Wednesday, 20 March 2019

Learned to love

When I dreamed about love,
You were nowhere in my life.
When I tried to touch your core,
My care was not enough to reach you.
When I learned to smile,
There was no one to smile at.

I cried.
I fell down.
I deconstructed me.

Then I assembled me again.
Learned to live again.
Learned to love me.
Learned to reach me.

Then I reincarnated in a dark evening,
And learned to smile at me at last.

Since then, everyday, every moment,
I learned to immerse myself into me.

Now you smile at me,
Touched my hand.
I felt warmth of love there.

I cried again- yes, truly.
But now I trust me.
Now I learned to trust my love.
Now I am in the path to be me.

পাথরা

লাল মাটির প্রতি কি জানি একটা আকর্ষণ ছিলই প্রথম থেকে। যখন বছর দুই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে থাকার সুযোগ হল, তখন সাইকেল চালিয়ে লাল মাটির গন্ধ নিয়েছি অনেক। তখনো মেদিনীপুরে লাল মাটি বা মোরাম বিছানো রাস্তার অভাব ছিলনা। আর ইউনিভার্সিটির আশেপাশে ছিল কিশোর বয়স্ক শাল, সেগুন আর কাজু গাছের জঙ্গল। গোধূলিবেলায় লাল মাটি, কচি শাল গাছের সবুজ রং আর সাইকেলের চাকায় মোরামের কুড়কুড় শব্দ, এইসব জড়িয়ে ছিল আমার প্রেম। কিন্তু কখনোই মেদিনীপুর শহরের বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অনেক জায়গার নাম শুনতাম, যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু বাহন বলতে- সাইকেল। সে বেচারা কত দূরেই বা নিয়ে যেতে পারে? তাই অনেক জায়গাতেই যাওয়া হয়নি। পাথরাও না। খুব ইচ্ছে করছিল একবার যাবার। না, পাথরা দেখা হয়নি ভাল করে, বলা যায় পাথরা ছুঁয়ে এসেছি। এই কদিন আগে। সেই গল্পই বলি কেমন?

