Wednesday, 24 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............ শেষ পর্ব

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............দ্বিতীয় পর্বের পর

রাজা রামমোহন রায় এর বসত বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে বেরিয়ে আসতে আসতে  মনে হচ্ছিল যে বাড়িটির যেটুকু অংশ এই দেড়শ-দুশো বছর ধরে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে সেটিকে যদি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ না করা হয়, উপরে একটা ছাউনির বন্দোবস্ত অন্তত না করা যায় তবে আর কতদিন এটি টিকে থাকবে? আর পাঁচটা ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মতন এটিও ধ্বংস হবে কালের নিয়মেই। বর্তমানে সামান্য দু-পাঁচ টাকা এন্ট্রি ফী নিয়ে এটিকে পার্ক হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন-প্রেমিক প্রেমিকার দল বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বাড়িটি, তার মালিক বা তাঁর লড়াই, তাঁর মতবাদ, তাঁর কুসংস্কারবিহীন-স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এসব নিয়ে বিশেষ উত্সাহী নন কেউই। ভাবতে ভাবতে আবার এটাও মনে হলো যে সত্যিই কি  সংরক্ষণ করার আদৌ দরকার আছে? এই বাড়ি তো কতকগুলি ইঁট মাত্র। যাঁর কারণে এই জায়গার মাহাত্ম, সেই লোকটির কথা কতজন মনে রেখেছে? নিজের জীবন দিয়ে জগদ্দল গোঁড়া সমাজটাকে নাড়িয়ে দিলেন যিনি, সারা ভারতবর্ষের মেয়েদের নবজীবন দিলেন যিনি, তাঁর মতাদর্শ কি সত্যিই বাংলাদেশের লোকেরা আত্মস্থ করতে পেরেছে? ব্রিটিশ শাসককুল আইন করে সতীদাহ বন্ধ না করলে আরো কতদিন চলত কে জানে? এই দুশো বছর পরেও এখনো জন্মানোর পর থেকেই মেয়েদের বৃহত্তর অংশকে তাদেরই মা ঠাকুমার দল বোঝাতে থাকে যে তাদের জন্মানোর উদ্দেশ্য বিয়ে, আর তার অব্যবহিত পরেই সন্তান। পরবর্তী জীবনে সন্তান পালন। এই মনোভাবের গ্রাম-শহর-শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো ভেদাভেদ নেই। পরিস্থিতি ভেদে বলার ভঙ্গিটা শুধু বদলে যায়। কোনো এক চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ের কথা মনে পড়ছে। তার ঠাকুমা তার সম্পর্কে তার সামনেই আমাদের বলেছিলেন "ওর মনে খুব দুঃখ জানত? গায়ের রং কালো তো, দিদিরা সবাই ফর্সা।" সেই শুনে একজন আধুনিকমনস্ক ব্যক্তির উত্তর ছিল, "ও নিজেই যত্ন নিতে শিখলে বয়সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে।" অর্থাত ফর্সা হওয়াটা জরুরি। আমি বাচ্চাটিকে ততক্ষনাত জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কেন রে? ফর্সা না হলেই বা কি হয়?" বিনা দ্বিধায় বাচ্চাটির উত্তর ছিল, "বিয়ে হবেনা তো কালো হলে।" একটি পাঁচ বছরের বাচ্চা জন্ম থেকে বিয়ে-বাচ্চা-সংসার-স্বামী এসব শুনে শুনে বড় হলে সে এর বেশি আর কি উত্তর দেবে? এই যখন এখনো আমাদের বাংলার নব্বই ভাগ বাচ্চা মেয়েদের ভবিষ্যত তখন রামমোহন রায় এর বাড়ির ইঁট কটা রইলো না খসে পড়ল তা নিয়ে মন খারাপ করে আর কি হবে?

এগিয়ে চললাম রাধানগরের দিকে। পথের দুপাশে মাঝে মাঝেই বহু পুরনো সুন্দর কারুকার্য করা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। যার কোনো ইতিহাস কেউ জানে না। স্বপনকাকাও কিছু বলতে পারলেন না। এভাবেই আর কিছু বছর পরে এগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রাধানগরে আছে রামমোহন মেমোরিয়াল হল। আমরা গিয়ে দেখলামতার সদর দরজায় তালাবন্ধ। আর বাইরে থেকে এক ভদ্রমহিলা তালাটার সাথে যুদ্ধরত। চাবি দিয়ে তালাটা কিছুতেই খুলছে না। বললেন তিনি নাকি সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। ভাবলাম ভালই হলো। ইনিই সব ঘুরিয়ে দেখাতে পারবেন। অমা! সে গুড়ে বড় বড় দানার বালি। তালাটা স্বপনকাকা চেষ্টা করে খুলে দেবার পর, তিনি চট করে ভেতরে ঢুকে কোলে করে তুলে নিয়ে এলেন একটি ছাগলছানা। আমরা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছি দেখে একগাল হেসে বললেন "এর জন্যই তো তালাটা খোলার চেষ্টা করছিলাম, তা তোমরা ঘুরে দেখো না। আমি একে বাড়িতে রেখে আসি। তোমাদের হয়ে গেলে দরজাটা টেনে দিও। গরু-টরু ঢুকে পড়ে তো নইলে।" বলে পান খাওয়া বাদামী দাঁতের এবড়ো খেবড়ো সারি আরো একবার দেখিয়ে চলে গেলেন। আমরাও গুটি গুটি ঢুকে পড়লাম। এখানেই নাকি রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি ছিল এখন একটি স্মৃতিমন্দির। আর আছে একটি বেদী যেটি নাকি ১৮৫৯ সালে রেভারেন্ড জেমস লঙ বলেছিলেন এটিই রাজা রামমোহন রায়ের জন্মবেদী। এই রইলো ছবি।

   
এই বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকেই আছে ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি মন্দিরের হুবহু নকল একটি স্মৃতিসৌধ। তার লাগোয়া একটি গ্রন্থাগার।  সেই নকল স্মৃতিসৌধের ছবি দিলাম নিচে। সঙ্গের লেখাটাও ব্রিস্টল এ আসল সমাধি মন্দিরের গায়ে উত্কীর্ণ লেখাটির প্রতিরূপ।


