Monday, 23 September 2019

খাঁড়ির গান-৩

খাঁড়ির গান-৩
------------------- 

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো ডানদিক থেকে আসা একরাশ আলোয়। ঝকঝকে সকাল। চোখ খুলতেই মনে হলো ইশ, সময় নষ্ট হচ্ছে। যদিও কিচ্ছুটি করব না বলেই এমনতর জায়গায় এসে থাকা। তাও বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাত বাড়ানো দূরত্বের আটলান্টিককে অবহেলা করা কি যায়? বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই মনে দুই রকমের অনুভূতি। প্রথম অনুভুতিটা হলো, "আহ!" আর দ্বিতীয়টি হলো "ইশ।" খুব ভাল কিছু অভিজ্ঞতা হলে সেটিকে একান্ত আপনজনের সাথে ভাগ করে না নিলে সে অভিজ্ঞতা পূর্ণতা পায়না কোনোমতেই। তা সেই যে এক সবুজ গঞ্জে দুটি ছোট ছোট বাচ্চাকে রেখে এসেছি, যাঁরা কিনা একদিন ছোট্ট আমিটাকে কোলে-কাঁখে করে বঙ্গোপসাগরের তীরে নিয়ে গিয়ে প্রথমবার আঙ্গুল দেখিয়ে শিখিয়েছিলেন, "ওই দেখ সমুদ্র", সেই দুটি মানুষের জন্য বড় মনকেমন  লাগলো। 
চোখ মুখ ধুয়ে পায়ে চপ্পল গলিয়ে নেমে এলাম নিচে। নিচে তখন ব্রেকফাস্টের শেষ পর্যায় চলছে। আমরা ছাড়া আরো যেসব অতিথি আছেন তাঁরা প্রায় সকলেই বয়স্ক মানুষ। পরে দেখেছি, বেশিরভাগ আমাদের মত বয়সের মানুষদের এস্পারেঞ্জার দিকটাই পছন্দ। ব্রেকফাস্টে নানান কিসিমের পাউরুটি-ফল-দুধ-সিরিয়ালস, আরো নানান কিছু। সাথে কফি। একবাটি ফল আর দুধ নিয়ে পিছনের উঠোনে বেরিয়ে এলাম। এর ঠিক উপরেই আমাদের ঘর-বারান্দা। এই উঠোনেই একটা মাঝারি গোছের সুইমিং পুল। তার পাশে ফাঁকা জায়গাটায় কয়েকটা চেয়ার। তারই একটা টেনে নিয়ে উঠোনের নিচু পাঁচিলের ওপরে খাবার রেখে বসলাম। চকচকে রোদ্দুর সামনের পাঁচিলে এসে মাথা কুটছে গাঢ় নীল সমুদ্র। আর দেড় বছর পরের প্রথম একটা কাজহীন দিন। অনুভূতিটা হয়ত "আহ" ছাড়া আর কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারব না। খাওয়া শেষ করার আগেই পিনাকীও নেমে এলো নিচে। দুজনে বেশ কিছুক্ষন বসে রইলাম ঐভাবেই। ততক্ষনে খাওয়া শেষ করে অন্যান্য অতিথিরা বেরিয়ে পড়েছেন হোটেল ছেড়ে বেড়াতে। আমাদের কোথাও যাবার ছিল না। আমরা পায়ে পায়ে হোটেলের পিছনের বেড়া ঠেলে ভেজা বালিতে পা রাখলাম। হোটেলের পাঁচিল ঘেঁষে তিন-চারটি নারকেল গাছ, নীল আকাশ আর একসমুদ্র নীলের মাঝে সবুজের একটা রঙিন বৈপরীত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে নামলাম সেটি কোনো বিচ নয়। বাড়ির খিড়কি দরজা খুলেই যে পাশের পুকুরঘাটে নামবার রানা করা থাকে এটি সেই। কেবল তফাৎ এই যে, খিড়কি পুকুরটি খোদ আটলান্টিক। আমাদের বাঁদিকে ওই দূরে দেখা যাচ্ছে পুয়ের্তো রিকো। আর ডানদিকে ওই যে ছায়া ছায়া লাইন একটা, ঐটি ফ্ল্যামেঙ্কো। ওইটিতে থাকার জায়গা না পেয়ে আমরা ভাইকোয়েসে এসেছি। ভাগ্যিস। পুয়ের্তো রিকোর সানওয়ান ফেরিঘাট থেকে লঞ্চ আসছে ভাইকোইয়েসের ফেরিঘাটের দিকে। আর এতোলবেতোল হাওয়ার মধ্যে আটলান্টিক অক্লান্তভাবে তৈরী করে চলেছে