Friday, 31 January 2020

একটি পথ এবং একটি অনুভব-২

প্রথম পর্বের পর

রোদ বাড়ার সাথে সাথে গরম বাড়তে লাগলো। আমরা নিয়মিত হাঁটিয়ে নই। আমাদের গরম জামাকাপড় আস্তে আস্তে বোঝা হয়ে যেতে লাগলো। পরতের পর পরত খুলতে খুলতে এগোচ্ছিলাম। অনেক জায়গায় গোড়ালির ওপর পর্যন্ত তুষারে ডুবে যাচ্ছে। পথের বর্ণনা বিশেষ দেব না। ছবি থেকে কিছুটা আন্দাজ পাবেন। যেটা বলব বলে বসেছি, সেটা পথের বর্ণনা নয়। অন্য কিছু। যেকথাটা আগের পর্বের প্রথমে বলার চেষ্টা করছিলাম, সেটি হলো, কিছুদিন ধরে কোনো বিষয়ে খানিক উৎসাহ জাগলে সে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে এমনিই খানিক উৎসাহ জাগে। উৎসাহের চোটে কিছু প্রস্তুতি নিশ্চয়ই হয় কিন্তু তা যথেষ্ট কিনা সেটা আসল রঙ্গমঞ্চ ছাড়া বোঝার উপায় নেই। 

আমরা পিচ্ছিল বরফঢাকা পথে লাঠি আর জুতোর ট্রাকশনের দৌলতে মোটামুটি সহজেই এগোচ্ছিলাম। তবে যাঁরা ট্রাকশন ছাড়া এগোচ্ছিলেন তাঁদের বেশ কিছু ক্ষেত্রেই অসুবিধা হচ্ছিলো বুঝতে পারছিলাম। আবার নাতিকে পিঠের ব্যাগে বসিয়ে দাদু দৃপ্ত পায়ে আমাদের ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছিলেন এও দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম, আমাদের মা বাবারা কেবলই নিজেদের অপারগ ভাবেন। এতটা না পারলেও অনেক কিছুই তাঁরা পারবেন। দোষটা আমাদেরই, আমরাই তাঁদের আলোটা দেখাতে পারিনা। 

পায়ে পায়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছিলাম। বেশ চড়াই। নিচে ভার্জিন রিভারকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। দুই পাহাড়ের মধ্যে সাদা তুষারময় একটা অবতল ভূমিতে কোথায় কে জানে মুখ লুকিয়ে বয়ে চলেছে। এতক্ষন রাস্তায় কোথাও ছায়া ছিল না। গরমকালে যাঁরা আসেন, তাঁদের জন্য এই জায়গাটা উটার রোদ্দুরে এতখানি চড়াই ভেঙে উঠে আসার পর মরুভূমি পেরিয়ে আসার মতোই ব্যাপার। রোদের রাজ্য পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তা বাঁক নিলো। একটা লোহার ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে সামনে পাহাড়টার পিছনে এসে পড়লাম। এ জায়গাটাকে এই রাস্তার মরুদ্যান বলে বলে শুনেছি। কারণটা আগেই বললাম। এখন থেকে বেশ খানিকটা রাস্তা সমতল। সরু রাস্তা কিন্তু চড়াই নেই। এবার আমাদের এই ডানদিকের পাহাড়টার গা বেয়ে পিছনে পৌঁছে, উত্তরদিক দিয়ে পর পর জিগজ্যাগ চড়াই রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়টার মাথায় পৌঁছাতে হবে। সমতল রাস্তাটা সহজেই পেরিয়ে গেলাম। এবার চড়াইটা ভাঙতে বেশ কষ্ট হল। মাঝে মাঝে এক-দু মিনিট দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠে পড়লাম ওপরে। উঠেই চোখ ঝলসে গেল। এতক্ষন পাহাড়ের গায়ে এত পুরু বরফ ছিল না।  কিন্তু এখানে পাহাড়ের মাথায় পুরু তুষারের আস্তরণ। কখনো কোনো জায়গায় হাঁটু ছুঁই ছুঁই বরফ। চকচকে সূর্য্যের আলো সাদা তুষারে পড়ে শতগুনে তার ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে চারিদিক ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। একসাথে এতটা চড়াই ভাঙার পর জায়ণের তুষার মোড়া রূপ দেখে কোনো কষ্ট অনুভূত হচ্ছিলো না। 

