Tuesday, 30 September 2014

বেঁচে আছি বলেই তো মনে হচ্ছে এখনও!

মহাষষ্ঠীর দিন শুনেছি মা দুগ্গার ঘুম ভাঙানো হয়। ঐদিনই তিনি নাকি তিনি চোখ কচলে উঠে বসে-আড়মোড়া ভেঙ্গে-দাঁত মুখ মেজে-এককাপ দুর্দান্ত দার্জিলিং চা খেয়ে সিংহীটাকে 'চলরে, বাঁদরটাকে খানিক টাইট করে আসি' বলে বেরিয়েছিলেন। তারপরতো 'কি যুদ্ধু..........কি যুদ্ধু!!!! বাপরে! মানে টিভিতে 'মহিষাসুরমর্দিনী' বলে মহালয়ার দিনে যা নাচন-কোঁদন দেখানো হত আর আমি সাত সকালে উঠে একগ্লাস দুধ আর দুটো-মারী বিস্কুট নিয়ে হাঁ আ আ আ করে যা গিলতাম আর কি। তারপর সে ব্যাটা দুষ্টু মহিষ তো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে বেশ খানিকটা তেজ দেখাতো। শেষকালে মা দুগ্গার ত্রিশুলের খোঁচা আর সিংহের থাবার চড়-থাপ্পড় খেয়ে দুগ্গামায়ের পায়ের তলায় দাঁত ছড়কুটে পড়ত। তবেই ধরাধামে শান্তি। তদ্দিনে অবশ্য শাস্ত্রমতে ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী পেরিয়ে নবমী আসবো-আসবো করছে। মোদ্দা কথা এই যে সময়টা চলছে তাতে মা দুগ্গার ত্রিশুলের খোঁচায় সমস্ত মহিষের মুখোশধারী চোর-ছ্যাঁচড়-ডাকাত-জনগণের তহবিল তছরূপকারী-খুনি-ধর্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় আপদ বিদেয় হবার কথা।

এদ্দিন মনে হচ্ছিল বুঝি সত্যযুগের মত তেত্রিশ কোটি দেবদেবী আর দুশো কোটি হাভাতে জনগণের সমবেত চিত্কার-চেঁচামেচি ছাড়া মা-দুগ্গার ঘুমও আর ভাঙবে না। অসুরদমনও আর হবে না। মহিষাসুরের তাড়া খেয়ে যেমন দেবতারা কোঁচা সামলে হৃত্পিণ্ড হাতে করে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছিলেন তেমনি আমাদেরও মরতে মরতে দৌড়াতে হবে মোষের শিং-এর খোঁচা থেকে বাঁচতে। এই করতে গিয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে হচ্ছিল বুঝি মরেই গেছি। আর কোনো মাদুগ্গার ক্ষমতা নেই এই আগাছা পরিষ্কার করার। অসুর ব্যাটারা ঝাড়ে-বংশে এক্সপোনেনশিয়াল রেট-এ বেড়ে বাকিদের ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করলো বলে।

কিন্তু ইদানিং কালের পরপর কয়েকটা ঘটনায় মনে হচ্ছে নাহ, বোধহয় এখনো বেঁচেই আছি। এবং আরো কিছুদিন বোধহয় বেঁচে থাকতে পারব। মা দুগ্গা যে নিজে না আসলেও দূর থেকে বেশ কিছু চ্যালা-চামুন্ডা তৈরী করে চলেছিলেন সেটা এবার বেশ বুঝতে পারছি। চ্যালারাই এখন ভরসা। মা দুগ্গার চ্যালা বলে কথা এ কি আর সোজা কথা? এই যেমন ধরুন না কেন মহিষদলের অন্যায়ভাবে ঢুঁশো মারার প্রতিবাদে মা দুগ্গার হাজার-হাজার পুঁচকে চ্যালার দল নিজেদের ডিগ্রী-সার্টিফিকেট-রেকমেন্ডেশন-বিদেশযাত্রা-গবেষনার তোয়াক্কা না করে এই যে সারা দেশ জুড়ে নিজেদের পাঠশালার হেড-পন্ডিতের এবং তত্সহ মহারানীর সংসারের রাঘব-বোয়াল গোছের মাতব্বরদের ঝুঁটি ধরে এমন টানটাই দিল যে ঝুঁটি খুলে আসার উপক্রম প্রায়। ঝুঁটি বাঁচাতে বড়-বড় মহিষদের এখন মা দুগ্গার পায়ের তলায় বসে 'ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি'-গোছের অবস্থা। এতে করে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, নিজেরটুকুনি কোলে আঁকড়ে বসে না থেকে, নিজের এবং বাকি সকলের কেবলমাত্র সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটুকু সুনিশ্চিত করতে পথে নামার লোক এখনও আছে। তারা কেউ পরবর্তী নির্বাচনের সম্ভব্য প্রার্থী নয় যে 'আমি সত্য পথে জনগণের সাথে আছি' বোঝাতে পথে নেমেছে। দস্তুরমতন পেন-খাতা-পরীক্ষা-গবেষণা ছেড়ে নেমেছে।  মনে খানিক বল পেলাম এই চ্যালাদের দেখে। তাহলে এখনো সব ফুরিয়ে যায়নি কি বলেন? এখনো কেরিয়ার কে পাশে রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়!

