"সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে"
অহংকার কথাটা বেজায় গোলমেলে। না থাকলে কাজকর্ম পন্ড। আবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়ে গেলেই গন্ডগোল। উপনিষদ রচয়িতারা বলছেন অহং পঞ্চকোষের অংশমাত্র। আমি নই। আবার জড়জগতে কাজকর্ম চালাতে গেলে এই অহং বা বাইরের আমিটি না থাকলে চলে না। যেই বাইরের কাজ ফুরায় অমনি এই বাইরের আমিটিকে তখনকার মতন ঝেড়েঝুড়ে, পাট করে দেরাজে তুলে রেখে আসল আমিটিকে খুঁজতে ডুব দিতে হয় ভিতরপানে। উপনিষদ রচয়িতা ঋষিরা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথও বলেছেন তাঁর গানে, বিবেকানন্দ বলেছেন তাঁর অজস্র বক্তৃতায়, বর্তমানে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরাও বলছেন। আবার নব্যযুগের কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট বা কসমোলোজিস্টরাও তেমনই কিছু একটা বলবো বলবো করছেন। উপনিষদ যাকে 'আমি' বলেছেন, 'ব্রহ্ম' বলেছেন, চৈতন্য বা চেতনা বলেছেন, আজকের কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট বা কসমোলোজিস্টরা তাকেই 'Consciousness' বা 'Qualia' বলছেন। এতদিন পর্যন্ত অধিকাংশ পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকরা consciousness যে মস্তিস্কপ্রসূত একটি অলীক 'বস্তু'-এই বলে গলা ফাটাতেন, তাঁদেরই কিছু জন ধীরে ধীরে এতদিনের প্রাচ্যের বলা কথার সারবত্তা বুঝেছেন। বলছেন, যেহেতু Qualia বা Consciousness ফার্স্ট পার্সন এক্সপেরিয়েন্স তৈরী করে, সেহেতু সেটি বস্তু বা জড়জগতের অংশ হতে পারে না বা বস্তুজগৎ থেকে উৎপন্নও হতে পারে না। এবং সেই একই কারণে মস্তিস্ক দ্বারা উৎপন্নও হতে পারে না। বাহিরের যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে ধরা তো যায়ই না। মন, মস্তিক এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা এটি প্রকাশিত হয় মাত্র। অর্থাৎ সেই বাইরের আমির বোধটুকু তৈরী করে মাত্র। শরীর মরে ক্ষয়ে, মন মরে নিজের জ্বালায়। যা কিছু ঝড়-ঝাপ্টা সবই ওই বাইরের আমির। আসল আমিটি দিব্য মজায় থাকে। Untouched .
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'সুন্দর', রামকৃষ্ণ বলেছেন 'চৈতন্য', বেদান্ত বলেছেন 'ব্রহ্ম'। আবার শিব, কালী বা কৃষ্ণ ভক্ত বলেছেন 'শিব', 'কালী', বা 'কৃষ্ণ'। এখন এই আদত আমিটি নতুন নাম পেয়েছে। Qualia বা Consciousness. যা আমাকে আমি বলে বোধ করাচ্ছে। নামে কী যায় আসে! আসল কথাটি হলো মনে ভার নেমে যাওয়া। এই যে দিন-দুবেলা সে কেন আমার সাথে এমন ভাবে কথা কইলো? ও কেন এমন দেখনদারী করলে? ও কেন আমায় যার পর নাই সম্মান করলে না। ইত্যাদি আর যা কিছু হাবিজাবির ভার বয়ে বয়ে মনে ব্যাথা হলো, উত্তেজনায় রক্তচাপ বেড়ে শরীর ক্ষয় হলো, সেসব বেশ নামিয়ে রেখে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে এই বা কম কী? যদিও তুমি, আমি, বাকি সকলে আদতে একই- এসব কথাও বড়রা বলেন, তবুও নয় সেসব এখনকার জন্য বাদই রাখলাম।
এই সেদিন একজায়গায় দেখলাম বড়বড় হরফে লেখা রয়েছে "Relax! Enjoy the show!" এইটি তারপর থেকে বড় মনে ধরেছে। মনে পড়লেই বেশ গায়ে এক খাবলা সর্ষের তেল মেখে নাইতে নেমেছি এমন একটা অনুভব হয়। তুমি আমার ওপর চেঁচাবে? চেঁচাও। মনে লাগবে, কিন্তু আসল আমিটিকে তুমিতো ছুঁতে পারলে না! তেল ভেদ করে গায়ে লাগলে তবে তো! মনের ওপরের জল চোখের জলের গামছায় মুছে নিলেই হলো। বাইরের 'আমি'র শান্তি। "সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।"
এই যে দিনে-দুপুরে-সন্ধ্যায়-রাত্তিরে বাইরের এই আমিটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করার এত আয়োজন, পান থেকে চুন খসলেই হয় চোখের জল নয় মনের ঝাল, একদিন তো তার প্রয়োজন ফুরোবেই। তখন যে বাহির ফেলে ভেতরে ঢুকতে হবেই। তখন কী আর তোমার আমার পার্থক্য থাকবে? আজ যাকে দেখে আড়ালে রসিকতা করে আনন্দ পাচ্ছো, আজ যার অনিচ্ছাকৃত ভুলে সমালোচনার অশ্বমেধ ছোটাচ্ছো, আজ যাকে ঠিক নিজের মতোই নয় বলে দূরে ঠেলে রাখছো, সেদিন তার আর তোমার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাবে তো? নিজেই নিজেকে অপমান করার লজ্জা সেদিন তোমায় রাঙিয়ে দেবে না তো? সেই যে, "নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান।"
তার চেয়ে বরং এই ভালো।এই যে প্রতিদিন 'বেঁচে থাকা'র মতন দুর্দান্ত একখান অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেটিকে তো সাপ্টে উপভোগ করতে হবে নাকি? কে বলতে পারে কাল সকালে চা খাবার সৌভাগ্য হয় কি না হয়! সুতরাং, নতুন বছরে " Relax, enjoy the show". Happy তো এমনিই হয়ে যাবে বছরটা।