সাদা পাতায় আঁচড় কাটতে আগে কালি-কলম-মন তিনটেরই খোঁজ পড়ত। প্রথম দুটির আজকাল বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না যদিও, শেষেরটি না হলেই নয়। আর চিরকালই, যেটি না হলেই নয় সেটিই সময় বুঝে কখনো কখনো বাড়ন্ত হয়ে পড়ে। মনের খোঁজ পাওয়া গেলেই তো শুধু হল না, উপরের সমস্ত উথালপাথাল সরিয়ে একদম ভিতর থেকে উথালপাথালের সঠিক কারণটিকে চিনে নিয়ে তার পর তাকে বের করে আনা। তবেই সাদা পাতায় প্রথম আঁচড়টি পড়ে।
অনেক ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে, তখন সদ্য পড়াশুনা শুরু করেছি হয়ত। সন্ধ্যেয় পড়তে বসতে হয় কিন্তু একদিন না বসলেও কিছু ক্ষতি হয়না। তখন কেবল রুটিনবদ্ধ পড়াশুনাটাই ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার একমাত্র শিক্ষা ছিল না। ভাগ্যিস! অনেক অনেক এমন কিছু শিখেছিলাম যা স্কুলের ব্যাগে থাকা বইয়ে লেখা ছিল না। ছিল দিদিমনি মাস্টারমশাইদের মুখের কথায়, সরস্বতী পুজোর আগের সন্ধ্যেয় বুড়ো ঠাকুরদাদার গল্পে, পাড়ার কাকীমা-জ্যেঠিমাদের অবাধ রান্নাঘরে। গ্রামের মেয়ে আমি। গোটা একটা পাড়া এককালে একটি পরিবার ছিল। তারপর ডালপালা মেলতে মেলতে নতুন নতুন রান্নাঘর, নতুন নতুন বাড়ি। যা হয়। তাই ছোট থেকেই পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই কাকা-জ্যাঠা-বৌদি- দিদি। লতায় পাতায় সম্পর্কিত। বিজয়া দশমীতে আমার মায়ের ঘুগনি বাটি বরাদ্দ ওই বাড়ির দিদির জন্য। আর ওই কাকিমার বড় বড় গোল্লা গোল্লা নাড়ুর লোভে আমার বাড়িতে খাওয়া বন্ধ। অরন্ধনের দিন ওই বাড়ির বড়বৌদি যতক্ষন না নারকেল ভাজা, চালতার চাটনি, ওলের বড়া নিয়ে হাজির হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের বাড়ির ভাতের থালায় কেউ হাত দেয় না। জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে সব। একই পুকুরের কলমি লতার মতোই। তখন ক্লাস থ্রি বা ফোর হবে, সদ্য সাইকেল চালানো শিখছি। বাবার বড় সাইকেলে, হাফ প্যাডেল। মানে ওই তেকাঠির মধ্যে দিয়ে একটা পা গলিয়ে ডান হাত দিয়ে সাইকেলের সিটটা ধরে অর্ধেকটা উঠে চালানো আর কি। অমন ছোটবেলায় সিটে উঠে প্যাডেল করার আগে সকলেই করেছে। সাইকেল সোজা গিয়ে কিরকম করে যেন ধাক্কা খেল ভাঙা পাঁচিলে, আর আমার বাঁপায়ের শেষ দুটি আঙুলের নখ, চামড়া সব জট পাকিয়ে গেল। বাড়িতে সেদিন বাবা মা দুজনেই নেই। ওই কলমি লতার জোড় ছিল বলে সেদিন বাবা মায়ের বাড়িতে না থাকাটা টের পাইনি। বাবা মা কাছে ছিল না কিন্তু বড়বৌদি ছিল। পাড়ার প্রায় সক্কলের বড় বৌদি। তার পর তো দুম করে একদিন সকালে উঠে শুনলাম গতকাল রাত থেকে বড়বৌদি নেই হয়ে গেছে। এরকমই হয়, ওই যে বললাম, যার থাকাটা খুব জরুরি সে দুম করে রাতারাতি নেই হয়ে