তারপরে ধরুন দেশের উত্তরতম প্রান্তে বরুনদেবের বাঁধনছেঁড়া খেয়ালিপনায় বন্যা-টন্যা হয়ে একশা কান্ড। বাড়িঘর ভেঙ্গে-রাস্তা, টেলিফোন ব্যবস্থা ধুয়ে মুছে সাফ। খাবার জল বিষিয়ে গেছে। হাসপাতালের দেওয়াল ভেঙ্গে রোগীর বিছানাসমেত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জলের তোড়। শিশুখাদ্য-খাবার জল-ওষুধপত্র এই নূন্যতম জিনিসপত্রের যোগান পর্যন্ত নেই। এসব দৃশ্য তো টিভি খবরের কাগজের দৌলতে কারো আর অজানা নয়। আমরা প্রত্যেকেই সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে চা-কফি আর ভালোমন্দ স্ন্যাকস খেতে খেতে 'ইশ কি অবস্থা ওখানে' বলে সেসব দেখছি আর তারপরেই চ্যানেল বা ওয়েবসাইট বদলে আমাদের পছন্দের চ্যানেল বা অনলাইন শপিং সাইটে চলে গেছি। আরো কয়েকমিনিট একটু বেশি খরচ করা যেতে পারে সেটা ভেবেও দেখিনি। অথচ, মাদুগ্গারই আরো একদল চ্যালা, এরাও কিন্তু জীবনের প্রথম পর্বে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন-প্রেম-জীবিকা-ডিগ্রী-পরীক্ষা-বিদেশ যাত্রা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পারত। হয়ত আছেও। কিন্তু মাদুগ্গার চ্যালা কিনা, তাই আমাদের চেয়ে জীবন, সময় সবকিছুরই যথার্থ ব্যবহারটা জানে। তারা কিনা নিজেদের মধ্যে-বন্ধুবান্ধব মধ্যে-তাদের বন্ধুবান্ধব-নিজেদের ইউনিভার্সিটি-বন্ধুদের ইউনিভার্সিটি-রিসার্চ ইনস্টিটিউট সব জায়গা থেকে সকলের কাছে আবেদন করে টাকা পয়সা জড়ো করলো। পুরো দিল্লি চত্ত্বরে কম ইউনিভার্সিটি-ইনস্টিটিউট নেই। সেই ঢেউ বন্ধু-তার বন্ধু-তার বন্ধু পরিবাহিত হয়ে আমাদের এই অজগাঁয়ের ইনস্টিটিউটেও এসে পৌঁছালো। প্রত্যেকেই নিজেদের সাধ্যমতো টাকাপয়সা দিল। এখান থেকে সেই টাকাপয়সা দিল্লির পাঁচমাথার মোড়ে গিয়ে জমা হলো। সেই টাকায় খাবারদাবার-পানীয় জল-ওষুধপত্র-শিশুখাদ্য ইত্যাদি অতি অবশ্যক জিনিসপত্রের যোগাড় করলো। সেইসব বিপুল পরিমাণ জিনিস নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ করে নিজেরা গিয়ে বন্যার্তদের হাতে সরাসরি তুলে দিল। যদিও সেই টাকা জমা নিয়ে নাটকও কিছু কম হয়নি। কেউ বলল আমাদের বেতন থেকে তো প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে ট্যাক্স হিসেবে টাকা প্রতিমাসেই জমা পড়ে অতএব আমরা আলাদা করে একটাকাও দিলে গরীব হয়ে যাব। কেউ বলল কাজ কর্ম ছেড়ে দিয়ে এইসব ত্রান-ফান নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে কি হবে? নবরাত্রির পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য এঁনারা সক্কালসক্কাল বৌবাচ্চা সহ কপালে হলুদ-সিঁদুর-চন্দন আরো যাবতীয় পূত-পবিত্র তিলক কেটে কাজে আসছেন। মাদুগ্গার পায়ে মাথা খোঁড়ার জন্য এঁনারা সকলেই একপায়ে খাড়া। কোলের বাচ্চাটিকেও ছাড়েন না মন্দিরে মাথা ঠোকবার জন্য। অথচ মাদুগ্গার সত্যিকারের চ্যালাদের অসুরদমন অভিযানে এঁনাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।

যাক গে যাক। এইসব তুশ্চু জনগনের কথা এই ভালো দিনে না ভাবাই ভালো। আপাতত সত্যি সত্যি যে দূর্গা মায়ের ঘুম ভেঙ্গেছে আর তাঁর চ্যালাকুল যে প্রবলপ্রতাপে এখনো অসুরদমন আর শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে শিষ্টের পালন করে চলেছে এতেই আমার মনে নতুন করে বেশ আশার উদ্রেক হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন একেবারে মরে যাইনি। এখনো বেঁচেই আছি। আর আমাদের মতন আমজনতার পাশে যদি মা দুগ্গার চ্যালারা এরকম ভাবেই থাকে তাহলে অসুরকুলের মুখে ছাই দিয়ে আরো কিছুদিন বেঁচেবর্তে থাকতে পারব বলেই মনে হচ্ছে। কি বলেন? এই আনন্দে পুজোয় ভালো করে ঠাকুর দেখবেন, ভালোমন্দ খাবেন, ছোটখাটো অসুর চারপাশে দেখতে পাবেনই পাবেন, দেখলেই মা দুগ্গার নাম করে তাদের দমন করার চেষ্টা করবেন। আর কি? সবাই ভালো থাকবেন। শুভ মহাষষ্ঠী।

  

Thursday, 25 September 2014

ভালো আছি

হু হু করে ভেসে যাওয়া হাওয়ায়
ভালো আছি কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম নিজেকে
অন্ধকার রাজপথ থেকে উঠে এসেছিল মৃদু গুঞ্জন
খুঁজে দিয়েছিল উত্তর।

ধুঁকতে ধুঁকতে কোনমতে বেঁচে থাকা
সংসারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে রাখতে
যে মেয়েটিকে পথে নামতে হয় অষ্টমীর সন্ধ্যেতেও
আমি কি তার চেয়ে ভালো নেই?

ষোলো পেরোতে না পেরোতেই
যে মেয়েটিকে উনুনে কাঠের জ্বালানি ঠেলতে ঠেলতে
আর বাচ্চার কাঁথাকানি বদলাতে বদলাতে ভুলেই যেতে হয়
তারও ছিল উড়তে পারার স্বপ্ন
আমি কি তার চেয়ে ভালো নেই?

বিত্তবান শহরের অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে এসে
যে মেয়েটিকে ঊরু দৈর্ঘ্যের চকচকে পোশাকটিকে
দুই আঙ্গুলে টেনে হাঁটুর দিকে নামাতে হয় আজও
আমি কি তার চেয়ে ভালো নেই?

