Monday, 13 April 2020

".....now the priority is different."

".....now the priority is different."


দু এক দিন আগে হঠাৎই আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়াতে কিছুটা তুষারপাত হয়েছে। আমার ডেরা থেকে ল্যাব বিল্ডিং পর্যন্ত পৌঁছাতে মিনিট পনের সময় লাগে। এর মধ্যে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাইরে হাঁটতে  হয় বাকি পুরোটাই হাসপাতালের করিডোর ধরে হাঁটা পথ।  শীতকালে ওই পাঁচ মিনিট বাদে বাকিটা অসুবিধা হয়না বিশেষ। কিন্তু হাসপাতালের ভেতরের পথ এড়িয়ে বাইরে দিয়ে আসতে চাইলে পনের মিনিটের সোজাসাপ্টা পথটাই আরো খানিক বেড়ে যায় আর তার সাথে শীতের কামড়। গতকালও বড় কষ্ট হয়েছে কনকনে হাওয়া আর হিমাঙ্কের নিচে চলে যাওয়া তাপমাত্রায়। তাও নির্দ্বিধায় বাইরের পথটাই নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরের রাস্তা অপ্রয়োজনে এড়িয়ে চলারই নির্দেশ এসেছে গত সপ্তাহে। হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল দিকটায় গেলেই ওরা এখন একটা করে সার্জিক্যাল মাস্ক দিচ্ছে। গতসপ্তাহে এখানেই একটা রিসার্চ এর ফলাফল দেখে এই সতর্কতা নিচ্ছে ওরা। 

অথচ কয়েকসপ্তাহ আগেও কোনো কিছুই হয়নি এরকম একটা আবহাওয়া ছিল চারিদিকে। মনে আছে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমাদের ল্যাবেরই একজন ছাত্র তার সাংহাইয়ের শহরতলীর বাড়িতে কয়েক বাক্স সার্জিক্যাল মাস্ক পাঠাচ্ছিল পোস্টে। ফেডেক্সের অফিসে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। পঁচাত্তর না আটাত্তর ডলার লেগেছিলো শিপিং চার্জ। বেরিয়ে এসে বলেছিলাম "ওরে বাবা! এতো অনেক!" যে ছেলেটির সেরকম কোনো বন্ধু নেই, কোনো শখ আহ্লাদ নেই, কোনোক্রমে সেদ্ধ সবজি, মাংস, সাদা ভাত আর ফলমূল হলেই চলে যায়, সে ছেলেটি নির্দ্বিধায় বলে উঠেছিল, "Sometimes money is not important to consider, now the priority is different." এরকম একটা দার্শনিক উক্তি অমন একটা 'কিছুতেই কিছু আসে যায় না' টাইপের মানুষের মুখে গত চার বছরে সেই আমার প্রথম শোনা। অত্যন্ত অবাক হলেও, এখন বুঝতে পারি বিপদের সময় বাড়ির লোকের নিরাপত্তাটা কতটা অগ্রিম অধিকার নিয়ে আসে। তখন ওর স্বদেশেই কেবল বিপদ ছিল। আমার স্বদেশে ছিল না। তাই ও জানত, পড়তো, আপডেটেড থাকত সেই বিপদ সম্পর্কে। আমি থাকতাম না। সে বিপদ যে এদেশেও ঘাঁটি গাড়বে সে সম্পর্কে আজ থেকে দুই মাস আগেই সে ওয়াকিফহাল ছিল। সেই আসন্ন বিপদের গুরুত্ব বুঝে আগাম সতর্কতায় প্রায় তখন থেকেই হাসপাতালের বাইরে দিয়ে যাতায়াত করে। ওকে দেখে আমরা ভাবতাম 'ধুস বাড়াবাড়ি'। আসলে বিপদ যতক্ষণ না আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে, আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষতি করে, ততক্ষন আমাদের সে বিপদ সম্পর্কে যা থাকে তা মেকি সহানুভূতি, সতর্কতা নয়। আমরাও তাই তখন থেকে সতর্ক হইনি। 

