প্রিয় জানালা, গত কয়েকদিনের পর আজ তোমার গা ভর্তি রোদ্দুর। আয়তাকার শরীরের অর্ধেকটা জুড়ে নীল আকাশের ক্যানভাস। তাইতে ন্যাড়া গাছের আঁকিবুকি কাটা। আল্পনা যেন। মাঝে মাঝে দুচার জন মানুষ চলেছেন সাথে পোষ্য নিয়ে। কোথাও কোনো বিরুদ্ধতা নেই যেন। তাই না? সুন্দর একটি অলস দিন। অথচ তুমি জানো প্রিয় জানালা, কি ভীষণ বিরুদ্ধতায় দিন কাটছে আমাদের সক্কলের। অসুস্থতার আর মৃত্যুভয়ে বসুন্ধরা জর্জরিত। আরো বেশি অস্থিরতা যেন অনিশ্চয়তায়। কবে শেষ হবে এই বিরুদ্ধতার? আমার অসুখ আর সুস্থতার মাঝে তুমি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছো আজ প্রিয় জানালা আমার। তোমার ভিতর দিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততুটুকুই আজ পৃথিবী। অন্ততঃ আজকের জন্য তো বটেই। মারাত্মক এক বস্তু যাকে ঠিকঠাক জীব পর্যন্ত বলা চলে না সে কিনা আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবের চলনে গমনে কঠোর এক শেকল পরিয়ে দিলে। যা কেটে বেরিয়ে পড়া মৃত্যুরই নামান্তর। কি অদ্ভুত পরিহাস শ্রেষ্ঠত্বের। এত খানি পরাজয় চোখের সামনে দেখেও তবুও সেই শ্রেষ্ঠ জীব শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে। তবুও সে অকিঞ্চিৎকর বিষয়ে অপরিসীম তর্ক করে গলা ফাটিয়ে। তবুও সে সকালের রোদে পুবমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে একবার ধন্যবাদ দেয় না যে আজকের সকালটাও সে দেখতে পাচ্ছে সে কেবল তার সৌভাগ্য বলে। এ তার পাওনার ঝুলিতে নাও থাকতে পারতো। আমার কষ্ট হয় প্রিয় জানালা আমার। মানুষের প্রতি মানুষের এত বিদ্বেষ! এতটা! মতানৈক্য হলে এমন দুর্দশার দিনেও একজন মানুষ আর একজন মানুষের প্রতি এতটা কলুষিত বাক্য ব্যবহার করতে পারে! কেবল মতের মিল হয়না বলে! এই তার শ্রেষ্ঠত্ব! এই তার স্থীর্য্য!
পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসি প্রিয় জানালা। তোমার আয়তাকার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে সকালের রোদ্দুর মেখে নিই কপালে, দুচোখে। মনে মনে বলি - হে, দিবাকর নীরোগ করো, পৃথিবীর অসুখে প্রলেপ দাও। প্রিয় জানালা, তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে বাইরের পৃথিবীর স্পর্শ নিই। গত অক্টোবর মাসে ক্ষেত থেকে কুড়িয়ে আনা ছোট ছোট কুমড়ো গুলো, যেগুলো তোমার হেপাজতে রেখে নিশ্চিন্তে ছিলাম আমি, সেগুলোকে খেলনা মনে হয় জানো। তোমার ভিতর দিয়ে পিছন থেকে আসা রোদ্দুরে কমলা আলোর একটা ছোট্ট আবহ তৈরী করে রাখে ওরা প্রতি সকালে। বাইরের অসুখে ওরাও বুঝি অসুখী। শুকিয়ে হালকা হয়ে গেছে। অসুখের ছোঁয়াচ লেগে ছত্রাক বাসা বাঁধছে ওদেরও শরীরে। আর কত কতদিন যুঝতে পারবে ওরা জানিনা। আর কতদিন পৃথিবী যুঝতে পারবে জানিনা। মরে যাওয়ার আগে রয়ে যাওয়া কাজ, থেকে যাওয়া ইচ্ছে আর ফেলে যাওয়া মানুষের মুখ। এসব কিছুই একসাথে মরণটাকে সহজ করে দেয় না যে। মরে যাওয়া ভারী কঠিন।
কবে কোন যুগ আগে তোমারই সঙ্গে গল্প করতে করতে তোমারই কোলের কাছে বসে বুঝি একটি ছবি এঁকেছিলাম। মনে আছে তোমার? সে ছবি শেষ করেছিলাম কিনা মনে পড়ে না। অসাবধানতায় তুলির ডগা থেকে খানিকটা রং গিয়ে পড়েছিল তোমারই পায়ের কাছে দেওয়ালে। তুমি বলেছিলে, "ইশ! দিলে তো খানিকটা রংকে এজন্মের সার্থকতায় না পৌঁছাতে?" দেওয়ালে সে ছবির রং আজও রয়ে গেছে। সে ক্যানভাসটা শেষ করতে ইচ্ছে করে। পুরোনো রঙের ওপরে নতুন রঙের প্রলেপ দিতে ইচ্ছে করে। অসুখ সারলে হলুদ আর কমলা রঙের বন্যা আনতে ইচ্ছে করে। ক্যানভাস জুড়ে সূর্য্য উঠবে আবার। ভারী ইচ্ছে করে। আমার সে প্রিয়জন ভারী সুন্দর একটা গাছ দিয়েছিলো আমায়। তুমি তো জানোই। তোমারই ডানদিকে রেখেছিলুম তাকে, রোদ্দুরের উষ্ণতায় স্নান করিয়ে দিতে। তখন আমার বাতাস নীরোগ ছিল। এই আকালেও তিন তিনটে পাতা গজিয়েছে তার নতুন করে। চকচকে সবুজ, গোল হয়ে গুটিয়ে আছে। ও বাড়তে চায় এখন। অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে রোজ বলে- "কই হাত পা ছড়াবার একটা বড়সড় একটা জায়গা দিলে না যে আমায়?" তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কেবল স্বান্ত্বনা দিই - "এই তো দিই, আর কটা দিন সবুর করে যা মাণিক, অসুখ খানিক উপশম হলেই......।"
প্রিয় বাতায়ন আমার, আমার ছোট্ট গাছটিকে রোদ্দুর দিয়ে, প্রাণশক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে ততদিন সুস্থ রেখো।
জীবনকে চোখের সামনে রেখে মৃত্যু যে ভারী কঠিন।
0 comments:
Post a Comment