Tuesday, 4 June 2024

মনস্বিতা

সাতসকালে তখন আলোই ফোটেনি ভালো করে। ঘরের চাল থেকে শিশির চুঁইয়ে পড়ে পড়ে কেমন একটা বৃষ্টি ভেজা হয়ে রয়েছে ঘরের চারপাশের মাটি। কুয়াশা কুয়াশা সাদাটে আঁধার চারদিকে। আঁধার থেকে আলো ফোটার সেই সন্ধিক্ষণটা কোনোদিনই আর চোখে ধরে উঠতে পারেনি মেয়েটা। ঘুম ভেঙে চোখ কচলাতে কচলাতে কতদিন পুব আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে সময় গুনেছে সে। তারপর যেই না অধীর হয়ে একটু এদিক ওদিকে মন দিয়েছে অমনি সেই ফাঁকে আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। এর চাইতে বরং সূর্যাস্ত ভাল। আকাশে দোলখেলা চলে কতক্ষন ধরে! চেয়ে দেখলেও চলে, না দেখলেও। আসলে বোধহয় 'আঁধার আসছে' এই কথাটি মনে করিয়ে দিতেই আকাশের এত আয়োজন সাঁঝবেলায়। আর ভোরের সময় দেখো, চুপি চুপি ফাঁকি দিয়ে টুক করে কেমন একফাঁকে সুয্যিদেবের চলা শুরু। কিছুতেই তাঁর প্রথম পা ফেলাটাকে জাপটে জড়িয়ে নিতে পারেনা মেয়েটা। ঠাকুরদাদা শুনে একদিন হেসেই খুন। বলে, নাই বা দেখলি। এই যে আঁধার কেটে আকাশ ধূসর নীল থেকে পরিষ্কার হলো, এই যে আমার বুক থেকে ঘুম ভেঙে উঠে শুক সারি ঠোঁট দিয়ে পালক মেজে সারাদিনের প্রয়োজনের জন্য তৈরী হচ্ছে, এই যে তুই ঘুম ভেঙে উঠে খালি পায়ে শিশিরমাখা ঘাস মাড়িয়ে আমার সঙ্গে গপ্প করতে এলি রোদ্দুর ওঠার আগেই, এই যে রাত ফুরোলেই তোর কচি শিউলি গাছটা হাত পা নাড়িয়ে তোর জন্য দু-আঁচলা শিউলি ঝরিয়ে রাখে প্রতিদিন, সেবুঝি দিনের শুরু নয়? সুয্যিদেবের পথচলাটুকুনিই দেখলি নাতিন, এদের দেখলিনে? শেষরাতের শিশিরে স্নান সেরে ঠাকুরদাদা তৈরী সুয্যিদেবের অভ্যর্থনায়। তাকেও তাড়া লাগায়। নে নে এবার আলসেমি ছেড়ে ওঠ দিকিনি। স্নানে যা। পুবদিকে গোলাপি আবীর ছড়িয়ে লাল পাটের কাপড়টি উড়িয়ে দিয়ে সুয্যিদেব ততক্ষণে পুজোয় বসেছেন। হাতে পায়ের জট ছাড়িয়ে জোর করেই উঠতে হয় এবার মেয়েটাকে। আড়মোড়া ভেঙে ঠাকুরদাদা আর বাকিদেরকে "আসি গো" বলে পিছন ফিরতেই বাস্তব একরাশ তাড়াহুড়ো নিয়ে আক্রমণ করে মেয়েটাকে। 