রামমোহন রায় কে এখানেই ফেলে রেখে এখান থেকে আমরা গেলাম খানাকুলের ঘণ্টেশ্বর মন্দির দেখতে। নাম শুনে যদিও মনে হয় যে শিব মন্দির আসলে এটি শক্তি মন্দির।   ভেতরে পাথরে খোদাই করা দশবাহু দুর্গার মূর্তি।


খানাকুল হলো স্বপনকাকার পূর্বতন কাজের জায়গা। সুতরাং তিনি সবই চেনেন। চেনা একটি দোকানে চা খেয়ে গোপীনাথ মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে একটি ঘটনা ঘটল যেটি বলার লোভ আমি সামলাতে পারছিনা। পথে পড়ল একটি দর্জির দোকান। যেখানে নাকি স্বপনকাকা একদম প্রথম জীবনে দর্জির কাজ শিখেছিলেন। আমরা বাইরে  রইলাম। স্বপনকাকা ভেতরে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। হটাত দেখি মালিক বেরিয়ে এসেছেন। স্বপনকাকা ভেতরে গিয়ে কি বলেছিলেন জানিনা। তিনি দেখি প্রচন্ড গদগদ হয়ে পিনাকীকে বলছেন, "আমার কি সৌভাগ্য, আপনি আমার দোকানে এসেছেন। আমার দোকান ধন্য হয়ে গেল। আপনার সাথে আলাপ করে খুব খুশি হলাম। আমি স্বপনের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করব কিন্তু। কি সৌভাগ্য! একটু  অন্তত: বসে যান, একটু চা-কফি-ঠান্ডা কিছু খান........" সত্যি বলছি ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন আমাদের যথাসম্ভব "হেঁ হেঁ.....না মানে....ইয়ে ঠিক আছে......হেঁ হেঁ......" এসব উপযুক্ত ধরতাই এর ফাঁকে ফাঁকে। পিনাকীর মুখটা দেখছি ক্রমশঃই ভেবলু হয়ে উঠছে। উনি তাকে বোধহয় নোবেলজয়ী কোনো বৈজ্ঞানিক ভেবেছেন। আর আমার পেট থেকে ক্রমশঃই ভসভসিয়ে হাসি উঠে আসছে। কোনোক্রমে তাঁর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ফের মোটরবাইক এ উঠেই হ্যা হ্যা করে মিনিট পাঁচেক হেসে নিলাম। তারপর স্বপনকাকাকে বললাম তুমি ঠিক কি বলেছিলে আমাদের সম্পর্কে বলত? সেও দেখি খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। যাই হোক হাসি টাসি সামলে একটা কথা ভেবে অবশ্য খুব লজ্জা পেয়েছিলাম যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়টা পাঁচজন সাধারণ মানুষ যাঁরা এই পেশায় নেই তাঁদের কাছে কতটা দূরের বিষয় এখনো। নুন্যতম ধারণা নেই কারো। সুতরাং ভালো মেধার তুখোড় বুদ্ধির ছাত্ররা কেমন করে আকৃষ্ট হবে এ রাস্তায় হাঁটতে। এটা আমাদেরই লজ্জা। আমরা যারা এই বিষয়ে কিছুটা অন্তত জানি তারাই পারিনি আমাদের বাবা-কাকা-মামা-বন্ধুবান্ধবদের এ সম্পর্কে অবগত করতে। তাই এখনো একজন সাধারণ গবেষককে কেউ বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভেবে ভুল করে, আশা করে তার থেকে বিশাল কিছু স্বাস্থ্য বা সামাজিক পরিবর্তনের।

গেলাম গোপীনাথজীর রাসের মেলা দেখতে। মেলা বিশেষ কিছু দেখলাম না। সাধারণ দোকান পাতি। আর পাঁচটা মেলার সাথে বিশেষ ফারাক নেই। যদিও জিলিপির দোকানগুলো চোখ টানছিল খুবই। কিন্তু দুপুরের ভরপেট খাওয়া আর রাতের জোরদার মেনু স্মরণ করে কষ্ট করেই লোভ সামলালাম। মন্দির দেখলাম।

গোপীনাথ মন্দির 
পাশেই রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের সামনে তিনদিন ধরে হচ্ছে নর-নারায়ণ সেবা। এত লোক একসাথে বসে খাচ্ছেন। সামান্যই খাবার। খিচুড়ি। হয়ত সবার বাড়িতেই আজ এরচেয়ে ভালো মেনু। তাও চারচাকা দামী গাড়ি থেকে নেমে আর দুচাকার লড়ঝরে সাইকেল থেকে নেমে পাশাপাশি বসে একহাতা ঝোল ঝোল খিচুড়ি খাওয়ার আমেজ বোধহয় আলাদা। পাশেই সুন্দর করে আলোয় সাজানো রাধাগোবিন্দ মন্দির।

রাধাগোবিন্দ মন্দির 
ফেরবার পথে রাসপূর্নিমার ঝকঝকে জ্যোত্স্নায় মনে হচ্ছিল এই যে রাস উপলক্ষ্যে মেলা-আনন্দ-লোকসমাগম এতকিছু মানুষের এই ছোটছোট আনন্দটা সত্যি? নাকি ইন্টারনেট-বিদেশযাত্রা-মহাকাশ ভ্রমণ-ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-সবকিছুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে স্কুল এর পড়া শেষ হতে না হতেই স্বপনকাকার মেয়ের মত হাজার হাজার ভারতীয় মেয়েদের শুধুমাত্র বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো এই চরম সত্যিটাই সত্যি?

মোটরসাইকেল-এর হুহু গতি, চকচকে জ্যোত্স্না, দুপাশে মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত আর শিরশিরে ঠান্ডায় মনটা দোলাচলে দুলছিল। খুশি হতে গিয়েও কিরকম ভাবে যেন পুরোপুরি খুশি হতে পারছিলাম না। ভারী হয়ে আসছিল মনটা।


(শেষ)  
    

Friday, 19 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............দ্বিতীয় পর্ব

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর ভ্রমনের যে গল্পটা আপনাদেরকে বলতে শুরু করেছিলাম, ঠান্ডার চোটে আর ল্যাবের চাপে সে গপ্পে খানিক বাধা পড়ে গেছিল। সে জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমা টমা চেয়ে নিয়ে বাকি অংশটা বরং বলে ফেলি কেমন?

