Monday, 21 December 2020

মহাভারত ও পাটিসাপ্টা

 

সাতসকালে কড়ে আঙ্গুলের আকারের দেড়খানি কলা, দড়কচা মার্কা ছিল বলে অর্ধেকটা ফেলে দিতে হল, আর সাথে দুটি ঘসঘসে বিস্কুট আর চা। তারপর থেকে এই যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, খাবার কথা কারো মনেই নেই যেন। একা খাবার কথা ছিল না আজকে। সুতরাং অপেক্ষা করতেই হয়। খিদের জ্বালায় দু কুঁচি শশা, গাজর চিবিয়েছি ছাগলের মত। সেসব আবার খিদের সময় অনুঘটকের কাজ করে। পেটের ভেতর ইল্বল, বাতাপি একসঙ্গে ভীমপলশ্রীর আরোহণ সেই যে শুরু করেছে তার আর অবরোহণের নামটি নাই। ইচ্ছে করে দুবাক্স খাবার একাই খেয়ে ফেলি। কিন্তু সেসব তো আর করা যায় না। পেটে কিল মেরে রোদ খাচ্ছি তাই। এমন শীতের রোদ্দুর! এমন সময় চাট্টি গরম ফুরফুরে ভাত আর পোস্তর বড়া একখানা পাওয়া গেলে, আহা রে! এই বড়া বলতে মনে পড়লো, একজনের কি যেন একটা ভাল দিনে সাথে থেকেছিলুম বলে সে বেজায় উদার হয়ে বলেছিল, “কি খাবি বল খাওয়াব।“ তা আমি বাঙালি ভোজনপটীয়সী নোলা সামলে বললুম “কদ্দিন বড়ার ঝাল খাইনি।“ এ বড়া অবশ্য বড়োলোক পোস্তর বড়া নয়। নেহাতই ডালের বড়ার ঝাল। এ জিনিস আমি শয়নে-স্বপনে- জাগরণে সর্বদাই খেতে পারি। করে খাওয়ানোর লোক পাওয়া ইদানিং দুস্কর বলে মাঝে মধ্যে বিরহ অসহ্য হলে নিজেই নিজের জন্য বানিয়ে খাই। তা এমন উদার “কি খাবি বল?” আবাহন শুনে স্বাভাবিক ভাবেই বড়ার ঝাল ছাড়া আর কিই বা মনে আসে! তা সে নাকি আমায় ছুটির দিনে সে জিনিস বানিয়ে খাওয়াবে বলেছিল। তারপর অবশ্য দু-দুটো ছুটির দিন কেটে গেছে। আমার বড়া এখন ডালের কৌটোর ভেতরেই বিরাজ করছে। যাক গে, পেলে ভালো নইলে বানিয়েই নেবো। এসবে কি আর আমি ডরাই, সখি! 

এই যে, বসে বসে খটমট করে টাইপ করতে করতে কটা মনের কথা কইছি, তাতেও মাঝে মধ্যে শীতের খাবার-দাবারের কথা মনে করে প্রাণটা হু হু করে উঠছে। বাড়ি গেলে ঘরে-বাইরে কতই না খাবারের অনুসঙ্গ। এই মনে কর, সকালে ডাইজেস্টিভ বিস্কুট আর চা এর বদলে সাদা সাদা ফুলকো লুচি আর ঝাল-ঝাল আলুর তরকারি, মটরশুঁটি আর ধনেপাতার অলংকারসহ। তারপর মনে কর, তার সঙ্গে যদি একখানি পন্ডিতের দোকানের নলেন গুড়ের রসগোল্লা জুটেই যায়, তাহলে তো! যাক যে যাক, এসব মনে করে বড় বড় শ্বাস বের হয়ে আসছে। কদিন ধরে পিঠে আর পাটিসাপ্টার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে প্রায় লোকজনের মনে সন্দেহই ঢুকিয়ে দিচ্ছিলুম যে নির্ঘাত এ ব্যাটার কোভিড হয়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সেদিন আর থাকতে না পেরে নিজেই কটা রেসিপি ইত্যাদি দেখে পাটিসাপ্টা বানাতে গেলুম। ভেতরের পুরটা আদতে ক্ষীরের হবার কথা। কিন্তু অত করার ধৈর্য্য থাকলে তো হয়েই যেত! এমনই মরিয়া দশা যে ফ্রিজে দুধের বোতল নেই দেখে সেটা আর দোকান থেকে আনার পর্যন্ত তর সইলো না। কফির জন্যে রাখা কফিমেটের কৌটোটা হাতে পেয়েই- 'জয়তারা, এইটাই গুলে ঢেলে দেব', বলে কানে মহাভারত গুঁজে শুরু করে দিলুম। নারকেলের গুঁড়ো, ফ্রিজে থেকে থেকে প্রায় জীবাশ্ম পর্যায়ে চলে যাওয়া একখাবলা গুড় আর খানিকটা কফিমেটের গুঁড়ো মিশিয়ে একখানা মিষ্টি মণ্ড তৈরী হলো। যেটা দেখিয়ে- এই দেখ 'পাটিসাপ্টার পুর' বললে আমার মা কেন, আমার গোপালনগরের বাড়ির বেড়ালটাও হাসবে। একবার মনে হলো যাক যা হয়েছে হয়েছে। একে নিয়ে আর উচ্চাশা করে লাভ নেই। এইটাই নাড়ুর মত পাকিয়ে খেয়ে নিই বরং। কিন্তু কানের ভেতর দিয়ে ততক্ষণে গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে অরণি, উপমন্যু আর বেদ এর পরম অধ্যবসায় আর শত প্রলোভনেও লক্ষ্যে স্থির থাকার কাহিনী। আমিও পূর্বপুরুষদের সেসব সুকীর্তির কথা শুনে সেই কুক্ষনেই ভুল করে লক্ষ্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললুম। যতক্ষণে বুঝতে পারলুম যে ভুলটা করেই ফেলেছি ততক্ষনে দেখি হাতে চালের গুঁড়ো, ময়দা-টয়দা আর ভগবান জানেন কি কি মিশিয়ে একটা ট্যালট্যালে গোলার বাটি হাতে মুখ ভেটকে দাঁড়িয়ে আছি। ইয়ারফোনে শুনি মহাভারতের ব্যাখ্যাকার বলছেন-'অনুশোচনা রাখবে না, কাজের ভালো মন্দ কিছু হয় না। কাজ কাজই।' মহাভারতেরই কোনো উপকাহিনীর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমি মাঝখানে কিছুক্ষন শুনিনি বোধহয়। তাল পাচ্ছিনা। এরপরেও ফেঁদে বসা কাজ শেষ না করলে মহাভারত রচয়িতা ঠিক পাপ দেবেন। "জয় বেদব্যাস" বলে একহাতা ওই ট্যালট্যালে বস্তুটি ফ্রাইং প্যানে ঢেলে দিয়ে আর এক হাত দিয়ে জিমন্যাস্টিকের স্টাইলে তাকে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখি সে ব্যাটা প্যানের গায়ে সেঁটে গেছে। তাকে নাড়াতে না পেরে আর এক হাতা। তারপর আরো একহাতা। এই করে যতক্ষণে ব্যাপারটা পুরো প্যানে ছড়ালো ততক্ষনে সেটা আর পাটিসাপ্টার পাতলা ফুরফুরে খোল নয়, মোটা কাঁথার মতো ধুসকো একটা কি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তারপর আর কি? সেই কাঁথার মধ্যে নারকেল গুঁড়ো, প্রাগৈতিহাসিক গুড় আর কফিমেটের মন্ডটা যত্ন করে শুইয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়ে বাক্সে তুলে দিলুম। যতই হোক, সুচিন্তা নিয়ে শুরু করা কাজ যত্ন করে শেষ করতে হয়। তার পরিণতির কথা না ভেবেই। মহাভারতে বলা আছে।  

এই সেই কাঁথায় মোড়া নারকেলের মন্ড 

  

Sunday, 20 December 2020

গপ্পগাছা

আচ্ছা খাঁদু, তুই কি সকালবেলার সদ্য নামানো তালের রস খেয়েছিস? একবার ছোটবেলায় খুব সকালে, রোদ ওঠেনি তখনও মনে আছে। কুয়াশা হয়েছিল বোধহয়। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই উঠোনের সামনেটা বুঝলি। ঝুমরোদা দেখি এক ক্যান ভর্তি তালের রস নিয়ে এসেছে। সদ্য নামানো। উফফ সে নাকি এক মহার্ঘ্য ব্যাপার। না মানে সদ্য নামানো তালের রস তো সত্যিই খুব মিষ্টি। আমার জানিস খেয়ে বিশেষ ভাল লাগেনি। তা সেকথা বলতেই তিনজনে বিস্তর অবাক হল। তখন অমন খারাপ লাগলে দুমদাম বলে দেওয়া যেত।  তিনজন মানে মা- বাবা- আর ঝুমরোদা। তারা পুরো একগ্লাস করে খেয়ে ধন্য ধন্য করছে। আর এদিকে আমার নাকে যেন বদখত একটা গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে। এমন ছাড়া ছাড়া করে বলছি তার কারণ, অমনই মনে পড়ছে। ঘটনার আগা-পাশ-তলা আর কিছুটি মনে নেই। মিষ্টি স্বাদের বাজে গন্ধওয়ালা তরলটিকে এত তোল্লাই দেওয়ার কি আছে সেটা বুঝতে না পেরে নিজের রসনাকে দোষ দেব, না আর দুচুমুক দিয়ে দেখবো সেই দোটানায় ভোম্বলের মতন দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে পড়ে। সত্যিই বেশ খারাপ খেতে লেগেছিল। আসলে কি বলত ছোটবেলায় নাক- কান- জিভ ইত্যাদি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল বুঝলি। যত দিন গেছে তত ব্যবহার না করে করে ভোঁতা করে ফেলেছি। ঐ অসাধারণ শর্করার ভাণ্ডারকে ফাঁপিয়ে সুধারস তৈরির পদ্ধতি ততক্ষনে শুরু হয়ে গিয়েছিল যার প্রাথমিক গন্ধটাই আমার নাকে এসে লেগেছিল। ছোটকালে খারাপ অনুভূতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তো থাকেই তার সাথে সাথে খারাপ কে খারাপ বলার উৎসাহও দেখেছি বেশ থাকে। এখন হলে হয়ত ওইটুকু গন্ধ নাক অবধি পৌঁছাতও না। বেশিরভাগ অপছন্দের জিনিস ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য করতে পারে এখন। বড় হয়ে যাবার এই একখানা বেজায় সুবিধা আছে বুঝলি। তুইও যখন আরও বড় হয়ে যাবি দেখবি নাকে বদ্গন্ধটন্ধ বিশেষ পাচ্ছিস না। বদবাক্য কান পর্যন্ত তেমন করে আর পৌঁছচ্ছে না। দূষিত দৃশ্য চোখ পার হয়ে মাথা পর্যন্ত যাবার পথ পাচ্ছে না। ইত্যাদি বিস্তর সুবিধা দেখবি। কেমন নিজেকে বেশ সাধক সাধক মনে হবে। খাবি, ঘুমবি আর নিজের কাজ করবি। একেবারে সরলরৈখিক জীবন। হ্যাঁ তা যা বলছিলাম। এখন মাঝে মাঝে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে জানিস, মনে কর যদি মাকে বলি, “তুমি আমায় বাচ্চা মানুষ পেয়ে জোর করে সেদিন তাড়ি খেতে বলছিলে! তারপর যদি ভাল লেগে যেত? আর কালক্রমে তাড়িখোর মাতাল হয়ে যেতুম! ও জিনিষের তো অভাব কোনোকালেই ছিল না আশেপাশে।” মনে কর, খুব গম্ভীর, আলোচনাযোগ্য পরিণত মানুষের গলায় যদি মাকে জিজ্ঞাসা করি এসব? করে দেখবো কি জবাব পাই, তারপর তোকে জানাবো। তবে কি জানিস আর কিছুটা বড় হয়ে একবার খালনা গিয়ে গুড়ের শাল থেকে অর্ধতরল তালের গুড় খাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আহা রে! সে কি ভাল! কি ভাল! তোর খালনার কথা মনে আছে? তুই গিয়েছিস বেশ কয়েকবার তোর বাবার মোটরসাইকেলে চেপে। তুই অবশ্য তখন পুঁচকে। মনে থাকার কথাও নয়। তা সে যাই হোক। খালনায় সাবেকি বাঁড়ুজ্জে বাড়ির জটলাটা থেকে বেরিয়েই বাঁয়ে ওই যে জগদ্দল দীঘির মতন পুকুরটা রে, আর তাকে পাক মেরে ইঁট বাঁধানো পায়ে চলা রাস্তাটা। সেইটে ধরে বড় রাস্তায় ওঠার আগেই ডাইনে প্রতি বছরই ওরা গুড় বানাতো জানিস। গুড় বানানোর ওই আয়তাকার জায়গাটা কি দিয়ে ওরা বানাতো সে আমি জানি না। মাটি দিয়ে? কে জানে? কি বিশাল রে বাবা! ওকে যে শাল বলে সে আমি জানতুম না। সেই আমার গুড় তৈরি দেখা। সারা পাড়া ম ম করছে গন্ধে। কি ভাল গন্ধ রে! ওই একই তালের রস থেকে তাড়ির অমন উৎকট গন্ধ আর গুড়ের ওই সুবাস! ভাবা যায়! ওই আর কি যেমন রান্না তেমন স্বাদ। আমি আর টুকুনদিদি বোধহয় ছিলুম। কিরে টুকুনদিদি তুই ছিলি তো সেদিন আমার সাথে? আর কে থাকবে ওখানে! তুইই ছিলি। দাঁড়িয়ে দেখছিলুম দেখে তারা দুজনকে দুটি ছোট বাটিতে করে গরম গুড় দিলে খেতে। ঈষদুষ্ণ গুড়ে তর্জনী ডুবিয়ে তারপর সাবধানে টপ করে পুরো আঙ্গুলটা মুখে ঢুকিয়ে দিবি, বুঝলি। তারপর আর সব ভুলে যাবি। বাটিটা ছোট ছিল বড্ড বুঝলি। তারপর আর কি, বাটি ফেরত দিয়ে দুজনে আঙ্গুল চাটতে ফিরে গেলুম আমি আমার পিসিমার বাড়ি আর টুকুনদিদি তার মামারবাড়ি। সে আর এক দারুণ মজার জায়গা ছিল তখন।