প্রতিদিনের ঘুম ভাঙার পরের কিছুক্ষণ, যখন দিনের আগামী কয়েক ঘন্টার জীবনের দাবীদাওয়াকে থামিয়ে রাখে মেয়েটা সেই কিছুক্ষণ মেয়েটার কারো কাছে কোনো সম্পর্কের দায় থাকে না। নিজস্ব কোনো পরিচয়ের, এমনকি নামের পর্যন্ত প্রয়োজন পড়ে না। তখন সে পুবের জানালা ভেদ করে ঠাকুরদাদা গাছের কাছে অনায়াসে চলে যেতে পারে। মনে মনেই। শিশির মাখা ঘাসে হাঁটতে হাঁটতে ঠাকুরদাদার গায়ে হাত বুলিয়ে সমস্ত জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। প্রতিদিন। তারপর আজকের মতোই শ্বাস ছেড়ে পিছন ফিরে সারাদিনের জন্য মেয়েটাকে ঢুকে পড়তে হয় প্রয়োজনীয়তার জীবনচক্রে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে নির্দিষ্ট দায়িত্ব, নির্দিষ্ট সম্পর্কের হিসেবনিকেশ। সেখানে রয়েছে তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের এবং পৃথকীকরণের প্রধান উপকরণ, একটি নাম। প্রতিদিনের মত আজও সেই নামের দায়বহনের জন্য মেয়েটা পুবের জানালা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় 'অহনা' নামের ভার নিয়ে।