বালিপুরে দুদিন ধরে ঠাকুমা-কাকিমাদের অনবদ্য রান্নাখেয়ে দেয়ে যখন মনটা তর-চোখটা আধবোজা আর ভুঁড়িটা আরো খানিকটা মোটা হয়ে উঠেছে তখন এসে পৌঁছালো মাধবী পিসি। যাঁর কথা আগের পর্বে বলেছি। সঙ্গে বিশাল এক ক্যান ভর্তি বাড়ির গরুর ঘন দুধ। আর স্বপন কাকা এনে হাজির করলো সাড়ে তিন কেজি ছোটো ছোটো পুঁটি মাছ। কারণ বৌমাটি দুধ এবং পুঁটি মাছের ভক্ত। বৌমাটির তো তখন "এতা কাবো, ওতা কাবো, থব কাবো" গোছের অবস্থা। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই? উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে সবাই মিলে সেই মাছের পাহাড় বাছা শেষ হলো। তারপর উঠেই শুনি একটা অপ্রত্যাশিত খবর। বালিপুর থেকে রাধানগর মানে রাজা রামমোহন রায় এর জন্মস্থান নাকি খুব সামনে। ওঁনার নিজের তৈরী বাড়ির ধংসাবশেষ এখনো রয়েছে। এবং আমরা সেখানে যাব দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে। স্বপনকাকা সারথী। সঙ্গে খানাকুলের বিখ্যাত গোপীনাথজী-র রাসের মেলা আর ঘণ্টেশ্বর মন্দির ফাউ পাওনা। একটা দেখলে দুটো ফ্রি। শুনেই তো আমার পায়ের নিচে সর্ষেগুলো কিলবিল করে উঠলো। মনটা উড়ু-উড়ু হয়ে গেল। এখানে এসে যে অমন একটা দর্শনীয় স্থান অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে যাবে, কে জানত? আনন্দের চোটে কোঁত-কোঁত করে খানিকটা দুধ খেয়ে, ঝপাঝপ স্নান সেরে, পুঁটিমাছের ঝাল দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ভাত খাওয়ার লোভ সামলে চটপট ভাত-মাছ খেয়ে নিয়ে, তীর্থের কাকের মত স্বপনকাকার দিকে চেয়ে বসে রইলাম দুজনে। সে বেচারা ব্যবসাপাতি সামলে-সুমলে, ঘরে ফিরে, স্নান খাওয়া সারছে। আর আমাদের দুজনের দুজোড়া চোখ ড্যাবডেবিয়ে তাকে অনুসরণ করে চলেছে। আমাদের নীরব তাড়ার চোটে কোনক্রমে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই বেচারাকে মোটরবাইক নিয়ে বেরোতে হলো। 

দুপুর তিনটের সময় দুজনে স্বপনকাকার পিঠে চেপে রওনা হলাম। পথে মুন্ডেশ্বরী পার হলাম কুড়কুড়ি-র ঘাটে। 

কুরকুড়ি ঘাটের পথে

সেই বাঁশের সাঁকো। অদ্ভূত সুন্দর জায়গাটা। নেহাত পঁচিশে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে পিকনিক করিয়ের দল জায়গাটার খোঁজ পায়নি তাই জায়গাটি এখনো কুমারীই রয়ে গেছে। আমাদের রূপনারায়ণ-এর তীরের মতন এখনো একে বছর বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে গণধর্ষিতা হতে হয়না। শান্ত নিরিবিলি বালির চর। তন্বী মুন্ডেশ্বরী সিধে একটা বাঁশের সাঁকো। সেখানে কখনো কখনো বাচ্চা কাঁকে মা, ধুতি পরা দাদু, সাইকেল বা মোটর সাইকেল এ সাধারণ যাত্রী পারাপার করছে।সেখানে আমাদের মতন শহুরে জামাকাপড় পরা চোখে সানগ্লাস আঁটা বেয়াদবরা বড়ই বেমানান। বাঁশের সাঁকোটার ঠিক সোজাসুজি একটা ঋজু তালগাছ যেন ঠিক ছবি তোলার জন্য মাপ করে বসানো। 

কুরকুড়ি-র ঘাটে মুন্ডেশ্বরী 

সাঁকো পেরিয়ে এসে একটা বাঁশেরই ছোটো মাচা। পারানির কড়ি দিতে হবে এখানে। মন ভরে গেল কুড়কুড়ি-র ঘাট দেখে। স্বপনকাকাকে বলে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম এখানে। তিনি অবাক। তার রোজকারের এই রাস্তা এই সাঁকোতে কেন এতটা সময় নষ্ট করছি আমরা বুঝতেই পারলেন না। আমাদের ছেলেমানুষী দেখে হেসেই খুন। "চল চল দেরী হয়ে যাচ্ছে, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে, আরো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সামনে।" অগত্যা আবার এগোলাম। 

আবার আসতে রাজি আছি এই সাঁকো পেরোতে     
গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফ থেকে গ্রামের ভেতর ভেতরের রাস্তা গুলোকেও বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতটা রাস্তা যেতে কোথাও পুরনো সেই লাল মোরাম ফেলা রাস্তা নেই, সবই ঢালাই করা রাস্তা। কিন্তু এখনো এইসব জায়গা কিরকম গ্রাম তা বলে বোঝানো যাবে না। ভালো হাসপাতাল, ভালো স্কুল- কলেজ কিচ্ছু নেই। শুধু ঘরে ঘরে ডিস্-এন্টেনার বাহুল্য চোখে পড়ার মত। স্বপনকাকা নানান রকম গল্প করতে করতে চলেছিলেন। আমার পেছনে বসে বসে একটা কথা মাথায় ঘুরছিল শুধু। আমরা চলেছি রাজা রামমোহন রায় এর বসত বাড়ি দেখতে। যে বাড়ি নাকি তিনি নিজে বানিয়েছিলেন থাকার জন্য, যখন নাকি তাঁর বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন সমাজবিধির বিরুদ্ধে যাবার জন্য। আমার মাথায় ঘুরছিল একটা কথা যে, এই জায়গা এখনই এরকম গ্রাম, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে রামমোহন রায় এর সময়কালে এই জায়গা কেমন ছিল তার আন্দাজও বোধহয় আমরা আজ ২০১৪ সালে বসে করতে পারি না। সেই শিক্ষা -সভ্যতার সংস্পর্শবিহীন গ্রামে রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু পরিবারে জন্মে এত মনের জোর, এত পরিস্কার মাথা, এত সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন করে পেলেন তিনি? দাপুটে জমিদার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে, পারিবারিক সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে এই অজ গাঁয়ের এই লোকটির মত কিছু লোক সেদিন দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে সব প্রতিকূলতাকে সরিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত আজ আমার মতন মেয়েরা ব্লগ এ নিজের কথা লিখতে পারছে। নইলে শিক্ষা-সভ্যতার আলো দেখতে এদেশের মেয়েদের আরো কত শত বছর লাগত কে জানে? মনে মনে সেইসব মহামানবদের প্রনাম করলাম। চলতে চলতে এসে পৌঁছলাম নাঙ্গুলপাড়া। এখানেই সেই তীর্থস্থান। জীর্ণ বোর্ড ঢোকার মুখে গেটের ওপরে।