আমাদের এই ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা মেডিক্যাল সেন্টার যদিও ইউনাইটেড স্টেটস এর অন্য ইউনিভার্সিটিগুলো সতর্ক হবার আগে থেকেই একটু বেশি তৎপর ছিল। তার কারণ ওই ক্রুজশীপ থেকে এদেশীয় সমস্ত যাত্রীদের এখানেই আনা হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন আর অবসারভেশন এর জন্য। গতবারে ইবোলার সময়ে এই ইউনিভার্সিটি এত ভাল কাজ করেছিল যে সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এই ইউনিভার্সিটি বেশ ভাল একটা নাম এখন। কিন্তু সেসব যাত্রীদের সাধারণের নাগালের অনেক বাইরে বহু সতর্কতায় রাখা হয়েছিল সে নিয়ে আমাদের চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। তারপর দিন বদলাতে থাকলো। পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলি বিশেষত নিউইয়র্কে মারণযজ্ঞ তখন সবে শুরু হয়েছে। আমাদের এই শহরেও ভয় আর আতংক বাড়তে থাকলো। নানা রকম খবর শুনি। জিনিসপত্র কিনে রাখতে শুরু করেছে অনেকেই। সব বন্ধ হয়ে গেলে রেঁধে খাবার জিনিস বাড়ন্ত হবে যে। কিন্তু তখনও বেশ অনেকের কাছেই ব্যাপারটা হাস্যকর নতুন একটা ব্যাপার। ফেসবুক, টুইটার ইন্সট্রাগ্রাম খুলে লোকে দেখাচ্ছে নানান মজা এই নিয়ে যে, লোকে টয়লেট সিট্ চেটে দেখাচ্ছে যে দেখো আমি কত সাহসী। আমার রোগের ভয় নেই। এদিকে সমস্ত সুপারমার্কেটে টয়লেট পেপার, কিচেন টাওয়েল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং সমস্ত রকমের ডিসিনফেক্ট্যান্ট বাড়ন্ত। একদিন বাজার করতে গিয়ে সারা শহর খুঁজে খুঁজে একটাও হ্যান্ড স্যানিটাইজার পেলাম না। আমাদের বাজার করতে যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। মোটামুটি সপ্তাহ দুয়েক রান্না-বান্না চলার মত বাজার করলাম। এটাও শুনলাম যে এখানে নাকি বন্দুক কেনার হিড়িক পরে গেছে। অর্থাৎ খাবার না পেলে আমি আমার খাবার লুঠ হবার থেকে বাঁচাতে বন্দুক কিনে রাখছি। শুনে কি প্রতিক্রিয়া আসা উচিৎ, আর কি দেখানো উচিৎ সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 

