খাঁড়ির গান-৪
-------------------
সেই যে বলছিলাম না, Bio-luminescence Bay দেখতে যাব বলে দুজনে দাঁড়িয়েছিলাম ভেইকোয়েসের সান বিচের প্রায়ান্ধকার নির্জনতায়। আমাদের আশাহত হতে যখন আর একটুই বাকি আছে ,তখনই বিচের রাস্তাহীন রাস্তা দিয়ে দুটি গাড়ি এসে পৌঁছালো নির্জন সান বীচে। এপর্যন্ত তো বলেই ছিলাম। তারপরের গল্পটা বলি। সেই গাড়ি থেকে নামলো দুতিনটি পরিবার। বাচ্চারা বা কমবয়স্ক মানুষ বিশেষ নেই। প্রত্যেকেই মধ্যবয়স অতিক্রম করেছেন। ক্রমে ক্রমে আরো দু-তিনটি গাড়ি এসে পৌঁছালো। আরো কয়েকজন সহযাত্রী বাড়লো। আমরা ততক্ষণ জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি যে তাঁদের একই পথের যাত্রী। নিশ্চিন্ত হলাম। যাত্রীরা হাজির, কান্ডারীদের দেখা নেই তখনও। তারপর দেখলাম, একটি সাদা রঙের মিনিবাস, আর তার পেছনে পেছনে দুটি ট্রাক ঢুকছে। ট্রাকের পিঠে পনেরো-বিশটা কায়াক। নিশ্চিন্ত। কান্ডারীরা এসে গেছেন। গাড়িগুলো ততক্ষণে একটা ঘাসহীন জায়গাকে পার্কিং লট বানিয়ে জটলা তৈরী করেছে। আর যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে হৈচৈ করছেন। প্রত্যেকেই জলে নামবার উপযুক্ত পোশাকে। মানে অন্তত ভিজে গেলে জুতো জামা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে এমন পোশাকে। আর আমরা দুজন আপাদমস্তক সাধারণ জিন্স- টি-শার্ট-স্নিকার। জলে পড়ে গেলে ওই ভেজা জিন্সের আর জুতোর ভারেই ডুবে যাবো। এত সব ভাবিনি আগে। যাক গে যাক, যদি জলে পড়ি, যদি জামা-জুতোর ভারে ডুবে মরি, এত সব ভেবে Bio-luminescence Bay এর থ্রিলটাকে মাটি করব এমন বোকা আমি নই। মহানন্দে স্কুটারটাকে বড় বড় গাড়িগুলোর মাঝে দাঁড় করিয়ে লক করে দিলাম। সবাইকে নাম ধরে ধরে বাসে ওঠাচ্ছে লাল জ্যাকেট পড়া একটা ছেলে। সেইসঙ্গে টাকাও কালেক্ট করে নিচ্ছে। হেলমেটগুলো নিয়ে বাসে উঠতে দেখে আমাদের বললে, "এই সব লটবহর নিয়ে নৌকা বাইবে নাকি?" তখন ব্যাপারটা বুঝিনি। "কোথায় রেখে যাব?" "বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দাও। কেউ নেবে না তোমার হেলমেট।" সত্যি নাকি? কতক্ষণের জন্য যাব তার ঠিক নেই, অন্ধকারে পড়ে থাকবে? তার পর আমাদের আরো অবাক করে দিয়ে বললে, "গাড়ির কাঁচ খুলে গাড়ি আনলক করে দিয়ে সবাই বাসে ওঠো। শুধু টাকাকড়ি, কাগজপতি নিয়ে।" সেকি? কি বলে রে বাবা! তারপর বিষয়টা ব্যাখ্যা করলে। এখানে গাড়ি চুরির মত বড় অপরাধ করার মতন কেউ নেই। গাড়ি আনলকড থাকলেও নিয়ে কেউ পালাবে না। এইটুকু জায়গায় গাড়ি চুরি করে পালাবে কোথায়? যেটুকু হয়, সেসব ছোটোখাটো চুরি। গাড়ির কাঁচ বন্ধ থাকলে বা লকড থাকলে তারা ভাবতে পারে যে, নিশ্চয়ই দামি কিছু আছে গাড়ির ভেতরে, তাই লক করা। তখন গাড়ির কাঁচ ভাঙলেও ভাঙতে পারে। তাই ফিরে এসে গাড়ি গোটা অবস্থায় পেতে হলে, কাঁচ খুলে আনলক করে যাওয়াই শ্রেয়। সম্পূর্ণ নতুন কথা আমাদের কাছে।
