গতকাল সন্ধ্যে সোয়া সাতটা মতো বাজে তখন। ওমাহারহেমন্তসন্ধ্যা তখন আকাশের দিনশেষের শেষ নরম কমলাআলো নিভিয়ে ফেলেছে। অন্ধকারে সারি সারি শ্লথ গতিরগাড়ির পিছনের জোড়া জোড়া লাল আলোগুলোহ্যালুইনের আলোকসজ্জার মতো মনে হচ্ছে। চলন্তগাড়িতে নিশ্চুপ বসে থাকলে চিন্তার স্রোত বয়ে যায় মাথাজুড়ে। সারাদিনে পাঁচজনের সাথে, মানে বিশেষ ভাবে বলার মতো ইন্টারঅ্যাকশন হয়েছে। দুইজন ফোনের মেসেজিং এর মাধ্যমে। আর তিনজনের সাথে সরাসরি।প্রথম জনকে আমি মেসেজ করে খুঁচিয়েছিলাম। কুশল সংবাদ নিতে। সেসব হল। পাঁচ বছর USA এর প্রথম সারির মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে মন দিয়ে কাজ করার পরপাব্লিকেশন এর ভাঁড়ার বাইরে থেকে প্রায় শূন্য। শিকারহয়েছে বাইরে অপ্রকাশিত বর্ণবিদ্বেষের। চোরাস্রোতের মতো এখনো বহু বহু জায়গায় এজিনিস বিদ্যমান।বেশিরভাগই বাইরে লিবারেল ভেতরে একশো বছর আগেরধারণা নিয়ে বসে আছে। সেরকমই ল্যাব পলিটিক্সের শিকার হয়ে কিছু পেপারের ফার্স্ট অথোরশিপ হাতছাড়া।তারপরে বাক্যবানের জ্বালা। দীর্ঘদিন ধরে সয়ে সয়ে শেষেল্যাব পরিবর্তন করার বাসনায় অন্য ল্যাবে কথাবার্তা- ইন্টারভিউ চালাতে থাকে। কয়েকটি জায়গায় মনমতো কথাবার্তাও এগোয়। পুরোনো ল্যাবে নোটিশ দেওয়ার পরেপরেই বোমার মতো খবরগুলো এসে পৌঁছায়। বর্তমানসরকারের বিজ্ঞান গবেষণায় ফান্ডিং কাট, এমনকি ফান্ডেড গ্রান্ট মানি রিলিজ না করা, সর্বোপরি নতুন H1b
ভিসা নিয়ে প্রথম এনাউন্সমেন্ট। ব্যাস, সাম্ভব্য পরবর্তীএমপ্লয়াররা স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে গেলেন এই মুহূর্তেনতুন কাউকে নিতে। সম্ভাবনাময় তরুণী ডাটা সায়েন্টিস্টএর কেরিয়ার অনিশ্চিত। বাড়িতে থাকা, একজনের আয়েবাচ্চাকে ডেকেয়ারে রেখে কাজ খোঁজা, পুরোনো ল্যাবেরযাবতীয় পলিটিক্স সামলে পেপারের তদবির করা। সবইকরছে। ভেঙে পড়ছে। একা ঘরে কাঁদছে। আবার চোখমুছে উঠে নতুন এপ্লিকেশন করছে। আরো কি কি র সাথেলড়াই করছে তা নাহয় নাই বললাম।
দ্বিতীয় জন নিজেই তার লেখা দুটি লেখা আমায় পড়তেপাঠালো। অনেক জুনিয়। তার ডক্টরাল কোর্সের প্রথম দিনথেকে চিনি। কলকাতার বাঙালি বলে নিজে থেকে এসেআলাপ করেছিল। কোর্সের বিভিন্ন সময় বিভিন্নএকাডেমিক সমস্যায় সিনিয়র হিসেবে বা বড়ো দিদিহিসেবে গাইড করার চেষ্টা করেছি। তার আলস্য দেখলেমৃদু বকুনিও দিয়েছি। তাকে নরম, অপরিণত ছোটবোনেরবাইরে তেমন কিছু ভাবিনি। কাল তার দুটি লেখা প্রথমবারের মতো পরে বুঝলাম ভেতরে মানুষটা কতটা পরিণত! ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন, সম্পর্কের পরিণতিসম্পর্কে তার ভাবনার প্রকাশ চোখে জল এনে দিল।মানুষকে আর কতদিন আমরা মলাট দেখে বিচার করবোজানিনা। পিএইচডি শেষে পোস্টডক্টরাল রিসার্চে ঢুকেছে।ব্যক্তিগত জীবনে প্রবল সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।এমতাবস্থায় কাজের স্থিরতাটুকু যেন থাকে ভগবান! তারওল্যাবে সমস্যা চলছে শুনেছি।