এই জায়গাটা আসলে তিনটি পাহাড়ের সঙ্গমস্থল। একটি হলো আমরা যে পাহাড়ের পিছন দিক দিয়ে হেঁটে তারপর উত্তরদিকে দিয়ে চড়াই বেয়ে ওপরে উঠেছি। দ্বিতীয়টা হলো সামনে বাঁদিকের চড়াইটা।  এই পাহাড়ের গা দিয়ে ওয়েস্ট রিম ট্রেলটা শুরু। দুদিনের পথ। আর তৃতীয়টি হলো Angel's Landing. যেখানে উঠবো বলেই এ যাত্রা আমাদের জায়ণ অভিযান। সামনের চোখ ধাঁধানো আলোর প্রান্তরটা পেরিয়ে ওই যে সামনে খাড়াই দাঁড়িয়ে আছে Angel's Landing. দুপাশ বেমালুম চাঁছাপোঁছা। বেয়াক্কেলের মত সরু তার প্রস্থ। আর এই সরু গা বরাবর লোহার মোটা চেন লাগানো। সেই ধরে ধরে উঠতে হবে বাকি রাস্তাটা। নইলে সিধে নিচের ভার্জিন রিভারের উপত্যকায় সলিল সমাধি। একসাথে একটিই পা ফেলার জায়গা। সুতরাং এখন থেকে বাহুল্যের কোনো জায়গা নেই। হাঁটতে হাঁটতে গরমের জন্য একটা জ্যাকেট খুলে ফেলেছিলাম। চেনের সামনে পর্যন্ত পৌঁছে সেটাই পেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। এতক্ষন বসার জন্য এতটা জায়গা ছিল না। সরু রাস্তা বেয়ে কেবল উঠে এসেছি। অনেকেই বসে আছেন। আসলে Angel's Landing এ ওঠা শুরু করার আগে একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছেন বা বলা ভালো নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমরাও বসলাম। ব্যাগ থেকে আপেল, কলা, শুকনো ফল বের করে খেলাম। জল খেয়ে, মন ভরে চারিপাশের ছবি তুলে ক্যামেরা, মোবাইল সব বন্ধ করে পিঠের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম। কারণ একদম ওপরে পৌঁছাবার আগে আর ছবি তোলার জন্য দুটো হাত খালি থাকবে না। হাঁটার লাঠি দুটোও ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়া গেলো। এদের আপাতত কোনো কাজ নেই। তারপর দুজনে দুজনকে "হবেই হবে" বলে উৎসাহ দিয়ে Angel's Landing এর চড়াই এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। 

