Sunday, 21 July 2024

ওকব্রুক পার্কের জানালা

ওকব্রুক পার্কের জানালায় আজ ভরা বর্ষা। কাল সারারাত ধরে ঝরে ঝরে সকালের দিকে ক্ষান্ত দিয়েছে। সকাল থেকে তাই রোদ্দুরের পাট নেই। ইদানিং অবশ্য মোতিমালার সকাল হচ্ছে খানিক দেরি করেই। সপ্তাহান্তের ছুটির দিনগুলিতে কাকভোরে উঠে চুপি চুপি একাই ঊষাকালটিকে জাপটে ধরে খানিক বুঁদ হয়ে উপভোগ করা হয়ে উঠেছে না। তেমন করে কিছুই হয়ে উঠছে না মোতির। নিজেকে সে ছেড়ে দিয়েছে। যা নিজে থেকে তার কাছে আসবে তা তার। নইলে নয়। জোর নেই তার কিছুতেই। তেমনই এই উষা বিলাসও, এই মেঘলা সকালও। চোখে মুখে জল দিয়ে বেরোলো যখন, তখন আর ভোর নেই। কটা চীনাবাদাম কাঠবিড়ালী আর পাখিদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে এসে বারান্দায় পা ছড়িয়ে একটা বই খুলে নিয়ে বসে হাঁ করে সামনের গাছগুলিতে দিকে তাকিয়েছিলো সে। তেমন যে কিছু একটা দেখছিলো তাও নয়। ওই আর কী। চেয়ে থাকা। কিছু দেখতে পাওয়ার আশায় নয়। কিছু দেখার আশায় চেয়ে থাকলে দ্রষ্টব্য সামনে আসে না। দর্শক নির্বিকার হলে বোধহয় দ্রষ্টব্যেরেও নিজেকে প্রকাশ করার তাগিদ জন্মায়। সামনের কটনউড গাছগুলো এখন সবুজ। সে চত্বরে রোদ্দুর উঠুক না উঠুক কাঠবেড়ালী আর পাখিদের ব্যস্ততার হেরফের হয় না তাতে সকালে। পাখিদের কনসার্ট হচ্ছিলো আজ। মোতির কান মন ভরে। মাথায় লাল পাগড়ী একজোড়া কাঠঠোকরা দুএকবার ইলেকট্রিক পোস্টের কাঠে ঠোক্কর মেরে গাছের মরা ডালটাতে বসে দাম্পত্য আলাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গত সপ্তাহে এরকমই সকালে একটি রেড কার্ডিন্যালের স্ত্রী বাদাম নিতে এসেছিলো। মোতির ফোনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সে। আজও দেখ না দেখ টুকটুকে লাল বরটিকে গাছের ডালে বসিয়ে রেখে তার বৌটি টুক করে বাদাম নিয়ে পালালো। আগের দিনেরটাই কিনা কে জানে! পুরুষটি তার রঙের জন্যই সহজে চোখে পড়ে। তাই হয়ত লাজুক বর বৌটিকে পাঠায় মানুষের উঠোনে। তার ঠিক পরেই এলেন একজন একাকী ব্লু জে. তিনিও একটি বাদাম নিলেন। তিনি গাছের দিকে গেলেন না।  অন্য দিকে চলে গেলেন। এঁর বাসা বোধকরি দূর পাড়ার কোনো গাছে। রেড কার্ডিন্যাল আর ব্লু জে রোজকার পাখি এখানকার। যদিও তাদের রূপের সঙ্গে এই নাম একেবারেই লাগসই লাগে না মোতির। মনে মনে মোতি তাদের নাম দিয়েছে লালকমল আর নীলকমল। কেমন রূপকথা রূপকথা নাম তাই না! কিছু পরে কাঠবেড়ালীদের সঙ্গে ঝটরপটর করতে করতে গাছে এলো একটি হলুদ পাখি। মোতি তার নাম জানে না। চেনা হলুদপাখি বেনেবৌ এর মতোই। অরিওলই হবে কোনো। যাই হোক ইনি আর নামলেন না নিচে। পড়া তেমন কিছু আর হলো না আজ মোতির। সামনের সবুজ ক্যানভাসে রঙের কাটাকুটি দেখতে সময় গেলো। কিছু পরে মোতি যখন দপ্তর গুটিয়ে ভেতরে ঢুকে এসেছে দিনের চাহিদা মেটাতে, তখন একটি গোবদা কাঠবেড়ালী উঠোন থেকে বাদাম নিয়ে এসে মোতির পাকঘরের জানালার সামনে বসে মুখে বাদাম নিয়ে মোতির কুশল নিয়ে গেল। 

তেমন কিছুই প্রত্যাশা ছিল না আজ সকালের কাছে মোতিমালার। তবুও সে ভিজিয়ে দিলো মোতিকে আজ। তাই তো মোতি তেমন করে আর কিছু চায় না।            

Tuesday, 4 June 2024

মনস্বিতা

সাতসকালে তখন আলোই ফোটেনি ভালো করে। ঘরের চাল থেকে শিশির চুঁইয়ে পড়ে পড়ে কেমন একটা বৃষ্টি ভেজা হয়ে রয়েছে ঘরের চারপাশের মাটি। কুয়াশা কুয়াশা সাদাটে আঁধার চারদিকে। আঁধার থেকে আলো ফোটার সেই সন্ধিক্ষণটা কোনোদিনই আর চোখে ধরে উঠতে পারেনি মেয়েটা। ঘুম ভেঙে চোখ কচলাতে কচলাতে কতদিন পুব আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে সময় গুনেছে সে। তারপর যেই না অধীর হয়ে একটু এদিক ওদিকে মন দিয়েছে অমনি সেই ফাঁকে আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। এর চাইতে বরং সূর্যাস্ত ভাল। আকাশে দোলখেলা চলে কতক্ষন ধরে! চেয়ে দেখলেও চলে, না দেখলেও। আসলে বোধহয় 'আঁধার আসছে' এই কথাটি মনে করিয়ে দিতেই আকাশের এত আয়োজন সাঁঝবেলায়। আর ভোরের সময় দেখো, চুপি চুপি ফাঁকি দিয়ে টুক করে কেমন একফাঁকে সুয্যিদেবের চলা শুরু। কিছুতেই তাঁর প্রথম পা ফেলাটাকে জাপটে জড়িয়ে নিতে পারেনা মেয়েটা। ঠাকুরদাদা শুনে একদিন হেসেই খুন। বলে, নাই বা দেখলি। এই যে আঁধার কেটে আকাশ ধূসর নীল থেকে পরিষ্কার হলো, এই যে আমার বুক থেকে ঘুম ভেঙে উঠে শুক সারি ঠোঁট দিয়ে পালক মেজে সারাদিনের প্রয়োজনের জন্য তৈরী হচ্ছে, এই যে তুই ঘুম ভেঙে উঠে খালি পায়ে শিশিরমাখা ঘাস মাড়িয়ে আমার সঙ্গে গপ্প করতে এলি রোদ্দুর ওঠার আগেই, এই যে রাত ফুরোলেই তোর কচি শিউলি গাছটা হাত পা নাড়িয়ে তোর জন্য দু-আঁচলা শিউলি ঝরিয়ে রাখে প্রতিদিন, সেবুঝি দিনের শুরু নয়? সুয্যিদেবের পথচলাটুকুনিই দেখলি নাতিন, এদের দেখলিনে? শেষরাতের শিশিরে স্নান সেরে ঠাকুরদাদা তৈরী সুয্যিদেবের অভ্যর্থনায়। তাকেও তাড়া লাগায়। নে নে এবার আলসেমি ছেড়ে ওঠ দিকিনি। স্নানে যা। পুবদিকে গোলাপি আবীর ছড়িয়ে লাল পাটের কাপড়টি উড়িয়ে দিয়ে সুয্যিদেব ততক্ষণে পুজোয় বসেছেন। হাতে পায়ের জট ছাড়িয়ে জোর করেই উঠতে হয় এবার মেয়েটাকে। আড়মোড়া ভেঙে ঠাকুরদাদা আর বাকিদেরকে "আসি গো" বলে পিছন ফিরতেই বাস্তব একরাশ তাড়াহুড়ো নিয়ে আক্রমণ করে মেয়েটাকে। 

প্রতিদিনের ঘুম ভাঙার পরের কিছুক্ষণ, যখন দিনের আগামী কয়েক ঘন্টার জীবনের দাবীদাওয়াকে থামিয়ে রাখে মেয়েটা সেই কিছুক্ষণ মেয়েটার কারো কাছে কোনো সম্পর্কের দায় থাকে না। নিজস্ব কোনো পরিচয়ের, এমনকি নামের পর্যন্ত প্রয়োজন পড়ে না। তখন সে পুবের জানালা ভেদ করে ঠাকুরদাদা গাছের কাছে অনায়াসে চলে যেতে পারে। মনে মনেই। শিশির মাখা ঘাসে হাঁটতে হাঁটতে ঠাকুরদাদার গায়ে হাত বুলিয়ে সমস্ত জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। প্রতিদিন। তারপর আজকের মতোই শ্বাস ছেড়ে পিছন ফিরে সারাদিনের জন্য মেয়েটাকে ঢুকে পড়তে হয় প্রয়োজনীয়তার জীবনচক্রে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে নির্দিষ্ট দায়িত্ব, নির্দিষ্ট সম্পর্কের হিসেবনিকেশ। সেখানে রয়েছে তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের এবং পৃথকীকরণের প্রধান উপকরণ, একটি নাম। প্রতিদিনের মত আজও সেই নামের দায়বহনের জন্য মেয়েটা পুবের জানালা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় 'অহনা' নামের ভার নিয়ে।

