয়র সায়েন্টিস্টরা তাঁদের আগের বা অন্য ongoing প্রজেক্টে কাজ করা লোকজনের মধ্যে কাজটি বাঁটোয়ারা করে দেন। অথবা অনেক সিনিয়র সায়েন্টিস্টকে দেখেছি সব কিছু সামলে সন্ধ্যার পরে নিজে ল্যাবে কাজ করেন।
এবার ল্যাবের কাজ শুরু হবে। কিন্তু সে অনেক লম্বা পদ্ধতি। সংক্ষেপে বললেও বড্ড বড় হয়ে যাবে লেখাটা। তখন আর আপনার পড়তে ইচ্ছে করবে না। তার চাইতে আজ বরং এই পর্যন্তই থাক কেমন? পরের সপ্তাহে বরং আমি আপনাকে নিয়ে ল্যাবে ঢুকবো।
আজ আসি। ভালো থাকুন সবাই।
অর্পিতা
0 comments:
Post a Comment