আমাদের বাঁহাতে চেন। আমাদের একমাত্র অবলম্বন এই রাস্তায়। এই চেনের ভরসাতেই শয়ে শয়ে লোক Angel's Landing এ ওঠেন। আমরাও এসেছি। কিন্তু সমস্যাটা অন্য। সমস্যাটা ওই পর্বতারোহীর সংখ্যায়। শয়ে শয়ে মানুষ যদি ওঠেন এবং নামেন ওই সরু পথ বেয়ে, তাহলে আপনি যখন উঠবেন তখন একসাথে অন্তত পক্ষে দশ জন উঠবেন এবং দশজন নামবেন। যে পথে আগেই বলছি একটার বেশি দুটি পা একসাথে ফেলার জায়গা নেই, সেখানে ওই দশ-দশ কুড়ি জনের ওই জটলাটা ঠিক কি দাঁড়াবে আশা করি আন্দাজ করতে পারছেন। উপরন্তু এই কুড়ি জনের প্রত্যেকের অন্তত একটি হাত থাকবে চেনে ধরা। নইলে গন্ডোগোল। এখন এসব ক্ষেত্রে মানুষজনকে ধৈর্য্যশীল এবং সভ্য হতেই হয়। এতো আর হাওড়া স্টেশন নয়, যে কারণ না থাকলেও, স্রেফ অভ্যাস বলে হন হন করে হাঁটতে গিয়ে অন্যের পা মাড়িয়ে, চশমাতে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যাবেন। একজন অন্যেকে উঠতে বা নামতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতেই হয়। নইলে ওই সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের বাসের সামনে ভেড়ার পালের মত অবস্থা হবে। আরো একটা সমস্যা আছে এই মুহূর্তে। সেটি হলো বরফ। বরফে এই ট্রেক করা আমাদের সাধ্যের মধ্যে নয়। কিন্তু গতকালের সারাদিনভর তুষারপাত আমাদের সামনে সেই চ্যালেঞ্জটা খাড়া করেছে। কোথায় পা ফেলবো? পুরোটাই তো সাদা ঝুরো বরফ। এই ট্রেলের যে ছবি বা ভিডিও দেখেছি আগে, তাতে লাল পাথরের গায়ে মানুষ জনের পায়ে পায়ে রীতিমত ধাপ তৈরী হয়ে গেছে দেখেছিলাম। সেসবে পা দিয়ে উঠে যাওয়া সোজা। কিন্তু সেসব তো এখন হাঁটু পর্যন্ত বরফের তলায়। আন্দাজে পা ফেলতে হবে। আর ভুল জায়গায় পা পড়লে....। অর্থাৎ, একটা পা ফেলে সেই পা টি যতক্ষণ না শক্ত পাথরে পৌঁছোচ্ছে ততক্ষন পরের পা গেঁথে রাখতে হবে। আর হাতের ওই জীওনকাঠি চেনটিকে ছাড়লে চলবে না। মনে হচ্ছিলো হবে না। কিন্তু এতটা এসে চেষ্টা না করেই ফিরে যাবো? 

বাঁহাতে চেনটাকে শক্ত করে ধরে পা বাড়ালাম। পিছনে পিনাকী। সামনে জনাতিনেক মেয়ে। একসাথে কোনো এক ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে। ছোট ছোট জিগজ্যাগ বাঁক। আর চেন একবার বাঁদিকে তো পরের বাঁকেই ডানদিকে। প্রথম বাঁক পেরোলাম। দ্বিতীয় বাঁকে এসেই আটকালাম। সামনের বাঁকের চেনটা ডানদিকে। আর সেটা একটু দূরে। এই বাঁকের বাঁহাতের চেনটা ধরা অবস্থায় ডানহাত বাড়িয়ে পরের চেনটা ধরা যাচ্ছে না। কারণটা আমার উচ্চতা। আমার হাত অতটা লম্বা নয়। শেষে কিছুটা লাফিয়েই ধরে ফেললাম চেনটা। ধরার পরে বেশ কনফিডেন্স বাড়লো। তরতর করে পরের বাঁকটা পর্যন্ত উঠে গেলাম। এবারে সামনের চেনটা ধরে কিছুটা সমতল, চড়াই নেই। মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এগোলে এভাবে বেশ অনেকটাই যেতে পারব। পিছনেই পিনাকীর উঠে আসার কথা আমার মত করেই। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে দেখি পিনাকী নেই। সে অনেকটা নিচে দ্বিতীয় বাঁক থেকে তৃতীয় বাঁকের জায়গাটায় আটকে আছে। এটা আমি ভাবিনি। জীববিজ্ঞানের নিয়মেই আমার চাইতে পিনাকীর শারীরিক শক্তি বেশি। আমার চাইতে উচ্চতা প্রায় একফুট বেশি। তাহলে ও বাঁ হাতের চেন ছেড়ে ডানহাতের চেনটা ধরতে পারলো না কেন? চেষ্টা করছে। পারছে না। ওর পেছনে আরো পাঁচ-সাতজন দাঁড়িয়ে আছে চেন ধরে। ও না উঠলে তারাও উঠতে পারবে না। আমি কিছুটা নেমে এলাম। কিন্তু হাত ধরে টেনে তুলে আনা যাবে না এই ঢালু বরফে। ওকে বলছি একটু লাফিয়ে আমার মত করে চেনটা ধরতে। ও লাফাতে ভয় পাচ্ছে। কারণ ওর পিঠের ব্যাগ। আমার পিঠে একটা পাতলা ব্যাগ তাতে একটি ছোট্ট জলের বোতল, কিছু খাবার আর মোবাইল। কিন্তু পিনাকীর পিঠে ক্যামেরা এবং তার সরঞ্জাম বাবদ একটি মোটামুটি বড় ব্যাগ। তার ওজনের জন্য পিনাকী লাফিয়ে চেনটা ধরতে পারছে না। কিছুটা ভয়ও পাচ্ছে। পাওয়াটা স্বাভাবিক। বরফে কোথায় যে পা ফেলছি জানি না। ও বেচারা কনফিডেন্সটাই পাচ্ছে না। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে নেমে যাব। এপথে আর সব কিছু না হলেও চলে কিন্তু নিজের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে সে মানুষটাকে জোর করে ওপরে নিয়ে যাওয়া চরম বোকামি। অতবড় ব্যাগ নিয়ে এপথে আসা আর একটা মারাত্মক বোকামি। আর ওই ব্যাগ নিচে রেখে যাওয়া যাবে না। সুতরাং........। 

