যে কথা বলছিলাম আগের দিন, 'Near death experience' বা 'NDE' সংক্রান্ত গবেষণার কথা। কিন্তু এই বিষয়ে গবেষণার প্রধান সমস্যাটা হলো, মডেল। অর্থাৎ, প্রায় মারা যেতে যেতে ফিরে আসছেন এরকম কোনো মানুষ গবেষকরা কোথায় পাবেন? যখন পাবেন তখন তাঁদের NDE অভিজ্ঞতা চলাকালীন মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়বিক কার্যকলাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। যদিও NDE- কে বর্তমানের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সংক্রান্ত জ্ঞান দ্বারা বিচার করা, ব্যাখ্যা করা যে অসম্ভব তা বহু গবেষক বা চিকিৎসকই বলেছেন, তবুও ওই সময়ে মস্তিষ্কে বা স্নায়বিক কার্যকলাপে অন্তত কি পরিবর্তন হয় সেটি মাপা যেত যদি অভিজ্ঞতা চলাকালীন পরীক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দ্বারা সুস্থ ভলেন্টিয়াকে প্রায় তিনি মারা যাচ্ছেন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে একটি মডেল তৈরি চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তা আসল ব্যাপারের অনেকটাই দূর দিয়ে গেছে।
অন্য কোনো উপায়ে NDE-র মতন কোনো অনুভূতি তৈরী করা যায় কিনা সে চেষ্টাও হয়েছে। যার একটার কথা আমি আগের দিনের প্রথম পর্বের লেখায় বলেছিলাম। সেটি হলো DMT প্রয়োগ করে কিছুটা NDE -র মতো অভিজ্ঞতা তৈরী করা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে আরো একটি মাল্টিসেন্টার স্টাডি পাচ্ছি ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির মিলিত গবেষণার ফল। প্রকাশিত হয়েছে ওই ২০১৮ তেই। এই স্টাডিটি আরো লম্বা সময় ধরে চলেছিল। প্রায় তিন বছর। এখানে উইলিয়াম ভ্যান গর্ডন এবং তাঁর সহগবেষকরা খানিকটা অদ্ভুতভাবেই NDE তৈরী (induce) করেছেন। করেছেন মেডিটেশন বা মনসংযোগ দ্বারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রাচীন বৌদ্ধপুঁথিতে এক বিশেষ পদ্ধতির মেডিটেশন এর সাহায্যে NDE তৈরি করা সম্ভব একথার উল্লেখ আছে। একে বলা যাক MI-NDE (Meditation Induced- NDE)।আধুনিককালের বৌদ্ধ মেডিটেটররা মনোসংযোগের দ্বারা আগে থেকে প্ল্যান করা সময়ে MI-NDE তৈরী করতে সমর্থ হয়েছেন। এর ফলে তাঁদের নিয়ে পরীক্ষা করলে অন্তত পরীক্ষা করার জন্য একটি মডেল পাওয়া সম্ভব হবে। এই স্টাডিতে তাঁরা ১২ জন বৌদ্ধ মেডিটেটরের ওপর পরীক্ষা করেন। সেখানে MI-NDE তৈরী করে এমন পদ্ধতির মেডিটেশন এবং তার সাথে আরো দুটি আলাদা ধরণের মেডিটেশন পদ্ধতি, যা MI-NDE পদ্ধতির কন্ট্রোল (যেমন অন্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে placebo থাকে) হিসেবে কাজ করবে এমন দুটি পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হয়। এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই স্টাডিটির ক্ষেত্রে এই যে, স্টাডিটি চলেছিল একটানা তিন বছর। অর্থাৎ, MI-NDE পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে তিনবছর ধরে একই মানুষের উদ্ভুত NDE তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে দেখা গিয়েছিলো। অন্যান্য দুটি পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে কিন্তু সেটি বাড়েনি। এই পদ্ধতিতে মেডিটেটররা নিজেদের ইচ্ছেমতো সময়ে সচেতন ভাবে NDE তৈরী করতে পেরেছিলেন। এই স্টাডিটি একটি আশার আলো দেখায় যে ভবিষ্যতে এই অ্যাডভান্স স্টেজের মেডিটেটরদের নিয়োগ করে NDE চলাকালীন সরাসরি মস্তিস্ক এবং স্নায়ুসংক্রান্ত পরিবর্তনগুলি মাপা যেতে পারে। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, এক্ষেত্রে মেডিটেটররা সচেতন যে তাঁরা NDE তৈরী করছেন, সাধারণ NDE -র ক্ষেত্রে যা হয়না। ফলে দুটি অবস্থার শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য থেকেই যায়।
