Saturday, 13 June 2020

সেদিন হঠাৎ করেই


সাতই মার্চ ২০২০, দিনটা শনিবার। কোনো পড়ে থাকা কাজ নেই যা সেইদিনই শেষ করতে হবে। মিডওয়েস্টের মারকাটারি ঠান্ডাটা একটু সহ্য করার মত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সুতরাং মনটা ঘরে থাকছিল না। স্যান্ডহিল ক্রেনরা ফিরছিলো তাদের বাৎসরিক পরিক্রমা সেরে, সে খবর পেয়েছিলাম। নেব্রাস্কার পুব দিক ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া প্ল্যাট নদীর ধারে ধারে ওদের অস্থায়ী বসবাস শীতের শেষে। কিন্তু তার জন্য আমাদের পশ্চিমে ঘন্টা দেড়-দুই উজিয়ে যেতে হবে, ওদের সাথে মোলাকাত সেরে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসার সময়ের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারটা একটা প্ল্যানিং এর কারণে। সেই যে ছোটবেলায় স্কুলে মাঝে মাঝে মুড়ির পিকনিক হতো না, তখন অবশ্য 'ফিস্ট' বলতাম। সমস্ত স্কুলে হতো কিনা জানিনা। আমাদের মতো মফস্বলের গার্লস স্কুলগুলোতে হতো জানি। সেরকমই একটা মুড়ির ফিস্ট হবার কথা ছিল দুই একদা মফস্বলী গার্লস স্কুলে পড়া মূল- উৎপাটিত মেয়ের উদ্যোগে। পুরোনো স্বাদে ফেরা মাঝে মধ্যে, এই আর কি! এই নস্ট্যালজিক সময়ে ফিরে যাবার আকর্ষণ কম নয় অথচ এমন একটা পড়ে পাওয়া দিনে বাড়িতে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ার দিকেই মন বেশি টানলো।  সু কে বললাম তোর বাড়ির মুড়ির পার্টিটা বরং পরের সপ্তাহে পিছিয়ে দেওয়া যাক। আজ বরং বক দেখে আসি চল। করোনার চক্রান্তে সে পার্টি এখনো মুলতুবি আছে যদিও। সু আর বড়দাদাও ছিল ল্যাবে। দুটোকেই ভুজুং ভাজুং দিয়ে বগলদাবা করলাম। অমন দুম করে বেরোনো একটু কঠিন। তাদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো তারপর চারজনে বেরিয়ে পড়লাম। দুপুরের খাওয়া সেরকম কিছু হয়নি ওদের। রাস্তাতেই অল্পসল্প স্যান্ডউইচ - ফলমূল জাতীয় কিছু দিয়ে দুপুরের জ্বলন্ত খিদে সামলে সাঁই-সাঁই করে এগোচ্ছি ইন্টারস্টেট ৮০ ধরে সিধে পশ্চিমমুখো। সূর্যাস্তের অন্তত এক দেড় ঘন্টা আগে পৌঁছাতে হবে নইলে অন্ধকার হয়ে পড়লে ওদের দেখবো কি করে? আর আমরা যে জায়গা লক্ষ্য করে বেরিয়েছি সে জায়গায় ওদের কোনো বড়ো ঝাঁক নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে একটু আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করতে সময় লাগবে। মাঝে একজায়গায় থামা হলো। তখন সবে এখানে করোনা ঘাঁটি গাড়তে শুরু হয়েছে। তেমন ভাবে সকলকে পঙ্গু করে দিতে পারেনি তখনও।

