খাঁড়ির গান- ২
---------------------
রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে দুচার ডলার কম নিয়েই গাড়ি তো চলে গেল। আমরাও অন্ধকারের মধ্যে ব্যাগ টেনে ক্যাশলেস অবস্থায় হোটেলের দরজার দিকে এগোলাম। এ পর্যন্ত তো আগেই বলেছি। প্রথম পর্ব লেখবার পর পিনাকী মনে করিয়ে দিল, হোটেলের নাম ছিল 'ব্র্যাভো বিচ রিসোর্ট'। ট্রিপ এডভাইসার বলছে এ অঞ্চলের সবচাইতে ভাল হোটেল। সুনাম তার বহিরঙ্গে বা তার বিলাসিতার নয়। তার অবস্থান এবং তার সার্ভিসে। সফল ব্যবসার যেটি একমাত্র মূলমন্ত্র। ব্র্যাভো বিচ রিসোর্ট ছোট্ট হোটেল। আগেই বলেছি এটি এক্কেবারেই স্থানীয় জনবসতির মধ্যে। এস্পেরাঞ্জার দিকের অপেক্ষাকৃত বড় হোটেলগুলির মত চাকচিক্য তার নেই। এই অঞ্চলে হোম স্টে কিছু আছে। কিন্তু হোটেল বলতেই এটিই। ছোট্ট দোতলা ধবধবে সাদা বাড়ি। একতলা দোতলা মিলিয়ে গোটা পনের ঘর হবে হয়ত। এ অঞ্চলের অন্যান্য বাড়ির মতোই দোতলার টানা বারান্দাটি খোলা। সিঁড়ির মাথায়ও কোনো ঢাকাঢুকির বালাই নেই। এই বিষয়টি পরের দুই দিন বড় ভাল লেগেছিল। কারণ খোলামেলাতেই আমরা অভ্যস্ত। এই ওমাহাতে আসার পরে ঠান্ডার দৌলতে বাড়িতে, ল্যাবে, গাড়িতে সর্বদা কন্ট্রোলড হওয়া চলাচলের ঠেলায় আমার বিরক্তির চুড়ান্ত। হোটেলটিতে ঢুকেই ডানহাতে ছোট্ট ঘরোয়া অফিসঘর। আর বাঁহাতে সরু একচিলতে বাগান। বাগান অবশ্য সব জায়গাতেই। যেখানেই একটুকরো জায়গা পেয়েছে সেখানেই সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে গাছপালা দিয়ে। উঠোনের ঠিক মাঝখানে বেশ বড় একটা গাছ। তার গোড়াটা বাঁধানো। বেশ বসে আড্ডা দেওয়ার মতন। সব কিছুই খুব চেনা চেনা পরিবেশ। অফিসঘরে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন একজন ভদ্রমহিলা। আমাদের চাইতে একটু বেশি বয়স হবে।স্বামী-স্ত্রী মিলে রিসোর্ট চালান। আমাদের জন্যেই বসে ছিলেন। আমরা যেতেই আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়ে পাততাড়ি গুটোলেন। রাতে খাবার ব্যবস্থা নেই এখানে। বললেন, চলো, "আমরা বাড়ি ফেরার সময় তোমাদের বাজার এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যাবো। ওখানে কিছু খাবার পেয়ে যাবে।" ওঁনারা এখানে থাকেন না। রাতে নিজেদের বাড়ি ফিরে যান। হোটেলের পিছনেই আটলান্টিক ডাকছে। এমতবস্থায় কি আর তাকে উপেক্ষা করে খাবার-দাবারের দিকে মন যায়? তাঁদের নরম করে না বলেই সোজা হোটেলের ঘরে। নম্বর টিপে ঘর আনলক করেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ঘরটি ছোট্ট। কিন্তু