একের পর এক ঢেউ। সাদা ফেনায় ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের পা। তার সাথে কুচি কুচি অজস্র পাথর আর পাথরের মাথায় সামুদ্রিক গুগলি, শামুকদের জটলাকে। ছোট ছোট পাথরে বাসা বেঁধেছে ওরা। প্রতিটা ঢেউ এসে ধুয়ে দিচ্ছে ওদের বসবাসকালীন জমে ওঠা ক্লেদ। একসাথে অনেকজন একটা ছোট জায়গায় অনেকদিন ধরে থাকলে কেমন একটা আবর্জনা জড়ো হয় মন জুড়ে। এদের বোধহয় সেসবের বালাই নেই। প্রতিটা নতুন ঢেউতে ভেসে যায় বোধহয় ওদের আবর্জনা। বেশ কয়েকটা পাথর সামুদ্রিক শ্যাওলায় রঙিন হয়ে আছে। আর আছে লাল কালোর নকশাদার কি যেন একরকম পোকা। অপূর্ব সুন্দর দেখতে। ভালোবাসাবাসি চলছে ওদের নিজেদের মধ্যে দেখলাম। আমরা চপ্পল খুলে রেখে ভেজা বালিতে হাঁটছিলাম।  আমরা ছাড়া আর কারো পায়ের ছাপ নেই। আমরা হাঁটলাম। যদিও বেশি দূর যাবার নেই। যেহেতু এটি ট্যুরিস্ট বিচ নয়, আদতে কোনো বিচই নয়, তাই পারিপাট্যও নেই। বেশিদূর যাওয়া যায়না।  নারকেল গাছের ছায়ায় বসে বসে লঞ্চ বা নৌকার যাতায়াত দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কতটা  চলতে হয়? সত্যিই  কি তার প্রয়োজনীয়তা আছে? এই যে গত কয়েকবছর ধরে পাগলের মতন করে ল্যাব আর বাড়ি করছি, সাংঘাতিক সায়েন্স করছি তা তো নয়, সায়েন্স করতে গেলে কি কি  জানতে হয়,  এসবের  সাথে পরিচিত হচ্ছি বলা চলে। আমাদের নিজের বিজ্ঞান দিয়ে, মেডিক্যাল সায়েন্সে সামান্যতম কিছু করতে হলে আমায় সারা জীবন কাজ করতে হবে তবে গিয়ে হয়ত কিছু কাজ করার সার্থকতা আসবে। না আসার সম্ভাবনাই বেশি। অথচ কি দৌড়টাই না দৌড়াতে হবে সে জন্য। কতটা ধৈৰ্য থাকবে? ভাবছিলাম। দেখছিলাম। সময় কাটাচ্ছিলাম। তারপর অনেক্ষন পর ভাবনা গুলোকে ওই আঘাটার বালিতেই এদিক ওদিক ছড়িয়ে রেখে উঠে পড়লাম।

বেলা বেড়েছিল। আগের দিন হোটেলে ঢোকার সময় কতগুলো ছবিছাবাওয়ালা লিফলেট জোগাড় করেছিলাম হোটেলের অফিস ঘর থেকে। এই ভাইকোয়েস ভ্রমণ সংক্রান্ত সব। ঘরে বসে পাতা ওল্টাচ্ছি, পিনাকী স্নানে। লিফলেটের বেশির ভাগই এস্পেরাঞ্জার দিকে গিয়ে ওয়াটার স্পোর্টস আর ওয়াটার এমুসমেন্ট সংক্রান্ত। দেখে পাতা মুড়ে আবার রেখে দিচ্ছি। এগুলি আমাদের বিশেষ কাজে লাগবে না। ওরই মধ্যে একটি লিফলেটে চোখ আটকালো। মুখ ছোট করে এককোনে বসেছিল সে। স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং এর চকচকে পোষ্টার নয়। সম্পূর্ণ অন্য প্রাকৃতিক ঘটনা। এখানে আসার আগে আমি অন্তত বিশেষ কিছু পড়াশুনা করে আসিনি। কারণ নির্জনতা আর সমুদ্র বাদে আমার চাহিদা কিচ্ছু ছিল না। মাঝে মাঝে চাহিদা কম থাকলে, প্রাপ্য ভাঁড়ার পূরণ করার দায়িত্ব প্রকৃতিদেবী নিজেই নিয়ে নেন। এ লিফলেটটিও সেরকম। ফোনের ইন্টারনেটের অবস্থা খুব খারাপ। তারই মধ্যে কোনো মতে একটু দেখে নিলাম ব্যাপারটি। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফুটছি। এ জিনিস না দেখে ভাইকোয়েস থেকে ফিরে যাবার কোনো মানেই হয় না। এক ধাক্কায় কিচ্ছু না করা ছুটিকে বিদায় দিয়ে দিয়েছি ততক্ষনে। পিনাকী কেন এখনো বেরোচ্ছে না বাথরুম থেকে? সে বেরোতে ব্যাপারটা বললাম। আমি স্নান করে তৈরী হচ্ছি যখন, ততক্ষনে সে লিফলেটের ফোন নম্বর গুলোতে ফোন করে করে একটা ট্যুর বুক করে ফেলেছে। আজই সন্ধ্যায়। কি কান্ড! এর জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না এতটুকুও। এই পড়ে পাওয়ার জীবনে এমন একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হবে তা ভাবিনি। বিষয়টা হলো, বায়োলুমিনিসেন্স বে (Bio-luminescence Bay)।

অর্থাৎ,  খুব সংক্ষেপে বললে, রেড ম্যানগ্রোভ অধ্যুষিত, ঈষৎ উষ্ণ অঞ্চলের সামুদ্রিক খাঁড়িতে যদি ডায়ানোফ্লাজেলেট (dinoflagellates) জন্মায় এবং সেই আণুবীক্ষণিক শৈবাল জাতীয় জীবের গা থেকে নীলচে নিয়ন আলোর মত হালকা আলো বের হয়, যদি কোনো ভাবে তারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এবং সেই খাঁড়ির যথেষ্ট গভীরতা থাকতে হবে। একটি দিক সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত থাকলে ভাল। এখন ভাইকোয়েসের উত্তরে, যেদিকে আমরা আছি, সেদিকে  আটলান্টিক, দক্ষিণে ক্যারাবিয়ান উপসাগর।তার স্রোত উষ্ণতর এবং মাঝে মাঝে ভাইকোয়েসের মাটি ক্ষইয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তাতে যেমন তৈরী হয়েছে অসংখ্য ছোট বড় বিচ তেমনই ছোট বড় খাঁড়ি। তার সবচাইতে বড়টি হলো mosquito bay, যার চারিপাশটা ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঢাকা। বেশ কিছুটা পরিধির মধ্যে মানুষের বসবাস নেই। এবং এই mosquito bay তে জন্মেছে অসংখ্য ডায়ানোফ্লাজেলেট। এখন আধো অন্ধকার রাতে যদি আপনি এই mosquito bay তে গিয়ে জলে হাত পা ডোবান, বা কোনো কিছু দিয়ে জলে আঘাত করেন, তাতে ওই ডায়ানোফ্লাজেলেটদের গায়েও আঘাত লাগবে এবং তারা নীলচে নিয়নের মতন হালকা আলো বিচ্ছুরণ করতে থাকবে। এখন এই আলোর পরিমাণ নির্ভর করবে জীবাণুদের সংখ্যা, আকাশে আলোর পরিমাণ  ইত্যাদির উপর। এই mosquito bay -র পরিধি এবং এর মধ্যে ডায়ানোফ্লাজেলেটদের সংখ্যা, এই bay কে বিশ্বের বৃহত্তম এবং উজ্জ্বলতম  Bio-luminescence Bay-এর তকমা  দিয়েছে। আবার সেই 'তর- তম' -র  হিসেবনিকেশ। অর্থহীন। এটি বৃহত্তম না ক্ষুদ্রতম নাকি অনুল্লেখযোগ্য মধ্যম, তাতে কিই বা যায় আসে? এটি প্রকৃতির একটি সম্পদ, যা তিনি দয়া করে আমাদের দেখার নাগালে রেখেছেন।লিফলেটে এটি সম্পর্কে দেখার পরেই আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, এই bay তে যাবো। ভেইকোয়েসে যখন এসেই পড়েছি। সন্ধ্যা ছটায় ট্যুর। সান- বিচে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে তারপর ওদের গাড়িতে ওরা নিয়ে যাবে।

