Sunday, 12 April 2020

আলোর খোঁজে





মানুষ আটকে থাকলে তার অভিমান বাড়ে। কেন আমার পাওনা চলাফেরায় বাঁধ দেওয়া হচ্ছে সেই নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়, প্রতিবাদ করে। তারপর এই বাঁধনের ফলে তার রোজকার জীবনে যে ভীষণরকম একটা অসুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে সে বিষয়ে আশেপাশের সমস্ত লোকের অস্বস্তির কারণ হন। এই সাম্প্রতিক বাঁধন যে নিতান্তই দায় এবং কর্তব্য এটি বুঝতে খানিক সময় যায়। তারপর সেই নতুন রুটিনে মানিয়ে নেয়। বাঁধনের ঘেরাটোপের মধ্যে নিজের ভাললাগার বিষয় খুঁজে নেয়। যে কারণে জেলখানার গারদের পিছনে বসে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত বন্দিরা পর্যন্ত একসময় বুক ভরে একটি শ্বাস নিয়ে ভাবে ঠিক আছে দেখি এখানে আর কি করা যায়। বন্দীদশাতেও সে বই লেখে, গান গায়, ছবি আঁকে! মানুষ নিজের নিজের জানালা ঠিকই খুলে নেয়। কেউ আগে কেউ পরে। তার আগে পর্যন্ত একটু বেসামাল, অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয় বলে খানিক এদিক ওদিক দৌড়ে মরে এই যা! এই সত্যটি বোঝার জন্য এর চাইতে ভাল সময় বুঝি আর কোনোদিন ছিল না। প্রতিবাদ, পারস্পরিক দোষারোপ, কি করলে কি হতো এই সব বেসামাল দশা পেরিয়ে এখন কিছুটা থিতু হয়েছি আমরা। আপাতত এটুকু বেশিরভাগ মানুষের মগজে ঢুকেছে যে, এই ভাইরাসটি আর যাই হোক, "just like a flu" নিশ্চয়ই নয়। তাই একমাস যারা খানিক সতর্কতা নিচ্ছিলো তাদের দেখে যাঁরা আড়ালে বা ব্যক্তি বুঝে সামনেই ব্যাঙ্গের হাসি হেসেছিলেন তাঁরা নিজেরাই সৌভাগ্যবশতঃ সতর্ক হয়েছেন। নিজেদের সাথে সাথে আমাদেরও নিশ্চিন্ত করেছেন। 

এমতবস্থায় বেশ কিছু মানুষ কোনো কিছু পাবার আশায় না থেকে নিজেদের মতন ভেবে এমন কিছু কাজ করছেন যা কিছুটা হলেও এই অনিশ্চিত সময়ে আশা জাগায়। মনে হয়, মানুষের পুরোপুরি স্বার্থসর্বস্ব যন্ত্রবৎ হয়ে যেতে এখনো কিছু দেরি আছে হয়ত। সে কাজ তাঁরা হয়ত না জেনেই করছেন, সেকাজের যে বিশাল কিছু ব্যাপ্তি আছে তাও নয়, তবুও এসব ঘটনা কোথাও কিছু মানুষের কাছে বিপদের সময় আনন্দাশ্রু এনে দেয়। 

মাসখানিক আগের কথা বলছি। তখন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে মহামারী শুরু হয়েছে। নেব্রাস্কার প্রেইরীতে তখন তার ঢেউ তেমন ভাবে এসে পৌঁছায়নি। কেবল ডায়মন্ড প্রিন্সেসের এগারোজন যাত্রীকে এখানে এনে রাখা হয়েছে। এছাড়াও কয়েকজনের মধ্যে রোগ ছড়িয়েছে। কিছু মানুষ পৃথিবীর আর বাকি দেশগুলির খবরাখবর শুনে কিছুটা সতর্ক। বাকিরা সতর্ক লোকজনদের দেখে ব্যঙ্গ আর হাসির খোরাক পাচ্ছেন। এমন একটা সময় সব্জি বাজার করতে গেছি। কিনেছি বেশ কয়েকটা বড় বেগুন। দুহাত ভরে বেগুনগুলো নিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরব বলে এগোচ্ছি, সবকটা বেগুন হাত ফস্কে মেঝেতে পরে গেল। ভ্যাবলার মতো কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে তুলতে যাব বেগুন গুলো, এমনসময় আমায় অবাক করে দিয়ে এগিয়ে এলেন একজন বয়স্ক মহিলা। কম করে ষাট বছর হবেই বয়স। আমার হাতে হাত লাগিয়ে সবকটা বেগুন কুড়িয়ে নিতে সাহায্য তো করলেনই, উপরন্তু একটা প্লাস্টিক নিয়ে মুখটা খুলে দাঁড়ালেন আমার সামনে। মিষ্টি হেসে বললেন, "I washed my hands, they are clean." অর্থাৎ এই সংক্রমণের সংসারে, আমি তাঁর হাত দিয়ে কুড়িয়ে দেওয়া বেগুন এবং এখন এই প্লাস্টিকের প্যাকেটের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারি। আমি এতটাই হতভম্ব হয়েছিলাম যে একটি শুকনো ধন্যবাদ ছাড়া তাঁকে আর কিছুই বলতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এই মিডওয়েস্টে একজন ষাটোর্দ্ধ স্বর্ণকেশিনী শুভ্রবর্ণা মহিলার পক্ষে নিজে থেকে একজন ভারতীয়কে সাহায্য করা, বিশেষত তার জিনিসপত্র স্পর্শ করে, এ খুব একটা সাধারণ বিষয় নয়। তাও আবার এই সংক্রমণকালে। আমায় গুছিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। 