সারাদিনের খাবার আর পিঠের পেটমোটা ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে দুরদাড়িয়ে হাঁটছিলো অহনা। সাড়ে আটটার আগে আজ ঢুকতেই হবে। সব গুছিয়ে এনিম্যাল হাউস থেকে খাঁচাগুলোকে এনে শুরু করতে করতে নয়টা তো বাজবেই। এর বেশি দেরি হলে পুরো কাজটাই পিছিয়ে যাবে। হাসপাতালের সামনে এসে হাতের মাস্কটা পরতে পরতে দেখলো একটা মাঝারি গোছের এম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে মেন গেটে। অর্ধশায়িত অবস্থায় আচ্ছন্ন এক বয়স্ক মানুষ। ধরাধরি করে নামাচ্ছে গেটের আর এম্বুলেন্সের ডিউটিরত ছেলেদুটি। আড়চোখে দেখতে দেখতে অহনা দ্রুতপায়ে এগোচ্ছিল পিছনের গেটের দিকে। ওদিক দিয়েই আজকাল রিসার্চ উইংসের সকলের যাতায়াতের ব্যবস্থা। এলিভেটর যথারীতি বেশ কিছুটা দেরি করিয়ে দিলো ওর। হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছালো যখন ল্যাবের ঘড়িতে তখন আটটা পঁয়ত্রিশ। ইশ! সকাল সকাল হুড়োহুড়ি করতে এক্কেবারে ভালো লাগে না। কি যে ঘুম থেকে উঠেই জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাস তার! আরও মিনিট পনের আগে পৌঁছানো উচিৎ ছিল। শুধু শুধু দেরি হয়ে গেল। তাকে দেখেই নড়েচড়ে বসেছিল আইলিন। তার  জন্যই অপেক্ষা করছিলো। দুজন না হলে অসুবিধা এই কাজে।
"হাই আইলিন, গুড মর্নিং। সরি, লিটিল লেট্।"  পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলে অহনা।
" গুড মর্নিং। ইটস ওকে ডিয়ার। উই উইল বি ওকে। " -মুখে হাসি নিয়ে বলে ওঠে আইলিন।
"আমি তাহলে নিচে থেকে খাঁচাটা নিয়ে আসি। কোন রো-এর কত নম্বর খাঁচা নেব বলোতো?"- আইলিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অহনা।
"দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমায় এখন বোঝাতে গেলে অনেক সময় লাগবে। আমি জানি কোন খাঁচাটা। তুমি বরং এদিকটা দেখো, আমি নিয়ে আসছি খাঁচা।"- আইলিন ডেস্ক থেকে ফোনটা নিয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে।
অহনার সুবিধাই হলো। আবার এখনই হাঁপাতে হাঁপাতে এনিম্যাল হাউসে ছুটতে হলোনা। সত্যিই আইলিন ইঁদুরগুলোর সার্বিক দায়িত্বে। ওর পক্ষে সহজ হবে ব্যাপারটা অনেক। মেয়েটা অনেক কাজ করে। অহনার "থ্যাংক ইউ আইলিন"  এর উত্তরে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল আইলিন। অহনা ঝটপট হাতে গ্লাভস চড়িয়ে প্রয়োজনীয় টিউব, রিয়েজেন্ট, প্লেট, কাঁচি, ফরসেপ গুছিয়ে নিয়ে শেষ করলো যখন, তখনও আইলিন ফেরেনি এনিম্যাল হাউস থেকে। ঝুপ করে এনিম্যাল ওয়ার্ক টেবিলের সামনে বসে পড়লো অহনা। যতক্ষণ আইলিন না ফেরে একটু শ্বাস নিয়ে নেবে। সারাদিনের কাজ রয়েছে আজকে। সাতসকালে তাকে চেয়ারে বসে দুলতে দেখে পাশের ল্যাব থেকে রিয়াজ বলে ওঠে "কি সকাল সকাল বসে দোলা খাচ্ছেন যে? কাজ নাই?" আশে পাশে অন্য ভাষার কেউ না থাকলে রিয়াজ অহনার সাথে বাংলাতেই কথা বলে। "এই শুরু করবো।"- হেসে বলে অহনা। কয়েকদিন রিয়াজের সাথে তেমন কথা হয়নি কাজের চাপে। "তারপর করোনার কি অবস্থা বাংলাদেশে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?" -একেবারেই এই কয়েকমিনিট সময় কাটাতে জিজ্ঞাসা করে অহনা। মুহূর্তে চোখের হাসিটা চলে গিয়ে মুখটা ছোট হয়ে যায় ছেলেটার।
"কোথায় আর ঠিক! বাড়িতে তো মুড়ি-মুড়কির মত মারা যাচ্ছে মানুষ।"
একেবারেই অকারণে সময় কাটাতে রিয়াজের সাথে কথা শুরু করেছিল অহনা। দিনের শুরুতেই এমন একটা উত্তরের জন্য তৈরি ছিল না সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কথাটা শুনে। তার ভেতর থেকে "কি বলছিস?" কথাটা বেরিয়ে আসে অজান্তেই। ততক্ষনে মাসি, মাসির ছেলে, কাকিমা আরো কার কার যেন করোনায় মৃত্যুর কথা পরপর বলে চলেছে ছেলেটা। গত দুই মাসে এতগুলি মানুষের অকাল মৃত্যুর সংবাদ বহন করেছে ছেলেটা বিদেশে বসে! হাসিখুশি ছেলেটিকে কোনোদিন দেখে বোঝেনি তো সে? অবশ্য তেমন করে কথা বলা হয়না। দুপক্ষেরই কাজের চাপে। "বাড়িতে ফোন দিতে ভয় পাই জানেন দিদি। মা-বাবা-র মানসিক অবস্থা যা!" - মাথা নিচু করে রিয়াজ।
এ কথা অহনাকে আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। গত এক বছরে তার বাড়িতেও ছয় জন মানুষ চলে গেছেন। সে কেবল কানে ফোন চেপে শূন্য দৃষ্টিতে শুনে গেছে। শেষের দুইজন অকালে তো বটেই, অকস্মাৎ দুর্ঘটনায়। খবরটা প্রথম আসে তারই কাছে। জীবনে প্রথমবার বাড়িতে এই সংবাদ তাকেই পৌঁছাতে হয়েছিল জনে জনে ফোনের এপারে বসে। কি করে সে পেরেছিলো আজও জানে না সে। মানুষের বোধহয় নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আন্দাজ থাকে না ঠিকঠাক। সেও জানতো না, যে সে এত বড় হয়ে গেছে এই কয়বছরে। সারা ছোটবেলাটা যাঁদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল, একবছরের মধ্যে পর পর এইভাবে তাঁদের ছয়জনের চলে যাওয়াকে সেও তো হজম করে ফেলছে আস্তে আস্তে! রিয়াজের মনের তোলপাড়টাকে চিনতে এতটুকু কষ্ট করতে হয়না তাকে। সে জানে রিয়াজ এই মুহূর্তে কতটা অসহায়। কিছুই বলতে পারে না সে রিয়াজকে। একটু এগিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অহনা। ভেতরে ভেতরে তার ক্ষতটাও জেগে উঠছিলো, যেটা রিয়াজের সামনে প্রকাশ করতে চাইছিলো না অহনা। মাস্কের আড়ালে ঢোক গিলে গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া নিকট অতীতের কষ্টগুলোকে গিলে ফেলছিলো সে। হয়তো রিয়াজও একই ভাবে তাই করছিলো। এছাড়া কিই বা করতে পারে তারা। ভাঙতে ভাঙতে উঠে দাঁড়ানো ছাড়া!

অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা ভেঙে সেসময় ল্যাবের দরজাটা দুম করে বন্ধ হয়। অহনা আর রিয়াজ দুজনকেই ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সেই মুহূর্তে আইলিন ফিরে এসেছে। হাতে একটা ইঁদুরের খাঁচা।
"হিয়ার ইট ইস।" - আইলিনের হালকা গলাটা ল্যাবে ফিরিয়ে আনে অহনাকে। হাতের পেন্সিলটা টেবিলের ওপর ঠুকতে ঠুকতে রিয়াজও স্মিত হাসার চেষ্টা করে। মুখের পেশীর বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায় না যদিও। নিজের চেয়ারের দিকে ফিরে যায় রিয়াজ।
"আর ইউ রেডি হিয়ার? শ্যাল উই স্টার্ট দেন?" আইলিনের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ে অহনা। গ্লাভসের বাক্সটা যেন কোথায়? এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে অহনা বোঝে সে আসলে দেখছে না কিছুই। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে টেবিলের দিকে ফিরে আসে। গ্লাভস পড়া হাতে খাঁচাটা খুলে ধরে অহনা। ভেতরে দুটো কালো ইঁদুর এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ওরা জানে বোধহয় কি হতে চলেছে।অভ্যস্ত হাতে একজনের লেজ ধরে তুলে আনে অহনা।

"উইল ইউ পাশ মি দ্য কন্ট্রোল টিউবস প্লিজ?" বোঁ বোঁ করে হেপা ফিল্টারের ফ্যানের আওয়াজে আইলিনের বলা কথাটা হারিয়ে যাচ্ছিলো প্রায়? কোণাকুণি রাখা অন্য হুডটায় একরাশ টিউব সাজিয়ে বসেছিল আইলিন। হাত বাড়িয়ে টিউবের সারিটা আইলিনকে দিয়ে দেয় অহনা। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কাজ করছে দুজনে তারা পাশাপাশি বসে যন্ত্রের মতো। একই প্রজেক্টের দুটো ডিরেক্শনের দুরকম এক্সপেরিমেন্টের দায়িত্বে ওরা দুজনে। এই প্রজেক্টটা আপাতত মাথা খাটানোর দরকার নেই বিশেষ। পর পর করে গেলেই হলো। মাথাটা তাই অন্যদিকে খাটানোর সুযোগ পাচ্ছে অহনা। এরকম লাক্সারি বিশেষ আসেনা অহনার। ফলে বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। কাজের শুরুটা ছাড়া। কাজের শুরুর ওই কোষগুলিকে জোগাড় করতে অহনাকে নিতে হয় একটি বা দুটি ইঁদুরের পায়ের হাড়। সেখান থেকে বাকি সব কিছু ফেলে দিয়ে অস্থিমজ্জা অংশটুকু বের করে নেওয়ার কাজটা একটুও উপভোগ করে না অহনা। তবুও ওকেই করতে হয় কাজটা। খারাপ-ভালো মিলিয়েই আদতে শেষের সবটা। এই শেষের সবটা ভালো হলেই বাকিটা মেনে নেওয়া যায়। এই নিয়ে টানাপোড়েনের উত্তর নেই অহনার কাছে।

কতবার সাঁঝের ঝোঁকে মুখ ঝুলিয়ে ঠাকুরদাদার কাছে প্রশ্ন নিয়ে এসেছে মেয়েটা। কেবল সবলতর বলেই কি দুর্বলতর প্রাণীর জীবনের নিয়ন্তা হওয়া যায় ঠাকুরদাদা? ঠাকুরদাদা মেয়েটার গায়ে কচি পাতার আলতো আদর করে, সন্ধ্যের বাতাস বুলিয়ে মাথার চুল যত্নে আঁচড়ে দিয়ে মেয়েটাকে শান্ত করেছে। বলেছে, সব কাজের ভালো-মন্দ হয়না রে নাতিন। কিছু কাজ কেবল কাজই। তুই না করলে অন্য কেউ করবে। কাজটা কেন করছিস সেটা ভাবিস বরং। এই 'কেন'টার উত্তর পেলে তখন নয় বিচার করতে বসিসখন আদতে তুই কাজের কাজ কিছু করলি নাকি পুরোটাই ফাঁকি? ঠাকুরদাদা যেন কী! কোনো কিছুতেই যেন 'নেই' দেখতে পায়না। ঠাকুরদাদার সাথে কথা কইলেই তাই মনটা আলো হয়ে যায় মেয়েটার। তাইতো ভোর থেকে সন্ধ্যে অবধি ঘুরঘুর করে মেয়েটা ঠাকুরদাদার আশেপাশে।মনে মনে সাজিয়ে নেওয়া তার নিজের বাগান। সেখানে ঠাকুরদাদা গাছ আছে, ভুলু আছে, একরাশ পাখপাখালি আছে। আর শান্ত একটি মন রাখা আছে মেয়েটার। সেই যে সাতসকালে এসে গপ্প জুড়েছে, তারপর তো ঠাকুরদাদা সকালের শিশিরে স্নান সেরে হাতে বুকে মাথার আনাচ কানাচ থেকে পাখিদের জাগাবে, পাতা থেকে খসিয়ে দেবে টুপটাপ শিশির জল। সেই জলে মুখ মাথা ধুয়ে জেগে উঠবে ঠাকুরদাদার প্রিয় পাখিরদল। সাথে সাথে কয়েকদিনের জন্য ঠাকুরদাদার কাঁধে এসে আস্তানা গেড়েছে ওই যে পরিযায়ী পাখিরা, ওরাও কিচিরমিচির জুড়ে দেয় সকালবেলা মেয়েটাকে দেখলেই। তবে সেসময় তাদের বড় তাড়া। গল্প হয়না বিশেষ। গল্প হয় সাঁঝের বাতি জ্বালার আগে তারা ফিরে এলে পর। এ ওর ডানা পালক থেকে কুটি-নাটি, পোকা-মাকড় বেছে পরিষ্কার করতে করতে সারাদিনের কত দিগ্বিজয়ের গল্প শোনায় তখন তারা মেয়েটাকে। মেয়েটা গোল গোল চোখে শোনে। সেসময় ভুলুটাও মশা এড়িয়ে মেয়েটার কোল ঘেঁষে বসে থাকে। আজও থাকে কি? থাকে নিশ্চয়ই! এসব গল্প ওর কানে যায়না অবশ্য। ওর এই একসঙ্গে জটপাকিয়ে বসে থাকতেই আনন্দ। ঠাকুরদাদাও সন্ধ্যের ঝোঁকে ঝিমোতে ঝিমোতে গপ্প শোনে কি শোনে না।