এরমধ্যে খবর পাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে পূর্বদিকের শহর গুলির রিসার্চ ল্যাব গুলো বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ মানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কিন্তু যাদের বেঞ্চে এসে কাজ না করলে হবে না তারা কি করবে? অদ্ভুত এক দোলাচল। এদিকে আমি সদ্য একটা পেপার জমা দিয়েছি। সপ্তাহ দুই পরেই তার রিভিউয়ারদের কমেন্ট আসবে। তাঁদের মতামত অনুসারে আমায় যদি আরো বেশ কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয় তাহলে আমি কি এই অবস্থায় কি করে করবো? যদিও এই অবস্থায় সকলেই সময় বাড়াচ্ছে। দেখা যাক। এদিকে ভারতেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। বাড়ির জন্য চিন্তা বাড়ছে। আমার বাড়ির অনেককেই এখনো নিয়মিত বাইরে বেরোতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে। দিনের বেলা ল্যাবে গিয়ে নানান রকম খবর পাই, সাথে নেটের খবর তো আছেই। মার্চের ষোলো তারিখে এখানে জিম, বার, নাইট ক্লাব, রেস্তোরাঁ সমস্ত কিছুর ওপর দশ জনের বেশি লোক একসাথে জড়ো হওয়া বারণ হলো। তারপর এসব কিছুই বন্ধ হয়ে গেলো। রেস্তোরাঁ থেকে যদিও খাবার অর্ডার করার অপশন এখনো খোলা আছে। তবে পাবলিক হেলথ সম্পর্কে নিজের নিজের ধারণা মেনে কেউ এটাকে বেছে নিচ্ছেন, কেউ না। সারাদিন ইউনিভার্সিটির জিমটা সরব থাকত। গমগম করত ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলা। এখন যখন জিমের পাশ দিয়ে রোজ হেঁটে আসি মনে হয় একটা মৃত্যুপুরী। তারপর আস্তে আস্তে ল্যাব বিল্ডিংয়ে রিসার্চারের সংখ্যা কমতে থাকলো। কেউ কেউ রাতের দিকে কাজ করতে শুরু করলো। কেউ খুব ভোরে এসে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে যাবার চেষ্টা করছে। আসলে যতটা মানুষের সংস্পৰ্শ এড়ানো যায়। আমাদের ল্যাবেরও সেল কালচার বা মাইক্রোস্কোপের্ ঘর গুলোতে একসাথে একজনের বেশি এখন ঢোকা বারণ। কারণ ঘরগুলো ছোট। ডিপার্মেন্টাল মিটিং গুলো জুম্ দিয়ে অনলাইনে হচ্ছে। প্রতিটা ল্যাব থেকে দুজনের নাম নিয়ে রাখা আছে এসেন্টিয়াল পার্সন হিসেবে যাতে যদি পুরোপুরি বন্ধ করতে হয় সব কিছু তাহলে এনিম্যাল হাউসের খাঁচায় রাখা ইঁদুরদের দেখাশোনা বা অন্য কিছু জরুরি প্রয়োজনে সেই দুটি মানুষ আসতে পারেন। আমাদের রিসার্চ করোনা বা সংক্রামক রোগ নিয়ে নয়। যাঁরা এই কাজ করছেন তাদের ল্যাবে এখন দিবারাত্র কাজ হচ্ছে হয়ত। মাঝে PPE র যোগান না থাকায় ব্যবহৃত PPE কি করে ডিসইনফেক্ট করে পুনরায় ব্যবহার করা যায় তার পদ্ধতি প্রকাশ করেছে আমাদের ইউনিভার্সিটি। বেশ কিছু এন্টিভাইরাল কম্পাউন্ডের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও চলছে। এত দ্রুত বায়োমেডিক্যাল রিসার্চকে আর কখনো প্রোমোট করা হয়নি আগে। সায়েন্টিস্টরা পাগলের মত কাজ করছেন। এত চেষ্টার ফল নিশ্চয়ই অতি দ্রুত সামনে আসবে। কিন্তু ততদিনে বড় বেশি প্রাণহানি হয়ে যাবে। এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। 

গত সপ্তাহেও দেখেছি মাস দু তিনের বাচ্চাকে প্র্যামে নিয়ে মা ওয়ালমার্টে বাজার করছেন। চারটি শিশুকে নিয়ে বাবামা ছুটির মুডে বাজার করতে বেরিয়েছেন। শিশুটি সবজির আইলের ধাতব পাত হাত দিয়ে ঘষে পরে সেই হাতই মুখে দিচ্ছে। আমি দেখে আতংকিত হয়েছি। মনে মনে চেয়েছি কেন মানুষের হাঁটাচলা নিয়ন্ত্রণ করা হবে না যদি তাঁর নিজের দায়িত্বশীলতা না থাকে! কিন্তু এদেশে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। ইতালির খবর শুনে শুনে হঠাৎ একদিন ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। প্যানিক। ততদিনে বিষয়টার ভয়াবহতা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। একটা ইতিহাস তৈরী হচ্ছে যার চলন্ত কুশীলব আমরা। আমাদের আজকের বর্তমান, আমাদের আজকের চিন্তাভাবনা, আমাদের আজকের আচরণ আমাদের ভবিষ্যৎ তৈরী করছে। যা প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য। যার বহুমুখী প্রভাব থাকবে প্রতিটি দেশেই। আমাদের আজকের আচরণের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির দায়ভার সেদিন নিতে পারবো তো? ভয় পাচ্ছি।

ভারতের লকডাউনের খবর পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছিলাম। যাক আমার বাড়ির লোকের আশেপাশে আসা লোকের সংখ্যা কমবে কিছুটা হলেও। কিছুটা হলেও কমবে তাঁদের অসুস্থ হবার সম্ভাবনা। এখানে কবে মানুষ সচেতন হবে জানি না। গত সপ্তাহে পার্কে অজস্র লোকে নাকি হাঁটতে, দৌড়াতে, গল্ফ খেলতে বেরিয়েছিল। ওমাহা নিউয়র্কের মত জনবহুল নয়। কিন্তু তাতেও ঝুঁকি কিছু কম নয়। নেব্রাস্কার সংখ্যাটা সরকারি ভাবে এখনো চারশোর আশেপাশে। কিন্তু বাড়তে কতক্ষণ? এই ঋতু পরিবর্তনে একটু আধটু গলা খুসখুস করলেই ভয় করছে। সারা পৃথিবীর সাথে সাথে আমরাও আশা নিয়ে আর আতংক নিয়ে বেঁচে আছি এখনো। আর বেঁচে আছি যখন, তখন যে কাজ করার জন্য বাড়ি ছেড়ে এখানে আসা, সে কাজটাই মন দিয়ে করে চলেছি প্রতিদিন। যতদিন সকালে উঠে ল্যাবে আসার সুযোগ পাচ্ছি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে, মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। এভাবে ভয়ে ভয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। কিন্তু আপাতত এই পথই রয়েছে খোলা। ".....now the priority is different."
  

