Tuesday, 9 September 2014

বন্ধু

অনেকদিন আপনাদের সাথে আড্ডা মারা হয়নি। মাঝে প্রচুর গবেষণা করলাম। গুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কার হব হব করেও হলো না। সাধারণ ভাবে যা হয় আর কি আমাদের মতন সব ভবিষ্যত ভি. রামাকৃষ্ণনদের সাথেই। যাই হোক, এর ফলে এন্তার ভালো মন্দ খেতেই হলো কি করব বলুন, সেসব ট্রাজেডি কাটিয়ে উঠতে হবে তো। তারপর সম্পূর্ণ ফর্মে ফিরতে প্রচুর শিল্প কর্ম করতে হলো। ক্যাম্পাসের বাত্সরিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে কয়েক সপ্তাহ হলো।  প্রতি শনিরবি তেই নানান রকম খেলাধূলা, শিল্পকলার পারদর্শিতার প্রদর্শনী চলছে। ভাবলাম এই এই আশিমণ বপু নিয়ে খেলার মাঠের দিকে না যাওয়াই ভালো, তার চেয়ে বরং এই ফাঁকে আমিও খানিক রং টং ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসি না কেন? তো সেইসব মহামূল্যবান শিল্পকর্ম করতে গিয়েও বেশ কিছুটা সময় গেল। তাতে অবিশ্যি আমার কোনো দুঃখু  নেই কারণ, কালকে ছোটবেলার মত করে হাতের পাঁচটা আঙ্গুলে ইচ্ছেমত রং মেখে কাগজে ইচ্ছেমত আঁকিবুঁকি কেটে বিস্তর মজা করেছি। কাগজে রং মাখিয়েছি। অনিচ্ছেতেও হাতে পায়ে গলায় রং মেখে গেছে। সাদা টি-শার্ট আর জিন্সও বাদ যায়নি। মোটকথা পোস্টার কালার নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছি। এসব করে টরে মেজাজ খুশ। তাই ভাবলাম একটু আড্ডা মারা যাক।

আমার আপডেট তো দিলাম। এবার যার গল্প শোনাব বলে ভাবছি আজকে আপনাদেরকে, সে প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। বেশ কিছুদিন ধরেই শোনাব ভাবছিলাম কিন্তু ওই যে বললাম, প্রকান্ড সব গবেষণা আর শিল্পকর্মের ভিড়ে গল্প ল্যান্ড করার ফাঁক পাচ্ছিলো না। এইবেলা বলে ফেলি কেমন?

গল্পটা আমার এক অনেক ছোটবেলার বন্ধুকে নিয়ে। সে প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা যখন তার সাথে আমার প্রথম আলাপ। সে বেচারীর শরীরটা যত্পরোনাস্তি রোগা পাতলা। কিন্তু গায়ে বেজায় জোর। কতবার কত রকম ভাবে যে সে আছাড় খেয়েছে, কখনো কখনো আমিও পড়েছি বেচারির ঘাড়ের ওপর, কিন্তু একটু আধটু ছড়ে-কেটে যাওয়া ছাড়া তার আর কখনো কিছু হয়নি। দুজনে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে দাঁত ছরকুটে পড়েছি দুজনেই। আমি তো যথারীতি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাড়ি ফিরেছি, ব্যথায় চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে রাতে পায়ে গরমজল ঢেলেছি। সে কিন্তু বহাল তবিয়তে দাঁত বার করে আমায় দেখে হ্যা হ্যা করে হেসেছে।