ভেতরে ঢুকতেই ডানহাতে বাড়ির মালিকের আবক্ষ মূর্তি। আর সোজা নাক বরাবর তাকালে একটি পাকা ভাঙ্গা বাড়ির কঙ্কাল। সেইটিই আমাদের দ্রষ্টব্য। এই বাড়িতে থাকতেই নাকি নিজের বৌদিকে সহমরণে বাধ্য করার প্রতিবাদে রাজা রামমোহন রায় সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সেসব কথা এই বাড়ির বাগানের এখানে ওখানে বড় বড় বোর্ড এ লেখা আছে। সাথে তাঁর  জীবনের নানা ঘটনার কথা। এই সেই বাড়ি।

  




আর ডানদিকে বাঁদিকে বাগান। বহু পুরনো আমলের বড় বড় গাছ জায়গাটিকে যেন থমথমে করে রেখেছে। কেমন যেন পুরনো দিনের অনুভূতি মনের মধ্যে জেগে ওঠে। আছে একটি পুকুরও। সেখানে নাকি পিকনিক মরশুমে বোটিংও হয়। এখন পুকুরে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।

বাগানে আছে একটা তিনতলা watch tower, মনে হয় ওটা পরে বানানো। সেখানে উঠে চারপাশটা সুন্দর দেখা যায়। বাগানের প্রাচীনত্বের সাথে এই watch tower টি বেমানান। বসত বাড়িটি দেখে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য রাধানগর গ্রাম। যেখানে আছে রামমোহন মেমোরিয়াল হল। সেখান থেকে যাব কাছাকাছির মন্দিরগুলো দেখতে। কিন্তু আমার কেমন যেন আর ভালো লাগছিল না কোথাও যেতে। যাই হোক, এগিয়ে চললাম রাধানগরের দিকে।

Sunday, 14 December 2014

আজকে স্নান? পাগল?



সেই গল্পটা মনে আছে তো? ওই যে প্রচন্ড কিপ্টে একজন লোক কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "আপনি স্নান করেন না কেন?" তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'ধরো, তোমায় দুটো দড়ি দেওয়া হলো। একটা তুমি রোজ কূয়ো-র জলে ডোবাবে আর তুলবে। আর অন্যটা বাড়িতে শুকনো জায়গায় রেখে দেবে। কোনটা বেশিদিন টিকবে বলে তোমার মনে হয়? আমাদের শরীরটাও হলো গিয়ে ওরকম দড়ির মতো। যত জল লাগবে তত তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে। তার পর ধরো না কেন স্নানের সময় তেল, সাবান, গামছা এসবের খরচখরচা তো আছেই।' গল্পতে এই কিপ্টে ভদ্রলোক যতই হাসির খোরাক হন না কেন আমি কিন্তু মাঝে মাঝে এই লোকটির এই কথাটি বেদবাক্যি বলে মনে করি। বিশেষতঃ এই শীতকালে। না দাঁত বার করার মতন কিছু হয়নি। আজকের মতন এরকম একটা দিনে চান ফান করার মতন বিতিকিচ্ছিরি কাজে কেউ সময় নষ্ট করে? এ কি আর আমার সেই ছোটবেলার শীতকালের স্নান? চরচড়ে শীতের রোদে অনেকক্ষণ ধরে সর্ষের তেল মেখে রোদে রাখা গরম জলের সাথে আরো খানিক গরম জল মিশিয়ে উঠোনেই রোদের মধ্যে ঝুপঝাপ স্নান সেরে নেওয়া? একে শীতকাল, তায় আবার আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, সঙ্গে তেহাই হিসেবে আজ আবার রবিবার। ত্রহ্যস্পর্শ। সকাল দশটার সময় পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে কিনা দেখে নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিছানায় উঠে বসতে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো শপথ করে ফেলতে হয়। যেমন, আজ আমায় কেটে ফেললেও আমি ঘর থেকে বেরোব না। তারপর কিছু রান্নাবান্না করব না, ফ্রিজ হাঁটকে যা বেরোবে তাই দিয়ে কাজ চালাব। কাজ না চললে দোকানে ফোন করে কাজ চালাবার ব্যবস্থা করব। অত্যন্ত জাগতিক ও জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া সারাদিন লেপের ওম ত্যাগ করবনা। বিছানায় বসেই সিনেমা দেখা, গপ্পের বই পড়া, গান শোনা, ইন্টারনেট এ দেশের দশের খবর নেওয়া, হাচিকোকে ভ্যাংচানো, হাচিকোর ঘুমের সময় বিটকেল আওয়াজ করে ওকে চমকে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম সারব। আর মঝে মাঝেই একটু করে ঘুমিয়ে নেব। আর এর মধ্যে স্নান? পাগল? আজকে স্নান মানে তো অপরাধ। এইসব শপথ টপথ নিতে নিতেই দশটা থেকে অন্ততঃ এগারোটা বাজবে। তারপর জনগনের ঠেলায় ঝুঁটি টুঁটি সামলে আয়নার সামনে নিজেকে মুখ ভ্যাংচাতে-ভ্যাংচাতে দাঁত মাজতে হবে। তারপর বারোটার সময় ফ্রিজে রাখা চিকেন আর ভাত খেয়ে সারাদিনের জন্য আবার লেপের তলায় চলে যেতে হবে। 