Sunday, 9 August 2020

খাঁড়ির গান-৪

খাঁড়ির গান-৪
-------------------
সেই যে বলছিলাম না, Bio-luminescence Bay দেখতে যাব বলে দুজনে দাঁড়িয়েছিলাম ভেইকোয়েসের সান বিচের প্রায়ান্ধকার নির্জনতায়। আমাদের আশাহত হতে যখন আর একটুই বাকি আছে ,তখনই  বিচের রাস্তাহীন রাস্তা দিয়ে দুটি গাড়ি এসে পৌঁছালো নির্জন সান বীচে। এপর্যন্ত তো বলেই ছিলাম। তারপরের গল্পটা বলি। সেই গাড়ি থেকে নামলো দুতিনটি পরিবার। বাচ্চারা বা কমবয়স্ক মানুষ বিশেষ নেই। প্রত্যেকেই মধ্যবয়স অতিক্রম করেছেন। ক্রমে ক্রমে আরো দু-তিনটি গাড়ি এসে পৌঁছালো। আরো কয়েকজন সহযাত্রী বাড়লো। আমরা ততক্ষণ জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি যে তাঁদের একই পথের যাত্রী। নিশ্চিন্ত হলাম। যাত্রীরা হাজির, কান্ডারীদের দেখা নেই তখনও। তারপর দেখলাম, একটি সাদা রঙের মিনিবাস, আর তার পেছনে পেছনে দুটি ট্রাক ঢুকছে। ট্রাকের পিঠে পনেরো-বিশটা কায়াক।  নিশ্চিন্ত। কান্ডারীরা এসে গেছেন। গাড়িগুলো ততক্ষণে একটা ঘাসহীন জায়গাকে পার্কিং লট বানিয়ে জটলা তৈরী করেছে। আর যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে হৈচৈ করছেন। প্রত্যেকেই জলে নামবার উপযুক্ত পোশাকে। মানে অন্তত ভিজে গেলে জুতো জামা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে এমন পোশাকে। আর আমরা দুজন আপাদমস্তক সাধারণ জিন্স- টি-শার্ট-স্নিকার। জলে পড়ে গেলে ওই ভেজা জিন্সের আর জুতোর ভারেই ডুবে যাবো। এত সব ভাবিনি আগে। যাক গে যাক, যদি জলে পড়ি, যদি জামা-জুতোর ভারে ডুবে মরি, এত সব ভেবে Bio-luminescence Bay এর থ্রিলটাকে মাটি করব এমন বোকা আমি নই। মহানন্দে স্কুটারটাকে বড় বড় গাড়িগুলোর মাঝে দাঁড় করিয়ে লক করে দিলাম। সবাইকে নাম ধরে ধরে বাসে ওঠাচ্ছে লাল জ্যাকেট পড়া একটা ছেলে। সেইসঙ্গে টাকাও কালেক্ট করে নিচ্ছে। হেলমেটগুলো নিয়ে বাসে উঠতে দেখে আমাদের বললে, "এই সব লটবহর নিয়ে নৌকা বাইবে নাকি?" তখন ব্যাপারটা বুঝিনি। "কোথায় রেখে যাব?" "বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দাও।  কেউ নেবে না তোমার হেলমেট।" সত্যি নাকি? কতক্ষণের জন্য যাব তার ঠিক নেই, অন্ধকারে পড়ে থাকবে? তার পর আমাদের আরো অবাক করে দিয়ে বললে, "গাড়ির কাঁচ খুলে গাড়ি আনলক করে দিয়ে সবাই বাসে ওঠো। শুধু টাকাকড়ি, কাগজপতি নিয়ে।" সেকি? কি বলে রে বাবা! তারপর বিষয়টা ব্যাখ্যা করলে। এখানে গাড়ি চুরির মত বড় অপরাধ করার মতন কেউ নেই। গাড়ি আনলকড থাকলেও নিয়ে কেউ পালাবে না। এইটুকু জায়গায় গাড়ি চুরি করে পালাবে কোথায়? যেটুকু হয়, সেসব ছোটোখাটো চুরি। গাড়ির কাঁচ বন্ধ থাকলে বা লকড থাকলে তারা ভাবতে পারে যে, নিশ্চয়ই দামি কিছু আছে গাড়ির ভেতরে, তাই লক করা। তখন গাড়ির কাঁচ ভাঙলেও ভাঙতে পারে। তাই ফিরে এসে গাড়ি গোটা অবস্থায় পেতে হলে, কাঁচ খুলে আনলক করে যাওয়াই শ্রেয়। সম্পূর্ণ নতুন কথা আমাদের কাছে।

যাইহোক, আমাদের গাড়িও নেই কাঁচ খোলার প্রশ্নও নেই। হেলমেটদুটো স্কুটারের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। পছন্দ মত সিটে বসে আছি। বাকিরা একে একে বাসে ওঠার পর দেখা গেল বাসের সব সিট একেবারে ভরা। আমরা ছাড়া ভারতীয় মুখ একটিও নেই। ড্রাইভার বাস ছাড়লো। লাল জ্যাকেট, বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণে দেখলাম, তার পিঠে একখানা গিটার বাঁধা। তার বাকি সঙ্গীসাথীরা ট্রাকদুটি আর তাতে বাঁধা নৌকাগুলিকে নিয়ে আগেই এগিয়ে গেছে। সান বিচের বেলাভূমি পেরিয়ে বালি বিছানো পথ অন্ধকার জঙ্গলের দিকে। পথ বলতে ঘাস হীন বালি। এতক্ষনে আমাদের বাসও চলতে শুরু করলো। বাসের ভেতরের লাইট জ্বলছে। লাল জ্যাকেট আমাদের গাইড। বললো, "আমার নাম ড্যানিয়েল। তোমরা আমায় 'ড্যান' বলতে পারো। আমি তোমাদের একটা আশ্চর্য্য জিনিষ দেখাবো যা তোমরা কখনো দেখোনি। এ আমার দেশের বিস্ময়। তবে তার আগে কয়েকটা জিনিস তোমাদের বলে নেওয়া দরকার। এমন কিছু নয়। এই কায়াক চালানোর আর এই ট্রিপের কয়েকটা সতর্কতা।" এই বলে আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাইফ জ্যাকেট দিয়ে দিলো। বললো, "বাস থেকে নেমেই এগুলো পরে নেবে। প্রত্যেকটায় একটা করে হুইসিল লাগানো আছে। দেখে নাও সকলের জ্যাকেটে আছে নাকি। না থাকলে আমায় এখনই বোলো আমি এখনই জ্যাকেট বদলে দেব।" চেক করে নিলাম। তারপর বললো, "প্রত্যেক দুই জনের জন্য একটা করে কায়াক। প্রথমজনের পিঠের দিকে মুখ করে পিছনের জন বসবে। মানে দুজনের মুখ যেন একই দিকে থাকে। কিছু সমস্যা হলে হুইসিল বাজাবে। তবে একটা কথা, হুইসিল তখনই বাজাবে, যখন তোমার  লাইফ রিস্ক দেখা দেবে। নইলে মোটেই নয়। কারণ হুইসিল শুনলেই আমি পুরো ট্রিপ ক্যান্সেল করে দেব। সুতরাং দায়িত্ব নিয়ে বাজাবে।" 

আমার চক্ষু চড়কগাছ। এ বলে কি রে? দুজনে একটা কায়াকে মানে? নিজেদেরই চালাতে হবে? এতক্ষণ দুর্দান্ত লাগছিল। এবার আমার সমস্ত উত্তেজনার বেলুন এখানে এসেই ফেটে গেল ফুস করে। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা ট্যুরিস্টের মত গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব আর আমাদের নৌকা চালাবার আলাদা লোক থাকবে। এতো দেখছি নিজেদেরই চালাতে হবে ওই প্লাস্টিকের কায়াকগুলো। তাও এই অপরিচিত অন্ধকারে। বাকি লোকেদের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা গেল না। ছোট থেকে প্রতি গরমের ছুটিতে আমরা যখন টিভিতে 'ছুটি ছুটি'  দেখেছি আর ফেলুদার গল্প পড়েছি সারা দুপুর ধরে, এই বাসের বাকিরা ঠিক সেই সময়টাতেই লেক বা নদীতে মাছ ধরেছে, কায়াকিং করেছে। তাদের কাছে কায়াকিং করা আর সাইকেল চালানো একই ব্যাপার। আর আমরা জীবনে পদ্মপুকুরে কলার ভেলাও নিজে হাতে চালাইনি। যদিও একবার অন্যের ভরসায় উঠে পদ্মপুকুরে সেযাত্রা সলিল সমাধি হতে বসেছিল প্রায়। আমার বুক ধুকপুক করতে লাগলো। আর এই কায়াকগুলো শুনেছি মহাবদ। দুই মাঝির হাতের দাঁড়ের ছন্দের এদিক ওদিক হলে দিব্বি কাত হয়ে হেলে পড়ে একদিকে। ভিডিও দেখেছি কত। আর কাত হলে দুজনেই যে টুপ্ করে জলে খসে পড়ব সে বিষয়ে নিশ্চিত। পিনাকী সাঁতার পর্যন্ত জানে না। ফলে ওই দুমনি শরীর যে ওই তুশ্চু লাইফ জ্যাকেটে ভাসবে না এ বিষয়েও আমি একশভাগ নিশ্চিত। আর আমি সাঁতার জেনেই বা কি করব? এ কি আমার পদ্মপুকুর বা সিংদের পুকুরে সাঁতার দেওয়া নাকি? mosquito bay এর একদিক ক্যারাবিয়ান উপসাগরে যুক্ত। সোজা ভাসতে ভাসতে দিক ভুল হয়ে সেদিকে গিয়ে পড়লেই মায়ের সাধের একমাত্র মেয়েটির গঙ্গা (সাগর) প্রাপ্তি ঘটবে। আর এই ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দিকভুল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। 

হাতে একটা ছোট্ট জলের বোতল ছিল, কোঁৎ কোঁৎ করে অর্ধেক জল খেয়ে বাকিটা পিনাকীর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে দেখি বলছে, "আরে দাঁড়ানা, দেখছি।" দেখার আর আছেটা কি? এখন সান বিচ থেকে জঙ্গলের ভেতর চলে এসেছি বেশ কিছুটা। টর্চ নেই। এখানে বাস থামিয়ে নেমে পড়লেও পিছনে ফেরাটা মুশকিল। এমন সময় শুনি ড্যানিয়েল বলছে, "সবার সব কিছু পরিষ্কার? কারো কোনো প্রশ্ন আছে?" সবাই উল্লাস ধ্বনি দিয়ে জানিয়ে দিলো সবাই এক্কেবারে রেডি। আমাদের মুখ দেখে ড্যানিয়েল কিছু বুঝতে পেরেছিলো কিনা জানিনা। জিজ্ঞাসা করলে, "এখানে কায়াক একবারও চালায়নি এমন কেউ আছে?" সটান হাত তুলে দিলাম। এটা দেখে যদি আমাদের ওর সাথে একটা বড় বোটে নিয়ে নেয়। আমাদের হাত তোলা দেখে বাস সুদ্ধ সবকটা মুন্ডু দেখি আমাদের দিকে ঘুরে গেছে। অবাক বিস্ময় প্রতি জোড়া চোখে। যেন দুটো মঙ্গল গ্রহের জীব এইমাত্র এই মিনিবাসের সিটে উঠে বসেছে। আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা হচ্ছিল না তাতে অবশ্য। প্রাণের চেয়ে লজ্জা অনেক পরের ব্যাপার। ড্যানিয়েল দেখলাম দুসারি ধপধপে দাঁত বের করে হেসে বলছে-" আরে কোনো ব্যাপারই নয় কায়াক বাওয়া। ডানদিকে যেতে গেলে বাঁদিকে দাঁড় বাইবে, আর বাঁদিকে যেতে গেলে ডানদিকে। বুঝলে?" বোঝার কিছু ছিল না। তারপরে আরো অনেককিছু বলছিলো। আমরাও ঢকঢক করে মাথা নাড়ছিলাম। আমাদের আশ্বস্ত করতে শেষকালে ড্যানিয়েল বললে, "মনে রেখো, কায়াক হচ্ছে রাগী বাবার মতন। বেমক্কা নাড়াবে না একদম। নাড়ালেই তোমার সমস্যা। সামলাতে না পারলে দাঁড় তুলে নেবে জল থেকে। দেখবে নিজেই শান্ত হয়ে গেছে?" ছোটবেলায় কিছু অকাজ করার পর সামনে বাবার মুখটা মনে করে বাসের হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম। বাস ততক্ষনে জঙ্গলের মধ্যে কাঁচা রাস্তায় ঢেউ এর মতন নড়তে নড়তে চলেছে। রাস্তাই তো নেই। অন্ধকার এমন যেন ছুরি দিয়ে কাটা যাবে। যা থাকে কপালে আজ, হয় কায়াক চালানো শিখব আর পুরো অভিজ্ঞতাটা সঞ্চয় করব। নয়ত জলে পড়লে সাঁতার দিয়ে পাড়ে উঠব। উদ্বেগটা কেবল পিনাকীকে নিয়ে। ওকে ফিসফিস করে বললাম, "দেখ, কোনো এক্সিডেন্ট হলে কায়াকটাকে ছাড়বি না, হ্যাঁ। প্রানপনে ধরে থাকবি। ওটা ডুববে না। ওটা ধরে ভেসে থাকবি।" সে দেখি হুঁ-হাঁ করে অর্ধেক শুনলো, অর্ধেক শুনলো না। 

