Monday, 15 September 2014

গুপ্তধন কোথায়?.......প্রথম পর্ব

হইহই কান্ড রইরই ব্যাপার ! আমাদের গাঁয়ে থুড়ি আমাদের ক্যাম্পাসে মেলা  বসেছে। প্রতিভার মেলা। সারা ক্যাম্পাস মাতোয়ারা। আগের দিনই তো বলছিলাম না খেলার মাঠের কথা। ফুটবল-ভলিবল-ছোটো, বড় মহিলা -পুরুষ হরেক কিসিমের ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন-টেবিল টেনিস, তারপর ধরুন গিয়ে ছোটবেলার কাবাডি- খো-খো, তিনপায়ে দৌড়-গুলিচামচ কি নেই সে লিস্টে ! দারুন ব্যাপার। আমি তো ভাবছিলাম বস্তা দৌড়- ব্যাং লাফ, কুমির ডাঙ্গা  সেসবও রাখতে বলব পরের বছর। মানে যদি কোনো 'হা-পরামর্শদাতা' অর্গানাইজার আমার পরামর্শ চাইতে আসে আর কি। কেন বলুন তো? ওপরে যেসব কুলীন খেলাধূলোর কথা লিখলাম, সেসব আমার মত লেবদুশের কম্ম না হলেও আমি কিন্তু একটা কথা প্রচন্ড গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে, আমি 'ও কুমির তোর জলকে নেমেছি' বলে দুর্দান্ত কুমির-ডাঙ্গা খেলতাম এককালে। এখন এই চালকুমড়ো মার্কা দেহপট নিয়ে কতটা পারব সে কূটপ্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েও বলছি পরের বছর যদি লিস্টে কুমিরডাঙ্গার নাম থাকে, আমি আমার একমাত্র ক্রীড়া-প্রতিভা, কুমিরডাঙ্গার জন্য নিশ্চয়ই লাফাতে লাফাতে গিয়ে নাম লিখিয়ে আসব। ও ও ও...... আরো একটা কাজ আমি খুব ভালো করতে পারি সেটা হলো গিয়ে মাঠের পাশে বসে প্রবল উত্সাহে চেঁচাতে পারি, আর মুমূর্মুহু হাততালি দিতে পারি। এটাও কি কম প্রতিভা বলুন? সবাই যদি খেলবে তো সেসব কসরৎ দেখে উল্লসিত হয়ে হাততালি দেবে কে?
এত গেল গিয়ে খেলার খবর। আরো আছে। সঙ্গীত, আঁকাঝোকা, রান্নাবান্না-লেখালেখি- সঅ অ অ অ ব আছে সেই মেলায়। সেখানেও জনগণ গিয়ে প্রতিভার প্রদর্শন করে এসেছে। আমিও বাদ পড়িনি। আমি যে কতবড় চিত্রশিল্পী আর কতবড় রাঁধুনি সে সাক্ষর রেখে এসেছি। সেইসব প্রতিযোগিতা নিয়ে উচ্ছ্বাস-আনন্দ-ফাজলামি-গোমড়ামি সব মিলে সে এক দুর্দান্ত প্যাকেজ। যেমন ধরুন কেউ গেছে স্রেফ আনন্দ পেতে-দুহাতে রং মেখে কাগজে ছোটবেলার মত ইচ্ছেমত মাখাতে, কেউ গেছে আপাদমস্তক ফাজলামির মন নিয়ে-রং নিতে বিশাল কাগজ ভর্তি কেবল স্মাইলি আঁকা শেষ করে অন্যের কাগজে আঙ্গুল দিয়ে রাইট চিহ্ন এঁকে বললে তোর আকাশে পাখি এঁকে দিলাম। বলেই খি খি করে ফাজিল হাসি। মোদ্দা কথা পুরো সন্ধ্যে ভর্তি কেবল মজা ভেতরে-বাইরে সর্বত্র। এরমধ্যেও আবার কেউ কেউ সত্যিকারের প্রতিযোগী যারা জীবনে সত্যিই কিছু করে দেখাতে চায়, তারা আবার এইসব ফাজলামিতে বড়ই বিরক্ত। কেউ বলে, আমি গেলে এসবের চেয়ে তো অনেক ভালো খেলতে/আঁকতে/গাইতে/রাঁধতে পারতাম। কেউ আবার বলে শোন, এইসব বালখিল্য ব্যাপারে নেহাত আমার কোনো উত্সাহ নেই তাই, নইলে এখানে যা যা হচ্ছে সেসবে আমি বলে বলে সকলকে হারাতে পারি। কেউ আবার বলে, লোকে নিজেদেরকে এত বড় ভাবে যে, আমায় কেউ আগের বছর পাত্তাই দেয় নি জানিস তো, তাই আমি এবছর সব কিছুতে বড় কষ্ট করেই তুশ্চু মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেউ আবার আমায় এমন কিছু একটা করতেই হবে যে লোকে আমার প্রতিভা নিয়ে যেন হ্যা হ্যা না করে, এই মনোভাবে সাংঘাতিক সব ভালো ভালো শিল্প রচনা করে ফেলে। স্বাভাবিক, যারা প্রচন্ড প্রতিভাধারী তাদের তো নাকি কেউ চিনতে পারে না তাই না? এই যে আমি শিল্পচর্চায় যে আমার এত প্রতিভা আমিই কি ছাই জানতাম আগে? এককথায় ফাজলামি-উদ্দাম মনের আনন্দ-ঈর্ষা-অহেতুক প্রতিযোগীতা-ব্যাঁকা সমালোচনা-ও রে আমি কি হনু রে- সব কিছু নিয়ে ফাটাফাটি একটা মাসখানেকের কার্নিভাল। আর তার মধ্যে আমার লাভ হলো ওই সাইডে বসে চিপস খেতে খেতে বেশ কিছুদিনের জন্য মাথাটা ফ্রেশ করে নেওয়া। কারণ দুটো লাভ দেখুন, আমরা বিনা পয়সায় পাক্কা একমাস ধরে একটানা কমেডি শো দেখে গেলাম। আর মাঝে মাঝে সেই শো এর কুশীলব হয়ে নিজেদেরকেও বেশ অন্য লোকের কাছে কমেডিয়ান-কমেডিয়ান করে তুলতে পারলাম। যাই হোক এখন, মেলা শেষ। মাথা ফ্রেশ।