আমি অনেকটা উঁচু থেকে ওকে দেখছি। কি অদ্ভুত অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে না এই মানুষটা প্রচন্ড ধৈর্য্য ধরে যেকোনো টেকনিক্যাল ট্রাবলশুট করতে পারে। মনে হচ্ছে না এই মানুষটা অসাধারণ সব ভিডিও এডিটিং করেও তাতে সামান্য খুঁত ঠিক করতে পারছে না বলে নির্মমভাবে তাকে ডিলিট করে দিতে পারে। মনে হচ্ছে না এই মানুষটাই সামান্য একটা বুকলেট, যা কেউ দুবার হাতে নিয়ে দেখবে না, তাকে নিখুঁত করে বানাতে সারাদিন ল্যাবে কাজ করার পর সারারাত জাগতে পারে। কেবল তার সৃষ্টিকে নিখুঁত করবে বলে। আমার চাইতে অনেক কিছুই এই মানুষটা অনেক ভালো করতে পারে, কিন্তু এই ডানহাতের চেনটা সে ধরার সাহস আর জোর পাচ্ছে না। কি অসহায় চোখ! আমায় বললো, "তুই উঠে যা। আমি নিচে অপেক্ষা করছি।" ওর চোখ সোজা আমার দিকে। আর সে ভাষা আমি জানি। ও ভাবছে-ওর জন্য আমি উঠতে পারছি না। আমি ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবারের মত Angel's landing থাক। পরে কখনও হবে। এতটা পথ একসাথে এসে বাকিটা একা যাওয়া যায়না। যেতে নেই। আমায় নামতে হবে। আমাদের নামতে হবে।

নামব বললেই তো নামা সহজ নয়! এত জনের পায়ে পায়ে পথ পিচ্ছিল হয়েছে। ওঠার সময় অসুবিধা হয় না। কিন্তু নামার সময় প্রায় পিছলেই নামতে হচ্ছে। বসে পড়লাম। বরফে পিছলে হুড়মুড় করে পিনাকীর কাছ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। ওখানে ততক্ষনে জটলা তৈরী হয় গেছে একটা। এর হাতের তলা দিয়ে ওর মাথার পাশ দিয়ে চেন আঁকড়ে ধরে, কিছুটা হেঁটে, কিছুটা পিছলে অবশেষে নেমে এলাম দুজনে।

পিনাকী একদম চুপ করে গেছে। ওর মন খারাপ আমার চেয়েও বেশি। কারণ ও ভাবছে-ওর জন্য আমি যেতে পারলাম না। সত্যিই হয়ত আরও কিছুটা উঠতে আমি পারতাম। অনেকেই কিছুটা উঠে তারপর নেমে আসছে। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র একদম ওপর পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। আমি ভাবিনি যে ওপর অবধি পৌঁছাবো। কিন্তু আরো কিছুটা যেতে পারব এই বিশ্বাস ছিল। তিন চার মাস ধরে ফুসফুসের জোর বাড়িয়েছি এটার জন্যই। হিমালয়ের আরও কত কত কঠিন পথে যাচ্ছেন আমাদের দেশের কত মানুষ। আর আমি এই ছোট্ট একটা পাহাড়ের মাথায় উঠতে পারলাম না! সুতরাং মনটা যে দমে আছে সেকথা সত্যি।