যায়। বাকি সকলকে সাবালক হতেই হয় তখন। তারপর এই তো সেদিন, গেল বার বাড়ি থেকে চলে আসার দিন দুই আগে, ওই বাড়ির কাকিমা, এক টিফিনবাক্স ভর্তি নাড়ু, পিঠে নিয়ে আমায় দিলে। "চলে যাবি, আবার কবে আসবি, তাই একটু করলাম তোর জন্য।" এত ভালবাসা আমি কোথায় আর পাই? আমাদের তিনজনের পরিবারের তখন ছন্নছাড়া অবস্থা। সদ্য একটা বীভৎস বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার লড়াই চলেছে তিনজনের। একেকটা দিন সুস্থু ভাবে যাপন করতে পারলেই মনে হয় যাক আজকের দিনটা ঠিকঠাক কাটলো। মনে একটু একটু করে আশার সঞ্চার হয়। তখন মেয়ে দুদিন পর চলে যাবে বলে মায়ের আর বিশেষ কিছু রেঁধে দেবার পরিস্থিতি ছিল না। সেটি আন্দাজ করে কাকিমা বাক্স ভরে খাবার নিয়ে এসেছেন। এত ভালবাসা পাবার যোগ্য কিনা আমি জানিনা। কিছুই বলতে পারিনি সেদিন কাকিমাকে, বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে চোখের জল থামিয়েছিলাম। কলমি লতার জোড় সব। একই পুকুরে বাস। মনে হয় সব আলাদা আলাদা গাছ বুঝি। জলের ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু জোড় আছে। দরকার মতন ঠিকই টান পড়ে।
একথা সেকথায় অনেক দূর চলে গেছি, যা বলছিলাম, মনের কথা। তা সেই ছোট্টবেলায় যখন বইয়ের অক্ষরই পড়তে হবে এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না, সেরকমই এক সন্ধ্যেবেলায়, ছোড়দাদুর বাড়িতে, আমরা তিনজন তুতো ভাইবোন মিলে 'ভবসাগর তারণ কারণ হে' গানটা গাইছিলাম। গাইছিলাম না বলে শিখছিলাম বলাই ভাল। কে যে শেখাচ্ছিল তা আর মনে পড়ে না। দাদুও হতে পারে, পিসিও হতে পারে বা দিদিও হতে পারে। গানটার দুটি লাইন শিখেছিলাম। চোখ বন্ধ করে গাইছিলাম। বেসুরেই হয়ত। কিন্তু বেশ ভাল লাগছিল এটুকু মনে পড়ে। সেই প্রথম বোধহয় মনকে শান্ত হতে দেখেছিলাম। তখন বুঝিনি কিচ্ছুই। এখনো কি ছাই বুঝি? তারপর একা একা, ভিড়ের মধ্যে কত জায়গায় কত রকম ভাবে, কতবার এই দুলাইন গেয়েছি মনে মনে মনে পড়ে না।
মনকে লাগাম পরিয়ে বাইরে টুকুন পরিপাটি রেখে চলার চেষ্টায় দিন গেল। ইচ্ছেরা জন্মায়, অপেক্ষা করে পূরণ হবার। আমরা বড় হই আর ইচ্ছের পায়ের বেড়ি ক্রমশঃ শক্ত হতে হতে পাথরের মতন ইচ্ছের ঘাড়ে চেপে বসে। এখন রইল বাকি অহল্যার মতন প্রতীক্ষা, কখন কেউ এসে পাথর গলিয়ে ইচ্ছেকে মুক্তি দেয়। মনের সে একমুখী গতিই বা কই আর তার জোরই বা কত যে নিজে হাতে আগল খোলে? পাগলের মতন কেবল এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। অযুত শক্তি নিয়ে কেবল রাস্তা হাতড়ে চলা। তারপর এদেওয়ালে ওদেওয়ালে মাথা কুটে কুটে শক্তিক্ষয়। তারপর, সে শক্তির যখন তিলমাত্র অবশিষ্ট, তখন মনের টনক নড়ল। এই যাহ সমস্ত কিছুই যে রইল পড়ে, কিছুই যে করা হল না। এবার উপায়?