কান থেকে ফোনটা নামিয়ে অহনা আস্তে আস্তে হাঁটছিলো। বাড়ি ফিরে ভালো করে গরম জলে স্নান করে, রাতের মত খাওয়া সেরে আশেপাশেই এ-রাস্তা, সে-রাস্তা হেঁটে বেড়াচ্ছিল সে। সবে অন্ধকার হয়েছে। এই গরমের কটা দিনই এখানে এই উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ানোর বিলাসিতা করা সম্ভব। সারাদিন বেজায় ব্যস্ততায় কেটেছে। আলো আঁধারিতে হেঁটে দিনের ক্লান্তি দূর করে অহনা। কথা বলতে ভালো লাগে না এসময়। তবুও ফোনের পর্দায় কিছু মানুষের নাম ফুটে উঠলে তাকে অহনা এড়াতে পারেনা। তেমনই একটি কথোপকথন শেষ করে হাঁটছিলো অহনা। ফোনের ওপাশে দীপ্ত। বলে যাচ্ছিলো হতাশার কথা। দেশ ছেড়ে ভালো করে বিজ্ঞান জানার বাসনায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায় যেসব বোকা মানুষগুলো, বিদেশে যারা দ্বিতীয় ধাপের নাগরিক, আর বছর তিনেক বাদেই যারা আবিষ্কার করে - দেশেও তারা ততদিনে ব্রাত্য, তেমনই 'ঘরেও নহে পরেও নহে'-দের  একজন দীপ্ত। যেমন অহনাও। যেমন রিয়াজ। যেমন আরও আরও কত কত জন। ভালো করবার আশা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছাড়ে। কেউ করে, কেউ আপাদমস্তক অতিসাধারণত্বের ভার নিয়ে দিনের পর দিন ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন বোনে। পুরোটাই অনিশ্চয়তা। অহনার চেয়ে অনেক বেশি বোধ নিয়ে এদেশে এসেছিলো দীপ্ত। অথচ থিতু হতেই পারলো না এখনো। গত পাঁচ বছরে তিন তিন বার ল্যাবের ঠিকানা বদল করতে হয়েছে দীপ্তকে। কখনো গবেষক নয় ঠিকে মজুরের মত দিনের পর দিন কাজ করে যাবার হতাশায়, কখনো কাজের প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জোগাড় না হওয়ায় ল্যাব ছেড়ে এসেছে, কখনো অনভিপ্রেত ল্যাব পলিটিক্সের শিকার হয়ে দীপ্তকে হাতে তৈরী সম্ভাবনাময় গবেষণা ছেড়ে আসতে হয়েছে। ছেলেটা প্রতিবার আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু কিছুতে মন ডুবিয়ে কাজ করতে পারে না। অথচ পারলে হয়ত সত্যিকারের একটা কাজের কাজ হত। মনটা খারাপ হয়ে আছে অহনার। দেশে মা-বাবার বয়স এত কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। আর তার সাথে বেড়ে চলেছে হতাশা। দীপ্ত ভেঙে পড়ছে এবার। প্রতিবারের মতোই এবারেও সাধ্যমত তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছে অহনা। কিন্তু সত্যিই কি যা বলছে, তা নিজেকে বোঝাতে পারছে অহনা?
তার মত অনেকেই অলস পায়ে হাঁটছে, বাচ্চাদের বা পোষ্যকে নিয়ে বা একাই, সাইকেল চালাচ্ছে। ঝিম ধরা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হোপ টাওয়ারটার পায়ের কাছে সিমেন্টের বেঞ্চটায় বসে পড়ে অহনা। কোথায় পৌঁছাচ্ছে সে বা দীপ্ত বা রিয়াজ বা তাদের মত আরো অনেকে? প্রতিদিনের সাধারণত্বকে মেনে নিতে নিতে ভুলেই যেতে বসেছে এর চেয়েও আর একটু সহজে আর একটু কম প্রতিকূলতায় ভালোবাসার কাজটা করা যেতে পারলে বেশ হতো। যাত্রাপথকে নাকি উপভোগ করতে হয় কিন্তু কোথাও পৌঁছোবার দায় না থাকলে যাত্রাপথ বলে কি কিছু থাকে? চলবার প্রয়োজনটাই অবান্তর নয় কি তখন? পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে উজিয়ে এসেছে তাদের মত কত কত মানুষ, যদিও কিছু জনের কাছে তারা এসেছে কেবলই কুবেরের ধন লাভ করবে বলে। তবুও দীপ্তর মতও কেউতো আছে যারা কেবল কাজটার শেষ দেখবে বলে, নিজের মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবে বলে, নিজের বুদ্ধির অর্ধেক দাম নিয়ে, অর্ধেক মানুষ হয়ে, দিনের পর দিন চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষের এই জিজ্ঞাসার পথের কাঁকড়, নুড়ি যদি খানিক কম হত! যদি প্রিয়জনের পাশে থেকেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজটা করা সম্ভব হতো! মাথা নিচু করে বসেছিল অহনা। 

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ঠাকুরদাদা। মনকেমনের ওষুধ নেই রে নাতিন। জীবনকে দুহাত পেতে গ্রহণ করতে হয়। স্রোতকে ঠেলতে গেলে সাঁতার কাটার সাহস, আর যা কোনোদিন হয়নি, তাকে করে দেখানোর উদ্যোগ লাগে। ভালো করে খুঁজে দেখ দিকি মনের ভিতরে, যা করতে চাস তা সত্যিই করতে চাস কিনা? তাহলে ঠিক তার পথ আপনিই খুঁজে পাবি। তারপর সেইমত সাহস করে এগিয়ে যা বরং আর কিচ্ছুটি ভাবিসনে মেয়ে। ভাবলেই ভয় পাবি। এখন যা দিকি সাঁঝের বেলায় পৃথিবী ঘুম যায় জানিসনে! পরের দিনের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। তুইও যা মেয়ে। কালকের জন্য প্রস্তুত হয়ে নে বরং। মেয়েটা তবুও ঠাকুরদাদার কোল ঘেঁষে জড়ো হয়ে বসেই ছিল।  

কতক্ষণ বসে ছিল তার হিসেবে করেনি অহনা। শীত শীত করছে এবার। আশেপাশের লোকজনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় রাতের মত বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে অহনার। হাতের চশমাটা চোখে লাগিয়ে নিয়ে একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় অহনা। পায়ে পায়ে চকচকে আলো মাখা ফেরার রাস্তাটার দিকে এগিয়ে যায় অহনা। সামনের দিক থেকে আসছেন একজন সাইকেল আরোহী। হেঁটে যাচ্ছেন আরও কয়েকজন। অহনা শুনলো, মধ্যবয়স্ক সাইকেল আরোহী প্রত্যেককে পেরিয়ে আসার সময় বলছেন, "গুড ডেস আর কামিং ফোকস, গুড ডেস আর কামিং।" অহনাকে পার হয়ে এগিয়ে যাবার সময় তাকেও বলে গেলেন "গুড ডেস আর কামিং ফ্রেন্ড।" অহনা হেসে মাথা নাড়লো। মনে মনে বললো, "হোপিং সো।"

ওপর দিকে ঘাড় তুলে তাকালো একবার। অন্ধকার কালো আকাশে হোপ টাওয়ারের সোনালী দেহটা আলোয় আলো মেখে মূর্তিমান স্পর্ধার মত দাঁড়িয়ে আছে। 'হোপ' মানেই তো স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার স্পর্দ্ধা। 'আশা' করাটাই ঔদ্ধত্ব। প্রতিকূলতাকে বুক পেতে গ্রহণ করে, হেরে না যাওয়ার অঙ্গীকার।

হাতের ফোনটা টিং করে উঠলো। ফোনের পর্দায় আইলিনের ছোট্ট মেসেজ। "হেই, উই আর গেটিং টু মোর পেসেন্ট ব্লাড টুমোরো। চেক ইওর ইমেইল।" তারপর বেশ কয়েকটা উচ্ছসিত উল্লাসের ইমোজি।এদুটো হলেই ফেজ ওয়ানের সবকটা স্যাম্পল হয়ে যায়। স্নায়ু শিথিল, মুখের পেশী শিথিল। ঘুম পাচ্ছে এইবার অহনার। ইমেইলের ওপর আঙ্গুল ছোঁয়ায় অহনা বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতেই।

Sunday, 1 January 2023

"সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে"

"সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে"

অহংকার কথাটা বেজায় গোলমেলে। না থাকলে কাজকর্ম পন্ড। আবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়ে গেলেই গন্ডগোল। উপনিষদ রচয়িতারা বলছেন অহং পঞ্চকোষের অংশমাত্র। আমি নই। আবার জড়জগতে কাজকর্ম চালাতে গেলে এই অহং বা বাইরের আমিটি না থাকলে চলে না। যেই বাইরের কাজ ফুরায় অমনি এই বাইরের আমিটিকে তখনকার মতন ঝেড়েঝুড়ে, পাট করে দেরাজে তুলে রেখে আসল আমিটিকে খুঁজতে ডুব দিতে হয় ভিতরপানে। উপনিষদ রচয়িতা ঋষিরা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথও বলেছেন তাঁর গানে, বিবেকানন্দ বলেছেন তাঁর অজস্র বক্তৃতায়, বর্তমানে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরাও বলছেন। আবার নব্যযুগের কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট বা কসমোলোজিস্টরাও তেমনই কিছু একটা বলবো বলবো করছেন। উপনিষদ যাকে 'আমি' বলেছেন, 'ব্রহ্ম' বলেছেন, চৈতন্য বা চেতনা বলেছেন, আজকের কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট বা কসমোলোজিস্টরা তাকেই 'Consciousness' বা 'Qualia' বলছেন। এতদিন পর্যন্ত অধিকাংশ পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকরা consciousness যে মস্তিস্কপ্রসূত একটি অলীক 'বস্তু'-এই বলে গলা ফাটাতেন,  তাঁদেরই কিছু জন ধীরে ধীরে এতদিনের প্রাচ্যের বলা কথার সারবত্তা বুঝেছেন। বলছেন, যেহেতু Qualia বা Consciousness ফার্স্ট পার্সন এক্সপেরিয়েন্স তৈরী করে, সেহেতু সেটি বস্তু বা জড়জগতের অংশ হতে পারে না বা বস্তুজগৎ থেকে উৎপন্নও হতে পারে না। এবং সেই একই কারণে মস্তিস্ক দ্বারা উৎপন্নও হতে পারে না। বাহিরের যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে ধরা তো যায়ই না। মন, মস্তিক এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা এটি প্রকাশিত হয় মাত্র। অর্থাৎ সেই বাইরের আমির বোধটুকু তৈরী করে মাত্র। শরীর মরে ক্ষয়ে, মন মরে নিজের জ্বালায়। যা কিছু ঝড়-ঝাপ্টা সবই ওই বাইরের আমির। আসল আমিটি দিব্য মজায় থাকে। Untouched . 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'সুন্দর', রামকৃষ্ণ বলেছেন 'চৈতন্য', বেদান্ত বলেছেন 'ব্রহ্ম'। আবার শিব, কালী  বা কৃষ্ণ ভক্ত বলেছেন 'শিব', 'কালী', বা 'কৃষ্ণ'। এখন এই আদত আমিটি নতুন নাম পেয়েছে। Qualia বা Consciousness. যা আমাকে আমি বলে বোধ করাচ্ছে। নামে কী যায় আসে! আসল কথাটি হলো মনে ভার নেমে যাওয়া। এই যে দিন-দুবেলা সে কেন আমার সাথে এমন ভাবে কথা কইলো? ও কেন এমন দেখনদারী করলে? ও কেন আমায় যার পর নাই সম্মান করলে না। ইত্যাদি আর যা কিছু হাবিজাবির ভার বয়ে বয়ে মনে ব্যাথা হলো, উত্তেজনায় রক্তচাপ বেড়ে শরীর ক্ষয় হলো,  সেসব বেশ নামিয়ে রেখে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে এই বা কম কী? যদিও তুমি, আমি, বাকি সকলে আদতে একই- এসব কথাও বড়রা বলেন, তবুও নয় সেসব এখনকার জন্য বাদই রাখলাম।     