এর চাইতে ভালো, এর চাইতে আলোর পথের প্রত্যাশায়।



Sunday, 12 April 2020

আলোর খোঁজে





মানুষ আটকে থাকলে তার অভিমান বাড়ে। কেন আমার পাওনা চলাফেরায় বাঁধ দেওয়া হচ্ছে সেই নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়, প্রতিবাদ করে। তারপর এই বাঁধনের ফলে তার রোজকার জীবনে যে ভীষণরকম একটা অসুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে সে বিষয়ে আশেপাশের সমস্ত লোকের অস্বস্তির কারণ হন। এই সাম্প্রতিক বাঁধন যে নিতান্তই দায় এবং কর্তব্য এটি বুঝতে খানিক সময় যায়। তারপর সেই নতুন রুটিনে মানিয়ে নেয়। বাঁধনের ঘেরাটোপের মধ্যে নিজের ভাললাগার বিষয় খুঁজে নেয়। যে কারণে জেলখানার গারদের পিছনে বসে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত বন্দিরা পর্যন্ত একসময় বুক ভরে একটি শ্বাস নিয়ে ভাবে ঠিক আছে দেখি এখানে আর কি করা যায়। বন্দীদশাতেও সে বই লেখে, গান গায়, ছবি আঁকে! মানুষ নিজের নিজের জানালা ঠিকই খুলে নেয়। কেউ আগে কেউ পরে। তার আগে পর্যন্ত একটু বেসামাল, অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয় বলে খানিক এদিক ওদিক দৌড়ে মরে এই যা! এই সত্যটি বোঝার জন্য এর চাইতে ভাল সময় বুঝি আর কোনোদিন ছিল না। প্রতিবাদ, পারস্পরিক দোষারোপ, কি করলে কি হতো এই সব বেসামাল দশা পেরিয়ে এখন কিছুটা থিতু হয়েছি আমরা। আপাতত এটুকু বেশিরভাগ মানুষের মগজে ঢুকেছে যে, এই ভাইরাসটি আর যাই হোক, "just like a flu" নিশ্চয়ই নয়। তাই একমাস যারা খানিক সতর্কতা নিচ্ছিলো তাদের দেখে যাঁরা আড়ালে বা ব্যক্তি বুঝে সামনেই ব্যাঙ্গের হাসি হেসেছিলেন তাঁরা নিজেরাই সৌভাগ্যবশতঃ সতর্ক হয়েছেন। নিজেদের সাথে সাথে আমাদেরও নিশ্চিন্ত করেছেন। 

এমতবস্থায় বেশ কিছু মানুষ কোনো কিছু পাবার আশায় না থেকে নিজেদের মতন ভেবে এমন কিছু কাজ করছেন যা কিছুটা হলেও এই অনিশ্চিত সময়ে আশা জাগায়। মনে হয়, মানুষের পুরোপুরি স্বার্থসর্বস্ব যন্ত্রবৎ হয়ে যেতে এখনো কিছু দেরি আছে হয়ত। সে কাজ তাঁরা হয়ত না জেনেই করছেন, সেকাজের যে বিশাল কিছু ব্যাপ্তি আছে তাও নয়, তবুও এসব ঘটনা কোথাও কিছু মানুষের কাছে বিপদের সময় আনন্দাশ্রু এনে দেয়। 