কিন্তু আসল কথাটা বলি, এই মেলার দৌলতে আমি জীবনে প্রথমবার একটা দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাগিরি করলাম। ফেলুদা টাইপ নয়, হেমেন মজুমদার এর কুমার-বিমল টাইপ। মানে? মানেটা হলো গুপ্তধন খোঁজার খেলা। ট্রেজার হান্ট। কি দারুন ব্যাপার না? খেলার দিন সকাল থেকে ল্যাবে কাজকর্ম সেরে বিকেল থেকে তো আমাদের টীম এর পোড়খাওয়া পাকা খেলুড়েরা আমাদের দুই আনকোরাকে- "আধঘন্টা ঘুমিয়ে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেবে নইলে রাত দুটো তিনটে অবধি টানতে পারবে না", "হালকা কিন্তু এনার্জেটিক কিছু খেয়ে স্টার্ট করবে", "পা ঢাকা বুটজুতো পরে আসবে নইলে ছুটতে অসুবিধা হবে", "আর সবাই সাদা টি-শার্ট পরে নেবে আমাদের টীম এর রং হলো সাদা" ইত্যাদি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী দিয়ে নিজেরা যে যার রুম এ চলে গেল সন্ধ্যে সাতটায় দেখা হচ্ছে বলে। আর আমি সব নির্দেশেই বাধ্য ছাত্রের মত ঢক ঢক করে মাথা নেড়ে বাড়ি চলে এলাম। তারপর দুই এডভেঞ্চার লোভীর কি হলো বলি গুছিয়ে।