আমরা পৌঁছলাম কার্নে। নেব্রাস্কার কার্নে, নর্থ প্ল্যাট, গ্র্যান্ড আইল্যান্ড - প্ল্যাট নদীর অববাহিকায় এইসমস্ত জায়গা বছরের দুবার প্রায় আড়াইশো প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বিশ্রামস্থল হয়ে দাঁড়ায়। এযাত্রা শীতের শেষে ঘরে ফেরার পথে আমরা ওদের সাথে দেখা করতে এসেছি। কিন্তু আমাদের পুরোনো জায়গায় পৌঁছে দেখলাম এবছর ওই জায়গায় কোনো বড় পাখির ঝাঁক নেই। তবুও নদীর কাছে নেমে পায়ে হেঁটে শুকনো ঘাসের জঙ্গলে জঙ্গলে বেশ কিছুটা এগিয়েও তেমন লাভ হলো না। দূরে নদীর ঠিক মাঝখানে একখানা চড়া তৈরী হয়েছে। সেখানে একঝাঁক পাখি উঠছে নামছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সে অনেক দূরে। সামনে দিয়ে মাঝে সাঝে পাঁচ-সাতটি পাখির ঝাঁক আমাদের দেখতে পেয়ে কর্কশ গলায় ধমক দিতে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্যামেরাধারীদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এদিকে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে প্রায়। আমরা পড়ি কি মরি করে সূর্য্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে আবার অন্য রাস্তা দিয়ে নদীর অন্য আর একটি দিকে পৌঁছাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাড়াহুড়োয় যেখানে গিয়ে পৌঁছালাম সে রাস্তা একটি প্রাইভেট ফার্মহাউসের সামনে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। নদীর ধারে পৌঁছাতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু যেখান দিয়ে এলাম সেটি ফসল ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে গ্রাম্য রাস্তা। এবং ফসল কাটার পর, পরে থাকা ভুট্টার দানা খেতে সেসব ক্ষেতে নেমেছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। তাদের কর্কশ গলার মিলিত কোরাসে সরগরম পুরো জায়গাটা। নদীতে না পৌঁছাতে না পেরে ভালোই হলো। পড়ন্ত সূর্য্যের কমলা আকাশের প্রেক্ষাপটে অজস্র বিশালাকায় পাখির ঝাঁক। উড়ছে, নামছে, নানানরকম আকৃতি তৈরী করছে ঝাঁকের, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সে এক মহোৎসব যেন। জায়গাটা যেহেতু পক্ষিসন্ধানী টুরিস্টদের সাধারণ রুটের বাইরে, ইতিউতি দুএকটি ফার্মহাউস আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলক্ষেতের মধ্যেকার একটি গন্ডগ্রাম বিশেষ, সেহেতু অনাবশ্যক মনুষ্যসৃষ্ট শব্দ সেখানে অমিল। আমরা চারজনে প্রাণভরে ছবি তুললাম। মন ভরে তাদের সমবেত কথোপকথন শুনলাম। লাল আকাশের প্রেক্ষাপটে ঝাঁকেঝাঁকে পাখির সারি আর তাদেরই সৃষ্টি করা কোরাসে, উদাত্ত হাওয়া আর মধ্যে নেব্রাস্কার বিখ্যাত আদিগন্ত সমভূমির মাঝখানে ব্যোমকে গিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম কিছুক্ষণ।

ফেরার জন্য পিছন ফিরলাম যখন ততক্ষনে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কি ভাবছেন ভ্রমণ শেষ? আরে না না, এত সহজে ঘর ঢুকবো বলে লিখছি নাকি? বলছি সব আস্তে আস্তে।