রাস্তার পাশে প্রায় জড় মনটিকে
বিন্দুমাত্রও রেয়াত না করে
অর্ধমৃত বাচ্চার মা হতে বাধ্য করা হলো যে মেয়েটিকে
আমি কি তার চেয়ে ভালো নেই?

ঘুমিয়ে পড়া, জড়িয়ে যাওয়া মন
চিত্কার করে উঠলো
ভালো আছি, ভালো আছি, ভালো আছি
প্রবল ভাবে আজও বেঁচে আছি। 

Tuesday, 23 September 2014

বিশ্বকর্মা পুজো ও লাউগাছ

এই সেদিন একজনের সাথে কথা হচ্ছিল। আমি তাকে যত্পরোনাস্তি যুক্তিসঙ্গত ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম যে আমার এই পাঁচফুটিয়া চেহারাটা দেখে যতই শান্তশিষ্ট-সাত চড়ে রা না কাড়া জাতীয় মনে হোক না কেন আমি কিন্তু অত্যন্ত জটিল-অত্যন্ত কুচুটে-ঝগড়াটে আর পাজির পা ঝাড়া একটি মহিলা। বিটকেল বদমায়েসি বুদ্ধি কিন্তু আমার একটুও কম নেই। সে কিছুতেই ব্যাপারটার সত্যতা বোঝেনা। খালি হাসে আর মাথা নাড়ে। কি করে যে বোঝাব? যাক গে বলে তাকে আর ঘাঁটালাম না তখনকার মত। তারচেয়ে বরং আপনাদের কাছে আমার কুচুটেপনার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

অনেকদিন আগে যখন আমি সত্যি সত্যি ছোট ছিলাম মানে এইরকম সাইজে ছোট মাথায় বদ-বুদ্ধি গুলো বড়বড়, সেরকম নয়। চেহারা, বয়স আর মন তিনটেই যখন ছোট আর সাদা ছিল তখনকার কথা বলছি। আমার প্রানের বন্ধু রুমা। তার কথা তো আপনাদের আগেই বলেছি। তার জ্যেঠুদের ছিল ডেকোরেটিং-এর ব্যবসা। সেসব জিনিসপত্র রাখার জন্য বাড়ির লাগোয়া গুদামঘর। আর তাঁদের বাড়ির সামনে থাকত প্রচুর বাঁশ যেগুলো ছিল আমাদের মানে সারা পাড়ার কুঁচোদের বৈকালিক হুড়োহুড়ির জায়গা। বছরের একটি বিশেষ সময় এই বাঁশগুলি সরিয়ে ফেলা হত। কারণ তখন বাঁশগুলো দিয়ে খাঁচা বানিয়ে প্যান্ডেল বানানো হতো বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য। আর যতদিন না সেই বাঁশের খাঁচার ওপরে লাল-গোলাপী-সাদা কাপড় লাগিয়ে প্যান্ডেলের অবয়ব তৈরী হত ততদিন ওই বাঁশের খাঁচাটা ছিল আমাদের সম্পত্তি। বিকেলে ওই খাঁচার সবচেয়ে নিচের ধাপের বাঁশে উঠে পা দোলানো, বা বাঁশ ধরে ঝুলে পা দুটিকেও বাঁশের ওপরে তুলে দিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে থাকা এজাতীয় দুর্দান্ত এডভেঞ্চার করা চলত। যারা আমার মতন হাঁ করা বাচ্চা ছিল না, প্রাণে কিঞ্চিত সাহস এবং বাড়ির লোকের তুমুল উত্তম-মধ্যম হজম করার মত কলিজা ছিল, তারা বাঁশের খাঁচার আরো উপরের দিকে উঠে নানা কসরত দেখাত আর আমরা একদম নিচের ধাপে বসে জুলজুল চোখে সার্কাস দেখতাম আর মুগ্ধ হতাম। 

ক্রমে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এগিয়ে আসত। পুজোর আগের দিন বিকেল থেকে আমাদের বাঁশে চড়ার খেলা বন্ধ হত আর আমরা প্যান্ডেলে বসে প্যান্ডেলে কাপড় চাপানো আর একটা নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁশের খাঁচা কেমন করে সুন্দর সাজানো ঘরের মত প্যান্ডেল হয়ে উঠছে সেটা অবাক চোখে বসে দেখতাম। রুমার সাথে হলায়-গলায় বন্ধুত্বের দৌলতে সেই পুজোবাড়িতে আমার অবাধ যাতয়াত ছিল। পুজোর আগের দিন রাত থেকে তাদের বাড়িতে রুমার সাথে সাথে আমারও পাত পড়ে যেত। এবং সেই সূত্রে বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন সন্ধ্যেয় মা দয়া করে আমার পড়ার ছুটি দিত। আর সেই ছুটি আমি আর রুমা আমাদের পাড়ার বাকিদের সাথে যথেচ্ছভাবে উদযাপন করতাম।