মিনিট পনের-কুড়ি পরে বাস আমাদের নামিয়ে দিল একটা অপেক্ষাকৃত চওড়া জায়গায়। সেখানে ট্রাকগুলোও দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়েছি বাসে বসেই। ড্যানিয়েল আর তার বন্ধুদলের টর্চের আলোয় আমরা আস্তে আস্তে জঙ্গলের সুঁড়িপথ বেয়ে জলের ধারে এসে পৌঁছোলাম। এতক্ষণে অন্ধকারটা একটু পরিষ্কার হলো। আমাদের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটু কম অন্ধকার। ঐটিই mosquito bay। অন্ধকারে চোখটা সয়ে আসতে দেখি, কায়াকগুলো জলের ধার ঘেঁষে পরপর রাখা। এখানে এসে ড্যানিয়েল আমাদের থামালো। বললো, "দেখো আকাশে মেঘ আছে, তাই অন্ধকারটা বেশি। সেটা একদিক থেকে ভালোই। অন্ধকার বেশি থাকলে জলের আলো বেশি উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাব আমরা। কিন্তু একেবারেই চাঁদ না উঠলেও মুশকিল। একটুও আলো না থাকলে আবার বিশেষ কিছু দেখা যায়না।" সেই শুনে কেউ একজন উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "তাহলে! মেঘ না সরলে? চাঁদ একেবারেই দেখা না দেয় যদি?" ড্যানিয়েল মজার গলায় হাসল। বললে, "বন্ধু, কিছু চিন্তা কোরো না। তোমাদের সাথে আছে ড্যান। আমি গান গাইলেই মেঘ সরে যায়। এই দেখছো না গিটার এনেছি তো সেজন্যই।" বলে হা হা করে হাসলে।

তারপর বললে, "নাও এবার দুজন দুজন করে কায়াক নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। আমি এক এক করে নাম্বার দেব কায়াক গুলোর। নিজেদের নাম্বার মনে রাখবে। জলে নেমে সোজা যাবে। ডানদিকে বেশি যাবে না।  ডানদিকে দেখবে কিছুদূরে গেলেই কতগুলো বয়া ভাসছে। ওটা সীমানা। ওর ওপারে যাওয়া মানা।  ওদিকে কিন্তু একদম যাবে না। তাহলে সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। আর বেশি ধার ঘেঁষেও যাবে না।  তাহলে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ফাঁকে আটকে যেতে পারো। মাঝামাঝি থাকবে। জলে হাত বা দাঁড় দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করবে তারপর দেখবে ম্যাজিক। আমি মাঝে একবার রোলকলের মত নাম্বার কল করব। তখন হাজিরা দিও চেঁচিয়ে। কারো কিছু প্রশ্ন আছে?" কারো কোনো প্রশ্ন ছিল না। আমরাই জলে নামার জন্য নিশপিশ করছি। বাকিরা তো করবেনই। ড্যানিয়েল বললে, "নাম্বার ওয়ান কায়াকে কারা যাচ্ছে তবে?" দুজন এগিয়ে গেলেন। ড্যানিয়েল বললো, একবার দেখাও দেখি তোমদের হুইসিল বাজছে কেমন।" তাঁরা দুজনেই বাজিয়ে দেখালেন। ড্যানিয়েল নিশ্চিন্ত হয়ে দুটি দাঁড় তাঁদের হাতে দিয়ে দিলে। তাঁরা এগিয়ে যেতেই ড্যানিয়েলের বন্ধুরা একটা কায়াক হাঁটুজলে নামালো টেনে। আবছা আলো আঁধারিতে চোখ সয়ে এসেছে। তাঁরা যতক্ষণ উঠছিলেন কায়াকটায়, ড্যানিয়েলের বন্ধুরা ধরে রইল টলমলে প্লাষ্টিকের শালতিটাকে। তারপর তাঁরা থিতু হয়ে বসতেই, "গুডলাক" বলে জলের দিকে ঠেলে দিল কায়াকটাকে। 

এরকম করে আরো কয়েকটা কায়াকের যাওয়া দেখলাম। উঠে বসার পদ্ধতিটি দেখার চেষ্টা করছি।ড্যানিয়েল প্রত্যেকটি কায়াকের নাম্বার দিচ্ছে আর প্রত্যেকটি বাঁশি বাজচ্ছে কিনা পরীক্ষা করে তারপর দাঁড় দিচ্ছে হাতে। একসময় আমরা এগিয়ে গেলাম সাহস করে। আমাদের নম্বর ছয়। আমাদের বাঁশি পরীক্ষা হলো। কিন্তু তারপরেই দাঁড় দিলো না হাতে আমাদের। পিনাকীর পিঠে একটা সাহসের থাবড়া মেরে বললে, "কোনো চিন্তা নেই, এনজয় কোরো। শুধু একটা কথা মনে রেখো, বেশি দোলাবে না কায়াককে। বললাম না, একদম রাগী বাবাদের মত হয়। না ঘাঁটালেই আর কোনো সমস্যা নেই।" এই বলে দুজনের হাতে দুটো দাঁড় দিয়ে দিলে। আমরাও গুটি গুটি পায়ে জলের ধারে এগিয়ে গেলাম। আমাদের নাও প্রস্তুত। ছপছপ করে জলে নেমে পড়লাম বুক ঠুকে। কি আর হবে?  ডুবে যাওয়া অতই সহজ নাকি? ততক্ষণে পায়ের জুতোর ভেতর দুকলসি জল, আর জিন্স হাঁটু পর্যন্ত ভেজা। ওসবের মায়া আমি কোনো কালেই করি না বেড়াতে বেরোলে। ভিজেছে, আবার শুকিয়ে যাবেখন। টলমল করে উঠে বসলাম। পিনাকী সামনে, আমি পিছনের পাটাতনে। মা দুগ্গার ত্রিশুল ধরার ভঙ্গিতে বাগিয়ে ধরেছি দাঁড়টা। "ঠিক আছে?" "হ্যাঁ " বলে উত্তর দিতে না দিতেই একধাক্কায় দেখ না দেখ ওই একফালি প্লাস্টিকের নৌকা সোজা বেশ কয়েক হাত জলে। বুকটা দুড়দাড়িয়ে উঠলো। 

সামনে তিনদিকে ঘন জঙ্গল আর উঁচু পাহাড়ি দ্বীপভূমি। নিঝুম পাহারাদারের মত এই অলীক আলোর খাঁড়িকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কালো জল। রাতের সমুদ্রের হাওয়ায় ভেজা প্যান্ট- জুতো-মোজা থেকে শিরশিরিয়ে ঠান্ডা উঠছে। গভীর এক জলজঙ্গলের মাঝে, বিশাল এক উপসাগরের বিশাল এক খাঁড়িতে, রাতের মেঘলা আকাশ ভেদ করে আসা আবছা আলোয় দুই আনকোরা মাঝির হাতে অচেনা এক নৌকা। চালাতে শিখতে হবে আগে, তারপর যে সৌন্দর্য্যের খোঁজে এসেছি সেটির সন্ধান করতে হবে। 

পিনাকী সামনে থেকে জিজ্ঞাসা করল, "রেডি?" একবুক বাতাস টেনে নিয়ে বললাম, "রেডি।" 

Thursday, 30 July 2020

স্বীকৃতি


স্বীকৃতি

এই গত মাস চার-পাঁচে প্রতিটি মানুষেরই জীবন বদলেছে কিছুটা হলেও। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছিল আমাদের। অর্থাৎ হাতে ইমার্জেন্সি ওয়ার্কার লেখা একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল-হাতে ধরে করতে হবে এমন নতুন এক্সপেরিমেন্ট শুরু কোরো না। পুরোনোগুলো শেষ করার জন্য যেমন যেমন আসতে হবে তেমন তেমন সময়ে এসে শেষ করো। আর বাকি লেখালেখি বা ডেটা এনালাইসিস এর কাজ ঘরে বসেই করো। সেই মতো সপ্তাহদুয়েক বাড়িতে থেকে কাজ করলাম। প্রতিদিন সকালে কাজের ফিরিস্তি দিতে হতো ইমেইলে। সাপ্তাহিক মিটিংগুলো যেমন চলার চলছিল। তফাৎটা শুধু বাড়ি থেকেই জ্যুমের মাধ্যমে সারা যাচ্ছিলো। তারপর আরো সপ্তাহ দুয়েক সকাল আর বিকেলের শিফটিং ডিউটির মত করে ল্যাব মেম্বারদের মধ্যে কাজের সময় ভাগ করে দেওয়া হলো। যাতে সকলে একই সময়ে ল্যাবে গিয়ে জড়ো হতে না পারে। অর্ধেক সময় কাজ করা যাবে। এই সময় থেকেই আবার নতুন এক্সপেরিমেন্টগুলো করার বাধা থাকলো না। ফলে কাজ এগোতে থাকলো আস্তে আস্তে। তারপর গত সপ্তাহ থেকে ইউনিভার্সিটির 'বাড়িতে থেকে কাজ' করার পলিসি বন্ধ হতে আমরা সাধারণ সময় অনুসারেই সকাল সকাল ল্যাবে গিয়ে পূর্ণ উদ্যমে আমাদের কাজ করছি। তবে সারাদিনই সকলের মুখেই মাস্ক। এবং ক্যাফেটেরিয়াতে বসে খাওয়া বা সেমিনার হলে বসে সেমিনার শোনা এসব সঙ্গত কারণেই বন্ধ। কাজ থেমে নেই কোথাওই। আমাদের ল্যাব থেকেই এর মধ্যেই জ্যুমের মাধ্যমে একজন পিএইচডি থিসিস ডিফেন্ড করে ডিগ্রি পেলো। তিন তিনটি রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশিত হলো।   

ওই অর্ধেক সময় কাজ করার অনুমতি পাওয়া গেলো যখন, তখনকার একটি ঘটনা বলি। কাজ সেরে বিকেলে বেরিয়েছি বিল্ডিং এর পিছনের দরজাটা দিয়ে। এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডাইনে গেলে হাসপাতালের এমার্জেন্সি। তার সামনের রাস্তাটা, যেটা বাঁয়ে একটা নব্বই ডিগ্রী মোচড় দিয়ে সোজা বড় রাস্তায় মিশেছে, সেটি গত দুই মাস বন্ধ। সে জায়গায় সম্ভাব্য কোভিড রোগীদের টেস্টিং এর জন্য স্যাম্পল কালেকশনের অস্থায়ী তাঁবু খাটানো হয়েছে। ফলে ঐরাস্তা দিয়ে আপাতত বড় রাস্তায় গিয়ে পড়া যায় না। আর দরজা থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে গেলে হাসপাতালের প্রধান দরজার সামনে দিয়ে বাড়ির দিকে আসার হাঁটাপথ। সেদিনও বাড়ি ফেরার জন্য সেই পথেই পা বাড়িয়েছিলাম। সামনে থেকে আসছিলেন দুজন বয়স্ক মহিলা। একটু অবাক হয়েছিলাম, ঐদিকের রাস্তা তো আপাতত বন্ধ, তাহলে ওঁনারা যাচ্ছেন কোথায়! ভাবতে ভাবতেই বন্ধ রাস্তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ওঁদের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ঐদিক দিয়ে ওঁনারা বড় রাস্তায় পৌঁছাতে পারবেন কি না। হাসপাতালের সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঐদিকে হেঁটে যাবার চেষ্টা করছিলেন বোঝাই যাচ্ছিলো। বললাম, যে ঐদিকের রাস্তা আপাতত বন্ধ। কারণটাও বুঝিয়ে বললাম। তারপর দুজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কি রিসার্চ পার্সন? ল্যাবে কাজ করো?" মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে নিজের পথে পা বাড়াতেই হঠাৎ একটা এমন কথা শুনলাম যার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বলে উঠলেন, "I owe you." "আমি তোমার কাছে ঋণী।" আমি জিজ্ঞাসু চোখে ঘুরে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, "তোমরা দিনরাত্রি কাজ করছো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য। তোমাদের আন্তরিক চেষ্টার জন্যই তো এতো মানুষ আশার আলো দেখছে।" অর্থাৎ কোভিডের ভ্যাকসিন বা এন্টিভাইরাল ড্রাগ তৈরী করার চেষ্টার জন্য এত রিসার্চ হচ্ছে, আর আমি একজন রিসার্চার তাই আমার মায়ের বয়সী একজন মানুষ আমায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। 