খড়গপুর বা মেদিনীপুর  যেদিক দিয়েই যাওনা কেন, পাথরা পড়বে মাঝামাঝি। তাই সুবিধা মত যেদিক দিয়ে খুশি গেলেই হল। আমরা গিয়েছিলাম খড়্গপুর থেকে। তা খড়গপুরের বম্বে রোডের (আমরা তো এখনো বম্বে রোডই বলি!) চৌরাস্তা থেকে মেদিনীপুরের রাস্তা ধরে খানিক এগোলেই তুমি পাবে আমতলা। ম্যাপ বলবে ক্ষুদিরাম পার্ক। সেখান থেকে বাঁ দিকের সরু রাস্তায় চোখ বন্ধ করে ঢুকে পড়ো। না বাপু আমতলার পর গাড়ি ঘোড়া বিশেষ পাবেনা এ রাস্তায়। তাই বাহনের ব্যবস্থা করে আসাই ভাল। রাস্তা বাঁধানো, তাই ছোট একটা গাড়ি নিয়ে নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়ো দেখি পাথরার রাস্তায়। এরপর তোমার ম্যাপ খুলে রাখার আর প্রয়োজন দেখিনা। ডানদিকে ততক্ষনে তোমায় রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে সাজুগুজু করে এসে দাঁড়িয়েছে কংসাবতী। ব্যস, বাকি রাস্তাটা ওর সাথেই যাওনা কেন? মাঝে সাঝে একটু আড়ালে চলে যায় বটে, কিন্তু তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, পাথরা পৌঁছানো পর্যন্ত কংসাবতী তোমার ডাইনে থাকবেই। দুপাশের লোকজন, ছোট ছোট দোকানপাট, পোষ্য আর বাড়িঘর দেখতে দেখতে এগোও না। ভালোই লাগবে দেখো। দুপুর শেষে বন্ধ বাজার, দোকান পাটের ঝাঁপ পড়ছে। দু- দুইখানি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের ঝাঁপও পড়ব পড়ব করছে হয়ত ততক্ষনে। এই সব দেখতে দেখতে তুমি এসে পৌঁছে গেছো এতক্ষনে হাতিহল্কা  মোড়ে। ওহো বলা হয়নি, এতক্ষন তুমি তো হাতিহল্কা রোড ধরে চলছিলে। এইবার হাতিহল্কা মসজিদকে তার মেলা, প্যান্ডেল, কাঁচের চুড়ি আর ঘুগনীর দোকান সহ বাঁদিকে বসিয়ে রেখে একটু বাঁয়ে বেঁকে তোমায় হাতিহল্কা টু পাথরা রোডে ঢুকতে হবে। পরিষ্কার চকচকে মাটির একতলা বা দোতলা বাড়ি। উঠোনে ভাত ঢেলে খাওয়া চলে এত পরিচ্ছন্ন আর তকতকে করে রাখা। বনবিভাগের শাল প্যান্টেশন দেখতে পাবে। কিন্তু এত কিলোমিটার রাস্তায় কোনো হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র দেখতে পাবে না। অন্তত রাস্তার ধারে তো নয়ই। বাড়িতে বয়স্ক লোকজন থাকলে ঐদিকেই আবার মনটা পড়ে থাকে কিনা। তাই শাল- সেগুন-বাঁশ আর ঘেঁটু গাছের ছায়ায় চলতে চলতে তুমি ভাববে, শরীর খারাপ হলে সবচেয়ে সামনের শহর মেদিনীপুর। রাত্তিরবেলায়, যানবাহনহীন এই রাস্তায় মেদিনীপুর নিয়ে যেতে হবে সামান্য থেকে সামান্যতম চিকিৎসার জন্যও। তখন তুমি ভাববে, তুমি কত ভাগ্যবান যে তুমি এই মুহূর্তে এখানকার ট্যুরিস্ট, স্থায়ী বাসিন্দা নও।

যাক যে যাক এসব কথা। পাথরার গল্পে ফিরি। হ্যাঁ ততক্ষনে তুমি কংসাবতীর সেচখালের ওপর সেই সাঁকোটার কাছে এসে পৌঁছেছো, যেখানে প্রায় তিরিশ বছর আগে প্রাইমারী স্কুলে পড়া শ্রীমান পিনাকী বাবা মায়ের সাথে পাথরা দেখতে এসে একটি নধর ফণীমনসার ঝাড়ে কষিয়ে লাথী মেরেছিলেন। কেন মেরেছিলেন তার কোনো সঠিক কারণ নেই। এই ধরণের কাজে সাধারণত থাকেও না। কিন্তু পা ঢাকা জুতো না পরে, ফণীমনসার ঝাড়ে লাথী কষালে কারণ থাকুক বা না থাকুক তার নির্দিষ্ট একটি ফলাফল নিশ্চিত থাকে। এক্ষেত্রেও ছিল। যথাযথই ছিল।