বাপরে বাপ। কত্ত কাজ। এসব কাজ সেরে, হাচিকোকে খুঁচিয়ে শেষে মনে প্রবল বিরহ পেল। 'এএএই শীইইতে-মেঘলা দিইইনে-বাইরেএএএ  থাআআআকে নাআতও  মওওন। কবে যাবওও, কাছে পাবওও, ওগো লেপের নিমওওন্ত্রণ।'-গাইতে গাইতে লেপে ঢুকতে যাব, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে জনগণ আমায় খোঁচালো। "কিরে তুই সত্যি স্নান করবি না?" 
করুণার দৃষ্টিতে তাকালাম। মনে মনে বললাম "ভগবান, এই অর্বাচীনকে তুমি ক্ষমা করে দিও ঠাকুর। এ জানে না এ নিজের কি ক্ষতি করছে এই শীতে রোজ রোজ স্নান করে। ভিজে দড়ি আর শুকনো দড়ির গল্পটা একে মনে করিয়ে দিও ঠাকুর।" কিন্তু এসব কথা তো আর মুখে বলা যাবে না। সুতরাং বললাম, "আজকে ছেড়ে দে। কাল ঠিক করব। কাল রোদ উঠবে, আমি ওয়েদার ফোরকাস্ট এ দেখে নিয়েছি (এখন দেখাচ্ছে কালও নাকি মেঘ বৃষ্টি হবে। হায় হায়!!!!! কাল আর ছাড়ান পাবোনি গো ঠাকুর। কাল গায়ে জল ঢালতেই হবে। নইলে জনগণ আমার গায়ে ঠান্ডা জলই না ঢেলে দেয়! নিজে করলে তাও গরম জল পাব। কি যন্ত্রণা!!)।"
মনটা সেই আগামীকালের সমাগত দুঃখে এত ভারী হয়ে গেল কি বলব। এরকমও মনে হতে লাগলো কেউ আমার বন্ধু নয়। আপনজন? ছোঃ !! আপনজন কি এই শীতে-মেঘলায় গায়ে জল ঢালার পরামর্শ দেয়? রাগে-দুঃখে বারান্দায় চলে গেলুম। গিয়েই বাপ বাপ বলে আবার ঘরে ঢুকে আসতে হলো যদিও। কি হওয়া কি বলব! তার মধ্যে ঝির ঝির বৃষ্টি। বারান্দায় রাখা একমেঅদ্বিতীয়ম কারিপাতার গাছটা পর্যন্ত এই হাওয়ায়-ঠান্ডায়-বৃষ্টিতে দিব্যি স্নান টান করে চকচকে ভেজা সবুজ পাতা নাড়িয়ে আমায় ভ্যাংচাচ্ছে। 



দেখে শুনে মনে মনে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আর কাঁপতে কাঁপতে আরো দীর্ঘ্য দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকে এলাম। গুটি গুটি লেপের তলায় ঢুকে আপাতত প্রার্থনায় বসব ভাবছি। "হে ভগবান, কিছু একটা করো, কাল যেন রোদ ওঠে, নইলে যেন ঠিক স্নানের সময়টাতে অন্ততঃ ইনস্টিটিউট এর জলের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুর।"


Monday, 8 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............প্রথম পর্ব

আগের দিন যে কথাটা বলছিলাম, ওই যে বালিপুর বেড়াতে যাবার গল্প। সে গল্পটাই আজ শোনাতে বসেছি। বালিপুর হল হুগলী জেলার ছোট্ট গ্রাম। তারকেশ্বর থেকে দুই নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আরামবাগের দিকে যাবার সময় চাঁপাডাঙ্গা-র পরে দামোদরের পাকা সেতু পেরিয়েই পুরশুড়া থেকে যে পাকা রাস্তাটা গাছ-গাছালি আর আদিগন্ত ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বামদিকে ছত্রশালের দিকে এগিয়ে গেছে সেই রাস্তা ধরে দশ বারো কিলোমিটার গেলেই বালিপুর। সেই যেখানে মুন্ডেশ্বরী নদী পথচলার ক্লান্তিতে দুভাগ হয়ে আবার পরে দুটি ধারা মিশে গিয়ে সৃষ্টি করেছে 'উদনা'-র চর, সেই সেখানে হলো গিয়ে বালিপুর গ্রাম। সেখানে আছে একটি মাত্র স্কুল- একটিমাত্র বাজার-বেশ কয়েকটি মন্দির-সঙ্গে ঘরে ঘরে হরেক চ্যানেল এর হরেক কিসিমের সিরিয়াল এর সাড়ে বত্রিশ ভাজা-এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত ধান আর শাকসবজির ক্ষেত-মুন্ডেশ্বরী নদীর বাঁকে প্রতিদিনের নরম-আদুরে সূর্যাস্ত-আর আছে পিনাকীর ফেলে আসা ছেলেবেলার প্রথম পাঁচটি বছর। 
বালিপুরে সন্ধ্যে নামার আগে মুন্ডেশ্বরী নদীর ঘাটে 
সেই ফেলে আসা পাঁচটি বছরের স্বাদ নিতেই এত বছর পর আবার যাওয়া। তারকেশ্বরে ট্রেন থেকে নেমে আমরা গেলাম তারকেশ্বর মন্দির দেখতে। বহু ছোটোবেলায় আমি নাকি গেছিলাম, মা বাবার মুখে শুনি। অবশ্যই একা নয়, আয়েশ করে গ্যাঁট হয়ে তাঁদের কোলে চেপে বসে। তা  "সেসব আমার মনে তো নেই।" তাই সে অর্থে আমার প্রথম বার দেখা তারকেশ্বর মন্দির। বিশেষ কিছু বলার নেই। বিখ্যাত মন্দির যেমন হয়। জল-কাদা-অতি উত্সাহী ভক্ত কুলের ঠেলাঠেলি। এই বুঝি পুণ্যের খাতায় এন্ট্রিটা ফসকে গেল। মন্দিরের সামনে গলি। পেঁড়ার দোকান। জুতো রেখে যাবার জন্য আকুল টানাটানি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা চারজন মন্দিরের সামনে থেকে ঘুরে, দুধপুকুর দেখে,  "এই ঠেলাঠেলিতে আর তোমার দরবারে সশরীরে পৌঁছবার দুঃসাহস দেখালাম না বাবা, খ্যামা দাও"- এই বলে দূর থেকে বাবা শিবের কাছে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে গলির দোকানে ধোঁয়া ওঠা ভাত-তরকারী সাঁটিয়ে সোজা বালিপুরের দিকে। 