আমি ভাইরোলজিস্ট  নই, একজন ক্যান্সার রিসার্চার। আমি কোনো মতেই সরাসরি এই কৃতজ্ঞতার দাবিদার হতে পারিনা। কিন্তু তবুও সেদিন কিছুই বলতে পারিনি। নন-রিসার্চ পার্সনের কাছ থেকে কোনো রিসার্চার সরাসরি কোনোদিন তাঁর কাজের জন্য যথাযথ মর্যাদা বা স্বীকৃতি পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অফিসিয়াল স্টাফরা পর্যন্ত রিসার্চারদের কাজের প্রতি উদাসীন। এ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলছে। আমাদের বাড়ির লোকজন পর্যন্ত জানার চেষ্টা করেন না আমরা ঠিক কি করি। বায়োয়োমেডিক্যাল রিসার্চের প্রতি  চিকিৎসকদের যতখানি ওয়াকিফহাল থাকা প্রয়োজন আমাদের দেশে ঠিক ততখানিই উদাসীনতা দেখে আমরা অভ্যস্ত। উদাসীনতা, হতশ্রদ্ধা, আশাহীনতা, ফান্ডিং না থাকা এমন কি ঠিক সময়ে ফেলোশিপ না পাওয়াটা পর্যন্ত এতটাই সাধারণ ঘটনা আমাদের কাছে, যে উপরোক্ত ঘটনাটিতে আমি বেমালুম বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। আমি কেবল একজন রিসার্চার বলে একজন মানুষ আমায় তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এটি আদ্যন্ত নতুন ঘটনা আমার কাছে! শ্রদ্ধায় মাথা নামিয়ে চলে এসেছিলাম সেদিন। 

অনেকদিন হলো ভাইরাস নিয়ে ঘর করতে করতে মানুষের ভয় কমে গেছে। আমাদের দেশের মতো এখানেও মানুষ আর সুরক্ষাবলয় মানছেন না। বর্ণবিদ্বেষবিরোধী জনসমাবেশে, শপিং সেন্টারগুলোতে মাস্ক পরিহিত মানুষের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। ফলে ভাইরাসও তার প্রয়োজন মতো বংশবিস্তার করছে। অদূর ভবিষ্যতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সমস্ত ধাপ পেরিয়ে মানুষের দেহে ব্যবহারযোগ্য সুরক্ষিত ভ্যাকসিন আসতে চলেছে কিনা জানিনা। ভারতবর্ষে কোভিডের প্রকোপ কবে কমবে জানিনা। তবে কোভিড- ১৯ সেদিন রিসার্চার গোষ্ঠীর অন্ততঃ একজন মানুষকে আনন্দে কাঁদিয়েছিল। সারা পৃথিবীর সমস্ত ভাইরোলজিস্টদের আমি তাঁদের প্রাপ্য সেই মর্যাদাটুকু এই লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চাই। এই স্বীকৃতিটুকু নিশ্চয়ই তাঁদের প্রাপ্য। অনন্ত উদাসীনতার মাঝেও অন্ততঃ দু একজন মানুষও যে মনে রেখেছেন এই ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানকর্মীদের কথা, এটুকুই এখন অনেকদিনের অক্সিজেন হয়ে থাকবে।

অর্পিতা চ্যাটার্জী
ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা মেডিকেল সেন্টার
ওমাহা, নেব্রাস্কা
ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা
9th June, 2020


Saturday, 27 June 2020

Near Death Experience - 2

যে কথা বলছিলাম আগের দিন, 'Near death experience' বা 'NDE' সংক্রান্ত গবেষণার কথা। কিন্তু এই বিষয়ে গবেষণার প্রধান সমস্যাটা হলো, মডেল। অর্থাৎ, প্রায় মারা যেতে যেতে ফিরে আসছেন এরকম কোনো মানুষ গবেষকরা কোথায় পাবেন? যখন পাবেন তখন তাঁদের NDE অভিজ্ঞতা চলাকালীন মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়বিক কার্যকলাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। যদিও NDE- কে বর্তমানের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সংক্রান্ত জ্ঞান দ্বারা বিচার করা, ব্যাখ্যা করা যে অসম্ভব তা বহু গবেষক বা চিকিৎসকই বলেছেন, তবুও ওই সময়ে মস্তিষ্কে বা স্নায়বিক কার্যকলাপে অন্তত কি পরিবর্তন হয় সেটি মাপা যেত যদি অভিজ্ঞতা চলাকালীন পরীক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দ্বারা সুস্থ ভলেন্টিয়াকে প্রায় তিনি মারা যাচ্ছেন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে একটি মডেল তৈরি চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তা আসল ব্যাপারের অনেকটাই দূর দিয়ে গেছে। 

অন্য কোনো উপায়ে NDE-র মতন কোনো অনুভূতি তৈরী করা যায় কিনা সে চেষ্টাও হয়েছে। যার একটার কথা আমি আগের দিনের প্রথম পর্বের লেখায় বলেছিলাম। সেটি হলো DMT প্রয়োগ করে কিছুটা NDE -র মতো অভিজ্ঞতা তৈরী করা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে আরো একটি মাল্টিসেন্টার স্টাডি পাচ্ছি ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির মিলিত গবেষণার ফল। প্রকাশিত হয়েছে ওই ২০১৮ তেই। এই স্টাডিটি আরো লম্বা সময় ধরে চলেছিল। প্রায় তিন বছর। এখানে উইলিয়াম ভ্যান গর্ডন এবং তাঁর সহগবেষকরা খানিকটা অদ্ভুতভাবেই NDE তৈরী (induce) করেছেন। করেছেন মেডিটেশন বা মনসংযোগ দ্বারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রাচীন বৌদ্ধপুঁথিতে এক বিশেষ পদ্ধতির মেডিটেশন এর সাহায্যে NDE তৈরি করা সম্ভব একথার উল্লেখ আছে। একে বলা যাক MI-NDE (Meditation Induced- NDE)আধুনিককালের বৌদ্ধ মেডিটেটররা মনোসংযোগের দ্বারা আগে থেকে প্ল্যান করা সময়ে MI-NDE তৈরী করতে সমর্থ হয়েছেন। এর ফলে তাঁদের নিয়ে পরীক্ষা করলে অন্তত পরীক্ষা করার জন্য একটি মডেল পাওয়া সম্ভব হবে। এই স্টাডিতে তাঁরা ১২ জন বৌদ্ধ মেডিটেটরের ওপর পরীক্ষা করেন। সেখানে MI-NDE তৈরী করে এমন পদ্ধতির মেডিটেশন এবং তার সাথে আরো দুটি আলাদা ধরণের মেডিটেশন পদ্ধতি, যা MI-NDE পদ্ধতির কন্ট্রোল (যেমন অন্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে placebo থাকে) হিসেবে কাজ করবে এমন দুটি পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হয়। এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই স্টাডিটির ক্ষেত্রে এই যে, স্টাডিটি চলেছিল একটানা তিন বছর। অর্থাৎ, MI-NDE পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে তিনবছর ধরে একই মানুষের উদ্ভুত NDE তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে দেখা গিয়েছিলো। অন্যান্য দুটি পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে কিন্তু সেটি বাড়েনি। এই পদ্ধতিতে মেডিটেটররা নিজেদের ইচ্ছেমতো সময়ে সচেতন ভাবে NDE তৈরী করতে পেরেছিলেন। এই স্টাডিটি একটি আশার আলো দেখায় যে ভবিষ্যতে এই অ্যাডভান্স স্টেজের মেডিটেটরদের নিয়োগ করে NDE চলাকালীন সরাসরি মস্তিস্ক এবং স্নায়ুসংক্রান্ত পরিবর্তনগুলি মাপা যেতে পারে। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, এক্ষেত্রে মেডিটেটররা সচেতন যে তাঁরা NDE তৈরী করছেন, সাধারণ NDE -র ক্ষেত্রে যা হয়না। ফলে দুটি অবস্থার শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য থেকেই যায়। 

২০১৭ তে conscious cognition জার্নালের আর একটি আর্টিকেল পাচ্ছি এটিও ইউরোপের একাধিক দেশের ইউনিভার্সিটি এবং গবেষনা সংস্থার মিলিত ফসল। যেখানে তাঁরা ১৫২ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখছেন NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, অর্থাৎ গ্রেইসন স্কেলের স্কোর যত বেশি, তাঁর সেই অভিজ্ঞতা লম্বা সময় ধরে মনে রাখার ক্ষমতাও তত বেশি। অর্থাৎ NDE পরবর্তী life-transforming ঘটনা ঘটার ব্যাপারটাকে এই ফলাফল কিছুটা হলেও সমর্থন করে। NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে life-transformation এর ঘটনা তত তীব্র। স্মৃতি এক্ষেত্রে পজেটিভ অনুঘটকের কাজ করে। NDE-সংক্রান্ত স্মৃতির কথা যখন উঠলোই, তখন ইতালির University of Padova Padova থেকে করা একটি স্টাডির কথা বলা যাক। আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে Frontier of human neuroscience জার্নালে। এই কাজটিতে তাঁরা EEG-র মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেন যে, NDE - র স্মৃতি, সাধারণ সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতি এবং কোনো এক কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যকারিতার কি কি পরিবর্তন হয়। এই পরীক্ষায় ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE আছে আর আরো ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের কখনো NDE র সামনাসামনি হতে হয়নি। এই পরীক্ষায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক উঠে আসে। NDE -র স্মৃতিচারণা এবং সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতিচারণের সময়ে মস্তিস্কের কার্যকলাপ দেখা যায় একই রকম। তুলনায় কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণে ঘটে মস্তিস্কের কার্যকারিতার সম্পূর্ণ আলাদা। আর্টিকেলটির লেখকদের ভাষায় বললে, " Findings showed that NDE memories were similar to real memories in terms of detail richness, self-referential, and emotional information. Moreover, NDE memories were significantly different from memories of imagined events." EEG- র ফলাফল দেখে এই আর্টিকেলের গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, NDE -র স্মৃতি কোনোমতেই কাল্পনিক কোনো ঘটনার স্মৃতির সাথে তুলনীয় নয়। 

এই যে NDE-র পরে দীর্ঘ্যকালীন একটা চরিত্রগত পরিবর্তন (Long term positive life transformation) লক্ষ্য করা যায়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত যে থিওরিটি আছে সেটি হলো, এই অবস্থায় চেতনা (Consciousness) মস্তিষ্কের স্নায়বিক তন্ত্রের (Neural system) থেকে আলাদা (Detached) হয়ে যায়। কিন্তু সেটি কি করে হওয়া সম্ভব সেটি এখনো ল্যাবরেটরিতে নকল করা সম্ভব হয়নি। আর একটি থিওরি হলো, এই অভিজ্ঞতা মারাত্মক বিপদ বা প্রাণহানির সময়ে মস্তিকের অস্বাভাবিক কার্যকারিতার দ্বারা মস্তিষ্কের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচতে এর বিরুদ্ধে মস্তিষ্কেরই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। NDE -র সময়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়েছে এমন আপাতত একটিমাত্র স্টাডিই পাচ্ছি 'Critical Care' জার্নালে। ২০১০ সালের স্টাডি। স্লোভেনিয়ার তিনটি বড় হাসপাতালের ৫২ জন কার্ডিয়াক এরেস্টের রোগীর ওপর করা। যাঁদের গড় বয়স ৫৩.১ বছর এবং এই ৫২ জনের মধ্যে ৪২ জনই ছিলেন পুরুষ। এদের মধ্যে ২১.২% এর গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE ছিল। এই স্টাডিতে দেখা গিয়েছিলো, NDE আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ধমনীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আংশিক চাপ এবং রক্তে পটাশিয়াম এর ঘনত্ব বেশ বেশি যাঁদের NDE ছিল না তাঁদের তুলনায়। 

তবে বড় জটিল অস্ত্রপ্রচার বা বয়স্ক মানুষদেরই এই অভিজ্ঞতা হবে তা নয়, জেনিভার ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে একটি ১২ বছরের ছেলের সাধারণ এনেস্থেসিয়া দিয়ে অতিসাধারণ অস্ত্রপ্রচার চলাকালীন তার NDE হয়। এই কেস স্টাডিটি পাচ্ছি 'Pediatric Anesthesia' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে। 