এই সেদিন একজায়গায় দেখলাম বড়বড় হরফে লেখা রয়েছে "Relax! Enjoy the show!"  এইটি তারপর থেকে বড় মনে ধরেছে। মনে পড়লেই বেশ গায়ে এক খাবলা সর্ষের তেল মেখে নাইতে নেমেছি এমন একটা অনুভব হয়। তুমি আমার ওপর চেঁচাবে? চেঁচাও। মনে লাগবে, কিন্তু আসল আমিটিকে তুমিতো ছুঁতে পারলে না! তেল ভেদ করে গায়ে লাগলে তবে তো!  মনের ওপরের জল চোখের জলের গামছায় মুছে নিলেই হলো। বাইরের 'আমি'র শান্তি। "সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।" 

এই যে দিনে-দুপুরে-সন্ধ্যায়-রাত্তিরে বাইরের এই আমিটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করার এত আয়োজন, পান থেকে চুন খসলেই হয় চোখের জল নয় মনের ঝাল,  একদিন তো তার প্রয়োজন ফুরোবেই। তখন যে বাহির ফেলে ভেতরে ঢুকতে হবেই। তখন কী আর তোমার আমার পার্থক্য থাকবে? আজ যাকে দেখে আড়ালে রসিকতা করে আনন্দ পাচ্ছো, আজ যার অনিচ্ছাকৃত ভুলে সমালোচনার অশ্বমেধ ছোটাচ্ছো, আজ যাকে ঠিক নিজের মতোই নয় বলে দূরে ঠেলে রাখছো, সেদিন তার আর তোমার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাবে তো? নিজেই নিজেকে অপমান করার লজ্জা সেদিন তোমায় রাঙিয়ে দেবে না তো? সেই যে, "নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান।"

তার চেয়ে বরং এই ভালো।এই যে প্রতিদিন 'বেঁচে থাকা'র মতন দুর্দান্ত একখান অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেটিকে তো সাপ্টে উপভোগ করতে হবে নাকি? কে বলতে পারে কাল সকালে চা খাবার সৌভাগ্য হয় কি না হয়! সুতরাং, নতুন বছরে " Relax, enjoy the show".  Happy তো এমনিই হয়ে যাবে বছরটা। 

Sunday, 13 February 2022

বেয়াদব মন

শিশির নামে ক্লান্ত কাঁধ বেয়ে। অযত্নের লালচে চুলের ডগায় জমেছে রুক্ষতা। চিড় ধরেছে। দ্বন্ধ হয়েছে বৃদ্ধি। শিশিরে ভিজেও রুক্ষতা ঘোচেনা তার। মাঝরাতের মেঘহীন আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কি ধীরে ধীরে গলে যাবে সমস্ত দীর্ঘ্যশ্বাস? অর্ধেকটা প্রশ্বাস নিতে নিতে আর অর্ধেকটা নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসের ক্ষমতা। প্রকাশ্যে আসে না এসব কথা। অহেতুক দুঃখ বিলাসিতা বলে একলা মানুষকে আরও একলা করে দেবে বাকিসব আত্মপ্রত্যয়ী মানুষেরা। সকলেরই ভাগ না করে নেবার মতন কিছু যন্ত্রণা থাকে। থাকে কোনো সমাধান না থাকা সমস্যা। থাকে অনিবার্য ক্ষয়। সেসবই ক্লান্তি হয়ে নেমে আসে ঘাড়-পিঠ-চুল বেয়ে। এবং তৎক্ষণাৎ সেসব মনের খোরাক হয়ে যায়। 

মনের কাজই হলো এতটুকু তিলপ্রমাণ বাধার সন্ধান পেলেই তাকে বিশ্বব্যাপী দুর্লঙ্ঘ্য বাধা বলে প্রক্ষেপ করা। তবুও মনের চলনে লাগাম পরানো যায় না। আবার ভালোর সন্ধান পেলে সেই মনই বলে - এই তো বেশ শান্তি! দৈবিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক সমস্ত পার্থিব যন্ত্রণার ওপরে উঠে মন ঠান্ডা হয়ে আসে। এই যেমন ঘরে ঢুকলেই একটা স্নায়ু শান্তিকর সুগন্ধ আসে নাকে। একটা সুগন্ধী মোমবাতি জ্বলছে কয়েকদিন ধরে। কয়েকদিন বলতে সন্ধ্যায় জ্বলে, রাতে ঘুমোতে যাবার আগে নিভিয়ে দেওয়া হয়। এমন যদি হতো সবকিছুই! এই মনে করো, মন ঠান্ডা করার আয়োজন রইলো হাতের কাছেই সারাদিন ধরে, প্রয়োজন মতো জ্বালিয়ে নেওয়া যেত! এইসব আবোল-তাবোল ভাবনায় সন্ধ্যা কেটে যায়। উদ্যোগী কর্মযোগীরা এরকম পড়ে পাওয়া সন্ধ্যায় কত কীই না করে। বিন্দু বিন্দু কর্ম যোগ করে করে সাগর তৈরী করে। আর আমি বসে এতোল-বেতোল ভেবে মরি। তার মধ্যেই কখন সন্ধ্যে ফুরিয়ে রাত নেমে আসে! এমন করে সাগর কেন, ডোবাও তৈরী হয়না। অবশ্য মাঝে মাঝে ভাবি, এমন কীই বা রয়েছে যা দিয়ে কিছু করা যায়! আমি তো কর্মযোগী নই। এই যে কত কিছুই না ঘটে চলেছে চারিপাশ জুড়ে তার একখানি বেশ সমঝদার শ্রোতা-দর্শক তো চাই। নইলে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির উপলক্ষই যে মাটি। আবার মনে হয়, এসব ভাবনা আসলে অলস মনের চলন। যার বেয়াদপিতে আদত আমিটিকেই বেমালুম ভুলতে বসেছি। কাজ না করবার বাহানায় নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছি। হবেও বা। প্রতিদিনের অজস্র খুচরো দাবি মেটাতে গিয়ে প্রধান কাজটিতেই পড়েছে ফাঁকি। মনের এইসব খেলায় ভুলে ছোট ছোট আনন্দের নুড়ি দিয়ে ঝোলা ভরে নিয়ে, সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দোলবার বিপুল প্রাণময়তাটিকেই জলাঞ্জলি দিয়ে এইবার ফিরবার সময় হতে চললো। 

সাগরের কথায় মনে পড়লো, একবার একজন গাইছিলেন -"রূপগঞ্জের হাটে আইসা...., পরের কথাগুলি আর মনে নেই। তখন বসে ভাবছিলাম, "রূপসাগর, রূপগঞ্জ, রূপনগর... শব্দকোষের এসব আউলিয়া শব্দ মানবজীবন বা ভবসংসারে মানুষের ক্ষণিকের অবস্থান বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু 'রূপ' কথাটা সবেতেই রয়েছে। "রূপ" কেন? একটু ভেবে কিছু মানে বের করতে পারছিলাম না। মাথা দিয়ে সেরকম ভাবে ভাবছিলাম না হয়তো। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, হয়তো রূপ মানে সৃষ্টি বা ক্রিয়েশন অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই যে চোখ খুললেই আমরা এত কিছু দেখছি এবং প্রায় সমস্ত কিছুর মধ্যেই এত সৌন্দর্য্য, সেই কারণেই হয়তো রূপ কথাটা ব্যবহার করা হয়। কথাটা মনে ধরলো। রূপসাগরের রূপক সত্যিই বেশ পরিচিত। আসলে আউলিয়া বা সুফী সাধকদের অল্প কথায়, সহজ সুরে, সাধারণ জীবনযাত্রার রূপক ব্যবহার করে অনন্ত এক সত্যের কথা বলে যাওয়াটা আমাদের মতন দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষদের জন্য অজান্তেই আধ্যাত্মিকতার একটা সুর বেঁধে রেখে দিয়েছে। আজকালের এই পল্লবগ্রাহীতার যুগে আধ্যাত্মিকতার কথা বললে অবশ্য অনেকেই ধর্মীয় বাধা নিষেধ ইত্যাদির প্রসঙ্গ তুলে অনর্থক তর্ক করবেন। অথচ তিনি নিজেও ছোটবেলায় শুনেছেন, একটা বয়স পর্যন্ত মনে মনে বিশ্বাস করেছেন, পালন করেছেন এমন কিছু নিয়ম, যা তৈরী হয়েছিল বিস্তারিত একটি সত্যজ্ঞানকে, লালন করার মতো একটি অভ্যাসকে সাধারণ নিয়মের নাম দিয়ে সকলের মধ্যে দিয়ে যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে যাবার সাধু উদ্দেশ্যে। 

এসব ভেবে সন্ধ্যে পার করি। এসব ভাবনার না আছে আদি, না আছে অন্ত। শুধু ভাবনার ভেলায় হাল-দাঁড়হীন দিগভ্রান্তের মতো ভেসে চলা। মনের হাতছানিতে ভেসে চলার যে মারাত্মক নেশা, যাঁর আছে সে জানে। চারিপাশের সমস্ত কিছুকে দশেন্দ্রিয় মন্থন করে আদ্যন্ত শুষে নিয়ে, মন আর বুদ্ধির ক্ষুদ্রতা দিয়ে সাধ্যমত বিশ্লেষণ করে, অহং -এর ভ্রান্ত রং মিশিয়ে চিত্তাকাশে যে ছবিটি প্রতি মুহূর্তে রচিত হয়ে চলেছে, তার কত শতাংশ যে আদতে সত্য- তা বোঝার ক্ষমতা বেচারি মনের আর রইলো না। সে বেশ রঙিন একটি ছবি দেখে এবং দেখিয়েই তার দায় শেষ করলো। এখন এই বিপুল ছবি থেকে সত্য-মিথ্যা বাছাই করতে করতে এবং তদসংক্রান্ত অনুভূতির প্রকাশ সামাল দিতে দিতেই 'আমি' বেচারির দিন গেল। আসল সমে আর ঠিক সময়ে তালটি পড়লো না। মনকে শাসন করে এ নেশা কাটিয়ে বেরিয়ে আসা কঠিন। মানসলোকের একটি তিল থেকে কখন যে তাল, আর সে তাল থেকে কখন যে চোখের সামনে ভুলের একটি বিশাল ইমারত তৈরী হয়ে বসবে বোঝার উপায়টি রইবে না। ভালোর ভালোটিকে বাড়াবে না, কেবল কালোর কালোকে মিশকালো করে তুলবে। এমনই বেয়াদব মন!  