সারাদিনের খাবার আর পিঠের পেটমোটা ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে দুরদাড়িয়ে হাঁটছিলো অহনা। সাড়ে আটটার আগে আজ ঢুকতেই হবে। সব গুছিয়ে এনিম্যাল হাউস থেকে খাঁচাগুলোকে এনে শুরু করতে করতে নয়টা তো বাজবেই। এর বেশি দেরি হলে পুরো কাজটাই পিছিয়ে যাবে। হাসপাতালের সামনে এসে হাতের মাস্কটা পরতে পরতে দেখলো একটা মাঝারি গোছের এম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে মেন গেটে। অর্ধশায়িত অবস্থায় আচ্ছন্ন এক বয়স্ক মানুষ। ধরাধরি করে নামাচ্ছে গেটের আর এম্বুলেন্সের ডিউটিরত ছেলেদুটি। আড়চোখে দেখতে দেখতে অহনা দ্রুতপায়ে এগোচ্ছিল পিছনের গেটের দিকে। ওদিক দিয়েই আজকাল রিসার্চ উইংসের সকলের যাতায়াতের ব্যবস্থা। এলিভেটর যথারীতি বেশ কিছুটা দেরি করিয়ে দিলো ওর। হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছালো যখন ল্যাবের ঘড়িতে তখন আটটা পঁয়ত্রিশ। ইশ! সকাল সকাল হুড়োহুড়ি করতে এক্কেবারে ভালো লাগে না। কি যে ঘুম থেকে উঠেই জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাস তার! আরও মিনিট পনের আগে পৌঁছানো উচিৎ ছিল। শুধু শুধু দেরি হয়ে গেল। তাকে দেখেই নড়েচড়ে বসেছিল আইলিন। তার  জন্যই অপেক্ষা করছিলো। দুজন না হলে অসুবিধা এই কাজে।
"হাই আইলিন, গুড মর্নিং। সরি, লিটিল লেট্।"  পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলে অহনা।
" গুড মর্নিং। ইটস ওকে ডিয়ার। উই উইল বি ওকে। " -মুখে হাসি নিয়ে বলে ওঠে আইলিন।
"আমি তাহলে নিচে থেকে খাঁচাটা নিয়ে আসি। কোন রো-এর কত নম্বর খাঁচা নেব বলোতো?"- আইলিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অহনা।
"দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমায় এখন বোঝাতে গেলে অনেক সময় লাগবে। আমি জানি কোন খাঁচাটা। তুমি বরং এদিকটা দেখো, আমি নিয়ে আসছি খাঁচা।"- আইলিন ডেস্ক থেকে ফোনটা নিয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে।
অহনার সুবিধাই হলো। আবার এখনই হাঁপাতে হাঁপাতে এনিম্যাল হাউসে ছুটতে হলোনা। সত্যিই আইলিন ইঁদুরগুলোর সার্বিক দায়িত্বে। ওর পক্ষে সহজ হবে ব্যাপারটা অনেক। মেয়েটা অনেক কাজ করে। অহনার "থ্যাংক ইউ আইলিন"  এর উত্তরে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল আইলিন। অহনা ঝটপট হাতে গ্লাভস চড়িয়ে প্রয়োজনীয় টিউব, রিয়েজেন্ট, প্লেট, কাঁচি, ফরসেপ গুছিয়ে নিয়ে শেষ করলো যখন, তখনও আইলিন ফেরেনি এনিম্যাল হাউস থেকে। ঝুপ করে এনিম্যাল ওয়ার্ক টেবিলের সামনে বসে পড়লো অহনা। যতক্ষণ আইলিন না ফেরে একটু শ্বাস নিয়ে নেবে। সারাদিনের কাজ রয়েছে আজকে। সাতসকালে তাকে চেয়ারে বসে দুলতে দেখে পাশের ল্যাব থেকে রিয়াজ বলে ওঠে "কি সকাল সকাল বসে দোলা খাচ্ছেন যে? কাজ নাই?" আশে পাশে অন্য ভাষার কেউ না থাকলে রিয়াজ অহনার সাথে বাংলাতেই কথা বলে। "এই শুরু করবো।"- হেসে বলে অহনা। কয়েকদিন রিয়াজের সাথে তেমন কথা হয়নি কাজের চাপে। "তারপর করোনার কি অবস্থা বাংলাদেশে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?" -একেবারেই এই কয়েকমিনিট সময় কাটাতে জিজ্ঞাসা করে অহনা। মুহূর্তে চোখের হাসিটা চলে গিয়ে মুখটা ছোট হয়ে যায় ছেলেটার।
"কোথায় আর ঠিক! বাড়িতে তো মুড়ি-মুড়কির মত মারা যাচ্ছে মানুষ।"
একেবারেই অকারণে সময় কাটাতে রিয়াজের সাথে কথা শুরু করেছিল অহনা। দিনের শুরুতেই এমন একটা উত্তরের জন্য তৈরি ছিল না সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কথাটা শুনে। তার ভেতর থেকে "কি বলছিস?" কথাটা বেরিয়ে আসে অজান্তেই। ততক্ষনে মাসি, মাসির ছেলে, কাকিমা আরো কার কার যেন করোনায় মৃত্যুর কথা পরপর বলে চলেছে ছেলেটা। গত দুই মাসে এতগুলি মানুষের অকাল মৃত্যুর সংবাদ বহন করেছে ছেলেটা বিদেশে বসে! হাসিখুশি ছেলেটিকে কোনোদিন দেখে বোঝেনি তো সে? অবশ্য তেমন করে কথা বলা হয়না। দুপক্ষেরই কাজের চাপে। "বাড়িতে ফোন দিতে ভয় পাই জানেন দিদি। মা-বাবা-র মানসিক অবস্থা যা!" - মাথা নিচু করে রিয়াজ।
এ কথা অহনাকে আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। গত এক বছরে তার বাড়িতেও ছয় জন মানুষ চলে গেছেন। সে কেবল কানে ফোন চেপে শূন্য দৃষ্টিতে শুনে গেছে। শেষের দুইজন অকালে তো বটেই, অকস্মাৎ দুর্ঘটনায়। খবরটা প্রথম আসে তারই কাছে। জীবনে প্রথমবার বাড়িতে এই সংবাদ তাকেই পৌঁছাতে হয়েছিল জনে জনে ফোনের এপারে বসে। কি করে সে পেরেছিলো আজও জানে না সে। মানুষের বোধহয় নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আন্দাজ থাকে না ঠিকঠাক। সেও জানতো না, যে সে এত বড় হয়ে গেছে এই কয়বছরে। সারা ছোটবেলাটা যাঁদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল, একবছরের মধ্যে পর পর এইভাবে তাঁদের ছয়জনের চলে যাওয়াকে সেও তো হজম করে ফেলছে আস্তে আস্তে! রিয়াজের মনের তোলপাড়টাকে চিনতে এতটুকু কষ্ট করতে হয়না তাকে। সে জানে রিয়াজ এই মুহূর্তে কতটা অসহায়। কিছুই বলতে পারে না সে রিয়াজকে। একটু এগিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অহনা। ভেতরে ভেতরে তার ক্ষতটাও জেগে উঠছিলো, যেটা রিয়াজের সামনে প্রকাশ করতে চাইছিলো না অহনা। মাস্কের আড়ালে ঢোক গিলে গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া নিকট অতীতের কষ্টগুলোকে গিলে ফেলছিলো সে। হয়তো রিয়াজও একই ভাবে তাই করছিলো। এছাড়া কিই বা করতে পারে তারা। ভাঙতে ভাঙতে উঠে দাঁড়ানো ছাড়া!

অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা ভেঙে সেসময় ল্যাবের দরজাটা দুম করে বন্ধ হয়। অহনা আর রিয়াজ দুজনকেই ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সেই মুহূর্তে আইলিন ফিরে এসেছে। হাতে একটা ইঁদুরের খাঁচা।
"হিয়ার ইট ইস।" - আইলিনের হালকা গলাটা ল্যাবে ফিরিয়ে আনে অহনাকে। হাতের পেন্সিলটা টেবিলের ওপর ঠুকতে ঠুকতে রিয়াজও স্মিত হাসার চেষ্টা করে। মুখের পেশীর বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায় না যদিও। নিজের চেয়ারের দিকে ফিরে যায় রিয়াজ।
"আর ইউ রেডি হিয়ার? শ্যাল উই স্টার্ট দেন?" আইলিনের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ে অহনা। গ্লাভসের বাক্সটা যেন কোথায়? এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে অহনা বোঝে সে আসলে দেখছে না কিছুই। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে টেবিলের দিকে ফিরে আসে। গ্লাভস পড়া হাতে খাঁচাটা খুলে ধরে অহনা। ভেতরে দুটো কালো ইঁদুর এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ওরা জানে বোধহয় কি হতে চলেছে।অভ্যস্ত হাতে একজনের লেজ ধরে তুলে আনে অহনা।

"উইল ইউ পাশ মি দ্য কন্ট্রোল টিউবস প্লিজ?" বোঁ বোঁ করে হেপা ফিল্টারের ফ্যানের আওয়াজে আইলিনের বলা কথাটা হারিয়ে যাচ্ছিলো প্রায়? কোণাকুণি রাখা অন্য হুডটায় একরাশ টিউব সাজিয়ে বসেছিল আইলিন। হাত বাড়িয়ে টিউবের সারিটা আইলিনকে দিয়ে দেয় অহনা। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কাজ করছে দুজনে তারা পাশাপাশি বসে যন্ত্রের মতো। একই প্রজেক্টের দুটো ডিরেক্শনের দুরকম এক্সপেরিমেন্টের দায়িত্বে ওরা দুজনে। এই প্রজেক্টটা আপাতত মাথা খাটানোর দরকার নেই বিশেষ। পর পর করে গেলেই হলো। মাথাটা তাই অন্যদিকে খাটানোর সুযোগ পাচ্ছে অহনা। এরকম লাক্সারি বিশেষ আসেনা অহনার। ফলে বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। কাজের শুরুটা ছাড়া। কাজের শুরুর ওই কোষগুলিকে জোগাড় করতে অহনাকে নিতে হয় একটি বা দুটি ইঁদুরের পায়ের হাড়। সেখান থেকে বাকি সব কিছু ফেলে দিয়ে অস্থিমজ্জা অংশটুকু বের করে নেওয়ার কাজটা একটুও উপভোগ করে না অহনা। তবুও ওকেই করতে হয় কাজটা। খারাপ-ভালো মিলিয়েই আদতে শেষের সবটা। এই শেষের সবটা ভালো হলেই বাকিটা মেনে নেওয়া যায়। এই নিয়ে টানাপোড়েনের উত্তর নেই অহনার কাছে।