আগেই বলেছি যে হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইউনিটগুলোতেই NDE-র ঘটনা সবচাইতে বেশি ঘটতে দেখা যায়।নেদারল্যান্ডের Rijnstate Hospital এর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক Dr. Pim van Lommel নেদারল্যান্ডের ১০টি হাসপাতাল থেকে ৩৪৪ জন কার্ডিয়াক এরেস্ট হওয়া মানুষ নিয়ে প্রায় আট বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্টাডি করেছিলেন যেটি ২০০১ সালে 'Lancet' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ৩৪৪ জনের মধ্যে ১৮% এর NDE ছিল। সেখানে তিনি দেখেন, কার্ডিয়াক এরেস্ট কতটা সময় ধরে হচ্ছে, কতক্ষন ধরে মানুষটি অচেতন থাকছেন, কি ধরণের ওষুধ তিনি খাচ্ছেন, মৃত্যুভয় মানুষটির মনের মধ্যে ছিল কিনা ইত্যাদি কোনো কিছুর সাথেই এই অভিজ্ঞতা হওয়া বা না হওয়ার কোনোরকম সম্পর্ক নেই। 

এই Dr. Lommel ২০১১ সালে একটি রিভিউ লেখেন Annals of the New York Academy of Sciences জার্নালে। সেখানে তিনি প্রবন্ধটি আরম্ভ করেন এই বাক্যটি দিয়ে- "কার্ডিয়াক এরেস্ট হবার পর যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের বর্ণিত অভিজ্ঞতার থেকে যে সমস্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল ও সিদ্ধান্তের এতটাই মিল, যে NDE -র ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আর অবহেলা করা যাবে না।" এই প্রবন্ধে তিনি আরও সিদ্ধান্ত করেন যে, "The NDE is an authentic experience that cannot be simply reduced to imagination, fear of death, hallucination, psychosis, the use of drugs, or oxygen deficiency." অর্থাৎ NDE একটি সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। কল্পনা, মৃত্যুভয়, দৃষ্টিভ্রম, মানসিক বৈকল্য, কোনো রাসায়নিকের প্রভাব বা মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব নয়। 

আপাতত NDE সংক্রান্ত গবেষণা যা পাচ্ছি তার সারাংশ মোটামুটি এইই। বাকি যা আর্টিকেল তা প্রধানত কেস স্টাডি। অর্থাৎ অস্ত্রোপ্রচারের সময় বা দুর্ঘটনা বা কার্ডিয়াক এরেস্টের সময় শরীরের বাইরে থেকে শরীরটিকে দেখতে পাওয়া বা আপনজনদের বা সামনের সমস্ত দৃশ্য দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এসম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে। তার মূল কারণ আমাদের বোধ, বিজ্ঞান, মাপজোকের যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা। তবে যেহেতু NDE একটি Life transforming event বলেই বেশিরভাগ রিপোর্ট বর্ণনা করছে এবং সেই পরিবর্তনটি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ভালোর দিকে, সেহেতু NDE-র পদ্ধতিটি ঠিকঠাক বুঝতে পারা গেলে এবং তাকে প্রয়োজন মতো induce করা সম্ভব হলে (যেমন কিনা MI-NDE-র ক্ষেত্রে মেডিটেশন দিয়ে করার কথা বলা হচ্ছে) ড্রাগ বা এলকোহল এডিকশন বা আত্মহনন মানসিকতা বা PTSD-র মতো দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরো একটি বিকল্প পদ্ধতি হলেও হতে পারে। তবে এই Alternative treatment পদ্ধতির কথা এখনই ভাবা অসম্ভব। আরো একটি অর্ধশতক বা শতক পরে হয়তো এ বিষয়ে আশা করা উচিৎ হবে।    

আজ এপর্যন্তই। 
ভালো থাকবেন।
অর্পিতা।    

Tuesday, 23 June 2020

Near Death Experience - 1

খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছেন যাঁরা অর্থাৎ মরতে মরতে বেঁচেছেন এমন কিছু মানুষ, যেমন ধরা যাক- কোনো একটা জটিল অস্ত্রপ্রচারের সময় হার্টবিট কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেল তারপর কয়েকসেকেন্ড পরে আবার তা ফিরে এলো, অথবা বীভৎস কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে কেউ একজন মারা পড়তে পড়তেও বেশ গেলেন, বা  কেউ বেশ কয়েকদিন কোমাতে কাটিয়ে এলেন বা কার্ডিয়াক এরেস্ট হলো বা ভূমিকম্পের ফলে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন এমন মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে আমরা যেমন ভাবে সন্ধ্যেবেলায় গল্প করতে করতে বলি যে, "আজ একেবারে মরতে মরতে বেঁচে গেলাম", সেরকম নয়, সত্যিকারের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন যাঁরা তাদের কথা বলছি। ওই কয়েকসেকেন্ডের অভিজ্ঞতা তাদের ঠিক কি রকম? এই অভিজ্ঞতাকেই বলা হচ্ছে 'near death experience' বা সংক্ষেপে 'NDE' অদ্ভুতভাবে  ওই মানুষেরা ঐসময়ের এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেন যা দেশ-কাল ভেদেও একইরকম। বেশ একটা মিল লক্ষ্য করা যায় তাঁদের বর্ণিত বিষয়টিতে। যেমন, নিজের শরীরকে শরীরের বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া (out of body experience), নিজের পুরো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী পুনর্বার ফিরে দেখা (life review), বা একটি উজ্জ্বল আলোর টানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তাঁরা। সর্বোপরি, একটা ভীষণ সুন্দর, শান্ত, সমাহিত, সমস্তরকম দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত উন্নততর মনের অবস্থার কথা তাঁরা প্রত্যেকেই বর্ণনা করেন। এই বর্ণনাগুলি আগেই বলেছি দেশ-কাল ব্যতিরেকে সকলের ক্ষেত্রে একই।  

Near death experience (NDE) নিয়ে প্রথম পাবমেড (Pubmed) আর্টিকেল পাচ্ছি ১৯৮৩ সালে। লিখেছেন ব্রুস গ্রেইসন (Bruce Greyson)। Dr. Greyson এর পরিচয় এককথায় বলতে গেলে বলতে হয় তিনি ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির Professor Emeritus of Psychiatry and Neurobehavioral Sciences. তাঁর আরো পরিচিত পরিচয় হলো, 'the father of research in near-death experiences.'  এই near-death experiences শব্দবন্ধটি অবশ্য প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রেমন্ড মুডি। তাঁর শুরু করা চিন্তাধারাকে নতুন ভাবে একটা কোয়ান্টিটেটিভ রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন গ্রেইসন। একা গ্রেইসন নন আরো অনেকেই এই NDE রিসার্চকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তবে গ্রেইসন NDE কে ঠিকঠাক চিহ্নিত করবার জন্য একটি পরিমাপন পদ্ধতি প্রণয়ন করেন যা 'গ্রেইসন স্কেল' নামে বহুল বিখ্যাত একটি মডেল। অর্থাৎ কেউ একজন যদি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তবে তাঁর তিনি আদৌ কিছু অনুভব করতে পেরেছেন কিনা, মানে তার অভিজ্ঞতাকে আদৌ NDE বলা চলে কিনা, বা বললেও সেই অভিজ্ঞতা ঠিক কোন পর্যায়ে পড়ে সেটির মাপকাঠি এই গ্রেইসন স্কেল। তবে গ্রেইসন স্কেল এর প্রণেতা কিন্তু শুধু NDE -র পরিমাপ নয়, NDE- র সাথে কার্ডিয়াক কেয়ার বা অন্যান্য ক্লিনিকাল প্রভাব, আধ্যাত্মিকতার সাথে তার সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয় এমনকি আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তি সম্পর্কেও লিখেছেন। 

এখন এই অভিজ্ঞতাগুলিকেই গ্রেইসন স্কেল অন্তত চারটি ভাগে ভাগ করে। অর্থাৎ মানুষটির মানসিক অবস্থা, স্নায়বিক অবস্থা, বেড়ে ওঠার পরিবেশ, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয় এই অভিজ্ঞতাগুলিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই চারটি ভাগে ফেলে। Cognitive type, Transcendental type, Affective type এবং Paranormal type. বাকি আর যা অন্য চারটের মিশ্রণ তাকে আর শ্রেণীবিন্যাস করা যায় না।  ফলে বাকি সবগুলো হলো মিশ্র বা unclassified type. এখন NDE -র অভিজ্ঞতার ভিন্নতা অনুসারে এই টাইপগুলি ঠিক কি? অভিজ্ঞতার তীব্রতা অনুসারে তার গ্রেডিং করতে বলা হয়। পদ্ধতিটি self assessment গোত্রীয়। প্রায় ষোলোটি প্রশ্নের ০, ১ বা ২ হিসেবে গ্রেডিং করতে বলা হয় NDE প্রত্যক্ষ করেছেন এমন মানুষকে। গ্রেইসন স্কেল বলছে, এই ষোলোটি প্রশ্নের (অভিজ্ঞতার) ধরণ হলো ওই Cognitive type, Transcendental type, Affective type অথবা Paranormal type এর। এখন কোনো একজন মানুষের অভিজ্ঞতা অনুসারে গ্রেডিং করতে করতে কোনো একটি টাইপ এর গ্রেড ৫ বা তার বেশি হলে মানুষটির NDE- কে সেই টাইপ এ বা গোত্রে ফেলা যাবে। এখন ওই ষোলোটি প্রশ্ন একটু দেখে নিই। 

যখন আপনি NDE- র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, অর্থাৎ ঠিক মৃত্যু হবো হবো থেকে আবার ফিরে আসছেন ওই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আপনার কি মনে হয়েছে-

১. সময়ের গতি অস্বাভাবিক বেড়ে বা কমে যাচ্ছিলো? অর্থাৎ সব কিছু ভীষণ দ্রুত বা ধীর লয়ে ঘটছিল?
২. আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা অস্বাভাবিক দ্রুত বা ধীর লয়ে চলছিল?
৩. আপনার জীবনের পুরোনো ঘটনাবলী কি আপনার মনে আবার ফিরে আসছিল?
৪. আপনি কি হঠাৎ করেই আপনার বা আপনার চারপাশে ঘটে চলা সমস্ত জানা অজানা ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন? বুঝতে পারছিলেন সমস্ত কিছু?
৫. আপনি কি অসম্ভব একটা শান্তি, স্বস্তি অনুভব করছিলেন? 
৬. আপনার কি ভীষণ একটি আনন্দ হচ্ছিলো?
৭. আপনি কি নিজেকে বিশ্বজগতের সাথে একসূত্রে বাঁধা, একাত্ম একজন মনে করছিলেন? 
৮. আপনি কি নিজের চারিদিকে উজ্জ্বল একটা আলোর গোলক দেখেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন?
৯. আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি কি সাধারণ অবস্থার তুলনায় আরো শক্তিশালী বা তীব্র হয়ে উঠেছিল?
১০. আপনার কি মনে হচ্ছিলো, মানে আপনি কি অনুভব করতে পারছিলেন যে অন্যকোথাও একটা চলে যাচ্ছেন বা আশেপাশের জিনিষগুলি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে?
১১. ভবিষ্যতের কোনো দৃশ্য কি আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল? 
১২. আপনি কি অনুভব করেছিলেন যে আপনি আপনার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছেন (Out of body experience, OBE)? 
১৩. আপনার কি মনে হচ্ছিলো আপনি অপার্থিব কোনো জায়গায় পৌঁছে গেছেন?
১৪. আপনি কি রহস্যময় কোনো বস্তুর উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন বা অচেনা কোনো কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন?    
১৫. আপনি কি আপনার মৃত কোনো আত্মীয় বা আধ্যাত্মিক কোনো মানুষকে দেখেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন?
১৬. আপনি কি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলেন যেখান থেকে প্রায় আর ফিরে আসা যায় না? 