সেরকমই একবছর বিশ্বকর্মা পূজোর আগেরদিন সন্ধ্যেয় প্যান্ডেল বানানো চলছে। ডেকোরেটিং এর জিনিসপত্রের গুদামে বিশ্বকর্মা ঠাকুর হাতির গায়ে ত্রিভঙ্গ মুরারী হয়ে হেলান দিয়ে চার হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর চারপাশে কাগজের ফুল-শিকলি-মাথার পেছনে কাগজের জাপানি পাখা সব লাগানো কমপ্লিট। এদিকে তখনও প্যান্ডেলের কাপড় সেলাই চলছে। বোরিং কাজ। এরপর লাগানো হবে তারপর সাজানো হবে। সেই অবাককরা ব্যাপারটা আসতে অনেক দেরী। আমাদেরও লুকোচুরি-কুমিরডাঙ্গা-পিট্টু সব শেষ হয়ে গেছে। এমনকি প্রতিটি খেলার শেষে যে ইন্টারেষ্টিং ঝগড়াঝাঁটি-চেঁচামেচির বিষয়টা থাকে সেটাও শেষ। সবাই বসে বসে প্যান্ডেলের কাপড় সেলাই দেখছে আর নাক-কান-হাত-পা খুঁটছে। মোদ্দাকথায় বেজায় বোরিং একটা ব্যাপার চলছে। এমন সময় আমাদের হাতে এসে পড়ল একটা নতুন ব্লেড। এই জিনিসটা সাধারণতঃ আমাদের হাতে কেউ তখন দিত না। কারণ উত্সাহের চোটে নিজেদের হাত পা-ই কেটে বসে থাকব হয়ত। প্যান্ডেলের কারিগরদের হাত থেকেই কোনভাবে এই নিষিদ্ধ বস্তুটি আমাদের হাতে এসে পড়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলো। চকচকে ধারালো ব্লেডটা নিয়ে কিছু যে  করতেই হবে এ বিষয়ে  দ্বিমত ছিল না। কিন্তু কি কাটা হবে  সেটাই প্রশ্ন। আমার মাথার বদ বুদ্ধির ঢিপি নড়ে উঠলো। বললাম চলে আয় সবাই আমার সাথে। প্রথমেই যে বাড়ির পুজো তাদের বাড়ির পেছনের বাগানে। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হলো এখান থেকেই অভিযান শুরু। বেছে বেছে লাউ-কুমড়ো বা চালকুমড়ো গাছ খুঁজে নেওয়া হলো। কারণ এইসব গাছ ছাড়া ব্লেড দিয়ে কোনো গাছই কাটা যায় না। এই সময় এইসব গাছ সকলের বাগানেই লকলকিয়ে উঠেছে। আমরা আনন্দে নাচতে নাচতে সারা পাড়ার সমস্ত লাউ কুমড়ো গাছের গোড়া মানে মাটির ঠিক উপরেই কচাত করে কেটে সেই নতুন ব্লেড -এর ধার পরীক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের লোকজনদের নিজেদের বাড়ির গাছও বাদ গেল না। রেহাই পেল কেবল যেসব বাড়ির পাঁচিলের মধ্যে গাছপালা আছে তারা। যেমন আমাদের বাড়ি, রুমাদের বাড়ি ইত্যাদি। ভর সন্ধ্যেবেলা, অন্ধকারে কোনো বাড়ির সদস্যদেরই মনে হয়নি বাড়ির পেছনের লাউ-কুমড়ো গাছ পাহারা দেবার কথা। সুতরাং পরদিন সকালে দেখা গেল পাড়ার এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত সমস্ত লাউ-কুমড়ো-চালকুমড়ো গাছ কোনো এক অজানা কারণে নেতিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যের মধ্যে নেতিয়ে যাবার কারণটি আর অজানা রইলো না। প্রত্যেক বাড়ির মা জ্যেঠিমারা এই নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন এবং যে বা যারা এই কাজটি করেছে তাদের মুন্ডুপাত করতে লাগলেন।

আমরা যারা ভালোমানুষ মুখে এই আলোচনাচক্রে শ্রোতার ভূমিকায় ছিলাম তাদের যে মা-জ্যেঠিমা-কাকিমার দল বিন্দুমাত্র সন্দেহই করেননি বলাই বাহুল্য। কারণ আমাদের মত ক্যাবলাকান্ত-আঙ্গুলচোষা-শান্ত বাচ্চারা যে এসব গর্হিত অপরাধ করতে পারে এ তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি। তাঁদের আমাদের প্রতি অগাধ আস্থার জোরে আমাদের পিঠ-কান-গাল সেযাত্রা বেঁচে গিয়েছিল।

এখন আমাদের সেদিনের দলবলের দিকে চোখ দিলে দেখা যায় কেউ প্রচন্ড কড়া মা , বাচ্চাকে শাসন করতে পেলে সন্ধ্যের সিরিয়াল পর্যন্ত ভুলে যায়। কেউ আপাদমস্তক গম্ভীর সরকারী কর্মচারী, প্রচন্ড দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত। কেউ বা আমার মতন হাড়-হাভাতে গবেষক, আজীবন ছাত্র থাকার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ। মোটকথা কাউকে দেখলেই শান্ত-শিষ্ট রামগরুড়ের ছানা ছাড়া কিছু মনে হবার যো নেই। পেটে পেটে কিন্তু আমরা যে একেকটি বদের গাছ সেটার একটা উদাহরণ তো পেলেন? আরো আছে ক্রমশঃ প্রকাশ্য। এই তো পুজো আসছে, পুজোর সময়েই একটি ঘটনা ঘটিয়েছিলাম।সেটা আরো এককাঠি সরেস ব্যাপার। কয়েকদিন বাদে বলব নিশ্চয়ই।

Saturday, 20 September 2014

বিধাতা উবাচ

কেবলমাত্র প্রতিদিনের যত্সামান্য খাদ্যের দাবিতে
পশুত্বের প্রকাশ করে সারমেয়কুল
ভরপেট ভাত আর একছটাক ভালবাসা দিয়ে দেখো
আহ্লাদে ভরিয়ে দেবে সে তোমায়
অন্যকে শিক্ষা নামে অকারণে
সে দেশের অন্য সারমেয়শিশুর গলা শ্বদন্তে চিরে ফেলেনা সে
সে দেশের ভরন্ত কুক্কুরীদের অনিচ্ছায় ধর্ষিত হতে হয়না কোনদিন
খিদের ভাতটুকু পেলে সে ভুলেই যাবে
তারও আছে নখ তারও আছে শ্বদন্ত।