কতবার সাঁঝের ঝোঁকে মুখ ঝুলিয়ে ঠাকুরদাদার কাছে প্রশ্ন নিয়ে এসেছে মেয়েটা। কেবল সবলতর বলেই কি দুর্বলতর প্রাণীর জীবনের নিয়ন্তা হওয়া যায় ঠাকুরদাদা? ঠাকুরদাদা মেয়েটার গায়ে কচি পাতার আলতো আদর করে, সন্ধ্যের বাতাস বুলিয়ে মাথার চুল যত্নে আঁচড়ে দিয়ে মেয়েটাকে শান্ত করেছে। বলেছে, সব কাজের ভালো-মন্দ হয়না রে নাতিন। কিছু কাজ কেবল কাজই। তুই না করলে অন্য কেউ করবে। কাজটা কেন করছিস সেটা ভাবিস বরং। এই 'কেন'টার উত্তর পেলে তখন নয় বিচার করতে বসিসখন আদতে তুই কাজের কাজ কিছু করলি নাকি পুরোটাই ফাঁকি? ঠাকুরদাদা যেন কী! কোনো কিছুতেই যেন 'নেই' দেখতে পায়না। ঠাকুরদাদার সাথে কথা কইলেই তাই মনটা আলো হয়ে যায় মেয়েটার। তাইতো ভোর থেকে সন্ধ্যে অবধি ঘুরঘুর করে মেয়েটা ঠাকুরদাদার আশেপাশে।মনে মনে সাজিয়ে নেওয়া তার নিজের বাগান। সেখানে ঠাকুরদাদা গাছ আছে, ভুলু আছে, একরাশ পাখপাখালি আছে। আর শান্ত একটি মন রাখা আছে মেয়েটার। সেই যে সাতসকালে এসে গপ্প জুড়েছে, তারপর তো ঠাকুরদাদা সকালের শিশিরে স্নান সেরে হাতে বুকে মাথার আনাচ কানাচ থেকে পাখিদের জাগাবে, পাতা থেকে খসিয়ে দেবে টুপটাপ শিশির জল। সেই জলে মুখ মাথা ধুয়ে জেগে উঠবে ঠাকুরদাদার প্রিয় পাখিরদল। সাথে সাথে কয়েকদিনের জন্য ঠাকুরদাদার কাঁধে এসে আস্তানা গেড়েছে ওই যে পরিযায়ী পাখিরা, ওরাও কিচিরমিচির জুড়ে দেয় সকালবেলা মেয়েটাকে দেখলেই। তবে সেসময় তাদের বড় তাড়া। গল্প হয়না বিশেষ। গল্প হয় সাঁঝের বাতি জ্বালার আগে তারা ফিরে এলে পর। এ ওর ডানা পালক থেকে কুটি-নাটি, পোকা-মাকড় বেছে পরিষ্কার করতে করতে সারাদিনের কত দিগ্বিজয়ের গল্প শোনায় তখন তারা মেয়েটাকে। মেয়েটা গোল গোল চোখে শোনে। সেসময় ভুলুটাও মশা এড়িয়ে মেয়েটার কোল ঘেঁষে বসে থাকে। আজও থাকে কি? থাকে নিশ্চয়ই! এসব গল্প ওর কানে যায়না অবশ্য। ওর এই একসঙ্গে জটপাকিয়ে বসে থাকতেই আনন্দ। ঠাকুরদাদাও সন্ধ্যের ঝোঁকে ঝিমোতে ঝিমোতে গপ্প শোনে কি শোনে না।

