Friday, 29 December 2017

শুভ নববর্ষ


“The wound is the place where the Light enters you.”-Rumi


পিঠ সোজা করে বোসো একবার, বন্ধ করো চোখ, প্রবেশ করো নিজের ভিতরে, বুকের খাঁচা ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে থুতনি উঁচু করে তাকাও দেখি আকাশের দিকে, এবার একবার ফুসফুস খালি করে ত্যাগ করো দেখি সমস্ত আবর্জনা। 

করেছো? 

এবার সত্যি করে বোলো দেখি, মাথার ভিতরটা একটুও খালি হল কিনা? দুকাঁধে পেশিগুলো একটুও শিথিল হয়নি কি? দুই ভ্রূ এর মাঝের চামড়াতে একটা ভাঁজও কি কমেনি?

কি বলছো? 

জানিনা ঠিক কি পরিবর্তন হলো, কিন্তু ঠিক এর পরের শ্বাসটা মনে হলো যেন একটু বড় করে নিতে পারলাম। 

তবে তো উৎসব শুরু। 

তুমি যুদ্ধে জিততে শুরু করেছো যে। একটি একটি করে শ্বাস তোমার হয়ে কথা বলবে এভাবেই। তারপর শ্বাসের সাথে সাথে একটু একটু করে দেখবে গোটা ফুসফুসটা তোমার কথা শুনে চলছে। তারপর একদিন দেখবে পুরো শরীরটা, যেখানে তুমি রয়েছো এতগুলি বছর ধরে, সে তোমার কথা শুনতে শুনতে ক্রমশঃ তুমি হয়ে উঠেছে। আর অনুভূতিগুলো যেগুলো এতবছর ধরে পুতুল নাচন নাচিয়ে চলছিল তোমায়, একদিন তাদের কান ধরে শাসন করে, লাটাইয়ের সুতোর ডগায় বেঁধে হুস করে দিয়েছো আকাশে ভাসিয়ে। 

সত্যি বলছি। একটা শ্বাস যদি বুকভরে নিতে পারো, এ সবই পারবে তুমি। একবার বিশ্বাস করে বুক চিতিয়ে চোখটা বন্ধ করে দেখোই না। 

দুঃখ, দুঃসময়, প্রবঞ্চনা, একাকিত্ব, অপ্রেম, অনিশ্চয়তা এতো কিছু পেরিয়ে চলেছো তুমি, এখনো তো দিব্য বেঁচে আছো, নিজেও কি ভেবেছিলে পার হতে পারবে নড়বড়ে সাঁকোটা? 

কিন্তু পেরিয়ে তো এলে? বা পার হবার বার জন্য সাহস করে প্রথম পা টা তো ফেলেছো দেখতে পাচ্ছি। তবে অর্ধেক যুদ্ধ তো জিতেই গেলে প্রায়। কি বললে, যন্ত্রনায় ছিঁড়ে পড়ছে মন? শরীর আর চলছে না? ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে জীবন? জানি তো।  হচ্ছে তো।  তোমার-আমার-ওর-সক্কলের। যন্ত্রণার প্রকার কেবল তোমার-আমার-ওর-সক্কলের মৌলিক। জীবন মৌলিক তাই যন্ত্রণাও মৌলিক। মৌলিক যোদ্ধার জীবন যাপন। জীবন। যুদ্ধটা কেবল অমৌলিক। সত্যিটা হলো, প্রতিনয়ত প্রতি সেকেন্ডে যুদ্ধটা জিতে চলেছি তুমি-আমি-ও-সক্কলেই। প্রতিদিনের ওঠা নামায়। নইলে আজও জানলা দিয়ে সূর্য্যাস্তের লাল আলো চোখে পড়লে একবার চোখ বন্ধ করে সে আলোটা চোখে মেখে নাও কেন তুমি? আজো খানসাহেবের আঙ্গুল সরোদ  ছুঁলে ঈশ্বর এসে স্পর্শ করেন কেন তোমার হৃদয়? আজও কেন নেই রাজ্যের বাসিন্দা কারো যুদ্ধজয়ের গল্প শোনার শেষে তোমার চোখ ভিজে আসে? আজও কেন আরো একবার চেষ্টা করতে ইচ্ছে করে? জিতেছ  বলেই তো? ওই যে কবে প্রথম শ্বাসটা নিয়েছিলে চেষ্টা করে দেখবে বলে, সেইদিনেই জিততে শুরু করেছিলে নিজেও বোঝোনি। বুঝিনি- বোঝেনা। তুমি-আমি-ও-সক্কলে।  