অনেক ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে, তখন সদ্য পড়াশুনা শুরু করেছি হয়ত। সন্ধ্যেয় পড়তে বসতে হয় কিন্তু একদিন না বসলেও কিছু ক্ষতি হয়না। তখন কেবল রুটিনবদ্ধ পড়াশুনাটাই ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার একমাত্র শিক্ষা ছিল না। ভাগ্যিস! অনেক অনেক এমন কিছু শিখেছিলাম যা স্কুলের ব্যাগে থাকা বইয়ে লেখা ছিল না। ছিল দিদিমনি মাস্টারমশাইদের মুখের কথায়, সরস্বতী পুজোর আগের সন্ধ্যেয় বুড়ো ঠাকুরদাদার গল্পে, পাড়ার কাকীমা-জ্যেঠিমাদের অবাধ রান্নাঘরে। গ্রামের মেয়ে আমি। গোটা একটা পাড়া এককালে একটি পরিবার ছিল। তারপর ডালপালা মেলতে মেলতে নতুন নতুন রান্নাঘর, নতুন নতুন বাড়ি। যা হয়। তাই ছোট থেকেই পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই কাকা-জ্যাঠা-বৌদি- দিদি। লতায় পাতায় সম্পর্কিত। বিজয়া দশমীতে আমার মায়ের ঘুগনি বাটি বরাদ্দ ওই বাড়ির দিদির জন্য। আর ওই কাকিমার বড় বড় গোল্লা গোল্লা নাড়ুর লোভে আমার বাড়িতে খাওয়া বন্ধ। অরন্ধনের দিন ওই বাড়ির বড়বৌদি যতক্ষন না নারকেল ভাজা, চালতার চাটনি, ওলের বড়া নিয়ে হাজির হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের বাড়ির ভাতের থালায় কেউ হাত দেয় না। জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে সব। একই পুকুরের কলমি লতার মতোই। তখন ক্লাস থ্রি বা ফোর হবে, সদ্য সাইকেল চালানো শিখছি। বাবার বড় সাইকেলে, হাফ প্যাডেল। মানে ওই তেকাঠির মধ্যে দিয়ে একটা পা গলিয়ে ডান হাত দিয়ে সাইকেলের সিটটা ধরে অর্ধেকটা উঠে চালানো আর কি। অমন ছোটবেলায় সিটে উঠে প্যাডেল করার আগে সকলেই করেছে। সাইকেল সোজা গিয়ে কিরকম করে যেন ধাক্কা খেল ভাঙা পাঁচিলে, আর আমার বাঁপায়ের শেষ দুটি আঙুলের নখ, চামড়া সব জট পাকিয়ে গেল। বাড়িতে সেদিন বাবা মা দুজনেই নেই। ওই কলমি লতার জোড় ছিল বলে সেদিন বাবা মায়ের বাড়িতে না থাকাটা টের পাইনি। বাবা মা কাছে ছিল না কিন্তু বড়বৌদি ছিল। পাড়ার প্রায় সক্কলের বড় বৌদি। তার পর তো দুম করে একদিন সকালে উঠে শুনলাম গতকাল রাত থেকে বড়বৌদি নেই হয়ে গেছে। এরকমই হয়, ওই যে বললাম, যার থাকাটা খুব জরুরি সে দুম করে রাতারাতি নেই হয়ে যায়। বাকি সকলকে সাবালক হতেই হয় তখন। তারপর এই তো সেদিন, গেল বার বাড়ি থেকে চলে আসার দিন দুই আগে, ওই বাড়ির কাকিমা, এক টিফিনবাক্স ভর্তি নাড়ু, পিঠে নিয়ে আমায় দিলে। "চলে যাবি, আবার কবে আসবি, তাই একটু করলাম তোর জন্য।" এত