অথচ আমার প্রতিরূপ হিসেবে সৃষ্ট মনুষ্যকুল
যার কাছে অবাধে আমি দিয়ে রেখেছিলাম
স্বর্গ-নরক দুটি দরজারই চাবি
বিশ্বাস ছিল সে নিজে খুঁজে নিতে পারবে তার পথ
কারণ আমি তাকে দিয়ে রেখেছিলাম সমস্ত হাতিয়ারই
লোভ আর ঈর্ষা-বাসনা আর চাহিদা-প্রতিহিংসা আর অসত্য
এসব যেমন ছিল তাদের ঝুলিতে
সঙ্গে ছিল মনুষ্যত্বের সব অস্ত্রই
বিশ্বাস ছিল, সে ঠিক বেছে নিতে পারবে তার পথ
কারণ বড় আদরে, বড় যত্নে তৈরী করা আমারই প্রতিরূপ যে মানুষ
তাকে আর কেবল মাত্র তাকেই তো আমি দিয়ে রেখেছিলাম
আমার কাছে থাকা একটিমাত্র ব্রম্ভাস্ত্র
যার নাম -বোধ।

বিশ্বাস ভেঙ্গেছে সে
বোধহীন মানুষকে তাই
মনুষ্যজন্মের অর্ধভাগ আর সারমেয় জন্মের অর্ধভাগ
এই নিয়ে পুরোপুরি বেঁচে থাকার আদেশ দিলাম আজ
মানুষের বুদ্ধিমত্তা
মানুষের সৃষ্টিশীলতা
মানুষের সৌকুমার্য্য
মানুষের চিন্তাশীলতা
আর যা কিছুর জন্য মনুষ্যত্বের উন্মেষ করেছিলাম আমি
যা কিছুর জন্য আমারই সৃষ্ট আর সকল প্রাণীকুল
নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব-
আমি আদেশ করছি সেসব কিছুরই পরিপূর্ণ ব্যবহারের
নতুবা অতিধীরে কিন্তু অনিবার্য্য ভাবে ফিরিয়ে নেব সবকিছুই
পড়ে থাকবে কেবল
মনুষ্যত্বহীন-বোধহীন-পশুপ্রায়-জড়বুদ্ধিধারী কিছু প্রাণ
একদা আমিই যাদের দিয়েছিলাম শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা
পরিচয় দিয়েছিলাম মানুষ বলে।       

Thursday, 18 September 2014

গুপ্তধন কোথায়?...........শেষ পর্ব


প্রথম ক্লু তো তালে গোলে হরিবোল হয়ে গেল। দ্বিতীয় ক্লু পেতে দেখি তাতে লেখা আছে ক্যান্সার সংক্রান্ত কিছু। এমন একটা জায়গা যেখানে ঢুকলে 1400 শতাব্দীর কথা মনে হয়, আবার তাতে ক্যান্সার এর উল্লেখ আছে, আবার তাতে নয়নতারা ফুলের উল্লেখ আছে..........বোঝো। ঠিক যেন চন্দ্রবিন্দুর '', বেড়ালের '' আর রুমালের 'মা' কি আর বলব? আমার মনে পড়ল কোথায় আমি নয়নতারা ফুলের ঝোপ দেখেছি। সবাইকে বলতে, দে দৌড় সেখানে। সেখানে গিয়ে যথারীতি কিছু মিলল না। কোনো সাইন, টুকরো কাগজ- কিচ্ছু না। আবার লেখা আছে একলা দাঁড়ানো একটি নয়নতারা ফুলের গাছের কথা। কেউ কোনো ভাবেই মনে করতে পারল না একলা দাঁড়ানো একটি নয়নতারার কথা (কোথায় কি গাছ আছে তার একটা ভার্চুয়াল লিস্ট মনে মনে সেভ করে রাখতে হবে দেখছি) আমি আর পিয়ুশি গেলাম ল্যাবে। ওখানে টবে টবে একটা করে গাছ রাখা আছে তার মধ্যে কোনটা নয়নতারা নয় তো? তারপর আবার ক্যান্সার এর কথা লিখেছে। তার মানে আমাদের ল্যাব নয় তো? আমাদেরতো ক্যান্সার নিয়ে কিঞ্চিত নাড়াঘাঁটা হয়। দুজনে দোতলার যাবতীয় টব দেখে শুনে একটা লতানে মানিপ্ল্যান্টকে প্রায় উত্খাত করার উপক্রম করে বিফল মনোরথ হয়ে নিচে নেমে এলাম। নিচে সবাই জটলা করছে। নানা মুনির নানা মত। বেচারা একটি নিরীহ ছেলে শেষ পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় চলে এলো। সে নাকি নেক্সট ভলেন্টিয়ার। তার কাছে নেক্সট ক্লু থাকতে পারে। তার অপরাধ বেচারা একটু বেশি সংখ্যায় সিগারেট খায়। যেহেতু ক্লু তে ক্যান্সার এর কথা আছে, সেহেতু তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সে বেচারাকে সিগারেট খায় বলে ক্যান্সার অবধি টেনে নিয়ে যেতেও ছাড়া হলো না। নেহাত সে আমার ব্লগ পড়বে না এই বিশ্বাস থেকেই লিখছি এত বিশদে। যাই হোক, এই ক্লু থেকে কোন ভলেন্টিয়ার আমাদের পরের ক্লু তে নিয়ে গেল আমি জানি না। কি ভাবেই বা এই ধাঁধার নির্ণয় হলো জানি না। দেখলাম তৃতীয় ক্লু হাতে চলে এসেছে। তাতে লেখা আছে এই ক্লু টি ভাঁওতা, আগের ক্লুতে ফিরে যাও। কি জ্বালা দেখুন দিকি