আমার এই হারকিউলিস বন্ধুটির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আমি তখন ক্লাস ফাইভ। বাবা ই একদিন দিয়েছিল আলাপ করিয়ে। সেই যে দুজনের বন্ধুত্বের শুরু সে এখনো চলছে। এমনকি তার গায়ে উল্কি করে আমার নাম পর্যন্ত লেখা ছিল।বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই কি প্রচন্ড প্রেম ! আমরা দুজনে একসাথে স্কুল এ যেতাম। তারপরতো মাধ্যমিকের গন্ডি টপকে ক্লাস ইলেভেন এ উঠতেই আমরা দুজনে আঠার মত একসাথে জুড়ে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের মত খাবার দাবার ব্যাগে ভরে সেই যে দুজনে বেরোতাম, অঙ্ক- বায়োলজি-কেমিস্ট্রি-ফিজিক্স-ইংরাজী -বাংলা -র মাস্টারমশাই দের বাড়ির বৈঠকখানা আর স্কুল এর চত্বরে পাঁচ-ছয় ঘন্টা কাটাবার পর সেই সন্ধ্যায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফেরা। আমি যথারীতি জিভ বার করে হ্যা হ্যা করতে করতে আর সে যথারীতি টগবগে ঘোড়ার  মত দৌড়াতে দৌড়াতে। এরকম সময় একবার মনে আছে কোনো কারণে দুপুর বেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। গরম কাল। জনমানব নেই রাস্তায়। প্রবল হাওয়া দিচ্ছে মাঠের মাঝে। আর তার মধ্যে আমি তাকে জোর করছি আরও জোরে দৌড়ে বাড়ি যাবার জন্য। সে সেই বিপরীত হাওয়ার মধ্যে প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে সামনে এগোবার। আমিও নাছোড়বান্দা। আমাকেও তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। ফলে আর কি? লেগে গেল ঝটাপটি। ওই হাওয়ার মধ্যে আমার স্কুল এর শাড়ী গেল জড়িয়ে তার সাথে। দুজনেই পড়লাম মুখ থুবড়ে মেন রাস্তার মধ্যে। কোনমতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না শাড়ীটাকে। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার শেষে উল্টো দিক থেকে অন্য একজন সাইকেল আরোহী এসে আমাদের মাঝ রাস্তা থেকে উদ্ধার করেছিলেন সেদিন। দুজনের রণঝটাপটি থামিয়ে দুজনকে আলাদা করে দিতে ফের দুজনে গলা জড়াজড়ি করে বাড়ি ফিরেছিলাম মনে আছে।

দুটি বছর প্রতিদিন সন্ধ্যে-রাত্রি-সকাল-দুপুর সদাসর্বদা আমরা দুজনে আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বল এলাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। তারপর আমায় একাই যেতে হলো কলকাতার কলেজে পড়তে। একদম ভালো লাগতনা জানেন কলেজ থেকে বিকেলে মালা আন্টির ওই ঘুপচি পেয়িং গেস্ট রুমে থাকতে। মনে হত এখন বাড়ি থাকলে দুজনে কেমন রাস্তায় রাস্তায় দুরে বেড়ানো যেত। নদীর পাড়েও গেছি কতবার দুজনে সঙ্গে বাবা। দুর্গাপুজোয় বাবার সাথে আমরা ঠাকুর দেখতে যেতাম দিনের বেলা। শনি বার বাড়ি ফিরে গল্প যে হত না তার সাথে তা নয়। অনেক সময়েই দুজনে বেরোতাম বেড়াতে। কিন্তু সেই রোজকারের যাওয়া আসাতে ফাঁক পড়ে যেত। সে অভিমান করত জানি কিন্তু তাকে সেসময় তেমন করে সময় দেওয়া হয়ে ওঠেনি।

পরে যখন ইউনিভার্সিটিতে যেতে শুরু করলাম তখন আবার তার সাথে পুরনো প্রেম চাগিয়ে উঠলো। দুজনে সেই লাল মাটির কাঁকুড়ে রাস্তা বেয়ে আবার সেই পুরনো দিনের মত ঘুরে বেড়াতাম। ততদিনে তার চেহারারও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কিছু গয়নাগাঁটি উঠেছে শরীরে। আমিও কলকাতার ওই ভিড়ভাট্টা  থেকে রাঙ্গামাটির দেশে পালিয়ে আসতে পেরে বেজায় খুশি। ফলে দুজনে মহানন্দে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলাম আবার। স্টেশন-ইউনিভার্সিটি-মেস-মেডিকেল কলেজ সর্বত্র দুজনে ঘুরে বেরিয়েছি। অবশ্য দুজনে বললে ভুল হবে, তিনজনে। ততদিনে আরো এক বন্ধু যোগ দিয়েছে আমাদের দৌড়াদৌড়িতে।