নতুন বছরে নতুন যুদ্ধের রসদ পেয়েছো তো আগের আগের সমস্ত বছরের যুদ্ধ গুলো থেকে? ব্যুহসজ্জাও সম্পন্ন হয়েছে নিখুঁতভাবে? হয়েছে।  তোমার-আমার-ওর সক্কলের অজান্তেই।  এস তবে আরেকবার ব্রহ্মক্ষণে দরজা খুলে দাঁড়াই ভৈরবী আলোয়, নতুন যুদ্ধের আবাহনের অপেক্ষায়। জিতবো বলে। বুক পেতে ক্ষতটা গ্রহণ করবো বলে। সেই ক্ষতপথে ভৈরবী আলোর সবটুকু বুকের ভেতর গ্রহণ করবো বলে। বেঁচে উঠবো বলে। আরও একবার। তুমি- আমি- সক্কলে। একসাথে। ভিন্ন ভিন্ন পথে। 

ভাগ্যিস ক্ষতরা থাকে সক্কলের জীবনে, নইলে আলোরা যে বাইরেই মাথা কুটে মরতো (“The wound is the place where the Light enters you.”-Rumi)।  

শুভ নববর্ষ।    




Saturday, 8 July 2017

ফিরে আসছ প্রেম?

ফিরে আসছ প্রেম?
বদ্ধ ঘর রয়েছে তোমার অপেক্ষায়।
তুমি এসে খুলে দাও সবকটা জানলা।
শীতল বাতাস এসে ভরে দিক ঘর।
এতদিন রোদ ঢোকেনি এঘরে।
তুমি সাথে করে একছিটে রোদ্দুর আনতে যেন ভুলো না।
ছড়িয়ে দেব ঘরে।

তাড়াতাড়ি এস প্রেম।
একজোড়া চায়ের কাপের একটা
হারিয়েছে উষ্ণতা।
অন্য কাপটি যে ছিল অনুপস্থিত।
এইকয়দিন খঞ্জনা দুটিও ছিল নিখোঁজ।
জানলার বাইরে নরম আদর
চুইঁয়ে পড়ছিল না তো, তাই।
খঞ্জনাদুটি আসে যে ওই
আদরটুকুনিই খুঁটে খেতে।
প্রেম, আসবার সময় আঁচলা ভরে খানিক আদরও এনো, কেমন।
ঘর উপচে খানিক দেব
জানলার বাইরে ছড়িয়ে।

ফিরে আসছ প্রেম?
সাবধানে এসো,
তাড়াহুড়ো নেই কোনো।
তাড়াতাড়িতে ভুল করে
যেন ভুল ঠিকানায় যেও না।
তোমার জন্য যত্ন করে
শান্ত ভোরের আলো, নিস্তব্ধ চকচকে দুপুর
আর শিরশিরে হাওয়া মাখা সন্ধ্যা রেখেছি সাজিয়ে।
ঠিক যেমনটি তুমি চেয়েছিলে।
তুমি এসে সব দেখে বুঝে নিও,
নিজের মতন করে।
আর হ্যাঁ প্রেম, আসার সময়
খানিক বৃষ্টিও এনো সাথে করে।
ঠিক ততটুকুন, যতটা লাগে
অপ্রেমকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিতে।

Monday, 26 June 2017

বর্তমান

ভাল মন্দের হিসেব কষেছ মেয়ে?
পুষেছ নীতির মালা?
তাই তো তোমার ঘর নেই কোনো,
নেই কেউ শোনবার।

দেশ তো তোমার নেই জানতাম,
ছিলোও না কোনোকালে।
আগু পিছু?
সেও গেছে বুঝি?
পথ নেই ফেরবার?