এই হলো গিয়ে গ্রেইসন স্কেলে উল্লিখিত ষোলোটি প্রশ্ন। এখন এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের ধরণ অনুসারে, ০, ১ বা ২ গ্রেডিং করা হয়। যেমন এই শেষ প্রশ্নটিই ধরা যাক, 'আপনি কি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলেন যেখান থেকে প্রায় আর ফিরে আসা যায় না?' এই প্রশ্নের উত্তর যদি "না" হয় তবে তার জন্য বরাদ্দ নম্বর হলো '০', যদি উত্তর হয় এরকম-"আমি নিজে সচেতনভাবে জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম" তাহলে তার জন্য বরাদ্দ নম্বর হলো '১', আর যদি উত্তরে NDE অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষটি বলেন যে-"আমি একটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম যে বাধাটি পার হবার অনুমতি ছিল না। বা আমায় জোর করে ফেরত পাঠানো হয়েছে" তাহলে তার জন্য বরাদ্দ নম্বর হলো '২'। এখন এইসবগুলি প্রশ্নের মিলিত উত্তর ৭ বা তার বেশি হলে তবেই ধরা হয় যে আদৌ মানুষটির near death অভিজ্ঞতা হয়েছে। 
এখন ১ থেকে ৪ নম্বর প্রশ্ন হলো cognitive component, ৫ থেকে ৮ নম্বর প্রশ্ন হলো affective component, ৯ থেকে ১২ নম্বর প্রশ্ন হলো paranormal component এবং ১৩ থেকে ১৬ নম্বর প্রশ্ন হলো transcendental component. কোন ধরণের প্রশ্নে মানুষটির স্কোর বেশি হচ্ছে তার ওপরে মানুষটির অভিজ্ঞতার ধরণ নির্ণীত হয়। 
তাঁরা যা যা অভিজ্ঞতা বা অনুভূতির কথা বলেছেন সেসবের ওপর ভিত্তি করে ১৫৮ জন NDE সম্পন্ন মানুষের ওপর করা সাম্প্রতিকতম আর্টিকেল পাচ্ছি এই বছরেরই অর্থাৎ ২০২০ -র জানুয়ারিতে প্লস ওয়ান (PLoS One) জার্নালে প্রকাশিত। সেখানে গ্রেইসন স্কেলে করা প্রশ্নগুলো ছাড়াও নিজেদের ভাষায় (Descriptive) তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে বলা হয়েছিল। তাতে গ্রেইসন স্কেলে বেঁধে দেওয়া প্রশ্নোত্তরের গন্ডি তা থাকে না। তাতে তাঁরা যে কথা গুলি বলেছেন তার মাধ্যমেও NDE -র মূল ব্যাপারটাকে খানিকটা বোঝা বা ধারণা করা যাচ্ছে। এখানে মূলত তাঁরা NDE কে বর্ণনা করতে যে যে শব্দ বা শব্দবন্ধ বর্ণনা করেছেন তার প্রকৃতি মূলত তিন ধরণের: visual perceptions, emotions and spatial components অর্থাৎ দেখা, অনুভব করা বা অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য। 

এবারে কিছু উল্লেখযোগ্য স্টাডির কথা বলি যা পাবমেড থেকে আপাতত পাচ্ছি। অবশ্যই এছাড়াও অজস্র স্টাডি আছে যাতে ইনভেস্টিগেটররা NDE-র ঘটনাগুলিকে কেস স্টাডি হিসেবে প্রকাশ করেছেন। আমি সেই কেস স্টাডিগুলি আপাতত বলছিনা। বলছি সেই স্টাডিগুলোই যেগুলিতে গবেষকরা NDE-র কিছু অন্তর্গত কারণ, এসোসিয়েশন বা নিউরোনাল পরিবর্তনের কথা আন্দাজ করেছেন (অবশ্যই কারণসহ) বা করার চেষ্টা করেছেন আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানে ব্যবহৃত জ্ঞান, থিওরি বা যন্ত্রপাতিতে যতটুকু মাপা সম্ভব আর কি, তাই দিয়ে।

NDE-র কারণ হিসেবে সবচাইতে প্রচলিত থিওরিটি হলো দৃষ্টিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন। যদিও বর্তমানে গুচ্ছ গুচ্ছ এমন NDE কেসের কথা পাওয়া যাচ্ছে যা কেবলমাত্র একটি প্রায় মৃত মস্তিষ্কের বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন বলে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এবিষয়ে সাম্প্রতিকতম আর্টিকেলটা পাচ্ছি এই বছরের (২০২০) মার্চ মাসে প্রকাশিত এক্সপ্লোর জার্নালে। প্রকাশ করেছেন Institute of Neuroscience, Department of Human Physiology, University of Oregon এর গবেষকরা। সেখানে ৩২ বছর বয়সী একজন চিকিৎসকের তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কার্ডিয়াক এরেস্ট হয় এবং তাঁর NDE-র অভিজ্ঞতা হয়। তারপর তিনি নিজেই তাঁর কেস অত্যন্ত বিশদভাবে পরীক্ষা করে মূলত দুটি সিদ্ধান্তের কথা এই রিপোর্টে প্রকাশ করেন যে, ১) আমাদের বস্তুগত ধারণা অনুসারে, মানুষের চেতনা (Consciousness) যদি শুধুমাত্র মানুষের মস্তিস্ক থেকে তৈরী হয় তবে তা দিয়ে NDE-র সময়, মানুষের যে যে ইন্দ্রিয়গত অনুভূতি হয় তাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এবং ২) NDE-র পরে মানুষের চেতনা (Consciousness) সম্পর্কে মূল ধারণাটিই পাল্টে যায়।এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটির অবশ্য ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। জীবন সম্পর্কে, ধারণার আমূল পরিবর্তন, সাংঘাতিক একটা চরিত্রগত পরিবর্তন (অবশ্যই ভালোর দিকে), নেশা ছেড়ে দেওয়া, আলস্য ছেড়ে জীবনকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি life changing ঘটনার অজস্র উদাহরণ আছে NDE-র পর। এমনকি Suicidal প্রকৃতির মানুষ বা post traumatic stress disorder এর মতো long term চিকিৎসাধীন রোগীদেরও NDE-র পর সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ হয়ে যাবার বেশ কিছু প্রমান বা কেস স্টাডির উল্লেখ পাওয়া যায়। গত বছরে জার্মানি এবং ডেনমার্কের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের কথা বলি, যেখানে পৃথিবীর পঁয়ত্রিশত দেশ থেকে ১০৩৭ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা হয় এবং এঁদের ৮১ জনের মধ্যে মানে প্রায় ৭.৮% মানুষের NDE ছিল। এই পরীক্ষায় আর একটি বিষয় উঠে আসে। সেটি হলো, এই ৮১ জনের মধ্যে ৩৩ জনের একটি বিষয় মিল ছিল সেটি হলো মাইগ্রেন অরা। অর্থাৎ খুব সোজা কোথায় বললে, মাইগ্রেনেই মাথা ব্যাথার সময় তাঁরা উজ্জ্বল একটি আলোর উৎস দেখতে পান। অর্থাৎ মাইগ্রেন অরা সংক্রান্ত স্নায়বিক কার্যকলাপ বোঝা গেলে তার কিছুটা দিয়ে NDE -র ধারণাটিকে নেড়েচেড়ে দেখা যেতে পারে ভবিষ্যতে। আবার ওই গতবছরেরই কথা, Medical hypothesis জার্নালে Center for Integrative Medicine, University of Arizona College of Medicine থেকে একটি রিভিউ প্রকাশ করলেন ড: জেমস লেক। সেখানে তিনি বললেন, NDE একটি "Higher cognitive trait" যা জেনেটিক, বা এপিজেনেটিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্ভব। এখানে, আমার একটা ব্যক্তিগত wild চিন্তার কথা বলি। মনে করা যাক, NDE বা ঐধরণের অভিজ্ঞতাগুলিকে যদি আধ্যাত্মিক (Spiritual) অভিজ্ঞতা হিসেবে মনে করি এই মুহূর্তের জন্য, তাহলে "Higher cognitive trait", এই কথাটিকে খানিক চেনা চেনা লাগে। আমাদের দেশে সেজন্যই কি বলা হয় যে যিনি মনের দিক থেকে (In case of consciousness) যত উন্নত ততই তাঁর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা তত স্পষ্ট? দু ক্ষেত্রেই মোদ্দা কথাটা একই কেবল টার্মিনোলজিটা আলাদা?                

NDE -র স্টাডি সব থেকে বেশি হয়েছে হাসপাতালের "terminally  ill" রোগীদের ওপরে, বা কার্ডিয়াক ইউনিটের ক্রিটিকাল অস্ত্রপ্রচারের রোগীদের ওপরে। সাধারণ হাসপাতালের রোগীদের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য স্টাডি পাওয়া যাচ্ছে শ্রীলংকার কলম্বো নর্থ টিচিং হাসপাতাল থেকে। ৮২৬ জন সাধারণ রোগীর ওপর গ্রেইসন স্কেল অনুসারে পরীক্ষা করে ৩% মানুষের মধ্যে NDE চিহ্নিত করতে পেরেছেন তাঁরা। এছাড়া অজস্র স্টাডি হয়েছে কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল ইউনিটগুলোতে। সমস্যা একটা জায়গায় আটকে আছে যে ঠিক ওই অভিজ্ঞতা ঘটাকালীন শারীরিক, স্নায়বিক পরিবর্তনগুলি খুব ভালো করে মাপা বা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়না এখনো পর্যন্ত। ফলে ফিজিওলজিক পরিবর্তনগুলি এখনো অধরা। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে ওই যে ওপরের প্রশ্নাবলী বললাম না, মানুষটির দেশ, জাতি, বড় হয়ে ওঠা, আধাত্মিকতা এবং ধর্মীয় মতবাদ বা যদি সে নাস্তিকও হয়, সমস্ত ভিন্নতা স্বত্তেও সব ক্ষেত্রেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই ধরণের অভিজ্ঞতার কথাই তাঁরা বলেন। সাধারণত এই জাতীয় অভিজ্ঞতায় ধর্মবিশ্বাসের সাথে সম্পর্ক থাকার ভাবনাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৮৪ সালের একটি স্টাডি হয়েছিল তাতে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের সাথে NDE -র গভীরতা সম্পর্কে কাজ হয়েছিল। এই স্টাডিতে SA McLauhlin ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে NDE -র কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাননি। বছর দুই আগে Imperial College London, London, এবং University Hospital of Liège, Belgium এর বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রকাশিত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টাডির কথা এখানে বলি, আমাদের শরীরে সেরোটোনার্জিক নিউরন, যা কিনা আমাদের সামগ্রিক আনন্দে থাকার ব্যাপারটা খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করে তা থেকে উৎপন্ন N,N-Dimethyltryptamine (DMT) প্রয়োগ করেছিলেন ১৩ জন সুস্থ মানুষের দেহে এবং তারপর পরে আলাদা ভাবে তাঁদের দেহে প্লাসিবো (placebo) কিছু তরলও প্রয়োগ করেছিলেন। অবশ্যই কখন কোনটা প্রয়োগ করা হচ্ছে সেসময় তাঁদের সেটি জানানো হয়নি। অর্থাৎ যাকে বলে 'within-subjects placebo-controled study' এবং দুই ক্ষেত্রেই NDE -র বৈশিষ্ট্যগুলি পরীক্ষা করা হয়েছিল। এবং দেখা গিয়েছিলো, DMT প্রয়োগের পর তাদের NDE মতো বেশ কিছু অনুভূতি হয়েছিল। অর্থাৎ এটিও NDE -কে স্নায়বিকভাবে ব্যাখ্যা করার আরো একটি পদ্ধতি হলেও হতে পারে।

আরো কিছু গবেষনা হয়েছে NDE নিয়ে। সবই আপাতত খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। তবুও আপাতত যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর গল্প নিয়ে আবার পরের দিন ফিরে আসছি।
আজ এপর্যন্তই। 
ভালো থাকবেন।
অর্পিতা।             
            

Wednesday, 17 June 2020

Hitchcock Nature Center

Today’s trail. In the morning, usual way to the lab has shown an unusual combination of colors. The bright yellow speed caution board in the foreground on a background of a grayish cloudy sky. The chimney usually smokes in the morning but today it was sleeping I guess.

After completion of a routine day we headed towards Hitchcock Nature Center, our nearest and easy way out to collect our scattered mind.

We took our usual trail to the west end of the nature center. It gives us the majestic sunset at the end of the trail every time. Today the trail was not crowded, only a family for photo-shooting during the upward trail and a father-kid camping duo during the way back said “hi” to us.

End of the winter, the forest is flooded with green foliages and full of birds. We do not know the name of the birds but that did not hinder us to be a part of the grand ceremony of ending of a day.

With every shades of green, serenity of sunset colors, whistle of a passing train on a single track, choir of birds and whispering wind in the years old oaks. I touched the leaves and the trunks of them during my way back and took the feeling of the rough surface with me. Every time I touch the rough trunk of an aged tree, I feel a touch of someone, I can depend on. Like the elderly person of the family, like a loving, wise grandpa.

We were returning with the last ray of the day, with bunch of busy butterflies and the velvety bees. A hummingbird also said good night to us from a bunch of yellow grass flowers. They may have a specific name but I do not bother to know the names of plants and the animals always. The “yellow grass flowers” is enough to memorize their beauty under a green canopy and a serene ray of sun.

A small beagle kissed me today during the returning trail. He was going with his human friends for a walk towards the same trail. After a long three months time this was the first touch of a dog for me due to Covid-19. This is another friendly touch that I never miss to realize.

We started towards Hitchcock with a dumbed mood. The jungle filled us with part of her green, part of her silence, part of her sunlight and part of her chorus of natural sounds.