তা এই লাথী খালের ওপরে এখন আর বাঁশের সাঁকো নেই। এত বছর পরে থাকাটা কাম্যও নয়। রীতিমত কংক্রিটের ব্রিজ। দিব্য গাড়ি চলে। এর এই লাথী খাল পেরোলেই পাথরা গ্রামের সীমানা শুরু। হাতিহল্কা মোড় থেকে কংসাবতী একটু আড়ালে চলে গিয়েছিল। এবার দেখবে কেমন বাইরের পোশাকটি ছেড়ে, মুখ-হাত-পা ধুয়ে শাড়ি পরা কংসাবতী থেকে ফ্রক পড়া কাঁসাই হয়ে তোমায় আদর করে পাথরায় নিয়ে যায়। কাঁসাইয়ের বাঁধ ধরে বাকি রাস্তাটা চলতে চলতে দেখবে ডানদিকে নদীর পাড়ে গোটা, আধভাঙা, পুরো ভাঙা কত মন্দির। গাড়ি থামিয়ে চাইলে কাছে গিয়ে একটু দেখোই না কিছু গল্প শুনতে পাও কিনা। গল্প না শুনলে না হয় কাঁসাইএর চড়ায় শেষ শীতের সবজি ক্ষেতের পাশ দিয়ে একটু হাঁটলেই বা। তারপর আবার বাঁধে উঠে একটু সামনে এগোলেই পাথরার মন্দির পাড়া। যা দেখাবে বলেই কাঁসাই এই এত আপ্যায়ন করে তোমায় এখানে নিয়ে এলো। আসলে কি বলোতো, সেই অনেককাল আগে বিদ্যানন্দ ঘোষাল, নবাব আলীবর্দীর থেকে এই অঞ্চলের খাজনা আদায়ের অনুমতি পেলেন। আর এখানে একের পর এক মন্দির তৈরী করে ফেললেন। কেন বলতো? আরে, তাম্রলিপ্ত বন্দর তখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রধান বাণিজ্যপথ। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন সমস্ত ধর্মের লোকজনের যাতায়াত সে রাস্তায়। তা এত গুলি হিন্দু মন্দির একসাথে একজায়গায় পেলে বাণিজ্যযাত্রার আগে পুণ্যসঞ্চয়ী হিন্দু বণিক কি আর তমলুক বন্দরের এত কাছের এই পাথরায় একবার আসবে না? আর স্থান মাহাত্ম্য প্রচার হলে তো আর কথাই নেই। আর যত বেশি লোক সমাগম, তত বেশি খাজনা আদায়ের সুযোগ। সুতরাং বিদ্যানন্দ আলিবর্দি কে খুশি করতে আর নিজের লাভ রাখতে পাথরাকে অল্পদিনের মধ্যেই মন্দির নগরীতে পরিণত করে ফেললেন। কিন্তু বিদ্যানন্দের হিসেবের গোড়ায় যে গলদ। তিনি হিন্দু মন্দির স্থাপন করে কর আদায়ের রাস্তা খুঁজেছিলেন। আলীবর্দী খুশি তো হলেনই না, উপরন্তু বিদ্যানন্দ গেলেন কারাগারে। এবং শেষে মৃত্যু। শোনা যায়, একটি হাতির ওপর দায়িত্ত্ব ছিল বিদ্যানন্দের মাথা গুঁড়িয়ে দেবার জন্য, কিন্তু হাতিটিকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেকাজ করানো যায়নি। এই ঘটনার পর পাথরা সেসময়ের বাণিজ্য পথে আরো বিখ্যাত হয়ে গেল।  আর বিদ্যানন্দের বংশধরেরা নবাবের ভয়ে ঘোষাল পদবী বদলে মজুমদার হলেন। পরে মজুমদারেরা আর তাঁদেরই আর এক শাখা, বন্দোপাধ্যায়রা মিলে পাথরার মন্দিরের সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। তারপর? তারপর আর কি? যা হয়। কলসির জল শেষ হয় আর মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণও চলে যায় স্বয়ং সময়ের হাতে। সময় গড়িয়েছে আর মন্দিরের রমরমা গেছে, বিগ্রহ গেছে, মন্দিরের গা থেকে ইঁট পর্যন্ত চলে গেছে। তারপর এই সেদিন কিছু স্থানীয় মানুষ, খড়গপুর আই আইটির উদ্যোগে মন্দিরগুলির সংরক্ষণ শুরু হয়।  তবে তুমি এখনো গিয়ে দেখবে কোথাও কোনো পাঁচিল নেই। রাতের অন্ধকারে যে কেউ যা খুশি করতে পারে। কাঁসাইয়ের বাঁধের দুপাড়ে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র অসংরক্ষিত ইতিহাস।