বালিপুরের কথা আমি পিনাকীর মুখে শুনে এসেছি সেই প্রথম দিন থেকেই। পরের দিকে হয়ত বারবার বলার কারণে উত্সাহ হারিয়ে হুঁ-হা দিয়ে কাজ সেরেছি। আমার ছেলেবেলা-বুড়োবেলা সবটাই একই জায়গায় কেটেছে এবং ভবিষ্যতেও কাটবে বলে হয়ত ছোটবেলার একটা বড় অংশ বেমালুম হাতছাড়া হয়ে যাবার ব্যথাটা ধরতে পারতাম না ঠিক করে। কিন্তু সেখানকার সময়টুকু, মানুষজন বোধহয় ঢুকে গেছিল আমার ভেতরেও। তাই সেখানে যাবার প্ল্যানিং হতেই দেখলাম আমিও চার হাত পা তুলে "কবে যাওয়া হবে? কবে যাওয়া হবে?"বলে নাচতে লেগেছি। আসলে মানুষ তার ছোটবেলার প্রতিটি কণা সঞ্চয় করে রাখতে চায় সযত্নে। তাই এত বছর পরেও জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর যে জায়গার সাথে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, যার বেশিরভাগ স্মৃতিই মস্তিক কোষে জায়গা নিয়ে পারেনি এই ত্রিশ-বত্রিশ বছরের অজস্র হাবিজাবি স্মৃতির ভিড়ে, সেই জায়গাটার-সেই এককামরার ভাড়ার ঘর- প্রথম স্কুল-দুচার টুকরো স্মৃতির সন্ধানে ফের আমরা বালিপুরের পথে। বালিপুরে কি কি আছে বলতে গিয়ে যে কথাটা বলা হয়নি সেটা হলো ওখানে আছে একটি এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শাখা। আর সেই শাখাটিই হলো বাপি মানে পিনাকীর বাবার প্রথম চাকরিস্থল। ব্যাঙ্কটি এবাড়ি-ওবাড়ি ঠিকানা বদলে বদলে এখন বালিপুর বাজারের কাছে গিয়ে স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে পুঁচকে এই ব্যাঙ্কটিতেই লোটাকম্বল নিয়ে জীবিকার প্রয়োজনে এসে থানা গেড়েছিলেন বাপি। প্রথমে ব্যাঙ্কের মেস তারপর বিবাহপরবর্তী জীবনে বাজারের কাছেই বারোয়ারী এক ভাড়াবাড়ির এককামরার ঘরে। সেই ঘরে এখন জরির এমব্রয়ডারীর কাজ হয়। পুরো বাড়িটিতেই এখন আর কোনো পরিবার বাস করে না। কোনো ঘরে কাঠের কাজ, কোথাও হারমোনিয়াম তৈরী হয়। এই সেই ঘর দেখুন। এই যে ছবি। 

এই ঘরেই বছর ত্রিশ-বত্রিশ আগে পিনাকী বাবু চুষিকাঠি মুখে গম্ভীর হয়ে হামাগুড়ি দিতেন 
সেখানথেকে বালিপুর বাজারে আমরা টহল দিলাম পথে পড়ল একটি জায়গা। যেটি এককালে পিনাকীর স্কুল ছিল। কুঁচো বেলার প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমাদের দুজনের অনেক মিল আর অমিলের লিস্টে প্রথমেই যেটা আসে সেটা হলো প্রথম স্কুল। আমি হলুম গিয়ে সরকারী প্রাইমারী স্কুল-বাংলা মাধ্যম ওয়েস্টবেঙ্গল বোর্ড স্কুল-অনামী কলেজ-ইউনিভার্সিটি-অনামী পিএইচডি ল্যাবরেটরি পেরিয়ে আসা আপাদমস্তক তকমাহীন এক মহিলা। পিনাকীও তাই হতে হতেও হলো না তার একটা কারণ তার পিএইচডি ল্যাবরেটরিটি অন্ততঃ কলকাতা শহরের ছাত্রছাত্রীরা চেনে। আর দ্বিতীয় কারণটা এই অখ্যাত বালিপুরের আনন্দমার্গ স্কুল। যেটিতে নাকি লাল জামা-কালো প্যান্ট-কালো জুতো-সর্বোপরি একটি কালো টাই পর্যন্ত পরে, কপালে ধেবড়ে যাওয়া ইয়াবড় একটা কাজলের টিপ নিয়ে প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে পিনাকীচরণ এককালে বছর দুয়েক প্রচন্ড পড়াশুনা করেছিলেন। পরে অবিশ্যি খড়গপুরের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলেন। আমার স্কুলের গল্প তো আগেই বলেছি আপনাদের। সেসব কথা মনে থাকলেই বুঝবেন প্রথম স্কুল এর ব্যাপারটাতেই তার সাথে আমার কোথায় অমিল। যাই হোক, তো সেই আনন্দমার্গ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এখনো আছে। কিন্তু এরও ঠিকানা বদল হয়েছে। নতুন ঠিকানায় আর যাওয়া হয়নি। পুরনো ঠিকানাটা বর্তমানে হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর ডাক্তারখানা। এই যে দেখুন এখানেই পিনাকীচরণ গাল ফুলিয়ে টিনের বাক্স হাতে রিম্পার হাত ধরে পড়াশুনা করতে যেতেন। বাল্যপ্রেম-ট্রেম ছিল কিনা সেটা অবিশ্যি আমি জানিনা। যাক গে যাক, অবান্তর কথা ছেড়ে এই যে দেখুন ছবি। 
এটি এককালে পিনাকীর স্কুল ছিল
 তারপর বালিপুর হাইস্কুলের মাঠে। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেকার যে কিরকম গ্রাম ছিল সেটা আজকের বালিপুর দেখেই আন্দাজ করা যায়। তখন সেই অজ গ্রামে বাইরে থেকে গিয়ে ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা স্কুলের মাস্টারমশাইরা কাজের শেষের বাকি সময়টা কিভাবে কাটাবেন বুঝে উঠতে পারতেন না। কোনোরকম এন্টারটেইনমেন্ট এর ব্যবস্থা ছিলনা সেদিনের বালিপুরে। তাই বহিরাগত সেসব ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা স্কুলের মাস্টারমশাই দের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল একটি ক্লাব। এবং তাদেরই ব্যবস্থাপনায় হয়েছিল ব্যাঙ্ক কর্মচারী vs স্কুলের মাস্টারমশাই ফুটবল ম্যাচ স্কুল এর মাঠে। গ্রামবাসীদের প্রবল উত্সাহের সেই খেলা মনে রাখার একটি কারণ হলো বাপির দেওয়া গোল। এই সেই মাঠ। এখন নাকি অনেক ছোটো হয়ে গেছে। এই যে ছবি। 