মা গতসপ্তাহে ফোনে বললো, অনেকদিন হয়ে গেল বাজারে গিয়ে ফল কিনতে পারে না সংক্রমণের ভয়ে। বাজারের ফলের দোকানদার অনেকদিন মাকে না দেখে কোনো একজনের হাতে প্রায় তিন সাড়ে তিন কেজি ফল পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে। যাঁদের বাড়ির সাথে যে তার বিশেষ পরিচিতি আছে অনেকদিন ধরে এমনটাও নয়। মা তাঁকে তার প্রাপ্য মূল্য পাঠিয়ে দিয়েছেন যদিও, তাও এমন সময় অযাচিত এমন উপকার, এমন ভাবে মনে রাখা, কেবল প্রয়োজন মেটায় না ভরসা যোগায়। আশার কিরণ নিয়ে আসে।      

এবার গত সপ্তাহের আর একটা ঘটনা বলি। গতসপ্তাহে UNMC মানে আমাদের ইউনিভার্সিটি ঘোষণা করলো যে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল দিকে গেলেই মাস্ক পড়তে হবে কারণ কোভিড রোগীদের ঘরের বাতাসে বেশ কিছুটা দূরেও ভাইরাসের RNA পাওয়া গিয়েছে। আমাদের মাস্ক ছাড়া একতলার লবিতেও যেতে নিষেধ করা হলো। আমরা সোজা রাস্তা ছেড়ে হাসপাতালের বাইরে দিয়ে ঘুরপথে পিছনের দরজা দিয়ে সোজা রিসার্চ বিল্ডিংয়ে ঢুকতে থাকলাম। কিন্তু সমস্যাটা হল তখন, যখন CDC ঘোষণা করলো যে, যে সমস্ত দেশে সাধারণ অবস্থায় মানুষজন সুস্থ অসুস্থ নির্বিশেষে মাস্ক ব্যবহার করেছে, সেসব দেশে সংক্রমণ কম হয়েছে। সুতরাং একটু মানুষজন বেশি থাকলেই মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। এবার সকলের মধ্যে মাস্ক জোগাড় করার জন্য একটা ব্যস্ততা দেখা গেলো। হাসপাতালের প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকলেই একটা করে মাস্ক দেয়া হতে থাকলো। অনেকে মাস্ক না থাকায় এমনিই ভয়ে ভয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলো। অনেকেই আবার নাক মুখ ঢাকলো এনিমেল হাউসে কাজ করার জন্য রক্ষিত মাস্ক দিয়ে যা সার্জিক্যাল মাস্কেরই সমতুল। হঠাৎ একদিন আমাদের ল্যাব ম্যানেজার ল্যাবের সকলের জন্য একটা করে কাপড়ের তৈরী মাস্ক নিয়ে এসে হাজির। ওর মা আমাদের ল্যাবের সকলের জন্য নতুন কাপড় কিনে বাড়িতে বানিয়ে দিয়েছেন। তারপর ভালো করে কেচে, শুকিয়ে ইস্ত্রি করে নতুন প্যাকেটে করে ওর বাবার হাত দিয়ে ঐদিন সকালে ল্যাবের নিচে পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা সবাই মিলে এই কদিন ওঁনার তৈরী ওই মাস্ক পরেই করিডোরে হাঁটাহাঁটি করলাম। সত্যি বলতে কি এটা আমি একেবারেই আশা করিনি। কেন করিনি সেসব কথা থাক। কিন্তু সমবেত বিপদ, বিশেষত যে বিপদে শুধু আমি বাঁচলে চলবে না, তুমি বাঁচলে তবে আমি বাঁচব- এমন বিপদে যে আশা না করা মানুষের কাছ থেকেও অযাচিত সাহায্য এসে পড়ে তা আর একবার দেখে অবাক হলাম। উনি আমাদের কোনোদিন দেখেননি। অথচ সকলের জন্য একটা করে মাস্ক বানিয়েছেন। কাপড়ের মাস্ক কতটা সুরক্ষা দেবে সে প্রশ্ন আসার আগে এটা মনে আসে যে, এই বিপদের দিনে ওঁনার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল উনি সেটা করেছেন।  