Monday, 18 January 2021

খাঁড়ির গান -১

খাঁড়ির গান -১
------------------

লিখতে চেয়েছে অনক্ষর ছন্দ। অতিদূর সাগরের অচেনা খাঁড়িতে ভাসিয়েছে ভেলা অখ্যাত জ্যোৎস্নাবেলায়। আধোঘুমে সে রাতের উদাত্ত স্প্যানিশ গান গাওয়া অচেনা ছেলেটির স্বর ভেসে আসে। ঘুমোতে দেয়না, জাগিয়েও রাখেনা সারারাত। নিঝুম অতলান্তিকের খাঁড়িতে পথভুলে চলে যাওয়া ম্যানগ্রোভ ঝোপঝাড়ে। বৈঠার টান রুখতে অসফল সে গতি। এসবই জাগিয়ে রাখে। আধখানা চাঁদ শুধু মিশে যায় গাইয়ে ছেলেটির সুরে, নেশার মতন। অচেনা সাগরের, অচেনা খাঁড়িতে প্রাণপণে অনভ্যাসের বৈঠা বেয়ে তীরে ফিরে আসার লড়াই চালায় সেই দুটি ছেলেমেয়ে, যারা একদিন একসাথে দাঁড় বাইবে বলে সাগরে নেমেছিল। সাথে বয়ে নিয়ে চলে অচেনা স্প্যানিশ গানের চেনা চেনা সুর।জলের ছেলেটির গা ছুঁয়ে পিছু নেয় অতলান্তিকের জ্যোৎস্না। আরও অনেকদিন তাদের ঘুমোতে দেবেনা আর জাগিয়েও রাখবেনা বলে।

                                  *********************** **********************

ওপরের কথাগুলো যে অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে সে ঘটনার সময়কাল ২০১৬-র অক্টোবর মাস। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের বয়স তখন আমাদের মাত্র একবছর হব হব করছে।  তার আগের কয়েক বছরে  মানুষের কিছু কথাবার্তা বা ধ্যানধারণাকে অযথা বা প্রয়োজনাতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের কাছেই নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছি। নিজের প্রতি আস্থা প্রায় শূন্য। সামান্য থেকে সামান্যতম কাজ করতে গিয়েও মনে হয়, পারব তো? কি করে সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি সে অন্য গল্প। এই একবছরে নতুন সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে নিতে, জীবন ধারণের নতুন নতুন শর্তপূরণ করতে করতে দিশেহারা অবস্থা। কেন এসব নিজস্ব কথা বলছি তার একমাত্র কারণ হল, এই সময়কার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া। এখনকার সাথে তার তুলনা চলে না। আর এই প্রাককথনটি আজকের গল্পের সাথে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত। এরকম একটা মানসিক অবস্থায়, কেবল একটু সুস্থির ভাবে দিনযাপনই একমাত্র কাম্য তখন। একটি পুরো দিনও যদি নির্ভুলভাবে সমস্ত কিছু ঘটে তবে মনে হয় আহঃ, পারলাম। এমতাবস্থায়, ওমাহা ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল। গত একবছরে আমরা কোত্থাও যাইনি। ওমাহায় এসে সকলে অন্তত শিকাগো ঘুরে আসে সপ্তাহান্তে।  আমরা যাইনি। এমনকি প্রতিটি ছুটির দিনও আমাদের কাছে কাজের দিন ছিল। ফলে বছরের শেষের দিকে কয়েকটা ছুটি নিতে এমনকি গাইড পর্যন্ত বলেছেন কয়েকবার। আমরা ঠিক করলাম বেরোবো। কবে বেরোবো ঠিক করলাম। কিন্তু এদিক ওদিন নানান জায়গা সম্পর্কে পড়ে কিছুই আর ভাল লাগে না।  কারণ প্রতিটা জায়গাতেই কিছু না কিছু করতে হবে গিয়ে, কোনো না কোনো সাংঘাতিক ভাল কিছু দেখতে হবে। নইলে নাকি সেসব জায়গায় যাওয়াই বৃথা। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা কোথাও গিয়ে কিচ্ছুটি করতে চাই না। স্রেফ শুয়ে বসে আরাম করে জায়গাটা দেখতে চাই। অনেক খুঁজে পেতে একটি জায়গা দেখে মনে হলো এখানে অনেক কিছু দেখার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পার্কের ভিড় নেই। ক্যাম্পার বা হাইকারদের লাইন নেই। আবার বড় শহরের বিলাসী দেখনদারিও নেই। টিক মার্ক দেবার মতন কিছুই নেই। আছে কেবল প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো একটি বুড়ো স্প্যানিশ দূর্গ।সেটি অবশ্য সত্যিই দ্রষ্টব্যঃ। তার কোথায় পরে আসছি। এছাড়া আছে উদাত্ত সমুদ্র। উত্তরে আটলান্টিক আর দক্ষিণে ক্যারাবিয়ান সাগর। বাকি সময়টা সমুদ্রের পাড়ে বসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। দুজনেরই ভারী পছন্দ হল জায়গাটি। সমস্যা একটাই, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের মেনল্যান্ডের বাইরে। ঔপনিবেশিক অঞ্চল। এখন আমাদের মতন একাডেমিক ভিসা পকেটে নিয়ে সেখানে যাওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। একটু পড়াশুনা করে মনে হলো অসুবিধা হবে না। সুতরাং যাওয়া মনস্থ করলাম পুয়ের্তো রিকো (Puerto Rico)। মায়ামি থেকে প্রায় হাজার মাইল দক্ষিণ পূর্বে উত্তর ক্যারাবিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ, ডোমিনিকান রিপাবলিক আর ইউ. এস. ভার্জিন আইল্যান্ডের মাঝামাঝি পাতলা একফালি দ্বীপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ। 

এখন একটু দেখে শুনে নিতে গিয়ে দেখলাম, পুয়ের্তো রিকো থেকে একটি ফেরি সার্ভিস চালু আছে যেটা দিয়ে পুয়ের্তো রিকো দ্বীপভূমির শাসন ব্যবস্থার মধ্যে থাকা আশেপাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দ্বীপগুলোর সাথে পুয়ের্তো রিকোর প্রধান ভূমি খণ্ডের সাথে যোগাযোগ বজায় থাকে। এরকম দুটি দ্বীপ হল, উত্তর পূর্বে  ফ্ল্যামেঙ্কো-কুলেব্রা আর দক্ষিণ পূর্বে ভেইকোয়েস (Veiques, উচ্চারণটা অনেকটা 'ভেইকেস' আর 'ভেইকুয়েজ' এর মাঝামাঝি কিছু একটা। আমি বরং ভেইকোয়েস লিখি কেমন?)। মনে মনে ভাবছিলাম একদিন ফেরি করে ওই ছোট দ্বীপগুলোর একটায় একদিন কাটিয়ে আসলে কেমন হয়? যদিও বেশি কেউ যায়না হয়ত। প্রধানত, সাধারণ রোজকার জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগান দেবার জন্যেই এই ফেরি। তার সাথে সাথে কিছু টুরিস্টও যাতায়াত করেন। এমন ভাবতে ভাবতে মনে হলো অমন একখানা দ্বীপেই গিয়ে কদিন  থাকি না কেন? আমাদের তো দেখার কিছু নেই। করার কিছু নেই। কেবল শোনার আছে। সমুদ্রের গান। সে ছোট দ্বীপই হোক বা বড়। কি যায় আসে? বরং যত ছোট জায়গা হবে তত কিচ্ছুটি না করার বিলাসিতার সুযোগ বেশি। ফ্লেমিঙ্কো অপেক্ষাকৃত বড় এবং একটু হলেও পরিচিত ভূখন্ড। তাই তাতে হোটেলপাতি আছে। এবং খোঁজ করে জানা গেল সেসব ভর্তি। আর যেসব জায়গায় এখনো ঠাঁই রয়েছে, সেসব জায়গায় পা দেবার মত পকেট আমাদের নেই। অগত্যা ভেইকোয়েসে খোঁজখবর শুরু হলো। খুব একটা আশাপ্রদ কিছু নয়। এখানে আরো কম, হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল। অনেক খুঁজে, হোটেল পাড়ার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে স্থানীয় বসতির মধ্যে একখানা হোটেলের দেখা পাওয়া গেল। যার চাহিদা এবং আমাদের পকেটের সম্বন্ধ আদায় কাঁচাকলায় নয়। বুকিং হলো কিন্তু সেসময় সত্যি বলতে কি একটু ভয় ভয়ই করছিল। এত ছোট্ট একটা জায়গায় স্থানীয় বসতির মাঝে, যেখানে সাধারণ টুরিস্ট যাবে না সেখানে একটা ছোট্ট হোটেলে থাকাটা কতটা ঠিক হবে সেই নিয়ে। যেমন হয় আর কি। কিন্তু দুটো বিষয়, এক, আর কোথাও জায়গা নেই।  এই জায়গাকে না বলে দিলে পুরো ভেইকোয়েসকেই না বলতে হয়। আর পুয়ের্তো রিকোর অপেক্ষাকৃত শহুরে জনপদে এসে থাকতে হয়। আর জীবনে প্রথমবার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দ্বীপভূমিতে থাকার উত্তেজনায় খানিক ভাঁটা পড়ে। আর দুই, হোটেলটি যতই সাধারণ মানের হোক না কেন, হোটেলটির ঘর, ব্যালকনি, উঠোন আর আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে কোনো ব্যবধান নেই। অর্থাৎ, বিছানায়, ব্যালকনিতে, উঠোনে দাঁড়িয়ে আপনি যা দেখবেন সেটি অতলান্ত আটলান্টিকের অগাধ নীল। আর মনে হলেই, উঠোনের বাঁশের নড়বড়ে দরজা খুলে আপনি যেখানে প্রথম পাটা ফেলবেন সেটি আটলান্টিকের বালি। টুরিস্ট স্পটের সাজিয়ে দেওয়া বালি নয়, আপনার বাড়ির কোনায় পুকুর ঘাটের মতন আটপৌরে বালি। আক্ষরিক অর্থেই শ্যাওলাপড়া আঘাটার কাদা মাখা পাথরে সাগরের ভেসে আসা ছোট ছোট মৃত জীবের আধপচা দেহ পড়ে থাকা পান্ডব বর্জিত সমুদ্র তীর। ঘরোয়া, নিজস্ব আটলান্টিক মহাসাগর তার গাঢ়তম নীল নিয়ে আপনার পায়ের পাতায় আছড়ে পড়ছে। দোতলায় বারান্দায় দাঁড়ালে একসারি নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে পুয়ের্তো রিকো থেকে ফেরী আসছে দেখা যায়। এসব অবশ্য তখন জানতাম না। তখন কেবল জানতাম আমরা একখানা থাকার জায়গা পেয়েছি এবং সেটা সমুদ্রের এক্কেবারে পাশে। সুতরাং অচেনা ছোট্ট জায়গায়, টুরিস্ট বৃত্তের বাইরে, স্থানীয় জনবসতির মধ্যে থাকার অজানা ভয়কে সরে যেতেই হলো।