২০১৭ তে conscious cognition জার্নালের আর একটি আর্টিকেল পাচ্ছি এটিও ইউরোপের একাধিক দেশের ইউনিভার্সিটি এবং গবেষনা সংস্থার মিলিত ফসল। যেখানে তাঁরা ১৫২ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখছেন NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, অর্থাৎ গ্রেইসন স্কেলের স্কোর যত বেশি, তাঁর সেই অভিজ্ঞতা লম্বা সময় ধরে মনে রাখার ক্ষমতাও তত বেশি। অর্থাৎ NDE পরবর্তী life-transforming ঘটনা ঘটার ব্যাপারটাকে এই ফলাফল কিছুটা হলেও সমর্থন করে। NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে life-transformation এর ঘটনা তত তীব্র। স্মৃতি এক্ষেত্রে পজেটিভ অনুঘটকের কাজ করে। NDE-সংক্রান্ত স্মৃতির কথা যখন উঠলোই, তখন ইতালির University of Padova Padova থেকে করা একটি স্টাডির কথা বলা যাক। আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে Frontier of human neuroscience জার্নালে। এই কাজটিতে তাঁরা EEG-র মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেন যে, NDE - র স্মৃতি, সাধারণ সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতি এবং কোনো এক কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যকারিতার কি কি পরিবর্তন হয়। এই পরীক্ষায় ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE আছে আর আরো ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের কখনো NDE র সামনাসামনি হতে হয়নি। এই পরীক্ষায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক উঠে আসে। NDE -র স্মৃতিচারণা এবং সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতিচারণের সময়ে মস্তিস্কের কার্যকলাপ দেখা যায় একই রকম। তুলনায় কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণে ঘটে মস্তিস্কের কার্যকারিতার সম্পূর্ণ আলাদা। আর্টিকেলটির লেখকদের ভাষায় বললে, " Findings showed that NDE memories were similar to real memories in terms of detail richness, self-referential, and emotional information. Moreover, NDE memories were significantly different from memories of imagined events." EEG- র ফলাফল দেখে এই আর্টিকেলের গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, NDE -র স্মৃতি কোনোমতেই কাল্পনিক কোনো ঘটনার স্মৃতির সাথে তুলনীয় নয়।
এই যে NDE-র পরে দীর্ঘ্যকালীন একটা চরিত্রগত পরিবর্তন (Long term positive life transformation) লক্ষ্য করা যায়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত যে থিওরিটি আছে সেটি হলো, এই অবস্থায় চেতনা (Consciousness) মস্তিষ্কের স্নায়বিক তন্ত্রের (Neural system) থেকে আলাদা (Detached) হয়ে যায়। কিন্তু সেটি কি করে হওয়া সম্ভব সেটি এখনো ল্যাবরেটরিতে নকল করা সম্ভব হয়নি। আর একটি থিওরি হলো, এই অভিজ্ঞতা মারাত্মক বিপদ বা প্রাণহানির সময়ে মস্তিকের অস্বাভাবিক কার্যকারিতার দ্বারা মস্তিষ্কের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচতে এর বিরুদ্ধে মস্তিষ্কেরই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। NDE -র সময়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়েছে এমন আপাতত একটিমাত্র স্টাডিই পাচ্ছি 'Critical Care' জার্নালে। ২০১০ সালের স্টাডি। স্লোভেনিয়ার তিনটি বড় হাসপাতালের ৫২ জন কার্ডিয়াক এরেস্টের রোগীর ওপর করা। যাঁদের গড় বয়স ৫৩.১ বছর এবং এই ৫২ জনের মধ্যে ৪২ জনই ছিলেন পুরুষ। এদের মধ্যে ২১.২% এর গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE ছিল। এই স্টাডিতে দেখা গিয়েছিলো, NDE আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ধমনীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আংশিক চাপ এবং রক্তে পটাশিয়াম এর ঘনত্ব বেশ বেশি যাঁদের NDE ছিল না তাঁদের তুলনায়।