গাড়ি থামার পর দেখবে, ডানদিকে একটি বড় মন্দির। ঐটি নবরত্ন মন্দির। সবচাইতে বড় আর অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত। টেরাকোটার কাজগুলি এখনো তোমার দিকে তাকিয়ে হাসবে দেখো। তার ডাইনে ছোট নাটমন্দির আর শিব মন্দির। আর দুটি ছোট ছোট ঘরও দেখতে পাবে। পূজারীর থাকতেন সে ঘরে? না কি দেবতার ভোগের ঘর? দেউলকে জিজ্ঞাসা করো তো গেলে। ওই দেখো, নবরত্ন মন্দিরের পাশ দিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে কাঁসাই। দেখোনা কেমন উর্বর আঁচলা বিছিয়ে কাত হয়ে থাকা ছিপ নৌকাটা কোলে করে পাতলা কুয়াশা জড়িয়ে শুয়ে আছে। যাও না ডুমুরগাছটার পাশ দিয়ে কেমন পায়ে চলা রাস্তা নেমে গেছে নদী পর্যন্ত। ওই যে গো, ওই মেঠো আল ধরে নদী থেকে ভিজে কাপড়ে মন্দিরের দিকে উঠে আসছে ঠাকুমা। হাতে একগোছা বাসন। সামনে হাঁটছে তার কঞ্চি হাতে ন্যাংটাপুটো বীরপুরুষ নাতিটি। তাঁদের উঠে আসার রাস্তা দেবার পর সাবধানে নেমে পড়ো দিকিনি নদীর কোলে। একটুও অবাধ্য নয় আমাদের কাঁসাই। ভারী ভাল মেয়ে। তোমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে না। মুখে, ঘাড়ের পেছনে, দুচোখে তাকে মেখে দেখো, কেমন ঠান্ডা।

নামার সময় দেখো দুটি ভাঙা খিলান। হয়ত ঐটেই ছিল নদীপথে পাথরার পুজো দিতে আসা বণিকের মন্দিরে ঢোকার প্রধান পথ।  এতদিন পরে সেকথা ঠিক কিনা কে আর বলে দেবে? কাঁসাইয়ের আদর মেখে তুমিও উঠে এসো সেই একই পথ দিয়ে। নাহয় আজ আর সেই গর্বিত খিলান পথ নেই, কিন্তু কাঁসাই তো আছে। না হয় মন্দিরের বিগ্রহ আজ অন্তর্হিত, কিন্তু ইতিহাসের সেই মন্দির তো আছে।  সেই মন্দিরের গায়ে হাত দিলে খড়খড়ে ঝামাপাথর আর টেরাকোটার মূর্তির পাশ দিয়ে পুরোনো তেল সিঁদুর আর ধুনোর গন্ধ কি একটুও চুঁইয়ে আসবে না তোমার কাছে? ঘাড় উঁচু করে দেখতো একবার সেই পুরোনো কারিগরের হাতের ছোঁয়ায় পাথরে জেগে ওঠা সূক্ষ্ম আল্পনা আজও নিজেকে কালের গর্ভে তলিয়ে যেতে দেয়নি। তোমারই জন্য আজও সে সারা গায়ে পশ্চিমের কমলা রোদের প্রসাধন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইবার দেখোতো, সেদিকে তাকিয়ে লাল মাটি, লাল রোদ্দুর আর লাল ঝামাপাথরের মন্দির আর তার ফিসফিসিয়ে বলা ইতিহাস তোমার চোখ থেকে একফোঁটা জল বের করতে পারে কিনা। কান্না নয়, ইতিহাস আর সুন্দরকে স্পর্শ করার আবেগ।

কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে চোখকে যে ভিজতে নেই। লোকে দেখলে সে এক কান্ড হবে যে। তাই তুমি চটপট বাঁহাতের কড়ি আঙ্গুল ছুঁইয়ে চোখের কোন থেকে জলের ফোঁটাটা সরিয়ে তুমি মন দেবে বাঁধের ওপারের মন্দিরগুলোয়। সামনেই ওই দেখো একটি চৌকোনা একতলা বাড়ি। দেখে তোমার মনে হবে, পুরোনো জমিদারের সেরেস্তা ঘর বুঝি। অথবা মন্দিরের অফিসঘর। আজকালের মন্দিরে যেমন থাকে। আবার নহবৎ খানাও হতে পারে। সত্যি করে যে কি তার আমি কি জানি? কোথাও কিচ্ছুটি লেখা নেই যে। তখন তোমার কৌতূহল বাড়বে। উত্তেজনাও। পাশে বানানো সিঁড়ি ছেড়ে বাঁধের ঢাল বেয়েই তরতরিয়ে নেমে যাবে তুমি নিচে। নেমেই দেখবে তিনটে পাশাপাশি শিব মন্দির। যেমন আটচালা সারি সারি শিবের মন্দির থাকে আর কি বাংলার নানান জায়গায়। ভেতরের শিবলিঙ্গের জায়গায় এক একটি গহ্বর। শিব মন্দিরের ডানদিকে একটি খন্ডহর। তার একটি সিঁড়ি আজও অক্ষত। এটি মন্দির নয়, আসলে যে কি ছিল আজ আর তা জানার উপায় নেই। এই চত্বরে আরো একটি মন্দির তুমি পাবে। পারলে একটু ছুঁয়ে দেখো মাটিতে প্রায় মিশে যাওয়া ইঁটের সারিগুলোকে।

সেখান থেকে একটু চোখ তুললেই দেখবে ডানদিকে দুর্গাদালান। সুন্দর তোরণ এখনো অক্ষত। আশপাশটা একটু ভেঙে গেছে বটে কিন্তু ঝামাপাথরের সহ্যশক্তির নমুনা এখনও আছে।  ভাল করে ঘুরেঘারে দেখে নাও দিকি চটপট। নইলে আবার কখন প্রি-বিয়ে, পোষ্ট-বিয়ে ছবি তোলাতে একজোড়া মানুষ একটি ফটোগ্রাফার ঘাড়ে করে ভটভটি হাঁকিয়ে আসেপাশের শহর থেকে এসে পড়ে। তুমি গেলে শিব মন্দির আর তার ইতিহাস দেখতে, গিয়ে দেখলে জ্বলজ্বলে একটি বর্তমান সাদা পাঞ্জাবি পরে, লাল শাড়ি পরা-শ্যাম্পু চুলের আর একটি জ্বলজ্বলে বর্তমানকে কাঁখে করে দাঁড়িয়ে আছে। ফটোগ্রাফারের সহকারী লাল শাড়ির নীল আঁচল এমন ভাবে ধরে আছে যে সূর্য্যের আলো দারুন এক রিফ্লেকশন তৈরী করেছে। আর ফটোগ্ৰাফার শুয়ে, বসে, উবু হয়ে, কাত হয়ে সহকারীকে ফ্রেমের বাইরে রেখে, তোমার ইতিহাসকে পিছনে রেখে, বর্তমানের দলিল তৈরী করছে। এরপর পাঞ্জাবী, শাড়ির রং বদল হবে। একজোড়া বর্তমানের পজিশন বদলাবে। প্রেমের প্রকাশ বদলাবে, ক্যামেরার লেন্স বদলাবে। এইসবের মাঝেই কিন্তু তোমায় ঢুকে পড়ে ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে নইলে সূয্যিমামা ঘুমোতে গেলে আর এখানে কিচ্ছু নেই দেখার। আলো টালোর বালাই নেই যে এই ফটোসেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে তুমি। চায়ের দোকানও নেই যে গিয়ে বসবে। সুতরাং প্রেমের মাঝে মূর্তিমান বেসুরের মতন তুমি সে চত্বরে ঢুকে পড়বে আর বাকি দুটো মন্দিরও দেখে নেবে। তারপর মাঠের শেষে, শেষ মন্দিরটা যখন তুমি দেখবে তখন পুরোনো বাংলা ভাষার অক্ষর কিছুটা সেই মন্দিরের গায়ে তোমার চোখে পড়লেও পড়তে পারে। আর কালো পাথরের একটি মূর্তি মন্দিরের দরজায় আজও পাহারা দিচ্ছে দেখো। এটিই বোধহয় পঞ্চরত্ন মন্দির। জিজ্ঞাসা কোরো দিকি।