পলকে হারালে অতীত তোমার,
পলকে ভবিষ্যৎ।
সামনে কেবল একপদ ভূমি,
সত্য বর্তমান।

Sunday, 21 May 2017

পিদিমের আলো

সপ্তাহভর টাপুরটুপুর, আকাশের মুখ ভার।
মেঘমাখানো বিকেলবেলায়, গৃহস্থালির হার।
মেঘের গায়ে চু কিত কিত, জানলাতে মন গোল্লাছুট।
ছোট ছোট ছোট ছুট্টে গিয়ে, ছোট্টবেলার ছক্কা পুট।
মেঘের গায়ে সাপ লুডো নেই, মেঘের রঙ কালো।
ঘরের কোনে আজ বিজলিবাতি, নেই পিদিমের আলো।

Sunday, 9 April 2017

প্রত্যাশা

মৃতবৎসা মায়ের তৃতীয় এবং
শেষ গর্ভের সন্তান আমি।
জন্মের সময় থেকেই
আমার কাছে
কারও কোনো প্রত্যাশা ছিল না
কেবল বেঁচে থাকা ছাড়া।
পুত্র বা কন্যা,
বুদ্ধিমান বা বোধহীন,
সৌন্দর্য বা কদর্যতা,
দায়িত্বশীল বা দায়িত্বহীন
কোনোকিছুরই আশা করেনি কেউ
শুধুমাত্র আমার
জীবিত থাকা ছাড়া।
কন্যারূপে,
বন্ধুরূপে,
স্ত্রীরূপে
আমিও হয়ত তাই
কারও কোনো
প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব
নিইনি কোনোদিন।
কেবল বেঁচে আছি।
দুমড়ে বেঁকে যাওয়া পিঠ,
আর আদ্যন্ত স্বার্থপরতা সম্বল করে
আজও জীবিত আছি
প্রবলভাবে।

Wednesday, 29 March 2017

বৃষ্টিভোর


আজ ভোরে জানলা খুলতেই তার সাথে দেখা। সে যে আছে, কিংবা বলা যায়, বহুক্ষণ থেকেই ছিল, তা জানলা খোলার আগে অনুভবই করিনি। কোলাহলবিহীন তার উপস্থিতি। জানলা খুলেই দেখি, আজকের দিনটির মলিনতা মুছিয়ে ধুয়ে মেজে চকচকে করে রেখেছে সবকিছু সে। গাছপালারাও স্নান সেরে নিয়েছে ভোর রাত্রেই। ঝাঁকড়া চুল থেকে বাড়তি জল ঝরিয়ে নিয়ে সবাই মিলে জানালো 'সুপ্রভাত'। প্রভাতের তখনও অল্প দেরি আছে আসার। ভাবলাম বুঝি, সে এসে চলে গেছে ঘুমের মধ্যেই, তার আসা যাওয়ার সংবাদ ঘুমের পরত ভেদ করে এসে পৌঁছোয়নি আমার কানে। ভুল ভেবেছিলাম। ঝরঝর নৃত্যে তখনও অবিরল তার প্রভাতীবন্দনা। মরজগৎ  জেগে উঠেছে, উছলিত হয়ে উঠেছে সে বন্দনায়। কেবল আমি ছাড়া। জানালার ভেতরে দাঁড়িয়ে আর একটু হলে সদ্য নিদ্রত্থিতা আমি বেমালুম অস্বীকারই করে বসেছিলাম তার প্রবল উপস্থিতিকে। কেবলমাত্র তার উপস্থিতিজনিত কোলাহলটুকু নেই বলে। নিজেদেরই তৈরী করা শব্দনিরোধ জানালায় নিজেই প্রায় বঞ্চিত হচ্ছিলাম জগতজোড়া এই আনন্দময় প্রভাতফেরী থেকে। কতকিছুই যে এইরকম ভাবে নজরানা না দিয়ে মুখলুকোয় তার হিসেব কে রাখে। উপস্থিতির কোলাহলমুখরতার দিকেই বুঝি কেবল আমার একনিষ্ঠা। লাজুক কোলাহলবিমুখ আনন্দের উপস্থিতি তাই হারিয়ে যায় প্রতিদিনের অহেতুক শব্দময়তায়।

Monday, 27 March 2017

চাহিদা




ক্ষুধার প্রয়োজনে অন্নসংগ্রহ, 
অন্ন অন্বেষণের ক্লান্তিতে নিদ্রা, 
আর শারীরিক প্রয়োজনে মৈথুন 
শুনেছি আদিকালে এই ছিল 
জীবনের চাহিদা। 