ততক্ষণে একটা জিনিস পরিস্কার হয়েছে যে আমাদের কোনো চিহ্ন খুঁজতে হবে না। ক্লু অনুসারে সঠিক ভলেন্টিয়ারকে খুঁজে বার করতে হবে। এইখানেই ট্রিক। যার জন্যই মিস্টার হুয়াং, মুখ বদল ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো ভাঁওতাবাজির অবতারণা। আমাদের টীম এর কত নম্বর ক্লু কোন ভলেন্টিয়ারের কাছে আছে সেটি বের করতে পারলেই হলো। যাই হোক, কি করে যেন সকলের মনে হলো গেটের কাছে যে ভলেন্টিয়ারটি আছে তার কাছে থাকতে পারে।  সে যেতে আমাদের পরের ক্লু দিয়েও দিল। আমি না অনেক কে জিজ্ঞাসা করলাম জানেনযে কি করে বুঝলে যে ওর কাছে আছে নেক্সট ক্লু? সবাই দেখি আমতা আমতা করে। যাই হোক পরের ক্লু তো পাতাভর্তি কিসব লেখা। সবাই ঝুঁকে পড়ে টর্চ জ্বালিয়ে পড়ছে। আমি যথারীতি এই পাঁচফুট উচ্চতা নিয়ে ডিঙ্গি মেরেও লোকজনের ঘাড় পেরিয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। সুতরাং জটলার চারপাশে ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছি। এমন সময় দেখি সেই প্রথম ক্লু এর গোমড়ামুখো দিদিমনি এসে জিজ্ঞাসা করছে, 'এই তোমাদের কত নম্বর ক্লু চলছে?' বললাম, চার। বলে দেখি আগের তিনটে ক্লু। সে গবেষণা শেষ করে যা জানালো তাতে বোঝা গেল গেটের ভলেন্টিয়ারটি গোলমাল পাকিয়েছে। সে যে ক্লু টি আমাদের দিয়েছে সেটি আমাদের হাতে এখনি পড়ার কথা নয়। এর ঠিক আগে আরো একটি ক্লু আছে যেটি এই দিদিমনির কাছে আছে। তাই সেটি তার হাত থেকে না নিয়ে কি করে আমরা পরের ক্লু পেয়ে গেলাম সেটি দেখেই তার মনে হয়েছে গড়বড় কিছু একটা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে তোম্বা মুখে আগের ক্লু টি দিয়ে দিল হাতে আর বলল এটি একটি পাজল। এটার উত্তর না জানলে পরে যখন সব ক্লু এর সমাধান জিজ্ঞাসা করা হবে তখন না বলতে পারলে কিন্তু হবে না, নম্বর কাটা। অর্থাত কিনা আসল ফোর্থ ক্লু এখন আমাদের হাতে আর পঞ্চম ক্লু আমরা আগেই পেয়ে গেছি। ফোর্থ ক্লু এর সমাধান পরে ভাবা যাবে বলে সবাই ফিফথ ক্লু তে মনোনিবেশ করলো। আর আমি যথারীতি জটলার বাইরে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষতে শুরু করলাম। সেই একপাতা জোড়া আবোল তাবোল গল্প পড়া শেষ করে দেখি সবাই ক্যাম্পাস এর মেন গেট এর দিকে ছুটছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে ওখানে ব্যারিকেড কথাটার উল্লেখ আছে। তাই ব্যারিকেড  যাওয়া হচ্ছে। ব্যারিকেড মানে হলো এই ইনস্টিটিউট এর মেন গেট ঢোকার প্রায় সাতশো মিটার আগে যে একটি চেকপোস্ট আছে সেটি। এই সাতশো মিটার রাস্তা ইনস্টিটিউট এরই। সবাই এখানে মর্নিং-ইভনিং-নাইট সবরকম ওয়াকই করে থাকে। তো সেদিকে ছুটছি এমনসময় পাশের ল্যাবের একটি ছেলে এসে অযাচিত ভাবেই আমাদের ফোর্থ ক্লু এর উত্তর বলে দিল। যেটা আমাদের এখনো দেখাই হয়নি। পরে পেলাম। তারপরে দেখি সেই ছেলেটি গাছের নিচে আধোঅন্ধকারে বসে আছে। যেখান থেকে যা জানতে পারছে সব দলকেই সাহায্য করছে। ভালো ব্যাপার। বড় উপকারী ছেলে। কচুরি খেতে বড় ভালবাসে জানি। ভাবছি ওকে একদিন ডেকে কচুরি টচুরি বানিয়ে খাইয়ে দেব। 

যাই হোক ব্যারিকেড যাবার আগেই দেখি একটি ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে অন্ধকারে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে বসে আছে। ব্যাটা নিশ্চয়ই ভলেন্টিয়ার। চেপে ধরলাম সবাই মিলে। বললাম আমরা টীম ফাইভ। তোমার কাছে কি আমাদের নেক্সট ক্লু? সে হাতের তালু আড়াল টাড়াল করে মোবাইলে অনেক কিছু চেক করে টরে বলে কিনা, "দেখি তোমাদের ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড-ফোর্থ-ফিফথ-সিক্সথ আর সেভেন্থ ক্লু।"

আঁই!!!! তার মানে এর কাছে আমাদের টীম এর আট নম্বর ক্লু আছে। আমরা তো এখন ফিফথ ক্লু তে আছি। সেটা আর জিজ্ঞাসা করেনি হাঁদাগঙ্গারামটা। আগেভাগেই প্রকারান্তরে জানিয়ে দিয়েছে যে তার কাছে আমাদের কখন আসতে হবে। হে হে। 

যাই হোক সেই পাঁচ নম্বর ক্লু সলভ করতে করতে তো হোস্টেল এর বাইরের দিকের মেনটেনেন্স এর জন্য রাখা যাবতীয় দরজা খুলে দেখা গেল। অন্য টীম এর ক্লু রাখা আছে দেখলাম। আমাদেরটাই নেই। পিনাকী, আমি আর ইমরান মিলে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ড্রেন মেনটেনেন্স এর যাবতীয় সরু সরু সুগন্ধি দরজা খুলে খুলে দেখলাম। তার মধ্যে রুচি-পিয়ুশি মেস থেকে আলুর পরটা এনে মাঠে বসেই খেতে শুরু করে দিয়েছে। বেচারাদের খিদে পেয়ে গেছে ছুটতে ছুটতে। আমার এতক্ষণে মনে পড়ল যে ভাত-ডাল-বাঁধাকপির তরকারী আমার সাথে বিশেষ বেয়াদপি করেনি তো। বেশ তো দৌড়াচ্ছি। তার মানে এখনও অনিয়ন্ত্রিত রকম বেঢপ হইনি মনে হয়। নইলে এর আগেই দম শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। কথাটা মনে হতে এত ভাল্লাগলো জানেন, ঐসব গন্ধওয়ালা দরজা-ফরজা ছেড়ে দিয়ে মাঠে বসেই পড়লাম লা-লা-লা-লা করতে করতে। ট্রেজার না পেলেই বা কি? তাই না বলুন? 