এই চত্বর পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় একটু এগিয়ে বাঁদিকে নেমে গেলে আরো কিছু মন্দির আছে।  সেসব আমার আর দেখা হয়নি। বেলাবেলি পৌঁছে গেলে তুমি কিন্তু দেখতে ভুলোনা। বেলাবেলি কেন? আরে ফিরতে হবে না? পাথরায় কিন্তু থাকার জায়গা বলে কিচ্ছুটি নাই আগেই বলে রাখলুম। তা ওই বাংলা লেখা মন্দিরের পাশ দিয়ে বাঁধে উঠে এসো। রোদ্দুর তখন প্রায় নেই বললেই চলে। বাঁধের গায়ে বেড়ে উঠেছে শিয়ালকাঁটার ঝোপ। আর তাদের ঝকঝকে হলদে রঙের ফুল। লালচে রোদে শ্যাওলা পড়া লাল মন্দিরের ব্যাকগ্রাউন্ডে তোমারও সেই হলুদ ফুলের ছবি তুলতে ইচ্ছে হবে দেখো। দেখবে কেমন করে রোদ্দুরের শেষ কিরণটা তোমার আর ওই হলুদ ফুলের ওপর একসাথে এসে পড়ে। ঐটিই পাথরার দেওয়া উপহার তোমার জন্য। সামলে নিয়ে গাড়িতে উঠে বোসো। ফিরতে হবে তো?

ফেরার সময় গাড়িতে উঠতে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখোতো ফটোসেশনের শেষে মন্দির চত্বর থেকে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় প্রেমিকের মাথায় ফেজ টুপি আর প্রেমিকার গায়ে কালো বোরখা উঠেছে কিনা। কে যেন বলে, কোথায় যেন শোনা যায়, আমাদের দেশে নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন। হবেওবা অন্য কোথাও। এখানে সেসব বালাই নেই। নিশ্চিন্তে এসে দেখে যেও। তারপর যখন কাঁসাইয়ের বাঁধ ধরে পড়ন্ত দিনের আলোকে সামনে নিয়ে আবার ফিরবে, হাতিহল্কার মসজিদের পাশে গাড়ি থামিয়ে একভাঁড় চা আর সুজির বিস্কুট খেও কেমন। ভাল লাগবে। চা- বিস্কুটের স্বাদের কথা বলছি না। সে আমি কেমন করে জানব? আমি তো খাই-ই নি। আমি বলছি অন্য কথা। ওই ছোট দোকানের পেছনের ঝুপসি বাঁশবন থেকে আসা ঝিঁঝিঁর ডাক শুনবে, চা খেতে খেতে মসজিদের আজান শুনবে, বিস্কুটের লোভে সাদা কালো একটা কুকুর এসে জুটবে, তার জন্য তুমি আরো একটা বিস্কুট কিনে তাকে অল্প অল্প করে ভেঙে দেবে। সে খাবে আর হাসি মুখে অল্প অল্প লেজ নাড়বে। তুমিও খুব অল্প অল্প করে চায়ে চুমুক দেবে যাতে সময়টা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে না যায়।

দেখবে, অনেকদিন আগে ছোটবেলায় বাড়িতে অতিথি এলে শোনা একটা কথা, আজানের সুর ছাপিয়ে তোমার কানে এসে পৌঁছবে। পৌঁছবেই। "আজকের দিনটা থেকে গেলে হতো না? কাল দুটি মুখে দিয়ে নাহয়......."
  







