বিছানা-১ এর পর.......
জাগরী নিজের বিছানা পাতা সম্পর্কে একটু সচেতন। দিনের বাকি সবকিছুর ওপর বিশেষ নজরদারি না করলেও রাতের বিছানাটি পরিস্কার না হলে তার মন খুঁতখুঁত করে। কিছুটা পিটপিটেই সে বলবে নিজেকে এই ব্যাপারে। বেশ করে বিছানা ঝেড়ে ঝুড়ে তবে সে শোয় বিছানায়। কিন্তু একজন মানুষ নিজের বিছানাটা যে কতখানি আদর করে তৈরী করতে পারে সেটা দেখা বাকি ছিল জাগরীর। স্টেশনই যাঁর রাতের ঠিকানা সেরকম এক বৃদ্ধার রাতের বিছানা তৈরী হতে দেখল সে রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে।
বৃদ্ধা মাথা-পিঠ-কাঁধের বোঝা নামিয়ে নিলেন একে একে। তারপর নিজের কাঁধের শুশ্রূষা চলল কিছুক্ষণ কাঁধে হাত ঘষে ঘষে। জাগরীর বেঞ্চের পাশের জায়গাটা মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। খাবারের দোকানের ডাস্টবিনের থেকে একটু দূরে ব্যাগগুলোকে পাশাপাশি রাখলেন বৃদ্ধা। মাথা থেকে নামানো নাইলনের ভারী ব্যাগটা থেকে বেরোলো একটা বহুলব্যবহৃত প্লাস্টিকের শিট, আর একটি ছোটো কাপড়ের টুকরো। কাপড়ের টুকরোটি দিয়ে বেশ করে মেঝেটা ঝেড়েঝুড়ে প্লাস্টিকের শিটটি পেতে ফেললেন বৃদ্ধা। তারপর এদিক ওদিক থেকে টেনেটুনে টানটান করে ফেললেন তাকে। এইটুকু ঘটনা ঘটতে অন্তত মিনিট পাঁচ-সাত সময় লাগলো। প্রতিটি ঘটনা অতি যত্নে সম্পন্ন হচ্ছিল ধীরে ধীরে। তারপর কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখা কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোলো একটি মোটা চাদর গোছের জিনিস। পিটপিটে চোখে লক্ষ্য করলো জাগরী সেটিতেও বেশ ব্যবহারের ছাপ। চাদরটিকে বের করে প্রথমে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে ভাঁজ খুলে বেশ করে ঝেড়ে নিলেন বৃদ্ধা। তারপর ফিরে এসে প্লাস্টিকের শিটের ওপরে সুন্দর করে বিছিয়ে দিলেন। এবার হাতের পাতা বুলিয়ে বুলিয়ে চারিদিক থেকে সমান করছেন তিনি। এত যত্নে যে কেউ এই সামান্য বিছানা তৈরী করতে পারে তাই দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যাচ্ছিল জাগরী। সম্বিত ফিরলো মশার কামড়ে। ডানহাতের কনুই এর কাছে জব্বর কামড়েছে মশাটা। প্রতিবর্তে বাঁহাতটা দিয়ে চাপড় মেরেও লাভ হলো না। কনুই চুলকাতে চুলকাতে আবার নজর দিল জাগরী বৃদ্ধার রাত্রিকালীন সংসারের দিকে।
ততক্ষণে চাদর বিছানো শেষ হয়েছে তাঁর। এবার ব্যাগগুলোর দিকে নজর দিলেন বৃদ্ধা। প্রথমে পিঠ থেকে নামিয়ে রাখা বস্তাটাকে বিছানার মাথার দিক মানে খাবারের দোকানের দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিলেন। তার দুইপাশে বড় নাইলনের ব্যাগ আর কাপড়ের ব্যাগদুটোকে এমন ভাবে রাখা হলো যে একটা মাঝারি মাপের মাঝের দাঁড়িটা ছাড়া একটা ইংরাজির 'ই' তৈরী হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না জাগরীর। এতে করে তো বিছানার প্রায় অর্ধেক অংশই ভরে গেল ব্যাগ রেখে।