Friday, 24 October 2014

দেওয়ালী............২

দেওয়ালী............১ এর পর 

চলতে চলতেই বাঁ-দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেল আবার একটা আলোর ফুলকি। ওপরে উঠে বিশাল ফুল হয়ে ফাটবো ফাটবো করছে। “শনু-উ-উ-উ-উ উপর দেখ”-চেঁচিয়ে উঠল মকবুল। শনু তার দিকে তাকালো তার ডাক শুনে। আর তখনি কেমন যেন সব গণ্ডগোল হয়ে গেল মকবুলের। বাঁ দিকের আকাশ থেকেই যেন বিশাল একটা আলোর ঝরনা নেমে এল মকবুলের ওপর। চারপাশ থেকে গাড়িগুলো হুহু শব্দে ছুটে চলেছে সিগন্যাল সবুজ হতেই। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা অজস্র গালিগালাজ আর হায় হায় এর মধ্যে নিজেকে নিয়ে কোনোক্রমে ছিটকে গেল মকবুল ফুটপাথের দিকে। টেনে-হিঁচড়ে ডান পা খানা ফুটপাথে উঠিয়ে যখন হাপরের মত হাঁপ ছাড়ছে মকবুল ততক্ষণে তার ডান পায়ের হাওয়াই চপ্পলখানা কোথায় চলে গেছে। ডান হাঁটুটা রাস্তায় ঘসে গিয়ে রক্ত ঝরছে। পায়ের বুড়ো-আঙ্গুলের নখ উঠে গিয়ে ঝুলছে।

শনু দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। হাতের প্যাকেটগুলো রেখে বসে পড়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে মকবুলকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো-“ঠিক তো হ্যায় না মকবুল?” হাঁপাতে-হাঁপাতেই আস্তে করে ঘাড় নাড়ে মকবুল। “প্যায়ের মে ক্যা হুয়া? দিখা। আরে দিখা না।” ডান পা টা জোর করে নিজের দিকে টেনে নেয় শনু। মকবুল ততক্ষণে ভয়টা একটু সামলেছে। ব্যাথার অনুভূতিটা আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। ক্ষতবিক্ষত হাঁটু আর নখের ব্যাথা দাঁত চেপে সহ্য করে মকবুল। “আরে এ ক্যায়া হুয়া? ইতনা খুন! আরে ইশ!” আস্তে করে হাত বোলাতে থাকে তার পায়ে। “চল উসপার। পানি সে পেহেলে ধো না হোগা। তু তো দেখা থা উস তরফকা সিগন্যাল খুল গ্যায়া থা। ম্যায় দুসরে ফুটপাথকে তরফ চল দিয়ে থে। তো তুঝকো সমঝনা চাহিয়ে থা না কি ইস তরফ ভি এক হি টাইমপে সিগন্যাল খুলেগা। তু বেওকুফ কি তরহ রোড ক্রস কিঁউ করনে লগা?” কি আর বলবে মকবুল? এত যদি সে শনুর মতন সিগন্যাল বুঝত তবে ত হয়েই যেত। “চল,পানি তো উধার দুকানপে মিলেগা। চল পায়েগা?”- তাড়া দেয় শনু। গলার শুখনো ভাবটা এতক্ষণে অনুভব করে মকবুল। আস্তে করে বলে-“হাঁ চল। পানি পিনা হ্যায়।” নিজের আবিরের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নেয় শনু। হঠাৎ খেয়াল হয় মকবুলের।

-“শনু, মেরা প্যাকেট? মোমবাত্তিয়া?”  

নিজের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিতে নিতে চমকে তাকায় শনু। “কাঁহা? তেরা মাল?” বলেই রাস্তার দিকে তাকায় শনু। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তায় চোখ যায় মকবুলেরও। ঠিক যেখান থেকে সে আলোর ফুলকিটা দেখতে পেয়ে শনুকে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করেছিল, আর তার সেই বেয়াদবিকে পিষে ফেলার উদ্যম নিয়েছিল সবুজ সিগন্যাল পাওয়া আটকে থাকা গাড়ির দল, ঠিক সেখানেই তার ডান পা টা একচুলের জন্য পিষে ফেলতে না পারার আক্রোশেই হয়ত তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া, তার সারাদিনের রোজগার, সবুজ-গোলাপি-হলদে-রংবেরঙের মোমবাতিগুলোকে নির্দ্বিধায় রাস্তার সাথে মিশিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে সেদিকে চেয়ে থাকার পর শনু তার কাঁধে হাত রাখে। বলে, “চল মকবুল। পানি লে লেতে হ্যায় দুকান সে।”