যাইহোক, আমাদের গাড়িও নেই কাঁচ খোলার প্রশ্নও নেই। হেলমেটদুটো স্কুটারের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। পছন্দ মত সিটে বসে আছি। বাকিরা একে একে বাসে ওঠার পর দেখা গেল বাসের সব সিট একেবারে ভরা। আমরা ছাড়া ভারতীয় মুখ একটিও নেই। ড্রাইভার বাস ছাড়লো। লাল জ্যাকেট, বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণে দেখলাম, তার পিঠে একখানা গিটার বাঁধা। তার বাকি সঙ্গীসাথীরা ট্রাকদুটি আর তাতে বাঁধা নৌকাগুলিকে নিয়ে আগেই এগিয়ে গেছে। সান বিচের বেলাভূমি পেরিয়ে বালি বিছানো পথ অন্ধকার জঙ্গলের দিকে। পথ বলতে ঘাস হীন বালি। এতক্ষনে আমাদের বাসও চলতে শুরু করলো। বাসের ভেতরের লাইট জ্বলছে। লাল জ্যাকেট আমাদের গাইড। বললো, "আমার নাম ড্যানিয়েল। তোমরা আমায় 'ড্যান' বলতে পারো। আমি তোমাদের একটা আশ্চর্য্য জিনিষ দেখাবো যা তোমরা কখনো দেখোনি। এ আমার দেশের বিস্ময়। তবে তার আগে কয়েকটা জিনিস তোমাদের বলে নেওয়া দরকার। এমন কিছু নয়। এই কায়াক চালানোর আর এই ট্রিপের কয়েকটা সতর্কতা।" এই বলে আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাইফ জ্যাকেট দিয়ে দিলো। বললো, "বাস থেকে নেমেই এগুলো পরে নেবে। প্রত্যেকটায় একটা করে হুইসিল লাগানো আছে। দেখে নাও সকলের জ্যাকেটে আছে নাকি। না থাকলে আমায় এখনই বোলো আমি এখনই জ্যাকেট বদলে দেব।" চেক করে নিলাম। তারপর বললো, "প্রত্যেক দুই জনের জন্য একটা করে কায়াক। প্রথমজনের পিঠের দিকে মুখ করে পিছনের জন বসবে। মানে দুজনের মুখ যেন একই দিকে থাকে। কিছু সমস্যা হলে হুইসিল বাজাবে। তবে একটা কথা, হুইসিল তখনই বাজাবে, যখন তোমার লাইফ রিস্ক দেখা দেবে। নইলে মোটেই নয়। কারণ হুইসিল শুনলেই আমি পুরো ট্রিপ ক্যান্সেল করে দেব। সুতরাং দায়িত্ব নিয়ে বাজাবে।"
আমার চক্ষু চড়কগাছ। এ বলে কি রে? দুজনে একটা কায়াকে মানে? নিজেদেরই চালাতে হবে? এতক্ষণ দুর্দান্ত লাগছিল। এবার আমার সমস্ত উত্তেজনার বেলুন এখানে এসেই ফেটে গেল ফুস করে। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা ট্যুরিস্টের মত গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব আর আমাদের নৌকা চালাবার আলাদা লোক থাকবে। এতো দেখছি নিজেদেরই চালাতে হবে ওই প্লাস্টিকের কায়াকগুলো। তাও এই অপরিচিত অন্ধকারে। বাকি লোকেদের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা গেল না। ছোট থেকে প্রতি গরমের ছুটিতে আমরা যখন টিভিতে 'ছুটি ছুটি' দেখেছি আর ফেলুদার গল্প পড়েছি সারা দুপুর ধরে, এই বাসের বাকিরা ঠিক সেই সময়টাতেই লেক বা নদীতে মাছ ধরেছে, কায়াকিং