শোবার জায়গা কই? তার চেয়ে ব্যাগগুলো মাথার কাছে সারি দিয়ে রাখলেই তো ভালো হত। দোকানের দেওয়াল থাকার জন্য নিরাপদও থাকত আর বেশ চওড়া শোবার জায়গাও পাওয়া যেত। নিজের মনেই হিসেব করছিল জাগরী। বৃদ্ধা ততক্ষণে চতুর্থ ছোটো ব্যাগটাকে 'দাঁড়ি ছাড়া ই' -এর ঠিক মাঝখানে সুন্দর করে জায়গা করে দিয়েছেন। জাগরী ভাবছিল এবার ঠিক কতটুকু জায়গায় সারারাতের জন্য শোবেন বৃদ্ধা? তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মৃৎশিল্পী প্রতিমার চোখে তুলির শেষ টান দিয়ে একটু পিছিয়ে এসে যেমন করে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন নিজের সৃষ্টির দিকে তেমনি করে বৃদ্ধা নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। সেই কয়েক সেকেন্ড জাগরীও বুঝি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল এই স্রষ্টার দিকে। ভাবছিল এতক্ষণে বুঝি সারাদিনের শেষে বিশ্রাম নেবার সময় এসেছে তাঁর।
কিন্তু না। ভারী নাইলনের ব্যাগটার চওড়া ফিতের ভার বহন করছিল বৃদ্ধার মাথার যে চাদরটি সেটি এতক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে। আর ঠিক যেমন করে ঘুমন্ত বাচ্চার নড়াচড়ায় তার গা থেকে ঢাকা খুলে গেলে আদর করে ঢেকে দেন মা তেমনি করেই সেই চাদর দিয়ে তিনি পরম মমতায় ঢেকে দিচ্ছেন তাঁর চারটি ব্যাগ। তারপর চললেন প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তের দিকে। কি ব্যাপার! অবাক হল জাগরী। এত যত্ন করে তৈরী করা শয্যা ফেলে এত রাতে চললেন কোথায়? তার যাওয়ার পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল জাগরী। তখনি সে সচকিত হলো তার ট্রেনের ঘোষণায়। আগের তিন চারটি ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ায় এতক্ষণে তার ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। চটপট ইলেকট্রনিক বোর্ডে তাদের কামরার সম্ভব্য অবস্থান দেখে নিলো জাগরী। কুলিদেরকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক জায়গাতেই বসেছে তারা। তার বেঞ্চের থেকে দশ-বারো পা ডানদিকে এগোলেই বি-সিক্স কোচ এর বোর্ড জ্বলজ্বল করছে। ঠিক আছে, ট্রেন ঢুকতে এখনো মিনিট দশেক দেরী আছে। বসেই থাকে জাগরী। একবার চাদরে ঢাকা পরিপাটি বিছানা আর ব্যাগগুলিকে দেখল সে। তখনি মনে হলো বৃদ্ধা গেলেন কোথায়? বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্লান্ত পায়ে ফিরছেন বৃদ্ধা। হাতে কি? ভালো করে ঠাহর করতে করতেই বৃদ্ধা তার সামনে দিয়ে নিজের বিছানার কাছে পৌঁছে গেছেন। হাতে তাঁর কয়েকটা ভাঁজ করা মোটা কাগজের কার্টন। স্টেশন চত্ত্বরের ফলের দোকান-টোকানের হবে। কৌতুহলী হলো জাগরী। এটা কি হবে? বিছানার ঢাকা সরিয়ে বস্তাটির মুখ খুললেন বৃদ্ধা। তারপর কার্টনগুলোকে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে সাইজ অনুযায়ী থাক দিয়ে গুছিয়ে নিলেন তিনি। জাগরীর মনে পড়ল ছোটোবেলায় সে ঠিক এই ভাবেই নিজের হেপাজতের কয়েকটা বই সাইজ অনুযায়ী নিচ থেকে ওপরে গুছিয়ে রাখত সে। বর্ণপরিচয় আকারে সবার চেয়ে ছোটো তাই সেটা সবচেয়ে ওপরে আর পৃথিবীর মানচিত্র বইটা আকারে আয়তনে সবচেয়ে বড় তাই সেটা সবচেয়ে নিচে। আর মাঝখানে বাংলা-ইংরাজি ছড়ার বই, ছোটদের রামায়ণ, ছবিতে ইতিহাস, মনিষীদের ছেলেবেলা ইত্যাদি আরো যা যা সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এবং দৈনিক পাঠ্য বই বলে তার সেই চার পাঁচ বছর বয়সে মনে হত সেগুলোকে তার অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ঠিক এরকম ভাবেই গুছিয়ে রাখত সে। তার