মাসখানিক আগের কথা বলছি। তখন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে মহামারী শুরু হয়েছে। নেব্রাস্কার প্রেইরীতে তখন তার ঢেউ তেমন ভাবে এসে পৌঁছায়নি। কেবল ডায়মন্ড প্রিন্সেসের এগারোজন যাত্রীকে এখানে এনে রাখা হয়েছে। এছাড়াও কয়েকজনের মধ্যে রোগ ছড়িয়েছে। কিছু মানুষ পৃথিবীর আর বাকি দেশগুলির খবরাখবর শুনে কিছুটা সতর্ক। বাকিরা সতর্ক লোকজনদের দেখে ব্যঙ্গ আর হাসির খোরাক পাচ্ছেন। এমন একটা সময় সব্জি বাজার করতে গেছি। কিনেছি বেশ কয়েকটা বড় বেগুন। দুহাত ভরে বেগুনগুলো নিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরব বলে এগোচ্ছি, সবকটা বেগুন হাত ফস্কে মেঝেতে পরে গেল। ভ্যাবলার মতো কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে তুলতে যাব বেগুন গুলো, এমনসময় আমায় অবাক করে দিয়ে এগিয়ে এলেন একজন বয়স্ক মহিলা। কম করে ষাট বছর হবেই বয়স। আমার হাতে হাত লাগিয়ে সবকটা বেগুন কুড়িয়ে নিতে সাহায্য তো করলেনই, উপরন্তু একটা প্লাস্টিক নিয়ে মুখটা খুলে দাঁড়ালেন আমার সামনে। মিষ্টি হেসে বললেন, "I washed my hands, they are clean." অর্থাৎ এই সংক্রমণের সংসারে, আমি তাঁর হাত দিয়ে কুড়িয়ে দেওয়া বেগুন এবং এখন এই প্লাস্টিকের প্যাকেটের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারি। আমি এতটাই হতভম্ব হয়েছিলাম যে একটি শুকনো ধন্যবাদ ছাড়া তাঁকে আর কিছুই বলতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এই মিডওয়েস্টে একজন ষাটোর্দ্ধ স্বর্ণকেশিনী শুভ্রবর্ণা মহিলার পক্ষে নিজে থেকে একজন ভারতীয়কে সাহায্য করা, বিশেষত তার জিনিসপত্র স্পর্শ করে, এ খুব একটা সাধারণ বিষয় নয়। তাও আবার এই সংক্রমণকালে। আমায় গুছিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। 

মা গতসপ্তাহে ফোনে বললো, অনেকদিন হয়ে গেল বাজারে গিয়ে ফল কিনতে পারে না সংক্রমণের ভয়ে। বাজারের ফলের দোকানদার অনেকদিন মাকে না দেখে কোনো একজনের হাতে প্রায় তিন সাড়ে তিন কেজি ফল পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে। যাঁদের বাড়ির সাথে যে তার বিশেষ পরিচিতি আছে অনেকদিন ধরে এমনটাও নয়। মা তাঁকে তার প্রাপ্য মূল্য পাঠিয়ে দিয়েছেন যদিও, তাও এমন সময় অযাচিত এমন উপকার, এমন ভাবে মনে রাখা, কেবল প্রয়োজন মেটায় না ভরসা যোগায়। আশার কিরণ নিয়ে আসে।      

