সাতসকালে কড়ে
আঙ্গুলের আকারের দেড়খানি কলা, দড়কচা মার্কা ছিল বলে অর্ধেকটা ফেলে দিতে হল, আর সাথে
দুটি ঘসঘসে বিস্কুট আর চা। তারপর থেকে এই যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, খাবার কথা
কারো মনেই নেই যেন। একা খাবার কথা ছিল না আজকে। সুতরাং অপেক্ষা করতেই হয়। খিদের জ্বালায় দু
কুঁচি শশা, গাজর চিবিয়েছি ছাগলের মত। সেসব আবার খিদের সময় অনুঘটকের কাজ করে। পেটের
ভেতর ইল্বল, বাতাপি একসঙ্গে ভীমপলশ্রীর আরোহণ সেই যে শুরু করেছে তার আর অবরোহণের নামটি
নাই। ইচ্ছে করে দুবাক্স খাবার একাই খেয়ে ফেলি। কিন্তু সেসব তো আর করা যায় না। পেটে
কিল মেরে রোদ খাচ্ছি তাই। এমন শীতের রোদ্দুর! এমন সময় চাট্টি গরম ফুরফুরে ভাত আর পোস্তর
বড়া একখানা পাওয়া গেলে, আহা রে! এই বড়া বলতে মনে পড়লো, একজনের কি যেন একটা ভাল দিনে
সাথে থেকেছিলুম বলে সে বেজায় উদার হয়ে বলেছিল, “কি খাবি বল খাওয়াব।“ তা আমি বাঙালি
ভোজনপটীয়সী নোলা সামলে বললুম “কদ্দিন বড়ার ঝাল খাইনি।“ এ বড়া অবশ্য বড়োলোক পোস্তর বড়া
নয়। নেহাতই ডালের বড়ার ঝাল। এ জিনিস আমি শয়নে-স্বপনে- জাগরণে সর্বদাই খেতে পারি। করে
খাওয়ানোর লোক পাওয়া ইদানিং দুস্কর বলে মাঝে মধ্যে বিরহ অসহ্য হলে নিজেই নিজের জন্য
বানিয়ে খাই। তা এমন উদার “কি খাবি বল?” আবাহন শুনে স্বাভাবিক ভাবেই বড়ার ঝাল ছাড়া আর
কিই বা মনে আসে! তা সে নাকি আমায় ছুটির দিনে সে জিনিস বানিয়ে খাওয়াবে বলেছিল। তারপর
অবশ্য দু-দুটো ছুটির দিন কেটে গেছে। আমার বড়া এখন ডালের কৌটোর ভেতরেই বিরাজ করছে। যাক গে, পেলে ভালো নইলে বানিয়েই নেবো। এসবে কি আর আমি ডরাই, সখি!
এই যে, বসে বসে খটমট করে টাইপ করতে করতে কটা মনের কথা কইছি, তাতেও মাঝে মধ্যে শীতের খাবার-দাবারের কথা মনে করে প্রাণটা হু হু করে উঠছে। বাড়ি গেলে ঘরে-বাইরে কতই না খাবারের অনুসঙ্গ। এই মনে কর, সকালে ডাইজেস্টিভ বিস্কুট আর চা এর বদলে সাদা সাদা ফুলকো লুচি আর ঝাল-ঝাল আলুর তরকারি, মটরশুঁটি আর ধনেপাতার অলংকারসহ। তারপর মনে কর, তার সঙ্গে যদি একখানি পন্ডিতের দোকানের নলেন গুড়ের রসগোল্লা জুটেই যায়, তাহলে তো! যাক যে যাক, এসব মনে করে বড় বড় শ্বাস বের হয়ে আসছে। কদিন ধরে পিঠে আর পাটিসাপ্টার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে প্রায় লোকজনের মনে সন্দেহই ঢুকিয়ে দিচ্ছিলুম যে নির্ঘাত এ ব্যাটার কোভিড হয়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সেদিন আর থাকতে না পেরে নিজেই কটা রেসিপি ইত্যাদি দেখে পাটিসাপ্টা বানাতে গেলুম। ভেতরের পুরটা আদতে ক্ষীরের