কিন্তু যেকথা পিনাকী জানে না সেটি হলো, এই আপাত পরাজয় আমায় মারাত্মক দুটি কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এক, আমি এই Angel's landing এর চড়াইটাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিইনি। তাই সেও আমায় তার বুকে জায়গা দেয়নি। আমাদের নেওয়া প্রস্তুতি এর জন্য যথার্থ ছিল না। নইলে এতবড় ব্যাগ নিয়ে আসার মত ভুল আমরা করতাম না। প্রথমেই যে বলছিলাম না, "প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি" -র কথা এই "প্রয়োজনীয়" কথাটির যথার্থ মান বিচার করাটাতেই আমাদের গোড়ায় গলদ ছিল। আমাদের আবার আসতে গেলে 'সত্যিকারের' প্রস্তুতি নিয়ে তবেই আসতে হবে।
আর দুই, সামনে এগিয়ে যাবার সুযোগ এবং অনুমতি থাকলেই সবসময় সামনে এগিয়ে যেতে নেই। টিমের বাকি সদস্যও যতক্ষন না সেই অবস্থায় এসে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষন অপেক্ষা করার, ফিরে আসার ধৈর্য্য অন্তত আমার আছে। এটা কি পরাজয় হলো তবে? হিমালয়ের দেশের মেয়েকে Angel's landing পরাজিত করবে এমন সাধ্যি কি তার আছে? তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে সেখান থেকে চারিদিক দেখতে পারিনি ঠিকই তবে পরবর্তী ক্ষেত্রে যেকোনো কাজে 'যথার্থ প্রস্তুতি' আর প্রয়োজন পড়লে পিছিয়ে আসার অমূল্য এক অনুভব সে দিয়েছে আমায়।

নিচে নেমে ওয়েস্ট রিম ট্রেলের শুরুর জায়গাটায় উঠে Angel's landing এর দিকে তাকিয়েছিলাম। রোদে তাকানো যাচ্ছে না ভালো করে। সরু পথটা দেখা যাচ্ছে না ভালো করে।  কালো কালো কিছু জীব নড়াচড়া করছে সাদা তুষারের মাঝে। ওরা মানুষ, আমাদের মত। কেউ উঠবে, কেউ পারবে না আমাদের মত। কিন্তু সকলকেই Angel's landing কিছু না কিছু বলবে। সেকথা শুনতে পাওয়াটাই বোধহয় জয়। মনে গেঁথে নেওয়াটাই ভিক্ট্রি। এই একান্ত কানাকানিটুকু শুনতে পাবার লোভেই বার বার পাহাড়-নদী-জঙ্গল ভেঙে হাঁটা। ঝরাপাতায়, কনকনে তুষারে, মাতাল সমুদ্রের হাওয়ায় বুক পেতে থেবড়ে বসে থাকা। একজন্মেই নিযুত জন্মের খিদে মিটিয়ে নেবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।


(শেষ)
            

Monday, 27 January 2020

একটি পথ এবং একটি অনুভব-১

কিছু কিছু সময় পরাজয় প্রয়োজন। তাতে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে মিথ্যে ধারণা গুলোর একটা হিল্লে হয়। আর মাথা পরিষ্কার হলে পরাজয়ের ক্ষোভ মিটিয়ে, প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে, ফের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাবার খিদে জাগে মনে। বললাম বটে- "প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে", কিন্তু এই 'প্রয়োজনীয়' কথাটিই ভারী মারাত্মক। কতটা প্রস্তুতি যে ঠিক 'প্রয়োজন', সেটি আন্দাজ করে ওঠা দুস্কর হয়ে পড়ে। 
কোনো একটি জায়গায় পড়েছিলাম, "Getting better isn't easy. There are no shortcuts. No cheat codes, No quick fixes. It's only work." 
অল্প একটু চেষ্টায় নিজেকে একটু ঠেলে তুলতে পারলেই মনে হয়-এই তো বেশ খানিক পথে এসেছি  বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাতে অনেকটা পথ হাঁটা গেলেও সর্বদা শেষ রক্ষা হয়না বোধহয়। তবে আরো একটা বিষয় বারংবার দেখেছি যে খুব খানিক চেষ্টা করলে কোনো না কোনো ভাবে শেষ মুহূর্তে অবিশ্বাস্যভাবে সাহায্য এসে যায়। কি করে জানিনা। 