এবার গত সপ্তাহের আর একটা ঘটনা বলি। গতসপ্তাহে UNMC মানে আমাদের ইউনিভার্সিটি ঘোষণা করলো যে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল দিকে গেলেই মাস্ক পড়তে হবে কারণ কোভিড রোগীদের ঘরের বাতাসে বেশ কিছুটা দূরেও ভাইরাসের RNA পাওয়া গিয়েছে। আমাদের মাস্ক ছাড়া একতলার লবিতেও যেতে নিষেধ করা হলো। আমরা সোজা রাস্তা ছেড়ে হাসপাতালের বাইরে দিয়ে ঘুরপথে পিছনের দরজা দিয়ে সোজা রিসার্চ বিল্ডিংয়ে ঢুকতে থাকলাম। কিন্তু সমস্যাটা হল তখন, যখন CDC ঘোষণা করলো যে, যে সমস্ত দেশে সাধারণ অবস্থায় মানুষজন সুস্থ অসুস্থ নির্বিশেষে মাস্ক ব্যবহার করেছে, সেসব দেশে সংক্রমণ কম হয়েছে। সুতরাং একটু মানুষজন বেশি থাকলেই মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। এবার সকলের মধ্যে মাস্ক জোগাড় করার জন্য একটা ব্যস্ততা দেখা গেলো। হাসপাতালের প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকলেই একটা করে মাস্ক দেয়া হতে থাকলো। অনেকে মাস্ক না থাকায় এমনিই ভয়ে ভয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলো। অনেকেই আবার নাক মুখ ঢাকলো এনিমেল হাউসে কাজ করার জন্য রক্ষিত মাস্ক দিয়ে যা সার্জিক্যাল মাস্কেরই সমতুল। হঠাৎ একদিন আমাদের ল্যাব ম্যানেজার ল্যাবের সকলের জন্য একটা করে কাপড়ের তৈরী মাস্ক নিয়ে এসে হাজির। ওর মা আমাদের ল্যাবের সকলের জন্য নতুন কাপড় কিনে বাড়িতে বানিয়ে দিয়েছেন। তারপর ভালো করে কেচে, শুকিয়ে ইস্ত্রি করে নতুন প্যাকেটে করে ওর বাবার হাত দিয়ে ঐদিন সকালে ল্যাবের নিচে পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা সবাই মিলে এই কদিন ওঁনার তৈরী ওই মাস্ক পরেই করিডোরে হাঁটাহাঁটি করলাম। সত্যি বলতে কি এটা আমি একেবারেই আশা করিনি। কেন করিনি সেসব কথা থাক। কিন্তু সমবেত বিপদ, বিশেষত যে বিপদে শুধু আমি বাঁচলে চলবে না, তুমি বাঁচলে তবে আমি বাঁচব- এমন বিপদে যে আশা না করা মানুষের কাছ থেকেও অযাচিত সাহায্য এসে পড়ে তা আর একবার দেখে অবাক হলাম। উনি আমাদের কোনোদিন দেখেননি। অথচ সকলের জন্য একটা করে মাস্ক বানিয়েছেন। কাপড়ের মাস্ক কতটা সুরক্ষা দেবে সে প্রশ্ন আসার আগে এটা মনে আসে যে, এই বিপদের দিনে ওঁনার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল উনি সেটা করেছেন।  

আর আমাদের ল্যাবের সেই কাটখোট্টা ছেলেটি, যে বাঁধাকপি সেদ্ধ আর ভেড়ার মাংস খায় আর ভিডিও গেম খেলে বাড়তি বন্ধুহীন সময় কাটায়, সে হঠাৎ করে একদিন ব্যাগ থেকে একটার পর একটা প্যাকেট বের করতে থাকে। বড় বড় জিপলক ব্যাগ, প্রতিটা ব্যাগে দুটো করে N95 লেখা মাস্ক। যা এখন অনলাইনেও পাওয়া দুষ্কর। তার দেশে জানুয়ারি মাসেই যখন মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিলো, তার ভয়াবহতা আঁচ করে সে জানুয়ারি মাসেই দুএক বাক্স এই মাস্ক কিনে রেখেছিলো। এখন আমাদের প্রয়োজনে সে ল্যাবের প্রত্যেককে দুটি করে ভাগ দিচ্ছে নিজের সুরক্ষা থেকে কাটছাঁট করে। এই ছেলেই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে একবাক্স মাস্ক পাঠিয়েছিল পঁচাত্তর ডলার শিপিং চার্জ দিয়ে। আমি শুনে বলেছিলাম- "ওরে বাবা সে তো অনেক!" সেদিন এই আপাত কাটখোট্টা ছেলেই বলেছিলো, "Sometimes money is not important to consider, now the priority is different."