গ্রামের মেঠো রাস্তায় ঢুকে গিয়েছিলাম অনেকটা। ফলে বড় রাস্তায় এসে পড়তে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। এদিকে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে একটি জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম তারপর থেকে জলযোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ কিন্তু জলবিয়োগের অবকাশ পাইনি। সেই থেকে দৌড়েছি। এখন ফেরার আগে সে প্রয়োজন সকলেরই উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং সাথে পেটে চোঁ চোঁ করছে খিদে। পথের পাশে একটি ছোট দোকানে দাঁড়ানো স্থির হলো। নেব্রাস্কার এরকম ভেতরদিকের গ্রামে ভারতীয় মুখের আনাগোনা বেশি নয় এখনও। ফলে কিছু জায়গায় এখনো পুরোনো দিনের মানুষেরা দুবার ফিরে তাকান। নতুন প্রজন্মের কমবয়সী দোকানি মেয়েদুটি ভারী মিষ্টি। দোকানটি যেমন পথের পাশের দোকান হয় সেরকমই হরেকরকম্বা গোত্রীয়। আমরা কিছু খাবার দাবার কিনলাম। সাথে ওয়াসাবি পেস্ট লাগানো রোস্টেড সবুজ মটর একপ্যাকেট। সেই বস্তু ভুল করে একমুঠো একসাথে মুখে ফেলে দেবার পরেই টাং করে মাথার সমস্ত স্নায়ুতন্তুর জট খুলে যায়, চোখ থেকে দরদরিয়ে জল পড়তে থাকে, নাকের ভেতরে এককিলো নস্যির সমান জ্বলন শুরু হয়, মুহূর্তে ক্লান্তি গায়েব হয়ে মাথা পরিষ্কার হয়। আহা! সে স্বর্গীয় গাট্টাটি গলাধঃকরণ করেই কিনা জানিনা আর একটি চিন্তার উদয় হলো মাথায়। বললুম, এখনই বাড়ি না ফিরে যদি আর একটু দূরে কোথাও গিয়ে, একটা রাত্তির কাটিয়ে কাল আর একটু এদিক ওদিক দেখে তারপর নয় কাল বিকেল নাগাদ ফিরি? বলেই চোরা চোখে সু কে একটু দেখে নিলুম। প্রথম কিলটা আসলে ওর দিক থেকেই আসবে। আমরা নয় আগে থেকেই এই শনি-রবি কাজ করবো না ঠিক করেই রেখেছিলাম। কিন্তু বাকি দুজনকে তো ল্যাব থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। বড়দাদা নয় খানিক বড়ো হয়ে গেছে বলে নিজের কাজ নিজের সময়মত করার খানিক স্বাধীনতা আছে কিন্তু সু এর তা এখনো নেই। ফলে সে খানিক কাঁইকিচির জুড়লে। কিন্তু দোকানেরই এক কোণে রাখা ছোট দুটি টেবিলে বসে খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সমস্ত নেগেটিভ ভোট পজেটিভ হয়ে গেলো। এক্সপেরিমেন্টগুলোর কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করানোর ব্যবস্থা হিসেব করা গেলো। সকলেই তৈরী কোথাও একটা যেতে। এখন প্রশ্ন যাবোটা কোথায়? 

এই আদিগন্ত প্রেইরি অঞ্চলে ঘাসজমি ছাড়া দেখার বিশেষ কিছু নেই। তা ঘাসজমিই দেখতে পারি কিন্তু থাকার জায়গা একটি লাগবে রাতের মতো। চারটি ফোনের ম্যাপ খুলে এদিক ওদিকের বিস্তর গবেষণা করে স্থির হলো আমরা যাবো নিওব্রারা স্টেট পার্ক। সেটি এখান থেকে সিধা উত্তরে ২০০ মাইল। ঘন্টা তিনেক লাগবে। নেব্রাস্কা আর সাউথ ডাকোটার সীমান্ত বরাবর নিওব্রারা এবং মিসৌরি নদীর সঙ্গমস্থলের একটি জঙ্গুলে জায়গা। সুবিধেটা এই যে  আগামীকাল সেখান থেকে কোনাকুনি দক্ষিণ পুব মুখো রওনা হলে সোজা ওমাহাতে গিয়ে পড়া যাবে। পথ অনেক কমে যাবে। সু বিকেল বিকেল ফিরে গিয়ে ঘানিগাছটায় আবার জুড়ে যেতে পারবে। সুতরাং নিওব্রারাই স্থির হলো। আবার কিছু এদিক ওদিক ফোনকলের পর নিওব্রারার দক্ষিণে নেলি (Neligh) তে একখানা মোটেলে রাতের মত ঠাঁই মিলবার আশ্বাসও পাওয়া গেলো। সুতরাং চল পানসি নেলি পানে।