তবে বড় জটিল অস্ত্রপ্রচার বা বয়স্ক মানুষদেরই এই অভিজ্ঞতা হবে তা নয়, জেনিভার ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে একটি ১২ বছরের ছেলের সাধারণ এনেস্থেসিয়া দিয়ে অতিসাধারণ অস্ত্রপ্রচার চলাকালীন তার NDE হয়। এই কেস স্টাডিটি পাচ্ছি 'Pediatric Anesthesia' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে।
আগেই বলেছি যে হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইউনিটগুলোতেই NDE-র ঘটনা সবচাইতে বেশি ঘটতে দেখা যায়।নেদারল্যান্ডের Rijnstate Hospital এর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক Dr. Pim van Lommel নেদারল্যান্ডের ১০টি হাসপাতাল থেকে ৩৪৪ জন কার্ডিয়াক এরেস্ট হওয়া মানুষ নিয়ে প্রায় আট বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্টাডি করেছিলেন যেটি ২০০১ সালে 'Lancet' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ৩৪৪ জনের মধ্যে ১৮% এর NDE ছিল। সেখানে তিনি দেখেন, কার্ডিয়াক এরেস্ট কতটা সময় ধরে হচ্ছে, কতক্ষন ধরে মানুষটি অচেতন থাকছেন, কি ধরণের ওষুধ তিনি খাচ্ছেন, মৃত্যুভয় মানুষটির মনের মধ্যে ছিল কিনা ইত্যাদি কোনো কিছুর সাথেই এই অভিজ্ঞতা হওয়া বা না হওয়ার কোনোরকম সম্পর্ক নেই।
এই Dr. Lommel ২০১১ সালে একটি রিভিউ লেখেন Annals of the New York Academy of Sciences জার্নালে। সেখানে তিনি প্রবন্ধটি আরম্ভ করেন এই বাক্যটি দিয়ে- "কার্ডিয়াক এরেস্ট হবার পর যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের বর্ণিত অভিজ্ঞতার থেকে যে সমস্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল ও সিদ্ধান্তের এতটাই মিল, যে NDE -র ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আর অবহেলা করা যাবে না।" এই প্রবন্ধে তিনি আরও সিদ্ধান্ত করেন যে, "The NDE is an authentic experience that cannot be simply reduced to imagination, fear of death, hallucination, psychosis, the use of drugs, or oxygen deficiency." অর্থাৎ NDE একটি সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। কল্পনা, মৃত্যুভয়, দৃষ্টিভ্রম, মানসিক বৈকল্য, কোনো রাসায়নিকের প্রভাব বা মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব নয়।
আপাতত NDE সংক্রান্ত গবেষণা যা পাচ্ছি তার সারাংশ মোটামুটি এইই। বাকি যা আর্টিকেল তা প্রধানত কেস স্টাডি। অর্থাৎ অস্ত্রোপ্রচারের সময় বা দুর্ঘটনা বা কার্ডিয়াক এরেস্টের সময় শরীরের বাইরে থেকে শরীরটিকে দেখতে পাওয়া বা আপনজনদের বা সামনের সমস্ত দৃশ্য দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এসম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে। তার মূল কারণ আমাদের বোধ, বিজ্ঞান, মাপজোকের যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা। তবে যেহেতু NDE একটি Life transforming event বলেই বেশিরভাগ রিপোর্ট বর্ণনা করছে এবং সেই পরিবর্তনটি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ভালোর