হয়ত এই ছোট ছোট বিষয়গুলি অনেক মানুষের কাজে লাগার মতন কিছু নয়। কিন্তু দু পাঁচ জনের ছোট রোজকার গোষ্ঠীর মধ্যে এই ছোট ছোট যত্ন গুলিই তফাৎ তৈরী করে। ভালোবাসা আর ভরসা যোগায়। ধন্যবাদ দিয়ে এই প্রাপ্তিগুলিকে মাপা যায় না। আলোর আশায় বুক বেঁধে থাকি কেবল। মনে হয় এই তো বেঁধে বেঁধে আছি। হয়ত অলীক সুরক্ষার ভাবনা, কিন্তু তবুও কোথাও ভরসা জাগে। সামনের সোমবার থেকে দুই সপ্তাহের জন্য প্রয়োজন ছাড়া আমাদের ল্যাবে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বাড়ি থেকেই যা করার করতে হবে। নেব্রাস্কায় সংক্রমণ বাড়ছে। শুক্রবার সমস্ত কিছু গুটিয়ে বিকেলে বাড়ি ফেরার রাস্তায় দেখলাম একটি মন ভালো করা ছোট্ট জিনিস। হাসপাতালের প্রধান প্রবেশপথের পাশে ছোটখাটো ফুলের গাছের জন্য যে ছোট জায়গা গুলি করা আছে তাতে তিনটে ছোটছোট রং করা পাথর। এ জিনিস আমি আগেও দেখেছি। মাউন্ট রাসমোরের কাছে কাস্টার বলে যে ছোট শহরটি আছে আর চার্চের সামনে রাস্তায়। শহরের বাচ্চারা ছোট ছোট পাথরে রং করে তাতে ছোট নোট লিখে রাখে। সেটি থ্যাংক ইউ নোট হতে পারে বা যেকোনো পজেটিভ বার্তা। সমবেত ভাবে কোনো একটি সংস্থা বা কোনো একদল লোককে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানবার সাধারণ কিন্তু সুন্দর একটি আবেগঘন পদ্ধতি। আমাদের হাসপাতালের দরজার সামনে বাচ্চাদের হাতে রঙিন ওই তিনটুকরো পাথরের একটায় লেখা ছিল "It will be ok." অন্যটায় "Thank you." আর শেষেরটিতে শব্দহীন তিনটি রক্তিম হৃদয় কেবল। এই দুর্বিপাকে ওমাহা শহরের তিনজন মানুষ বা তিনজন ছোট শিশুর দেওয়া বার্তা এইমুহূর্তে ওমাহার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালের কর্মীদের প্রতি। মন ভরে গেল। আশা করলাম এই প্রবেশ পথ রঙিন হয়ে উঠুক আরো। সেই রং প্রবেশ করুক ভেতরের প্রতিটি মানুষের মনে। মন ভালো না থাকলে শরীর লড়াই করতে পারে না যে। এ বৈজ্ঞানিক সত্য।

সুস্থতা আসুক, সেরে উঠুক আমার দেশ। সেরে উঠুক এ শহর। সেরে উঠুক পৃথিবী। 


           

Monday, 6 April 2020

প্রিয় জানালা




প্রিয় জানালা, গত কয়েকদিনের পর আজ তোমার গা ভর্তি রোদ্দুর। আয়তাকার শরীরের অর্ধেকটা জুড়ে নীল আকাশের ক্যানভাস। তাইতে ন্যাড়া গাছের আঁকিবুকি কাটা। আল্পনা যেন। মাঝে মাঝে দুচার জন মানুষ চলেছেন সাথে পোষ্য নিয়ে। কোথাও কোনো বিরুদ্ধতা নেই যেন। তাই না? সুন্দর একটি অলস দিন। অথচ তুমি জানো প্রিয় জানালা, কি ভীষণ বিরুদ্ধতায় দিন কাটছে আমাদের সক্কলের। অসুস্থতার আর মৃত্যুভয়ে বসুন্ধরা জর্জরিত। আরো বেশি অস্থিরতা যেন অনিশ্চয়তায়। কবে শেষ হবে এই বিরুদ্ধতার? আমার অসুখ আর সুস্থতার মাঝে তুমি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছো আজ প্রিয় জানালা আমার। তোমার ভিতর দিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততুটুকুই আজ পৃথিবী। অন্ততঃ আজকের জন্য তো বটেই। মারাত্মক এক বস্তু যাকে ঠিকঠাক জীব পর্যন্ত বলা চলে না সে কিনা আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবের চলনে গমনে কঠোর এক শেকল পরিয়ে দিলে। যা কেটে বেরিয়ে পড়া মৃত্যুরই নামান্তর। কি অদ্ভুত পরিহাস শ্রেষ্ঠত্বের। এত খানি পরাজয় চোখের সামনে দেখেও তবুও সেই শ্রেষ্ঠ জীব শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে। তবুও সে অকিঞ্চিৎকর বিষয়ে অপরিসীম তর্ক করে গলা ফাটিয়ে। তবুও সে সকালের রোদে পুবমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে একবার ধন্যবাদ দেয় না যে আজকের সকালটাও সে দেখতে পাচ্ছে সে কেবল তার সৌভাগ্য বলে। এ তার পাওনার ঝুলিতে নাও থাকতে পারতো। আমার কষ্ট হয় প্রিয় জানালা আমার। মানুষের প্রতি মানুষের এত বিদ্বেষ! এতটা! মতানৈক্য হলে এমন দুর্দশার দিনেও একজন মানুষ আর একজন মানুষের প্রতি এতটা কলুষিত বাক্য ব্যবহার করতে পারে! কেবল মতের মিল হয়না বলে! এই তার শ্রেষ্ঠত্ব! এই তার স্থীর্য্য!

পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসি প্রিয় জানালা। তোমার আয়তাকার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে সকালের রোদ্দুর মেখে নিই কপালে, দুচোখে। মনে মনে বলি - হে, দিবাকর নীরোগ করো, পৃথিবীর অসুখে প্রলেপ দাও। প্রিয় জানালা, তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে বাইরের পৃথিবীর স্পর্শ নিই। গত অক্টোবর মাসে ক্ষেত থেকে কুড়িয়ে আনা ছোট ছোট কুমড়ো গুলো, যেগুলো তোমার হেপাজতে রেখে নিশ্চিন্তে ছিলাম আমি, সেগুলোকে খেলনা মনে হয় জানো। তোমার ভিতর দিয়ে পিছন থেকে আসা রোদ্দুরে কমলা আলোর একটা ছোট্ট আবহ তৈরী করে রাখে ওরা প্রতি সকালে। বাইরের অসুখে ওরাও বুঝি অসুখী। শুকিয়ে হালকা হয়ে গেছে। অসুখের ছোঁয়াচ লেগে ছত্রাক বাসা বাঁধছে ওদেরও শরীরে। আর কত কতদিন যুঝতে পারবে ওরা জানিনা। আর কতদিন পৃথিবী যুঝতে পারবে জানিনা। মরে যাওয়ার আগে রয়ে যাওয়া কাজ, থেকে যাওয়া ইচ্ছে আর ফেলে যাওয়া মানুষের মুখ। এসব কিছুই একসাথে মরণটাকে সহজ করে দেয় না যে। মরে যাওয়া ভারী কঠিন। 

কবে কোন যুগ আগে তোমারই সঙ্গে গল্প করতে করতে তোমারই কোলের কাছে বসে বুঝি একটি ছবি এঁকেছিলাম। মনে আছে তোমার? সে ছবি শেষ করেছিলাম কিনা মনে পড়ে না। অসাবধানতায় তুলির ডগা থেকে খানিকটা রং গিয়ে পড়েছিল তোমারই পায়ের কাছে দেওয়ালে। তুমি বলেছিলে, "ইশ! দিলে তো খানিকটা রংকে এজন্মের সার্থকতায় না পৌঁছাতে?" দেওয়ালে সে ছবির রং আজও রয়ে গেছে। সে ক্যানভাসটা শেষ করতে ইচ্ছে করে। পুরোনো রঙের ওপরে নতুন রঙের প্রলেপ দিতে ইচ্ছে করে। অসুখ সারলে হলুদ আর কমলা রঙের বন্যা আনতে ইচ্ছে করে। ক্যানভাস জুড়ে সূর্য্য উঠবে আবার। ভারী ইচ্ছে করে। আমার সে প্রিয়জন ভারী সুন্দর একটা গাছ দিয়েছিলো আমায়। তুমি তো জানোই। তোমারই ডানদিকে রেখেছিলুম তাকে, রোদ্দুরের উষ্ণতায় স্নান করিয়ে দিতে। তখন আমার বাতাস নীরোগ ছিল। এই আকালেও তিন তিনটে পাতা গজিয়েছে তার নতুন করে। চকচকে সবুজ, গোল হয়ে গুটিয়ে আছে। ও বাড়তে চায় এখন। অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে রোজ বলে- "কই হাত পা ছড়াবার একটা বড়সড় একটা জায়গা দিলে না যে আমায়?" তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কেবল স্বান্ত্বনা দিই - "এই তো দিই, আর কটা দিন সবুর করে যা মাণিক, অসুখ খানিক উপশম হলেই......।"  

প্রিয় বাতায়ন আমার, আমার ছোট্ট গাছটিকে রোদ্দুর দিয়ে, প্রাণশক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে ততদিন সুস্থ রেখো। 

জীবনকে চোখের সামনে রেখে মৃত্যু যে ভারী কঠিন।