নেলি খুবই ছোট্ট গ্রাম। মাত্র দেড়হাজার মানুষের বাস। উত্তরে নিওব্রারা থেকে পনকা (Ponca) উপজাতিদের যখন তাড়িয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিলো নিচে ওকলাহামার দিকে তখন সেই পরিযায়ী পনকা উপজাতির অসংখ্য মানুষ রাস্তায় মারা যান। পথের কষ্ট সব যুগেই সমস্ত মানুষের জন্যই সমান। সেসময় এই নেলির কাছেই মারা যায় পনকা উপজাতির একজন গোষ্ঠীপতির দেড়বছর বয়সী মেয়ে। তার সমাধি এখনো আছে নেলিতে।  এই সাউথ ডাকোটা থেকে নিচে ওকলাহামার মাঝে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে পুরোনো কালে। আমেরিকান আদি ইন্ডিয়ান উপজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই অঞ্চলে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার চাপে ক্রমশই তারা নিচের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। আর সাথে এই আইওয়া, নেব্রাস্কা, সাউথ ডাকোটা, ওকলাহামা,আর্কানসা এসব জায়গায় ফেলে যেতে থাকে অজস্র ইতিহাস। এই অঞ্চলের সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল ওমাহা। আমাদের বর্তমান কর্মস্থল। ওমাহার আশেপাশে এধরণের অসংখ্য ইতিহাস দেখা যায়।  তেমন করে নজর চলে না যদিও। হেরো মানুষের ইতিহাস-প্রদর্শনীতে দয়া থাকে, করুণা থাকে, বিজয়ীর প্রচ্ছন্ন গর্ব থাকে। কিন্তু বিজয়ীর ইতিহাসের প্রদর্শনীর মতো জাঁক তার কোথায়? সুতরাং আমেরিকান-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীপতিদের নামে হ্রদ বা একটি বনাঞ্চলের নাম দেওয়া হয় মাত্র নতুন পৃথিবীতে। বাকি ইতিহাসের খবর জানতে গেলে ইউনিভার্সিটির নেটিভ-আমেরিকান ইতিহাসের ছাত্র হতে হবে। তা ভিন্ন বিশেষ কিছুই বাকি নেই বাইরের জগতে। 