গেল নভেম্বরের কোনো এক দুপুরে আমরা ভরপুর তুষারপাতের মধ্যে উটা -র জায়ণ ন্যাশন্যাল পার্কে এসে পৌঁছেছিলাম। জায়ণের উত্তরদ্বার দিয়ে জায়ণে ঢোকার একটা অসাধারণ সুবিধা আছে। সেটি হলো, পথটি মারাত্মক রকম সুন্দর। কিন্তু অসুবিধাটি হচ্ছে- যদি কোনো কারণে রাস্তাটি বন্ধ থাকে তবে বেশ অনেকটা পথ মানে প্রায় আড়াই ঘন্টা উজিয়ে এসে তবে ঠিকঠাক লোকালয় পাওয়া যাবে থাকা বা পেট্রোল নেবার জন্য। শীতের তুষারপাতের জন্য অনেকসময়ই এই পথটি বন্ধ থাকে।সুতরাং এই পথে পা বাড়াবার আগে আমরা খোঁজ নিয়েছিলাম যে পথটি খোলা কিনা। খোলাই ছিল, কিন্তু দিনের শুরুতে চকচকে রোদ্দুর মাখা আকাশের নিচে চলতে শুরু করে বেলা বাড়ার সাথে সাথে যতক্ষণে আমরা জায়ণের উত্তরদ্বারে গিয়ে পৌঁছলাম, ততক্ষনে অবিশ্রান্ত তুষারপাতে দুধসাদা চারিধার। এবং জায়ণের উত্তরদ্বার ঠিক বন্ধ হবো হবো। রাস্তা পরিষ্কার না করে পর্যটকদের গাড়িকে যেতে দেবে না। তাতে বিপদ হতে পারে। বেশ কয়েকটা গাড়ির জটলা গেটের সামনে। আর একটা ইলেক্ট্রনিক বোর্ডে ঝলমল করেছে লেখা "Road closed due to heavy snowfall." অনেক দূর থেকেই পড়া যাচ্ছে। তবুও আশায় আশায় সামনে এগোলাম। এতগুলো গাড়ি কি করছে তবে রাস্তা বন্ধ যদি? ঢুকতেই একজন ফ্লুরোসেন্ট রঙের জ্যাকেট পরা মানুষ এসে জিজ্ঞাসা করলেন আমরা ভেতরে যেতে চাই কিনা। সে আর বলতে? সমস্বরে "হ্যাঁ" বলতেই ভগবানের দূত বললেন, "এস তবে, আমার গাড়ির পেছনে পেছনে। আমরা দশটা গাড়িকে ছাড়ছি। এরপর আজকের জন্য রাস্তা বন্ধ।" ভদ্রলোক রেঞ্জার। রাস্তা পরিষ্কার হবার খবর পেয়ে শেষ দশটা গাড়িকে এস্কর্ট করে রাস্তাটুকু পার করে দেবেন। এটি তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আর আমরা সেই সাকুল্যে দশটি গাড়ির লাইনের নয় নম্বর গাড়িটি। আমাদের পেছনেই একটি গাড়ি এসে ঢুকেছিলো আর পেছনের গেটটি সেদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ আর পাঁচটি মিনিট দেরি হলে, বা আমরা ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলে সেদিনের জন্য আমাদের এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। আর আমাদের সেদিনের রাতের আস্তানায় পৌঁছাতে গেলে পিছন ফিরে আরও অন্তত তিনঘন্টার রাস্তা যেতে হতো। 

তারপর আর কি? রেঞ্জারের গাড়ির পেছনে পেছনে দশটি গাড়ি গুড়গুড় করে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর রাস্তাটি ভয়ে এবং বিস্ময়ে আস্তে আস্তে পার হয়েছিলুম সেইদিন। তাই বলছিলাম আর কি যে খুব করে চাইলে আর চেষ্টা করলে শেষ মুহূর্তে একটা সহায় জুটেই  যায়। 