তারপর আরো কিসব খোঁজা খুঁজির শেষে রুচি আবিষ্কার করলো নতুন ল্যাব বিল্ডিং নেক্সট ক্লু। সেই ষষ্ঠ ক্লু বলছে হোয়াং হো নদীর কথা এই নদীর নাম একটি নির্দিষ্ট ভলেন্টিয়ারকে বলতে হবে আর তারপর p79 আর p80 খুঁজতে হবে। এখন 'Huang He' নদী কে আমজনতা ছোটবেলা থেকেই 'হোয়াং হো' নামেই চেনে। বাংলা বা হিন্দিতেও উচ্চারণটা 'হোয়াং হো' বলেই জানে সবাই। সেমতই তাকে যেই বলা হয়েছে যে 'হোয়াং হো' নদী, বলে না হয়নি। ঠিক করে বলতে হবে। শেষমেষ ফাহিম বানান করে করে বলল। ওরে মা -কার আর -কার আলাদা কিছু আমরা বুঝিনি ঠিকই বুঝেছি। তবে সে সন্তুষ্ট হলো। তাকে নাকি 'হোয়াং হে' বলতে হতো। কি ভীষণ খেলা রে বাবা
যাক গে যাক।  তারপর p79 আর p80 ব্যাপারটা বলি। এটা সোজা। ঊনআশি আর আশি নম্বর লাইট পোস্ট। এই দুটি লাইট পোস্টের মাঝে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই ঘাস জঙ্গলের মাঝে পাথর চাপা দেওয়া নেক্সট ক্লু বেরিয়ে গেল। সেখানেও অন্য দলের আরো একটি ক্লু ছিল দেখলাম। সেটা নিয়ে আর মাথা টাথা না ঘামিয়ে সোজা সেই মেন গেট এর বাইরে গঙ্গারামের কাছে। কারণ সে বলেছে তার কাছে আট নম্বর ক্লু আছে। সে আমাদের বিনা বাক্যব্যয়ে আট নম্বর ক্লু দিয়ে দিল। 


তাতে লেখা আছে "Mitochondria is the powerhouse of the cell"-এই একটি লাইন। এটা নিয়েও বিশেষ মাথা ঘামাতে হয়নি। কারণ পাওয়ার হাউস তো বলেই দিয়েছে।অতএবচল পানসি পাওয়ার হাউস। ওখানেই আছে নবম ক্লু। মানে শেষ ক্লু। পেতেই হবে তাড়াতাড়ি। তবেই ট্রেজার বক্স এর সন্ধান পাব। জয় মা বলে দৌড় লাগলাম পাওয়ার হাউস এর দিকে। বললে বিশ্বাস করবেন না আমার নিজের প্রতি কনফিডেন্স বেড়ে গেল যে আমি এত জোরেও দৌড়াতে পারি এখনো? এই চেহারা নিয়েও! দুদ্দাড়িয়ে পৌঁছালাম পাওয়ার হাউস। কে ভলেন্টিয়ার এখানে? কাউকে তো দেখছি না। তবে কি ঝোপে ঝাড়ে কোথাও লুকানো আছে ক্লু? পাওয়ার হাউস এর চারপাশ টর্চ দিয়ে পুরো খুঁজে ফেলা হলো। ভেতরে দানবীয় মেসিনগুলোর ফাঁক ফোঁকড়ও বাদ গেল না। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখে নেওয়া হলো। কিন্তু অতবড় পাওয়ার হাউস কোথায় খুঁজবো? এই মেশিন তো আর কুলার নয় যে ফাহিম কে বলব ভাই সব খুলে ফেলে উল্টে দিয়ে দেখ। এখানে আর যাইহোক টানাটানি করা যাবে না। দেখা গেল হয়ত ইনস্টিটিউট সমেত উড়ে গেল। পরদিন কাগজে হেডলাইন- 'ট্রেজার হান্ট খেলতে গিয়ে DBT- আশির্বাদধন্য গবেষণা কেন্দ্র ভস্মীভূত।' ওরেব্বাস!! কি করি? বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ফাহিম জনে জনে প্রতিটি কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করছে তুমি কি ভলেন্টিয়ার? তুমি কি ভলেন্টিয়ার? সবাই মাথা নাড়ে কি রে বাবা? এর মধ্যে দেখি রুচি, পিয়ুশি আর রেশমা হাওয়া। ফোন করতে বলে, আমরা তো মেসে এসেছি। পাওয়ারহাউস বলতে খাবারদাবারকেও বোঝাতে পারে তো, মানে আমরা তো ওখানথেকেই বডি-পাওয়ার পাই তাই এখানে এসেছি। এতক্ষণে মনে পড়ল ওদের আধখাওয়া আলুর পরোটাগুলো তো খবরের কাগজ মোড়া অবস্থায় আমার হাতেই রয়ে গেছে। কখন আমার হাতে দিয়েছিল। আমি সেটা নিয়ে নিয়েই দৌড়াচ্ছি। এই ফাঁকে আমিও ওগুলো থেকে কিছুটা পাওয়ার নিয়ে নেব কিনা ভাবছি, এমন সময় দেখি সদা, ইমরান আর পিনাকী নেক্সট ক্লু নিয়ে আমাদের ডাকছে। আর ফাহিম পাওয়ার হাউস এর একজন কর্মীকে প্রচন্ড বকাবকি করছে, "তুঝে ম্যায়নে কিতনি বার পুছা কি তু ভলেন্টিয়ার হ্যায় কি নেহি? বোল ?" -আর প্রতিটা শব্দের শেষে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটা করে 'শালে' গুঁজে দিচ্ছে। বুঝলাম গত পনের-কুড়ি মিনিট ধরে অন্ততঃ পাঁচ-সাত বার ওই ছেলেটিকে ফাহিম জিজ্ঞাসা করেছে যে টীম ফাইভ-এর জন্য নাইন্থ ক্লু তার কাছে আছে কিনা, সে ভলেন্টিয়ার কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সে প্রতিবারেই কোনো অজানা কারণে 'না' বলেছে। এখন নিজেই বলেছে যে তার কাছেই আছে ক্লু। কি আর বলব ভলেন্টিয়ারদের কথা।  কেউ নিজেই না বুঝে বলে দেয় আমার কাছে এত নম্বর ক্লু আছে। কেউ হাজারবার জিজ্ঞাসা করলেও বলে না। যেন আমরা খেলার নিয়মের বাইরে গিয়ে তাকে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করছি। মনে হলো বলে দি-" কে রে শান্তিগোপাল? এত আজব কালেকশন!!!" কিন্তু না আগের ভুল মাথায় রেখে আর বললাম না। যা হ্যাবলা আমি, বলব একজনকে, বুঝবে আর একজন হয়ত। কি দরকার বাবা? 