নেলিতেও কিছু নেই। কয়েক ঘর মানুষের বাস ইতিউতি। একটি ছোট বাজারপাড়া। একটিই রাস্তা আর তার পাশেই আমাদের এই রাতের আস্তানা। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় রাত এগারোটা বাজলো। শুনশান চারিদিক। একটি ছোট আলো জ্বলছে মোটেলের নাম দেখার জন্য সে আলো যথেষ্ট। আর কোনো কাজ সে আলোর দ্বারা হবে না। রাস্তার গায়ে লাগানো একটা পুঁচকি পার্কিং-এর জায়গা আর তার গা ঘেঁষে ঘেঁষে L -আকৃতির গোটা সাত-আট ঘর। এই হলো নেলির মোটেলটি। আস্ত একটি ভূতুড়ে গল্পের পটভূমি যেন। ঘুমন্ত নেলি গ্রামটিতে পৌঁছে আমরা রাস্তা থেকেই সাঁৎ করে ঢুকে গেলাম মোটেলের পার্কিং লটে -"এই তো এইটাই এইটাই।" কালো রঙের আরো একটি জগদ্দল ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে মিশে গিয়ে। তার পাশেই আমাদের পুঁচকে গাড়িটাকে দাঁড়াতে বলে চারমূর্তি নামলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না।  আমাদের ঘরের চাবিটা নেবো কোথা থেকে? অনেকসময় এখানে মোটেলের অফিস খোলা না থাকলে অফিসের সামনে পথিকের নাম লেখা বন্ধ খামে করে চাবি রাখা থাকে। অফিসটা খুঁজে বের করতে হবে। সবই অন্ধকার। সমস্ত দরজাই বন্ধ। সামনে জাঁদরেল সাইজের গুঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল ঝুপসি মহীরুহ। কি গাছ কে জানে! জায়গাটা রাস্তার আলোর থেকে আড়াল করে আরো বেশি অন্ধকার করে তুলেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় পায়ের কাছে লোমশ কি যেন একটা র উত্তাপ। তাকিয়ে দেখি মাটির কাছাকাছি সবুজ দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। ওরকম পরিবেশে বুকটা যে ধক করে ওঠেনি তা নয়, তবে আমার অনুভূতিগুলো বোধহয় একটুখানি ভোঁতা। এই পরিবেশে ওরকম দুটো চোখ দেখে আমি ভয় পেরিয়ে উঠে দেখলাম, কালোর সাথে মিশে থাকা কুচ্কুচে কালো একটা গোবদা বেড়াল আমাদের মোটেলের তরফ থেকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আমাদের অফিসঘর খুঁজতে দেখেই বোধহয় বাঁদিকের একটা সরু দরজার সামনে গিয়ে বললো, "ম্যাঁও।" সেই দরজার ঐপারে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। কাঁচের বাইরে থেকে একটি বড় এন্টিলোপের মাথার স্টাফিং দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে। কোথাও কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। বেড়াল পায়ের চারপাশে ঘোরে আর বলে "ম্যাঁও।" শেষকালে খাঁটি ভারতীয় পদ্ধতিতে ঠকঠক করতে শুরু করতে, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় মানুষ। আমাদের সকলের চেয়ে তিনি বেশি শক্তি ধরেন এতটাই গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পরনে সাদা টি-শার্ট আর বাদামি প্যান্ট। মাথায় মেক্সিকান হ্যাট। এই রাত্তিরেও মুখে সিগার। বাহুতে ট্যাটু। খাঁটি মধ্য-আমেরিকান চেহারা। চারজন টিংটিঙে বঙ্গসন্তানকে দেখে আশ্রয় প্রত্যাশী বলে চিনে নিতে ভুল হলো না তাঁর। নাম ধাম, সনাক্তকরণ ইত্যাদি মিটিয়ে নিতে অফিসে ঢোকা হলো। অফিস বলতে, বাড়ির সামনের বারান্দাটিতে একটি কাউন্টার বানানো আর কাউন্টারের পেছনে একটি চেয়ার। ব্যাস এই অফিস। সাধারণত এইধরণের রাস্তার পাশে মোটেলগুলোতে প্রাতরাশের ব্যবস্থা থাকে। এটিতে সেসবের বালাই নেই। প্রাতরাশের প্রত্যাশী আমরা ছিলামও না যদিও। নেলির মতো জায়গায় হুট্ করে চলে এসে থাকার জন্য একটি ঘর, ঘুমোবার জন্য একটি বিছানা পাচ্ছি এই ঢের। মোটেলের মালিক বেজায় গম্ভীর। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন কিনা কে জানে! ঝটপট কাজ সেরে চাবি ফেলে দিলেন কাউন্টারে। আমরাও মানে মানে চাবি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বিশেষ দর্শনীয় বিষয়টি হলো, এই যে মিনিট পাঁচেক সময় আমরা অফিস ঘরটিতে ছিলাম, তার মধ্যে আমি চারিদিকে চোখ ছড়িয়ে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক পশু পাখির স্টাফিং দেখতে পেয়েছি। কি নেই তার মধ্যে! বেশ কয়েকটি এন্টিলোপের মাথা, তার একটা বাইরে থেকে দেখেছি বললামই। এছাড়া, ঈগল, পেঁচা, ববক্যাট , শেয়াল, রাকুন। এমনকি একখানি সাপ পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের হোস্টিং করছেন একজন শিকারী। 