দিকে, সেহেতু NDE-র পদ্ধতিটি ঠিকঠাক বুঝতে পারা গেলে এবং তাকে প্রয়োজন মতো induce করা সম্ভব হলে (যেমন কিনা MI-NDE-র ক্ষেত্রে মেডিটেশন দিয়ে করার কথা বলা হচ্ছে) ড্রাগ বা এলকোহল এডিকশন বা আত্মহনন মানসিকতা বা PTSD-র মতো দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরো একটি বিকল্প পদ্ধতি হলেও হতে পারে। তবে এই Alternative treatment পদ্ধতির কথা এখনই ভাবা অসম্ভব। আরো একটি অর্ধশতক বা শতক পরে হয়তো এ বিষয়ে আশা করা উচিৎ হবে।
অন্য কোনো উপায়ে NDE-র মতন কোনো অনুভূতি তৈরী করা যায় কিনা সে চেষ্টাও হয়েছে। যার একটার কথা আমি আগের দিনের প্রথম পর্বের লেখায় বলেছিলাম। সেটি হলো DMT প্রয়োগ করে কিছুটা NDE -র মতো অভিজ্ঞতা তৈরী করা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে আরো একটি মাল্টিসেন্টার স্টাডি পাচ্ছি ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির মিলিত গবেষণার ফল। প্রকাশিত হয়েছে ওই ২০১৮ তেই। এই স্টাডিটি আরো লম্বা সময় ধরে চলেছিল। প্রায় তিন বছর। এখানে উইলিয়াম ভ্যান গর্ডন এবং তাঁর সহগবেষকরা খানিকটা অদ্ভুতভাবেই NDE তৈরী (induce) করেছেন। করেছেন মেডিটেশন বা মনসংযোগ দ্বারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রাচীন বৌদ্ধপুঁথিতে এক বিশেষ পদ্ধতির মেডিটেশন এর সাহায্যে NDE তৈরি করা সম্ভব একথার উল্লেখ আছে। একে বলা যাক MI-NDE (Meditation Induced- NDE)।আধুনিককালের বৌদ্ধ মেডিটেটররা মনোসংযোগের দ্বারা আগে থেকে প্ল্যান করা সময়ে MI-NDE তৈরী করতে সমর্থ হয়েছেন। এর ফলে তাঁদের নিয়ে পরীক্ষা করলে অন্তত পরীক্ষা করার জন্য একটি মডেল পাওয়া সম্ভব হবে। এই স্টাডিতে তাঁরা ১২ জন বৌদ্ধ মেডিটেটরের ওপর পরীক্ষা করেন। সেখানে MI-NDE তৈরী করে এমন পদ্ধতির মেডিটেশন এবং তার সাথে আরো দুটি আলাদা ধরণের মেডিটেশন পদ্ধতি, যা MI-NDE পদ্ধতির কন্ট্রোল (যেমন অন্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে placebo থাকে) হিসেবে কাজ করবে এমন দুটি পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হয়। এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই স্টাডিটির ক্ষেত্রে এই যে, স্টাডিটি চলেছিল একটানা তিন বছর। অর্থাৎ, MI-NDE পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে তিনবছর ধরে একই মানুষের উদ্ভুত NDE তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে দেখা গিয়েছিলো। অন্যান্য দুটি পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে কিন্তু সেটি বাড়েনি। এই পদ্ধতিতে মেডিটেটররা নিজেদের ইচ্ছেমতো সময়ে সচেতন ভাবে NDE তৈরী করতে পেরেছিলেন। এই স্টাডিটি একটি আশার আলো দেখায় যে ভবিষ্যতে এই অ্যাডভান্স স্টেজের মেডিটেটরদের নিয়োগ করে NDE চলাকালীন সরাসরি মস্তিস্ক এবং স্নায়ুসংক্রান্ত পরিবর্তনগুলি মাপা যেতে পারে। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, এক্ষেত্রে মেডিটেটররা সচেতন যে তাঁরা NDE তৈরী করছেন, সাধারণ NDE -র ক্ষেত্রে যা হয়না। ফলে দুটি অবস্থার শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য থেকেই যায়।