একটা দেওয়াল সম্পূর্ণ কাঁচের। আর সেদিকেই খোলা বারান্দা। বারান্দা থেকে ঠিক নিচে তাকালেই, নীল সুইমিং পুল। আর দৃষ্টি একটু ওপরে ওঠালেই আরো বড় সুইমিং পুল, আরো গভীর নীল, অতলান্ত আটলান্টিক মহাসাগর। জীবনে প্রথম বার আটলান্টিকের এত কাছে এমন একটা দ্বীপে থাকতে এসেছি। যত কম দিনের জন্যই হোক না কেন। আমরা হাতের জিনিসগুলো নামিয়েই সোজা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। সারাদিনের পথশ্রম ধুয়ে নিয়ে গেল পাঁচ মিনিটেই। বেশ কিছুক্ষন পর নিচে নামলাম খাবারের সন্ধানে। এবং বাইরে বেরিয়ে অনেকদিন পর টর্চের অভাব অনুভব করলাম। আমাদের গেঁয়ো পথে সন্ধ্যের পর রাস্তায় বেরোলে টর্চ একটা হাতে নিয়ে বেরোনোটা একটা অভ্যাস। কিন্তু এখন আমরা শহুরে জীব। আমাদের অবশ্য প্রয়োজনীয় তালিকা থেকে টর্চ অনেকদিন হলো বাদ গেছে। ভেইকোয়েস সেকথা আবার মনে করালো। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেদিকেই হাঁটতে থাকলাম। আশেপাশের বাড়ি থেকে আসা আলোয় পথ চলছি পাড়ার গলির মধ্যে দিয়ে। মোড় ঘুরতেই ডানদিকে সমুদ্রের পাড়ঘেঁষে একটা বাতিঘর। এটিই এখন ভেইকোয়েসের সচল বাতিঘর। এখন তার কাছে যাবার উপায় নেই। আপাতত কিছু খাবার জোগাড় করতে হবে। রাত বেড়ে যাচ্ছে। দোকানদানী বন্ধ হয়ে গেলে হরিমটর ছাড়া কিছুই জুটবে না। দোকানেও যদি কার্ড কাজ না করে তাহলে তো এমনিও হরিমটর। বাকি সব কালকের জন্য তুলে রেখে চটপট পা চালালাম। রাস্তাটা কখনো উঁচু কখনো ঢালু হয়ে এমন নেমেছে যে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নামতে হচ্ছে। এরাস্তার দিনে পাঁচবার হাঁটাচলা করলে পাঁচদিনেই পেটের ফ্যাটসেল গুলো "এখন আসি হ্যাঁ" বলে নিজের রাস্তা দেখবে। রাস্তাটা গিয়ে যেখানে একটু চওড়া হয়েছে সেখানে কয়েকটা দোকান। তার মধ্যে একটি খাবার দোকান। সাথে সামনের দিকে বার। টিমটিমে আলো। একেবারেই স্থানীয়। সামনে কয়েক কদম আগেই ফেরি ঘাট। দিনের শেষে ভেইকোয়েসের লোকজনের "অমুকদার চায়ের দোকান" এর মতন একটা ঠেক বলা চলে। এখানেই ঢুকব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু এখানে কার্ড কাজ না করার প্রভূত সম্ভাবনা। এবং প্রথম দিনেই না বুঝেশুনে এমন একটা ঠেকে ঢুকে পড়াটা কি উচিৎ হবে? এই একটা শহুরে ভাবনা থেকে বেরোতে পারিনি এখনো। আরও একটু এগিয়ে দেখবো ঠিক করলাম। এই সময় দেখি তিন চারটি হৃষ্ট-পুষ্ট সারমেয় দোকানের সামনে থেকে লেজ টেজ নেড়ে উৎসাহী মুখে হাসছে। যেকোনো ধরণের কুকুররাই আবার আমায় তাদের কুম্ভমেলার হারিয়ে যাওয়া বোন