 চার্ বঙ্গসন্তানের রাত এগারোটার সময় অপরিকল্পিত ভাবে চলে আসা মধ্য-পশ্চিম আমেরিকার এক শুনশান গ্রামে, কুচকুচে কালো বেড়ালের অভ্যর্থনা, নিঝুম মোটেলে গম্ভীর শিকারী মালিক, অফিসঘরে ঠাসা মৃত জানোয়ারের দেহ! আমার ভোঁতা ইন্দ্রিয়ের পক্ষেও যথেষ্ট ছিল সেদিন। জোরদার ভূতুড়ে গল্পের মশলা একেবারে। 

তারপর আর কি? সাথে তো জামাকাপড়-ব্রাশ-পেস্ট কিছুই ছিল না রাত্রিবাসের জন্য। ব্রাশ -পেস্টের ব্যবস্থা করা গিয়েছিলো গতরাতের ওই হরেকরকম্বা দোকান থেকেই। কিন্তু জামাকাপড় বদলাবার বালাই নেই। চাবি দিয়ে কোণার একখানা ঘর খুলে চারজনে দুটো বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে গেলাম। বেড়াল আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। আমাদের ঘরের পাশেই দেখলাম তার ঘর। মানে একটি বড়সড় কাঠের বাক্স, তার ভেতরে মোটা করে খড়, কম্বলের বিছানা। অর্থাৎ ইনি বাড়ির ভেতরের পোষ্য নন। বাইরেই তাঁর চৌকিদারী। কালো শরীর আর সবুজ জ্বলজ্বলে চোখে প্রথমটা চমকে দিলেও দিব্য ভাবসাব করতে চান দেখলাম। কিন্তু আশ্চর্য পরদিন সকালে বেড়াল এবং তার মালিকের দেখা আর আমরা পাইনি। ঘরে চাবি রেখে ঘর খোলা রেখেই সাত সকালে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাতে অবশ্য নাক ডাকিয়ে দিব্য ঘুমিয়েছি। চারজনের মধ্যে তিনজনই নাক ডাকতে ওস্তাদ। ফলে সকালে উঠে দেখলাম সু এর মুখ রাগে গনগনে করছে। বেচারী একটুও ঘুমোতে পারেনি বাকি তিনজনের রাতভর কনসার্টের চোটে। নেলিতে একজায়গায় পেট ঠুসে খেয়ে নিওব্রারা স্টেট পার্কে গিয়ে পৌঁছলাম। নেলি অসাধারণ সুন্দর ভ্যালি। নেলি থেকে নিওব্রারার রাস্তাটি নেব্রাস্কার সুন্দরতম রাস্তাগুলির একটি। দু পাশে উঁচু-নিচু উপত্যকা। ফসলি জমি। মাঝে মাঝে লাল ছাদওয়ালা সাদা দেওয়ালের ফার্মহাউস। আর দৈত্যাকৃতি হাওয়াকল। একেবারে ক্যালেন্ডারের পাতার দেখা ছবিগুলোর মত সুন্দর। কিছুক্ষন চলার পর বাঁদিকে এসে পড়লো নিওব্রারা নদী। চুপ করে দেখার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। নিওব্রারা স্টেট পার্কে পৌঁছে বাহনকে বিশ্রাম দিয়ে চারমূর্তি জঙ্গলে ঢুকলাম। জঙ্গলে হাঁটতে পারলে আর কিছু চাইনা আমি। অনেকটা ভেতর অবধি গিয়ে একজায়গায় বসে গল্পগাছা হলো। বেড়ানো, হাঁটা, দেখা, এ-ওর পেছনে লাগা এসব তো ছুতো। আসল কথা হলো আমরা চিরকালীন যে নেই রাজ্যে বাস করি, তাতে মাঝে মধ্যে শ্বাস ফেলতে না পারলে অবসাদ অবধারিত। নিজের নিজের হতাশাগুলো বেরোবার পথ পায় এই জলে জঙ্গলে একে ওপরের সাথে কথা ভাগ করে নিতে নিতে। কোনো কিছুরই আশু সমাধান নেই, তবুও একে অপরকে বলা যে, "সাথে আছি আমিও"- এই আর কি। ঘাসে পিঠ পেতে শুয়ে ওপরের নীল আকাশ থেকে আশ্বাস ধার করে নেওয়া। 