কান থেকে ফোনটা নামিয়ে অহনা আস্তে আস্তে হাঁটছিলো। বাড়ি ফিরে ভালো করে গরম জলে স্নান করে, রাতের মত খাওয়া সেরে আশেপাশেই এ-রাস্তা, সে-রাস্তা হেঁটে বেড়াচ্ছিল সে। সবে অন্ধকার হয়েছে। এই গরমের কটা দিনই এখানে এই উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ানোর বিলাসিতা করা সম্ভব। সারাদিন বেজায় ব্যস্ততায় কেটেছে। আলো আঁধারিতে হেঁটে দিনের ক্লান্তি দূর করে অহনা। কথা বলতে ভালো লাগে না এসময়। তবুও ফোনের পর্দায় কিছু মানুষের নাম ফুটে উঠলে তাকে অহনা এড়াতে পারেনা। তেমনই একটি কথোপকথন শেষ করে হাঁটছিলো অহনা। ফোনের ওপাশে দীপ্ত। বলে যাচ্ছিলো হতাশার কথা। দেশ ছেড়ে ভালো করে বিজ্ঞান জানার বাসনায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায় যেসব বোকা মানুষগুলো, বিদেশে যারা দ্বিতীয় ধাপের নাগরিক, আর বছর তিনেক বাদেই যারা আবিষ্কার করে - দেশেও তারা ততদিনে ব্রাত্য, তেমনই 'ঘরেও নহে পরেও নহে'-দের  একজন দীপ্ত। যেমন অহনাও। যেমন রিয়াজ। যেমন আরও আরও কত কত জন। ভালো করবার আশা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছাড়ে। কেউ করে, কেউ আপাদমস্তক অতিসাধারণত্বের ভার নিয়ে দিনের পর দিন ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন বোনে। পুরোটাই অনিশ্চয়তা। অহনার চেয়ে অনেক বেশি বোধ নিয়ে এদেশে এসেছিলো দীপ্ত। অথচ থিতু হতেই পারলো না এখনো। গত পাঁচ বছরে তিন তিন বার ল্যাবের ঠিকানা বদল করতে হয়েছে দীপ্তকে। কখনো গবেষক নয় ঠিকে মজুরের মত দিনের পর দিন কাজ করে যাবার হতাশায়, কখনো কাজের প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জোগাড় না হওয়ায় ল্যাব ছেড়ে এসেছে, কখনো অনভিপ্রেত ল্যাব পলিটিক্সের শিকার হয়ে দীপ্তকে হাতে তৈরী সম্ভাবনাময় গবেষণা ছেড়ে আসতে হয়েছে। ছেলেটা প্রতিবার আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু কিছুতে মন ডুবিয়ে কাজ করতে পারে না। অথচ পারলে হয়ত সত্যিকারের একটা কাজের কাজ হত। মনটা খারাপ হয়ে আছে অহনার। দেশে মা-বাবার বয়স এত কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। আর তার সাথে বেড়ে চলেছে হতাশা। দীপ্ত ভেঙে পড়ছে এবার। প্রতিবারের মতোই এবারেও সাধ্যমত তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছে অহনা। কিন্তু সত্যিই কি যা বলছে, তা নিজেকে বোঝাতে পারছে অহনা?
তার মত অনেকেই অলস পায়ে হাঁটছে, বাচ্চাদের বা পোষ্যকে নিয়ে বা একাই, সাইকেল চালাচ্ছে। ঝিম ধরা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হোপ টাওয়ারটার পায়ের কাছে সিমেন্টের বেঞ্চটায় বসে পড়ে অহনা। কোথায় পৌঁছাচ্ছে সে বা দীপ্ত বা রিয়াজ বা তাদের মত আরো অনেকে? প্রতিদিনের সাধারণত্বকে মেনে নিতে নিতে ভুলেই যেতে বসেছে এর চেয়েও আর একটু সহজে আর একটু কম প্রতিকূলতায় ভালোবাসার কাজটা করা যেতে পারলে বেশ হতো। যাত্রাপথকে নাকি উপভোগ করতে হয় কিন্তু কোথাও পৌঁছোবার দায় না থাকলে যাত্রাপথ বলে কি কিছু থাকে? চলবার প্রয়োজনটাই অবান্তর নয় কি তখন? পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে উজিয়ে এসেছে তাদের মত কত কত মানুষ, যদিও কিছু জনের কাছে তারা এসেছে কেবলই কুবেরের ধন লাভ করবে বলে। তবুও দীপ্তর মতও কেউতো আছে যারা কেবল কাজটার শেষ দেখবে বলে, নিজের মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবে বলে, নিজের বুদ্ধির অর্ধেক দাম নিয়ে, অর্ধেক মানুষ হয়ে, দিনের পর দিন চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষের এই জিজ্ঞাসার পথের কাঁকড়, নুড়ি যদি খানিক কম হত! যদি প্রিয়জনের পাশে থেকেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজটা করা সম্ভব হতো! মাথা নিচু করে বসেছিল অহনা। 

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ঠাকুরদাদা। মনকেমনের ওষুধ নেই রে নাতিন। জীবনকে দুহাত পেতে গ্রহণ করতে হয়। স্রোতকে ঠেলতে গেলে সাঁতার কাটার সাহস, আর যা কোনোদিন হয়নি, তাকে করে দেখানোর উদ্যোগ লাগে। ভালো করে খুঁজে দেখ দিকি মনের ভিতরে, যা করতে চাস তা সত্যিই করতে চাস কিনা? তাহলে ঠিক তার পথ আপনিই খুঁজে পাবি। তারপর সেইমত সাহস করে এগিয়ে যা বরং আর কিচ্ছুটি ভাবিসনে মেয়ে। ভাবলেই ভয় পাবি। এখন যা দিকি সাঁঝের বেলায় পৃথিবী ঘুম যায় জানিসনে! পরের দিনের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। তুইও যা মেয়ে। কালকের জন্য প্রস্তুত হয়ে নে বরং। মেয়েটা তবুও ঠাকুরদাদার কোল ঘেঁষে জড়ো হয়ে বসেই ছিল।  