আমরা যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। দুই রকমের ভ্রমণ হয়। এক, যেখানে আপনি কেবল বেরিয়ে পড়বেন। বাকিটা গিয়ে ঠিক করা যাবেখন বলে। আর দুই, যেখানে আপনাকে আগে থেকে কে, কি, কেন, কবে, কোথায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জেনে তবে বেরোতে হবে। দ্বিতীয়টিতে খাটনি বেশি তাই আমার অপছন্দের। কিন্তু সময় বিশেষে দ্বিতীয় পদ্ধতিটিই কার্যকরী। প্রথম প্রটোকলটি সেখানে খাটাতে যাওয়া মানে যেচে বিপদ ডেকে আনা। বিশেষত এই ম্যাপে খুঁজে না পাওয়া জনপদে। একসময় দেখলাম দুজনে দুখানি পিঠের ঝোলা আর একটি ছোট সুটকেস নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর আর ক্যারাবিয়ান সাগরের সঙ্গমের ছোট্টদ্বীপ ভেইকোয়েস এর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি। তখনও আমাদের সঠিক ধারণা নেই যে আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি। অর্থাৎ, থিওরিটিক্যাল ধারণা হয়তো আছে কিন্তু সেতো ইন্টারনেটের থেকে ধার করা কিছু ধারণা। আসল জায়গাটা ধরা পড়েছিল আস্তে আস্তে। ওমাহা থেকে ভোরবেলার একটা ফ্লাইট নিয়ে পৌঁছেছিলাম হিউস্টোন। বেলা দশটা এগারোটা নাগাদ। তারিখ পত্র আজ আর মনে নেই। পুরোনো ফোল্ডার গুলো খুঁজলে হয়ত মনে পড়বে কিন্তু সে অবান্তর তথ্যের সাথে এ গল্পের বিশেষ যোগ নেই। হিউস্টোনের এয়ারপোর্ট ওমাহার ছোট্ট ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টের চেয়ে অনেকখানি বড়। আমরা খাওয়া দাওয়া করে, বাথরুম সেরে পরবর্তী ফ্লাইটের গেটের দিকে যাওয়াই মনস্থ করলাম। এখন থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য San Juan, পুয়ের্তো রিকোর রাজধানী শহর। উচ্চারণটা যদিও অনেকটা 'সান- ওয়ান'। সেটাও অবশ্য পরে জেনেছিলাম। আরো একটি তথ্য এই লিখতে গিয়ে এখনই জানলাম যে, হিউস্টোন  থেকে ভেইকোয়েস যেতে এখন পুয়ের্তো রিকোতে না থামলেও চলে। সরাসরি আকাশ পথে খানিক হলেও যোগাযোগ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভূখণ্ডের সাথে। তিন বছর আগে সম্ভবত সেটি ছিল না। সময়ের সাথে সাথে সমস্ত জায়গাতেই যোগাযোগ, আধুনিকতা আসে। সে যত দরিদ্র, অবহেলিত অঞ্চলই হোক না কেন। এমনকি ঔপনিবেশিক অঞ্চল হলেও। উপনিবেশ পত্তনকারী দেশের সরকারের দায় থেকেই সে উন্নতি আসে। যাক, গল্পে ফিরই বরং। আপাতত হিউস্টোন থেকে সান ওয়ান এর ফ্লাইট ধরে আমরা এলাম পুয়ের্তো রিকো। চার- পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইট। সুতরাং পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল। সান ওয়ান এয়ারপোর্টে সৌন্দর্য আর কার্যকারিতার মেলবন্ধন।অনেকটা যেন আমাদের কোচি এয়ারপোর্টের মত। অতীতের স্পেনীয় উপনিবেশ, ইতিহাস আর ক্যারাবিয়ান সাগরের দ্বীপভূমির সমস্ত বৈশিষ্ট নিয়ে সুন্দর এয়ারপোর্ট। এখন এখানে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আজই যাব ভাইকোয়েস। প্রথমে যেভাবে ভেবেছিলাম, সেই ফেরি লঞ্চে করে আটলান্টিক বেয়ে ভেইকোয়েস পৌঁছাব সেই উত্তেজক ব্যাপারটিতে কিঞ্চিৎ বাধা পড়েছে। মানে, সান ওয়ানের ফেরিঘাট থেকে ভেইকোইসের দিকে দিনের শেষ লঞ্চটি ছাড়ার সময় আর আমাদের সান ওয়ান পৌঁছানোর সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সময়ের ব্যবধান বড়োই কম। এখন ওমাহা থেকে আসা আমাদের সুটকেসটি সংগ্রহ করে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরিঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে লঞ্চ যে ছেড়ে যাবেই সে ব্যাপারে আমাদের কোনো সন্দেহই ছিল না। সুতরাং আমাদের সে রাত্তির টুকু সান ওয়ানেই থেকে যেতে হত। তাতে ভেইকোয়েসের ভাগে আধবেলা কম পড়ে যায় আর আমাদেরও এক রাতের জন্য আর একখানা আস্তানার খোঁজ করতে হয়। এই দুটি বিষয় এড়িয়ে সেরাত্তিরেই ভেইকোয়েস পৌঁছানোর আরো একটা উপায় আছে।  সেটি হলো, সান ওয়ান এয়ারপোর্ট থেকেই ছোট্ট আট সিটের প্লেনে আধঘন্টার মধ্যে ভেইকোয়েস পৌঁছানো। ভাইকোয়েসে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও US আর্মির ঘাঁটি ছিল সেজন্য একটি ছোট্ট এয়ারপোর্টও আছে। সেখানে তখন কেবল ওই ছোট আট সিটের প্লেনই নামতে পারত। এখন জানিনা।আমরা আটলান্টিকের উপর দিয়ে ছোট লঞ্চে যাবার লোভ ছেড়েছিলাম কিছুটা হতাশ হয়েই। ভাবিনি জীবনে প্রথমবার আটলান্টিকের ওপর দিয়ে আট সিটের প্লেনে আধঘন্টার উড়ানও নতুন কিছু হবে আমাদের জন্য। হয়ত কিছুটা থ্রীলিংও। অন্তত টেক অফ এর সময়টা। সেই ছোট প্লেনের জন্য আমাদের সান ওয়ান এয়ারপোর্টের এক্কেবারে শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা অংশে বেশ খানিক খান অপেক্ষা করতে হলো। আমাদের সাথে যাঁরা অপেক্ষা করছেন ভাইকোয়েস যাবেন বলে তাঁরা সকলেই প্রায় বয়স্ক মানুষ। অবসর জীবনে ক্যারাবিয়ান দ্বীপে যাচ্ছেন ছুটি কাটাতে। যেখানে কিছু করার নেই বিশেষ। সেখানে আমরা দুজন অপরিপক্কতার চুড়ান্ত দুটি নিদর্শন হয়ে বসে আছি। দু একজন দেখছেনও আমাদের।  বয়সোচিত স্বাভাবিক জায়গায় না গিয়ে আমরা এমন একটা মরা জায়গায় যাচ্ছি কেন? মানুষের কক্ষে এপ্রশ্ন আমাদের জন্য অস্বাভাবিক নয়। এতে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের এক চৈনিক বন্ধু তো বলেই ফেলেছিল, "তোমাদের পছন্দ গুলো ঠিক অবসর প্রাপ্ত বয়স্কদের মত।" যাক যে সেকথা, ভেইকোয়েসের ছোট প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এই ফাঁকে বরং পুয়ের্তো রিকো সম্পর্কে কটা গল্প করে নিই। আগেই বলেছি, পুয়ের্তো রিকো ছিল স্পেনীয় উপনিবেশ। সে বড় আজকের কথা নয়, সেই কলম্বাসের সময় থেকেই। নাহোক প্রায় পাঁচশ বছর আগেকার সময় থেকেই। তার পর ফরাসি, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ কত জাতিই না চেষ্টা করেছে ভেইকোয়েস সহ পুয়ের্তো রিকো দ্বীপপুঞ্জকে দখল করার কিন্তু স্পেনীয়দের হাত থেকে তাকে সরাতে পারেনি। সেই নিয়ে কত যুদ্ধ, কতই না রক্তপাত। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই পুঁচকে একফালি দ্বীপের জন্য এত ঝগড়া ঝাঁটি, রক্তপাত কেন? কারণটা হল, এর অবস্থান। তখনকার পালতোলা জাহাজের যাত্রাপথ ঠিক হত সমুদ্রের বাতাসের এবং স্রোতের অনুকূলে। বাষ্প বা পর্বতীকালের ইলেকট্রিকের জলবাহনের যুগ তখনও অধরা। ইউরোপ থেকে পশ্চিমে উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকান ভূখণ্ডে আসতে গেলে আসার পথ ছিল উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের একটু দক্ষিণ দিয়ে। আর ফিরে যাবার পথটি ছিল একটু উত্তর দিক দিয়ে। বারমুডার কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে। কারণ সমুদ্র স্রোত সেকথাই বলে। এখন আসার রাস্তাটি ভাল করে দেখুন দিকি। স্পেন বা পর্তুগাল থেকে উত্তর আটলান্টিকের দক্ষিণ দিক দিয়ে আমেরিকা ভূখণ্ডের দিকে যাত্রা করলে প্রথম বড় দ্বীপটি কি? পুয়ের্তো রিকো। একমাস ধরে আটলান্টিকে কতে চলতে প্রথম যেখানে পায়ের তলায় জমি পেলেন, যেখান থেকে খাবার, জল, রসদ সংগ্রহ করে, পুরো ক্যারিবিয়ান সাগর পেরিয়ে আরো  ধনশালী, সোনার দেশ, পেরু বা মেক্সিকোর দিকে অভিযান করতে গেলে বা পূর্ব দখলীকৃত অঞ্চলে পৌঁছাতে গেলে প্রথম পড়বে পুয়ের্তো রিকো। সুতরাং এই দ্বীপটি দখলে থাকলে এদিক থেকে যেমন সুবিধা তেমনি, ইউরোপ থেকে আগত শত্রূ জাহাজকে ক্যারাবিয়ান সাগরে ঢুকে পেরু বা অন্যান্য জায়গায় পৌঁছে লুট করতে দেবার আগেই আটলান্টিকেই রুখে দেওয়া যাবে। সুতরাং এই পাহারাদার সদৃশ ছোট্ট ভূখণ্ডটির দিকে হাত বাড়িয়েছে সকলেই। কিন্তু অনেক গৃহবিপ্লব এবং যুদ্ধ সত্ত্বেও ১৮৯৮ এর আগে পর্যন্ত এই অঞ্চল থেকে স্পেনীয়দের সরাতে পারেনি কেউই। এমনকি এখানকার আদিবাসী তাইনো সম্প্রদায়ের বিপ্লব সত্ত্বেও। ১৮৯৮ এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং স্পেনের যুদ্ধ শেষে প্যারিস চুক্তি অনুসারে এটি আমেরিকান উপনিবেশে পরিণত হয়. এবং ১৯১৭ থেকে পুয়ের্তোরিকানরা আমেরিকান নাগরিকত্ব পান।