নবম ক্লু পেয়ে তো আহ্লাদে নাচতে নাচতে আটজন মিলে দেখলাম সেটা। একটা নক্সা। যেটা মাঠের মাঝে মেন বড় লাইট পোস্টটাকে বোঝাচ্ছে মনে হলো। আর তার চার পাশে প্রচুর সংখ্যা লেখা। দৌড়ে-দৌড়ে পোস্টটার কাছে পৌঁছে বুঝলাম এই সংখ্যাগুলো ছোটো ছোটো লাইট পোস্টগুলোর। যেমন আমরা p79 আর p80 খুঁজেছিলাম তেমনি এরকম পোস্ট সংখ্যা অনুযায়ী খুঁজে বার করে ক্লুএর কাছে পৌঁছাতে হবে যেটা আলটিমেটলি আমাদের বলবে কোথায় আছে গুপ্তধন। ক্লু অনুসারে p13, p9 p24 খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি এমন সময় দেখি মাঠময় হুল্লোড়। কিসের? কি আর? আমাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে অন্য একটা দল পেয়ে গেছে সন্ধান গুপ্তধনের। তারা যাচ্ছে সেটা নিতে। আর আমরাঅস্টরথীএকহাতে লাস্ট ক্লু আর এক হাতে বিশাল বড় ঝুলপড়া একটা হ্যারিকেন নিয়ে মাঠের মাঝে ভেবলু মুখে দাঁড়িয়ে আছি। 

তারপর? তারপর আর কি? তারা আনন্দে চেঁচাতে চেঁচাতে ট্রেজার এর বাক্স নিয়ে এলো। সেটা নিয়ে বাকি সব টীমের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে ছবি টবি তুলল। এই সময় আবার আমি উঁকি মেরে ছবি তোলা দেখতে গেছিলাম। সামনে একজন জগদ্দল পাথরের মত এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বলে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না তাই 'ধুস' বলে জটলা ছেড়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছি। এমন সময় দেখি পেছন থেকে একজন আবার ফ্রীতে জ্ঞান দিয়ে দিল। "আরে এতেই মুষড়ে পড়ছ কেন? জিততে পারনি তো কি হয়েছে?" আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে আবার আরো একটা কথা জুড়ে দিল-"জীবন অনেক বড়।".......ভগবান! কি বলব বলুন একে? ভাবলাম, একে আর কিছুই বলব না এখন। পরে বলব রসিয়ে, কি ছড়িয়েছে সে সেদিন। গুপ্তধনের বাক্স ততক্ষণে খোলা হয়ে গেছে। মণিমুক্তা সব ছড়িয়ে পড়ল তা থেকে। মণিমুক্তা মানে হলদিরামের চিপস, ভুজিয়া এসবের একগুচ্ছ প্যাকেট

দেখেশুনে খিদে পেয়ে গেল। আটগোয়েন্দা মিলে ক্যান্টিনে গিয়ে লোকেদের ঘুম ভাঙিয়ে চিপস কোল্ডড্রিংক খেতে খেতে পূর্ববর্তী বছরের ট্রেজার হান্ট এর গল্প করে, এই বছরের প্রথম ক্লু তে দেড়ঘন্টা পার হয়ে যাওয়া আর লাস্ট ক্লু তে পনের কুড়ি মিনিট ভলেন্টিয়ার এর জন্য নষ্ট হওয়া সময়ের বাপান্ত করতে করতে আরো খানিকক্ষণ হ্যা হ্যা করে বাড়ি চলে এলাম

এই হলো আমার জীবনের প্রথম গোয়েন্দাগিরির গল্প। এটা ঠিক কি ধরনের গোয়েন্দাগিরি জানিনা। হোমস-পোয়ারো-মিস মার্পল-ফেলুদা-ব্যোমকেশ-ভাদুড়িমশাই-কিরীটি বা হালের মিতিনমাসি-দীপকাকু-এঁদের কথা ছেড়েই দিলাম নেহাত পান্ডব গোয়েন্দারাও কি এরকম ভ্যাবলার মত গোয়েন্দাগিরি করত? মনে হয়না। যাই হোক অনেক কিছুর মত গোয়েন্দাগিরিতেও আমার দৌড় বোঝা গেছে। হাচিকোই ঠিক। আমার লাভ যেটা হলো সেটা এই যে, সারা সন্ধ্যে ধরে সারা ক্যাম্পাস ছোটাছুটি করে খানিক এনার্জি লস হলো। তাতে এই বিশাল বপুর হয়ত খানিক সুবিধা হলো এই আর কি। আর হ্যা হ্যা করে মাথাটার মেদও বেশ খানিকটা ঝরলো