সেদিন আমরা জায়ণের কিছু জায়গা দেখে রাতের আস্তানায় ফিরে গিয়েছিলাম। এই রাস্তা খারাপ থাকার জন্য আমাদের সেদিনের ঘোরার সময় এবং তালিকা থেকে কিছু কাটছাঁট করতে হয়েছিল। তাতে আমাদের বিশেষ ক্ষোভ ছিল না কারণ আমাদের জায়ণ ভ্রমণের প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ ছিল 'Angel's landing'. অর্থাৎ 'Angel's landing' নামের একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের মাথায় চড়া। নিয়মিত পর্বতারোহন করেন যাঁরা তাদের কাছে এটি হয়তো শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ধর্মতলায় ঘুরে বেড়ানোর মতোই মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের মতন নব্য এবং শখের হাঁটিয়েদের পক্ষে এটি বিশেষ সহজ সাধ্য নয়। বিশেষত আগের দিনের ঐরকম তুষারপাতের পর। যাই হোক, আমরা ভোর চারটেয় বেরোলাম এবং জায়ণের টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে পৌঁছে গেলাম পাঁচটায়। এখান থেকেই জায়ণের ভেতরে যাবার বাস ছাড়বে। তখনও অন্ধকার। আমাদের আগে দুজনমাত্র পৌঁছেছেন। বাসস্ট্যান্ডে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে আলো ফুটলো। সামনে সূর্যের প্রথম কমলা- হলুদ আলো এসে পড়লো লাল পাথরের দৈত্যাকার পাহাড়ে। সে পাহাড় তখন গতদিনের তুষারপাতের ফলে লাল-সাদা আল্পনায় পরিণত হয়েছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। অসাধারণ সুন্দর এই জাতীয় উদ্যান। 
আস্তে আস্তে আরো নানান দেশীয় পর্যটক এসে জড়ো হচ্ছেন বাসস্ট্যান্ডে। ভেতরে যাবার জন্য এদের নিজস্ব বাস ছাড়া অন্য কোনো গাড়ির অনুমতি নেই। সুতরাং বাসস্ট্যান্ডই সকলের গতি। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন বাস এলো না, তখন চিন্তা বাড়তে লাগলো। এমন তো হবার কথা নয় কোনো আগাম নোটিশ ছাড়া। বেলা যত বাড়বে Angel's landing -এ ওঠা তত বিরক্তিকর এবং কষ্টকর হবে গরম এবং রোদের জন্য। আমরা উসখুস করছিলাম। এমন সময় একজন পার্ক অফিসিয়াল এসে জানালেন যে বাস আপাতত বন্ধ। পার্কের ভেতরের রাস্তা পরিষ্কার করতে শুরু করেছেন ওঁনারা। রাস্তা পুরোপুরি পরিষ্কার না হলে বাস চালানো যাবে না। কাল দুপুরের পর থেকে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত অবিশ্রান্ত তুষারপাত হয়েছে। প্রধান সড়কগুলি রাতেই পরিষ্কার করে দেওয়ায় আমরা সাতসকালে এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু ভেতরের রাস্তাতে এখন পরিষ্কারের কাজ চলছে।মনটা দমে গেল। আমাদের এবারের জায়ণ অভিযানের অন্যতম কারণ হলো Angel's landing. এই অবস্থায় সেটিই না মাঠে মারা যায়। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে Angel's landing এর হাঁটা শুরু করার পয়েন্টটি অন্তত পাঁচ মাইল পথ। এর কিছুটা পর্যন্ত নিজেদের গাড়িতে যাওয়া যাবে। তারপর থেকে বাইরের গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। মনস্থির করে সেখান থেকেই বাকিটা হাঁটব স্থির করলাম। সেই মত গাড়ি নিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে তারপর বাসরাস্তা ধরে ঢিমে তালে হাঁটতে শুরু করলাম। বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভার্জিন রিভার। লাল পাথরের খাড়াই পাথুরে দেওয়াল ডাইনে বাঁয়ে। আমাদের পরিকল্পনায় এই অতিরিক্ত পাঁচ মাইল হাঁটাটা ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বলছে তখন হাঁটতে হবেই। ঠিক করলাম কোনো তাড়াহুড়ো করবো না। পুরো রাস্তাটার সৌন্দর্য্য শুষে নিতে নিতে এগোবো। তাতে যদি পুরোটা পৌঁছাতে না পারি তবে তাই সই। ফিরে আসব। কিন্তু কোথাও পৌঁছাতেই হবে এই লক্ষ্যে এগোলে তাতে মোহভঙ্গ হবার সম্ভাবনাই বেশি। উপরন্তু পৌঁছাতে হবে এই তাড়ায় রাস্তাটির সৌন্দর্য্যও হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই আমাদের কোথাও পৌঁছানোর তাড়া ছিল না। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হয়, এতই সুন্দর জায়ণ। Angel's landing এ উঠবো বলে আমরা কয়েকমাস ধরে নিজেদের মতন কিছু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। নইলে আমাদের এতটা রাস্তা হাঁটার মত শারীরিক সক্ষমতা ছিল না। প্রায় ঘন্টা খানেক রাস্তা ধরে হাঁটার পর পিছন থেকে বাস এলো। আপাতত কিছুটা রাস্তা পরিষ্কার হয়েছে তাই সেপর্যন্ত বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। যে পর্যন্ত চালু হয়েছে সেটি এখন থেকে আর একটি স্টপেজ। আর তার পরের স্টপেজটিই আমাদের Angel's landing এর হাঁটাপথের শুরু। অর্থাৎ বেশিরভাগ রাস্তাটি আমরা হেঁটেই চলে এসেছি। তাও যতটুকু শক্তি সঞ্চয় করা যায়, এই ভেবে বাসে করে পরের স্টপেজে এসে পৌঁছলাম। এটি জায়ণ লজ। এখানে এদের প্রধান থাকার জায়গা। জায়ণ লজের রেস্টুরেন্টে ঢুকে কফি দিয়ে কিছুটা ক্যাফিন শরীরে ঢুকিয়ে নিলাম। আর একটা কাজ করেছিলাম যেটি সেদিন আমাদের প্রচন্ড সহায় হয়েছিল পরবর্তী হাঁটার ক্ষেত্রে। সেটি হলো, দুজনে দুজোড়া shoe traction কিনে জুতোয় লাগিয়ে নিয়েছিলাম। আগের দিনের অল্প রাস্তার হাঁটাহাঁটিতেই বুঝেছিলাম তুষারপাতের পর শক্ত হয়ে গেছে বেশ কিছু জায়গাতেই। ফলে তার ওপরে হাঁটা কষ্টকর। ভয়াবহ রকম পিচ্ছিল বেশ কিছু জায়গা। shoe traction এক্ষেত্রে ত্রাতা। জুতোর গ্রিপ বাড়াবে। 