কিন্তু মানুষের তো সুখের দিন বেশি থাকে না। আমাদেরও ছিল না। আমার ইউনিভার্সিটির মেয়াদ শেষ হলো। আবার শুরু হলো সেই সোমবারের ভিড়ে ভর্তি লেডিস কম্পার্টমেন্ট। হাওড়া স্টেশন, কলকাতার ধাক্কাধাক্কি ভিড়, বিকেলহীন দিন, ক্লান্ত ধুলো আর অধৈর্য্যভরা সন্ধ্যে। তার ফাঁকে আমার খুব মন কেমন করত আমার সেই বন্ধুর জন্য। মনে হত এসময় যদি তার সাথে দুরে বেড়াতে পারতাম। ক্রমে ক্রমে সে অবহেলিত হতে থাকলো। অবহেলায় তার বাইরের চাকচিক্য কমেনি বটে, সেদিকে নজর রাখত বাবা। কিন্তু মনে মনে সে অবহেলিত হতে থাকলো বেশ বুঝতে পারতাম।কফিনের শেষ পেরেকটা পোঁতা হলো যখন একটা স্কুটি এলো আমাদের সংসারে। নতুনের ঢেউ এ পুরনো বন্ধুর কথা প্রায় মনেই রইলো না। সে থাকত এককোণে পড়ে। অযত্নে। খুব অন্যায় করেছিলাম তখন। কিন্তু তাকে আমি আমার মনের বাইরে বার করে দিইনি কোনদিনই। বুঝতে পারলাম যখন তাকে অন্য কারো কাজে লাগার জন্য অন্য লোকের বন্ধু হবার জন্য অন্যের বাড়িতে রেখে আসা হলো। প্রচন্ড প্রতিবাদ করে তাকে আমি সেদিন ফিরিয়ে এনেছিলাম। পরে অবশ্য সে আমারই দাদার বাড়িতে গেছে। সেখানেই আছে আপাতত। কিন্তু তার ওখানেও এখন কোনো কাজ নেই। তাই ভাবছি ওকে আবার সসম্মানে আমার বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসবো। ওখানে তার হয়ত কোনো অযত্ন হয়না কিন্তু তাও আমার সেই কোন ছোট্টবেলাকার সাথী, তাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। কতদিন তার সাথে বেড়াতে যাইনা। কত দিন প্রাণপণে দুজনে সোজা রাস্তায় দৌড় দিইনা।  বড্ড মন কেমন করছে তার জন্য। এবার গিয়ে নিশ্চয়ই তাকে ফিরিয়ে আনব। আর দুজনে সেই পুরনো দিনের মতন রাস্তায় রাস্তায় দুরে বেড়াব। আমি আর আমার ছোট্টবেলার সাথী। আমার প্রথম নিজস্ব যান। যার হ্যান্ডেলের মাঝখানে আমার নাম খোদাই করা আছে এখনো। আমার সেই টুকটুকে লাল সামনে ঝুড়িওয়ালা হারকিউলিস সাইকেল। যাকে আমি বাসের মাথায় চাপিয়ে বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি নিয়ে গেছিলাম আবার ফিরিয়ে এনেছিলাম, ব্যবহার হচ্ছে না দেখে মা যাকে অন্যকে দিয়ে দিয়েছিল ব্যবহার করতে আর আমি শোনামাত্র তাকে অন্যের বাড়ি থেকে বাড়ি নিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার সেই পুরনো বন্ধুর সঙ্গে অনেক অবহেলা করেছি আমি এবার শোধরাতে হবে। বাড়ি নিয়ে এসে, ঝেড়ে মুছে চকচকে করে দুই স্যাঙ্গাত মিলে আবার বেরোব অভিযানে। বেরোবই।       



2 comments:

  1. বাঃ, খুব সুন্দর। বন্ধুর কথা শুনে খুব ভাল লাগলো। :)

    ReplyDelete
  2. Dhonnobad Arijit. Hya o amar khub priyo bondhu.

    ReplyDelete