  

কলমি লতার জোড়

সাদা পাতায় আঁচড় কাটতে আগে কালি-কলম-মন তিনটেরই খোঁজ পড়ত। প্রথম দুটির আজকাল বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না যদিও, শেষেরটি না হলেই নয়। আর চিরকালই, যেটি না হলেই নয় সেটিই সময় বুঝে কখনো কখনো বাড়ন্ত হয়ে পড়ে। মনের খোঁজ পাওয়া গেলেই তো শুধু হল না, উপরের সমস্ত উথালপাথাল সরিয়ে একদম ভিতর থেকে উথালপাথালের সঠিক কারণটিকে চিনে নিয়ে তার পর তাকে বের করে আনা। তবেই সাদা পাতায় প্রথম আঁচড়টি পড়ে।

অনেক ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে, তখন সদ্য পড়াশুনা শুরু করেছি হয়ত।  সন্ধ্যেয় পড়তে বসতে হয় কিন্তু একদিন না বসলেও কিছু ক্ষতি হয়না। তখন কেবল রুটিনবদ্ধ পড়াশুনাটাই ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার একমাত্র শিক্ষা ছিল না। ভাগ্যিস! অনেক অনেক এমন কিছু শিখেছিলাম যা স্কুলের ব্যাগে থাকা বইয়ে লেখা ছিল না। ছিল দিদিমনি মাস্টারমশাইদের মুখের কথায়, সরস্বতী পুজোর আগের সন্ধ্যেয় বুড়ো ঠাকুরদাদার গল্পে, পাড়ার কাকীমা-জ্যেঠিমাদের অবাধ রান্নাঘরে। গ্রামের মেয়ে আমি। গোটা একটা পাড়া এককালে একটি পরিবার ছিল।  তারপর ডালপালা মেলতে মেলতে নতুন নতুন রান্নাঘর, নতুন নতুন বাড়ি। যা হয়। তাই ছোট থেকেই পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই কাকা-জ্যাঠা-বৌদি- দিদি। লতায় পাতায় সম্পর্কিত। বিজয়া দশমীতে আমার মায়ের ঘুগনি বাটি বরাদ্দ ওই বাড়ির দিদির জন্য। আর ওই কাকিমার বড় বড় গোল্লা গোল্লা নাড়ুর লোভে আমার বাড়িতে খাওয়া বন্ধ। অরন্ধনের দিন ওই বাড়ির বড়বৌদি যতক্ষন না নারকেল ভাজা, চালতার চাটনি, ওলের বড়া নিয়ে হাজির হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের বাড়ির ভাতের থালায় কেউ হাত দেয় না। জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে সব।  একই পুকুরের কলমি লতার মতোই। তখন ক্লাস থ্রি বা ফোর হবে, সদ্য সাইকেল চালানো শিখছি। বাবার বড় সাইকেলে, হাফ প্যাডেল। মানে ওই তেকাঠির মধ্যে দিয়ে একটা পা গলিয়ে ডান হাত দিয়ে সাইকেলের সিটটা ধরে অর্ধেকটা উঠে চালানো আর কি। অমন ছোটবেলায় সিটে উঠে প্যাডেল করার আগে সকলেই করেছে। সাইকেল সোজা গিয়ে কিরকম করে যেন ধাক্কা খেল ভাঙা পাঁচিলে, আর আমার বাঁপায়ের শেষ দুটি আঙুলের নখ, চামড়া সব জট পাকিয়ে গেল। বাড়িতে সেদিন বাবা মা দুজনেই নেই। ওই কলমি লতার জোড় ছিল বলে সেদিন বাবা মায়ের বাড়িতে না থাকাটা টের পাইনি। বাবা মা কাছে ছিল না কিন্তু বড়বৌদি ছিল।  পাড়ার প্রায় সক্কলের বড় বৌদি। তার পর তো দুম করে একদিন সকালে উঠে শুনলাম গতকাল রাত থেকে বড়বৌদি নেই হয়ে গেছে। এরকমই হয়, ওই যে বললাম, যার থাকাটা খুব জরুরি সে দুম করে রাতারাতি নেই হয়ে যায়। বাকি সকলকে সাবালক হতেই হয় তখন। তারপর এই তো সেদিন, গেল বার বাড়ি থেকে চলে আসার দিন দুই আগে, ওই বাড়ির কাকিমা, এক টিফিনবাক্স ভর্তি নাড়ু, পিঠে নিয়ে আমায় দিলে। "চলে যাবি, আবার কবে আসবি, তাই একটু করলাম তোর জন্য।" এত ভালবাসা আমি কোথায় আর পাই?  আমাদের তিনজনের পরিবারের তখন ছন্নছাড়া অবস্থা। সদ্য একটা বীভৎস বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার লড়াই চলেছে তিনজনের। একেকটা দিন সুস্থু ভাবে যাপন করতে পারলেই মনে হয় যাক আজকের দিনটা ঠিকঠাক কাটলো। মনে একটু একটু করে আশার সঞ্চার হয়। তখন মেয়ে দুদিন পর চলে যাবে বলে মায়ের আর বিশেষ কিছু রেঁধে দেবার পরিস্থিতি ছিল না।  সেটি আন্দাজ করে কাকিমা বাক্স ভরে খাবার নিয়ে এসেছেন। এত ভালবাসা পাবার যোগ্য কিনা আমি জানিনা। কিছুই বলতে পারিনি সেদিন কাকিমাকে, বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে চোখের জল থামিয়েছিলাম। কলমি লতার জোড় সব। একই পুকুরে বাস। মনে হয় সব আলাদা আলাদা গাছ বুঝি। জলের ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু জোড় আছে। দরকার মতন ঠিকই টান পড়ে।