২০১৭ তে conscious cognition জার্নালের আর একটি আর্টিকেল পাচ্ছি এটিও ইউরোপের একাধিক দেশের ইউনিভার্সিটি এবং গবেষনা সংস্থার মিলিত ফসল। যেখানে তাঁরা ১৫২ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখছেন NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, অর্থাৎ গ্রেইসন স্কেলের স্কোর যত বেশি, তাঁর সেই অভিজ্ঞতা লম্বা সময় ধরে মনে রাখার ক্ষমতাও তত বেশি। অর্থাৎ NDE পরবর্তী life-transforming ঘটনা ঘটার ব্যাপারটাকে এই ফলাফল কিছুটা হলেও সমর্থন করে। NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে life-transformation এর ঘটনা তত তীব্র। স্মৃতি এক্ষেত্রে পজেটিভ অনুঘটকের কাজ করে। NDE-সংক্রান্ত স্মৃতির কথা যখন উঠলোই, তখন ইতালির University of Padova Padova থেকে করা একটি স্টাডির কথা বলা যাক। আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে Frontier of human neuroscience জার্নালে। এই কাজটিতে তাঁরা EEG-র মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেন যে, NDE - র স্মৃতি, সাধারণ সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতি এবং কোনো এক কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যকারিতার কি কি পরিবর্তন হয়। এই পরীক্ষায় ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE আছে আর আরো ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের কখনো NDE র সামনাসামনি হতে হয়নি। এই পরীক্ষায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক উঠে আসে। NDE -র স্মৃতিচারণা এবং সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতিচারণের সময়ে মস্তিস্কের কার্যকলাপ দেখা যায় একই রকম। তুলনায় কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণে ঘটে মস্তিস্কের কার্যকারিতার সম্পূর্ণ আলাদা। আর্টিকেলটির লেখকদের ভাষায় বললে, " Findings showed that NDE memories were similar to real memories in terms of detail richness, self-referential, and emotional information. Moreover, NDE memories were significantly different from memories of imagined events." EEG- র ফলাফল দেখে এই আর্টিকেলের গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, NDE -র স্মৃতি কোনোমতেই কাল্পনিক কোনো ঘটনার স্মৃতির সাথে তুলনীয় নয়।
এই যে NDE-র পরে দীর্ঘ্যকালীন একটা চরিত্রগত পরিবর্তন (Long term positive life transformation) লক্ষ্য করা যায়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত যে থিওরিটি আছে সেটি হলো, এই অবস্থায় চেতনা (Consciousness) মস্তিষ্কের স্নায়বিক তন্ত্রের (Neural system) থেকে আলাদা (Detached) হয়ে যায়। কিন্তু সেটি কি করে হওয়া সম্ভব সেটি এখনো ল্যাবরেটরিতে নকল করা সম্ভব হয়নি। আর একটি থিওরি হলো, এই অভিজ্ঞতা মারাত্মক বিপদ বা প্রাণহানির সময়ে মস্তিকের অস্বাভাবিক কার্যকারিতার দ্বারা মস্তিষ্কের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচতে এর বিরুদ্ধে মস্তিষ্কেরই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। NDE -র সময়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়েছে এমন আপাতত একটিমাত্র স্টাডিই পাচ্ছি 'Critical Care' জার্নালে। ২০১০ সালের স্টাডি। স্লোভেনিয়ার তিনটি বড় হাসপাতালের ৫২ জন কার্ডিয়াক এরেস্টের রোগীর ওপর করা। যাঁদের গড় বয়স ৫৩.১ বছর এবং এই ৫২ জনের মধ্যে ৪২ জনই ছিলেন পুরুষ। এদের মধ্যে ২১.২% এর গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE ছিল। এই স্টাডিতে দেখা গিয়েছিলো, NDE আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ধমনীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আংশিক চাপ এবং রক্তে পটাশিয়াম এর ঘনত্ব বেশ বেশি যাঁদের NDE ছিল না তাঁদের তুলনায়।