মা-ই তাকে এই অভ্যাসটি তৈরী করে দিয়েছিলেন। অনেক পুরনো দিনের সেই স্মৃতিটি ফিরে এলো তার সেই এই বৃদ্ধার কাগজের কার্টনের টুকরো গোছানো দেখে। বৃদ্ধা এইবার বস্তার মধ্যে সেই টুকরোগুলো কে ঢোকাতে থাকেন। বস্তার ভেতরে শুধুই এরকম কার্টনের টুকরোতে ভর্তি। কি হবে ওগুলি দিয়ে? জ্বালানি? চারটি ব্যাগে যিনি পুরো সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়ান তাঁর কি জ্বালানির প্রয়োজন আদৌ হয় কখনো? মনে তো হয় না। স্টেশনই যে তাঁর ঘরবাড়ি সে বিষয়ে অন্তত আশিভাগ নিশ্চিত জাগরী। তাহলে কি বিক্রি? কিন্তু ছেঁড়া টুকরো কারা কেনে? এ বিষয়ে আর বিশেষ গবেষণা করতে পারল না জাগরী। কারণ টুকরোগুলি বস্তায় ঢুকিয়ে, বস্তার মুখ বেঁধে, নিজের পায়ের জুতোটিকে কাপড়ের ব্যাগের তলায় চালান করে, সবচেয়ে ছোট ব্যাগটিকে কোলে করে বাকি দুটি ব্যাগ আর বস্তা দিয়ে তৈরী করা 'দাঁড়ি ছাড়া ইংরাজির ই'-এর খোঁদলে ঢুকে গেছেন ততক্ষণে বৃদ্ধা। আর জাগরীর দলের বাকি সকলেও হাতে পিঠে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা তাকেও ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ডিজিটাল বোর্ডে 'বি-সিক্স' লেখাটির তলায়। আর ঠিক তখনিই জাগরীর চোখে পড়ে ঘটনাটা।
দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়া শেষ করে কখন যেন রেলের সাফাইকর্মীর দলটি এই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে এসেছে। তাদের হুইসিল আর লম্বা লাঠির ঠেলায় দূরের দিকে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সারি সারি মানুষের দল ঘুমচোখে ধড়মড়িয়ে নিজেদের সম্বলটুকু সামলে উঠে পড়ছে জায়গা ছেড়ে। পিঠের ব্যাগ আর জলের বোতল সামলে চট করে পিছন ঘুরে বৃদ্ধার দিকে তাকায় জাগরী। ছোটো চাদরটা গায়ে টেনে গুটলী পাকিয়ে এতক্ষণে স্বস্তিতে শুয়ে পড়েছেন তিনি সারারাতের নিশ্চিন্ততায়। জাগরী আবার তাকায় সাফাই কর্মীদলটির দিকে। দানবীয় হোসপাইপ, বড় বড় ওয়াইপার, বড় লাঠির ডগায় বাঁধা ঝাঁটা আর হুইসিল নিয়ে ছয় আট জনের দলটি যেন দস্যুদলের মতই হামলা চালিয়েছে শুয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে। ক্রমশই এগিয়ে আসছে এইদিকে হোসপাইপে জল ছেটাতে ছেটাতে। এদিকে তার ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে আস্তে আস্তে। কয়েকসেকেন্ড ট্রেনের আগমন আর সাফাইকর্মীর দলটির ওপর চোখ বুলিয়ে ফের পেছনে তাকালো জাগরী। এতক্ষণে হুইসিলের আওয়াজ কানে গেছে বৃদ্ধার। উঠে পড়েছেন তিনি। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এবং অবিশ্বাস্য মনোসংযোগে একে একে ভাঁজ করছেন চাদর, প্লাস্টিক শিট। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেসব যেখান থেকে বেরিয়েছিল সেখানে আবার ঢুকে গেল। নিজের চোখে দেখেও জাগরীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পাতার সময় কত মমতায়, কত যত্ন নিয়ে, কত সময় নিয়ে এই বিছানাটি পেতেছিলেন বৃদ্ধা। কয়েক মুহুর্তেই সমস্ত কিছুর উল্টো চলচ্চিত্র অনুষ্ঠিত হতে দেখল জাগরী। ফের পিঠে বস্তা, মাথায় ভাঁজ করা চাদর, সেখান থেকে নাইলনের ফিতে দিয়ে ঝুলিয়ে নেওয়া হলো ভারী নাইলনের ব্যাগটা, কাঁধে উঠে গেল কাপড়ের ব্যাগটা, তার গর্ভে এখন চালান হয়েছে পেতে রাখা মোটা চাদরটা আর প্লাস্টিকের শিট, মাথায় ছোটো ব্যাগ।