ভাবে। আমিও তাদের দেখলে পরে-"ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁতকা রে" বলে হামলে পড়ি। বাড়ি থেকে এদেশে আসার পর যখন রাস্তাঘাটে তেনাদের সাথে যথেচ্ছ মুলাকাতে ভাঁটা পড়ল, তৎসময় হইতেই কিঞ্চিৎ মনোকষ্টে ভুগিতেছিলাম। তা সান্ধ্যকালীন ঠেকের সামনে এঁনাদের বন্ধুসুলভ আমন্ত্রণকারী হাসিমুখ দর্শন করিয়া পূর্বতন আহ্লাদ জাগিয়া উঠিল। যাক বাবা, এখানে রাস্তাঘাট এক্কেবারে ফাঁকা নয়। দুপেয়েদের জঙ্গলে চারপেয়েও কটা পাওয়া যাবে কথা বলার মতন। পরে দেখেছিলাম যে তারা সংখ্যায় 'কটা' মাত্র নয়, বেশ অনেক কটাই। সংখ্যায় এবং চেহারায় আমাদের দেশের মতোই। একই রকম আবহাওয়া, তাই চেহারাও আমাদের মতোই। আর এই দোকানটি তাদেরও রাত্রিকালীন ঠেক। সারাদিন পাড়াবেড়িয়ে সন্ধ্যায় দোকানে ফিরে আসে। যাইহোক, আপাতত তাদের "পরে দেখা হবে ভাই, এখন খেয়ে আসি" বলে এগিয়ে চললাম। সামনে ফেরিঘাটের কাছে দেখি একখানা পুঁচকে বাড়ি। সেটি ব্যাঙ্ক। এত রাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাঙ্ক বন্ধ। বাইরে দেখি একখানা এটিএম মেশিনও দাঁড় করানো আছে। দেখেই তো রে রে করে ছুটে গেলাম। কিন্তু যা হয়, মেশিন আপাতত অকেজো। মুষড়ে চলে আসছি, একজন বললেন, আরো এগিয়ে বাজারেলাকে নাকি আরো একটি ব্যাংক এবং এটিএম আছে। এগোচ্ছি, দেখি একখানা 'সাবওয়ে', মানে সুড়ঙ্গ নয়, স্যান্ডউইচ এর দোকান। ওই মুহূর্তে ওখানে 'সাবওয়ে' দেখতে পেয়ে বিশ্বাস করুন, মনে হলো, হাতে স্বর্গ পেলাম। সাবওয়ে তে কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যাবেই যাবে।সুতরাং, এটিএম, টাকা তোলা ওসব পরে দেখা যাবে, আগে তো খাই। এরপর এটি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলেই হয়েছে আর কি। সাবওয়েটি একদম সাগরের পার ঘেঁষে। বাইরে বসার জায়গাটির পাঁচিলে এসে ধাক্কা দিচ্ছে একের পর এক ঢেউ। একবার মনে হলো এখানে বসেই খাই। কিন্তু দুজনেরই হোটেলের ওই বারান্দাটির জন্য মন ছটফট করছিল। ফিরে আসারই মনস্থির করলাম। টাকা তোলাও কাল হবেখন। কাল সকালেও হোটেলেই ব্রেকফাস্ট। সুতরাং টাকা এখনই না তুললেও চলবে। দুজনে দুখানা সাবওয়ের প্যাকেট হাতে দুলোতে দুলোতে আবার হেঁটে হেঁটে চারপেয়েদের শুভরাত্রি বলে ফিরে চললাম। বারান্দায় বসে খেতে খেতে ভাবছিলাম মনে আছে যে, আমরা এই দুই নিতান্ত সাধারণ গেঁয়ো ছেলে মেয়ে এরকম রাতে, আটলান্টিকের ঘাড়ে চড়ে নৈশাহার সারছি এ কয়েকবছর আগেও খানিক অভাবনীয় ছিল বটে। নৈশাহারে যদিও স্যান্ডউইচ। তাও।
0 comments:
Post a Comment