তৃতীয় ও চতুর্থ দুইজন দিনের শেষে এলো আমার কাজেরঘরে আধঘন্টা কথাবার্তা হল। নব্বই ভাগ কথাবার্তাইকেরিয়ার সংক্রান্ত হতাশায়। এই দুইজন এখনো ডক্টরেটপায়নি। পেয়ে যাবে পরের বছরেই। সুতরাং আসন্ন দিনেএকাডেমিক জব মার্কেটের অনিশ্চয়তার খবরেপ্রত্যেকের মতো এরাও শঙ্কিত। এতদিন ধরে এতোরগড়ানি খেয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেয়ে পরবর্তী ক্ষেত্রে কাজথাকবে কিনা, থাকলেও মেধার মূল্য যা পাওয়া যাবে, এদেশে বিলাসিতা ছেড়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার এবং বিলপেমেন্ট করার জন্য তা যথেষ্ট হবে কিন। এই চিন্তাতেএকাডেমিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া গবেষকের সংখ্যাআশঙ্কাজনক ভাবে কমছে। এবং চিন্তাটি যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।পরে নাহয় একদিন এই নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা যাবে।আপাতত: শেষের জনের কোথায় আসি তাহলে এইপ্রসঙ্গের জ্বলন্ত এক উদাহরণকে সামনে থেকে আমরাদেখতে পাবো।
পঞ্চম তথা শেষের জনের সাথে দেখা হলো কাল সন্ধ্যায়ভারতীয় দোকানে সবজি কিনতে গিয়ে। অনেকদিন পরদেখা। বহুদিন ধরেই হতাশাগ্রস্থ। পিএইচডি ছিল উদ্ভিদবিজ্ঞানে। ভারত থেকে পোস্টডক রিসার্চ করতে এসে দুচার বছর অন্তর অন্তরই ল্যাব পরিবর্তন করতে হয়েছে।অতি সাম্প্রতিক কালের রিসার্চ ফান্ডিং ক্রাইসিস এর বহুআগে থেকেই গ্রান্ট পাওয়া ক্রমাগত চাপের হয়ে চলেছে।আর কোনো ল্যাবের ফান্ড কম থাকলে প্রথম কোপটা পরেপোস্টডকদের ওপর। কারণ ডক্টরাল স্টুডেন্ট দেড় কেউচলে যেতে বলতে পারবে ন। তাদের ডিগ্রি দিতে হবে।তাদের জন্য গ্রাজুয়েট কমিটি আছে। সুততং এইপঞ্চমজনের মতো পোস্টডকদের বার বার ল্যাব চেঞ্জকরতে হয়। একবার বলেছিলো মনে পড়ে দূর একটু মনদিয়ে কাজ করে ভালো ডাটা পাচ্ছি তো তারপরেইঅন্যজায়গায় চলে যেতে হচ্ছে। এরকম করে রিসার্চ হয়! সে কিন্তু বেতনের জন্য কমপ্লেইন করেনি। নূন্যতম চাহিদাছিল কাজের সামান্য দীর্ঘ্যস্থায়ীত্ব। রিসার্চে মনোনিবেশকরার জন্য যা অত্যন্ত জরুরি। কাল বললো একাডেমিয়াছেড়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যৌন করেছে। সেখানেও যে বিশেষ কিছুরিসার্চ হচ্ছে এমনটা নয়। যা হচ্ছে তার সুপারভিসারি করারকাজ। সর্বোপরি রিসার্চের স্বপ্ন ছেড়ে বেঁচে থাকে জন্য সেইন্ডাস্ট্রির কাজে যোগ দিলেও পারিবারিক জীবন মধুরচলছে এমনটা নয়। স্ত্রী রিসার্চ এর জব পেয়েছে। কিছুটাকাজের স্বাধীনতা। কিন্তু দেশের অন্যপ্রান্তে। সে বাচ্চাদেরনিয়ে দূরে। এ এপলাই করছে তার কাছাকাছি যাবার।অর্থনৈতিক দৈন্যতা, বিজ্ঞানের খিদে না মেটা, এমনকিপরিবারের সাথে থাকতে না পারা। এতোই কি মূল্য দেবারছিল ভালো রিসার্চ করবো এই স্বপ্ন দেখার জন্য!
জানিনা রিসার্চারদের কবে সমস্ত দেশের সরকার মেধা, প্রচেষ্টা আর বুদ্ধিমত্তার উপযুক্ত মূল্য দেবে!