এই তিন চাহিদা পূরিত করে, 
অনায়াস অর্জিত শান্তিতেই যাপিত হচ্ছিলো
আদিমানবীর জীবন। 

তারপর, কেমনকরে যেন, 
কোন এক দুর্বিপাকে, 
ক্ষনিকের জন্য 
শান্ত জলাশয়ে বিম্বিত হলো 
তারই শ্যামলী মুখচ্ছবিখানি।
প্রেমে পড়লো সে তার আপন লালিমার। 
আর সেই প্রাগৈতিহাসিক মুহূর্তে 
রচিত হলো বুঝি 
আত্মরতির ইতিহাস। 

কেবল আহার- নিদ্রা- মৈথুনে 
শান্ত রইল না জীবন।
কেবলই ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো 
সেই প্রাগৈতিহাসিনীর। 
ক্রমশঃই সেই নব জাগরিত নরম প্রেম, 
সঞ্চারিত হয়ে চললো দিগন্তের দিকে। 
এতদিনে তার প্রয়োজন পড়েছে প্রসাধনীর।
আলুলায়িত রুক্ষ কেশপুঞ্জ 
শাসিত হয়েছে নবকবরীর আল্পনায়। 
বসন্তে সেখানে উঠেছে 
রক্ত-পলাশগুচ্ছ।  
সে পলাশ তার কানে দিয়েছে 
তার প্রিয় আদিমানবের সুরের সন্ধান। 
শিহরিত হয়েছে তার গলার ঝিনুকমালা।
দিগন্তরেখা স্পর্শ করতে গিয়ে 
অনন্ত সেই প্রেম, 
ছুঁয়েছে আদিমানবের হৃদয়। 
আর সেই ক্ষনেই রচিত হয়েছে 
যুগলজীবনের নতুন চাহিদা। 

সৌন্দর্যপ্রিয়তার চাহিদা। 
জীবনের সৌন্দর্যরূপ 
পরস্পরে ভাগ করে নেওয়ার চাহিদা। 
কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়, 
ভালবাসার জন্য বেঁচে থাকার চাহিদা।

আর সেদিন থেকেই 
আহার- নিদ্রা- মৈথুনকে 
যোজনক্রোশ পিছনে ফেলে-
দীপ্যমান হয়ে দাঁড়িয়েছে 
জীবনের উজ্জ্বলতম চাহিদা, 
ভালবাসা।।


Sunday, 26 March 2017

ব্রহ্মনাদ


প্রানের জন্ম কি শব্দ থেকে?
ব্রহ্মনাদ শব্দটি সঠিক কি অর্থবাহক?
হাজার হাজার নারী পুরুষের কোন অন্তরীন অতল থেকে উতসারিত আনন্দ,
বীণার তানরূপে তুলেছে ঝঙ্কার।
সৃষ্টি করেছে আদিম ব্রহ্মনাদ।
সৃষ্টি করেছে প্রাণ।
সৃষ্টি  করেছে শ্রী।

সমষ্টিগত সেই শ্রীনাদের পুনরারম্ভে
আজ কি পুনরাগমন হবে না সেই আদিম শ্রীয়ের?
পুনরায় জেগে উঠবেন না কি সেই আদিমাতা?
সৃষ্টি করবেন না কি নতুন প্রাণ?

তিলে তিলে মিলন হচ্ছিল
নিমীলিত অজস্র হৃদয় আর
নবকল্পের সেই নবব্রহ্মনাদের।
অপার্থিব সেই সংগমে জেগে উঠেছে
প্রতিটি প্রানের প্রতিটি সুপ্ত সুর।
সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক সরগম।
নবকল্পের বীজ জেগেছে অনাদি নিদ্রা ভঙ্গ করে।
দিবাকরকে উষার অর্ঘ্য নিবেদনের সময়াসন্ন যে।

সমষ্টির আহবানে
আদিমাতা ধারণ করেছেন বরাভয়মুদ্রা।
জেগেছে সমস্ত সত্বা।
সমস্ত আগল ছিন্ন করে
সুরপ্লাবিত হয়েছে জগত।
ব্রহ্মনাদের আবাহনে
তরল হয়ে মিশে যাচ্ছে আজন্মের প্রস্তরীভূত আমিত্ব।