একথা সেকথায় অনেক দূর চলে গেছি, যা বলছিলাম, মনের কথা। তা সেই ছোট্টবেলায় যখন বইয়ের অক্ষরই পড়তে হবে এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না, সেরকমই এক সন্ধ্যেবেলায়, ছোড়দাদুর বাড়িতে, আমরা তিনজন তুতো ভাইবোন মিলে 'ভবসাগর তারণ কারণ হে' গানটা গাইছিলাম। গাইছিলাম না বলে শিখছিলাম বলাই ভাল। কে যে শেখাচ্ছিল তা আর মনে পড়ে না। দাদুও হতে পারে, পিসিও হতে পারে বা দিদিও হতে পারে। গানটার দুটি লাইন শিখেছিলাম। চোখ বন্ধ করে গাইছিলাম। বেসুরেই হয়ত। কিন্তু বেশ ভাল লাগছিল এটুকু মনে পড়ে। সেই প্রথম বোধহয় মনকে শান্ত হতে দেখেছিলাম। তখন বুঝিনি কিচ্ছুই। এখনো কি ছাই বুঝি? তারপর একা একা, ভিড়ের মধ্যে কত জায়গায় কত রকম ভাবে, কতবার এই দুলাইন গেয়েছি মনে মনে মনে পড়ে না।

মনকে লাগাম পরিয়ে বাইরে টুকুন পরিপাটি রেখে চলার চেষ্টায় দিন গেল। ইচ্ছেরা জন্মায়, অপেক্ষা করে পূরণ হবার। আমরা বড় হই আর ইচ্ছের পায়ের বেড়ি ক্রমশঃ শক্ত হতে হতে পাথরের মতন ইচ্ছের ঘাড়ে চেপে বসে। এখন রইল বাকি অহল্যার মতন প্রতীক্ষা, কখন কেউ এসে পাথর গলিয়ে ইচ্ছেকে মুক্তি দেয়। মনের সে একমুখী গতিই বা কই আর তার জোরই বা কত যে নিজে হাতে আগল খোলে? পাগলের মতন কেবল এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। অযুত শক্তি নিয়ে কেবল রাস্তা হাতড়ে চলা। তারপর এদেওয়ালে ওদেওয়ালে মাথা কুটে কুটে শক্তিক্ষয়। তারপর, সে শক্তির যখন তিলমাত্র অবশিষ্ট, তখন মনের টনক নড়ল। এই যাহ সমস্ত কিছুই যে রইল পড়ে, কিছুই যে করা হল না। এবার উপায়?