যাকগে, ছোট প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একগাদা কথা বলে ফেললাম। যেটা আজকাল চাইলে দু মিনিটেই জানা যায়।  যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখি প্লেন এলো কিনা। সময় হলে আমাদের পাশ দেখে লাইন করে ওয়েটিং লাউঞ্জ থেকে সোজা নিচে নামিয়ে দেওয়া হলো। এর আগে কোনো এয়ারপোর্টে এরকম পায়ে হেঁটে প্লেনে গিয়ে চাপিনি। নিদেন পক্ষে বাসে করে প্লেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের পথনির্দেশকের ঠিক পিছনে লাইন করে সবাই গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনও প্লেন আসেনি সেখানে। হাওড়া স্টেশনে বাসের জন্য লাইন দেওয়া মনে পড়ে যাচ্ছে। পথপ্রদর্শক আমাদের এবং আমাদের ব্যাগেদের সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিলেন। ব্যাগ তার আগেই আরো একবার করে ওজন করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ, প্লেনটিতে নির্দিষ্ট ওজনের বেশি নেওয়া যাবে না।  সুতরাং পারমুটেশন কম্বিনেশন করে দেখা গেল, আমরা এবং আমাদের ব্যাগ আলাদা প্লেনে যাবে। সবই এরকম ছোট্ট আট সিটের বাহন। তো সে বাহন এলো। ঠিক যেন অটোয় উঠছি বলে মনে হল।  পাইলটের ঠিক পিছনেই দরজা। এদিক ওদিক করে আরো সাতটা সিট্। উঠে বসলাম। নির্দেশিকা শোনানো হলো। বিশেষ কিছু শুনেছিলাম বলে মনে হয় না। প্লেন ছোট হবে জানতাম এরকম ছোট হবে আশা করিনি। আমার হতভম্ভ ভাব কাটছেই না। মনে হচ্ছে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে লঞ্চে যাবার হতাশা কাটতে চলেছে। পিঠের ব্যাগটা বাসের মত পায়ের তলায় নিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম। প্লেনের দরজা বাইরে থেকে পথপ্রদর্শক ভদ্রলোক বন্ধ করে দিলেন। একদম ম্যানুয়াল ব্যাপার স্যাপার। সম্ভবত উস আর্মির পুরোনো প্লেন এগুলো। জানিনা। একান্তই আমার মনে হওয়া। প্লেন গড়াতে শুরু করল।  গড়াতে গড়াতে সান ওয়ানের এয়ারপোর্ট এলাকা প্রায় পেরিয়ে এলো। কিন্তু স্পিড আর নেয় না। কি রে বাবা? ওই তো দেখা যাচ্ছে গাছের সারি, তার ওপাশেই সমুদ্র। উড়বে কখন? এতো রানওয়ে শেষ হয়ে এলো। পাইলটের ঠিক পিছনেই একজন তার পিছনেই আমি। হটাৎ দেখলাম, ডানহাতে পাইলট তার বাহনের কন্ট্রোলারের ওপর। আর বাঁহাত দিয়ে প্রাণপণে পাশের জানলার হ্যান্ডেল ধরে হ্যাঁচকা টান মারছেন। জানলা বন্ধ হচ্ছেনা। আর প্লেন গড়িয়েই যাচ্ছে থামছেনা। এদিকে সামনে গাছের সারি এগিয়ে আসছে। আমি ততক্ষনে নিশ্চিত যে এই প্লেন আর উড়বে না। আর এই মাঝসাগরের পুঁচকে দ্বীপেই আমার সমাধি হলো বুঝি। হঠাৎ মনে হলো আমিও প্রানপণে দুই পা দিয়ে পায়ের  নিচে রাখা ব্যাগটাকে চেপে ধরে আছি।  মরার আগে কুটোর মতন। শেষমেশ গাছের সারির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার ঠিক আগেই কেমন করে যেন জানলাও বন্ধ হয়ে গেল আর প্লেনও একটা ঘাসফড়িং এর মতন পুট করে হাওয়ায় ভেসে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পরে যখন বুঝতে পারলাম  মরিনি, এখনো বেঁচেই আছি ততক্ষনে গাছের সারি পেরিয়ে পায়ের তলায় আটলান্টিক।

তার আগে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে এসেছি একবারই। প্রথমবার যে ঢাউস এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি আমাদের দিল্লি থেকে প্রথম বারের জন্য শিকাগো পৌঁছে দিয়েছিল, সেই উড়ানের শেষ অংশটির কিছুটা। কিন্তু সেই যাত্রার পুরোটাই ছিল রাতের অন্ধকারে। শিকাগো এয়ারপোর্টে নামার আগে আকাশে লালচে আভা জেগেছিল মাত্র। সুতরাং আটলান্টিকের সাথে পরিকায় সে অর্থে এই প্রথম।ভয় কেটে যাবার পর জানলা থেকে নিচে আর সামনে দেখতে শুরু করলাম। পিছনে সান ওয়ান ডাকগা যাচ্ছে। দেখে মনে হলো এখানে না থেকে ভাইকোয়েসে থাকার সিদ্ধান্ত তা ঠিকই হয়েছে। সান ওয়ানের রাজধানীচিত কিছুটা হলেও আধুনিকতা আছে। যা হয়ত ভেইকোয়েসের নেই। মেঘ পেরিয়ে, সূর্যাস্ত পেরিয়ে, আর এক সাগর নীল পেরিয়ে আমাদের সেই ঘাসফড়িং ভেইকোয়েস পৌঁছে দিল যখন তখন সন্ধ্যা নেমেছে। পাইলট নিজেই নেমে দরজা খুলে দিলেন। লাফ মেরেই নেমে পড়লাম এবং তখন জানলাম যে এই জানলা বন্ধের গল্পটা রোজকারেরই। তাই উনি এত নির্বিকল্প চিত্তে বাঁহাতে জানলা ধরে টানতে পারছিলেন। বুঝলাম, আমাদের অভিজ্ঞতার এই শুরু। ভেইকোয়েস আমাদের আরো অনেক কিছুই দেবে। যা আদ্যন্ত নিজের প্রতি অনাস্থা রাখা একজন মানুষের পক্ষে এই চার্ পাঁচদিনে হজম করা একটু গুরুপাক। যাক পরের কথা পরে বলা যাবে। আপাতত ব্যাগ সংগ্রহ করে হোটেলে পৌঁছাতে হবে। ভেইকোয়েস এয়ারপোর্টটা হলো আদতে একটা দোতলা বাড়ি। ব্যাস আর কিচ্ছুটি নয়। ঢুকেই শেষ।  ঢুকেই দেখতে পেলাম ব্যাগ। নিয়ে বাইরে এসে দেখি বাইরে একটি মাত্র একটু হাইপাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে।  সেটিই এয়ারপোর্টের বাইরের একমেঅদ্বিতীয়ম আলো। তাতে বাইরের মিশকালো অন্ধকারের শোভা আরো বেড়েছে বই না। আর সেই আধো অন্ধকারে সাদা শার্ট পরে একটি গাড়িরই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। আমাদেরই অপেক্ষায়। জানতাম এখানে বাইরে কিছুটা পাওয়া যাবে না হোটেলে পৌঁছাবার জন্য। তাই আগে থেকেই এই ব্যবস্থা। নাম ধাম মিলিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। উঠেও বসলাম। এয়ারপোর্ট বাড়িটার ঠিক সামনে দিয়েই ডাইনে বামে আড়াআড়ি শুয়ে আছে একটা সরু রাস্তা। যার ডানদিকে গেলে ভেইকোয়েসের মেন্ টুরিস্ট এলাকা। যার নাম 'এস্পেরাঞ্জা', বাংলায় তর্জমা করলে হয়, 'আশা'। সেদিকেই সব দেখবার বা ঘুরে বেড়াবার মত বিচ। আর বাঁয়ে গেলে এখানকার স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়ি। আর সেদিকেই আমাদের গাড়ি চলতে  শুরু করল। আমাদের বাঁয়ে অন্ধকারের মধ্যে সাগরের থেকে একটা সাঁইসাঁই হওয়া আর শব্দ ভেসে আসছে। আর ডাইনে ঘন গাছপালা ঘেরা অন্ধকার জঙ্গলের মাঝে মাঝে একটা একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।  বাড়ির সামেন একটা করে মিটমিটে বাল্ব জ্বলছে। তাতেই সামনের রাস্তাটুকু একটু করে আলোকিত হচ্ছে। ঠিক যেন শীতকালে আমাদের বাড়ির রাস্তার মত। সেই একইরকম অন্ধকার। ও নাকি US territory. অর্থনৈতিক অগ্রগতি নাকি আধুনিকতা নাকি আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশকে তার আপন জায়গায় থাকতে দেওয়া কোনটা যে দরকারি কে জানে। যাই হোক, চলছিলাম। অবিশ্বাস আমাদের মজ্জায় মজ্জায় গাঁথা হয়ে গেছে। আর অবিশ্বাস থেকেই ভয়। বার বার মনে হচ্ছে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব কি সত্যিই এত দূর? নাকি......? ইন্টারনেট কাজ করছে না ঠিক করে ফোনে ঠিক করে দেখতেও পাচ্ছি না।  কিন্তু প্রতি বারের মত আমায় ভুল প্রমাণিত করে আমাদের উনি পৌঁছে দিলেন হোটেলের সামনে। হোটেলের নাম ভুলে গেছি। পরে মনে পড়লে বলবখন। নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে ভেইকোয়েস আমাদের দিনের দ্বিতীয় চমকটা দিল। এখানে সমস্ত কিছুই ক্যাশে পেমেন্ট করতে হয়।  একদম আমাদের বাড়ির মত। এদিকে আমরা গত একবছরে মানিব্যাগ সাথে রাখা ভুলেছি। সবকিছুই কার্ড সোয়াইপ করে চলছে। আমরাও এখানে আসার আগে ভাবিনি আর কেউ বলেও নি যে, US এর সমস্ত জায়গা মানেই US এর শহর নয়।  সেখানেও অজ গ্রাম আছে। দুজনের ব্যাগ, সুটকেশ সমস্ত কিছু হাঁটকে কিছু ক্যাশ বেরোলো। কখনো কোনো কারণে তুলেছিলাম। সেসব যোগ করেও প্রায় তিন চার ডলার কম হল ওঁনার গাড়ির ভাড়ার থেকে। কিন্তু আমাদের আর কিচ্ছু করার নেই তখন। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আপনার গাড়ির অফিসে গিয়ে কাল আমরা বাকি টাকাটা দিয়ে আসবো। আর আরো একবার আমায় লজ্জিত করে উনি বাকি টাকাটা না নেবার কথা বলেই চোলে গেলেন। আর দেবার দরকার নেই বলে। উনি বুঝতে পেরেছেন যে আমরা সত্যিই আতান্তরে পড়েছি। গাড়ি ঘুরিয়ে চোলে গেলেন আর পিঠে ব্যাগ আর হাতে সুটকেস নিয়ে আমি ভাবলাম এঁনাকেই নাকি কয়েক মিনিট আগে আমি ভয় পাচ্ছিলাম।

প্রথমেই বলেছি যে বিশ্রী একটা মানসিক অসুস্থ (অসুস্থই বলব) অবস্থায় আমি তখন। নিজের ওপর তো নয়ই, কারো ওপরেই বিশেষ ভরসা হয়না। এরকম অবস্থায়, অনভিজ্ঞ দুজনে রাতের অন্ধকারে, আটলান্টিক আর ক্যারাবিয়ান সাগরের মাঝের একটা নির্জন দ্বীপে সম্পূর্ণ ক্যাশলেস অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। বেরোবার চক্করে বেশি কিছু করে ফেলিনি তো? আবার একটা অনিশ্চয়তা ফিরে আসছে মনে। ব্যাগ টেনে হোটেলের দরজার দিকে চলতে শুরু করলাম দুজনে। কাল যা হোক করে কোনো ব্যাংকের ATM থেকে ক্যাশ তুলতে হবে।  নইলে তো খাবার জলটুকুও কিনতে পারব না।

(চলবে)