করেছে। তাদের কাছে কায়াকিং করা আর সাইকেল চালানো একই ব্যাপার। আর আমরা জীবনে পদ্মপুকুরে কলার ভেলাও নিজে হাতে চালাইনি। যদিও একবার অন্যের ভরসায় উঠে পদ্মপুকুরে সেযাত্রা সলিল সমাধি হতে বসেছিল প্রায়। আমার বুক ধুকপুক করতে লাগলো। আর এই কায়াকগুলো শুনেছি মহাবদ। দুই মাঝির হাতের দাঁড়ের ছন্দের এদিক ওদিক হলে দিব্বি কাত হয়ে হেলে পড়ে একদিকে। ভিডিও দেখেছি কত। আর কাত হলে দুজনেই যে টুপ্ করে জলে খসে পড়ব সে বিষয়ে নিশ্চিত। পিনাকী সাঁতার পর্যন্ত জানে না। ফলে ওই দুমনি শরীর যে ওই তুশ্চু লাইফ জ্যাকেটে ভাসবে না এ বিষয়েও আমি একশভাগ নিশ্চিত। আর আমি সাঁতার জেনেই বা কি করব? এ কি আমার পদ্মপুকুর বা সিংদের পুকুরে সাঁতার দেওয়া নাকি? mosquito bay এর একদিক ক্যারাবিয়ান উপসাগরে যুক্ত। সোজা ভাসতে ভাসতে দিক ভুল হয়ে সেদিকে গিয়ে পড়লেই মায়ের সাধের একমাত্র মেয়েটির গঙ্গা (সাগর) প্রাপ্তি ঘটবে। আর এই ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দিকভুল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
হাতে একটা ছোট্ট জলের বোতল ছিল, কোঁৎ কোঁৎ করে অর্ধেক জল খেয়ে বাকিটা পিনাকীর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে দেখি বলছে, "আরে দাঁড়ানা, দেখছি।" দেখার আর আছেটা কি? এখন সান বিচ থেকে জঙ্গলের ভেতর চলে এসেছি বেশ কিছুটা। টর্চ নেই। এখানে বাস থামিয়ে নেমে পড়লেও পিছনে ফেরাটা মুশকিল। এমন সময় শুনি ড্যানিয়েল বলছে, "সবার সব কিছু পরিষ্কার? কারো কোনো প্রশ্ন আছে?" সবাই উল্লাস ধ্বনি দিয়ে জানিয়ে দিলো সবাই এক্কেবারে রেডি। আমাদের মুখ দেখে ড্যানিয়েল কিছু বুঝতে পেরেছিলো কিনা জানিনা। জিজ্ঞাসা করলে, "এখানে কায়াক একবারও চালায়নি এমন কেউ আছে?" সটান হাত তুলে দিলাম। এটা দেখে যদি আমাদের ওর সাথে একটা বড় বোটে নিয়ে নেয়। আমাদের হাত তোলা দেখে বাস সুদ্ধ সবকটা মুন্ডু দেখি আমাদের দিকে ঘুরে গেছে। অবাক বিস্ময় প্রতি জোড়া চোখে। যেন দুটো মঙ্গল গ্রহের জীব এইমাত্র এই মিনিবাসের সিটে উঠে বসেছে। আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা হচ্ছিল না তাতে অবশ্য। প্রাণের চেয়ে লজ্জা অনেক পরের ব্যাপার। ড্যানিয়েল দেখলাম দুসারি ধপধপে দাঁত বের করে হেসে বলছে-" আরে কোনো ব্যাপারই নয় কায়াক বাওয়া। ডানদিকে যেতে গেলে বাঁদিকে দাঁড় বাইবে, আর বাঁদিকে যেতে গেলে ডানদিকে। বুঝলে?" বোঝার কিছু ছিল না। তারপরে আরো অনেককিছু বলছিলো। আমরাও ঢকঢক করে মাথা নাড়ছিলাম। আমাদের আশ্বস্ত করতে শেষকালে ড্যানিয়েল বললে, "মনে রেখো, কায়াক হচ্ছে রাগী বাবার মতন। বেমক্কা নাড়াবে না একদম। নাড়ালেই তোমার সমস্যা। সামলাতে না পারলে দাঁড় তুলে নেবে জল থেকে। দেখবে নিজেই শান্ত হয়ে