কতক্ষণ বসে ছিল তার হিসেবে করেনি অহনা। শীত শীত করছে এবার। আশেপাশের লোকজনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় রাতের মত বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে অহনার। হাতের চশমাটা চোখে লাগিয়ে নিয়ে একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় অহনা। পায়ে পায়ে চকচকে আলো মাখা ফেরার রাস্তাটার দিকে এগিয়ে যায় অহনা। সামনের দিক থেকে আসছেন একজন সাইকেল আরোহী। হেঁটে যাচ্ছেন আরও কয়েকজন। অহনা শুনলো, মধ্যবয়স্ক সাইকেল আরোহী প্রত্যেককে পেরিয়ে আসার সময় বলছেন, "গুড ডেস আর কামিং ফোকস, গুড ডেস আর কামিং।" অহনাকে পার হয়ে এগিয়ে যাবার সময় তাকেও বলে গেলেন "গুড ডেস আর কামিং ফ্রেন্ড।" অহনা হেসে মাথা নাড়লো। মনে মনে বললো, "হোপিং সো।"

ওপর দিকে ঘাড় তুলে তাকালো একবার। অন্ধকার কালো আকাশে হোপ টাওয়ারের সোনালী দেহটা আলোয় আলো মেখে মূর্তিমান স্পর্ধার মত দাঁড়িয়ে আছে। 'হোপ' মানেই তো স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার স্পর্দ্ধা। 'আশা' করাটাই ঔদ্ধত্ব। প্রতিকূলতাকে বুক পেতে গ্রহণ করে, হেরে না যাওয়ার অঙ্গীকার।

হাতের ফোনটা টিং করে উঠলো। ফোনের পর্দায় আইলিনের ছোট্ট মেসেজ। "হেই, উই আর গেটিং টু মোর পেসেন্ট ব্লাড টুমোরো। চেক ইওর ইমেইল।" তারপর বেশ কয়েকটা উচ্ছসিত উল্লাসের ইমোজি।এদুটো হলেই ফেজ ওয়ানের সবকটা স্যাম্পল হয়ে যায়। স্নায়ু শিথিল, মুখের পেশী শিথিল। ঘুম পাচ্ছে এইবার অহনার। ইমেইলের ওপর আঙ্গুল ছোঁয়ায় অহনা বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতেই।

Related Posts:

  • বরেকালা ওয়েদার রিপোর্ট বলছে এখন নাকি প্রবল বর্ষাকাল। হরিয়ানায় নাকি মুহুর্মুহু বৃষ্টি হচ্ছে। হবে হয়ত! আমি তো ছিটেফোঁটাও প্রসাদ পাচ্ছি না। বাড়িতে থাকলে বৃষ্টিট… Read More
  • চক্রবর্তী to চ্যাটার্জী একটা মানুষের পদবী কতরকম ভাবে স্থির হতে পারে? সাধারনভাবে জন্মানোর পর 'ভ্যাঁ' বেরোনোর আগেই আপনার আমার পদবী ঠিক হয়ে গেছে। আমি পিজি&n… Read More
  • রামবাবু আর শ্যামবাবু মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে আছে জানেন। কেন বলুন তো? কারণ পরের সপ্তাহে এতক্ষণ বাড়িতে। হে হে। আট মাস পর বাড়ি গেলে বাড়ির লোকজনও বেশ জমিয়ে আপ্যায়ন ক… Read More
  • Cricket...Cricket....Cricket....The funniest game হা হা হা হা !!!!!! এই জন্য ক্রিকেট দেখতে আমার ভালো লাগে। দেখুন।  … Read More
  • The lost key I have tried my best To reach to the light All the doors were closed Keys were inaccessible to me I am waiting for some spark Please snatch m… Read More

0 comments:

Post a Comment