বালিপুর স্কুলের মাঠ
সেখান থেকে মুন্ডেশ্বরী নদীর পাড়ে গেলাম। সন্ধ্যে নেমে এলো আসতে আসতে। ফিরে এলাম বালিপুর বাজারে। পথে অবশ্য অজস্র লোকজন-অজস্র দোকানপাটে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আসতে হলো। পুরনো চেনা লোকজন। আমরা দুজন অবশ্য হোঁদল কুতকুতের মত দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে রইলাম সব ক্ষেত্রেই। আমার তো প্রশ্নই ওঠেনা, পিনাকীও চেননা  কাউকে। বড়রা দুজন আপ্লুত হয়ে কথাবার্তা বললেন। তারপর আমরা ফিরে এলাম বাড়িতে। কি বললেন? বাড়ি মানে? বাড়ি মানে স্বপনকাকাদের বাড়ি। এঁনাদের কথা একটু গুছিয়ে বলতে হবে। বালিপুরে থাকার পুরো সময়টাতেই এই পরিবারটিকে পাশে পেয়েছিলেন বাপি মামনি। এঁনাদের টানেই, এঁনাদের ডাকেই এই বালিপুর ভ্রমণ। রক্তের সম্পর্ক টম্পর্কের কথা যাঁরা বলেন তাঁদের জন্য শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো এই দুটি পরিবারের সম্পর্ক। আপনজন হয়ত এঁদেরই বলে।

ছোটখাটো কারখানার মজদুরি, বাড়ির গরুর দুধ বিক্রি, মুড়ি-বাদাম ভেজে বিক্রি ইত্যাদি নানান ছোটখাটো কাজ করে সৎপথে কোনোমতে দিন আনি দিন খাই এর সংসার ছিল দাদু মানে স্বপনকাকার বাবার। তিনটি ছেলেমেয়ে। তপন, স্বপন আর মাধবী। নয়- দশ বছরের ছোট্ট মাধবী পিসির সাথে কেমন করে যেন আলাপ হয়ে গেল মামনির। সেই থেকে সদ্যজাত পিনাকীর টানে তার মায়ের নেওটা হয়ে পড়ল মাধবী পিসি। সেই থেকে দুটি পরিবারের সম্পর্ক শুরু। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের সময়ের টানে এই পরিবারটি অর্থনৈতিক ভাবে উঠে এসেছে অনেকখানিই। কিন্তু বদলায়নি এঁনাদের আন্তরিকতা আর সততা। জীবনে প্রথমবারের জন্য এখানে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল বুঝি কত কালের চেনা এঁনারা আমার।  

এই বাড়ির আর এক সদস্য হলো কুহেলি। কুহেলি চেহারাতেই গরু। স্বভাবে কুকুর। বাড়িতে নতুন কেউ ঢুকতে গেলে কুহেলির সামনে যদি পড়ে তবে তাকে টপকে বাড়িতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। শিং নাড়িয়ে তেড়ে যাবে সে। রোজ দুকেজি আলু খায় সে। সাথে আর যা কিছু গরুর খাবার সেসব তো আছেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা সে নাকি ছোটবেলায় ঠাকুরমার সাথে মশারির মধ্যে শুতো। সে অভ্যাস খানিকটা বদলে আজও বর্তমান। তার জন্য গোয়ালঘরে রাতে মশারি টাঙিয়ে দিতে হয়। সে রাতে মশারির ভেতরে ঘুমোয়। এই যে দেখুন ছবি। কুহেলীর পেছনে তার মশারিটি দেখা যাচ্ছে কি? 

কুহেলি ও তার মশারি 
পুরনো শিব মন্দিরে যাওয়া হলো দল বেঁধে। মন্দির তো নতুন রং এ সেজেগুজে একদম নতুন হয়ে গেছে। মন্দিরের গায়ে দশ মহাবিদ্যার মূর্তি গড়া রয়েছে। তাতে আধুনিকতার ছাপ সর্বত্র। তবে মন্দিরে যাবার তন্বী রাস্তাটি ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে সুন্দর গতিতে চলেছে। ধানক্ষেতে অজস্র সারস সবুজের মধ্যে যেন সাদা বুটিদার শাড়ী তৈরী করেছে।

গ্রামের শিব মন্দিরে যাবার রাস্তা

মন্দিরের গায়ে দশমহাবিদ্যা 

শিব মন্দির নতুন রূপে, পাশে নির্মীয়মান শীতলা মন্দির
আমরা যেদিন গিয়ে পৌছলাম বালিপুর সেদিন ছিল রাসপূর্নিমা। আর হুগলীর এই অঞ্চলে রাসপূর্নিমা পালন করা হয় বড় জাঁকজমক সহকারে। স্বপনকাকাদের বাড়িতেও পাড়ার অন্যবাড়ির মত রাধা কৃষ্ণের রাস উত্সব পালন করা  হচ্ছিল। আর পাশেই রয়েছে মনসা মূর্তি। বালিপুর বাজারেও দোকানে দোকানে বিক্রির জন্য রাখা অজস্র রাধাকৃষ্ণ আর গোপিনীদের মূর্তি। 


পরেরদিন আমরা যখন রাধানগর গেলাম তখনও খানাকুলের বিখ্যাত গোপিনাথজীর রাসের মেলা দেখলাম। সাথে দেখলাম আরো অনেক কিছু। সে গল্প পরের দিন হবেখন আজ এপর্যন্তই থাক কেমন?  