গেছে?" ছোটবেলায় কিছু অকাজ করার পর সামনে বাবার মুখটা মনে করে বাসের হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম। বাস ততক্ষনে জঙ্গলের মধ্যে কাঁচা রাস্তায় ঢেউ এর মতন নড়তে নড়তে চলেছে। রাস্তাই তো নেই। অন্ধকার এমন যেন ছুরি দিয়ে কাটা যাবে। যা থাকে কপালে আজ, হয় কায়াক চালানো শিখব আর পুরো অভিজ্ঞতাটা সঞ্চয় করব। নয়ত জলে পড়লে সাঁতার দিয়ে পাড়ে উঠব। উদ্বেগটা কেবল পিনাকীকে নিয়ে। ওকে ফিসফিস করে বললাম, "দেখ, কোনো এক্সিডেন্ট হলে কায়াকটাকে ছাড়বি না, হ্যাঁ। প্রানপনে ধরে থাকবি। ওটা ডুববে না। ওটা ধরে ভেসে থাকবি।" সে দেখি হুঁ-হাঁ করে অর্ধেক শুনলো, অর্ধেক শুনলো না।
মিনিট পনের-কুড়ি পরে বাস আমাদের নামিয়ে দিল একটা অপেক্ষাকৃত চওড়া জায়গায়। সেখানে ট্রাকগুলোও দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়েছি বাসে বসেই। ড্যানিয়েল আর তার বন্ধুদলের টর্চের আলোয় আমরা আস্তে আস্তে জঙ্গলের সুঁড়িপথ বেয়ে জলের ধারে এসে পৌঁছোলাম। এতক্ষণে অন্ধকারটা একটু পরিষ্কার হলো। আমাদের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটু কম অন্ধকার। ঐটিই mosquito bay। অন্ধকারে চোখটা সয়ে আসতে দেখি, কায়াকগুলো জলের ধার ঘেঁষে পরপর রাখা। এখানে এসে ড্যানিয়েল আমাদের থামালো। বললো, "দেখো আকাশে মেঘ আছে, তাই অন্ধকারটা বেশি। সেটা একদিক থেকে ভালোই। অন্ধকার বেশি থাকলে জলের আলো বেশি উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাব আমরা। কিন্তু একেবারেই চাঁদ না উঠলেও মুশকিল। একটুও আলো না থাকলে আবার বিশেষ কিছু দেখা যায়না।" সেই শুনে কেউ একজন উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "তাহলে! মেঘ না সরলে? চাঁদ একেবারেই দেখা না দেয় যদি?" ড্যানিয়েল মজার গলায় হাসল। বললে, "বন্ধু, কিছু চিন্তা কোরো না। তোমাদের সাথে আছে ড্যান। আমি গান গাইলেই মেঘ সরে যায়। এই দেখছো না গিটার এনেছি তো সেজন্যই।" বলে হা হা করে হাসলে।
তারপর বললে, "নাও এবার দুজন দুজন করে কায়াক নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। আমি এক এক করে নাম্বার দেব কায়াক গুলোর। নিজেদের নাম্বার মনে রাখবে। জলে নেমে সোজা যাবে। ডানদিকে বেশি যাবে না। ডানদিকে দেখবে কিছুদূরে গেলেই কতগুলো বয়া ভাসছে। ওটা সীমানা। ওর ওপারে যাওয়া মানা। ওদিকে কিন্তু একদম যাবে না। তাহলে সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। আর বেশি ধার ঘেঁষেও যাবে না। তাহলে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ফাঁকে আটকে যেতে পারো। মাঝামাঝি থাকবে। জলে হাত বা দাঁড় দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করবে তারপর দেখবে ম্যাজিক। আমি মাঝে একবার রোলকলের মত