সমস্ত আলস্য কাটিয়ে উৎসাহে উত্তেজিত দুজনেই। তৈরী হয়ে হোটেল থেকে বেরোলাম। আবার সেই বাতিঘর, সারমেয়দের ঠেক পেরিয়ে ফেরিঘাটে পৌঁছে বাঁয়ে  এগোলাম। আমরা যাব একটি বাহন ভাড়া করতে। এই দ্বীপের ভেতরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নিজস্ব একটি বাহন দরকার। আমরা ঠিক করেছি একটি স্কুটার ভাড়া করব। গাড়ি চালানোর চেয়ে অন্যরকম হবে। আর বড় মোটরসাইকেল হলে আমার চালাতে অসুবিধা। ছোট স্কুটার হলে আমিও চালাতে পারব। সেই মত বাজার এলাকার গির্জা এবং টাউন হলটিকে বাঁহাতে রেখে হাতে ছাপা ম্যাপ নিয়ে হাঁটছি। ফোনের ম্যাপের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না। ইন্টারনেট এই আছে এই নেই। পথে একজন আমাদের থামিয়ে স্প্যানিশে কিছু বললেন। আমাদের চেহারা দেখে ওঁনার দক্ষিণ দেশীয় মনে হয়েছে। বিনয়ের সাথে জানালাম যে আমরা ভারতীয় এবং আমরা স্প্যানিশ ভাষা জানিনা। বিশেষত আমায় দেখে অনেকেই স্প্যানিশ জানি ধরে নিয়ে কথা বলতে এসেছেন তারপরেও। যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে আমরা গেলাম গ্লাস বিচ। এটি হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা পথ। এও সাধারণ জনবসতির মধ্যে একচিলতে বালির প্যালেট। কয়েকটা পুরোনো রেললাইনের পাতের মত লোহার বিম পড়ে আছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন আমাদের দেখছে। এখানে বাইরের লোক বেশি আসে না বুঝলাম। বেশিক্ষন ওখানে থাকতে ইচ্ছে করছিলনা।  হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ফিরে আসছি বাজার এলাকার দিকে। এখানেই অন্য আর একটি ব্যাংক এবং তার ATM থাকার কথা। গতকাল রাতে ওই বন্ধ ATM এর পাহারাদার তাই বলেছিলেন আমাদের। এলাকাটা দেখে মনে হয় পুরোনো ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের মধ্যবিত্ত একটি উদাহরণ। পরিচ্ছন্ন, কিন্তু বাহুল্য বর্জিত। ছোট গ্রামের মত সবাই সবাইকে চেনে। সাইকেলে বা মোটরসাইকেলে যেতে যেতে হাত নেড়ে কথা বলা বা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে জটলা করা। একদম আমাদের চেনা দিনযাপনের ছবি। মার্কিনি বাহুল্য বা বাতুলতা কোনোটিই নেই। আমরা ATM খুঁজে টাকা তুললাম শেষ পর্যন্ত। ঠিক করলাম, যেখানে যেখানে কার্ড দিয়ে চলবে কিছুতেই সেখানে ক্যাশ খরচ করব না। নইলে গতকালের মত পরিস্থিতি হবে। এত কান্ড করেও শেষে যদিও আবার ক্যাশ কম পড়ে গিয়েছিল। সে গল্প নাহয় যথাসময়ে বলা যাবে। হাঁটতে ভাল লাগছিল আমাদের। ঘুরে ফিরে কয়েকটা মোড় আর কয়েকটি দোকানদানী। আমরা স্কুটার ভাড়া করার দোকানে এলাম। দেখেশুনে একটি বাহন পছন্দ করে ৫০ ডলার সিকিউরিটি ডিপোজিট দিয়ে যুদ্ধজয়ের মেজাজে বেরিয়ে আসছি, দোকানের ভদ্রলোক "আরে আরে করো কি? দাঁড়াও।" বলে আটকালেন। বললেন, "গাড়ির চারিদিক দেখে ছবি তুলে নাও। কোথাও কিছু চোট আছে কিনা গাড়ি নেবার সময় দেখে নেবে না? পরে যদি পুরোনো কোনো চোট দেখিয়ে আমি তোমাদের কাছে এক্সট্রা চার্জ করি?" এর আগে কোনো দিন গাড়ি ভাড়া করিনি দেশের বাইরে। জানলাম। শিখলাম গাড়ি ভাড়া করার অলিখিত নিয়ম। কে বলে শুধু মা বাবাই শেখান? আমাদের সারাজীবনে এরকম কত কত নিঃস্বার্থ শিক্ষক মিলে আমাদের তৈরী করেন কে তার হিসেবে রাখে?