তবে বড় জটিল অস্ত্রপ্রচার বা বয়স্ক মানুষদেরই এই অভিজ্ঞতা হবে তা নয়, জেনিভার ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে একটি ১২ বছরের ছেলের সাধারণ এনেস্থেসিয়া দিয়ে অতিসাধারণ অস্ত্রপ্রচার চলাকালীন তার NDE হয়। এই কেস স্টাডিটি পাচ্ছি 'Pediatric Anesthesia' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে।
আগেই বলেছি যে হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইউনিটগুলোতেই NDE-র ঘটনা সবচাইতে বেশি ঘটতে দেখা যায়।নেদারল্যান্ডের Rijnstate Hospital এর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক Dr. Pim van Lommel নেদারল্যান্ডের ১০টি হাসপাতাল থেকে ৩৪৪ জন কার্ডিয়াক এরেস্ট হওয়া মানুষ নিয়ে প্রায় আট বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্টাডি করেছিলেন যেটি ২০০১ সালে 'Lancet' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ৩৪৪ জনের মধ্যে ১৮% এর NDE ছিল। সেখানে তিনি দেখেন, কার্ডিয়াক এরেস্ট কতটা সময় ধরে হচ্ছে, কতক্ষন ধরে মানুষটি অচেতন থাকছেন, কি ধরণের ওষুধ তিনি খাচ্ছেন, মৃত্যুভয় মানুষটির মনের মধ্যে ছিল কিনা ইত্যাদি কোনো কিছুর সাথেই এই অভিজ্ঞতা হওয়া বা না হওয়ার কোনোরকম সম্পর্ক নেই।
এই Dr. Lommel ২০১১ সালে একটি রিভিউ লেখেন Annals of the New York Academy of Sciences জার্নালে। সেখানে তিনি প্রবন্ধটি আরম্ভ করেন এই বাক্যটি দিয়ে- "কার্ডিয়াক এরেস্ট হবার পর যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের বর্ণিত অভিজ্ঞতার থেকে যে সমস্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল ও সিদ্ধান্তের এতটাই মিল, যে NDE -র ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আর অবহেলা করা যাবে না।" এই প্রবন্ধে তিনি আরও সিদ্ধান্ত করেন যে, "The NDE is an authentic experience that cannot be simply reduced to imagination, fear of death, hallucination, psychosis, the use of drugs, or oxygen deficiency." অর্থাৎ NDE একটি সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। কল্পনা, মৃত্যুভয়, দৃষ্টিভ্রম, মানসিক বৈকল্য, কোনো রাসায়নিকের প্রভাব বা মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব নয়।
আপাতত NDE সংক্রান্ত গবেষণা যা পাচ্ছি তার সারাংশ মোটামুটি এইই। বাকি যা আর্টিকেল তা প্রধানত কেস স্টাডি। অর্থাৎ অস্ত্রোপ্রচারের সময় বা দুর্ঘটনা বা কার্ডিয়াক এরেস্টের সময় শরীরের বাইরে থেকে শরীরটিকে দেখতে পাওয়া বা আপনজনদের বা সামনের সমস্ত দৃশ্য দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এসম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে। তার মূল কারণ আমাদের বোধ, বিজ্ঞান, মাপজোকের যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা। তবে যেহেতু NDE একটি Life transforming event বলেই বেশিরভাগ রিপোর্ট বর্ণনা করছে এবং সেই পরিবর্তনটি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ভালোর দিকে, সেহেতু NDE-র পদ্ধতিটি ঠিকঠাক বুঝতে পারা গেলে এবং তাকে প্রয়োজন মতো induce করা সম্ভব হলে (যেমন কিনা MI-NDE-র ক্ষেত্রে মেডিটেশন দিয়ে করার কথা বলা হচ্ছে) ড্রাগ বা এলকোহল এডিকশন বা আত্মহনন মানসিকতা বা PTSD-র মতো দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরো একটি বিকল্প পদ্ধতি হলেও হতে পারে। তবে এই Alternative treatment পদ্ধতির কথা এখনই ভাবা অসম্ভব। আরো একটি অর্ধশতক বা শতক পরে হয়তো এ বিষয়ে আশা করা উচিৎ হবে।
আজ এপর্যন্তই।
ভালো থাকবেন।
অর্পিতা।