নাম্বার কল করব। তখন হাজিরা দিও চেঁচিয়ে। কারো কিছু প্রশ্ন আছে?" কারো কোনো প্রশ্ন ছিল না। আমরাই জলে নামার জন্য নিশপিশ করছি। বাকিরা তো করবেনই। ড্যানিয়েল বললে, "নাম্বার ওয়ান কায়াকে কারা যাচ্ছে তবে?" দুজন এগিয়ে গেলেন। ড্যানিয়েল বললো, একবার দেখাও দেখি তোমদের হুইসিল বাজছে কেমন।" তাঁরা দুজনেই বাজিয়ে দেখালেন। ড্যানিয়েল নিশ্চিন্ত হয়ে দুটি দাঁড় তাঁদের হাতে দিয়ে দিলে। তাঁরা এগিয়ে যেতেই ড্যানিয়েলের বন্ধুরা একটা কায়াক হাঁটুজলে নামালো টেনে। আবছা আলো আঁধারিতে চোখ সয়ে এসেছে। তাঁরা যতক্ষণ উঠছিলেন কায়াকটায়, ড্যানিয়েলের বন্ধুরা ধরে রইল টলমলে প্লাষ্টিকের শালতিটাকে। তারপর তাঁরা থিতু হয়ে বসতেই, "গুডলাক" বলে জলের দিকে ঠেলে দিল কায়াকটাকে।
এরকম করে আরো কয়েকটা কায়াকের যাওয়া দেখলাম। উঠে বসার পদ্ধতিটি দেখার চেষ্টা করছি।ড্যানিয়েল প্রত্যেকটি কায়াকের নাম্বার দিচ্ছে আর প্রত্যেকটি বাঁশি বাজচ্ছে কিনা পরীক্ষা করে তারপর দাঁড় দিচ্ছে হাতে। একসময় আমরা এগিয়ে গেলাম সাহস করে। আমাদের নম্বর ছয়। আমাদের বাঁশি পরীক্ষা হলো। কিন্তু তারপরেই দাঁড় দিলো না হাতে আমাদের। পিনাকীর পিঠে একটা সাহসের থাবড়া মেরে বললে, "কোনো চিন্তা নেই, এনজয় কোরো। শুধু একটা কথা মনে রেখো, বেশি দোলাবে না কায়াককে। বললাম না, একদম রাগী বাবাদের মত হয়। না ঘাঁটালেই আর কোনো সমস্যা নেই।" এই বলে দুজনের হাতে দুটো দাঁড় দিয়ে দিলে। আমরাও গুটি গুটি পায়ে জলের ধারে এগিয়ে গেলাম। আমাদের নাও প্রস্তুত। ছপছপ করে জলে নেমে পড়লাম বুক ঠুকে। কি আর হবে? ডুবে যাওয়া অতই সহজ নাকি? ততক্ষণে পায়ের জুতোর ভেতর দুকলসি জল, আর জিন্স হাঁটু পর্যন্ত ভেজা। ওসবের মায়া আমি কোনো কালেই করি না বেড়াতে বেরোলে। ভিজেছে, আবার শুকিয়ে যাবেখন। টলমল করে উঠে বসলাম। পিনাকী সামনে, আমি পিছনের পাটাতনে। মা দুগ্গার ত্রিশুল ধরার ভঙ্গিতে বাগিয়ে ধরেছি দাঁড়টা। "ঠিক আছে?" "হ্যাঁ " বলে উত্তর দিতে না দিতেই একধাক্কায় দেখ না দেখ ওই একফালি প্লাস্টিকের নৌকা সোজা বেশ কয়েক হাত জলে। বুকটা দুড়দাড়িয়ে উঠলো।
সামনে তিনদিকে ঘন জঙ্গল আর উঁচু পাহাড়ি দ্বীপভূমি। নিঝুম পাহারাদারের মত এই অলীক আলোর খাঁড়িকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কালো জল। রাতের সমুদ্রের হাওয়ায় ভেজা প্যান্ট- জুতো-মোজা থেকে শিরশিরিয়ে ঠান্ডা উঠছে। গভীর এক জলজঙ্গলের মাঝে, বিশাল এক উপসাগরের বিশাল এক খাঁড়িতে, রাতের মেঘলা আকাশ ভেদ করে আসা আবছা আলোয় দুই আনকোরা মাঝির হাতে অচেনা এক নৌকা। চালাতে শিখতে হবে আগে, তারপর যে সৌন্দর্য্যের খোঁজে এসেছি সেটির সন্ধান করতে হবে।
পিনাকী সামনে থেকে জিজ্ঞাসা করল, "রেডি?" একবুক বাতাস টেনে নিয়ে বললাম, "রেডি।"