স্কুটার আর দুটি হেলমেট নিয়ে হাসিমুখে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরোলাম। পাশেই আর একটি বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল। একটি ছোট্ট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। নাম "হিমালয়ান ষ্টোর" বা ঐরকম কিছু। এখন মনে পড়ছে না। "হিমালয়ান" লেখাটা ছিল মনে আছে। আর মনে আছে দোকানের বাইরে দেওয়ালে প্রায় দুই মানুষ সমান হাতে আঁকা আমাদের বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের ছবিটি। কি কান্ড? এই মাঝসাগরের পুঁচকে দ্বীপেও বাঁশিওয়ালা বাঁশিটি হাতে মিটিমিটি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে।বাড়িতে মায়ের প্রিয় ক্যালেন্ডারের গোপালের ছবিটি মনে পড়ল। হয়ত ইস্কনের সাথে সংযুক্ত কেউ এই দোকানটি খুলেছেন আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে এসে। দোকানে কর্পোরেট ছাপ নেই। বাইরে দেখলাম দিব্যি ভারতীয় কুর্তি ঝোলানো রয়েছে কয়েকটি। দেখে শুনে দুজনের ভারী ফুর্তি হলো। চলতে চলতে দেখলাম আবহাওয়ার গুণে অজস্র জবা, টগর গাছ জন্মেছে রাস্তার ধারে ধারে এবং বাড়িগুলিতে। ছোট্ট পাঁচিলঘেরা বাড়ি, বাইরে লাল জবার গাছ , তার পাশে একটা লালচে বেড়াল উদাস মুখে বসেছিল। আমার ডাকে একবার চোখ ফিরিয়ে দেখলে, কিন্তু বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দিলে না। মুখ ফিরিয়ে আবার চিন্তা করতে লাগল। একেবারেই আমাদের চেনা ঘরোয়া পরিবেশ এদিকটা।

বেলা অনেক হয়েছে। হাঁটাহাঁটি করে আর সমুদ্রের হাওয়ায় সকালের ফল আর দুধ কোথায় তলিয়ে গেছে। খেতে হবে কিছু। আমাদের দুজনের খাওয়ার দোকানদানি খুঁজে পেতে কোনোদিনই কোনো অসুবিধা বিশেষ হয়না। এখানে এসে ম্যাপ দেখে একখানা দোকানকে টার্গেট করে রেখেছিলাম কাল থেকেই। নাম অরোরাস চিকেন এন্ড গ্রিল। শুনতে আহামরি কিছু নয়। কিন্তু বলছে নাকি এখানকার স্থানীয় খাবার পরিবেশনায় এরা অনন্য। আর যেকোনো জায়গায় গিয়ে সেখানকার স্থানীয় খাবার না খাওয়া মানে বেড়ানো অসম্পূর্ন থাকা। সুতরাং আমরা ফোনের জিপিএস আর প্রিন্টেড ম্যাপ হাতে অরোরার খোঁজে বেরোলাম। ভেইকোয়েস ছিল সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় আমেরিকার নানান যুদ্ধাস্ত্র এবং বোম্ব পরীক্ষার জায়গা। একসময় পুরো দ্বীপটিই US আর্মির দখলে ছিল। তার আগে পুয়ের্তো রিকোর মতোই স্পেনীয়দের থেকে আমেরিকান আর্মি দখল করে। ওই পুঁচকে দ্বীপ ভেইকোয়েস। তার ঠিক অর্ধেকটাই ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ রিফুইজি। এবং সেই জঙ্গলের অনেকটা জায়গাই এখনো সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের মাইন পরবর্তী সময়ে বিস্ফোরণ হয়ে এখানে অনেক অঘটন ঘটিয়েছে। সেই পুরোনো সময়ের সেনা বাঙ্কার আমরাও পরের দিন কিছু দেখেছিলাম। পরে বলছি সেকথা। যেজন্যে এত কথা এখন বলছি, আমরা এগোচ্ছিলাম ডানদিকে US হাইওয়ে ২০০ ধরে। এখন থেকে সমস্ত কিছুই প্রায় দ্বীপের ডানদিকে। বাঁদিকে ওই জঙ্গল অঞ্চল। সেখানে পরের দিন কিছুটা আমরা গিয়েছিলাম। হাইওয়ে-২০০ নামেই হাইওয়ে। আদতে ছোট্ট গ্রামের রাস্তা। কিছুটা চলার পর বাঁয়ে বেঁকে আমরা অরোরার খোঁজ পেয়ে গেলাম। অরোরার কাছে দেখি ফার্মার্স মার্কেট বসেছে। আমাদের খোলা বাজারের মত টাটকা সবজি ঠেলায় নিয়ে বিক্রি করছেন স্থানীয় বিক্রেতারা। যাঁরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য এখানে থাকতে আসেন তাঁরা কিনে