সাতটায় বেরোতে হবে।  সন্ধ্যে ছটা পনেরয় ফেসবুক ইউটিউব সেরে ব্যাগ ঘাড়ে ল্যাব থেকে ফিরে এসে দেখলাম সকাল দশটায় বানানো ভাত-ডাল-বাঁধাকপির তরকারী দিব্বি রান্নাঘর আলো করে বসে আছে তখনও। দুপুরে ক্যান্টিনেই খেয়েছি। অতএব চলো সন্ধ্যে সাড়ে ছটার সময় হালকা কিন্তু এনার্জেটিক খাবার-ভাত-ডাল-বাঁধাকপির তরকারী খেয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে দেখলাম পাওয়ারন্যাপ নেবার আর সময় নেই। ভর সন্ধ্যেয় ভাত খেয়ে শুলে আর দেখতে হবে না, রাত বারোটায় ঘুম ভাঙবে। অতএব প্রথম দুটো নির্দেশই জলে। তৃতীয় নির্দেশানুসারে স্নিকার বের করে দেখি-ও হরি, এর একটার তো শুকতলা লাগাতে হত, শুকতলা উঠে গিয়ে সে জুতো নিচ থেকে দাঁত বের করে হাসছে। ধুত্তেরি বলে অন্য একটা পা ঢাকা জুতো বের করলাম। তিনিও বিশেষ সুবিধার নন। তেনার একপাটির ভেলক্রো আবার প্রতি দশ সেকেন্ড অন্তরই দেখ না দেখ খুলে যায়। এটি পরেই আমি মায়াবতী গেছিলাম আর তখন থেকেই এটার এই অবস্থা সেকথা আমি বলেওছিলাম বোধকরি আপনাদেরকে। ক্যাম্পাস এ থাকলে কে আর কবে জুতো- জামার যত্নআত্তি করে? হাওয়াই চটি বা সাধারণ একটা স্লিপার গলিয়ে রোজ যাওয়া আসা। এখন এডভেঞ্চার কি করে করি? যা হবে হবে বলে দ্বিতীয় জুতোটাই পরব আর ভেলক্রোটার বেয়াদপি ইগনোর করব ঠিক করলাম। বাকি রইলো সাদা টিশার্ট। এতক্ষণে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার গায়েই তো সাদা টিশার্ট। কুছ পরোয়া নেই। আরো একটা আছে। তাঁকে খুঁজতে গিয়ে দেখি, তিনি সম্ভবত গত সাড়ে সাত বছরের ময়লা গায়ে মেখে বসে আছেন। আমারই কুঁড়েমির ফল। এবার কি করি? আঙ্গুল মটকে, মাথা চুলকে, খাটে বসে দশ মিনিট ধরে ঠ্যাং দুলিয়েও আর কোনো সাদা টি-শার্ট এর কথা মনে করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত সারা দিনের পরে থাকা-চটকে চচ্চড়ি হয়ে যাওয়া টিশার্টটাকেই ফের গলিয়ে একবোতল ডিওরডেন্ট দিয়ে চান করে পকেটে পেন কাগজ (পাজল সলভ করতে লাগতে পারে) মোবাইল এ যথেষ্ট চার্জ আছে কিনা পরীক্ষা করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তারমধ্যে উত্তেজনার চোটে হাউমাউ করে পিনাকীকে কি একটা বলতে গিয়ে মুখে একটা পোকা ঢুকে গেল আর আমি ঢোঁক করে সেটা গিলে ফেললাম। থু থু করতে করতে শুনি পিনাকী খি খি করে হাসছে আর বলছে কেমন মৌরি-মৌরি খেতে লাগছে কি? আমি তো আর প্যালারাম নই, যে পোকার মধ্যেও তার মৌরিত্ব খুঁজে পাবো। মনে মনে পিনাকীকে শাপশাপান্ত করতে করতে সন্ধ্যে সাতটায় পেট ঠুসে ভাত খেয়ে পোকা দিয়ে মুখসুদ্ধি করে বেরিয়ে পড়লাম গুপ্তধন খুঁজতে।

 মাঠে গিয়ে দেখি সব টীমই রেডি। আমাদের আট জনের টীম। সবাই সাদা টিশার্ট পরে মাঠে হাজির। বাকি টীমরাও কালো/সবুজ/ ধূসর/মেরুন নানা রঙের ফুল ফুটিয়ে হাজির। প্রথমে কায়দা করে ছবি টবি তোলা হলো। গেম কোঅর্ডিনেটর এসে হেডমাস্টারমশায়ের মত মুখ করে গেমএর নিয়মাবলী দিয়ে গেল প্রত্যেক দলকে। শুনলাম আমাদের দলের নম্বর নাকি পাঁচ। হেডমাস্টারমশাই আমাদের টীমের নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমি যথারীতি ভেবলু মুখে পাশের জনের দিকে তাকাচ্ছি, দেখি সবাই বলছে 'এক্সপ্লোরার'-'এক্সপ্লোরার', জানলাম আমাদের টিমের নাম 'এক্সপ্লোরার' যেটা আমি আর পিনাকী ছাড়া সবাই জানত। তার মাঝে দেখি আসিস্টান্ট হেডমাস্টারমশাই সব দলের দলপতিকে ডাকছে প্রথম ক্লু দেবার জন্য। আমাদের দলের দলপতি কে? ওমা কখন দেখি পিনাকী সর্বসম্মতিক্রমে দলপতি হয়ে চলে গেছে সেখানে। সেটাও আমি জানি না। দেখি পাশে হাচিকো বসে হাসছে। মনে হয় আমায় প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিল আর বলছিল, 'তোর দৌড় বুঝে গেছি। তুই আর কেন কষ্ট করবি? আমার পাশে বরং বসে খেলা দেখ।' যাই হোক ওর কোথায় বিশেষ পাত্তা না দিয়ে খেলা তো শুরু হলো।

তারপর রাত্রি বারোটা পর্যন্ত যে কি কি হলো, সে এক মিনি মহাভারত। সে কাহিনী বিস্তারিত পরের অংশতেই বলছি। আজকে এপর্যন্তই।

পরের অংশ এখানে.......

0 comments:

Post a Comment