জাগরীদের ট্রেন ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে থেমেছে। সকলের সাথে ট্রেনের দরজা দিয়ে ওঠবার সময় দেখল সে বৃদ্ধা বিড়বিড় করতে করতে হাঁটা লাগিয়েছেন তার পাশ দিয়েই। ট্রেনের থামতে যাত্রীদের কথাবার্তায় তাঁর বিড়বিড়ানি আর কান অবধি পৌঁছালো না জাগরীর। ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট সিটের দিকে যেতে গিয়ে এসি কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে চোখে পড়লো তাদের বসে থাকার জায়গার চারপাশটা জলে জলময়। বড় বড় ওয়াইপার চলছে সেখানে। শুধু নির্দিষ্ট সিটে পৌঁছে ব্যাগ ঠিকঠাক করে রেখে তার কাঙ্খিত আপার বার্থে উঠে বিছানা পেতে কম্বল গায়ে টেনে শুতে গিয়ে অনুভব করলো জাগরী তার ক্লান্তিটা কি করে যেন বেমালুম উবে গেছে। ঘুমের লেশমাত্র নেই তার একটু আগে পর্যন্ত ঢুলে আসা চোখে। কব্জির ঘড়িতে তখন রাত ঠিক একটা।
ততক্ষণে চাদর বিছানো শেষ হয়েছে তাঁর। এবার ব্যাগগুলোর দিকে নজর দিলেন বৃদ্ধা। প্রথমে পিঠ থেকে নামিয়ে রাখা বস্তাটাকে বিছানার মাথার দিক মানে খাবারের দোকানের দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিলেন। তার দুইপাশে বড় নাইলনের ব্যাগ আর কাপড়ের ব্যাগদুটোকে এমন ভাবে রাখা হলো যে একটা মাঝারি মাপের মাঝের দাঁড়িটা ছাড়া একটা ইংরাজির 'ই' তৈরী হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না জাগরীর। এতে করে তো বিছানার প্রায় অর্ধেক অংশই ভরে গেল ব্যাগ রেখে।শোবার জায়গা কই? তার চেয়ে ব্যাগগুলো মাথার কাছে সারি দিয়ে রাখলেই তো ভালো হত। দোকানের দেওয়াল থাকার জন্য নিরাপদও থাকত আর বেশ চওড়া শোবার জায়গাও পাওয়া যেত। নিজের মনেই হিসেব করছিল জাগরী। বৃদ্ধা ততক্ষণে চতুর্থ ছোটো ব্যাগটাকে 'দাঁড়ি ছাড়া ই' -এর ঠিক মাঝখানে সুন্দর করে জায়গা করে দিয়েছেন। জাগরী ভাবছিল এবার ঠিক কতটুকু জায়গায় সারারাতের জন্য শোবেন বৃদ্ধা? তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মৃৎশিল্পী প্রতিমার চোখে তুলির শেষ টান দিয়ে একটু পিছিয়ে এসে যেমন করে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন নিজের সৃষ্টির দিকে তেমনি করে বৃদ্ধা নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। সেই কয়েক সেকেন্ড জাগরীও বুঝি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল এই স্রষ্টার দিকে। ভাবছিল এতক্ষণে বুঝি সারাদিনের শেষে বিশ্রাম নেবার সময় এসেছে তাঁর।
কিন্তু না। ভারী নাইলনের ব্যাগটার চওড়া ফিতের ভার বহন করছিল বৃদ্ধার মাথার যে চাদরটি সেটি এতক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে। আর ঠিক যেমন করে ঘুমন্ত বাচ্চার নড়াচড়ায় তার গা থেকে ঢাকা খুলে গেলে আদর করে ঢেকে দেন মা তেমনি করেই সেই চাদর দিয়ে তিনি পরম মমতায় ঢেকে দিচ্ছেন তাঁর চারটি ব্যাগ। তারপর চললেন প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তের দিকে। কি ব্যাপার! অবাক হল জাগরী। এত যত্ন করে তৈরী করা শয্যা ফেলে এত রাতে চললেন কোথায়? তার যাওয়ার পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল জাগরী। তখনি সে সচকিত হলো তার ট্রেনের ঘোষণায়। আগের তিন চারটি ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ায় এতক্ষণে তার ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। চটপট ইলেকট্রনিক বোর্ডে তাদের কামরার সম্ভব্য অবস্থান দেখে নিলো জাগরী। কুলিদেরকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক জায়গাতেই বসেছে তারা। তার বেঞ্চের থেকে দশ-বারো পা ডানদিকে এগোলেই বি-সিক্স কোচ এর বোর্ড জ্বলজ্বল করছে। ঠিক আছে, ট্রেন ঢুকতে এখনো মিনিট দশেক দেরী আছে। বসেই থাকে জাগরী। একবার চাদরে ঢাকা পরিপাটি বিছানা আর ব্যাগগুলিকে দেখল সে। তখনি মনে হলো বৃদ্ধা গেলেন কোথায়? বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্লান্ত পায়ে ফিরছেন বৃদ্ধা। হাতে কি? ভালো করে ঠাহর করতে করতেই বৃদ্ধা তার সামনে দিয়ে নিজের বিছানার কাছে পৌঁছে গেছেন। হাতে তাঁর কয়েকটা ভাঁজ করা মোটা কাগজের কার্টন। স্টেশন চত্ত্বরের ফলের দোকান-টোকানের হবে। কৌতুহলী হলো জাগরী। এটা কি হবে? বিছানার ঢাকা সরিয়ে বস্তাটির মুখ খুললেন বৃদ্ধা। তারপর কার্টনগুলোকে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে সাইজ অনুযায়ী থাক দিয়ে গুছিয়ে নিলেন তিনি। জাগরীর মনে পড়ল ছোটোবেলায় সে ঠিক এই ভাবেই নিজের হেপাজতের কয়েকটা বই সাইজ অনুযায়ী নিচ থেকে ওপরে গুছিয়ে রাখত সে। বর্ণপরিচয় আকারে সবার চেয়ে ছোটো তাই সেটা সবচেয়ে ওপরে আর পৃথিবীর মানচিত্র বইটা আকারে আয়তনে সবচেয়ে বড় তাই সেটা সবচেয়ে নিচে। আর মাঝখানে বাংলা-ইংরাজি ছড়ার বই, ছোটদের রামায়ণ, ছবিতে ইতিহাস, মনিষীদের ছেলেবেলা ইত্যাদি আরো যা যা সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এবং দৈনিক পাঠ্য বই বলে তার সেই চার পাঁচ বছর বয়সে মনে হত সেগুলোকে তার অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ঠিক এরকম ভাবেই গুছিয়ে রাখত সে। তার মা-ই তাকে এই অভ্যাসটি তৈরী করে দিয়েছিলেন। অনেক পুরনো দিনের সেই স্মৃতিটি ফিরে এলো তার সেই এই বৃদ্ধার কাগজের কার্টনের টুকরো গোছানো দেখে। বৃদ্ধা এইবার বস্তার মধ্যে সেই টুকরোগুলো কে ঢোকাতে থাকেন। বস্তার ভেতরে শুধুই এরকম কার্টনের টুকরোতে ভর্তি। কি হবে ওগুলি দিয়ে? জ্বালানি? চারটি ব্যাগে যিনি পুরো সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়ান তাঁর কি জ্বালানির প্রয়োজন আদৌ হয় কখনো? মনে তো হয় না। স্টেশনই যে তাঁর ঘরবাড়ি সে বিষয়ে অন্তত আশিভাগ নিশ্চিত জাগরী। তাহলে কি বিক্রি? কিন্তু ছেঁড়া টুকরো কারা কেনে? এ বিষয়ে আর বিশেষ গবেষণা করতে পারল না জাগরী। কারণ টুকরোগুলি বস্তায় ঢুকিয়ে, বস্তার মুখ বেঁধে, নিজের পায়ের জুতোটিকে কাপড়ের ব্যাগের তলায় চালান করে, সবচেয়ে ছোট ব্যাগটিকে কোলে করে বাকি দুটি ব্যাগ আর বস্তা দিয়ে তৈরী করা 'দাঁড়ি ছাড়া ইংরাজির ই'-এর খোঁদলে ঢুকে গেছেন ততক্ষণে বৃদ্ধা। আর জাগরীর দলের বাকি সকলেও হাতে পিঠে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা তাকেও ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ডিজিটাল বোর্ডে 'বি-সিক্স' লেখাটির তলায়। আর ঠিক তখনিই জাগরীর চোখে পড়ে ঘটনাটা।
দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়া শেষ করে কখন যেন রেলের সাফাইকর্মীর দলটি এই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে এসেছে। তাদের হুইসিল আর লম্বা লাঠির ঠেলায় দূরের দিকে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সারি সারি মানুষের দল ঘুমচোখে ধড়মড়িয়ে নিজেদের সম্বলটুকু সামলে উঠে পড়ছে জায়গা ছেড়ে। পিঠের ব্যাগ আর জলের বোতল সামলে চট করে পিছন ঘুরে বৃদ্ধার দিকে তাকায় জাগরী। ছোটো চাদরটা গায়ে টেনে গুটলী পাকিয়ে এতক্ষণে স্বস্তিতে শুয়ে পড়েছেন তিনি সারারাতের নিশ্চিন্ততায়। জাগরী আবার তাকায় সাফাই কর্মীদলটির দিকে। দানবীয় হোসপাইপ, বড় বড় ওয়াইপার, বড় লাঠির ডগায় বাঁধা ঝাঁটা আর হুইসিল নিয়ে ছয় আট জনের দলটি যেন দস্যুদলের মতই হামলা চালিয়েছে শুয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে। ক্রমশই এগিয়ে আসছে এইদিকে হোসপাইপে জল ছেটাতে ছেটাতে। এদিকে তার ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে আস্তে আস্তে। কয়েকসেকেন্ড ট্রেনের আগমন আর সাফাইকর্মীর দলটির ওপর চোখ বুলিয়ে ফের পেছনে তাকালো জাগরী। এতক্ষণে হুইসিলের আওয়াজ কানে গেছে বৃদ্ধার। উঠে পড়েছেন তিনি। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এবং অবিশ্বাস্য মনোসংযোগে একে একে ভাঁজ করছেন চাদর, প্লাস্টিক শিট। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেসব যেখান থেকে বেরিয়েছিল সেখানে আবার ঢুকে গেল। নিজের চোখে দেখেও জাগরীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পাতার সময় কত মমতায়, কত যত্ন নিয়ে, কত সময় নিয়ে এই বিছানাটি পেতেছিলেন বৃদ্ধা। কয়েক মুহুর্তেই সমস্ত কিছুর উল্টো চলচ্চিত্র অনুষ্ঠিত হতে দেখল জাগরী। ফের পিঠে বস্তা, মাথায় ভাঁজ করা চাদর, সেখান থেকে নাইলনের ফিতে দিয়ে ঝুলিয়ে নেওয়া হলো ভারী নাইলনের ব্যাগটা, কাঁধে উঠে গেল কাপড়ের ব্যাগটা, তার গর্ভে এখন চালান হয়েছে পেতে রাখা মোটা চাদরটা আর প্লাস্টিকের শিট, মাথায় ছোটো ব্যাগ।
জাগরীদের ট্রেন ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে থেমেছে। সকলের সাথে ট্রেনের দরজা দিয়ে ওঠবার সময় দেখল সে বৃদ্ধা বিড়বিড় করতে করতে হাঁটা লাগিয়েছেন তার পাশ দিয়েই। ট্রেনের থামতে যাত্রীদের কথাবার্তায় তাঁর বিড়বিড়ানি আর কান অবধি পৌঁছালো না জাগরীর। ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট সিটের দিকে যেতে গিয়ে এসি কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে চোখে পড়লো তাদের বসে থাকার জায়গার চারপাশটা জলে জলময়। বড় বড় ওয়াইপার চলছে সেখানে। শুধু নির্দিষ্ট সিটে পৌঁছে ব্যাগ ঠিকঠাক করে রেখে তার কাঙ্খিত আপার বার্থে উঠে বিছানা পেতে কম্বল গায়ে টেনে শুতে গিয়ে অনুভব করলো জাগরী তার ক্লান্তিটা কি করে যেন বেমালুম উবে গেছে। ঘুমের লেশমাত্র নেই তার একটু আগে পর্যন্ত ঢুলে আসা চোখে। কব্জির ঘড়িতে তখন রাত ঠিক একটা।
(শেষ)
Bah besh bhalo likhechis golpota...
ReplyDeleteEta sotti sotti ghotechilo aneekda. Haridwar stn e. Tomar bhalo legeche pore, eta jene khub bhalo lagche.
Delete