রান্না বান্না করতে পারেন। যদিও এলাকাটি একদম আমাদের বড় টুরিস্ট স্পটে পৌঁছোবার রাস্তায় দুপুরে খাবার বিখ্যাত ধাবার মতন। প্রচন্ড ভিড় দোকানে। সকলেই অরোরার নাম শুনে খেতে এসেছেন। আমরাও অর্ডার করে বেশ কিচ্ছুক্ষন পরে খাবার পেলাম। মেক্সিকান ধরণেরই খাবার। খেয়ে দেয়ে আরো এগোলাম এস্পারেঞ্জার দিকে। আমাদের হাতে আরো বেশ কিছুটা সময় আছে। ছটায় আমাদের রিপোর্ট করতে হবে সান বিচে। সান বিচ এস্পারেঞ্জাতেই। ভেইকোয়েসের পরিধি বরাবর একের পর এক সমস্ত ট্যুরিস্ট বিচ গুলোই ঐদিকে। আমরা সোজা এগোতে থাকলাম ২০০ নম্বর রাস্তা ধরে। হঠাৎ দেখি শুনশান রাস্তায় মাঝখান দিয়ে ছুটছে আমাদের স্কুটার। আর আমাদের দুপাশে ছুটছে একদল ঘোড়া। একদম বন্য। স্পেনীয় উপনিবেশের শুরু থেকেই ওদের সাথেই ঘোড়া এসেছিল এখানে। তারাই বংশানুক্রমে বেড়ে বেড়ে পুরো দ্বীপে বন্য ঘোড়ার বংশ এখন ফুলে ফেঁপে রয়েছে। তাদের সাথে সেই প্রথম মোলাকাতের পর থেকে যখন তখন এদিক ওদিক তাদের দেখেছি। চকচকে গা, বলশালী দেহ, স্বাধীন আর অপরিসীম দার্ঢ্য তাদের। বঙ্গদেশীয় চোখে শ্রদ্ধার উদ্রেককারী। রাস্তা ধরে একদম শেষে গিয়ে দেখি এখানে হাট বসেছে প্রায়। নতুন দীঘার মত ব্যাপারস্যাপার। সমুদ্র, মাছ, সামুদ্রিক খাবারদাবার, বিয়ার আর জলকেলির বিপুল আয়োজন। পরিবার, কুকুর, বেড়ালসহ অবসরপ্রাপ্ত মার্কিনিরা এসে বসেছে এখানে। ভাগ্যিস এখানে থাকার প্ল্যান করিনি। যাইহোক, কাল এইসব বিচগুলো ভাল করে ঘুরে দেখা যাবে। বেশ কিছুক্ষন এস্পেরাঞ্জায় এদিক ওদিক ঘুরেফিরে ছটা বাজার একটু আগেই গিয়ে পৌঁছলাম সান বিচে। এখান থেকেই আমাদের বায়ো-লুমিনেসেন্স বে তে নিয়ে যাবার কথা। সান বিচ অসম্ভব সুন্দর দেখতে। আজ এখানে থাকতে পারব না।  কাল আবার আসব। আপাতত ট্যুর কন্ডাক্টারদের বা তাদের কোনো অফিস খুঁজে পেতে হবে। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে কোনো অফিস তো দূর, বাথরুম পর্যন্ত পেলাম না। একদম শুনশান বিচ। ঠিক জায়গায় এসেছি তো? একটাই স্বান্ত্বনা, কোনো টাকা পেমেন্ট করা নেই। ওরা হাতে হাতে ক্যাশ কালেক্ট করে নেবে বলেছিল ফোনে যখন বুকিং করছিলাম। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, দুজনে দুটো হেলমেট হাতে ঝুলিয়ে ভ্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে আছি বায়ো-লুমিনেসেন্স দেখার আশায় শুনশান বিচে। দূরে রাস্তার ধরে কতগুলি ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে এছাড়া আর কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। দুজনে বুঝে উঠতে পারছিনা কি করব। এদিকে ছটা বাজে। চলে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় দেখি দূরে রাস্তা দিয়ে দুটো গাড়ি ঢুকছে।

(চলবে)
  
     

Saturday, 7 September 2019

খাঁড়ির গান- ২

খাঁড়ির গান- ২
---------------------
রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে দুচার ডলার কম নিয়েই গাড়ি তো চলে গেল। আমরাও অন্ধকারের মধ্যে ব্যাগ টেনে ক্যাশলেস অবস্থায় হোটেলের দরজার দিকে এগোলাম। এ পর্যন্ত তো আগেই বলেছি। প্রথম পর্ব লেখবার পর পিনাকী মনে করিয়ে দিল, হোটেলের নাম ছিল 'ব্র্যাভো বিচ রিসোর্ট'। ট্রিপ এডভাইসার বলছে এ অঞ্চলের সবচাইতে ভাল হোটেল। সুনাম তার বহিরঙ্গে বা তার বিলাসিতার নয়। তার অবস্থান এবং তার সার্ভিসে। সফল ব্যবসার যেটি একমাত্র মূলমন্ত্র। ব্র্যাভো বিচ রিসোর্ট ছোট্ট হোটেল। আগেই বলেছি এটি এক্কেবারেই স্থানীয় জনবসতির