  

Wednesday, 3 December 2014

কৈফিয়ৎ ও জগদ্ধাত্রী পুজো

গত একমাস যাবৎ ঘাপটি মেরে থাকার পর আজ আবার ইচ্ছেখাতার পাতায় ভুস করে ভেসে উঠেছি। যদিও এই একমাস এর সবকটি দিনই আমায় প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হয়নি তাও আমি কষ্ট করে এক অাধ দিনের জন্য আর ভেসে উঠতে চাইনি আর কি। একমাসের বেজায় হুল্লোড়বাজি ছেড়ে আজ থেকে আবার নিজের কূয়োতে প্রত্যাবর্তন করেছি তো তাই আবার পুরনো বন্ধুর কাছে গত একমাসের গল্পের ঝাঁপি নিয়ে হাজির হয়ে গেছি। কি বললেন? কি করলাম এই একমাস? আরে কি করিনি তাই বলুন। দাঁড়ান গুছিয়ে বসি।  হ্যাঁ, এবার লিস্টি রেডি। বলছি। 'মুসকান' এর কুঁচোগুলোর সাথে একটা অনবদ্য দেওয়ালী কাটিয়ে গত ২৮শে অক্টোবর আমরা দুজনে দুটো খালি ব্যাগ নিয়ে কলকাতা রাজধানী চেপে সো ও ও ও ও জা যে যার বাড়ি গেছি। খালি ব্যাগ কেন? সোজা তো। বাড়ি থেকে ফেরার সময় যাতে ভর্তি করে আনতে পারি সেজন্য। তারপর তো দেদার মজা। পয়লা নভেম্বর জগদ্ধাত্রী পুজো ছিল। আমাদের বাড়িতে প্রায় শতাধিক বছর ধরে চলে আসছে জগদ্ধাত্রী পুজো। আক্ষরিক অর্থেই শতাধিক বললাম। কারণ শুনেছি দাদুর বাবার পাঁচ বছর বয়স থেকে চলে আসছে এই পুজো। দাদু মারা গেছেন ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স ছিল বিরাশি-তিরাশি বছর। সুতরাং তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর এখন বয়স হত ১১৯ বছর। তাঁর বাবার পাঁচবছর বয়সের পুজো মানে আরো ধরে নেওয়া যাক কুড়ি বছর। সুতরাং কাক্কেশ্বরের হিসেব অনুসারে প্রায় একশ চল্লিশ বছরের পুজো। আমাদের রাবনের গুষ্ঠির প্রতিনিধিরা মোটামুটি বছরের এই সময়টা যে যার কূয়ো ছেড়ে এই একশ চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা মা জগদ্ধাত্রী আর পারিবারিক হ্যা হ্যা হি হি র টানে লোটা কম্বল নিয়ে আমাদের বাড়িতে গুটি গুটি হাজির হয়। সেই চার পাঁচ দিন একই বিছানায় গুঁতোগুঁতি করে শুয়ে-সকাল থেকে স্নানের লাইন দিয়ে-পুজোর পর প্রসাদ খাওয়া নিয়ে বাচ্চাদের মত হইচই করে ছোটোপিসিমার ঘাড় ভেঙ্গে মিষ্টি-সিঙ্গারা খেয়ে মনেই পড়ে না যে আমি হরিয়ানার জঙ্গুলে গবেষণাগারে সারা বছর ধরে নানা হাস্যকর পরীক্ষা নিরীক্ষার ভান করি। আর প্রতিপদে অকৃতকার্য হয়ে চূড়ান্ত হতাশায় গুরগাঁও গিয়ে pizza খাই আর মোটা হই। যাই হোক, আজ আর এসব বাজে কোথায় সময় নষ্ট করব না। পুজোর শেষে মন খারাপের সুযোগ কিন্তু এবছর ছিল না।  কারণ, পুজোর পরই গেলাম বালিপুর। হুগলী জেলা। একটা দুর্দান্ত দুদিনের ভ্রমণ হলো। সেখানকার গল্প পরের দিন বলছি। বালিপুর থেকে ফিরে এখানে এলাম এবং তখনও কোনো মন খারাপ হলো না বরং আনন্দে নাচতে নাচতে ফিরে এলাম। কারণ সঙ্গে বাবা। বাবাকে আমরা দুজনে এবার "যেতেই হবে" বলে প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়ে চলে এসেছিলাম। বাবার সাথে weekend এ গেলাম দিল্লির নতুন সংযোজন অক্ষরধাম মন্দির, যা বাবার দিল্লি বাসের সময় ছিল না। সাথে ফাউ হুমায়ুনের সমাধি। বাকি দিল্লি বাবার চেনা। তাই আর রাস্তায় সময় নষ্ট না করে ভুরিভোজ হলো গুছিয়ে। সেসব গল্পও ধীরে ধীরে বলবখন। তারপর আমরা তিনজনে পরের সপ্তাহান্তে গেলাম জয়পুর। সেসব গল্পও পরে হবেখন। দুদিনে জয়পুর চষে বেরিয়ে সোমবার সকালে ব্যাক টু কূয়ো। আরও খারাপ খবর হলো ঠিক তার পরের দিন অর্থাত মঙ্গলবার বাবা ব্যাক টু বাড়ি। আর আমরা দুই মক্কেল কাল সন্ধ্যেয় বাবাকে নিউ দিল্লি স্টেশন এ তুলে দিয়ে আবার গুটি গুটি পায়ে খোঁয়াড়ে ফিরে এসেছি। মুখ চুন করে মুরগি সেদ্ধ আর রুটি গিলে ঘুমিয়ে পড়েছি। আজ আবার ল্যাবে এসে পুরোনো ভ্যানতাড়ায় সময় নষ্ট করছি। এবছরের মত খেল খতম। পুরনো ছবি দেখে মন ভরাও। আর কি? এই আমার একমাস ডুব মেরে থাকার কৈফিয়ত। কৈফিয়ত সেরে আপনাদের জন্যে রইলো এই বছরের আমাদের জগদ্ধাত্রী পুজোর কটা ছবি।