আমরা সেই কজনা

বুঝলি দেবী,  
একটা মানুষের মধ্যে বোধহয় অনেকগুলো মানুষ থাকে। একটা মানুষ ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে 'আহ' বলে পিঠটা বেঁকিয়ে দেয় পিছন দিকে। সেই একই মানুষের মধ্যে আর একটা মানুষ বলে-'এসব তো হলো ,আসল কাজটা কখন হবে? শুরু করো এবার।' ক্লান্ত শরীরে চনমনে একটা মন নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই হয় তখন। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ন্ত হয়ে পড়ে যেন। খিদেয় মায়ের কথা মনে পড়ে। আর তারই মধ্যে অন্য মানুষটা বসে বসে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, কত কি করার বাকি ভেবে। দুজনকে সামলে সুমলে মাঝামাঝি একটা জায়গায় এনে বেঁধে রাখাই দায়। এরই মাঝে মাঝে তোর কথা ভাবি। একগাদা কাজ করতে পারিস তুই। আমার মতন নয়। কেমন সুন্দর ছবি আঁকিস, কেন সুন্দর রাঁধিস। সবচাইতে বড় ব্যাপার, নিজেকে ভালবাসতে পারিস, যত্ন করে, পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে পারিস নিজেকে। তোকে আমি বিশেষ চিনতাম না ইস্কুলে পড়বার সময়ে। একখানা বেজায় রোগা মেয়ে, চোখে গোলগোল চশমা আর দুটি শিকলি বিনুনি। এর বাইরে তোকে বেশি চেনার কোনো কারণই ঘটেনি কখনো। এখন মনে হয়, তোকে এত খানি চিনলাম কবে? তুই হয়ত বলবি, বাবার অসুখের সময়। আমারও অনেকসময় তাইই মনে হয়েছে। সেদিন ওই বিপদের দিনে মা পাগলের মতন তোকে ফোন করেছিল বলে আর তুই পাগলের মতন আমি পৌঁছানো অবধি মাকে, আর আমি পৌঁছানোর পর আমাকে আগলে রেখেছিলি বলে কি? কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে পরে মনে হয়েছে ব্যাপারটা অত ব্যবসায়িক নয়। তবে কি বল দিকি? সেই একদিন মনে পড়ে, আমি তখন হরিয়ানায়, তুই ল্যাব আওয়ার্সের মধ্যেই একদিন ফোন করেছিলি। স্কুলের বন্ধুদের একটা হোয়াটস্যাপ গ্রূপ তৈরী করে আমায় তার মধ্যে টেনে নিলি। সেই সেদিন থেকেই বোধহয় তোর প্রতি আমার একটা কৃতঃজ্ঞতা জন্ম নিলো জানিস। আসলে কিছু লোকের কোনো গ্রূপ হয় না। হয়ত তারা আদতে কোনো গ্রূপে থাকতে চায়না বলেই। ওই মোম লাগানো পদ্ম পাতায় জল না লাগার মতোই। আর মানুষ কি অত বোকা? আমি না হাসলে তারা আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে কেন? আর এখানেই তোর প্রতি আমার উৎসাহের শুরু জানিস। আমি কারো খবর নিইনা। তাই আমার চিঠির বাক্সও খালিই থাকে। রোজ সকালে ভাবি, এমনও তো হতে পারে, আজ দেখবো নতুন একটা লাল চিহ্ন ফোনের কোথাও। তাও যাঁরা আমায় ভালোবেসে খবর পাঠান, তাদের মধ্যে তুই আছিস। আমি দিনের পর দিন নির্লজ্জের মতন ফোন সাইলেন্ট থেকে অন করতে ভুলে যাই। তাও তুই আমার মাথায় হাত বোলাতে ভুলিস না।  "এখন ঘুমোচ্ছি রাখ"- বলে চরম অসভ্যতা করি তোর সাথে। তাও তুই আমায় জড়িয়ে রাখিস। আমিও একমাত্র তোর সাথেই এই লাক্সারিটা করতে পারি। কেমন একটা ভরসা আছে তুই আমায় তাড়িয়ে দিবি না। ওই যে বলছিলাম না, দুটো বা তার বেশী মানুষ থাকে একটা মানুষের মধ্যে। আমার মনে হয়, তুই আমার মধ্যে ওই দ্বিতীয় মানুষটাকে উস্কে দিস। ওই যে একখানা গোটা ছেলেবেলা তোর জন্য  ফিরে পেলাম, হোক না ফোনের স্ক্রিনে, তবু ওই আমার দ্বিতীয় বিশ্ব। তোরা যদিও আমায় মনে মনে গালাগালি দিবি আমি জানি, যে কেন আমি আরো কথা বলি না সবার সাথে। কিন্তু এখানেও বলতে পারিস আমার ওই প্রথম জন খোলস থেকে বেরোতে চায় না বলেই। ওই যে একখানা চাদর মুড়ি দিয়ে কোণায় বসে মিটমিটিয়ে তোদের সবাইকার হৈ হৈ দেখা, এটার মধ্যে একটা তৃপ্তি আছে। এটা যারা করে, তারা জানে জানিস। আমার প্রথম জনটা বেজায় মজা পায় তোদের দেখতে, কথা শুনতে, ইয়ার্কি দেখতে। কিন্তু কোণ ছেড়ে উঠে যেতেই চায় না। তৃপ্তিটা যে ওই দেখাতেই বেশি। সরাসরি সামিল হবার চেয়েও।

যাই হোক, এই যে মনকেমনে ফিরে যাবার মতন কটা মিষ্টি ঠাকুমা মার্কা (কেউ কেউ আবার বেজায় রাগী। বাচালতা মোটেই সহ্য করেন না। দিদিমনি তো, তাই) মহিলাকে তোর দাক্ষিণ্যে দুহাতে ধরতে পেরেছি আবার, সেই আমার ধন। সেদিন সেজন্যই তোর মতন এক আধা অচেনা ক্ষীণকায়া মহিলাকে নতুন করে চিনতে ইচ্ছে হয়েছিল জানিস। স্রোতের মাঝে নিজের গতি বজায় রেখে চলা সহজ নয় রে মেয়ে। এ আমি নিশ্চিত করে বুঝেছি। স্রোত তোকে ঠেলতে চাইবেই। তুই চেষ্টাটা থামাসনা, থামাসনি এখনো অবধি সেইটিই তোর প্রতি আমার মুগ্ধতা।

জানিস, এমনই একদল পাগলকে জুটিয়েছিস, কবে কোন ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম যে ছোটবেলায় ওই যমজ দুটো আমায় চিঠি লিখতো গ্রীষ্মের ছুটিতে। সেই দেখে সেই যমজের একটা আমায় একখানা চিঠি হাতে লিখে আমায় ছবি তুলে পাঠিয়েছে। কি পাগল বল দিকিনি? বলেছে আবার আমি গেলে হাতে হাতে দেবে। আমি কি করি এদের নিয়ে? ওই যে সেদিন শহরের চৌরাস্তায় আর একটা কবিতার পাগল কিছু খাওয়াতে পারেনি বলে কেঁদেই ফেলছিল প্রায়, তারপরে শেষে ঝাল লজেন্সের প্যাকেট কিনে দিয়ে শান্ত হয়।  সেই প্যাকেট আমার ব্যাগে চড়ে এখান অবধি এসে পৌঁছেছিল। এসব কথা আমি সেই পাগলটাকে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় বলতে পারিনি। এসব আবেগের কথা বলতে ভারী লজ্জা হয় জানিস। ওকে বলে দিস, ও যখন সুন্দর করে সেজে স্টেজে ওঠে আবৃতি বা সঞ্চালনা করতে, ইচ্ছে করে বলি, "ভারী মিষ্টি লাগছে।" কিন্তু সে বললে কি আর আসলে যা বলতে চাই সেসব বলা যায়? আজ আবার দেখলুম আমাদের সেই মিষ্টি ফ্রক পড়া দুই বিনুনি মেয়েটি লিখেছে, তার মিষ্টি মেয়েটি নাকি বড় হয়ে গেছে। এক বছর! ধুস ওই তো এখনো বড় হয়নি ওর মেয়ে কিকরে বড় হবে? ভাবলুম লিখি। কিন্তু ওই, যা বলতে চাই সেসব কি লেখা যায় নাকি? আর ওই রাগী দিদিমনিটাকে বলিস ইস্কুলে গিয়ে বেশি বকাবকি না করতে। একদিন দেখি কি, একখানা জম্পেশ শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে পোজ দিচ্ছে। ভাবলুম তার ইস্কুল থেকে ক্লাস সিক্সের ছানাগুলোকে এনে দেখাই দিদিমনি কি করছে। তারপর ভাবলুম থাক, বেতের বাড়ি একটাও বাইরে পড়বে না। এসব কথা আবার দিদিমনিটাকে বলিসনা যেন। এমনিতেই আমায় বালিকার পর্যায়ে ফেলে। আবার কান ধরে সন্ধি-সমাস এর সূত্র ধরলেই হলো। আর বাদবাকি পাগল একটা আছে যেটা আমায় চাট্টি কেক খেতে দেবে বলেছে গেলে। আর একটা বেজায় সিরিয়াস মহিলা আছে যেটার ছবি আবার আমার ফোন বারবার ভুল করে আমি বলে চালাতে চায়। যত বলি, সে ব্যাটা আমার মতন ধুমসো নয়, তাও নাকি মুখ দেখে আমার মতোই মনে হয়।  যাক গে, থাকলেই হলো, যা বলে বলুক গিয়ে যাক। আর একটার মাথা তো আমি তবলার মত করে চাঁটি মেরে বাজাবো বলে দিস। আর একটাও যদি গুডমর্নিং আর ফরওয়ার্ডেড মেজেস পাই চণ্ডীমণ্ডপের জটলায়। মুখ খুলতে পারে না হতভাগী? তারও কি আমার মতন চাদরমুড়ি রোগ হয়েছে? আমি রেগে গেছি বলে দিস।
 
এই দেখ, তোর সাথে কথা কইতে কইতে কেমন মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। বাড়ি যাই বরং। বাড়িতে রাখা বাচ্চাগুলোকে ফোন করতে হবে। রাতের পেট পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে, এককাঁড়ি বাসন নিয়ে বাসন-মাজুনি হতে হবে। ওভেন পরিষ্কার করতে হবে। তবে গিয়ে তোদের গালাগালি শোনার সময় পাব। ভেবে এবার মন বেশ তেজ পাচ্ছি বুঝলি। এই কথাটাই এত কথা দিয়ে বলতে চাইছিলুম। যে দিনের শেষে ক্লান্তিতে তোরা থাকিস। তোরাই থাকিস। 

পুনশ্চ: ও হ্যাঁ ওই যমজের একটা আমায় একটা চিঠি দিয়েছে বলছিলাম না।  ঐটা পাঠালাম সাথে। পড়ে দেখ দিকি। বাকি গুলোকেও দেখাস। এক কাজ করনা, সবাই মিলে দল বেঁধে আমাদের বাড়ি চলে যা জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। আমিও মনে মনে তোদের সাথে পৌঁছে যাব। যাবি? যা না রে। বড় শান্তি-বড় আনন্দ তোরা গেলে।  

A frustration

A gorgeous painting, with all shades of red and yellow, that was a sunset observed during the way to home at the west after a long irritating day. The day was in a weekend. Still it was a long day of work. Work is not at all irritating to persons like me. It should not be. But sometime the way of communicating with the world through the work we does, is irritating. The way of presentation is not the representor's way, rather a putative way how the observer wants to look at it. Many times these two ways are not same. That time the creator of the work, needs to be molded in a popular, acceptable way. This is painful sometimes. Many creator don't want to be molded in a specific pre-existing way every time. I don't know which way to follow! Giving my best of the bests to create a piece of work to serve human health with a proper intention or make a popular, pre-denoted way to present the work to the world with a fake intention to serve human wellbeing! I know there will be lots of thoughts against this true intention to serve of human wellbeing. Whenever a person thinks wildly but very much with true and well intention, there are lots of well wishers to tell him to her that the thought needs to be redefined. Redefined means make it mundane, make it not so adventurous, take the path that already took by somebody else for some other reason, don't make a new path. This is not a true way of invent something new. This boring way of rediscovery we have to take again and again unless we become so old that we loose our physical and mental energy to fight against the systemic mundane process. There will be no sponsoring authority to sponsor our thinking process. We know this very very well. We wait for the smallest opportunity for 15-20 years. We being matured with this journey and then we do the same thing with our next generation workers. We make some technicians who will rediscover things by playing in a safe, known playground. We cannot create a creator, who will think to make a difference at least. Then at the end of the week, we become exhausted from whole day of  work. We will observe a gorgeous sunset from the running car but do not pay much attention because we need to do the groceries for the next week, which is starting in the next morning. This is the way we think we are creating a valuable knowledge bank for future humankind. We are great!