মধ্যে। এস্পেরাঞ্জার দিকের অপেক্ষাকৃত বড় হোটেলগুলির মত চাকচিক্য তার নেই। এই অঞ্চলে হোম স্টে কিছু আছে। কিন্তু হোটেল বলতেই এটিই। ছোট্ট দোতলা ধবধবে সাদা বাড়ি। একতলা দোতলা মিলিয়ে গোটা পনের ঘর হবে হয়ত। এ অঞ্চলের অন্যান্য বাড়ির মতোই দোতলার টানা বারান্দাটি খোলা। সিঁড়ির মাথায়ও কোনো ঢাকাঢুকির বালাই নেই। এই বিষয়টি পরের দুই দিন বড় ভাল লেগেছিল। কারণ খোলামেলাতেই আমরা অভ্যস্ত। এই ওমাহাতে আসার পরে ঠান্ডার দৌলতে বাড়িতে, ল্যাবে, গাড়িতে সর্বদা কন্ট্রোলড হওয়া চলাচলের ঠেলায় আমার বিরক্তির চুড়ান্ত। হোটেলটিতে ঢুকেই ডানহাতে ছোট্ট ঘরোয়া অফিসঘর। আর বাঁহাতে সরু একচিলতে বাগান। বাগান অবশ্য সব জায়গাতেই। যেখানেই একটুকরো জায়গা পেয়েছে সেখানেই সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে গাছপালা দিয়ে। উঠোনের ঠিক মাঝখানে বেশ বড় একটা গাছ। তার গোড়াটা বাঁধানো। বেশ বসে আড্ডা দেওয়ার মতন। সব কিছুই খুব চেনা চেনা পরিবেশ। অফিসঘরে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন একজন ভদ্রমহিলা। আমাদের চাইতে একটু বেশি বয়স হবে।স্বামী-স্ত্রী মিলে রিসোর্ট চালান। আমাদের জন্যেই বসে ছিলেন। আমরা যেতেই আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়ে পাততাড়ি গুটোলেন। রাতে খাবার ব্যবস্থা নেই এখানে। বললেন, চলো, "আমরা বাড়ি ফেরার সময় তোমাদের বাজার এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যাবো। ওখানে কিছু খাবার পেয়ে যাবে।" ওঁনারা এখানে থাকেন না। রাতে নিজেদের বাড়ি ফিরে যান। হোটেলের পিছনেই আটলান্টিক ডাকছে। এমতবস্থায় কি আর তাকে উপেক্ষা করে খাবার-দাবারের দিকে মন যায়? তাঁদের নরম করে না বলেই সোজা হোটেলের ঘরে। নম্বর টিপে ঘর আনলক করেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ঘরটি ছোট্ট। কিন্তু একটা দেওয়াল সম্পূর্ণ কাঁচের। আর সেদিকেই খোলা বারান্দা। বারান্দা থেকে ঠিক নিচে তাকালেই, নীল সুইমিং পুল। আর দৃষ্টি একটু ওপরে ওঠালেই আরো বড় সুইমিং পুল, আরো গভীর নীল, অতলান্ত আটলান্টিক মহাসাগর। জীবনে প্রথম বার আটলান্টিকের এত কাছে এমন একটা দ্বীপে থাকতে এসেছি। যত কম দিনের জন্যই হোক না কেন। আমরা হাতের জিনিসগুলো নামিয়েই সোজা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। সারাদিনের পথশ্রম ধুয়ে নিয়ে গেল পাঁচ মিনিটেই। বেশ কিছুক্ষন পর নিচে নামলাম খাবারের সন্ধানে। এবং বাইরে বেরিয়ে অনেকদিন পর টর্চের অভাব অনুভব করলাম। আমাদের গেঁয়ো পথে সন্ধ্যের পর রাস্তায় বেরোলে টর্চ একটা হাতে নিয়ে বেরোনোটা একটা অভ্যাস। কিন্তু এখন আমরা শহুরে জীব। আমাদের অবশ্য প্রয়োজনীয় তালিকা থেকে টর্চ অনেকদিন হলো বাদ গেছে। ভেইকোয়েস সেকথা আবার মনে করালো। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেদিকেই হাঁটতে থাকলাম। আশেপাশের বাড়ি থেকে আসা আলোয় পথ চলছি পাড়ার গলির মধ্যে দিয়ে। মোড় ঘুরতেই ডানদিকে সমুদ্রের পাড়ঘেঁষে একটা বাতিঘর। এটিই এখন ভেইকোয়েসের সচল বাতিঘর। এখন তার কাছে যাবার উপায় নেই। আপাতত কিছু খাবার জোগাড় করতে হবে। রাত বেড়ে যাচ্ছে।  