আর আমাদের ল্যাবের সেই কাটখোট্টা ছেলেটি, যে বাঁধাকপি সেদ্ধ আর ভেড়ার মাংস খায় আর ভিডিও গেম খেলে বাড়তি বন্ধুহীন সময় কাটায়, সে হঠাৎ করে একদিন ব্যাগ থেকে একটার পর একটা প্যাকেট বের করতে থাকে। বড় বড় জিপলক ব্যাগ, প্রতিটা ব্যাগে দুটো করে N95 লেখা মাস্ক। যা এখন অনলাইনেও পাওয়া দুষ্কর। তার দেশে জানুয়ারি মাসেই যখন মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিলো, তার ভয়াবহতা আঁচ করে সে জানুয়ারি মাসেই দুএক বাক্স এই মাস্ক কিনে রেখেছিলো। এখন আমাদের প্রয়োজনে সে ল্যাবের প্রত্যেককে দুটি করে ভাগ দিচ্ছে নিজের সুরক্ষা থেকে কাটছাঁট করে। এই ছেলেই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে একবাক্স মাস্ক পাঠিয়েছিল পঁচাত্তর ডলার শিপিং চার্জ দিয়ে। আমি শুনে বলেছিলাম- "ওরে বাবা সে তো অনেক!" সেদিন এই আপাত কাটখোট্টা ছেলেই বলেছিলো, "Sometimes money is not important to consider, now the priority is different."

হয়ত এই ছোট ছোট বিষয়গুলি অনেক মানুষের কাজে লাগার মতন কিছু নয়। কিন্তু দু পাঁচ জনের ছোট রোজকার গোষ্ঠীর মধ্যে এই ছোট ছোট যত্ন গুলিই তফাৎ তৈরী করে। ভালোবাসা আর ভরসা যোগায়। ধন্যবাদ দিয়ে এই প্রাপ্তিগুলিকে মাপা যায় না। আলোর আশায় বুক বেঁধে থাকি কেবল। মনে হয় এই তো বেঁধে বেঁধে আছি। হয়ত অলীক সুরক্ষার ভাবনা, কিন্তু তবুও কোথাও ভরসা জাগে। সামনের সোমবার থেকে দুই সপ্তাহের জন্য প্রয়োজন ছাড়া আমাদের ল্যাবে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বাড়ি থেকেই যা করার করতে হবে। নেব্রাস্কায় সংক্রমণ বাড়ছে। শুক্রবার সমস্ত কিছু গুটিয়ে বিকেলে বাড়ি ফেরার রাস্তায় দেখলাম একটি মন ভালো করা ছোট্ট জিনিস। হাসপাতালের প্রধান প্রবেশপথের পাশে ছোটখাটো ফুলের গাছের জন্য যে ছোট জায়গা গুলি করা আছে তাতে তিনটে ছোটছোট রং করা পাথর। এ জিনিস আমি আগেও দেখেছি। মাউন্ট রাসমোরের কাছে কাস্টার বলে যে ছোট শহরটি আছে আর চার্চের সামনে রাস্তায়। শহরের বাচ্চারা ছোট ছোট পাথরে রং করে তাতে ছোট নোট লিখে রাখে। সেটি থ্যাংক ইউ নোট হতে পারে বা যেকোনো পজেটিভ বার্তা। সমবেত ভাবে কোনো একটি সংস্থা বা কোনো একদল লোককে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানবার সাধারণ কিন্তু সুন্দর একটি আবেগঘন পদ্ধতি। আমাদের হাসপাতালের দরজার সামনে বাচ্চাদের হাতে রঙিন ওই তিনটুকরো পাথরের একটায় লেখা ছিল "It will be ok." অন্যটায় "Thank you." আর শেষেরটিতে শব্দহীন তিনটি রক্তিম হৃদয় কেবল। এই দুর্বিপাকে ওমাহা শহরের তিনজন মানুষ বা তিনজন ছোট শিশুর দেওয়া বার্তা এইমুহূর্তে ওমাহার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালের কর্মীদের প্রতি। মন ভরে গেল। আশা করলাম এই প্রবেশ পথ রঙিন হয়ে উঠুক আরো। সেই রং প্রবেশ করুক ভেতরের প্রতিটি মানুষের মনে। মন ভালো না থাকলে শরীর লড়াই করতে পারে না যে। এ বৈজ্ঞানিক সত্য।

সুস্থতা আসুক, সেরে উঠুক আমার দেশ। সেরে উঠুক এ শহর। সেরে উঠুক পৃথিবী। 


           

0 comments:

Post a Comment