ভালবাসা আমি কোথায় আর পাই? আমাদের তিনজনের পরিবারের তখন ছন্নছাড়া অবস্থা। সদ্য একটা বীভৎস বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার লড়াই চলেছে তিনজনের। একেকটা দিন সুস্থু ভাবে যাপন করতে পারলেই মনে হয় যাক আজকের দিনটা ঠিকঠাক কাটলো। মনে একটু একটু করে আশার সঞ্চার হয়। তখন মেয়ে দুদিন পর চলে যাবে বলে মায়ের আর বিশেষ কিছু রেঁধে দেবার পরিস্থিতি ছিল না। সেটি আন্দাজ করে কাকিমা বাক্স ভরে খাবার নিয়ে এসেছেন। এত ভালবাসা পাবার যোগ্য কিনা আমি জানিনা। কিছুই বলতে পারিনি সেদিন কাকিমাকে, বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে চোখের জল থামিয়েছিলাম। কলমি লতার জোড় সব। একই পুকুরে বাস। মনে হয় সব আলাদা আলাদা গাছ বুঝি। জলের ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু জোড় আছে। দরকার মতন ঠিকই টান পড়ে।
একথা সেকথায় অনেক দূর চলে গেছি, যা বলছিলাম, মনের কথা। তা সেই ছোট্টবেলায় যখন বইয়ের অক্ষরই পড়তে হবে এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না, সেরকমই এক সন্ধ্যেবেলায়, ছোড়দাদুর বাড়িতে, আমরা তিনজন তুতো ভাইবোন মিলে 'ভবসাগর তারণ কারণ হে' গানটা গাইছিলাম। গাইছিলাম না বলে শিখছিলাম বলাই ভাল। কে যে শেখাচ্ছিল তা আর মনে পড়ে না। দাদুও হতে পারে, পিসিও হতে পারে বা দিদিও হতে পারে। গানটার দুটি লাইন শিখেছিলাম। চোখ বন্ধ করে গাইছিলাম। বেসুরেই হয়ত। কিন্তু বেশ ভাল লাগছিল এটুকু মনে পড়ে। সেই প্রথম বোধহয় মনকে শান্ত হতে দেখেছিলাম। তখন বুঝিনি কিচ্ছুই। এখনো কি ছাই বুঝি? তারপর একা একা, ভিড়ের মধ্যে কত জায়গায় কত রকম ভাবে, কতবার এই দুলাইন গেয়েছি মনে মনে মনে পড়ে না।
মনকে লাগাম পরিয়ে বাইরে টুকুন পরিপাটি রেখে চলার চেষ্টায় দিন গেল। ইচ্ছেরা জন্মায়, অপেক্ষা করে পূরণ হবার। আমরা বড় হই আর ইচ্ছের পায়ের বেড়ি ক্রমশঃ শক্ত হতে হতে পাথরের মতন ইচ্ছের ঘাড়ে চেপে বসে। এখন রইল বাকি অহল্যার মতন প্রতীক্ষা, কখন কেউ এসে পাথর গলিয়ে ইচ্ছেকে মুক্তি দেয়। মনের সে একমুখী গতিই বা কই আর তার জোরই বা কত যে নিজে হাতে আগল খোলে? পাগলের মতন কেবল এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। অযুত শক্তি নিয়ে কেবল রাস্তা হাতড়ে চলা। তারপর এদেওয়ালে ওদেওয়ালে মাথা কুটে কুটে শক্তিক্ষয়। তারপর, সে শক্তির যখন তিলমাত্র অবশিষ্ট, তখন মনের টনক নড়ল। এই যাহ সমস্ত কিছুই যে রইল পড়ে, কিছুই যে করা হল না। এবার উপায়?
0 comments:
Post a Comment