দোকানদানী বন্ধ হয়ে গেলে হরিমটর ছাড়া কিছুই জুটবে না। দোকানেও যদি কার্ড কাজ না করে তাহলে তো এমনিও হরিমটর। বাকি সব কালকের জন্য তুলে রেখে চটপট পা চালালাম। রাস্তাটা কখনো উঁচু কখনো ঢালু হয়ে এমন নেমেছে যে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নামতে হচ্ছে। এরাস্তার দিনে পাঁচবার হাঁটাচলা করলে পাঁচদিনেই পেটের ফ্যাটসেল গুলো "এখন আসি হ্যাঁ" বলে নিজের রাস্তা দেখবে। রাস্তাটা গিয়ে যেখানে একটু চওড়া হয়েছে সেখানে কয়েকটা দোকান। তার মধ্যে একটি খাবার দোকান। সাথে সামনের দিকে বার। টিমটিমে আলো। একেবারেই স্থানীয়। সামনে কয়েক কদম আগেই ফেরি ঘাট।  দিনের শেষে ভেইকোয়েসের লোকজনের "অমুকদার চায়ের দোকান" এর মতন একটা ঠেক বলা চলে। এখানেই ঢুকব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু এখানে কার্ড কাজ না করার প্রভূত সম্ভাবনা। এবং প্রথম দিনেই না বুঝেশুনে এমন একটা ঠেকে ঢুকে পড়াটা কি উচিৎ হবে? এই একটা শহুরে ভাবনা থেকে বেরোতে পারিনি এখনো। আরও একটু এগিয়ে দেখবো ঠিক করলাম। এই সময় দেখি তিন চারটি হৃষ্ট-পুষ্ট সারমেয় দোকানের সামনে থেকে লেজ টেজ নেড়ে উৎসাহী মুখে হাসছে। যেকোনো ধরণের কুকুররাই আবার আমায় তাদের কুম্ভমেলার হারিয়ে যাওয়া বোন ভাবে। আমিও তাদের দেখলে পরে-"ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁতকা রে" বলে হামলে পড়ি। বাড়ি থেকে এদেশে আসার পর যখন রাস্তাঘাটে তেনাদের সাথে যথেচ্ছ মুলাকাতে ভাঁটা পড়ল, তৎসময় হইতেই কিঞ্চিৎ মনোকষ্টে ভুগিতেছিলাম। তা সান্ধ্যকালীন ঠেকের সামনে এঁনাদের বন্ধুসুলভ আমন্ত্রণকারী হাসিমুখ দর্শন করিয়া পূর্বতন আহ্লাদ জাগিয়া উঠিল। যাক বাবা, এখানে রাস্তাঘাট এক্কেবারে ফাঁকা নয়। দুপেয়েদের জঙ্গলে চারপেয়েও কটা পাওয়া যাবে কথা বলার মতন। পরে দেখেছিলাম যে তারা সংখ্যায় 'কটা' মাত্র নয়, বেশ অনেক কটাই। সংখ্যায় এবং চেহারায় আমাদের দেশের মতোই। একই রকম আবহাওয়া, তাই চেহারাও আমাদের মতোই। আর এই দোকানটি তাদেরও রাত্রিকালীন ঠেক। সারাদিন পাড়াবেড়িয়ে সন্ধ্যায় দোকানে ফিরে  আসে। যাইহোক, আপাতত তাদের "পরে দেখা হবে ভাই, এখন খেয়ে আসি" বলে এগিয়ে চললাম। সামনে ফেরিঘাটের কাছে দেখি একখানা পুঁচকে বাড়ি। সেটি ব্যাঙ্ক। এত রাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাঙ্ক বন্ধ। বাইরে দেখি একখানা এটিএম মেশিনও দাঁড় করানো আছে। দেখেই তো রে রে করে ছুটে  গেলাম। কিন্তু যা হয়, মেশিন আপাতত অকেজো। মুষড়ে চলে আসছি, একজন বললেন, আরো এগিয়ে বাজারেলাকে নাকি আরো একটি ব্যাংক এবং এটিএম আছে। এগোচ্ছি, দেখি একখানা 'সাবওয়ে', মানে সুড়ঙ্গ নয়, স্যান্ডউইচ এর দোকান। ওই মুহূর্তে ওখানে 'সাবওয়ে' দেখতে পেয়ে বিশ্বাস করুন, মনে হলো, হাতে স্বর্গ পেলাম। সাবওয়ে তে কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যাবেই যাবে।সুতরাং, এটিএম, টাকা তোলা ওসব পরে দেখা যাবে, আগে তো খাই। এরপর এটি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলেই হয়েছে আর কি। সাবওয়েটি একদম সাগরের পার ঘেঁষে। বাইরে বসার জায়গাটির পাঁচিলে এসে ধাক্কা দিচ্ছে একের পর এক ঢেউ। একবার মনে হলো এখানে বসেই খাই। কিন্তু দুজনেরই হোটেলের ওই বারান্দাটির জন্য মন ছটফট করছিল। ফিরে আসারই মনস্থির করলাম। টাকা তোলাও কাল হবেখন। কাল সকালেও হোটেলেই ব্রেকফাস্ট। সুতরাং টাকা এখনই না তুললেও চলবে। দুজনে দুখানা সাবওয়ের প্যাকেট হাতে দুলোতে দুলোতে আবার হেঁটে হেঁটে চারপেয়েদের শুভরাত্রি বলে ফিরে চললাম। বারান্দায় বসে খেতে খেতে ভাবছিলাম মনে আছে যে, আমরা এই দুই নিতান্ত সাধারণ গেঁয়ো ছেলে মেয়ে এরকম রাতে, আটলান্টিকের ঘাড়ে চড়ে নৈশাহার সারছি এ কয়েকবছর আগেও খানিক অভাবনীয়  ছিল বটে। নৈশাহারে যদিও স্যান্ডউইচ। তাও।