এতদিনে হল জন্ম।
আর নেই ভয়।

Saturday, 25 February 2017

আজকের ভোর




 সামনের জানলা তার ওপারে রাস্তা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের পূর্ব সীমানা। রাস্তার ওপারে একটা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। কিন্তু কখনো এই বাড়ি থেকে কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখিনি। আসলে এটা বাড়িটার পিছনের দিক। সামনের দিকে বড় দরজা, বাড়ির সামনে একটা বিশাল গাছ। নাম জানিনা।তাতে একটা দোলনা বাঁধা থাকতে দেখেছিলাম একদিন। তাইতেই বুঝেছিলাম বাড়িতে একটি ছোট সদস্যও আছেন। বাড়ির পিছনের দিকটাতে বিশেষ কেউ আসেনা। একটু জঙ্গুলে মতো। শীতকাল ছাড়া বোঝাই যায় না এখানে একটা বাড়ি আছে। জঙ্গলে ঢাকা থাকে। বাড়িটা একটু উঁচুতে। তাই শীতকাল ছাড়া অন্য সময়, যখন প্রচুর সবুজে বাড়িটা ঢেকে থাকে, তখন মনে করে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না যে, আমার জানলার ওপারে রাস্তা আর রাস্তার ওপারে সবুজে ঢাকা পাহাড়। আমি বুঝি হিমালয়ের কোনো শান্ত গ্রামে আছি।ভাবতে দোষ কি?

এই মুহূর্তে, শীতের দাপটে সব পাতা ঝরে, বাড়িটার পিছন দিকটা ন্যাড়া করে, জঙ্গলের গাছগুলো শুধু অজস্র হাত বাড়িয়ে উর্দ্ধমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরএই সুযোগে বাড়িটার ফাঁক দিয়ে পূর্বদিকের একফালি আকাশ আমার সামনে ফুটে উঠেছে। আস্তে আস্তে ফর্সা হচ্ছে আকাশ। রাস্তাটা দিয়ে ক্যাম্পাস সিকিউরিটির গোবদা গাড়িগুলো রাতের শেষ টহল দিয়ে গেলো একটু আগে। তখন আলো ফোটেনি। আলো ফুটতে শুরু করতে না করতেই, রাস্তার পাশের হাঁটার রাস্তাটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলো বরফ সাফ করার ছোট গাড়ি নিয়ে। মানুষ চলাচল শুরু হবার আগে হাঁটার রাস্তা পরিষ্কার থাকা জরুরি। অবশ্য স্বাস্থ্যসন্ধানী দৌড়বাজরা ছাড়া বিশেষ কেউ হাঁটেনা এখানে। তাও এরা নাগরিক সুবিধা গুলো বেশ যত্নের সঙ্গেই রক্ষা করে। কাল সারাদিন তুষারপাত হয়েছে। সন্ধ্যে থেকে ক্ষান্ত দিয়েছিলো। বড় রাস্তাগুলো এখানে সাথে সাথেই পরিষ্কার করে দেয়। এই বরফ পরিষ্কার করার গাড়িগুলো তিন রকম হয় দেখেছি। শহরের সবচেয়ে বড় আর ব্যস্ত রাস্তাগুলো পরিষ্কার করতে হয় সাথে সাথেই। তার জন্য সবচেয়ে বড় আর ভারী গাড়ি লাগে। সামনের দিকে বেলচার মতো বিশাল চামচ নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ছোট রাস্তা পরিষ্কার করার ছোট গাড়ি, আর রাস্তার পাশের হাঁটার রাস্তা পরিস্কার করার জন্য ছোট্ট গাড়ি। একটু আগে দৌড়াদৌড়ি করে তারই একটা আমার সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলো। গত বছর যখন এখানে প্রথম এসেছিলাম, এই রাস্তার বরফ পরিষ্কার করার গাড়িগুলো দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় গাড়িগুলো বেশ গাঁট্টাগোট্টা। চেহারাটা হুমদো মতো বলে আমরা ওগুলোকে মজা করে বলতাম, হুব্বাগাড়ি। বড় হুব্বাগাড়ি, মেজো হুব্বাগাড়ি , আর এখুনি যেটা দৌড়াদৌড়ি করছিলো সেগুলো ছোট হুব্বাগাড়ি। ছোট হুব্বাগাড়িগুলো খুব মজার। কেমন গুড়গুড়িয়ে চলে সব বরফ সরিয়ে রাস্তা করে দেয়।