We returned with the flood of nature within us. A place who never refuses us.

https://youtu.be/d2mBQkod4as

Saturday, 13 June 2020

সেদিন হঠাৎ করেই


সাতই মার্চ ২০২০, দিনটা শনিবার। কোনো পড়ে থাকা কাজ নেই যা সেইদিনই শেষ করতে হবে। মিডওয়েস্টের মারকাটারি ঠান্ডাটা একটু সহ্য করার মত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সুতরাং মনটা ঘরে থাকছিল না। স্যান্ডহিল ক্রেনরা ফিরছিলো তাদের বাৎসরিক পরিক্রমা সেরে, সে খবর পেয়েছিলাম। নেব্রাস্কার পুব দিক ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া প্ল্যাট নদীর ধারে ধারে ওদের অস্থায়ী বসবাস শীতের শেষে। কিন্তু তার জন্য আমাদের পশ্চিমে ঘন্টা দেড়-দুই উজিয়ে যেতে হবে, ওদের সাথে মোলাকাত সেরে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসার সময়ের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারটা একটা প্ল্যানিং এর কারণে। সেই যে ছোটবেলায় স্কুলে মাঝে মাঝে মুড়ির পিকনিক হতো না, তখন অবশ্য 'ফিস্ট' বলতাম। সমস্ত স্কুলে হতো কিনা জানিনা। আমাদের মতো মফস্বলের গার্লস স্কুলগুলোতে হতো জানি। সেরকমই একটা মুড়ির ফিস্ট হবার কথা ছিল দুই একদা মফস্বলী গার্লস স্কুলে পড়া মূল- উৎপাটিত মেয়ের উদ্যোগে। পুরোনো স্বাদে ফেরা মাঝে মধ্যে, এই আর কি! এই নস্ট্যালজিক সময়ে ফিরে যাবার আকর্ষণ কম নয় অথচ এমন একটা পড়ে পাওয়া দিনে বাড়িতে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ার দিকেই মন বেশি টানলো।  সু কে বললাম তোর বাড়ির মুড়ির পার্টিটা বরং পরের সপ্তাহে পিছিয়ে দেওয়া যাক। আজ বরং বক দেখে আসি চল। করোনার চক্রান্তে সে পার্টি এখনো মুলতুবি আছে যদিও। সু আর বড়দাদাও ছিল ল্যাবে। দুটোকেই ভুজুং ভাজুং দিয়ে বগলদাবা করলাম। অমন দুম করে বেরোনো একটু কঠিন। তাদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো তারপর চারজনে বেরিয়ে পড়লাম। দুপুরের খাওয়া সেরকম কিছু হয়নি ওদের। রাস্তাতেই অল্পসল্প স্যান্ডউইচ - ফলমূল জাতীয় কিছু দিয়ে দুপুরের জ্বলন্ত খিদে সামলে সাঁই-সাঁই করে এগোচ্ছি ইন্টারস্টেট ৮০ ধরে সিধে পশ্চিমমুখো। সূর্যাস্তের অন্তত এক দেড় ঘন্টা আগে পৌঁছাতে হবে নইলে অন্ধকার হয়ে পড়লে ওদের দেখবো কি করে? আর আমরা যে জায়গা লক্ষ্য করে বেরিয়েছি সে জায়গায় ওদের কোনো বড়ো ঝাঁক নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে একটু আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করতে সময় লাগবে। মাঝে একজায়গায় থামা হলো। তখন সবে এখানে করোনা ঘাঁটি গাড়তে শুরু হয়েছে। তেমন ভাবে সকলকে পঙ্গু করে দিতে পারেনি তখনও।

আমরা পৌঁছলাম কার্নে। নেব্রাস্কার কার্নে, নর্থ প্ল্যাট, গ্র্যান্ড আইল্যান্ড - প্ল্যাট নদীর অববাহিকায় এইসমস্ত জায়গা বছরের দুবার প্রায় আড়াইশো প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বিশ্রামস্থল হয়ে দাঁড়ায়। এযাত্রা শীতের শেষে ঘরে ফেরার পথে আমরা ওদের সাথে দেখা করতে এসেছি। কিন্তু আমাদের পুরোনো জায়গায় পৌঁছে দেখলাম এবছর ওই জায়গায় কোনো বড় পাখির ঝাঁক নেই। তবুও নদীর কাছে নেমে পায়ে হেঁটে শুকনো ঘাসের জঙ্গলে জঙ্গলে বেশ কিছুটা এগিয়েও তেমন লাভ হলো না। দূরে নদীর ঠিক মাঝখানে একখানা চড়া তৈরী হয়েছে। সেখানে একঝাঁক পাখি উঠছে নামছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সে অনেক দূরে। সামনে দিয়ে মাঝে সাঝে পাঁচ-সাতটি পাখির ঝাঁক আমাদের দেখতে পেয়ে কর্কশ গলায় ধমক দিতে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্যামেরাধারীদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এদিকে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে প্রায়। আমরা পড়ি কি মরি করে সূর্য্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে আবার অন্য রাস্তা দিয়ে নদীর অন্য আর একটি দিকে পৌঁছাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাড়াহুড়োয় যেখানে গিয়ে পৌঁছালাম সে রাস্তা একটি প্রাইভেট ফার্মহাউসের সামনে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। নদীর ধারে পৌঁছাতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু যেখান দিয়ে এলাম সেটি ফসল ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে গ্রাম্য রাস্তা। এবং ফসল কাটার পর, পরে থাকা ভুট্টার দানা খেতে সেসব ক্ষেতে নেমেছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। তাদের কর্কশ গলার মিলিত কোরাসে সরগরম পুরো জায়গাটা। নদীতে না পৌঁছাতে না পেরে ভালোই হলো। পড়ন্ত সূর্য্যের কমলা আকাশের প্রেক্ষাপটে অজস্র বিশালাকায় পাখির ঝাঁক। উড়ছে, নামছে, নানানরকম আকৃতি তৈরী করছে ঝাঁকের, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সে এক মহোৎসব যেন। জায়গাটা যেহেতু পক্ষিসন্ধানী টুরিস্টদের সাধারণ রুটের বাইরে, ইতিউতি দুএকটি ফার্মহাউস আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলক্ষেতের মধ্যেকার একটি গন্ডগ্রাম বিশেষ, সেহেতু অনাবশ্যক মনুষ্যসৃষ্ট শব্দ সেখানে অমিল। আমরা চারজনে প্রাণভরে ছবি তুললাম। মন ভরে তাদের সমবেত কথোপকথন শুনলাম। লাল আকাশের প্রেক্ষাপটে ঝাঁকেঝাঁকে পাখির সারি আর তাদেরই সৃষ্টি করা কোরাসে, উদাত্ত হাওয়া আর মধ্যে নেব্রাস্কার বিখ্যাত আদিগন্ত সমভূমির মাঝখানে ব্যোমকে গিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম কিছুক্ষণ।

ফেরার জন্য পিছন ফিরলাম যখন ততক্ষনে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কি ভাবছেন ভ্রমণ শেষ? আরে না না, এত সহজে ঘর ঢুকবো বলে লিখছি নাকি? বলছি সব আস্তে আস্তে।

গ্রামের মেঠো রাস্তায় ঢুকে গিয়েছিলাম অনেকটা। ফলে বড় রাস্তায় এসে পড়তে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। এদিকে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে একটি জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম তারপর থেকে জলযোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ কিন্তু জলবিয়োগের অবকাশ পাইনি। সেই থেকে দৌড়েছি। এখন ফেরার আগে সে প্রয়োজন সকলেরই উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং সাথে পেটে চোঁ চোঁ করছে খিদে। পথের পাশে একটি ছোট দোকানে দাঁড়ানো স্থির হলো। নেব্রাস্কার এরকম ভেতরদিকের গ্রামে ভারতীয় মুখের আনাগোনা বেশি নয় এখনও। ফলে কিছু জায়গায় এখনো পুরোনো দিনের মানুষেরা দুবার ফিরে তাকান। নতুন প্রজন্মের কমবয়সী দোকানি মেয়েদুটি ভারী মিষ্টি। দোকানটি যেমন পথের পাশের দোকান হয় সেরকমই হরেকরকম্বা গোত্রীয়। আমরা কিছু খাবার দাবার কিনলাম। সাথে ওয়াসাবি পেস্ট লাগানো রোস্টেড সবুজ মটর একপ্যাকেট। সেই বস্তু ভুল করে একমুঠো একসাথে মুখে ফেলে দেবার পরেই টাং করে মাথার সমস্ত স্নায়ুতন্তুর জট খুলে যায়, চোখ থেকে দরদরিয়ে জল পড়তে থাকে, নাকের ভেতরে এককিলো নস্যির সমান জ্বলন শুরু হয়, মুহূর্তে ক্লান্তি গায়েব হয়ে মাথা পরিষ্কার হয়। আহা! সে স্বর্গীয় গাট্টাটি গলাধঃকরণ করেই কিনা জানিনা আর একটি চিন্তার উদয় হলো মাথায়। বললুম, এখনই বাড়ি না ফিরে যদি আর একটু দূরে কোথাও গিয়ে, একটা রাত্তির কাটিয়ে কাল আর একটু এদিক ওদিক দেখে তারপর নয় কাল বিকেল নাগাদ ফিরি? বলেই চোরা চোখে সু কে একটু দেখে নিলুম। প্রথম কিলটা আসলে ওর দিক থেকেই আসবে। আমরা নয় আগে থেকেই এই শনি-রবি কাজ করবো না ঠিক করেই রেখেছিলাম। কিন্তু বাকি দুজনকে তো ল্যাব থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। বড়দাদা নয় খানিক বড়ো হয়ে গেছে বলে নিজের কাজ নিজের সময়মত করার খানিক স্বাধীনতা আছে কিন্তু সু এর তা এখনো নেই। ফলে সে খানিক কাঁইকিচির জুড়লে। কিন্তু দোকানেরই এক কোণে রাখা ছোট দুটি টেবিলে বসে খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সমস্ত নেগেটিভ ভোট পজেটিভ হয়ে গেলো। এক্সপেরিমেন্টগুলোর কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করানোর ব্যবস্থা হিসেব করা গেলো। সকলেই তৈরী কোথাও একটা যেতে। এখন প্রশ্ন যাবোটা কোথায়? 

এই আদিগন্ত প্রেইরি অঞ্চলে ঘাসজমি ছাড়া দেখার বিশেষ কিছু নেই। তা ঘাসজমিই দেখতে পারি কিন্তু থাকার জায়গা একটি লাগবে রাতের মতো। চারটি ফোনের ম্যাপ খুলে এদিক ওদিকের বিস্তর গবেষণা করে স্থির হলো আমরা যাবো নিওব্রারা স্টেট পার্ক। সেটি এখান থেকে সিধা উত্তরে ২০০ মাইল। ঘন্টা তিনেক লাগবে। নেব্রাস্কা আর সাউথ ডাকোটার সীমান্ত বরাবর নিওব্রারা এবং মিসৌরি নদীর সঙ্গমস্থলের একটি জঙ্গুলে জায়গা। সুবিধেটা এই যে  আগামীকাল সেখান থেকে কোনাকুনি দক্ষিণ পুব মুখো রওনা হলে সোজা ওমাহাতে গিয়ে পড়া যাবে। পথ অনেক কমে যাবে। সু বিকেল বিকেল ফিরে গিয়ে ঘানিগাছটায় আবার জুড়ে যেতে পারবে। সুতরাং নিওব্রারাই স্থির হলো। আবার কিছু এদিক ওদিক ফোনকলের পর নিওব্রারার দক্ষিণে নেলি (Neligh) তে একখানা মোটেলে রাতের মত ঠাঁই মিলবার আশ্বাসও পাওয়া গেলো। সুতরাং চল পানসি নেলি পানে।

নেলি খুবই ছোট্ট গ্রাম। মাত্র দেড়হাজার মানুষের বাস। উত্তরে নিওব্রারা থেকে পনকা (Ponca) উপজাতিদের যখন তাড়িয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিলো নিচে ওকলাহামার দিকে তখন সেই পরিযায়ী পনকা উপজাতির অসংখ্য মানুষ রাস্তায় মারা যান। পথের কষ্ট সব যুগেই সমস্ত মানুষের জন্যই সমান। সেসময় এই নেলির কাছেই মারা যায় পনকা উপজাতির একজন গোষ্ঠীপতির দেড়বছর বয়সী মেয়ে। তার সমাধি এখনো আছে নেলিতে।  এই সাউথ ডাকোটা থেকে নিচে ওকলাহামার মাঝে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে পুরোনো কালে। আমেরিকান আদি ইন্ডিয়ান উপজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই অঞ্চলে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার চাপে ক্রমশই তারা নিচের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। আর সাথে এই আইওয়া, নেব্রাস্কা, সাউথ ডাকোটা, ওকলাহামা,আর্কানসা এসব জায়গায় ফেলে যেতে থাকে অজস্র ইতিহাস। এই অঞ্চলের সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল ওমাহা। আমাদের বর্তমান কর্মস্থল। ওমাহার আশেপাশে এধরণের অসংখ্য ইতিহাস দেখা যায়।  তেমন করে নজর চলে না যদিও। হেরো মানুষের ইতিহাস-প্রদর্শনীতে দয়া থাকে, করুণা থাকে, বিজয়ীর প্রচ্ছন্ন গর্ব থাকে। কিন্তু বিজয়ীর ইতিহাসের প্রদর্শনীর মতো জাঁক তার কোথায়? সুতরাং আমেরিকান-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীপতিদের নামে হ্রদ বা একটি বনাঞ্চলের নাম দেওয়া হয় মাত্র নতুন পৃথিবীতে। বাকি ইতিহাসের খবর জানতে গেলে ইউনিভার্সিটির নেটিভ-আমেরিকান ইতিহাসের ছাত্র হতে হবে। তা ভিন্ন বিশেষ কিছুই বাকি নেই বাইরের জগতে। 