হবার কথা। কিন্তু অত করার ধৈর্য্য থাকলে তো হয়েই যেত! এমনই মরিয়া দশা যে ফ্রিজে দুধের বোতল নেই দেখে সেটা আর দোকান থেকে আনার পর্যন্ত তর সইলো না। কফির জন্যে রাখা কফিমেটের কৌটোটা হাতে পেয়েই- 'জয়তারা, এইটাই গুলে ঢেলে দেব', বলে কানে মহাভারত গুঁজে শুরু করে দিলুম। নারকেলের গুঁড়ো, ফ্রিজে থেকে থেকে প্রায় জীবাশ্ম পর্যায়ে চলে যাওয়া একখাবলা গুড় আর খানিকটা কফিমেটের গুঁড়ো মিশিয়ে একখানা মিষ্টি মণ্ড তৈরী হলো। যেটা দেখিয়ে- এই দেখ 'পাটিসাপ্টার পুর' বললে আমার মা কেন, আমার গোপালনগরের বাড়ির বেড়ালটাও হাসবে। একবার মনে হলো যাক যা হয়েছে হয়েছে। একে নিয়ে আর উচ্চাশা করে লাভ নেই। এইটাই নাড়ুর মত পাকিয়ে খেয়ে নিই বরং। কিন্তু কানের ভেতর দিয়ে ততক্ষণে গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে অরণি, উপমন্যু আর বেদ এর পরম অধ্যবসায় আর শত প্রলোভনেও লক্ষ্যে স্থির থাকার কাহিনী। আমিও পূর্বপুরুষদের সেসব সুকীর্তির কথা শুনে সেই কুক্ষনেই ভুল করে লক্ষ্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললুম। যতক্ষণে বুঝতে পারলুম যে ভুলটা করেই ফেলেছি ততক্ষনে দেখি হাতে চালের গুঁড়ো, ময়দা-টয়দা আর ভগবান জানেন কি কি মিশিয়ে একটা ট্যালট্যালে গোলার বাটি হাতে মুখ ভেটকে দাঁড়িয়ে আছি। ইয়ারফোনে শুনি মহাভারতের ব্যাখ্যাকার বলছেন-'অনুশোচনা রাখবে না, কাজের ভালো মন্দ কিছু হয় না। কাজ কাজই।' মহাভারতেরই কোনো উপকাহিনীর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমি মাঝখানে কিছুক্ষন শুনিনি বোধহয়। তাল পাচ্ছিনা। এরপরেও ফেঁদে বসা কাজ শেষ না করলে মহাভারত রচয়িতা ঠিক পাপ দেবেন। "জয় বেদব্যাস" বলে একহাতা ওই ট্যালট্যালে বস্তুটি ফ্রাইং প্যানে ঢেলে দিয়ে আর এক হাত দিয়ে জিমন্যাস্টিকের স্টাইলে তাকে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখি সে ব্যাটা প্যানের গায়ে সেঁটে গেছে। তাকে নাড়াতে না পেরে আর এক হাতা। তারপর আরো একহাতা। এই করে যতক্ষণে ব্যাপারটা পুরো প্যানে ছড়ালো ততক্ষনে সেটা আর পাটিসাপ্টার পাতলা ফুরফুরে খোল নয়, মোটা কাঁথার মতো ধুসকো একটা কি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপর আর কি? সেই কাঁথার মধ্যে নারকেল গুঁড়ো, প্রাগৈতিহাসিক গুড় আর কফিমেটের মন্ডটা যত্ন করে শুইয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়ে বাক্সে তুলে দিলুম। যতই হোক, সুচিন্তা নিয়ে শুরু করা কাজ যত্ন করে শেষ করতে হয়। তার পরিণতির কথা না ভেবেই। মহাভারতে বলা আছে।
এই সেই কাঁথায় মোড়া নারকেলের মন্ড |