লিখতে লিখতে চারদিকে আলো  ফুটে উঠছে। পূর্বদিকের একফালি আকাশে কমলা আভা লেগেছে। যদিও সূর্যোদয় দেখা এখান থেকে সম্ভব নয়। তাও বুঝতে তো পারছি যে এই শুরু হলো দিনের প্রথম ক্ষণ। সম্ভাবনাময় আরো একটা ভোর, মহাবিশ্বের উপহার, সক্কলের জন্য। 


রাস্তায় গাড়ি চলাচল এখনো শুরু হয়নি। আজ শনিবার, ছুটির দিন বলেই। অথচ ঘন্টা দুয়েক আগেও বেশ কয়েকটা গাড়িকে যাতায়াত করতে দেখেছি। রোজই দেখি। শেষরাতে অন্ধকারে কোথায় দৌড়ায় লোকজন কেজানে। হয়তো এয়ারপোর্ট যায়। তাছাড়া অত ভোরে আর কোথায় যাবে মানুষ। এখন রাস্তা ফাঁকা। শুধু সাদা রঙের একটা গাড়ি সারা গায়ে পাতলা তুষারের চাদর জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে আমার জানলার সামনে। 

রাস্তার আলোগুলো নিভে গেছে। সামনের বাড়িটার জানলায় এখনো আলো জ্বলছে। শেষরাত থেকেই জ্বলছে।  দুটো কাঠবেড়ালি নেমে পড়েছে রাস্তায়। ওরা সারাদিন খেলা করে।  ছুটির দিনে মাঝে মাঝেই দেখতে পাই জানলা দিয়ে ওদের। ওরা ওই সামনের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে থাকে। দুরন্ত ঠান্ডায়, বরফের মাঝেও খেলা করতে দেখেছি ওদের। প্রকৃতিদত্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ওরা। কি প্রাণশক্তি। সারাদিন দুটিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। খাবার খুঁজছে, খেলা করছে, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যে ছোটবেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলতাম, ওই খেলাটা ওরা জানে। অবিকল ওই ভঙ্গীতে একে অপরের পিছনে দৌড়ায়। বেশ লাগে দেখতে। 


চারদিক আধোনীল থেকে সাদা থেকে ক্রমশঃ সোনালী হয়ে উঠেছে। চরাচর জেগে উঠেছে। আমিও তার সাথে মিলিয়েছি সুর। এবার শুরু হবে আমার আজকের দিন।







  

Tuesday, 21 February 2017

নৈশঃব্দের শব্দ




নৈশঃব্দের শব্দে হারিয়ে যেতে যেতে,
ঘুঘুডাকা মধ্যাহ্নের উষ্ণতায় তপ্ত হতে হতে
অনর্গল বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতের আধোঘুমে,  
এমনকি পড়ন্ত গোধূলির আলোর বিষন্নতায় 
পূর্ণ হতে হতে 
একটু একটু করে ভাসিয়েছি নিজেকে।
যত্ন করে, বহুকাল ধরে। 

আজ আর মধ্যাহ্নে ঘুঘু ডাকে না বলে,
নাকি, এই শব্দনিরোধ বাতায়নে- 
মধ্যদুপুরের সশব্দ আঘাত বারণ বলে,
অথবা, সমস্ত রাত ভাসিয়ে দেবার মতন 
বৃষ্টি ভরা মেঘ বাড়ন্ত বলে,  
কিংবা, আজ গোধূলির আলোয় স্নান করা কেবল 
বিলাসিতা বলে-

ভেসে থাকতে গিয়েছি ভুলে।  
তলিয়ে যাচ্ছে প্রাণ,   
ধীরে, অথচ অনিবার্য গতিতে।

শুধু নৈঃশব্দ আজও রয়েছে সাথে 
পুনর্বার ভেসে ওঠার কবচ কুন্ডলরূপে।  
অতলে তলিয়ে যাবার আগে 
শেষবারের মত
ভেসে ওঠার বীজমন্ত্র দেবে কানে।