নেলিতেও কিছু নেই। কয়েক ঘর মানুষের বাস ইতিউতি। একটি ছোট বাজারপাড়া। একটিই রাস্তা আর তার পাশেই আমাদের এই রাতের আস্তানা। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় রাত এগারোটা বাজলো। শুনশান চারিদিক। একটি ছোট আলো জ্বলছে মোটেলের নাম দেখার জন্য সে আলো যথেষ্ট। আর কোনো কাজ সে আলোর দ্বারা হবে না। রাস্তার গায়ে লাগানো একটা পুঁচকি পার্কিং-এর জায়গা আর তার গা ঘেঁষে ঘেঁষে L -আকৃতির গোটা সাত-আট ঘর। এই হলো নেলির মোটেলটি। আস্ত একটি ভূতুড়ে গল্পের পটভূমি যেন। ঘুমন্ত নেলি গ্রামটিতে পৌঁছে আমরা রাস্তা থেকেই সাঁৎ করে ঢুকে গেলাম মোটেলের পার্কিং লটে -"এই তো এইটাই এইটাই।" কালো রঙের আরো একটি জগদ্দল ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে মিশে গিয়ে। তার পাশেই আমাদের পুঁচকে গাড়িটাকে দাঁড়াতে বলে চারমূর্তি নামলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না।  আমাদের ঘরের চাবিটা নেবো কোথা থেকে? অনেকসময় এখানে মোটেলের অফিস খোলা না থাকলে অফিসের সামনে পথিকের নাম লেখা বন্ধ খামে করে চাবি রাখা থাকে। অফিসটা খুঁজে বের করতে হবে। সবই অন্ধকার। সমস্ত দরজাই বন্ধ। সামনে জাঁদরেল সাইজের গুঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল ঝুপসি মহীরুহ। কি গাছ কে জানে! জায়গাটা রাস্তার আলোর থেকে আড়াল করে আরো বেশি অন্ধকার করে তুলেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় পায়ের কাছে লোমশ কি যেন একটা র উত্তাপ। তাকিয়ে দেখি মাটির কাছাকাছি সবুজ দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। ওরকম পরিবেশে বুকটা যে ধক করে ওঠেনি তা নয়, তবে আমার অনুভূতিগুলো বোধহয় একটুখানি ভোঁতা। এই পরিবেশে ওরকম দুটো চোখ দেখে আমি ভয় পেরিয়ে উঠে দেখলাম, কালোর সাথে মিশে থাকা কুচ্কুচে কালো একটা গোবদা বেড়াল আমাদের মোটেলের তরফ থেকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আমাদের অফিসঘর খুঁজতে দেখেই বোধহয় বাঁদিকের একটা সরু দরজার সামনে গিয়ে বললো, "ম্যাঁও।" সেই দরজার ঐপারে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। কাঁচের বাইরে থেকে একটি বড় এন্টিলোপের মাথার স্টাফিং দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে। কোথাও কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। বেড়াল পায়ের চারপাশে ঘোরে আর বলে "ম্যাঁও।" শেষকালে খাঁটি ভারতীয় পদ্ধতিতে ঠকঠক করতে শুরু করতে, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় মানুষ। আমাদের সকলের চেয়ে তিনি বেশি শক্তি ধরেন এতটাই গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পরনে সাদা টি-শার্ট আর বাদামি প্যান্ট। মাথায় মেক্সিকান হ্যাট। এই রাত্তিরেও মুখে সিগার। বাহুতে ট্যাটু। খাঁটি মধ্য-আমেরিকান চেহারা। চারজন টিংটিঙে বঙ্গসন্তানকে দেখে আশ্রয় প্রত্যাশী বলে চিনে নিতে ভুল হলো না তাঁর। নাম ধাম, সনাক্তকরণ ইত্যাদি মিটিয়ে নিতে অফিসে ঢোকা হলো। অফিস বলতে, বাড়ির সামনের বারান্দাটিতে একটি কাউন্টার বানানো আর কাউন্টারের পেছনে একটি চেয়ার। ব্যাস এই অফিস। সাধারণত এইধরণের রাস্তার পাশে মোটেলগুলোতে প্রাতরাশের ব্যবস্থা থাকে। এটিতে সেসবের বালাই নেই। প্রাতরাশের প্রত্যাশী আমরা ছিলামও না যদিও। নেলির মতো জায়গায় হুট্ করে চলে এসে থাকার জন্য একটি ঘর, ঘুমোবার জন্য একটি বিছানা পাচ্ছি এই ঢের। মোটেলের মালিক বেজায় গম্ভীর। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন কিনা কে জানে! ঝটপট কাজ সেরে চাবি ফেলে দিলেন কাউন্টারে। আমরাও মানে মানে চাবি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বিশেষ দর্শনীয় বিষয়টি হলো, এই যে মিনিট পাঁচেক সময় আমরা অফিস ঘরটিতে ছিলাম, তার মধ্যে আমি চারিদিকে চোখ ছড়িয়ে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক পশু পাখির স্টাফিং দেখতে পেয়েছি। কি নেই তার মধ্যে! বেশ কয়েকটি এন্টিলোপের মাথা, তার একটা বাইরে থেকে দেখেছি বললামই। এছাড়া, ঈগল, পেঁচা, ববক্যাট , শেয়াল, রাকুন। এমনকি একখানি সাপ পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের হোস্টিং করছেন একজন শিকারী। 

 চার্ বঙ্গসন্তানের রাত এগারোটার সময় অপরিকল্পিত ভাবে চলে আসা মধ্য-পশ্চিম আমেরিকার এক শুনশান গ্রামে, কুচকুচে কালো বেড়ালের অভ্যর্থনা, নিঝুম মোটেলে গম্ভীর শিকারী মালিক, অফিসঘরে ঠাসা মৃত জানোয়ারের দেহ! আমার ভোঁতা ইন্দ্রিয়ের পক্ষেও যথেষ্ট ছিল সেদিন। জোরদার ভূতুড়ে গল্পের মশলা একেবারে। 

তারপর আর কি? সাথে তো জামাকাপড়-ব্রাশ-পেস্ট কিছুই ছিল না রাত্রিবাসের জন্য। ব্রাশ -পেস্টের ব্যবস্থা করা গিয়েছিলো গতরাতের ওই হরেকরকম্বা দোকান থেকেই। কিন্তু জামাকাপড় বদলাবার বালাই নেই। চাবি দিয়ে কোণার একখানা ঘর খুলে চারজনে দুটো বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে গেলাম। বেড়াল আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। আমাদের ঘরের পাশেই দেখলাম তার ঘর। মানে একটি বড়সড় কাঠের বাক্স, তার ভেতরে মোটা করে খড়, কম্বলের বিছানা। অর্থাৎ ইনি বাড়ির ভেতরের পোষ্য নন। বাইরেই তাঁর চৌকিদারী। কালো শরীর আর সবুজ জ্বলজ্বলে চোখে প্রথমটা চমকে দিলেও দিব্য ভাবসাব করতে চান দেখলাম। কিন্তু আশ্চর্য পরদিন সকালে বেড়াল এবং তার মালিকের দেখা আর আমরা পাইনি। ঘরে চাবি রেখে ঘর খোলা রেখেই সাত সকালে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাতে অবশ্য নাক ডাকিয়ে দিব্য ঘুমিয়েছি। চারজনের মধ্যে তিনজনই নাক ডাকতে ওস্তাদ। ফলে সকালে উঠে দেখলাম সু এর মুখ রাগে গনগনে করছে। বেচারী একটুও ঘুমোতে পারেনি বাকি তিনজনের রাতভর কনসার্টের চোটে। নেলিতে একজায়গায় পেট ঠুসে খেয়ে নিওব্রারা স্টেট পার্কে গিয়ে পৌঁছলাম। নেলি অসাধারণ সুন্দর ভ্যালি। নেলি থেকে নিওব্রারার রাস্তাটি নেব্রাস্কার সুন্দরতম রাস্তাগুলির একটি। দু পাশে উঁচু-নিচু উপত্যকা। ফসলি জমি। মাঝে মাঝে লাল ছাদওয়ালা সাদা দেওয়ালের ফার্মহাউস। আর দৈত্যাকৃতি হাওয়াকল। একেবারে ক্যালেন্ডারের পাতার দেখা ছবিগুলোর মত সুন্দর। কিছুক্ষন চলার পর বাঁদিকে এসে পড়লো নিওব্রারা নদী। চুপ করে দেখার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। নিওব্রারা স্টেট পার্কে পৌঁছে বাহনকে বিশ্রাম দিয়ে চারমূর্তি জঙ্গলে ঢুকলাম। জঙ্গলে হাঁটতে পারলে আর কিছু চাইনা আমি। অনেকটা ভেতর অবধি গিয়ে একজায়গায় বসে গল্পগাছা হলো। বেড়ানো, হাঁটা, দেখা, এ-ওর পেছনে লাগা এসব তো ছুতো। আসল কথা হলো আমরা চিরকালীন যে নেই রাজ্যে বাস করি, তাতে মাঝে মধ্যে শ্বাস ফেলতে না পারলে অবসাদ অবধারিত। নিজের নিজের হতাশাগুলো বেরোবার পথ পায় এই জলে জঙ্গলে একে ওপরের সাথে কথা ভাগ করে নিতে নিতে। কোনো কিছুরই আশু সমাধান নেই, তবুও একে অপরকে বলা যে, "সাথে আছি আমিও"- এই আর কি। ঘাসে পিঠ পেতে শুয়ে ওপরের নীল আকাশ থেকে আশ্বাস ধার করে নেওয়া। 

আর কি? ভ্রমণ শেষ। এবার ফেরার পালা। 

তারপর সেই কোনাকুনি পথে ওমাহামুখো হলাম আবার। মাঝে একজায়গায় জিরিয়ে নিয়ে বিকেল বিকেল ওমাহা পৌঁছে গেলাম। বড়দাদা এখানে আছে প্রায় এক দশক। অলিগলি চেনে সে। সেদিন আমাদের ছাগলের দলকে একখানি নতুন শাকের ক্ষেত দেখিয়েছিলো। তারপর থেকে সে ক্ষেতে বসে খাওয়া বন্ধ বলে আর ওমুখো হওয়া হয়নি। কিন্তু পরে নিশ্চয়ই যাবো। একখানি জাপানি সুশির দোকান। সেখানে খাবার পরিবেশনের ট্রেগুলি সব কাঠের নৌকাকৃতির। আমাদের খিদে পেয়েছিলো প্রচন্ড। সকালে সেই নেলির দোকানে খেয়েছি। তারপর মাঝে একটু চা-কফি পড়েছে পেটে। ভালো করে বসে খাওয়া হয়নি। ওমাহা পৌঁছাবার তাড়া ছিল। আমি আর সু বাথরুম ঘুরে এসে (সেখানে আমাদের দুদিনের ব্যবহৃত দোমড়ানো জামা, জল-জঙ্গলে হেঁটে কাদামাখা জুতো, হাওয়ায় জট পাকানো চুল ইত্যাদির মিলিত প্রয়াসে জবরদস্ত চেহারা দেখে সকলে কিরকম একটা চোখে তাকাচ্ছিলো। আমরা যদিও পাত্তা দিইনি। ডাঁটসে কাজ সেরে বেরিয়ে এসেছি।) দেখি পিনাকী আর বড়দাদা গুছিয়ে অর্ডার করে ফেলছে। "এটা একটা বলি?" "দুটো বলে দাও।" আমাদের খিদের পরিমাপ করে বেচারারা একটার জায়গায় চারতে করে অর্ডার করে ফেললো। তারপর অপেক্ষা করছি যখন, তখন দেখি পাশের টেবিলে আট-দশ জনের একটা পরিবারের জন্য টেবিল জোড়া একটা কাঠের নৌকা করে বিভিন্ন ধরণের সুশি এসেছে। সে দেখে আমরা বাংলায় চুটিয়ে নিন্দে-মান্দা সেরে একঢোক জল খেয়ে যখন সবে ঠান্ডা হয়ে বসেছি, দেখি আমাদের চারজনের জন্য ওই সমপরিমাণ সুশি আসছে ওরকমই একটা কাঠের নৌকায় চেপে। আমাদের চারজনের টেবিল ছোট। ওদের বড় টেবিলে অন্তত নৌকাটাকে রাখতে অসুবিধা হয়নি। আমাদের টেবিলে যখন ঠকাস করে নৌকাটাকে বসিয়ে দিয়ে গেল, তখন দেখলাম আর প্লেট রাখবার জায়গা পর্যন্ত নেই। অগত্যা সরাসরি নৌকার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম চারজন চারদিক থেকে। পেটপুরে খেয়ে, বাকিটা চার ভাগ করে ছাঁদা বেঁধে নিয়ে এসে পরের দিন পর্যন্ত খেলাম। 

পাশের টেবিলের লোকেরা খেয়ে উঠে যাবার সময় খাবারের পরিমাণ আড়চোখে দেখছিলো দেখেছি। তাতে যদিও আমাদের ঘন্টা!