আর কি? ভ্রমণ শেষ। এবার ফেরার পালা। 

তারপর সেই কোনাকুনি পথে ওমাহামুখো হলাম আবার। মাঝে একজায়গায় জিরিয়ে নিয়ে বিকেল বিকেল ওমাহা পৌঁছে গেলাম। বড়দাদা এখানে আছে প্রায় এক দশক। অলিগলি চেনে সে। সেদিন আমাদের ছাগলের দলকে একখানি নতুন শাকের ক্ষেত দেখিয়েছিলো। তারপর থেকে সে ক্ষেতে বসে খাওয়া বন্ধ বলে আর ওমুখো হওয়া হয়নি। কিন্তু পরে নিশ্চয়ই যাবো। একখানি জাপানি সুশির দোকান। সেখানে খাবার পরিবেশনের ট্রেগুলি সব কাঠের নৌকাকৃতির। আমাদের খিদে পেয়েছিলো প্রচন্ড। সকালে সেই নেলির দোকানে খেয়েছি। তারপর মাঝে একটু চা-কফি পড়েছে পেটে। ভালো করে বসে খাওয়া হয়নি। ওমাহা পৌঁছাবার তাড়া ছিল। আমি আর সু বাথরুম ঘুরে এসে (সেখানে আমাদের দুদিনের ব্যবহৃত দোমড়ানো জামা, জল-জঙ্গলে হেঁটে কাদামাখা জুতো, হাওয়ায় জট পাকানো চুল ইত্যাদির মিলিত প্রয়াসে জবরদস্ত চেহারা দেখে সকলে কিরকম একটা চোখে তাকাচ্ছিলো। আমরা যদিও পাত্তা দিইনি। ডাঁটসে কাজ সেরে বেরিয়ে এসেছি।) দেখি পিনাকী আর বড়দাদা গুছিয়ে অর্ডার করে ফেলছে। "এটা একটা বলি?" "দুটো বলে দাও।" আমাদের খিদের পরিমাপ করে বেচারারা একটার জায়গায় চারতে করে অর্ডার করে ফেললো। তারপর অপেক্ষা করছি যখন, তখন দেখি পাশের টেবিলে আট-দশ জনের একটা পরিবারের জন্য টেবিল জোড়া একটা কাঠের নৌকা করে বিভিন্ন ধরণের সুশি এসেছে। সে দেখে আমরা বাংলায় চুটিয়ে নিন্দে-মান্দা সেরে একঢোক জল খেয়ে যখন সবে ঠান্ডা হয়ে বসেছি, দেখি আমাদের চারজনের জন্য ওই সমপরিমাণ সুশি আসছে ওরকমই একটা কাঠের নৌকায় চেপে। আমাদের চারজনের টেবিল ছোট। ওদের বড় টেবিলে অন্তত নৌকাটাকে রাখতে অসুবিধা হয়নি। আমাদের টেবিলে যখন ঠকাস করে নৌকাটাকে বসিয়ে দিয়ে গেল, তখন দেখলাম আর প্লেট রাখবার জায়গা পর্যন্ত নেই। অগত্যা সরাসরি নৌকার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম চারজন চারদিক থেকে। পেটপুরে খেয়ে, বাকিটা চার ভাগ করে ছাঁদা বেঁধে নিয়ে এসে পরের দিন পর্যন্ত খেলাম। 

পাশের টেবিলের লোকেরা খেয়ে উঠে যাবার সময় খাবারের পরিমাণ আড়চোখে দেখছিলো দেখেছি। তাতে যদিও আমাদের ঘন্টা!    

 

0 comments:

Post a Comment