এমনকি মৃত্যুও অপেক্ষমান
নৈঃশব্দের সে শব্দের প্রতীক্ষায় 
অনন্তকাল।

এসো নৈঃশব্দ, 
অনুরণিত করো আমায় 
সৃষ্টির আদিমতম শব্দে।
আরও একবার উপেক্ষা করি 
অতলের আহ্বান। 

Tuesday, 14 February 2017

বাঁচিয়ে রেখো ভালবেসে




দিনান্তে শেষটুকু ক্ষণ বেঁচে থাকুক।
ভালবাসতে।
ভালবেসে বেঁচে থাকতে।

দিনান্তের শেষটুকু ক্ষণ সরিয়ে রেখ।
নিজের মধ্যে ডুব দিতে।

সেই যে মানুষ।
অবুঝ মতন
কথায় কথায় চোখ মোছে যে।
মায়ের জন্য মনখারাপে।
আদর পেলেও চোখ ভরে যায়
অনেক বেশি পাওয়া বলে।

সেই যে মানুষ।
খুঁজছে শুধু রংতুলি আর কাগজ কলম।
ছোট্টবেলায় গুছিয়ে রাখা ছবির গোছা।
খুঁজছে শুধু নিজের সাথে একলা থাকা
চিলেকোঠার জানালা ধরে।

ছাদের পরে বৃষ্টি পড়ে অঝোর ধারে।
বৃষ্টি পড়ে চিলেকোঠার জানালা ধারে।
ভাবছ বুঝি মনখারাপের বৃষ্টি ধারা?
এক্কেবারে ভুল ভেবেছ
বৃষ্টি হলে, রাগ-দুঃখ-মান-অভিমান আলগা হয়ে ঝরে পড়ে।

বৃষ্টি হয়ে ছাদের পরে, চিলেকোঠার জানালা ধারে।
বৃষ্টি শেষে সব ধুয়ে যায়।
হাসি কান্না চাওয়া পাওয়া।
তখন কেবল থাকে বাকি অনাবিল সেই একটি মানুষ।
কানায় কানায় ভরে ওঠা।

দিনান্তের শেষটুকু ক্ষণ বেঁচে থাকুক
ভালবাসতে
সেই মানুষকে।
অভিমানী, নরম সরম সেই মানুষকে
ভালবেসো
বাঁচিয়ে রেখো ভালবেসে।

Sunday, 12 February 2017

মূল

একটা পিচঢালা রাস্তা, মাঝে মাঝে অবশ্য ওপরের চামড়া উঠে গিয়ে হাড়গোড় বেরিয়ে এসেছে, চকচকে ছবির মতন রাস্তা সে নয় যদিও, তবুও কাকভোরে কুয়াশা মাখা সে রাস্তায় হেঁটে বড়ো আরাম পেয়েছি। হোকনা সে খানিক ভাঙাচোরা, তবুও তার দুইপাশের জমাট বাঁধা কুয়াশা, আদিগন্ত আধসবুজ-আধহলুদ ধানের ভারে নুয়েপড়া ধানক্ষেত, সে আমার নিজের, বড়ো প্রিয়, বড়ো আরামের।  আজও একবুক কষ্ট নিয়ে তার কাছে গেলে সে বুক পেতে দেবে আমার চোখের জল ধারণ এর জন্য। আমি জানি, আজও সে ফিসফিসিয়ে বাম কানে বলে উঠবে , "কেঁদে নে মেয়ে, যতটা পারিস। সব পরাজয় এইখানে ফেলে উঠে দাঁড়া। কি বললি ? ফের পরাজয় এলে? আবার আসিস আমার কাছে। এ কান্নার জল শুকিয়ে যাবে ততদিনে আমার বুক থেকে। ফের ভিজিয়ে দিস নাহয় আমায়, তারপর উঠে দাঁড়াস। আরও একবার এর জন্য। আমি আছি তোদের সকলের জন্য।  চিরন্তন।" 

আম মুকুলের গন্ধ নিয়েছো কোনোদিন, অমন কুয়াশা ভরা কাকভোরে? আমি নিয়েছি। মহূয়ার গন্ধে জগৎ মাতাল হয় শুনেছি। সে কি আমমুকুলের গন্ধের চেয়েও বেশি নেশার? কিশোরবেলার নেশাধরা দোলাচলে আরো নেশাড়ু হয়ে উঠতে সেই আমমুকুলের গন্ধের কোনো ভূমিকা কি নেই সত্যিই? 