কথাটা কানে ঢুকলেও মাথায় ঢোকে না মকবুলের। পঞ্চাশ প্যাকেটের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচ প্যাকেট বিক্রি করতে পেরেছিল সে। বাকি পুরোটাই তার হাত আর হাতের বড় প্লাস্টিকের প্যাকেটে ছিল। যেগুলো বাইরে বেরিয়ে আছে সেগুলো এখন রঙ-বেরঙের ধুলো ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে যে প্যাকেটগুলো ছিল সেগুলোর মধ্যে থেকেও কি এক আধ প্যাকেটও বাঁচবে না? সামনেই আছে। দু পা বাড়ালেই পেয়ে যাবে প্যাকেটটা। সিগন্যাল লাইটের দিকে তাকায় মকবুল একবার। এখনও লাল হতে দেরি আছে। এখনও যদি তুলে আনা যায় প্যাকেটটা- নয়ত সিগন্যাল লাল হতে হতে প্যাকেটের একটি মোমবাতিও বাকি থাকবে না। আস্তে আস্তে ব্যাথা ভুলে উঠে দাঁড়ায় মকবুল। সিগন্যাল লাইটের দিকে আরেকবার দেখে নিয়ে ঝড়ের মত ছুটে আসা গাড়িগুলোর গতি মাপতে থাকে মকবুল। শনু ততক্ষণে বোধহয় তার মতলব বুঝতে পেরেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলে, “নেহি মকবুল, ছোড় দে। উসমে অর কুছ বাঁচা নেহি।”
“পাঁচাশ প্যাকেট হ্যায় শনু উসমে।”- আর্তনাদ করে ওঠে মকবুল।
“গাড়ি আ রাহা হ্যায় মকবুল। সিগন্যাল খুলা হুয়া হ্যায়।”- বলে শনু নিজের ছোট্ট হাতটা দিয়ে সর্বশক্তিতে চেপে ধরে মকবুলের সরু দুবলা কব্জিটা।
“আভি বাঁচা পাউঁ তো এক দো প্যাকেট মিল ভি সকতা হ্যায়, ছোড় দে মুঝে।”
-“বেওকুফি মত কর ইয়ার, প্যাকেট কা হাল তো দেখ। উসমে এক ভি বাঁচা নেহি। দেখ আভি ভি গাড়ি চল রাহি হ্যায় উসকে উপর।”

দুজনে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে সিগন্যাল লাল হওয়া পর্যন্ত। ডান পা টা হাঁটু থেকে নখ পর্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে মকবুলের। জ্বালা করছে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো। সিগন্যাল লাল হতে তাকে যেতে না দিয়ে শনুই গিয়ে উদ্ধার করে আনে প্যাকেটটা। ফুটপাথে উঠে এসে মুখ খুলে দেখে একটা নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকায় মকবুলের দিকে। যে দৃষ্টির মানে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না মকবুলের এই বয়সেও। তাও শেষবারের মত প্যাকেটটা শনুর হাত থেকে নিয়ে ভেতরটা আঁতিপাঁতি করে খোঁজে মকবুল। একটা মোমবাতিও যদি গোটা পায় সে আশায়। হতাশায় ছুঁড়ে দেয় প্যাকেটটা ফুটপাথের ধারে ঘাসের ওপর। শনু এসে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বলে, “ফেঁকনা মৎ ইয়ার, ফ্যাক্টরি মে দে দেনেসে ফির সে মোমবাত্তি বন সকতা হ্যায়। শেঠকে গুদামমে ইস কো লৌটাএঙ্গে তো থোড়া ডাঁট কম ভি পড় সকতা হ্যায়।” অসহায় চোখে শনুর চোখের দিকে তাকায় মকবুল। বিক্রম শেঠের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

এরপর দুই বন্ধু মিলে যখন মকবুলের ডানপায়ের চটিটা উদ্ধার করে, রাস্তার পাশের দোকান থেকে জল নিয়ে পা ধুয়ে, শনুর পকেটে থাকা রুমাল দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের আধখানা উঠে যাওয়া নখকে বেঁধে উঠে দাঁড়ালো তখন মকবুলের হাঁটু জবাব দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা আর জ্বালা। এখনও রক্ত ঝরছে। পিঠে হাত রাখল শনু। “বহুত দরদ হো রাহা হ্যায় ক্যায়া মকবুল? ধীরে ধীরে চলেঙ্গে ইয়ার।” শনুর কাঁধে ভর দিয়ে প্রায় আধঘণ্টা ধরে হেঁটে বহু কষ্টে যখন তারা বিক্রম শেঠের গুদামের দরজায় এসে পৌঁছালো তখন মকবুলের আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই দাঁড়িয়ে থাকার।

তাদের দেখে শেঠের কর্মচারী বিনোদ বলে ওঠে, “আরে, আ গ্যায়া ছোটু? আচ্ছা হি হুয়া। তুম দোনো কে লিয়ে ওয়েট কর রাহা থা। চল, বাকি কে মাল রাখ দে। জলদি জলদি হিসাব নিপটাকে ঘর জানা হ্যায়। দিওয়ালী কে দিন, জলদি কর। কিতনে প্যাকেট বাঁচা হ্যায় বোল। প্যায়সা লে লে মালিক সে। শনু, বাকি কে প্যাকেট দে দে মুঝে।”

শনু আর মকবুল স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে বিনোদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাদের দিকে অবাক চোখে তাকায় বিনোদ। বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, “আরে ক্যায়া হুয়া? জলদি কর। ইধার আ শনু কিতনে প্যাকেট বাকি হ্যায় তেরে পাশ? তুঝে গুলাল দিয়ে থে না আজ ম্যায়নে? আরে মকবুল প্যায়ের মে ক্যায়া হুয়া তেরা?”

এতক্ষণে বিনোদের চোখ গেছে মকবুলের পায়ের দিকে। বিপদ বুঝে চট করে সামনে এগিয়ে যায় শনু। “বিনোদ ভাইয়া, ইয়ে মেরা বাকি কে প্যাকেট। পাঁচাশ দিয়ে থে, ইয়ে ষোলা বাকি হ্যায়।”

-“আচ্ছা, সহি হ্যায়? অর মকবুল তেরা কিতনে বাকি হ্যায়?”


ভেতরের ধুকপুকুনিটা শুনতে শুনতে মকবুল শনুর দিকে তাকায়। শনুও ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। 




0 comments:

Post a Comment