কফি খেয়ে, জুতোয় ট্রাক্শন লাগিয়ে লাঠি বাগিয়ে এবার আসল হাঁটা শুরু হলো। জায়ণ লজ থেকে বেরিয়েই মোলাকাত হলো একটি শিং ওয়ালা হরিণের সাথে। সাতসকালে দুই তিনজন শিংবিহীন বৌ নিয়ে বরফ খুঁড়ে ঘাসপাতা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বেরিয়েছে। তাদের বিদায় দিয়ে বাঁদিকে একটা ছোট্ট কাঠের সেতু। সেটি পেরিয়েই ভার্জিন রিভারকে ডানহাতে রেখে চড়াই শুরু। বরফে সম্পূর্ণ ঢাকা সরু পায়ে চলা পথ। ঝুরো বরফে হাঁটতে আপাতত কোনো সমস্যা নেই। আমাদের যা গতি তাতে আমরা খুশি। কারো কারো থেকে বেশি। তাঁদের আমরা পেরিয়ে চলেছি। কারো কারো থেকে কম। তাঁরা আমাদের পেরিয়ে চলেছেন। আমরা জল খেতে খেতে, শুকনো ফল চিবোতে চিবোতে আর ছবি তুলতে তুলতে আঁকাবাঁকা সরু চড়াই পথ হেঁটে চলেছি Angel's landing এর দিকে। রোদ বাড়ছে ক্রমশঃ। 

(পরের পর্বে গল্পের শেষ)