নতুন কাটা ধান, কুয়াশার আবছায়া, নেশাধরানো আমমুকুলের গন্ধ, আসন্ন দোলউৎসবের আবীর আর সদ্য কৈশোরের তাজা একটা মন, এই তো বসন্ত। আমার দেখা বসন্ত।

সূর্যাস্তের লালিমা দেখতে শেখায়নি কেউই।  শীতের শেষে, বাতাসে যখন হিম ফুরিয়ে যায়নি সেই বছরের মতন,তখন শিরশিরে হাওয়ায়, সদ্যকাটা ধানক্ষেতে বসে সন্ধ্যা নেমে আসা দেখেছি সেই কোন ছোট্টবেলায়। অজান্তেই কখন শিখে গেছি, অস্তগামী সূর্যদেব বিদায় নেন কেবল পরদিন আবার আমায় জাগাবেন বলে।  অশরীরী কেউ যেন বুকের মধ্যে বসে শিখিয়ে দিয়ে গেছে, "সে বিদায়বেলায় শান্ত থেকো। কোলাহল সন্ধ্যাসূর্যের জন্য নয়। অনুভব করো তার শেষ কিরণটুকু। শুষে নাও অন্তরে। আসন্ন রাত্রির পাথেয় কর তাকে।" মাঠের শেষে পড়শী গ্রামের গাছপালার আড়ালে চলে যেতেন সূর্যদেব। অপলক আমায় তাঁর কমলা-লাল আভায় আপাদমস্তক অবিচল করে দিয়ে। ফ্রকপরা সেই ছোট্ট আমি সেই তবে থেকেই সূর্যদেব এর বিদায়কালে আর বিদায়সম্ভাষণ টুকুও জানিয়ে উঠতে পারিনি কোনোদিন। সূর্যাস্তের রক্তিমাভা চোখে লাগলেই কেমন করে যেন ঝিমধরা চোখে কেবল তাকিয়ে থেকেছি, থাকি। শান্ত হয়ে আসে ভিতর-বাহির। আশেপাশের সমস্ত কিছু মুছে গিয়ে ভেসে উঠতে থাকে আমার আশৈশব এর সদ্যকাটা ধানক্ষেত, আর আমার কিশোরী চোখে দেখা অস্তগামী সূর্যদেব। যিনি বিদায় নিচ্ছেন কেবল ফিরে এসে আমায় জাগবেন বলে। 

কুয়াশা মাখা-পাকা ধানক্ষেতের পাড় আঁকা-ভাঙা রাস্তা, বসন্তের আমমুকুলের গন্ধের নেশা, সন্ধ্যে নামার আগে, দিগন্তছোঁয়া ফাঁকা ধানক্ষেতে বসে সেদিনের মতো লাল-কমলায় সম্মোহিত হয়ে যাওয়া। এই আমার শৈশব-কৈশোর। এ কোনো কাব্য করে বলা কথা নয়, মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো সত্যি। সত্যিকারের আমি। এখনকার আমির মূল। যে আজও আমার চোখের জলে বুক পেতে দেয়। মেরুদন্ড সোজা করার শক্তি জোগায়। যার কারণেই আজও সব পরাজয় সরিয়ে রেখে নিজেকে দেখি সম্মোহিতের মতো স্থির কি অপূর্ব এক সৃষ্টির সামনে।  


Tuesday, 31 January 2017

জাগরণী

স্তব্ধতার কণ্ঠ বলে গিয়েছে আমায়,
এখনো হয়নি সব শেষ।
বহুদিন পর বলেছে সেদিন।
সমস্তদিন ধরে শুনেছি তা।
মধ্যরাতে দূর প্রান্তর থেকে ভেসে আসা
মালকোষের বিলম্বিত তানের মত
সে কণ্ঠ জড়িয়েছে আমায়।
টুটেছে কালরাত্রি।
ভেঙেছে কালনিদ্রা।
স্তব্ধতায় মাখামাখি হয়ে
জেগেছি আমি।
বহুদিন পর।
স্তব্ধতা এসে মুছেছে ঘুমপাড়ানি কলরব যত।
শুনিয়েছে জাগরণী। 
এখনো হয়নি সব শেষ।
এখনো রয়েছে বাকি।
এখনো হয়নি সব শেষ।